কবর-৭৯-৮০ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২৩ জানুয়ারি, ২০১৭, ১১:২০:২৯ সকাল
বিকেল, ২৮ জুলাই। বৃদ্ধ টিটি একজন পরিচ্ছন্ন কর্মি নিয়ে এসে বলল, ‘একে টেনে তুল’। কর্মিটা হাসানের মাথা ধরে ঝাকাতে লাগল, ‘এই পাগলা উঠ’। বৃদ্ধ ধমকে উঠলেন, ‘পাগল ডেকো না, ও পাগল নয়’। কয়েক ঝাকির পর হাসান জাগ্রত হল এবং ধড়ফড় করে উঠে মেয়ের দিকে হাত বাড়াল। বৃদ্ধ বললেন, ‘বাবাজি ট্রেন ছাড়ার সময় হয়েছে, ট্রেনে উঠেন’। কর্মিটাকে বলল, ‘তুমি বাচ্চাটা তুলে দাও’ সে মেয়েকে নিয়ে গেল। হাসান কারো সাহায্য ছাড়া নিজেই উঠল, আজ সে গায়ে কিছুটা শক্তি পাচ্ছে। ট্রেনে উঠে সে কাঁথাটা ভাল করে গায়ে পেছাল। তারপর মেয়েকে কোলে নিয়ে টয়লেটের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসল। বৃদ্ধ টিটি বলল, ‘আপনি এখানেই বসে থাকেন, ময়মনসিংহ গিয়ে আমি আপনাকে নামিয়ে দিব’।
আধা ঘণ্টা পর ট্রেন ছাড়ল। লোকজনের তেমন ভিড় নেই। গাড়ি সাপের মত হেলে দুলে চলতে লাগল। সেই সাথে হাসানও দু’দিকে দুলতে লাগল, দুলতে দুলতে এক সময় সে ঘুমিয়ে পড়ল। আর তার কোলে বাচ্চাটাও ঘুমিয়ে পড়ল। গাড়ি বিভিন্ন ষ্টেশনে থামছে, লোকজন উঠছে, আর একটা পাগল বারবার যাত্রীদের পায়ের তলায় পিষ্ট হচ্ছে। অবশেষে গাড়ি এসে প্রতিক্ষিত ময়মনসিংহ থামল। বৃদ্ধ টিটি একজন কুলি নিয়ে এসে বললেন, ‘ওকে তুলে নামিয়ে দাও। কুলি হাসানের মাথায় হাত দিয়ে ধাক্কা দিল হাসান জাগ্রত হল, তারপর চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, ‘এটা কোন জায়গা, ময়মনসিংহ? কুলি বলল, ‘হ্যাঁ ময়মনসিংহ’। সে মেয়েকে নিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। বৃদ্ধ কুলিকে বলল, ‘তুমি বাচ্চাটাকে নামাও। কুলি বাচ্চাকে নিয়ে নেমে গেল। হাসান একা একাই নামল, আজ তার গায়ে শক্তি পাচ্ছে। হয়ত সে সুস্থ হয়ে উঠেছে অথবা নিবন্ত প্রদীপের শেষ ঝলক।
সে নীচে গিয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে দুই পা হাঁটল, বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ তার মনে হতেই পিছন ফিরে তাকিয়ে বলল, ‘চাচা, আল্লাহ্ আপনাকে এই উপকারের প্রতিদান দিবেন’। বৃদ্ধ কৃতজ্ঞতায় নির্মিলিত চোখে করুণার সুরে বলল, ‘যান, আপনার মায়ের কাছে যান’। আর তখনই হাসানের পাশ দিয়ে বিশ পঁচিশ বছরের দু’টি ছেলে ধেয়ে এসে ট্রেনে উঠল। তাড়াতাড়ির কারণে তারা পাগলটার দিকে ফিরে তাকায়নি বা তাকানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস। ছেলে দু’টির একটি হাসানের ছোট ভাই অন্যটা মামাত ভাই। তারা হাসানের খোজে জামালপুর যাচ্ছে। গতকাল একদল গিয়েছে কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছে, আজ তারা যাচ্ছে। আর হাসানের অবস্থা তো হল কোন কিছু লক্ষ করা বা দেখার মত মানসিক চেতনা ও অনুভূতি তার মধ্যে ছিল না। এখন তার মধ্যে শুধু একটা হুসই আছে, যে করেই হউক তাড়াতাড়ি বাড়িতে পৌছতে হবে। মেয়েটা ইতিমধ্যেই হাত পা ও ঘাড় ছেড়ে দিয়েছে। শীঘ্র বাড়িতে পৌছতে না পারলে মেয়েকে বাঁচানো যাবে না।
সে বাইরে গিয়ে রিকশায় উঠে ব্রীজে যেতে চাইল, সেখানে গিয়ে বাসে চড়তে হবে, কিন্তু পাগলকে কেউ রিকশায় উঠাতে রাজি নয়। এছাড়া তার কাঁথায় কফ, কাশ ও রক্ত লেগে আছে। ঘৃণায় রিকশা ওয়ালারা নাক সিটকায়। হাসান পকেট থেকে একটা বড় নোট বের করে এক রিকশাওয়ালার সামনে ধরে বলল, ‘ভাই আমাকে একটু ব্রীজে দিয়ে আস। রিকশাওয়ালার চোখ চকচক করে উঠল। সে বুঝল পাগল, তাই আগে টাকাটা নিয়ে তারপর রিকশায় উঠাল।
ব্রহ্মপুত্র ব্রীজ, এখান দিয়ে সীমান্ত ও উত্তর এলাকার বাসগুলি যায় অর্থাৎ নকলা, শেরপুর, নালিতাবাড়ি, হালুয়াঘাট ইত্যাদির বাস এ পথ দিয়ে যায়। হাসান ফুলপুরের তারাকান্দা যাবে। বাসে উঠতে চাইল কিন্তু কোন বাস তাকে নিতে চায় না, সে বাস দেখলেই এগিয়ে যায় কিন্তু পাগল দেখে তাকে কেউ নেয় না। বর্ষাপক্ষ চলছে, কিছুক্ষণ পরপর বৃষ্টি নামছে, যাত্রী সংখ্যা কম। ঢাকা থেকে একটা বাস এল প্রায় খালি, যাত্রী কয়েক জন। হাসান গিয়ে কন্ট্রাক্টরকে অনুরোধ করল, ‘ভাই দয়া করে আমাকে একটু নিয়া যাও, আমি অসুস্থ আমার খুব বিপদ’ তারপর পকেট থেকে টাকা বের করে বলল, আমি মাগনা যাব না, টাকা দিব। সে চেচাল, ‘উস্তাদ পাগলটা যেতে চায় কী করব’? ড্রাইভার দরজার দিকে এক নজর তাকাল কিন্তু কথা বলল না। হাসান তাড়া দিল, কন্ট্রাক্টর আবার চেচাল, ড্রাইভার নিরুৎসাহিত গলায় বলল, ‘লয়া ল’। হাসান উঠে গিয়ে সিটে বসতে চাইল কিন্তু কন্ট্রাক্টর চেচাল, ‘এই পাগল নীচে বয় নীচে বয়, (বস), সিটে বসিস না। হাসান বাস্পারের কাছে নীচে বসল।
ময়মনসিংহ থেকে দশ মাইল উত্তরে তারাকান্দা বাজার। গাড়ি থামল, হাসান নামল। মেয়েটার অবস্থা খুব করুণ, ছোট্ট মুখটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। কোন নড়াচড়া নেই, স্পন্দন নেই, হাত পা ছেড়ে দিয়েছে। গত পাঁচ দিনের যুলুম তাকে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পৌঁছে দিয়েছে। হাসান কাঁদতে লাগল, কাঁদতে কাঁদতে মেয়েকে কিছু খাওয়ানোর জন্য একটা হোটেলে ঢুকতে চাইল। একটা বয় চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘এই পাগল বাইরে দাঁড়া, কী চাস। হাসান নরম সুরে বলল, ‘কিছু খাব’। ছেলেটা বলল, ‘দাঁড়া এখানে আমি আনছি’। তারপর দুইটা বাসি রুটি ও একটু তরকারি নিয়ে এল। হাসান বলল, ‘ভাত খাব’। ছেলেটা মালিককে বলল, ‘বস ভাত চায়’। মালিক বলল, ‘বাসী ভাতগুলি দিয়ে দে’। ছেলেটা ভাত ও গন্ধ উঠা তরকারী নিয়ে এল। হাসান বলল, ‘আমাকে একটু গোশত ও একটু ভাল মাছ দাও, আমি টাকা দিব’। ছেলেটা মালিককে বলে একটু গোশতের ঝুল এনে দিল।
হাসান মেয়েকে কোলে নিয়ে মাটিতে বসল, তারপর হাত ধুয়ে ভাত মাখিয়ে মেয়ের মুখে দিল কিন্তু সে ভাত খায় না, সে খুব দুর্বল ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। অসহায় বাবার চোখের অশ্রু পাতে গড়িয়ে পড়ে। সে কুরিয়ে কুরিয়ে একটু একটু করে মেয়েকে খাওয়াল এবং নিজে খেল। তারপর টাকা দিতে চাইল কিন্তু মালিক বলল, ‘টাকা লাগবে না যাও’। মাগনা খাওয়াটা হাসানের ভাল লাগল না, ভিক্ষা মনে হল, তার শ্লাঘায় বাধল। সে টাকা নিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘টাকা আছে নেন’। মালিক ধমকাল, ‘আরে যাও, টাকা লাগবে না’। ছেলেটা একটা কাঠের চেলা নিয়ে এসে বলল, ‘এই পাগল বেশি টাকা ওয়ালা অয়া গেছস, টাকা কোথায় পেলি, চুরি করছস, না? যা বেরু বেরু’ বলে সে চেলাটা উচুতে উঠিয়ে হাসানের হাতে টোকা মারতে লাগল। অর্থাৎ ভয় দেখাচ্ছে যে মারবে কিন্তু আসলে মারবে না। কারণ পাগলকে কেউ মারে না। লজ্বায় ঘৃণায় অপমানে তার ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে হাহাকার করে উঠল। সকালের আমীর সন্ধ্যায় ফকির। তার চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইছে। তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরে একটু অন্ধকার মত জায়গায় চলে গেল। অনিরুদ্ধ কান্নাটাকে শরীরের শক্তি দিয়ে দমিয়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল আর বেজান হয়ে আবৃত্তি করতে লাগল, ‘আল্লাহুম্মা মালিকাল মূলকি তু’তিল মুলকা মান তাশাউ ......।
হাসান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কাঁদল। সহসা মনে হল তাকে তাড়াতাড়ি বাড়িতে যেতে হবে নইলে মেয়েকে বাঁচানো যাবে না। তারাকান্দা থেকে সোজা সাত মাইল উত্তরে তাদের বাড়ি, কাচা রাস্তা, বর্ষাকাল। রাস্তার কথা মনে হতেই তার আত্মা ধক করে উঠল, মনে হল যেন হাজার মাইল দীর্ঘ দুর্গম গিরিখাদ, হিমালয়ের মত দুর্লঙ্ঘ দুরতিক্রম্য, এক বন্ধুর মৃত্যু বিবর- যেখানে পদে পদে পাতা রয়েছে মরণ ফাঁদ। কারণ মাটির রাস্তা বর্ষাকালে এমনিতেই হয় পিচ্ছিল, তার উপর বিভিন্ন যানবাহন ও গাড়ি ঘোড়া চলাচল করে পুরো রাস্তা হয়ে উঠে কর্দমাক্ত এবং কিছুটা অন্তর অন্তর গিরি খাদের মত গভীর খাদ সৃষ্টি হয়, বিশেষ করে গরুর গাড়ি ও ট্রলি চলাচল করে এই খাদগুলি সৃষ্টি করে। আর এই খাদে পা পরলেই চোরাবালির মত হাটু উরু এমনকি কোমর পর্যন্ত কাঁদায় ঢুকে যায়। কিন্তু যেভাবেই হউক মেয়েকে নিয়ে তাকে শীঘ্রই বাড়ি পৌছতে হবে।
যানবাহনের একমাত্র সম্বল রিকশা, কাছেই রিকশা স্ট্যান্ড, কয়েকটা রিকশা দাঁড়িয়ে আছে দেখা যায়। হাসান হাঁটতে হাঁটতে সেখানে গিয়ে বলল, ‘বালিয়া পাড়া যাবেন কেউ? কিন্তু পাগল দেখে কেউ কোন কথা বলল না। সে আবার বলল, ‘কেউ বালিয়া যাবেন? একজন রিকশাওয়ালার বাড়ি উত্তর দিকে। সে ঐ দিককার কোন যাত্রীর জন্য বসে আছে। ভাড়াও নিয়ে যাবে বাড়িতেও যাওয়া হবে। সে রিকশা থেকে নেমে কাছে এল, কিছুক্ষণ হাসানকে পর্যবেক্ষন করে বলল, ‘এই পাগল ট্যাহা আছে তোমার কাছে? – ‘হ ভাই, আছে’ সে উত্তর দিল। - কই যাইবা।? - বালিয়া। - আরে বালিয়া তো বুঝলাম কিন্তু কোন জায়গায়, বাজারে? – যাব শালজান তবে বাজার পর্যন্ত গেলেও চলবে, বাকিটা আমি কোন ব্যবস্থা করতে পারব। - যাইয়াম, কিন্তু ভাড়া লাগব ছয়শ। অর্থাৎ দুই মণ ধানের দাম, তখন তিনশত টাকা মণ ধান। তখন আরেক রিকশা ওয়ালা বলল, ‘সারা রাইত এই গাধার খাটুনি খাইট্যা এই মাত্র দুই মণ ধানের দাম, রাস্তার যে কন্ডিশন বালিয়া পন্ত (পর্যন্ত) যাইতে সারা রাইত লাগব, সহালের আগে যাইতারতো না। আরেক রিকশা ওয়ালা বলল, ‘হের পুষব, আরে হে তো বাড়িত যাইব, মাঝহানে ভাড়াডা ফাও লইয়া গেল’। হাসান যেতে ইচ্ছুক রিকশা ওয়ালাকে বলল, ‘ভাই কিছু কম নিলে চলে না, আমার কাছে তো এত টাকা নাই। রিকশা ওয়ালা বলল, ‘আরে পাগল, রাস্তার অবস্থা জান, দুই জন মাইনষের জান বারায়া যাইব, সহালের আগে বালিয়া যাওন যাইত না। এই গাধার খাটুনি খাইট্যা ছয়শ একটা ট্যাহা অইল।
হাসান পকেট থেকে টাকা বের করে তার হাতে দিয়ে বলল, ‘এই টাকাটা নিয়ে দয়া করে আমাকে একটু দিয়ে আস ভাই। রিকশা ওয়ালা টাকা গুনে ফেরত দিয়ে বলল, ‘আরে পাগল এহানে তো মাত্র দুইশ পনের ট্যাহা আছে। এই ট্যাহা দিয়ে তো মাঝিয়াল পন্তও (পর্যন্তও) যাওন যাইত না’। হাসান বলল, ‘আচ্ছা ভাই তুমি আমাকে নিয়ে যাও বাড়িতে গিয়ে শুধু ছয়শ নয় তোমাকে আরো দুই শত টাকা বাড়িয়ে দিব। আমরা ধনী মানুষ, তোমাকে ঠকাব না’। এ কথা শুনে রিকশা ওয়ালারা সবাই হাসতে লাগল, ‘হুন হুন (শুন) পাগল নাকি খুব ধনী, খুব বড় লোক। এহানে হে পাগল সাইজ্যা আবু কোল লইয়া গোয়েন্দাগিরি করতে আইছে, ধরতে আইছে আমরা কে কয়ডা কইর্যা খুন করছি’ বলে তারা হো হো করে হাসতে লাগল। হাসান নিরাশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, এখন উপায়? সে ভেবে কোন কুল কিনারা পাচ্ছে না। এই দুর্গম পথ সে কেমনে পাড়ি দিবে।
অনেকক্ষণ ধরে মেয়ে ডান কাধে থাকায় তার ডান হাত ধরে গেছে। পার্শ্ব বদলানোর জন্য বাম কাধে আনার সময় ডান হাত পরল গিয়ে বাম হাতের ঘড়িতে। আর সাথে সাথে তার মনটা আনন্দে নেচে উঠল, সে হাত থেকে ঘড়িটা খুলল এবং রিকশা ওয়ালাকে এক পাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘ভাই এটা ব্র্যান্ডের একটা ঘড়ি। কিছুদিন আগে এটা আমি আট হাজার টাকা দিয়ে কিনেছিলাম, এখন বেচলে নিম্নে পাঁচ ছয় হাজার টাকা বেচা যাবে। তুমি অন্তত পনের বিশ মণ ধান কিনতে পারবে। ভাই এটা নিয়ে দয়া করে আমাকে একটু দিয়ে আস’। লোকটা মনে করল পাগলটা বুঝি তার সাথে ঠাট্টা করছে, সে ধমকে উঠল, ‘এই পাগল তুই ঘড়ি কই পাইলি, নাকি চুরি করছস’? হাসান বলল, ‘আমি চোর নই, তুমি এটা নিয়ে কোন মেকারকে দেখালেই এর দাম বুঝতে পারবে’ বলে সে ঘড়িটা এগিয়ে দিল। রিকশা ওয়ালা ঘড়িটা নিয়ে উল্টা পাল্টা করে কিছুক্ষণ দেখল। অল্প দূরে রোডের পাশেই ঘড়ি মেকারের দোকান। সে ঘড়িটা নিয়ে সেখানে গেল। পাঁচ মিনিট পর বেরিয়ে এল, আর একটা ছেলে তার পিছু ডাকতে ডাকতে দোকানের সামনে বেরিয়ে এল, ‘এই এই শুন, যা চাইছস তাই দিমু, পাঁচ হাজারই দিমু নিয়ে আয়’। রিকশাওয়ালা নাচতে নাচতে আসছে, পিছন ফিরে বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, পরে আইতাছি, অহন ভাড়াডা দিয়ে আই’।
সে হাসি মুখে লাফাতে লাফাতে রিকশার কাছে এসেই হাক ছাড়ল, ‘কইরে মইজ্যা (মজিবর), ঐ হারাম জাদা তাড়াতাড়ি আয়’। পাশের দোকানে টিভি দেখারত পঁচিশ বছরের একটা ছেলে এগিয়ে এল। সে বলল, ‘নে পাগলডারে রিকশায় তোল। না, আচ্ছা তুই বাচ্চাডারে নে, হে নিজেই উঠুক’। ছেলেটা হাসানের কোল থেকে মেয়েকে নিল কিন্তু সাথে সাথে নাক ছিটকে বলল, ‘উহ হু, কি গুয়ের গন্ধ রে বাবা, এই জইগ্যা চাচা (জগত আলী) তোমার তো আর খায়া দায়া কাম নাই এই পাগলা ছাগলার ভাড়া মারন শুরু করছ’। হাসান রিকশায় উঠে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসল। এই রিকশাওয়ালার আনন্দ দেখে অন্যান্য রিকশা ওয়ালারা চোখ ঠারে, কি ব্যাপার ওকি কোন পাওয়্যা টাওয়্যা ( হঠাৎ খনি বা আশাতিত কিছু পেয়ে যাওয়া) পাইল নাকি, খুশিতে খালি নাচতাছে। তারা সবাই অবাক হয়ে গেল, অন্যের আনন্দে ইর্ষা হল। আবার পাগল তাকে গায়বি কোন কিছু দিল কিনা এই ভেবে ভাড়াটা নিজে না ধরে তারা সবাই আফসোস করতে লাগল। রিকশা ওয়ালা বলল, ‘এই মইজ্যা তুই রিকশায় উইঠ্যা ব (বস) পাকা রাস্তাটুক যা’। মজিবর বলল, ‘উহ হু, যে গুয়ের গন্ধ আমি পাগলের লগে বইতারতাম না, পিছে পিছে আইট্যাই যাইয়াম’। রিকশা ওয়ালা রিকশায় টান দিল আর তখন রাতের প্রথম প্রহর অতীত।
এক কিলোমিটার যাওয়ার পর তে- মাথায় রিকশা থামল। পাকা রাস্তাটা সামান্য বামে মোড় নিয়ে চলে গেছে ফুলপুর হয়ে হালুয়াঘাট সীমান্তের দিকে। আর মোড় থেকে সোজা মাটির রাস্তাটা চলে গেছে উত্তরে বালিয়ার দিকে। রিকশা ওয়ালা বাতি জ্বালিয়ে হ্যান্ডেলের সাথে ভাল করে বাধল, শহুরে রিকশার মত ডলনায় বাধল না, কারণ কাদার নীচে ডুবে যাবে। তারপর দু’জনেই ভাল করে লেংটি মারল, লেংটির উপর আবার শক্ত করে গামছা বেধে রিকশায় টান দিল। রিকশা ইলেক্ট্রিসিটির আলো ছেড়ে অন্ধকারের দিকে পা বাড়াল। সেই সাথে এক ভাগ্যাহত পথিক পৃথিবীর আলোকময় ভুবন ছেড়ে অনিশ্চিত অন্ধকার জগতের দিকে এগিয়ে চলল। প্রথম টানেই রিকশা গিয়ে পরল এক গর্তে, বডি পর্যন্ত কাঁদায় ঢুকে গেল। জইগ্যা বলল, মার ঠেলা, তারপর জইগ্যা হ্যান্ডেলে ধরে টান দিল আর মইজ্যা পেছন দিয়ে ঠেলা মেরে হেইয়্যো বলে এক টানে রিকশা তুলে ফেলল। তারপর কিছুক্ষণ পর পর রিকশা গর্তে ও খাদে পরে যাচ্ছে আর তারা মার ঠেলা, ইয়া আলী, হেইয়্যো ইত্যাদি বলে বলে রিকশা তুলে টেনে নিয়ে চলেছে। জইগ্যা টানছে আর মইজ্যা পেছন থেকে ঠেলছে। যেন দুইটা দৈত্য একটা জাহাজ মাটির উপর দিয়ে টেনে ও ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।
শ্রাবন মাস, বর্ষাপক্ষ চলছে। কিছুক্ষণ পর পর কুত্তা বিলাই বৃষ্টি হচ্ছে। অনন্ত আকাশ জুড়ে একটি তারারও অস্তিত্ব নেই, ঘন কাল মেঘ আকাশ ঢেকে রেখেছে, মনে হয় যেন মেঘের কাল পাহাড়গুলি সীমাহীন আকাশে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। পৃথিবী পাতিলের তলার গাঢ় পুরু কাল কালিতে আচ্ছাদিত। ঘন কৃষ্ণ কাল, অন্ধকার, তমসা, আধার, তিমির, জুলুমাত, আন্ধেরি, ডার্ক, ব্লাক ইত্যাদি কোন কিছুই এই অন্ধকারের যথার্থ নাম নয়। পৃথিবীর কোন ভাষাবিদ এই অন্ধকারের যথার্থ নামকরন করতে পারেনি। পারেনি এই অন্ধকারকে তার স্বমহিমায় সংজ্ঞায়িত করতে । মনে হয় যেন কোন দক্ষ কারিগর কালি ঢেলে ঢেলে বায়ু মণ্ডলের পুরো আস্তরটা পূর্ণ করে পৃথিবীকে কাল মোড়কে আচ্ছাদিত করে দিয়েছে, পৃথিবী কালির ঘেরাটোপে আবদ্ধ। হাতের তালু দেখা যায় না, একটু সামনে কিছুই দেখা যায় না। অদূর গ্রামগুলিতে দুয়েকটা আলোক শিখা দেখা যায়। হয়ত কেউ এদিক সেদিক যাওয়ার সময় বাতি নিয়ে যাচ্ছে কিন্তু ঘন ঘোর আধার সেই আলো এমন ভাবে গ্রাস করে নেয় যেন, ক্ষুদ্র জোণাকির মিটিমিটি আলো জ্বলছে। রাস্তা ঘাটে মাঠে কোথাও জন মানবের চিহ্ন নেই। বর্ষা ও রাতের আধার জন মানুষকে ঘর বন্ধি করে দিয়েছে। কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই, প্রকৃতি নীরব নিথর, তমসাচ্ছন্ন বরিষণময় রাতের প্রকৃতি মানব দানব, পশু পাখি, জীব- জন্তুকেও করে দিয়েছে বিকল, নির্বাক, নিস্পন্ধ। পৃথিবীতে এখন আধারের দাপট, একক অন্ধকারের রাজত্ব চলছে। প্রকৃতির দাপটে জীব জগত জবু থবু হয়ে উঠেছে।
হাসান মেয়েকে কোলে নিয়ে রিকশায় বসে বসে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে অন্তহীন নৈরাশ্য নিয়ে ভাবছে, ‘পৃথিবীর এই অন্ধকার তো কেটে যাবে কিন্তু আমার জীবনের আধার তো কোন দিন কাটবে না। আগামি কাল সুর্যোদয় হবে, সুর্যমুখীর অগ্নি কণিকাগুলি জুই ফুলির মত পৃথিবী পৃষ্টে ঝড়ে পরবে। জীব জগত আবার আড়মোড়া দিয়ে জেগে উঠবে, আবার ফুটবে ফুল, ফুটবে গোলাপ, ফুটবে ফুল শাখে শাখে, আবার পাখি গান গাইবে, ফুলে ফুলে মধুকরেরা উড়ে বেড়াবে, প্রজাপতিরা সাত রঙা পাখনা মেলে ঘোরে বেড়াবে, কপোত কপোতির বুকে চঞ্চু বুলিয়ে আদর দিবে, পাখ পাখালির কলতানে বাঁশ ঝাড় আম ঝাড়গুলি মুখোর হয়ে উঠবে। আবার গাংচিল কৃষকের পুকুরে ঝাপ দিবে, বাদর লাফ দিবে, সিংহ হাক দিবে, বাঘ শিকার ধরবে, শৃগাল গর্তে ঢুকবে। আবার কিষাণির মুখের হাসি নিয়ে লাঙল কাধে কিষান মাঠে যাবে, হেরে গলা ছেড়ে গান ধরবে, ‘শাহ জালালের বাংলাদেশ, শাহ পরানের বাংলাদেশ----। কিষাণীর কণ্ঠে ঝংকার তুলবে গীত, ‘লিলাবালি লিলাবালি, লীলা যুবতী সই গো, কী দিয়া সাজাইমু তরে...। আবার প্রেমিক প্রেমিকার হাসিতে বাগানের ফুলগুলি নেচে উঠবে, যুবতির হাসিতে যুবক আত্নহারা হবে। স্ত্রীর মধুমাখা হাসি গায়ে মেখে স্বামী যাবে মাঠে- কর্মক্ষেত্রে। মায়ের মুখের হাসি নিয়ে সন্তান যাবে বিদ্যালয়ে বা চাকরি স্থলে। শিশুর কান্না শুনে মা দৌড়াবে, কর্দমাক্ত শিশু মায়ের কোলে ঝাপিয়ে পড়বে, মা ক্ষুধার্ত শিশুকে বুকে চেপে ধরবে। আবার গো-বৎস হাম্বা দিবে, কুকুর ঘেউ দিবে, বিড়াল মিউ দিবে, মোরগ ছিউ দিবে। আবার ফুল ফুটবে, পাখি গাইবে, গোলাপ গন্ধ ছড়াবে। আবার পৃথিবী আলোকিত হবে, নিশাবসানে সুর্যোদয়ের পর আবার চিরচেনা পৃথিবী তার স্বমহিমায় ফিরে আসবে, আবার মুখর হয়ে উঠবে, কর্মচঞ্চল হয়ে উঠবে।
এক হতভাগ্য পথিক পৃথিবীর অন্ধকারের মধ্য দিয়ে তার নিজের পৃথিবীর দিকে তাকায়, সেখানে আধার, ঘন ঘোর অন্ধকার, এক ফোটা আশার আলো নাই, তার স্বপ্নময় আকাশে আশার তারাগুলি নিভে গেছে, নিরাশার কাল চাদরে ঢেকে গেছে। তার নাকের গোড়া বেয়ে ফোটায় ফোটায় অশ্রু গড়িয়ে পরছে, ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে আর ভাবছে, ‘হায়, কত আশা ছিল গড়ে তুলব ছোট্ট একটা নীড়, এর সামনে ফুলের বাগান থাকবে, সেখানে ফুল ফুটবে, পাখিরা গাইবে। আমার স্ত্রী সন্তান ফুলের সাথে ভাব করবে, পাখির সাথে গান গাইবে, ফুল দিয়ে মালা গাঁথবে। তারা হাসবে খেলবে নাচবে গাইবে, তাদের হাসিতে ফুলেরা হাসবে, পাখিরা নাচবে, আমি শুধু দেখব, মনটা আমার আনন্দে ভরে উঠবে, রচনা করব সুখের স্বর্গ। কিন্তু আমার সকল আশার প্রদীপ নিভে গেছে, আমার পৃথিবীতে নেমে এসেছে চিরনিশি, চির অমানিশা, চির অন্ধকার। এই আধার কোন দিন ঘোচবে না, আমার পৃথিবীতে আর কোনদিন ভোর হবে না, এই পৃথিবীর শত সুর্য ও সহস্র চন্দ্র আমার আধার ভুবনকে আলোকিত করতে পারবে না। আমার পৃথিবীর সুর্য অস্ত গিয়ে আরেক পৃথিবীতে চলে গেছে, সে এখন অন্যের, অন্যের পৃথিবী আলোকিত করছে। আর আমিও আমার সন্তান চির আধার পুরীতে হারিয়ে গেলাম। আমার জীবন তিমির সিন্ধুতে তলিয়ে গেছে চিরদিনের তরে।
আর কেউ আসবে না, আর কেউ আমার অন্ধকারময় জীবনকে প্রদীপ জ্বালিয়ে আলোকিত করবে না। আর কেউ আমার হাতটি ধরে আলোর পথে নিয়ে যাবে না, আর কেউ আমার পথপানে তাকিয়ে থাকবে না, আমাকে দেখে হাসবে না, নাচবে না, গাইবে না। আমার গোলাপ শুকিয়ে গেছে, বকুল ডাল ভেঙ্গে গেছে, আর কোন দিন ফুল ফুটবে না, পাখিরা গাইবে না। আমার পৃথিবীর সুর্য চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে, যমরাজা প্লুটো তাকে গ্রাস করে নিয়ে গেছে, আমার পৃথিবী আর কোন দিন আলোর মুখ দেখবে না, আমার জীবন অন্ধকার, জগত অন্ধকার।
আমার নিষ্ঠুর নিয়তি আমার সন্তানের জীবনটাও নষ্ট করে দিল, আধারে ঢেকে দিল। এখন আমার সন্তান পথে বসে কাঁদবে, গাছ তলায় পরে থাকবে কিন্তু কেউ এগিয়ে এসে মমতার আঁচল দিয়ে চোখটা মুছে কোলে তুলে নিবে না। ক্ষুধা পিপাসায় যখন তার গলাটা শুকিয়ে যাবে তখন কেউ তার পেটটা ভরানোর জন্য বুকে চেপে ধরবে না, দুধের বোতল মুখে তুলে দিবে না। আমার সন্তান কী খেল, কোথায় থাকল, কোথায় ঘুমাল, কোথায় গেল কেউ খুঁজ নিবে না। বাইরে গেলে কেউ তার পথপানে তাকিয়ে থাকবে না। শিশুরা যখন মায়ের কোলে হাসবে নাচবে খেলবে তখন আমার সন্তান চোখের জলে বুক ভাসাবে। আমি কাছে না থাকলে আমার সন্তান নিঃসঙ্গ হয়ে যাবে, তখন মা হারা মুরগী বাচ্চা যেভাবে গরু ছাগল, হাস মুরগী, মানুষ যে কোন প্রাণীর পিছু নেয় আমার সন্তানও একটু আদরের জন্য মানুষের পিছু পিছু ঘোরবে। আমার সন্তান যখন স্কুলে যাবে ও আমি বাইরে যাব তখন ঘর আমাদেরকে আকর্ষণ করবে না, কারণ আমাদের ঘর তো শুন্য ঘর, উজার ঘর, সেখানে কেউ নেই। আমাদের কোন কেন্দ্র নেই, অবলম্বন নেই, আশ্রয় নেই, ঘর নেই, আমরা হলাম ঝরের পাখি, ভাসমান শেউলা। আমরা ভাসমান শেউলার মত পৃথীবির অনন্ত তিমিরে ভাসতে থাকব। ঘোরপাক খেতে থাকব অনন্ত কাল ব্যাপি।
আমার দুর্ভাগ্য আমার মেয়েকেও স্পর্শ করেছে। আমি অভিশপ্ত, আমি অবাঞ্চিত, আমি আমার মেয়ের কাল রাহু। সে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। কাঁদে পৃথিবীর এক অসহায় হতভাগ্য বাবা। মেয়েটি নিথর হয়ে তার কোলে পরে আছে, কোণ নড়াচড়া নেই, কথা নেই, হাসি নেই, কান্না নেই, হাত পা টান টান হয়ে পরে আছে, ঘাড় ছেড়ে দিয়েছে। সে মেয়ের মাথায় হাত বুলাচ্ছে আর কাঁদছে। অসহায় বাবার চোখের জল গড়িয়ে পরছে মেয়ের মাথায়। সে কাঁদছে, তার শরীরটা ভীষণ ভাবে কাঁপছে। কান্নার গমকে হঠাৎ কাশ উঠে গেল। সে কাশি নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। রিকশাওয়ালারা ধমক দিচ্ছে, ‘এই পাগল কাশলে কিন্তু এখনি রিকশা থেকে নামিয়ে দিব’। দু’তিন বার মুখ ভরে রক্ত এল, কিছু গড়িয়ে কাথায় পরল আর কিছু বাইরে ফেলল। আপ্রাণ চেষ্টা করে কাশি থামাল।
৮০
সম্পুর্ণ রাস্তাই অন্তত আধাফুট কাদা। পুরো রাস্তা জুড়েই একজন টানছে আরেক জন ঠেলছে কিন্তু কিছুক্ষণ পর পর রিকশা গর্তে বা খাদে গিয়ে পরছে। তখন কখনো চাকার কিছু অংশ, কখনো অর্ধেক চাকা, কখনো বডি পর্যন্ত কাঁদায় ডুবে যাচ্ছে। কখনো এক চাকা গর্তে পরছে, তখন পিছনের জন হাটু বা উরু বরাবর কাঁদায় নেমে দানবের শক্তি নিয়ে চাকাটাকে উঁচু করে তুলে ধরে আর সামনের জন টান দিয়ে তুলে। রিকশা গভীর গর্তে ঢুকে গেলে তারা ‘মার ঠেলা, ইয়া আলী’ ইত্যাদি বিভিন্ন বুলি আওরিয়ে রিকশায় দুলনি সৃষ্টি করে, তারপর হঠাৎ হেইয়্যো বলে হেচকা টানা ঠেলা করে তুলে। তাতেও ব্যর্থ হলে ক্লান্ত হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বিশ্রাম করে, দু’জনে আস্ত দুইটা বিড়ি খেয়ে শরীর চাঙ্গা করে। তারপর এসে হেইয়্যো বলে এক টানে রিকশা তুলে ফেলে। এরপরেও যদি না উঠে তখন হাসানকে নামতে হয়, সে বাচ্চা কোলে নিয়ে কাঁদায় দাঁড়িয়ে থাকে তারা টানা ঠেলা করে রিকশা তুলে।
তারাকান্দা থেকে দিয়ারা ঘাট চার মাইল। ঘাট থেকে মাইল দেড়েক দুরে থাকতেই শুরু হল ঝুপঝাপ বৃষ্টি, মুষলধারে বৃষ্টি। রিকশার হুড তুলে দেয়া হল, হাসান মেয়েকে বুকে চেপে ধরে কাঁথাটা ভাল করে জড়িয়ে মেয়েকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। বৃষ্টির ঝাপটায় কাঁথা ভিজছে তার শরীর ভিজছে কিন্তু মেয়েকে কোন রকম বাঁচিয়ে রাখছে। বৃষ্টির কারণে রিকশাওয়ালাদের খুব আছান হল, কারণ শুকনা কাঁদায় রিকশার চাকা চুম্বকের মত কামড়ে ধরে কিন্তু বৃষ্টি হলে কাদা গলে যায় তখন এই কাদা পানিতে চাকা তো আটকায়ই না বরং দ্রুত ঘুর্ননে আরো সাহায্য করে। পানির উপর দিয়ে চেলচেলি রিকশার চাকা গড়িয়ে যাচ্ছে কিন্তু বিপত্তি ঘটল ঘাটের এক কিলো দক্ষিন থেকে। এ জায়গাটুকু ভয়ানক এটেল, কাদা ছাড়া এক ইঞ্চি জায়গা নেই, দুয়েক হাত অন্তর অন্তর গর্ত- খাদ। এসব গর্তে গিয়ে চাকা পুরোটা ঢুকে যায়, তারা চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়, হাসান নামে আর উঠে, আবার উঠে নামে, পা পিছলে মাটিতে পরে যায়, কাঁদায় লুটোপুটি হয়ে যায়। রিকশাওয়ালারা হাসে, অবশ্য তারাও কাঁদায় ভুত সেজে আছে কিন্তু তাদেরকে দেখে হাসবার কেউ নেই।
দিয়ারা ঘাট থেকে আধা কিলো দক্ষিণে বাড়িটার পিছনে এসে রিকশা খাদে পরল, তারা দুই বার বিশ্রাম করে বিড়ি খেয়ে চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। অবশেষে রিকশার চাকার পার্শ্ব থেকে কাদা সড়িয়ে তা তুলতে সক্ষম হল। ইতিমধ্যে বৃষ্টি কমে এসেছে, তার শরীর সম্পূর্ণ ভিজা, তার উপর কাঁদায় লুটোপুটি। বাকী রাস্তাটুকু ঠেলা ধাক্বা উঠা নামা ইত্যাদি করতে করতে রিকশা গিয়ে দিয়ারা ঘাটে থামল। চার মাইল পথ আসা হল, সামনে আর তিন মাইল বাকী। এখান থেকে বালিয়া বাজার দেড় মাইল, সেখান থেকে তাদের বাড়ি দেড় মাইল। হাসানের মুখটা খুশিতে ঝলমল করে উঠে, শীঘ্রই সে গিয়ে মায়ের সামনে দাঁড়াবে, মেয়েকে মায়ের কোলে তুলে দিবে, তখন আর কারো কোন দুঃখ থাকবে না।
মইজ্যা চেচিয়ে উঠল, ‘জইগ্যা চাচা, ঘাটে তো কোন নৌকা টৌকা নাই, অত রাইতে তো নৌকা পাওয়া যাইব না, পাড় অইবা কেমনে? জইগ্যা মইজ্যাকে নিয়ে কয়েক পা দুরে সরে গিয়ে কি জানি ইঙ্গিত করল এবং বিড়ি খেল। ততক্ষণে হাসান রিকশা থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে। তার শরীরটা সুস্থ লাগছে, জ্বর ছেড়ে গেছে, শরীরে শক্তি পাচ্ছে। সে ভাবছে আমি ভাল হয়ে গেছি ইংশাআল্লাহ, আর কোন ভয় নাই। জইগ্যা চিল্লাল, ‘এই পাগল খাড়য়া থাকবা, নাইম্যা দেহ (দেখ) নৌকা কই আছে’। রাস্তার মাথায় পূর্ব পাশে ঘাটের উপড়ে একটা বড় গাছ এবং ঝোপ ঝাড়। ঘাটের দিকে দুইটা রাস্তা নেমে গেছে। একটা সোজা সড়ক দিয়ে আরেকটা সড়কের একটু সামনে থেকে ঝোপের পূর্ব পাশ দিয়ে। হাসান সোজা সড়ক দিয়ে ঘাটের দিকে নামতে গেল, তখনি জইগ্যা চিল্লাল, ‘এই পাগলা এদিগ দিয়া পিছলা নামতারতা না, ডাইন পাশ দিয়া যাও’। আসলে সে মিথ্যা বলল, কারণ ঘোর পথে গেলে হাসানের সময় বেশি লাগবে এবং ঝোপের আড়ালে চলে যাবে আর এই সুযোগে সে ভেগে যেতে পারবে।
হাসান ফিরে এসে ডান পাশ দিয়ে নামল কিন্তু ঘাটে গিয়ে তার মুখটা কাল হয়ে গেল। নৌকা নাই, কোন জন মানব নাই, পাখ পাখালি নাই। অন্য সময় মৎস শিকারি, বর্শিওয়ালা ও তাদের বাতি থাকে, এখন তাও নাই। টু শব্দটা পর্যন্ত নাই, নদীর বুকে শ্মশানের নীরবতা। হতাশায় তার মনটা ভেঙ্গে গেল। পরামর্শের জন্য রিকশা ওয়ালাদের কাছে যেতে লাগল। কিন্তু পাহাড়ের মত চড়াই পেরিয়ে উঠতে তার দুর্বল দেহটা ক্লান্ত হয়ে উঠল। সড়কে উঠে সে অবাক হয়ে গেল। তারা নাই, অনেকটা দুরে দ্রুত ধাবমান বাতির ক্ষীণ শিখা দেখা যাচ্ছে। সে দ্রুত ডাকল, ‘রিকশা ওয়ালা ভাই, ঐ রিকশা ওয়ালা---- কিন্তু তার ক্ষীণ দুর্বল আওয়াজ রিকশা ওয়ালা পর্যন্ত যাবে দূরের কথা পঞ্চাশ হাত পর্যন্তও গেল না। হতাশায় ভেঙ্গে পরল। এই ঘোর অন্ধকার রাতে ঘাটে সে একা দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে ভয়াল বন- বনানী, আশ পাশে জন মানবের কোন চিহ্ন নেই, কোথাও একটু আলোক রশ্নি পর্যন্ত নেই। সুস্থ অবস্থায় হলে এতক্ষণে ভয়ে ডাক চিৎকার শুরু করে দিত অথবা বেহুশ হয়ে যেত কিন্তু এ অবস্থায় ভয়ের অনুভূতি তার ছিল না। এখন তার মন মগজ জুড়ে শুধু একটাই চিন্তা যত দ্রুত সম্ভব মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে যাওয়া এবং মায়ের হাতে তুলে দেয়া, নইলে মেয়েকে বাঁচানো যাবে না। কিন্তু এখন উপায়?
হতাশায় তার দেহের জোড়াগুলি ছেড়ে দিচ্ছে। ঘাটে নৌকা থাকলে না হয় সে নিজেই কোন রকম চালিয়ে চলে যেতে পারত, আশ পাশে কেউ নেই যে ডাকবে। তাহলে কী করা যায়। একবার চিন্তা করল, ঘাটে একটা মসজিদ আছে এর বারান্দায় গিয়ে শুয়ে থাকবে, সকালে কোন একটা ব্যবস্থা হবে। পরক্ষণেই ভাবল, কিন্তু এটা সম্ভব নয়, কারণ মশার জন্য এখানেই এক লহমা স্থির দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না, এখন মসজিদে গিয়ে শুইলে মশার কামড়ে বাপ বেটি উভয়কেই বেঘোরে জীবন হারাতে হবে, বিশেষত মেয়েকে বাঁচানো যাবে না। তাছাড়া সকাল দশটার আগে কোন রিকশা টিকশা পাওয়া যাবে না। সারা রাত মশার কামড় খেয়ে সকাল দশটা পর্যন্ত এভাবে না খেয়ে না ঘুমিয়ে এখানে পরে থাকলে আমার মেয়ে এমনিতেই মরে যাবে। কাজেই যেভাবেই হউক যাওয়ার চিন্তা করতে হবে। হঠাৎ তার মনে হল অনেক সময় ঘাটে ভোরকা (ভেলার আঞ্চলিক নাম) থাকে, কোন ভোরকা পেয়ে গেলেই তো আমার বিপদ কেটে যাবে। সে নেমে নদীর পাড় দিয়ে সামনে পিছনে আনাগুনা করে ভোরকা খুজতে লাগল।
তখন যামিনির দ্বিতীয় জাম অতীত। খুজতে খুজতে অনেকটা পশ্চিমে অর্থাৎ উজানে চলে গেল, আর হঠাৎ আনন্দে তার মনটা ভরে উঠল, হতাশা দূর হয়ে গেল। একটা ভোরকা পাওয়া গেল মাটিতে লগি গেথে আটকে রাখা হয়েছে। তার গায়ে এখন আর জ্বর নাই, তবুও অভ্যাস মত কাঁথাটা গায়েই জড়ানো ছিল, সে কাঁথাটা ফেলে দিয়ে পানিতে নামল। চার কলা গাছের একটা ভেলা, আধা পচা, পানি ধরে গেছে। পরীক্ষা করার জন্য এক পা ভেলায় তুলে ভর দিল, হ্যাঁ ঠিক আছে, ভার বইতে পারবে। মেয়ের ব্যাপারে তার চেতনা সব সময় পুর্নাংঙ্গ সজাগ, সে মেয়েকে ডান কাধে নিয়ে ভাল করে ধরল। তারপর পা না তুলে আগে ভেলায় বসল, তারপর ডান পা তারপর বাম পা তুলে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। দুই পাশে দুইটা ঝাকি দিল। হ্যাঁ ঠিক আছে, কোন রকম যাওয়া যাবে। লগি তোলার জন্য একটু সামনে গিয়ে লগি ধরল আর টান দেয়ার সাথে সাথে দু’কলা গাছের ছিপায় উরুযুল পর্যন্ত ডান পা ঢুকে গেল। আর সাথে সাথে হতভাগ্য বেচারা বিকট আর্তনাদ করে উঠল। বাঁশের টুকরা মুগুর দিয়ে পিটিয়ে কলা গাছে ঢুকিয়ে ভেলা বানানো হয়। দু’কলা গাছের মাঝে বাঁশের টুকরায় একটা ধারালো চোখা, সুচালো আইখ্যা ছিল, সেটায় লেগে হতভাগার পায়ের গোড়ালি থেকে উরুযুল পর্যন্ত ব্লেটের কাটার ন্যায় চামড়া কেটে দু’ভাগ হয়ে গেছে, ঝর্নার ন্যায় পা বেয়ে রক্ত নামছে। মেয়ের প্রতি সে পূর্ণ সচেতন, মেয়েকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে তীব্র যন্ত্রণায় কোকাতে লাগল। কিছুক্ষণ পর পা তুলে বসল, তীব্র ব্যাথায় অনেকক্ষণ কাঁদল। তারপর নাড়িয়ে নাড়িয়ে লগিটা তুলল এবং মাটিতে ঠেকিয়ে ভেলায় ঠেলা দিল। ভেলাটা মাঝ নদীর দিকে এগিয়ে চলল।
বর্ষার প্রশস্ত নদী, তীরের লবালব হয়ে অনন্ত জলরাশি দ্রুত বেগে ছুটে চলেছে। ভেলা এক পাশে কাত হয়ে আছে দেখে সে ঠিক মাঝখানে চারজানু হয়ে বসল। ভেলা মধ্য নদীতে স্রোতের টানে দু’পাশে দুলছে আর সোজা পূর্বে ছুটে চলেছে, পচা কলা গাছ পানির সমান্তরাল নীচে চলে গেছে। হাসান দু’দিকে তাকাল, মনে হল যেন সে সন্তান নিয়ে একা কোন সীমাহীন সমুদ্রে ভেলায় ভাসছে, জীবনে এটা তার নতুন অভিজ্ঞতা, এমন আর কোন দিন হয়নি। তার মধ্যে ভয় জাগল। ভেলার দিকে তাকাল, ভেলাটা পানির নীচ দিয়ে চলছে আর দু’পাশে দুলছে, তার আত্মা ধক করে উঠল। এই প্রথমবার সে বুঝতে পারল পচা ভেলা নিয়ে অনভিজ্ঞ মানুষ নদী পার হতে যাওয়া ঠিক হয়নি, মসজিদে পরে থাকাই ভাল ছিল। আল্লাহয় জানে কী হয় না হয়। সে দ্রুত ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা--- পড়তে লাগল।
এবার লক্ষ করল ভেলাটা স্রোতের টানে সোজা পূর্বমুখী ছুটছে, সে ভয় পেয়ে গেল। এভাবে চলতে থাকলে তো স্রোত তাকে কোন সুদুরে নিয়ে যাবে কে জানে। তখন তো আরো বিপদে পরতে হবে। ভেলাটা উত্তরমুখী করার জন্য সে মাটিতে লগি ঠেকিয়ে ঠেলা দিতে চাইল কিন্তু সাথে সাথে ভেলার দক্ষিণ পার্শ্ব কাত হয়ে পানির নীচে চলে গেল আর উত্তর পার্শ্ব পানির উপরে এক হাত খাড়া হয়ে গেল। তা দেখে হাসানের শিরদাড়া বেয়ে একটা হিমবাহ নেমে গেল, শরীরটা থড়থড় করে কাঁপছে, বুকে হাতুড়ি পেটার শব্দ কানে শুনা যাচ্ছে। সে ‘ইয়া আল্লাহ্’ বলে আর্তনাদ করে উঠল, ‘তাহলে কি আমি ও আমার মেয়ের সলীল সমাধি হতে যাচ্ছে। তার শরীর অবশ হয়ে গেল, দেহটা ভীষণ ভাবে কাঁপছে। মনে হচ্ছে কোল থেকে মেয়েটা পরে যাবে। সে সাক্ষাৎ মৃত্যু দেখে চোখ বন্ধ করে দোয়া ইউনুছ পড়তে লাগল। কারণ ভেলা উল্টে গেলে মেয়েকে কোলে নিয়ে সাতরে পাড়ে যাওয়ার মত শক্তি ও সাহস তার নেই। বিশেষত তার মেয়ের জীবন.........।
আর সে চিন্তা করতে পারল না। তার দেহটা ভেলায় গড়িয়ে পড়ল, মেয়ে তার বুকের উপর পরে রইল। আর এতেই তারা বেঁচে গেল। কারণ ভেলার উপর ছিল পানি আর তার শায়িত দেহের অর্ধেক ভার পানির উপর চলে গেল। ফলে ভেলাটা চলতে চলতে সোজা হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর তার দেহের কাঁপুনি বন্ধ হল, ভেলা সোজা হয়ে গেছে দেখে মনে সাহস সঞ্চার হল। আরো সাহস অর্জন করল এই ভেবে যে, ভেলা উল্টে গেলেও সমস্যা নাই। মেয়েকে ভেলার উপর বসিয়ে এক হাতে মেয়ে ধরবে আরেক হাতে ভেলা ধরে সে পানিতে ভাসতে থাকবে। তারপর ভেলা যেদিকে নিয়ে যায় যাক। হয়ত কোথাও গিয়ে ঠেকবে অথবা অন্তত ভোর হলে কেউ না কেউ সাহায্যে এগিয়ে আসবে। সে মোটামোটি প্রশান্ত হল।
সে আরো বুঝতে পারল যতক্ষণ শুয়ে থাকবে ততক্ষণ ভেলা উল্টাবেনা কারণ তার দেহের ভার পানির উপর থাকছে। এবার তার মাথায় আরেকটা বুদ্ধি এল। বৈঠা দিয়ে পানিতে আড় সৃষ্টি করে নৌকার রুখ পরিবর্তন করা হয়, তা লগি দিয়েও সম্ভব। আবার তার ভরসা ছিল শুয়ে থেকে লগি দিয়ে যাই করুক না কেন ভেলা উল্টিবে না। লগি তার হাতে ধরাই ছিল। এক হাতে মেয়েকে বুকে চেপে ধরে রেখেছে আরেক হাতে লগি। এবার বাম হাতে লগিটা নিয়ে বাম পায়ে বাজাল এবং পানিতে আড় সৃষ্টি করল। বাহ চমৎকার, ভেলার মাথাটা উত্তর পূর্ব কোণের দিকে ঘুরে গেল এবং কিছুক্ষণ পরই তীরে এসে ঠেকল। এবার সে লগি দিয়ে তীরের পানি আন্দাজ করতে চাইল, পানি বেশি না, কোমরের কম হবে। সে ভেলার মাথা বেয়ে আগে মাটিতে পা ঠেকিয়ে ‘আল হামদুলিল্লাহ’ বলে নামল এবং ভেলাটা পিছনে সরে গিয়ে স্রোতের টানে চলতে লাগল।
কিন্তু এখন দেখা দিল আরেক সমস্যা, নদীর ভাঙ্গনটা চলছে উত্তর পাড়ে আর গড়ন চলছে দক্ষিণ পাড়ে। ফলে উত্তর পাড় সোজা খাড়া, উঠার কোন উপায় নেই। আবার স্রোতের টানে ভেলাটা চলে এসেছে আধা কিলোর চেয়েও অনেকটা ভাটিতে। তাই হাসান চিন্তা করল উজানে- পশ্চিমে যেতে থাকবে, যেখানেই ঢালু পাবে সেখান দিয়েই উঠে যাবে। সে পাড় ঘেঁষে কখনো কোমর পানি কখনো আরো কম বা বেশি পানি ভেঙ্গে মেয়েকে কাধে নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল। অনেকটা যাওয়ার পর দেখল উপর থেকে বড় একটা মাটির চাকা ভেঙ্গে পাড় সংলঘ্ন পরে আছে, সে মাটির টুকরাটার উপর উঠল, হাত বাড়িয়ে মেয়েকে পাড়ে রেখে এক হাতে ধরল, এবার অন্য হাত পাড়ের উপর রাখল, পাহাড়ে উঠার মত ডান পায়ের আঙ্গুল পাড়ের নরম মাটিতে গেথে দিল, তারপর পাড়ে উঠার জন্য শরীর ঝাকুনি দিল কিন্তু তখনই মাটির টুকরাটা নদীর দিকে পিছলে গেল, আর সাথে সাথে মেয়েসহ সে নদীতে ঝপাৎ করে পরল। কিন্তু তৎক্ষণাৎ তার অনুভূতি তীব্রতর হয়ে উঠল। চোখের পলকে সে পানিতে হাত মারল, পেল না। দ্বিতীয় বার হাত মেরে পানি ছিটিয়ে মেয়েকে সোজা মাথার উপড়ে তুলে ধরল। মেয়েটা একটু ক্যাত করে উঠল আর নাকে পানির শব্দ হল এ পর্যন্তই। কাঁদলও না নড়াচড়াও করল না, কোন আওয়াজও করল না। সে মেয়ের পেটে চাপ দিতে চাইল কিন্তু তার প্রয়োজন বোধ করল না। কারণ পাঁচ সেকেন্ডে তার পেটে পানি যেতে পারেনি।
তীরের এ পাশটা জঙ্গল, গাছ-গাছালি। গাঢ় অন্ধকার কিছুই দেখা যায় না শুধু পায়ের অনুমানে চলছে। সাপ, বিচ্ছু, জলজ হিংস্র প্রাণী কোন কিছুর প্রতি তার খেয়াল নাই, ভয় নাই, চেতনা নাই। তার একটাই চেতনা, শুধু মেয়ে, মেয়েকে নিয়ে শীঘ্রই বাড়ি পৌছতে হবে। আরো কিছুক্ষণ যাওয়ার পর জল প্রপাতের মত পানির শব্দ পেল, সেদিকে এগিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে দেখল এখান দিয়ে মাঠের পানি নামছে। অনবরত পানি নামায় অনেক দূর পর্যন্ত পাড় ভেঙ্গে গর্ত হয়ে আছে। হাসানের জন্য সুবিধা হল। সে গর্ত ধরে এগিয়ে গেল এবং সুবিধামত জায়গা দিয়ে পাড়ে উঠে গেল। আর পাড় থেকে বিশ হাত উত্তরে পূর্ব পশ্চিমা একটা গো-পাট যা বড় রাস্তার সাথে গিয়ে মিশেছে। সে গোপাটে উঠল। এ রাস্তায় গাড়ি ঘোড়া চলে না বিধায় কাদা নাই। দশ মিনিট পশ্চিমে হাঁটার পর গিয়ে বড় রাস্তায় উঠল। চেনা রাস্তায় উঠেই ক্লান্তিতে মাটিতে বসে পরল এবং কুকুরের মত হাফাতে লাগল।
নদীর মৃত্যুপুরির সাথে সংগ্রাম করে এসে আবার চড়াই উৎরাই পেরুতে গিয়ে তার দুর্বল দেহটা একেবারে অসার হয়ে গেল। গোড়ালি থেকে উরু পর্যন্ত চামড়া কেটে দু’ভাগ হয়ে গেছে এখনো রক্ত ঝরছে। সে বসে বসে বিশ্রাম করতে লাগল। নদীর যমালয়ে যমের থাবা থেকে মেয়েকে নিয়ে বাঁচতে পাড়ায় সে আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করল, আল হামদুলিল্লাহ পাঠ করতে লাগল। এখন তার মধ্যে একটাই চেতনা যত দ্রুত সম্ভব মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে পৌছা। সে আর বসে থাকা সমিচীন মনে করল না, ক্লান্ত দেহটাকে টেনে তুলে দাঁড়াল। কিন্তু শরীর ভারি মনে হচ্ছে, কাপড় সব ভিজে গিয়ে ওজন হয়ে গেছে। ২৩ তারিখে তালাকের পর বাসায় পৌছে সে গা থেকে ঘড়ি ও কাপড় চোপড় খোলেনি। ঘড়ি তো দিয়েই দিয়েছে কিন্তু কাপড় চোপড় সেভাবেই আছে। সে কাপড় খোলার জন্য আবার বসল, মেয়েকে উরুর উপর বসাল আর মেয়ে নেতিয়ে পরল কিন্তু সে দিকে তার চেতনা নেই। সে পাঞ্জাবি ও গেঞ্জি খুলে ছোড়ে মারল। তারপর মেয়েকে কাধে শুইয়ে দোয়া ইউনুস পড়তে পড়তে শুরু করল যাত্রা। আধারের পথে যাত্রা, চলে আধার পথের মুসাফির।
খুব শীঘ্রই সে বুঝতে পারল নদীর ওপারের চেয়ে এদিককার রাস্তা আরো খারাপ। কখনো পা পিছলে পরে যাচ্ছে, কখনো গর্তে পরে হাটু বা উরু পর্যন্ত কাঁদায় ঢুকে যাচ্ছে, তখন অনেক কষ্ট করে পা টেনে তুলে আবার হাঁটছে। আর বৃষ্টির তো কোন বিরাম নেই। আকাশটা যেন চালনি হয়ে গেছে, সেই চালনির উপর দিয়ে সাত সমুদ্র তের নদীর জল গড়িয়ে যাচ্ছে আর ভূপৃষ্ঠে গড়িয়ে গড়িয়ে পরছে। পার্থক্য এতটুকু কখনো মুসলধারে বৃষ্টি হচ্ছে কখনো হালকা। ঠিকমত কিছুই দেখা যায় না, রাস্তাটুকু কোন রকম আবছা দেখা যায় কিন্তু কিছুই বুঝা যায় না। পানিতে ঢাকা সমতল মনে করে পা দিলে তো একেবারে গর্তে। হঠাৎ গর্তে পরে গিয়ে কখনো মেয়েটা কোল থেকে ছিটকে গিয়ে দূরে পরে। তাই তার সম্পূর্ণ চেতনা মেয়ের দিকে নিবিষ্ট করল, মেয়ের মাথা কাধে রেখে ডান হাতে ভাল করে পেছিয়ে ধরল, যাতে কোন অবস্থাতেই কোল থেকে না ফসকাতে পারে। কখনো রাস্তার কিনার ধরে ঘাসের উপর দিয়ে হাটে কিন্তু হঠাৎ পা পিছলে গড়িয়ে গিয়ে নীচে ক্ষেতে পড়ে। আবার উঠে আসে, আবার যাত্রা শুরু করে অন্ধকারের পথিক। কখনো মাঝ বরাবর আঙ্গুল টিপে টিপে নখ মাটিতে গেথে গেথে হাঁটে ও পিছলা খায়, থ্যাকনা খায়, ক্যাত করে মাটিয়ে বসে পরে। কখনো খাদে কখনো গর্তে পরে চোরাবালি থেকে উঠার ন্যায় কৌশলে অনেক শক্তি ব্যয় করে উঠতে হয়। ধীরে ধীরে তার শরীর দুর্বলতর হয়ে আসতে থাকে।
রাস্তা সংলগ্ন পশ্চিম পাশে একটা দরিদ্র বাড়ি। সড়কের উপর একটা বিশাল বড় গাছ। প্রতি বর্ষায় এ গাছের নীচে ভয়ঙ্কর গর্ত হয়ে যায়। হাসান আনমনে হেটে যাচ্ছে। তার এক পা রাস্তার উপর আরেক পা গর্তে গিয়ে পড়তেই একেবারে উরুমুল পর্যন্ত দেবে গিয়ে সে মুখ থুবড়ে পরল। আর মেয়েটা দু’হাত দুরে ছিটকে পড়ল। বাহ্যিক হুশ ও অনুভূতি না থাকলেও মেয়ের প্রতি তার চেতনা সব সময় তুঙ্গে থাকে। সাথে সাথে সে মেয়েকে টান দিয়ে কোলে তুলে নিল, মেয়ের পুরো শরীর কাঁদায় লেপটে গেছে। মেয়েটা পরে গিয়ে কাঁদলও না নাড়াচাড়াও করল না, বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে বুঝা যাচ্ছে না কিন্তু বাবার সেদিকে খেয়াল নেই। কারণ বাবার বিশ্বাস তার মেয়ে কোন অবস্থাতেই মরবে না, মরতে পারে না। হাসান উঠতে চেষ্টা করল কিন্তু বুঝতে পারল তার পা দু’টি যেন চোরাবালির ন্যায় আরো তলিয়ে যাচ্ছে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করল কিন্তু ব্যর্থ হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাফাতে লাগল।
চারিদিকে ঘন ঘোর অন্ধকার, সুচিরও অভেদ্য আধার, তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে, আর এরই মধ্যে এক ভাগ্যাহত বাবা সন্তান কোলে নিয়ে পথের চোরাবালিতে পড়ে ধুকছে। নীরব নিথর পৃথিবী, কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই, কোন বাড়িতে, পথে-ঘাটে-মাঠে কোথাও কোন আলোক রশ্নি নেই। বর্ষার পদাঘাতে পদাঘাতে প্রকৃতিতে নেমে এসেছে মৃত্যুপুরীর নীরবতা। জীব জগত ঘুমের কোলে গা ঢেলে দিয়েছে। কোন বাড়িতে কুকুরের ঘেউ পর্যন্ত নেই। জীব জগত আপন কুটিরে বা গর্তে মুখ গুজে পরে আছে। বর্ষার রুক্ষ প্রকৃতি তাদেরকে আপন আলয়ের সীমানায় আবদ্ধ করে দিয়েছে। এমন দুর্যোগ দিনে, তিমিরাবগুন্টিত রাতে মানব দানব, সাপ বিচ্ছু, কীট পতঙ্গ কেউই বাইরে নেই, সবাই নিজ নিজ কুটিরে বা গর্তে মাথা গুজে পরে আছে। যে এই দুনিয়ার সবচেয়ে নিঃস্ব সর্বহারা সেও স্ত্রী সন্তান বুকে জড়িয়ে তার ভাঙ্গা ঝুপড়িতে পরে আছে। গোয়ালে গরু, রান্না ঘরে বা বারান্দায় কুকুর, মাছায় বিড়াল নিজ নিজ সন্তান বুকে ও গলায় জড়িয়ে ধরে পরে আছে। গাছের গর্তে পাখি ও মাটির গর্তে উরগরা সাথীর সাথে গলাগলি করে ঘুমিয়ে আছে। বাইরে কেউ নেই, এই বিশাল বাস্তু চরাচরে কেউ রাস্তায় পরে নেই। আছে একজন, একটা কুকুর, একটা দু’পেয়ে কুকুর বাচ্চা কোলে নিয়ে রাস্তায় পরে আছে, পৃথিবীর পথে ধুকছে। ফেরদৌসি যখন তার নতুন সংসারে, নতুন ঘরে, নতুন স্বামীকে বুকে চেপে ধরে কামলিলায় মত্ত তখন এই বদবখত যুবক তার সন্তান কোলে নিয়ে পংকিল পৃথিবীতে ডুবে মরছে। অথচ এমন দুর্যোগের রাতে শহরের কোন বাসায় স্ত্রী সন্তানকে জড়িয়ে তার তো ঘুমিয়ে থাকার কথা ছিল। হায় মানবতা, হায় হতভাগ্য মানব সন্তান, হায়রে হতভাগিনী মায়ের সন্তান।
হাসান অনেকক্ষণ ধরে উঠার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। রাস্তা সংলঘ্ন ঘর, সে শুনতে পেল একটা শিশু কাঁদছে। স্বামী ডাকছে, ‘এই হুনছ আবু (বাবু বা বাচ্চার আঞ্চলিক শব্দ) কানতাছে’। একটা মহিলা কণ্ঠের মমতা ঝড়ে পরল, ‘ওমা মা, আমার আম্মু..... বাচ্চাটার কান্না থেমে গেল। অবস্থাটা শুনে হাসানের কলিজাটা যেন ফেটে যাচ্ছে। সমুদ্রের দুরন্ত ঢেউয়ের মত তার গলা দিয়ে কান্না উথলে উঠছে, সে ডুকরে কেঁদে উঠল এবং মেয়েটাকে কাধ থেকে নামিয়ে বুকে চেপে ধরে পাগলের মত চুমুতে লাগল, মাথায় হাত বুলাতে লাগল, হতভাগ্য বাবার চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। খোলা আকাশের নীচে পঙ্কিল পৃথিবীতে পরে কাঁদে এক হতভাগ্য বাবা, মেঘের জলের সাথে পাল্লা দিয়ে তার চোখের জলের ধারা নামে। সন্তানের জন্য এক নিঃসহায় বাবার অসহায় দুটি হাত উর্ধ্বে নিক্ষেপ করে আর্তনাদ করে উঠে, কেঁপে উঠে আকাশ, কেঁপে উঠে প্রকৃতি। সে আল্লাহ্র দরবারে দু’হাত তুলে অনেকক্ষণ পর্যন্ত আকুল হয়ে কাঁদল এবং মেয়ের জন্য দোয়া করল।
হাসান বহু চেষ্টার পর যখন বুঝল এভাবে সে গর্ত থেকে উঠতে পারবে না, তখন বাচ্চাকে পাশের শক্ত মাটিতে বসাল কিন্তু বাচ্চাটা নেতিয়ে পরল। সে শক্ত মাটিতে হাত রেখে দু’পা নাড়ায় এবং হাতে ভর দিয়ে হেচকা টান দেয়, এভাবে কিছুক্ষণ চেষ্টার পর উঠতে সক্ষম হল। তারপর আবার হাঁটা শুরু করল। এবার সে রাস্তার মাঝ ছেড়ে পার্শ্ব দিয়ে হাঁটছে। কিন্তু বারবার পা পিছলে পরে যাচ্ছে। কখনো পিছলে একেবারে নীচে ক্ষেতে গড়িয়ে পড়ছে, বারবার পা পিছলে পড়তে পড়তে থ্যাকনা খেতে খেতে একেবারে ক্লান্ত হয়ে গেল। আরেক বার পা পিছলে পিছল খেলার মত সোজা গিয়ে ক্ষেতে নামল। এই দুঃখের মধ্যেও তার হাসি পেল। কারণ ছোট বেলায় তারা পুকুরে এভাবেই পিছলা খেলত, শহরের পার্কে শিশুরা এভাবেই পিছল খেলে। সে ভাবল, না রাস্তা দিয়ে আর হাঁটা সম্ভব না, ক্ষেত দিয়ে হাঁটা হাজার গুণে ভাল।
বিষয়: সাহিত্য
১৬০৩ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
২ পরবে লিখাটা পোস্ট করলে ভালো হতো..
বাকিটা কালকে পড়তে হবে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন