কবর-৭৭ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১৭ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:৪১:০১ দুপুর

২৭ জুলাই দিবাগত রাত। নিশীথিনীর দ্বিতীয় জাম অতিক্রান্ত। বাহাদুরাবাদ ঘাটে দাঁড়িয়ে আছে যমুনা এক্সপ্রেস ট্রেন, যাত্রি শুন্য বগি খা খা করছে, জমাট অন্ধকার। পৃথিবীতে এমন কিছু মানব সন্তান জন্মায় জগতের হাসিতে যাদের কোন অংশ থাকে না, এরা শুধু পৃথিবীর গ্লানি আর বঞ্চনাটুকুর ভাগিদার হয়। এরা স্বপ্ন দেখে, তাদের স্বপ্নময় ভুবনে একটার পর একটা আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে যায় কিন্তু চোখের জলে একে একে সকল প্রদীপ নিভে যায়, তাদের মরুময় জীবনে নেমে আসে অমানিশার কালো আধার। এই অবাঞ্চিতদের জন্য পৃথিবী কখনো গোলাপ বকুল আর জুই চ্যামিলির ডালি মেলে ধরে না, কন্টক কাটা গুল্ম ছড়িয়ে রাখে এদের পথে পথে, কাটায় কাটায় এরা জর্জরিত হয়, ক্ষত-বিক্ষত হয়। একদিন এরা নীল কণ্ঠ হয়ে শতাব্দীর পাখনা থেকে ঝরে পড়ে অজ্ঞাত নামা হিসাবে। এমনি এক হতভাগা ট্রেনের পাটাতনে বেহুশ হয়ে পড়ে আছে। তার দুই বছরের বাচ্চাটা পাশে বসে মশার কামড়ে ছটফট করছে, হাত পা নাচাচ্ছে আর কাঁদছে। কিন্তু শিশুটির মধ্যে কান্নার শক্তিটুকুও আর অবশিষ্ট নেই। পৃথিবীর পথে নতুন এই অভিযাত্রীর ছোট্ট দেহটিকে কালের যুলুম নিস্প্রাণ, নিস্পন্দ, আর শক্তিহীন করে দিয়েছে। বাচ্চাটা ঘন ঘোর অন্ধকারে বসে তার দুর্বল দেহে ক্ষীণ কণ্ঠে শুধু ঘ্যান ঘ্যান করে কাঁদছে আর মশার কামড়ে অস্থির হয়ে বারবার বাবার দেহের উপর আঁচড়ে পড়ছে। অসহায় হয়ে বাবার গায়ে, মাথায় ও মুখে হাত মারছে, ‘বাব্বা বাব্বা’ বলে ডাকছে আর কাঁদছে।

একবার মেয়েটা নিঃসীম অসহায়ত্ব নিয়ে বাবার মুখে জোরে জোরে হাত মারতে লাগল। হাসান জেগে উঠল, আড়মোড়া দিয়ে উঠে বসল। রেলের বগির মধ্যে জমাট বাধা অন্ধকার, হাতের তালু দেখা যায় না, এক ফুট সামনের কিছুই চোখে ভাসে না। সে চমকে উঠল, অনুভূতি তীব্রতর হয়ে উঠল। অন্ধকার হাতরে মেয়েকে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল। সৃষ্টির সুচনা থেকে কোন বাবা নিজের সন্তানকে এমন অসহায় অবস্থায় ফেলেনি, সন্তানের এতটা অসহায়ত্ব স্বচক্ষে দেখেনি। সন্তানকে সন্তানের স্থলে না রাখতে পারলে বাবা নামটি ব্যর্থ, অভিশপ্ত। এক অভিশপ্ত বাবা সন্তানকে বুকে জড়িয়ে কাঁদে, ডুকরে কাঁদে, গুমরে গুমরে কাঁদে, কান্নার গমকে তার দেহটা থরথর করে কাঁপতে থাকে, দেহের কাঁপনে রেলের বগি কাঁপতে থাকে।

তীব্র যন্ত্রণায় এক অভিশপ্ত বাবা কলিজা ফাটা আর্তনাদ করে দু’হাত উর্ধ্বে মেলে ধরে চিৎকার করে, কেঁপে উঠে আকাশ, কেঁপে উঠে খোদার আসন- আরশ কুরসী, ‘ঐ স্বৈরাচার, আমাকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছিস কেন, পৃথিবীর এই অভিশপ্ত অবাঞ্চিত কুকুরটাকে কেন এখনো বাঁচিয়ে রাখতে হয়। কেন, কি প্রয়োজনে, কার স্বার্থে বাঁচিয়ে রেখেছিস? আমাকে স্বচক্ষে আমার সন্তানের এই করুণ দৃশ্য দেখানোর জন্য। আমাকে নিয়ে তোর যত ইচ্ছা খেলা, কিন্তু এই দুই বছরের একটা শিশুকে নিয়ে খেলতে তোর খোদায়িত্বের বিবেকে বাধল না? তুই না রহমান, তুই না রহীম, তোর কী একটিবার লজ্বা হল না এক অসহায় বাবাকে তার দুই বছরের সন্তানের এমন করুণ পরিণতি দেখাতে। তুই কিসের রহমান, কিসের দয়ালু, যে স্রষ্টা তার সৃষ্টিকে নিয়ে এমন নিষ্ঠুর খেলা খেলে সে স্রষ্টা নয়। যে স্রষ্টা একজন বাবাকে দিয়ে তার শিশু সন্তানের জন্য এমন পরিণতি ডেকে এনে পর্দার আড়ালে বসে উপহাসের হাসি হাসে সে নিষ্ঠুর পাষাণ, সে কোন স্রষ্টা নয়।

আমার প্রতি তোর এই উপহাসটুকুও বুঝি বাকী ছিল। আমাকে দিয়ে আমার সন্তানকে পৃথিবীতে এনে আবার আমাকে দিয়েই তাকে দুর্ভাগ্যের অতলান্তে তলিয়ে দিয়ে, আবার আমাকেই সেই দৃশ্য স্বচক্ষে দেখতে হবে- তোর এই খেলাটা বুঝি বাকী ছিল, এটাও বুঝি আমার ভাগ্যে ছিল। বন্ধ কর তোর খেলা, আমি আর তোর খেলার গুটি হতে পারছি না। আমারে মুক্তি দে, আমারে উঠিয়ে নে। আমার যা কিছু সুখ, সুন্দর আমার মেয়েকে দে, আমার মেয়ের যা কিছু দুঃখ কষ্ট কান্না আমাকে দে। মালিক আমার, আমার তো হয়ত সময় শেষ, আমার সন্তানের জন্য আমার অন্তিম ইচ্ছা, আমার শেষ আশা, শেষ দাবী, শেষ প্রার্থনাটুকু কবুল কর, এটাই তোমার কাছে এক অসহায় বাবার শেষ আর্জি। এই ধরিত্রীর একজন সদস্য হিসাবে পৃথিবীর দুঃখ কষ্ট ও কান্নায় হয়ত আমার মেয়েরও একটা অংশ আছে এই অংশটুকু আমি নিয়ে নিলাম, তুমি তা আমাকে দিয়ে দাও। আবার পার্থিব জগতের সুখ স্বচ্ছন্দ, আনন্দ উল্লাস ও হাসিতে পৃথিবীর একজন সদস্য হিসাবে আমারও তো একটা অংশ ছিল এবং আছে কিন্তু আমি তা কোনদিন পাইনি। আমার এই অংশটুকু আমার মেয়েকে দিয়ে গেলাম, আমার সবটুকু হাসি আনন্দ দাও আমার মেয়েকে আর আমার মেয়ের সবটুকু কান্না দাও আমাকে, তারপর আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাও। তোমার এই নরক পুরীতে আমি আর থাকতে চাই না। এরপর থেকে আমার মেয়ে যেন আর কোনদিন না কাঁদে। পৃথিবীর পথে কোনদিন যেন তার পায়ে কাটা না ফুটে, তার চলার পথ যেন হয় ফুলে ফলে সুসজ্জিত, সুশোভিত। আমার সন্তান যেন সারা জীবন ফুলের সাথে হেসে আর পাখির সাথে গেয়ে বেড়ায়, তার ললাট যেন কোন দিন কুঞ্চিত না হয়, সে যেন থাকে দুধে- ভাতে। এই হল আমার শেষ আর্জি, অন্তিম আর্তি। এটা তোমাকে কবুল করতেই হবে, করতে হবে এজন্য যে, যা কিছু ঘটেছে তা আমার জন্য ঘটছে না, তুমিই ঘটাচ্ছ। আমার সন্তানের এই ভোগান্তির জন্য দায়ী আমি নই, তুমি। কাজেই আমার অন্তিম সায়াহ্নের আবেদন তুমি কবুল কর, আমার বাবার মৃত্যুর সময় আমাদেরকে তোমার হাওয়ালায়- তোমার হাতে রেখে গিয়েছিলেন। আমিও আমার সন্তানকে তোমার হাতে রেখে গেলাম। তোমার কুদরতের হাতে সমর্পন করলাম। তুমিই হাফিয, আল্লাহুম্মা আমীন।

আমি মরে গেলে আমার সন্তান কোথায়.... আর সে কথা বলতে পারল না, বোবা যন্ত্রণায় তার ভাষা রুদ্ধ হয়ে এল। তার কণ্ঠ থেকে সন্তান হারা মায়ের মত শুধু বিলাপ আর কান্নার রাগিনী ভেসে আসছে, সেই কান্না নির্জন রেল প্রকোষ্ঠে গুঞ্জরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে উর্ধ্বে। বিষাদের কালিমা ছেয়ে ফেলে আকাশ, ঢেকে ফেলে পৃথিবী। এক ব্যর্থ জন্মদাতার আহ ও আর্তনাদের বিষাক্ত কনিকাগুলি জীবানুর মত তিমির গাত্রের কোষে কোষে পুশে গিয়ে কঠিন কৃঞ্চ কাল আধার বরফের মত গলে গলে ঝড়ছে, তুষার সম ফোটায় ফোটায় বিন্দু বিন্দু ঝড়ে পড়ে পৃথিবী পৃষ্ঠে। এক অসহায় বাবা সন্তানের মাথায় হাত বুলাতে থাকে আর তার চোখের নোনাজল ফোটায় ফোটায় ঝরে পড়ে সন্তানের পিঠে ও মাথায়।

বাচ্চাটা অঝোরে কাঁদছে আর উসখুস করছে। আজ দুই দিন ধরে সে বাবার কাঁথার সাথে বাধা আছে। একটু হাঁটা চড়া করতে পারছে না। বাইরে যেতে পারছে না, খাওয়া নাই, ঘুম নাই, গোসল নাই, হাফ পেন্টে পায়খানা পেশাব করছে আর সারা গায়ে ছড়িয়ে পড়ছে, এভাবেই শুকাচ্ছে। মেয়েটা অস্থির হয়ে উঠেছে। হাসান মেয়ের জামার সাথে কাঁথার গিরাটা খুলল, সিটে ঢেস দিয়ে উঠে দাঁড়াল। হাঁটতে পারবে কিনা বুঝার জন্য দু’পা হাঁটল কিন্তু তার মাথা ঘুরিয়ে গেল, আর সাথে সাথে টয়লেটের দেয়াল ধরে টাল সামলাল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল, আবার হাঁটল, না ঠিকমতই হাঁটতে পারবে বলে মনে হল। তারপর মেয়ের হাত ধরে বগির মাঝ বরাবর কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করল। না, শরীর ঠিক আছে মনে হচ্ছে, নামতে পারবে। তারপর দরজায় গিয়ে বসল, মেয়েকে হাত দেড়েকে পিছনে বসাল। তারপর হাতল ধরে নামতে গেল কিন্তু এক পা মাটিতে ঠেকিয়ে হাত ছাড়তেই ধপাস করে পড়ে গেল। মেয়ের প্রতি তার পুর্নাংগ চেতনা সজাগ ছিল, তার আশংখা মেয়ে আবার পড়ে যায় কিনা। ঝটকা মেরে উঠে গিয়ে ত্বরিতে দরজায় দাঁড়াল। না মেয়ে ঠিক আছে। সে হাত বাড়িয়ে মেয়েকে কোলে নিল।

বাইরে কিছুটা দুরে বিদ্যুতের আলো ঝলমল করছে। সে বুঝল ট্রেন তার সীমান্তে দাঁড়িয়ে আছে। অদূরেই বেশ কিছু দোকান পাট খোলা দেখা যাচ্ছে, সেদিকে হেঁটে চলল। মেয়েটা কোল থেকে নামতে ধাপাধাপি করছে। সে বুঝতে পারল মেয়ে হাঁটতে চাইছে। সে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল আর ডাকল, আব্বা, আব্বা, আ-আ-বা-বা, মেয়েও বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে ডাকল ‘বাব্বা বাব্বা’। হতভাগ্য বাবা আত্নহারা হয়ে মেয়েকে পাগলের মত চুমুতে লাগল আর হাসতে লাগল। বাবার মুখের সেই নির্মল হাসি বিদ্যুতের ঝলক আর সহস্র চন্দ্রের হাসিকেও ম্লান করে দেয়। সে মেয়েকে কোল থেকে নামিয়ে দিল। বাচ্চাটা মুক্ত হয়েই দৌড়তে চাইল কিন্তু পড়ে গেল। সে তুলে দিল। মেয়েটা মুক্তির আনন্দে গুটি গুটি পায়ে দৌড়ছে, পিছন ফিরে বাবাকে দেখছে, হাসছে, হাত নাচাচ্ছে আর খলখল করে হাসছে। যে হাসি এক মুমূর্ষ বাবাকে সাত নরকের যন্ত্রনা ভুলিয়ে দেয়। বাপ বেটি হাঁটছে, হাসছে আনন্দ করছে। হাঁটতে হাঁটতে তারা দোকানগুলির সামনে পৌঁছে গেল।

গভীর রাত, লোকজন খুব কম। সে মেয়ের হাত ধরে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করল। মেয়ে খেতে চাচ্ছে। সে একটা হোটেলে গিয়ে চেয়ারে বসতে চাইল আর এমনি বয়রা চেচিয়ে উঠল, ‘এই এই পাগল বাইরে যা, বাইরে যা, চেয়ারে বসবি না’। মালিক চেচিয়ে উঠল, ‘আরে পাগলটা ঘরে ঢুকল কেমনে, ওকে বাইরে বসিয়ে একটা কিছু খেতে দে। একটা ছেলে এসে ধমকাল, ‘এই পাগল বাইরে যা, বেরু বেরু। হাসান কাথায় মুখ ঢেকে দ্রুত আবৃত্তি করতে লাগল, ‘কুল আল্লাহুম্মা মালিকাল মুলকি... তার চোখ থেকে দর দর করে অশ্রু ঝড়ে পড়ছে। ছেলেটা মালিকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘উহ হু, কি পাগলের ঘরের ছাগল, বস দেহেন দেহেন ওর কাঁথাটায় কাশ আর রক্ত ছাড়া আর কিছু নাই। আর বাচ্চাটার শরীর গুয়ে মাখা। মালিক বলল, ‘বাইরে বসিয়ে একটা কিছু খেতে দে, পাগলদের খাওয়াতে হয়’। হাসান মেয়েকে নিয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। ছেলেটা দুইটা শুকনা রুটি একটু ডাল নিয়ে এল। হাসান পকেটে হাত দিয়ে টাকা বের করে বাড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমি কিনে খাব, ভাত খাব। ছেলেটা ডেকে বলল, ‘বস, পাগল রুটি খায় না ভাত চায়। ‘টাকা আছে’ বলে মালিক এ দিকে তাকাল, তার হাতে অনেকগুলি টাকা দেখে সন্তুষ্ট হয়ে বলল ‘দে যা চায়’। ছেলেটা ভাত নিয়ে এসে বলল, ‘মাছ, গোশত, ডিম, ইলিশ, রুই, মুরগী কোনটা দিব’। হাসান ভাবল, ‘মেয়ে গোশত ও মাছ পসন্দ করে, আবার রুই মাছে কাটা কম। সে অর্ডার দিল ‘গরু গোশত ও রুই মাছ দাও’।

সে মেয়েকে কোলে নিয়ে হোটেলের সামনে মাটিতে চারজানু হয়ে বসে পড়ল। তারপর হাত ধুয়ে মেয়েকে খাওয়ানো শুরু করল। মেয়ে গোগ্রাসে কিছুক্ষণ খেল, তারপর খেলা ও হাঁটাহাঁটি শুরু করল। এবার সে নিজে খাওয়া শুরু করল। মেয়েকে ধরে এনে খাওয়ায় এবং নিজেও খায়, তার কাশি আসতে চাইল কিন্তু কঠিনভাবে তা দমিয়ে রাখল। সাধারণত খাওয়ার সময় কাশি আসে। এভাবে বাপ বেটি দু’জনে ভরপেট খেল, সে টাকা দিয়ে ঠায় বসে আছে। মেয়েটা হাসছে, খেলছে ও দৌড়াদৌড়ি করছে। কয়েকদিন পর মুক্তির আনন্দটা তার দেহে উপছে পড়ছে। সেই আনন্দ স্রোতে বাবা ভেসে যাচ্ছে আর সন্তানের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। বাচ্চাটা একটু দুরে চলে গেল। সে উঠে বাচ্চার কাছে গেল কিন্তু বাচ্চা দৌড়ে, পিছন ফিরে বাবাকে দেখে খলখল করে হাসে আর দৌড়ে, আসলে এখন তার খেলার সময়। অসহায় বাপ- বেটির অন্তিম এবং ক্ষণিকের এই খেলা দেখে রাতের প্রকৃতি গুমরে কেঁদে উঠে।

হঠাৎ হাসান পেটে কামড় অনুভব করল। আশ পাশে কোন বাথরুম নাই, থাকলেও লাভ নাই। সেখানে কোন পাগলের গমন সুলভ হবে না। তবুও সমস্যা নাই, গ্রামাঞ্চল, একটু দুরেই অন্ধকার। আবার শ্রাবন মাস, পানির অভাব নেই। সে মেয়েকে কোলে নিয়ে অন্ধকারের দিকে চলে গেল। তারপর পুনরায় আলোর কাছাকাছি এসে বাচ্চাকে হাগা মুতা করাতে চাইল। হাফ পেন্ট খুলল কিন্তু অবাক হয়ে গেল। কাচা শুকনা পায়খানা আস্তর পড়ে আছে। তারপর মেয়েকে নিয়ে একটা জলার পাশে গিয়ে কোমর পর্যন্ত ভাল করে ধৌত করল। তারপর আবার ফিরে এল। কিছুক্ষণ ঘোরাফিরা করল। মেয়েও খেলা করল।

ইতিমধ্যে ট্রেনের বাঁশি বেজে উঠল। সে বুঝল ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। সে মেয়ের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে তার নির্ধারিত বগিটার কাছে গেল কিন্তু বাচ্চা কোলে নিয়ে উঠার সাহস পেল না। গ্রামাঞ্চল, যাত্রী নাই, হঠাৎ দুয়েক জন দেখা যাচ্ছে। সে অনেককে অনুনয় করতে লাগল, ‘ভাই আমি অসুস্থ, আমার মেয়েটাকে একটু তুলে দেন কিন্তু পাগল দেখে কেউ এগিয়ে এল না। অবশেষে কৃষক গোছের একজন লোক লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পড়া, মুখে দাড়ী- তিনি সাহায্য করলেন। হাসান বাচ্চাকে নিয়ে গিয়ে তার আগের জায়গায় বসল। সে মাথা ঘুরিয়ে বগিতে লোকজন খুজতে লাগল, কাউকে দেখলে অনুরোধ করবে তাকে যেন ময়মনসিংহ নামিয়ে দেয়। কিন্তু একটা লোকও নাই। একে তো প্রথম ষ্টেশন, তার উপর শেষ রাতের গাড়ি, লোকজন নাই। গাড়ী সাপের মত ফোস ফোঁস করে অজগরের মত হেলে দুলে চলতে শুরু করল। তার মনে হল আর সাথে সাথে মেয়ের জামা ও কাঁথার কোণায় গিট্টু দিল। তারপর টয়লেটের দেয়ালে ঢেস দিয়ে গাড়ীর তালে তালে ঢুলতে লাগল। আর কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে পড়ল, মেয়েও কাঁথার নীচে বাবার কোলে ঘুমিয়ে পড়ল।

কিন্তু খুব শীঘ্রই তার কাশি শুরু হল। আজ রাতে এ পর্যন্ত কাশ উঠে নাই। শুরু হয় কাশি, প্রচণ্ড কাশি, কাশতে কাশতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। মেঝেতে গড়াতে থাকে আর কাশতে থাকে। পাগলের মত কাশছে, মুখ ভরে কাশ ও রক্ত বেরিয়ে আসছে, ঠোঁট ও গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। এর উপর দিয়ে গরাগরি করছে আর কাশছে, রক্তে স্থানটুকু ভেসে গেল। কাশির তীব্রতায় এক সময় দেহটা নিথর হয়ে মেঝের উপর পড়ে রইল। গাড়ি বিভিন্ন ষ্টেশনে থামছে আর লোকজন উঠছে কিন্তু পাগলটার ধারে কাছে কেউ দাঁড়াচ্ছে না। কারণ জায়গাটা কফ, কাশ ও রক্তে ভেসে গেছে।

এই দুনিয়ার রঙ্গ মঞ্চে হায় আমরা সবাই অভিনেতা। হ্যাঁ, পৃথিবীর এই রঙিন রঙ্গ মঞ্চে সবাই অভিনেতা, সবাই নিজ নিজ রুল পারফর্ম করার জন্য ব্যস্ত, ছুটছে, উর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। পাশ ফিরে দেখে না, পিছনে ফিরে তাকায় না, পায়ের তলায় দৃষ্টি বুলায় না, দুস্থ মানুষের প্রতি হাতটি বাড়িয়ে দেয় না। কত বিপন্ন মানবতার দেহ দু’পায়ে মাড়িয়ে যাচ্ছে, কত তাজা ফুল পদতলে পিষ্ট করছে। পথের ধারে কত ফুটন্ত গোলাপ পড়ে পড়ে শুকিয়ে যাচ্ছে, কত মুকুল ঝরে যাচ্ছে, কত প্রতিভা পথের ধুলায় লোটুপুটি খাচ্ছে। কত সম্ভবনাময় প্রতিভা, কত মায়ের সন্তান হয়ত একটু মাথা ঘুরিয়ে রাস্তার ধারে পড়ে গেছে কিন্তু স্বার্থের ঠুলিতে অন্ধ এই পৃথিবী আর পৃথিবীর মানুষ দু’টি মিনিট নষ্ট করে তার দিকে হাতটি বাড়িয়ে দেয় না। তার মাথাটা একটু তুলে ধরে মুখে এক ঢোক পানি দেয় না, জিজ্ঞেস করে না ‘ভাই তুমি কোথায় যাবে’। দু’টি পয়সা খরচ করে তার জীবন বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসে না। এভাবে কত মায়ের বুক খালি হচ্ছে, কত সন্তান ইয়াতিম হচ্ছে, কত নারী বিধবা হচ্ছে, কত ফুল শুকিয়ে যাচ্ছে, কত ফুটন্ত মুকুল ঝরে যাচ্ছে কিন্তু তাতে এই পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষের কোন মাথা ব্যথা নেই।

কারণ স্বার্থ হানাহানির এই পৃথিবীতে এটাই নিয়ম এটাই বিধান। এখানে বন্ধু তোমার হাতে মধু থাকলে মশা মাছি মৌমাছির অভাব থাকবে না, সবাই তোমায় চেটে পোটে খাবে। কিন্তু একটু মাথা ঘুরিয়ে পরে দেখ, তোমার দেহটা পথের পাশেই পড়ে থাকবে, তোমাকে টেনে তোলার জন্য এক মিনিট সময় দেয়ার কেউ থাকবে না, তোমার মুখে এক ঢোক পানি দেয়ার মত পণ্ডশ্রম কেউ করবে না, তোমার জীবন বাঁচাতে একটি পয়সা খরচ করার মত দরাজ হস্ত কাউকে পাবে না। এটাই এই নরকপুরীর কানুন। এটাই এই পৃথিবী আর পৃথিবীর মানুষের সাথে তোমার সম্পর্ক। একটা মানুষ রক্তস্নাত হয়ে ট্রেনে পড়ে আছে, একটা শিশু পাশে বসে আছে কিন্তু কেউ সেদিকে ফিরেও তাকায় না, একটু এগিয়ে আসে না, মাথায় সহমর্মিতার হাত বুলিয়ে দেয় না, টেনে তুলে না, একটু জিগায় না, ‘ভাই কোথায় যাবে, কোত্থেকে এসেছ’।

ট্রেন জামালপুর ও ময়মনসিংহ ষ্টেশনে থেমেছে, কত লোকজন উঠছে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ত হাসানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অথবা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। কেউ হয়ত তার থেকে উপকৃত হয়েছে অথবা সে হয়েছে। কত জনের সাথে হয়ত কত হাসি আনন্দ করেছে, সাহায্য করেছে, উপকার করেছে। কত জন হয়ত তার ছাত্র বা তার অনুগত। কিন্তু তার বিপন্ন পতিত দেহটির দিকে কেউ ফিরেও তাকাল না। কেউ কেউ হয়ত দূর থেকে সুচিভেদ্য ভিড় ঠেলে একটু আরামে দাঁড়ানোর জন্য এগিয়ে এল কিন্তু কাছে এসেই, ‘উহ হু, কি নোংরা রে বাবা, ট্রেনটা পচিয়ে ফেলেছে’ বলে নাক সিটকিয়ে সরে যায়, দুরে চলে যায়। এভাবেই এক হতভাগ্য মায়ের সন্তান পুটিনের মত জমাট রক্তের পঙ্কে শুয়ে থাকে, আর তার দুই বছরের শিশু সন্তান পাশে বসে বসে কাঁদে।

বিষয়: সাহিত্য

১৩৭৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File