কবর-৭৮ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২০ জানুয়ারি, ২০১৭, ১০:৩১:২৯ সকাল

২৮ জুলাই, ২০০৬ সাল, অনেক রোদ বৃষ্টি ঝড়িয়ে অবশেষে এল অবিস্মরণীয় দিনটি। যমুনা এক্সপ্রেস ট্রেন, কমলাপুর ষ্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। জনশুন্য ফাঁকা ট্রেন, যাত্রীরা সব নেমে গেছে অনেক আগেই। ট্রেনের এক প্রান্ত থেকে তিন জন টিটি আসছে। দু’জন যুবক একজন বৃদ্ধ, মুখে পাকা দাড়ি, সাদা চামড়া, সুদর্শন বয়স্ক মানুষ। যুবক দু’জন বৃদ্ধ টিটির কাছে নালিশ করছে। বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করল, কবে থেকে? তারা উত্তর দিল, ‘আজ দুই দিন ধরে, সম্ভবত গত রাতের আগের রাত উঠেছে। তারপর থেকে মনে হয় আর নামেনি, ট্রেনেই পড়ে আছে। গতকালও কফ কাশি আর রক্তে ভাসিয়ে দিয়েছিল, আজও গিয়ে দেখেন একই অবস্থা, রক্তের বন্যা। বৃদ্ধ বলল, কিন্তু পাগলটা এল কোত্থেকে, আর যাবেই বা কোথায়? তারা বলল, কে জানে, সে তো ট্রেনেই বাড়ি ঘর বানিয়ে নিয়েছে। আবার সাথে একটা বাচ্চা জুটিয়েছে, পাগল যে বাচ্চা কোথায় পেল বুঝতে পারছি না।

ততক্ষণে তারা হাসানের বগিতে গিয়ে উঠল। যুবক দু’জন বলল, ‘দেখেন দেখেন অবস্থাটা, কি পরিমাণ রক্ত, এ তো বাঁচবে না, এর বাচ্চাটার কি হবে, ওর ঠিকানাটা জানা দরকার। বৃদ্ধ টিটি রক্ত দেখে চমকে উঠল, ‘আহ হা রে, কি করুণ অবস্থা’। যুবক দু’জন, ‘আপনি একটা ব্যবস্থা করেন’ বলে চলে গেল। বৃদ্ধ ‘এই পাগল, এই পাগল’ বলে কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করল কিন্তু পাগল উঠল না। তারপর পাগলের পায়ে নিজের পা ঠেকিয়ে গুতা মারতে মারতে ডাকতে লাগল। কিছুক্ষণ পর হাসান চোখ খুলল, কিন্তু চোখের সামনে মেয়েকে না দেখে ধড়ফড় করে উঠে দৃষ্টি বুলাল। একপাশ থেকে মেয়েকে টান দিয়ে কোলে নিয়ে কাঁদতে লাগল। টিটি জিজ্ঞেস করল, ‘এই তুমি কোত্থেকে এসেছ, কোথায় যাবে, বাড়ি কোথায়? কয়েক বার জিজ্ঞেস করার পর হাসান উত্তর দিল, ‘ময়মনসিংহ যাব, এটা কোন জায়গা? টিটি বলল, ‘এটা ঢাকা, তোমাকে হাসপাতালে পাঠাতে হবে, তুমি মরে যাবে। আচ্ছা তুমি বস আমি এখনি আসছি।

সে বুঝতে পারল বেহুঁশ হয়ে পড়ে থেকে আবার ঢাকায় এসে গেছে। জীবন সম্পর্কে হতাশ হয়ে গেল। নিঃসীম অসহায়ত্ব নিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়ল, ‘তাহলে বুঝি ট্রেনেই আমার জীবনের সমাধি হতে যাচ্ছে, মেয়েটার কি হবে’? চোখের পানি গড়িয়ে গড়িয়ে তার কান ভরছে। টিটি একজন পরিচ্ছন্নকর্মি সাথে নিয়ে এসে বলল, ‘এদেরকে সাবধানে নামাও, আগে মেয়েটাকে নামাও’। কর্মিটা মেয়েকে নামাল। হাসান উঠে বলল, ‘আমি নিজেই নামতে পারব’ তারপর একা একাই নামল। তার শরীরে শক্তি পাচ্ছে, মনে হচ্ছে সে সুস্থ হয়ে গেছে। তারপর মেয়েকে কোলে নিয়ে গিয়ে খাম সংলগ্ন আসনে বসল। বৃদ্ধ টিটি এসে বলল, ‘এই পাগল, তোমার যে পরিমাণ রক্ত যাচ্ছে তুমি তো মরে যাবে। চল, তোমাকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করি।

সাথে সাথে হাসান তার প্রতি হাত জোড় করে কেঁদে উঠল, ‘না চাচা, আমি আমার মায়ের কাছে যাব, তাড়াতাড়ি না গেলে আমার মেয়েটা বাঁচবে না। চাচা একটু দয়া করে আমাকে ময়মনসিংহ যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন’। টিটি এক দৃষ্টে তার হাতের দিকে তাকিয়ে আছে, ঘড়িটা দেখছে। কারণ এই ঘড়িটাই তিন দিন আগে তার ছোট ছেলেকে কিনে দিয়েছে, ব্র্যান্ডের একটা ঘড়ি, বহু দামি ঘড়ি। টিটি জিজ্ঞেস করল, ‘এই ঘড়িটা কার? হাসান তার মুখের দিকে রাগের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘আমাকে কি আপনার চোর মনে হয়’। বৃদ্ধ চমকে উঠল, কারণ কোন পাগল এমন উত্তর দিতে পারে না। আবার কোন পাগলের হাতে এমন দামি ঘড়ি ও জামা কাপড় থাকে না। বৃদ্ধ কিছুটা নুয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কোত্থেকে এসেছেন? সে বলল, ‘জামালপুর থেকে। - বাড়ি কোথায়? সে বলল, ‘ময়মনসিংহের ফুলপুর। - জামালপুর কি করেন। - চাকরি করি। - কীসে?

হাসান আর কোন কথা বলল না, কারণ নিজের এই বিপন্ন বিপর্যস্ত অবস্থায় পদের পরিচয় দিতে তার লজ্বা হল। টিটি বারবার জিজ্ঞেস করল কিন্তু সে মাথা নিচু করে মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে লাগল, কোন উত্তর দিল না। অবশেষে টিটি বলল, ‘আপনাকে হসপিটালে নেয়া দরকার, আপনি তো মরে যাবেন। তৎক্ষণাৎ হাসান আর্তনাদ করে উঠল, ‘না না চাচা আমার কিছুই হবে না। আল্লাহ্‌র ওয়াস্তে আমাকে বাড়িতে যাওয়ার একটু ব্যবস্থা করে দেন, নইলে আমার মেয়েটা মরে যাবে। টিটি বলল, ‘আপনার বাড়ির কি কোন মোবাইল নাম্বার আছে? সে বলল, ‘না, বাড়িতে মোবাইল নাই। টিটি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আপনি এখানেই অপেক্ষা করেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি ছাড়বে। তখন আমি আপনাকে ময়মনসিংহ নামিয়ে দিয়ে যাব। তারপর তিনি চলে গেলেন।

মেয়েটা বাবার কোল থেকে নামার জন্য হাত পা ছুড়ছে আর কাঁদছে। হাসান তাকে নামিয়ে দিল। আর সাথে সাথে বাচ্চাটা দৌড়াদৌড়ি শুরু করল। সে যেন খাচা থেকে মুক্ত হয়ে অনন্ত আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। মেয়েটা মুক্তির আনন্দে দৌড়াদৌড়ি করছে আর হাসছে। হাসান উঠে মেয়ের কাছে গেল কিন্তু বাচ্চা দৌড়ে, পিছন ফিরে বাবাকে দেখে আর ফুলের মত হাসে। এখন তার খেলার জোশ উঠেছে। হাসান বাচ্চার কাছাকাছি একটা বেঞ্চে বসল। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আনন্দে তার বুকটা ভরে উঠল। খুশিতে তার মুখটা চকচক করছে। সে ভাবনায় ডুবে গেল, ‘আমার বাগান, আমার শান্তির বাগান, আমার একটা সুন্দর বাগান ছিল, ফুলে ফলে ভর্তি ছিল। সেখানে সুর্য জীবনান্দের আলোতে ভরিয়ে দিত, চাদেরা মুঠি মুঠি জুই ফুল ঝড়াত, শুল্কা পক্ষের চন্দ্র কলার মত আমার বাগান ক্রমে ক্রমে পূর্ণ হচ্ছিল। সেখানে আমার স্ত্রী সন্তান হাসত, ফুলের মত হাসত, যে হাসিতে মুক্তা ঝড়ত, মুঠি মুঠি জুই চ্যামিলি ছড়িয়ে পড়ত। কিন্তু আমার বাগানটা বিরান হয়ে গেছে। হঠাৎ এল কাল বৈশাখী, সব কিছু লন্ডভন্ড করে দিল। বাগানের মালিকে উড়িয়ে নিয়ে গেল কোন সুদূরে---

কোন সুদূরে? সহসা তার মনে হল তার স্ত্রীর তো বিয়ে হয়ে গেছে। সে তো তার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক স্বামীর সাথে ঢাকাতেই আছে। স্ত্রীর মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠল, মনে হল সেই ভুবন ভুলানো হাসি, সেই উচ্ছ্বাসপূর্ণ হাসি যে হাসি তার হৃদয়কে আলোড়িত করত। খুশিতে তার মনটা নেচে উঠে। সে অধির হয়ে উঠে, অস্থির হয়ে উঠে, ‘না না, আমি যাব, যাব ওকে দেখতে। সে ঢাকাতে আমিও ঢাকাতে। এ অবস্থায় ওকে একটু না দেখে আমি যেতে পারি না, ওকে না দেখে চলে গেলে মরেও আমি শান্তি পাব না। না না, আমি তো সামনে যাব না, দূর থেকে শুধু এক নজর দেখব, শুধুই একটি নজর, একবার, শুধু একবার। আজ কতদিন ওকে দেখি না, আমার চাঁদ মুখ খানা আমার সোনা মুখ খানা আজ কত দিন দেখি না, আমার কলজেটা শুকিয়ে গেছে, আমার মনটা মরে গেছে। এতটা দিন ওকে না দেখে তো আমি কোনদিন থাকিনি।

মাদরাসায় এসে এ কয়েক ঘন্টা সময় আমার তর সইত না, ওর মুখটা দেখার জন্য পাগল হয়ে উঠতাম। সে তাদের বাড়িতে গেলে বা আমাদের বাড়িতে গেলে সপ্তাহটা আমার কাটত না, খাচায় বন্দী পাখির মত ছটফট করতাম। বৃহিস্পতিবারে পাগলের মত ছুটে যেতাম। আমি পৌছতেই সে উল্কার বেগে ছুটে এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরত। তারপর বুকে বুক ঠেকিয়ে তার মুখটা আমার মুখের সামনে তুলে ধরে হাসত, হাসত সে, সোনা ঝড়ানো হাসি হাসত। আমার সোনার ময়না আমাকে জড়িয়ে হাসত, আমার জন্য হাসত, শুধুই আমাকে পেয়ে হাসত। আজ কতদিন আমার ময়নার সেই হাসি আমি দেখি না। আজ দেখব, প্রাণ ভরে দেখব, আমি যাব, যাব ওর কাছে। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর হাসিটা আমি দেখব, ঠিক যেভাবে ইনুখ দেখেছিল। ইনুখ যেভাবে দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে নীরবে চলে এসেছিল, আমিও সেভাবে চলে আসব। হ্যাঁ ইনুখ, ইনুখ আর্ডেন।

সমুদ্র সৈকতে তিনটি শিশু খেলা করছে, দু’টি ছেলে একটি মেয়ে। বড় ছেলেটি মেয়েটাকে বলল, আমি তোকে বিয়ে করব, ছোট ছেলেটা বলল, ‘তুই না, আমি ওকে বিয়ে করব। ডানপিটে বড় ছেলেটি ক্ষেপে গেল, ‘কি আমার বউকে তুই বিয়ে করবি’ বলে ছোট ছেলেটিকে মারতে লাগল। তখন মেয়েটা দু’জনের মধ্যে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এই তোরা ঝগড়া করবি না, আমি তোদের দু’জনকেই বিয়ে করব’। অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস, আজ যা হাস্যকর কাল তা বাস্তব। বড় ছেলেটির নাম ইনুখ আর্ডেন, ছোট ছেলেটি রবিন আর মেয়েটি জুলিয়া ওরফে জুলি। পরিণত বয়সে বড় ছেলেটিই মেয়েটিকে বিয়ে করে। সে ছিল নাবিক, সমুদ্র সৈকতে ছিল তার দরিদ্র কুটির। কিছু দিন পর পর সে সমুদ্র যাত্রা করত, ভাল উপার্জন করত। তার সুখের ছোট্ট সংসারটি স্বচ্ছন্দে হেসে খেলে চলে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে তার ঘরে এল দু’টি চাঁদ, একটি ছেলে একটি মেয়ে। ছেলে মেয়ে স্কুলে ভর্তি হল, তার সুখের সংসার।

একদিন ইনুখ তার সর্বশেষ সমুদ্র যাত্রায় বের হল। সময় গড়াতে লাগল, কেটে গেল দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ , মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, কিন্তু ইনুখ ফিরে আসল না। তার স্ত্রী দূর দিগন্তে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। কোন জাহাজ দেখলেই তার মুখ থেকে মেঘের আবর সরে গিয়ে চাঁদের হাসি ফুটে উঠে। প্রতিক্ষার প্রহর আসে যায় কিন্তু ইনুখ আসে না। অসহায় স্ত্রী ঘরের আসবাব পত্র বিক্রি করে করে পরিবারটির অন্ন বস্ত্রের যোগান দিতে থাকে। কিন্তু এক সময় তাও শেষ হয়ে গেল, ছেলে মেয়ের লেখা পড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হল। ইনুখের সেই বাল্য বন্ধু রবিন ছিল জনৈক সামন্ত প্রভুর একমাত্র সন্তান। ব্যর্থ প্রেমের যন্ত্রণা বুকে চেপে সে আর বিয়ে করেনি, চির কুমার হয়ে থাকল। বাবার মৃত্যুর পর বিশাল জমিদারি নিয়েই সে পড়ে থাকে।

একদিন সে জানতে পারল ইনুখ নিরুদ্দেশ আর তার প্রেমিকা অস্বিত্ব সংকটের মোকাবিলা করছে। সে দৌড়ে এল, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল কিন্তু ইনুখের স্ত্রী ব্যর্থ প্রেমিকের সামনেও আসল না, কথাও বলল না, সাহায্যও নিল না, সে অধির আগ্রহে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। শিশুদের লেখা পড়া বন্ধ হল। মহানুভব রবিন এল কিন্তু জুলিয়া তার সাহায্য প্রত্যাখ্যান করল। কিন্তু এবার খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হল। রবিন এল কিন্তু প্রত্যাখ্যাত হল। একদিন ইনুখের ঘরটা ধ্বসে পড়ল, এবার মাথা গুজার ঠাইটুকুও থাকল না। মহানুভব জমিদার রবিন প্রেমিকাকে রাগ দেখাল, ‘তুমি নিজের জীবন যা খুশি করতে পার কিন্তু বাচ্চা দু’টির জীবন নষ্ট করার অধিকার তোমার নাই’ বলে সে ছেলে মেয়ে দু’টিকে নিয়ে গেল। অগত্যা জুলিয়া সমুদ্র পথে তাকিয়ে তাকিয়ে চোখ মুছে মুছে তাদের পিছু নিল। এর মধ্যে দশটি বছর কেটে গেল। সবাই নিশ্চিত হয়ে গেল ইনুখ আর বেঁচে নেই। তাদের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেল। ছোট্ট বালিকার কথা ‘আমি তোদের দু’জনকেই বিয়ে করব’ বাস্তবায়িত হল। তাদের সংসার সুখের স্বর্গে পরিণত হল।

এক যুগ- বার বছর কেটে গেছে। একদিন সমুদ্র সৈকতে একটা পাগলের আবির্ভাব ঘটল। পাগলটার পা ভাঙ্গা খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছে, মাথায় জটাধরা উসকু খুসকু চুল, দাড়ি গোফে মুখ ঢেকে গেছে, শতছিন্ন পোশাক, শরীর বলতে অস্থি চর্মসার কঙ্কাল কাঠামো। তার দেহটা সাক্ষ্য দিচ্ছে এই শরীরটার উপর কালের অনেক যুলুম ও ঝড় ঝঞ্ঝা বয়ে গেছে। পাগলটা ইনুখের বাড়ি খুঁজছে কিন্তু কোন কুল কিনারা পাচ্ছে না। কারণ এক যুগে সৈকতের পুরাতন কাঠামো ভেঙ্গে নতুন কাঠামো গড়ে উঠেছে, নতুন মানুষ, নতুন নতুন আধুনিক বাড়ি ঘর, নতুন জনপদ, নতুন নতুন রাস্তা ঘাট গড়ে উঠেছে। এক যুগের ব্যবধানে সৈকতের অবস্থা আমুল পাল্টে গেছে। পাগলটা ভাবছে হয়ত তার স্মৃতি ভ্রম হয়েছে, তাই অনেক খুঁজাখুঁজি করল, সৈকতে নতুন বসতির অনেককে জিজ্ঞেস করল। কিন্তু তারা উত্তর দিল, ‘ইনুখ নামের কোন মানুষ তো দূরের কথা এ নামের কোন গাধা আছে এমনটাও তারা এ তল্লাটে কোন দিন শুনেনি। অনেক ঘোরাফিরার পর সে নিরাশ হয়ে অবসন্ন হয়ে গেল।

রাত্রি নেমেছে। হঠাৎ তার মনে হল, সৈকতে একটা আশ্রম ছিল, রাতে সেখানে চলে গেল। আশ্রমের বৃদ্ধা নার্সকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা অনেক দিন আগে ইনুখ নামের কাউকে কি আপনি চিনতেন, তার বাড়িটা কোথায় বলতে পারেন, তার স্ত্রী সন্তানের খবর জানেন কি? বৃদ্ধা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে কিয়তকাল পাগলটার দিকে তাকিয়ে সহসা চেচিয়ে উঠল, ‘ইনুখ ইনুখ তুমি এখনো বেঁচে আছ? হায় এক সময়ে এ সৈকতের সবচেয়ে শক্তিশালী, সবচেয়ে ডানপিটে, সবচেয়ে সুদর্শন ছেলেটির একি হাল, কিভাবে এমন হল ইনুখ? তারপর বৃদ্ধা আকুল হয়ে কাঁদতে লাগল। কিছুক্ষণ পর ইনুখ তার অভিশপ্ত শেষ সমুদ্র যাত্রার কাহিনী বর্ণনা করল। আর বৃদ্ধার কাছে জানতে পারল তার সেই প্রতিদ্ধন্ধি বাল্যবন্ধু রবিনের সাথে তার স্ত্রীর বিয়ে হয়েছে এবং তার ছেলে মেয়েরা সেখানেই আছে। চির ডানপিটে ইনুখ ক্ষেপে গেল, সে আর্ত চিৎকার করল, ‘আচ্ছা ঐ বেশ্যা মেয়ে লোকটা একটিবার কেন ভাবল না যে, আমি ফিরে আসতে পারি, কেন আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারল না। বৃদ্ধা বুঝাল আর ইনুখ সারা রাত ছটফট করে কাটাল।

ভোরে সে তার স্ত্রী সন্তানকে দেখার জন্য জমিদার বাড়ি ছুটল, বৃদ্ধা বাধা দিল কিন্তু সে মানল না। তবে বৃদ্ধার চাপে সে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হল যে, সে স্ত্রী সন্তানের সামনে যাবে না, শুধু দূর থেকে দেখেই চলে আসবে। জমিদার বাড়ি, প্রাচীর ঘেরা বিশাল বড় বাড়ি, সামনে বিরাট বাগান। ইনুখ পাচিলের উপর দিয়ে উকি দিল। তার চোখ আনন্দে নেচে উঠল। দু’টি তরুণ তরুণী বাগানে খেলা করছে- যেন মানিক জোড়। সে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল, এতো ইনুখ, প্রথম যৌবনের ইনুখ, তার সন্তান। আনন্দাতিশয্যে হতভাগ্য বাবা মুখ চেপে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল, খুশিতে তার বুকটা ভরে উঠেছে। তার মতই হয়েছে বলিষ্ঠ গড়ন, চওড়া কাধ, আজানু লম্বিত বাহু, পিটানো শরীর। তারমতই ডানপিটে মনে হচ্ছে। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে সে আবার কেঁদে উঠল, কারণ প্রথম যৌবনে তার স্ত্রীর চেহারার হুবহু নকল। তার মেয়ে তার সন্তান, ঠিক মায়ের মত সুন্দরী হয়েছে। আনন্দে তার বুকটা ভরে উঠল। এক হতভাগ্য বাবার এক যুগ যন্ত্রনার গ্লানি মুছে গেল।

তারপর বাগানের এক কোণার দিকে তার দৃষ্টি গেল, সেখানে দু’জন মানুষ পাশাপাশি বসে আছে। একজন আপাদমস্তক সোনায় মোড়ানো, ভাটি যৌবনেও যুবতির মত দেখা যায়, অনন্ত যৌবনা মনে হয়। সে পাশের পুরুষটির সাথে হাসছে, হাতাহাতি করছে, খুনটুসি করছে, পুরুষটাকে মাতিয়ে তুলেছে। তার বুকটা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙ্গে চুরচুর হয়ে গেল। সে খামছি দিয়ে বুকটা ধরে মাটিতে বসে পড়ল এবং শুধু একটি কথাই উচ্চারণ করতে পারল, ‘হতভাগাদের এই পৃথিবীতে কিছুই থাকে না, এমনকি তাদের স্ত্রী সন্তানও অন্যের হয়ে যায়’। তারপর সে উঠে টলটলায়মান পায়ে আশ্রমের দিকে চলল, তার দেহটা টলছে, অবশ দু’টি পা কোন রকমে তার দেহের বোঝাটা বয়ে নিয়ে গিয়ে আশ্রমে ফেলল এবং কিছুক্ষণ পর সে মারা গেল। অবশ্য বৃদ্ধা নার্স তার মানবিক দায়িত্ব পালন করেছিল- ইনুখের স্ত্রী সন্তানকে খবর দিয়েছিল।

হাসান প্লাটফর্মের বেঞ্চে বসে সহসা চেচিয়ে উঠে, ‘হ্যাঁ আমিই তো ইনুখ, আমিই এ যুগের ইনুখ আর্ডেন। যুগে যুগে আমিই ইনুখ আর্ডেন। আমিই সেই হতভাগ্য ইনুখ যার স্ত্রী অন্যের হয়ে গেছে। তবে আমার ও ইনুখের মধ্যে পার্থক্য আছে। ইনুখের স্ত্রী তার সন্তানদের জীবন বাঁচাতে অন্যের ঘরে গিয়েছিল আর আমার স্ত্রী নিজের সুখ ও ভোগের ভাড়ার পূর্ণ করার জন্য অন্যের ঘরে গেল। ইনুখ আশ্রমে আশ্রয় নিয়েছিল, আমিও সুদূর দুরাশ্রয়ে নিরাশ্রয়ে পড়ে আছি। জুলিয়ার স্বামী জমিদার ছিল, আমার স্ত্রীর স্বামীও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, জমিদারের মত বড় লোক। নিশ্চয়ই তার আলিশান বাড়ি আছে, আর বাড়ির সামনে আছে বিরাট উদ্যান। আর প্রাচীর ঘেরা সেই উদ্যানে নিশ্চয়ই আমার স্ত্রী ফুলের সুবাসে নিজের যৌবন সুবাস একাকার করে দেয়, প্রজাপতির সাথে খেলা করে, পাখির সাথে গান গায়, মালা গাঁথে স্বামীকে পরায়।

আমি যাব, একটু দেখব ওকে, না না ওর কোন ক্ষতি করব না, সামনে যাব না। সে তো আমার ঘরে সুখি ছিল না, এখানে সে সুখি হবে, রাণীর মত জীবন কাটাবে এতে আমারও সুখ। আমি তাকে সুখি দেখতে চাই, তার দুঃখ আমি সইতে পারব না। আমি দেখব শুধু পাচিলের উপর দিয়ে উকি মেরে বা গেইটের পাশের ছিদ্র পথে বা পকেট গেইট খুলে একটু সামান্য ফাক করে দেখব, দেখব আমি আমার সম্রাজ্ঞীকে। দেখব আমি সে কিভাবে বাগানের দোলনায় স্বামীর কোলে বসে দোল খায়। দেখব কিভাবে সে প্রজাপতির মত ফুলে ফলে ঘোরে বেড়ায় আর ফুলের সুগন্ধি গায়ে মাখে। দেখব কিভাবে সে মালা গাঁথে আর ঐ লোকটার গলায় পড়ায়। দেখব সে মালা পড়িয়ে ঐ লোকটাকে কিভাবে জড়িয়ে ধরে, তারপর ঐ লোকটার সামনে মুখ তুলে কিভাবে হাসে, যে হাসিতে জুই চ্যামিলি ঝরে পড়ে, যে হাসিতে বাগানের ফুলগুলি আন্দোলিত হয়, প্রজাপতিরা নাচতে থাকে।

তখন যদি আমার কান্না আসে তাহলে মুখ চেপে ধরব, শব্দ বের হবে না। যদি আমার মেয়েটা আম্মু আম্মু বলে কেঁদে উঠে, তখন ওর মুখ চেপে ধরে দৌড়ে পালিয়ে যাব, কেউ দেখতে পাবে না, কেউ টের পাবে না। যেভাবে ইনুখ আর্ডেন চুপিসারে দেখে চুপিসারে প্রস্থান করেছিল আমিই তাই করব। আমি ওর সুখের সংসারে বাগড়া দিতে যাব না, ও সুখি হউক, অনেক সুখি, সে সুখি হলেই আমি সুখি, আমি তার সুখ চাই। সে আমার ঘরে অসুখী ছিল, এখন সেই অসুখ সুদে আসলে উসুল করুক। আর আমি রাস্তার কুকুর পড়ে থাকব পথের ধারে, এটাই আমার নিয়তি, এটাই আমার প্রাপ্য। ওকে দেখতে আমি যাবই, আমাকে যেতেই হবে।

সে বেঞ্চে বসে বসে ভাবছে, আচ্ছা ওর স্বামী তো এশিয়ান ইউনিভার্সিটির শিক্ষক, এশিয়ানে গেলেই তার ঠিকানা পাওয়া যাবে। সম্ভবত আশে পাশে কোথাও তার বাসা হবে। কিন্তু এশিয়ানটা কোথায় আমি তো তাও জানি না। আচ্ছা কারো কাছ থেকে জেনে নিতে হবে। একজন পাশ দিয়ে যাচ্ছে সে ডাকল, ‘এ যে ভাই শুনেন’ কিন্তু লোকটা ফিরেও তাকাল না। আরেকটা লোককে ডাকল। লোকটা তাকাল কিন্তু পাগল দেখে কথা না বলে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর যুবক যুবতির একটা দল এল, সম্ভবত কোন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সে ডাকল, ‘এই যে ছোট ভায়েরা শুন’। তারা ফিরে তাকাল। সে বলল, ‘আচ্ছা এশিয়ান ইউনিভার্সিটিটা কোথায়? এক ছাত্র বলল, কেন? সে বলল, একটু দরকার আছে। আরেক ছাত্র বলল, ‘আরে আজ কাল তো দেখছি পাগলরাও ভার্সিটির খোজ নেয়া শুরু করেছে। আরেকজন বলল, ‘আরে কাকে কি বলছিস, উনি তো এশিয়ানের ভিসি’ সবাই হেসে উঠল। মেয়েরা রহম দিল হয়, তারা কিছু বলল না শুধু হাসল আর করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ছাত্ররা একেক জন একেক মন্তব্য করতে করতে হাসতে হাসতে চলে গেল।

হাসান বিরক্ত হয়ে ভাবল, না আর কারো কাছে জিগাব না। পকেট থেকে টাকা বের করে দেখল এখনো অনেক টাকা আছে। সে চিন্তা করল ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে একটা সি এন জি নিয়ে এশিয়ানে চলে যাবে। সেখানে গেলেই ঐ লোকটার সন্ধান পাওয়া যাবে। আজ তার শরীরটা একটু ভাল লাগছে। হয়ত সুস্থ হয়ে উঠেছে। কাজেই যেতে কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু যাওয়ার আগে তো মেয়েটাকে কিছু খাওয়ানো দরকার, নিজেও কিছু খাওয়া দরকার। ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কলা, পাউরুটি ও পানি কিনল। তারপর মেয়েকে খাওয়াতে বসল। কিন্তু মেয়েটা খুব দুর্বল হয়ে গেছে। ক্ষুধা আছে তবুও জোরে জোরে খেতে পারছে না। মেয়ের সাথে সাথে সে নিজেও খাওয়া শুরু করল। বাপ বেটি দু’জনে মিলে প্লাটফর্মে বসে মোটামোটি ভালই খেল। তারপর বোতলের মুখ খুলে মেয়েকে পানি খাওয়াল এবং নিজে খাইতে চাইল, মুখে পানি একটু বেশি ঢুকে গিয়ে গিলার সময় ফুসফুসে চলে গেল আর সাথে সাথে শুরু হল কাশি, প্রচণ্ড কাশি। সে বুঝতে পারছে এখনি বেহুশ হয়ে যাবে। তাই মেয়ে সম্পর্কে পূর্ণ সজাগ হয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি কাঁথার কোণা ও মেয়ের জামায় গিট্টু দিল আর বসে বসে কাশতে লাগল। মুখ ভরে কফ কাশ ও রক্ত আসছে, চারপাশটা কফ, কাশ ও রক্তে ভরে উঠল। সে কাশতে কাশতে মাটিতে ঢলে পড়ল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই বেহুশ হয়ে গেল।

এভাবেই সে প্লাটফর্মে পরে থাকল আর বাচ্চাটা পাশে বসে থাকল। আর এ সময়ই ঘটল ঘটনাটা। যৌবন দিপ্ত এক নববধু আসল আর মানবতা ও মনুষ্যত্বের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তা পদদলিত করল। কোন মানুষ চরম শত্রুরও মুখ, মাথা ও কপালে কখনো পা লাগায় না, জুতা লাগায় না কিন্তু এই অভিশপ্ত নারী তাই করল। এইখানে মনুষ্যত্বের সমাধি রচিত হল। সে একসময় স্বামীকে লাথি মারার কথা বলেছিল তা বাস্তবায়িত করল। তারপর নিজের পেটের সন্তানকে ফেলে নতুন ভাতারের হাত ধরে চলে গিয়ে নিখিল মাতৃ জাতির ললাটে এঁটে দিয়ে গেল চির কলঙ্ক তিলক।

বিষয়: সাহিত্য

১২৪০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File