কবর-৭০-৭১ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ০৪ জানুয়ারি, ২০১৭, ১১:৩৪:৫৭ সকাল
পরিণতির পথে
নূরানি শুধু রুপবতি ও গুণবতীই ছিল না, তার ব্যক্তিত্বও ছিল প্রবল। আর ফেরদৌসি ছিল তার ব্যক্তিত্বে প্রভাবিত। পটেটোর ভাই সোলেমানের জন্য ফেরদৌসির বিয়ের আলাপ হয়েছিল কিন্তু দরিদ্র পরিবার ও অর্ধ শিক্ষিত ছেলে দেখে বিয়ে দেয়নি। তখন শৃগালের মত ধুর্ত পটেটো নুরানিকে ফেরদৌসির পিছনে লেলিয়ে দেয় এই বলে যে, ‘এত দুরে গিয়ে তুমি একা থাকতে পারবে না, তোমার একটা বোনকে সাথে নিয়ে যাও। তখন নূরানি ফেরদৌসিকে ফুসলাতে থাকল, ‘দেখ সোলেমান একদিন ভাল চাকরি করবে। তার সাথে তোর বিয়ে হলে তোরা আমরা একসাথে বাসা করব। তুই আর আমি একসাথে থাকব’। নূরানিকে সবাই ভালবাসত, পুরুষরা ভালবাসত তার রূপ সৌন্দর্যের কারণে আর নারীরা ভালবাসত তার গুণ ও ব্যক্তিত্বের কারণে। আর নূরানির রূপ, গুণ ও ব্যক্তিত্বের প্রভাব ফেরদৌসির উপর তো ছিলই, তার উপর ছিল বড় বোন। সে নূরানিকে নিজের প্রাণের চেয়েও অধিক ভালবাসত। কাজেই নূরানির সাথে বাসা করা একসাথে থাকা তার স্বপ্নে পরিণত হল, এটাকে সে চরম সৌভাগ্য মনে করল। সঙ্গত কারণেই যদিও সোলেমানের দিকে তার কোন আকর্ষণ ছিল না কিন্তু নূরানির কথায় সে আকৃষ্ট হয়ে পড়ল। পৃথিবীতে যত প্রেম সংগটিত হয়, তার অধিকাংশই মেয়েদের মধ্যস্থতায় গড়ে উঠে। কাজেই নূরানির মাধ্যমে ফেরদৌসির মধ্যেও সোলেমানের প্রেমরস সিঞ্চিত হয়ে গেল। তদুপরি নূরানি যখন বরিশাল যেত তখন বিশেষ উদ্দেশ্যে ফেরদৌসিকে সাথে করে নিয়ে যেত। আর তখন পটেটোর পরিবার তাকে পুত্রবধু হিসাবে অভিষেক করে নেয়। আর এভাবেই সোলেমানের সাথে ফেরদৌসির সম্পর্ক গড়ে উঠে।
দুনিয়াতে কিছু হতভাগা আছে- যারা চির দুর্ভাগ্য নিয়ে জন্ম নেয়, আমৃত্যু দুর্ভাগ্য তাদের পিছু তাড়া করে ফিরে। এমনি এক হতভাগা হল হাসান। ভাগ্যই তাকে এমন একটা নষ্টা মেয়ের সাথে গাটছড়া বেধে দেয়। হাসানের সাথে বিয়ের আলাপ হচ্ছে এটা ফেরদৌসি জানত না, হঠাৎ একদিন এশার পর তাকে ঘুম থেকে টেনে তুলে পাশের রুমে দেখাতে নিয়ে যাওয়া হল। ফেরদৌসি তখন রাগে আপাদমস্তক অগ্নিবৎ উত্তপ্ত হয়ে আছে। বরবেশি হাসানকে সে সহ্য করতে পারছিল না। এ জন্যই হাসান তাকে বারবার দেখতে চাইলেও দেখতে দেয়নি, কোন কথার উত্তর দেয়নি, শুধু রাগ দেখিয়ে গেল। একবার বর জিজ্ঞেস করল, আমি তো মাদরাসার শিক্ষক, আর মাদরাসা শিক্ষকদের টাকা-পয়সা কম থাকে বিষয়টা কি আপনি মেনে নিবেন? ফেরদৌসি তখন রাগে কি বলবে দিশা না পেয়ে ঝংকার দিয়ে বলে উঠল, ‘আমি অভিভাবকদের অবাধ্য নই’। ফেরদৌসি আশা করেছিল একথার পর লোকটা চলে যাবে।
কিন্তু অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস, যদিও পাত্রের পাত্রী পসন্দ হয়নি, আবার পাত্রীর রয়েছে অন্যত্র পসন্দ তবুও ফেরদৌসির অভিভাবক এবং বিয়ে মজলিসের অন্যান্যদের চাপে উভয়কে বিয়ের পিড়িতে বসতে হল। আর এ সময়টা ছিল ফেরদৌসির জন্য মরণ সংকটকাল। কারণ সে বারবার বলতে চেয়েছে যে, সে সোলেমান ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবে না কিন্তু সাহস পায়নি। সাহস পায়নি কারণ তার বড় সাতটি বোন, তাদের মধ্যে কেউ কোনদিন প্রেম করেনি, বিয়ের ব্যাপারে অভিভাবকদের কর্তৃত্বে নাক গলায়নি। কাজেই সে কি করে সোলেমানের কথা বলবে, কি করে অবাধ্যতা করবে। এই দ্যুদোল্যমানতার মধ্যেই ইযিন আদায়কারীগণ তার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পেশ করতে গেল, কবুল চাইল। আর এ সময় সে অসহায় হয়ে কাঁদতে লাগল যেন তার জীবন ধ্বংস হয়ে গেল, ইহলোকে তার চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাংখা সব শেষ হয়ে গেল। তার হুস নাই, আকুল হয়ে কাঁদছে, সংজ্ঞা হারানোর উপক্রম।
ওদিকে পর্দার আড়াল থেকে প্রস্তাবকারীরা বারবার বলছে কবুল বলেন, আর পর্দার ভিতর থেকে তার বোনেরা তাকীদ করছে কিন্তু ফেরদৌসি শুধু আকুল হয়ে কাঁদছে, কারণ সে জানে এই কবুল বলার সাথে সাথে সে সর্বাহারা হয়ে যাবে, নিঃস্ব হয়ে যাবে। তার জীবনের স্বাদ আহলাদ বলতে আর কিছুই থাকবে না, যৌবনের যে কুসুম কলিটি রং ধনুর সাত রং মেখে গোলাপের সুবাস ছড়িয়ে দেশ গাঁও মাতোয়ারা করে ফুটতে যাচ্ছে তা মুকুলেই ঝরে যাবে। একটা ভিনদেশী অপরিচিত ভ্রমর গোলাপাভ্যন্তরের ছিদ্র পথে হুল ফুটিয়ে ফুটিয়ে মধু চোষে নিবে আর তখন তার প্রাণনাথ, তার কলিজার টুকরা সোলেমান পথে বসে কাঁদবে। এই কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা তার ছিল না। সে কাঁদতে কাঁদতে প্রায় অচেতন হওয়ার উপক্রম। তখন ফেরদৌসির বড় বোন নিম্নস্বরে বলল, ‘ক কবুল’। আর এই ‘কবুল’ শব্দটা পর্দার আড়াল থেকে প্রস্তাবকারীরা শুনে মনে করল এটা ফেরদৌসির স্বীকৃতি, তারা চলে গেল। আর এ ভাবেই অন্যের একটা উচ্ছিষ্ট চির কমবখত হাসানের গলায় ঝুলে পরল চির কলংক ও চির অভিশাপ হয়ে। ৪ঠা এপ্রিল, ২০০৩ সাল, তাদের বিয়ে হয়ে গেল।
বিয়ের পর ফেরদৌসি ভেঙ্গে পরল, মরার মত বিছানায় পরে থাকে, দানা পানি ছেড়ে দিয়েছে, উসকু খুসকু চুল, ফালতু নোংরা জামা কাপড় পরে থাকে। মাঝে মধ্যে আয়নায় গিয়ে দাড়ায় আর তার আত্নাটা শতমুখে হাহাকার করে উঠে, গুমরে গুমরে কাঁদে। সে আহামরি সুন্দরী না হলেও যথেষ্ট সুন্দরী, কিন্তু নিজের চোখে সে নিজেকে দেখে আর ভাবে সেই তো শ্রেষ্ঠ সুন্দরী। তার মত সুন্দরী ও লম্বা মেয়ে মার্কেটে বড় বেশি একটা দেখা যায় না। সে আয়নার সামনে খুটে খুটে নিজেকে দেখে। গোলাপের পাপড়ির মত ঠসঠসে দু’টি গালে হাত বুলায়, এই নরম তুলতুলে দু’টি গাল একটা অপরিচিত দানবের দন্তপিস্ট হবে। রক্তজবার মত দু’টি ঠোঁটে আঙ্গুল বুলায়, অন্যের ওষ্ঠাধর এখানে চেপে বসবে। বুকে হাত বুলায়, এই কুসুম কোমল দু’টি ডালিমের রসে অন্যের অঞ্জলি ভরবে। কোথায় সোলেমান আর কোথায় সে। আজ সোলেমানের সম্পদ অনের হস্তগত হয়ে গেছে, এই উর্বর দেহ, এই উর্বসি যৌবন, এই মধুময় যৌবনের মধু পিপড়ায় খাবে কিন্তু হকদার পথে বসে কাঁদবে। সে কাঁদে আর ভাবে, ‘কোথাকার একটা ফেউ উড়ে এসে আমার উপর জোড়ে বসেছে। আমার এ রূপ লাবন্যময় দেহটা চিড়ে ফেড়ে খাবে’। সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, মনে কষ্টের তুষার- পাহাড় গলে গলে চোখ দিয়ে ঝরতে থাকে। তার শরীরে কোন শক্তি নেই, দেহের জোড়াগুলি যেন ছেড়ে দিয়েছে, সে অবশ হয়ে বিছানায় পরে থাকে।
পরদিন, ৪ঠা এপ্রিল। বিকালে তার নওশা নামের ঐ অপরিচিত লোকটা এল, কিন্তু তার আত্মা খাচায় বন্দী পাখীর মত ধড়পড় শুরু করেছে, তার সামনে যেতে কোন ভাবেই মন সায় দিচ্ছে না। কিন্তু বোন ও ভাগ্নিরা তাকে ঠেলে ঠুলে ধাক্কিয়ে পাশের রুমে পাঠিয়ে দিল। লোকটা নিরাপদ দুরত্বে বসে বসে কিছুক্ষণ বকবক করে চলে গেল সেও হাফ ছেড়ে বাঁচল। কারণ তার আশংখা ছিল তাকে দেখেই লোকটা বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পরে কিনা কিন্তু তেমন কিছু হয়নি। মনে হয় লোকটা ভীতু, কাপুরুষ। কারণ কথা বলার সময় তার কণ্ঠ কাঁপছিল, জিহ্বা জড়িয়ে আসছিল। আর কথা যা বলল, মোটামোটি মন্দ না। সে সারা জীবন কষ্ট করেছে, ছোট বেলা থেকে বাপ নাই, এখন স্ত্রীর কাছে মানে আমার কাছে শান্তি চায়, সে আমাকে কোনদিন কষ্ট দিবে না। হ্যাঁ, কথাগুলি ভালই কিন্তু হায়, এই কথাগুলি যদি আজ সোলেমান বলত তাহলে কতই না ভাল হত, আমার জীবনটা ধন্য হত।
তার পরদিন, ৫ই এপ্রিল। বিকালে লোকটা আবার এল। সে আসতে চায় না কিন্তু তার বোন ভাগ্নিরা আবার তাকে জোর করে ধাক্কিয়ে পাশের রুমে পাঠিয়ে দিল। এ অবস্থা হবে জানলে তাকে মেরে ফেললেও আসত না। সে এসে খাটের এক কিনারায় বসল। লোকটা অপর প্রান্তে বসা কিন্তু মুখে কোন কথা নেই, ফসকে ফসকে তার কাছে এসেই খপ করে জড়িয়ে ধরে গালের উপর ঠোঁট বসিয়ে দিল, মনে হল যেন গালের উপর বুলতা চেপে বসেছে, গালটা পোড়ে যাচ্ছে। তারপর ঠোঁটে ঠোঁট বসিয়ে দিল, মনে হল যেন বিছে পোকা ঠোঁটটা কুটকুট করে কামড়ে দিচ্ছে, ঠোঁটটা বুঝি পচে গেল। তারপর বুকে এমন চাপ দিল যে, ডালিমের দু’টি মুকুল যেন গলে গেল। মনে হচ্ছিল, কোন দৈত্য বুকের দুটি মাংস পিন্ড ছিড়ে নিয়ে যাচ্ছে। ব্যথায় ককিয়ে উঠে সে অসহায়ভাবে বিছানায় গা ছেড়ে দিল কিন্তু পাষাণ লোকটা তাকে ছাড়ল না, টেনে তুলে কসাইয়ের মত তার বুকে মুখে সমস্ত শরীরে হাত চালাল। কিন্তু সে ছিল অসহায়, কিছু বলার ও করার ক্ষমতা তার ছিল না, কারণ অভিভাবকরা তার কাছে বিয়ে দিয়েছে, সে স্বামী, বৈধ অধিকারী। কাজেই নিরুপায় হয়ে ঐ অপরিচিত পিশাচটার হাতে নিজের দেহটা সমর্পন করে দেয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকল না।
অবশেষে দানবটা তাকে ছেড়ে চলে গেল। সে দুঃখের জ্বলায় দগ্ধ হয়ে পাশের রুমে গিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদল। কারণ এই লোকটা তার দেহের হকদার নয়, অন্যায় ভাবে সে তার দেহটা ব্যবহার করেছে। অথচ প্রকৃত হকদার যে-সে কোন সুদুরে পরে থেকে মাটিতে গড়াগড়ি করছে। হয়ত সে তারই জন্য রাস্তায় পরে চোখের জলে পথের ধুলো ভিজাচ্ছে বা বিছানায় পরে বালিশ ভিজাচ্ছে।
বিয়ের সাতদিন পর অনুষ্ঠানের তারিখ হল। তার কোন সাজ-গোজ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না কিন্তু লন্ডনি খালা তো ছাড়ল না। তিনি ফুল চন্দন দিয়ে সাজিয়ে, শাড়ি গহনা পরিয়ে একেবারে পরী বানিয়ে ছাড়লেন। এদিনই তার মিন্স শুরু হল। অনুষ্ঠান শেষে নানি দানবটার কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন অসুখ আছে সাবধানে থেকো। এই বোকা লোকটা নানীর কথা বুঝতে পারেনি, তার দিকে রাক্ষসের মত তাকিয়ে ছিল যেন জীবনে এমন পরি দেখেনি। হঠাৎ উঠে বলল, তুমি শাড়িটা পাল্টাও আমি আসছি বলে বাইরে গেল। নববধূ বুঝল দানবটা এখনি এসে ঝাপিয়ে পরবে। কিন্তু তাকে এই রূপ সৌন্দর্য্য ভোগ করতে দেয়া হারাম। কাজেই সে সাথে সাথে উঠে গিয়ে চন্দন ধুয়ে, কাপড় পাল্টিয়ে পুরানো ময়লা কাপড় পরে কাজের মেয়ের মত বসে থাকল। লোকটা এসে দেখে বিরক্ত হল কিন্তু নববধূ খুশি হল।
তারপর বিয়ের পনের দিন পরে হল তার বাসর শয্যা। সে বাসর শয্যায় শুয়ে আছে আর তার আত্মাটা ধুকধুক করে কাঁপছে। এ অপরিচিত লোকটা তার পাশে বসে আছে, হঠাৎ তার বুকে হাত দিল আর সাথে সাথে সে কেঁদে ফেলল। কারণ এ কয়দিন তো টালবাহানা করে কেটে গেছে, লোকটা শুধু হাত ও ঠোঁট ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে, এর বেশি কিছু করার সুযোগ ছিল না। কিন্তু আজ তো আর বাঁচার উপায় নেই, স্বামী নামের এই দৈত্যটা আজ তো তার লক্ষে পৌঁছবেই। যে সম্পদ সে সোলেমানকে দিয়েছে, তার জন্য সংরক্ষণ করেছে সেই সম্পদ এখন পোকায় খাবে। যে হাতটা তার বক্ষ মন্থন করছে এটা সোলেমানের হাত নয়, তার শত্রুর হাত। মন চাচ্ছে হাতটা ভেঙ্গে দিতে কিন্তু সম্ভব নয়, কারণ লোকটা তার বৈধ স্বামী দাবীদার। কাজেই সে অসহায় হয়ে কেঁদে ফেলল, তারপর নিরুপায় হয়ে বলল, ‘আমার যা কিছু সম্পদ সব আপনাকে দিলাম’। এ কথা বলার অর্থ হল, গত পনের দিন সে নিজেকে সোলেমানের জন্য হেফাজত করেছে সংরক্ষণ করেছে কিন্তু যখন সোলেমান এল না, কেউ কোন ব্যবস্থা করল না, কোন পথ হল না, তখন সে অপারগ হয়ে নিজেকে স্বামীর হাতে সমর্পন করল। আর সেই সুবাদে বেচারা হাসানও একটা সেকেন্ড হ্যান্ড মাল হাতিয়ে নিল।
ফেরদৌসি বিয়ের পর থেকে বাসর পর্যন্ত পনেরটা দিন অপেক্ষা করেছে সোলেমান আসবে। সে দরজায় দাঁড়ালেই তার হাত ধরে চলে যাবে, দুনিয়ার কেউ তাকে আটকাতে পারবে না। কিন্তু সোলেমান এল না। সে আশা করেছিল পটেটো ও নূরানি একটা কিছু ব্যবস্থা করবে কিন্তু তারা তো ঢাকা থেকে আসেইনি। তাছাড়া তারা সবাই ইঞ্জিনিয়ারকে ইশ্বর মানে, ভয় পায় বিধায় কিছু করতে ও বলতে সাহস পায়নি, আর ফেরদৌসিরও আশা পূরণ হয়নি। অবশেষে বারবার সে চিন্তা করেছে বরিশাল পালিয়ে যাবে। কিন্তু সেই সুদূর বরিশাল একা যেতে সাহস পেল না। আবার আশংখা করল সোলেমান যদি তাকে গ্রহণ না করে। কাজেই অগত্যা নিজের পচা নোংরা উচ্ছিষ্ট দেহটাকে একটা কুমার চরিত্রবান ছেলের হাতে সমর্পন করে দিল, তাকে ঠকাল। যদিও তাদের বিয়েই হয়নি, কারণ কবুল বলেছে তার বড় বোন, সে নয়।
চরিত্রবান ও আদর্শবান পাত্র পাত্রীর মধ্যে বিয়ে হয়ে গেলে, আর তারা একে অন্যকে পসন্দ না করলেও দৈহিক সাক্ষাতের পর পসন্দ অপসন্দের বিষয়টা উবে যায়। তারা একে অপরকে মেনে নেয় এবং ভালবাসতে থাকে, এটা প্রাকৃতিক নিয়ম। কিন্তু ফেরদৌসি বাসর শয্যার পরও স্বামীকে মেনে নিতে পারল না, স্বামীকে সে সহ্যই করতে পারত না, শত্রু ভাবত। কারণ সে মনে করত হাসান অন্যায়ভাবে সোলেমানের স্থানটি দখল করে নিয়েছে। এজন্য যদিও সে অপারগ হয়ে স্বামীকে তার দেহ দিয়েছে কিন্তু দেহ যেন সে সম্ভোগ না করতে পারে সেই চেষ্টাই করত। সর্বদা নোংরা হয়ে থাকত, পেত্নির মত মাথার চুল উসকু খুসকু হয়ে থাকত। ছেড়া ময়লা ফালতু কাপড় পরত, কাজের মেয়ের মত হয়ে থাকত। স্বামী তাকে বারবার সাজ- গোঁজ করতে বলত। এ জন্য সে কথায় কথায় স্বামীকে অপমান করত, ব্যথা দেওয়ার চেষ্টা করত। হাসান বাহির থেকে আসতেই সে গিয়ে চিমটি কেটে অথবা সামান্য চামড়ায় ধরে চিপি মেরে স্বামীকে অভ্যর্থনা জানাত। বেচারা স্বামী ব্যথায় কখনো ককিয়ে উঠত, কখনো মুতে দেয়ার উপক্রম হত। একদিন ফেরদৌসি স্বামীর পেটের চামড়া ধরে এমন চিপি মারল যে বেচারা আর্তনাদ করে একেবারে মাটিতে বসে পরল। তারপর উঠে তার গালে এক থাপ্পড় কষে মারল। এরপর থেকে ফেরদৌসি বুঝল যে, স্বামীকে এভাবে গোপন মাইর মেরে প্রতিশোধ নিতে গেলে উল্টো মার খেতে হবে। কাজেই সে চিমটানো বন্ধ করে মুখের মার শুরু করল।
কিন্তু খুব শীঘ্রই সে অবাক হল। সে ভাবতে লাগল, এই লোকটা কি আদৌ মানুষ নাকি ভীনগ্রহের কোন প্রাণী, নাকি এলিয়েন। সারা জীবন সে বিদ্যা সাগরের নাম শুনেছে, এ লোকটা কি তাহলে বিদ্যাসাগর। সে শিক্ষিত সমাজ ও শিক্ষা বলয়ের মধ্যেই বড় হয়েছে। তার বাপ চাচা, ভাই বোন ও দুলা ভাইরা সবাই শিক্ষিত কেউ অশিক্ষিত মূর্খ নেই কিন্তু এ লোকটার মধ্যে শিক্ষার যে চমক সে দেখেছে এমনটা আর কোথায়ও দেখেনি তো দেখেইনি, কল্পনাও করতে পারে না। কারণ সে মুখ থেকে যতটা কথা উচ্চারণ করে তার স্বামী প্রত্যেকটা কথা, প্রতিটা শব্দ বাংলা, ইংরেজি, আরবি, ফারসি, উর্দু বা পৃথিবীর অন্য কোন ভাষা থেকে এল, শব্দটার আভিধানিক, পারিভাষিক ও প্রায়োগিক অর্থ কি, আভিধানিক অর্থের সাথে প্রায়োগিক অর্থের কি সম্পর্ক ইত্যাদি, প্রতিটা শব্দের কুস্টি উদ্ধার করে তাকে গিলিয়ে গিলিয়ে দেয়। মনে হয় যেন সেই বাংলা শব্দ ভাণ্ডারের মা বাপ। তাছাড়া পৃথিবীর যত শাস্ত্র আছে বিজ্ঞান, কলা, সাহিত্য, চলৎচিত্র, সঙ্গীত, ইতিহাস ইত্যাদি যে কোন বিষয়ে একটা প্রশ্ন করলে সে তিনটা উত্তর দিয়ে দেয়। তাছাড়া ইসলাম ও কোরআন- হাদীস তো তার নখ দর্পনে। সে বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়ে যায়। কোন মানুষ এত জ্ঞানী হতে পারে, এটা কি করে সম্ভব। কারণ সেও তো মানুষ, ছাত্র ছিল। সে ভাবে তার স্বামীর মাথাটা একটা কম্পিউটার।
একদিন দুপুরে স্বামী এল, তাকে আদর সোহাগ করে চলে গেল। সে আর উঠল না, বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিজেকে তিরস্কার করতে লাগল ‘হায় পোড়া মুখী, হিরা ফেলে কাচের জন্য অশ্রু ঝড়াচ্ছিল, কোথায় তোর স্বামী আর কোথায় সোলেমান। বহুমুল্য মুক্তা পায়ে পিষে কচু পাতায় জমে উঠা শিশির বিন্দুতে সুর্যের প্রতিবিম্ব দেখে মুক্তা মনে করে দৌড়াচ্ছিস। সোলেমান হল একটা অর্ধ শিক্ষিত দরিদ্র পরিবারের সন্তান। আর তোর স্বামী ত্রিমুখি ধারায় শিক্ষিত একটা যথার্থ বিদ্যান মানুষ। তোর দুলাভাইরা সবাই অশিক্ষিত ফকিন্নি পরিবারের ছেলে। আর তোর স্বামী একজন বিখ্যাত ব্যক্তির সন্তান আর পারিবারিক অবস্থা ব্যবস্থাও ভাল। তোর যে কোন দুলাভাইয়ের চেয়ে তোর স্বামী উর্ধ্বে অনেক উর্ধ্বে। কাজেই এমন একটা স্বামী পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে না করে উল্টো তাকে ঠকাচ্ছিস, তার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করছিস, মূর্খ আওরত।
ফেরদৌসির মস্তক নত হয়ে আসে। সে চমকে উঠে, ‘না না, আমি আর তাকে ঠকাব না, প্রতারণা করব না’। তার মনে পরল স্বামী তাকে সাজগোজ করার জন্য কত কাকুতি মিনতি করে, অনুরোধ করে কিন্তু স্বামীকে সে পাত্তাই দেয় না। এবার সে উঠল, শ্যাম্পু, সাবান দিয়ে ভাল করে গোসল করল, তারপর রাতের অপেক্ষায় বসে থাকল। এশার পর ব্রিফকেস খুলে বসল। শাড়ি গহনা পরে মেকাপ করল, তারপর নববধূ সেজে স্বামীর জন্য বসে থাকল। কিছুক্ষণ পর স্বামী এল, সে দরজা খুলল, আর বেচারা তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। মেঘের আবর সরে গেলে সুর্য মুখের ন্যায় তার স্বামীর মুখটাও খুশিতে ঝলমল করছে। স্বামী অভিনয় করতে বলল, বাইরে গিয়ে আবার ঘরে ঢুকল, সে প্রথম বারের মত স্বামীকে সেলাম করল, এরপর থেকে প্রতিরাতে এ অভিনয় চলতে থাকে।
কিন্তু ফেরদৌসি স্বামীর ভাবভঙ্গি ও কথার বিভিন্ন ইঙ্গিতে খুব শীঘ্রই বুঝতে পারল স্বামী তাকে পসন্দ করেনি। চাপে পরে দুর্ঘটনাক্রমে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিয়েটা হয়ে গেছে, সে প্রমাদ গুনল। কোথায় না সে স্বামীকে অবজ্ঞা অবহেলা করতেছিল কিন্তু এখন বুঝল যে সে নিজেই স্বামীর অবজ্ঞার পাত্রী। কিন্তু এখন তো অপারগ অবস্থা, বিয়ে হয়ে গেছে ঘর সংসার হয়ে গেছে, এখন তো সোলেমানও তাকে গ্রহণ করবে না। অগত্যা সে নিরুপায় হয়ে স্বামীকেই একমাত্র উপায় হিসাবে স্থির করল। এর মধ্যে ঘটল আরেক ঘটনা, হাসান বাড়িতে গেল, গৃহস্থালি ঝামেলায় তার আসতে দেরি হচ্ছিল। তখন একদিন বজলুর বউ এসে তার বড়াপাকে বলল, ওকে এত দুরে বিয়ে দিলে এখন যদি জামাইটা আর না আসে তখন কী হবে। ফেরদৌসি ছিল বোকা, এ কথা শুনার পর সে ভাবতে শুরু করেছে স্বামী তাকে ফেলে চলে যাবে। সে স্বামীকে ভয় পাওয়া শুরু করল, কিন্তু তাই বলে ঝগড়ার কমতি ছিল না।
কারণ সে ছিল ভয়ঙ্কর ধরনের বদমেজাজি এবং মুখরা। তার উপর ছিল চূড়ান্ত পর্যায়ের আত্মশ্লাঘা। আবার এ পরিবারের মেয়েরা স্বামীর সংসারে সার্বিক কর্তৃত্ব করে, স্বামীকে দাসের মত ব্যবহার করে। ফেরদৌসি যদিও বোকা ছিল কিন্তু তার মধ্যে এ স্বভাবটা ছিল প্রবল, সে চাইত স্বামী তার আঙ্গুলের ইশারায় উঠবে, বসবে। কাজেই স্বামী তাকে কোন কিছু বুঝাতে চাইলেই সে অপমান বোধ করত। আর তখন স্বামীর সাথে ঝগড়া হত, ঝগড়ার পর হাসান উঠতে চাইলেই সে মনে করত স্বামী বুঝি তাকে ফেলে চলে যাচ্ছে। আর তখন সে স্বামীকে ঝাপটে ধরত আর কাঁদত। এভাবে বছর খানেক চলে গেল। ইতিমধ্যে তারা গিয়ে বাসায় উঠেছে, মুনিরা পৃথিবীতে এসে গেছে। এভাবেই ঝগড়া ও মান অভিমানের মধ্যে সময় যাচ্ছিল।
৭১
আবার নূরানি এসে বিপত্তি ঘটাল। সোলেমান তখনো বিয়ে করেনি, কোথাও বিয়ে পাচ্ছে না, অপারগ হয়ে নূরানির কাছে প্রতিদিন রাতে কল করে বিয়ের কথা বলে, ‘ভাবী ঘুমে ধরে না, মাথার চুল পেকে যাচ্ছে একটা কিছু ব্যবস্থা করেন’। নূরানি ঢাকায় থাকে। সে জামালপুর এসে ফেরদৌসিকে এসব জানিয়ে বলে, ‘তুই যে কী করলি, কেন সোলেমানের জন্য অপেক্ষা করলি না, তোর জন্য ওর জীবনটা নষ্ট হল। এখন আমাকে খালি কল করে আর বলে, ভাবী ঘুম আসে না, একটা কিছু ব্যবস্থা করেন’। আর ফেরদৌসি ছিল এমনই বোকা যে, সে ভাবল, সোলেমান এখনো তার জন্য অপেক্ষা করছে, আর নূরানিকে বলছে ব্যবস্থা করতে, মানে স্বামীর ঘর ছেড়ে সোলেমানের ঘরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে। তার মন উচাটন হয়ে উঠে।
এরপর থেকে নূরানি যতবার ঢাকা থেকে জামালপুর আসে ততবার ফেরদৌসিকে শুধু একটা বার্তাই শুনিয়ে যায়, সোলেমান প্রতিদিন তাকে কল করে বলে, ‘তার ঘুম হয় না, মাথার চুল পেকে যাচ্ছে, বুড়ো হয়ে যাচ্ছে, একটা কিছু ব্যবস্থা করতে’। আর এজন্য নূরানি তাকেই দোষারোপ করে। ফেরদৌসি এসব সংবাদ শুনতে থাকে আর পাগল হয়ে উঠতে থাকে। সোলেমানের চিন্তা তার মন ও মস্তিস্ক আচ্ছন্ন করে ফেলে। তখন দ্বিতীয় বাসায় উঠেই সে স্বপ্ন দেখল দু’জন লোক তার জন্য অপেক্ষা করছে, একজন হাতে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে আরেকটি লোক এমনিতেই দাঁড়িয়ে আছে। সে স্বামীকে পরোয়া করত না। তাই স্বামীর সামনে ব্যাখ্যা করল, ‘সোলেমান মোমবাতি জ্বালিয়ে আমাকে খুঁজছে, আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আর অপর লোকটি হলেন আপনি, কই আপনি তো আমার জন্য মোমবাতি জ্বালিয়ে অপেক্ষা করেন না। আপনার চেয়ে আমার জন্য সোলেমানই ভাল’। তার বিশ্বাস হয়ে যায়, সোলেমান তার প্রতিক্ষায় আছে।
আর তজ্জন্য সে স্বামীর উপর শুরু করে পাশবিক টর্চার যেন স্বামী তাকে তালাক দিয়ে দেয়। স্বামী ও তার পরিবারকে গালাগাল করে, সর্বদা হেয় প্রতিপন্ন করে। নিজেই ঝগড়া করে উল্টো স্বামীকে মাফ চাওয়ায়, পায়ে ধরায়। তবুও স্বামী তালাক দেয়না। তখন সে নিজেই তালাক লিখা ও ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া শুরু করল। কিন্তু তাতেও কাজ হয় না, স্বামী তাকে হাতে পায়ে ধরে আটকে রাখে, কাঁদে, মাফ চায়। তখন সে মাঝে মধ্যে চিন্তা করত, কেন যাব, এমন একটা ধৈর্য্যশীল ভাল মানুষ তো পাব না। স্বামীকে যেহেতু সে পরোয়া করত না, দাস মনে করত, এজন্য মাঝে মধ্যে বলত, ‘আমি কবেই চলে যেতাম কিন্তু আপনার মত ধৈর্য্যশীল আর পাব না, এ জন্যই যাই না’।
কিন্তু যখনই সোলেমানের কথা তার স্বরণ হত তখনই পাগল হয়ে উঠত, আর নিজেকে ধরে রাখতে পারত না, বেপরোয়া হয়ে উঠত। সোলেমানের জন্য স্বামীর সামনে আকুল হয়ে কাঁদত, সোলেমান তাকে ভালবাসত, তার সাথে বিয়ে হলে কত ভাল হত ইত্যাদি বলত আর মাতম করত। এছাড়া স্বামী ও তার পরিবারকে গালাগালি করা, তালাক লেখা, ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া, তালাক চাওয়া ইত্যাদি নারী চরিত্রের বিপরীত কর্মকান্ড তার রুটিন কর্ম হয়ে দাঁড়াল। মানুষ ভুল করে, ভুল স্বীকার করে, মাফ চায়। যে ভুল করে কিন্তু স্বীকার করে না, সে হল আযাযিল শয়তান। আর বাহ্যত বুঝা যায়- ফেরদৌসির মধ্যে রয়েছে এই আযাযিলের চরিত্র। কারণ সে স্বামীর সাথে আড়াই বছরের জীবনে যত অন্যায় করেছে কোন দিন মাফ চাওয়া বা ভুল স্বীকার করা বা অনুতপ্ত হওয়া তো দূরের কথা, এতটুকুও বলেনি যে, ‘এটা করা বা বলা আমার ঠিক হয়নি বা অনুচিত হয়েছে’। এতে বুঝা যায় এ মেয়েটা আযাযিল শয়তান।
কিন্তু আসলে তা নয়, সে এতটা খারাপ মেয়ে নয়। আসল ঘটনা হল মানুষ তো তখনি ভুল স্বীকার করে বা মাফ চায় যখন সে অনিচ্ছাবশত ভুল করে এবং আপোষ চায়। কিন্তু ফেরদৌসি যা করত ইচ্ছাকৃত ভাবে করত, আর সে কোন আপোষ চাইত না। তার ইচ্ছা ছিল স্বামীকে তাতিয়ে চটিয়ে যেভাবেই হউক তার কবল থেকে মুক্ত হয়ে সোলেমানের করতল গত হওয়া। এজন্যই সে কখনো ভুলও স্বীকার করত না, মাফও চাইত না। এমনকি আম কেটে দেয়ার মত সাধারণ কথার জন্য শাশুড়ির চুলে ধরার মত জঘন্য কথা সাধারণত কোন নারী বলে না। বললেও মাফ চায়, ভুল স্বীকার করে কিন্তু ফেরদৌসি তা করেনি। আর করেনি কারণ সে স্বামীর সাথে আপোষ চাচ্ছিল না, চাচ্ছিল ভাঙ্গন ও মুক্তি।
কিন্তু এই মেয়েটা ছিল প্রকৃতই বোকা এবং পাগল। যখন তার মনে হত সোলেমান তাকে গ্রহণ করবে না, তখন আবার হাসানের অনুগত হয়ে যেত কান্নাকাটি করত। অবশেষে মাকে চুলে ধরার কথা বলার পর হাসান গিয়ে বিচার দিল আর ফেরদৌসি তার বড় বোনের বাসায় গেল। তার আশংখা ছিল এত বড় কথার জন্য বড় বোন তাকে শাসন করবে মারবে। কিন্তু সে কিছুই বলল না বরং আরো প্রশ্রয় দিল। ইঞ্জিনিয়ার বলল তাকে বাসা বাড়ি করে দিবে, সারা জীবন চলার ব্যবস্থা করে দিবে। ফলে লায় পেয়ে মেয়েটার মাথা সত্যিই বিগড়ে গেল। সে এলোপাথারি স্বামীর বদনাম শুরু করল যাতে সোলেমানের ঘরে যাওয়ার পথ তার জন্য সুগম হয়।
ইতিমধ্যে দুই সপ্তাহ কেটে গেছে। সবাই আসল, পটেটো ও নূরানি আসল কিন্তু কেউ তাকে বলল না ‘চিন্তা করিস না, তোর জন্য সোলেমানের বা অন্য কোন ব্যবস্থা করব। ইতিমধ্যে ইঞ্জিনিয়ার ও তার বউ তালাকের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। আর তখনই তার টনক নড়ল। কারণ যার জন্য সে এত কিছু করে যাচ্ছে সেই সোলেমানের কথা যখন কেউ কিছুই বলল না তখন সে নিরাশ হয়ে গেল আর স্বামীর কথাগুলি তার স্বরণ হতে লাগল। হাসান তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে কখনো বলত, ‘তোর কান্নায় গাছের পাতা ঝরে পড়বে, মানুষ, পশু, পাখি এমনকি পাথর পর্যন্ত কাঁদবে। কখনো বলত, ‘এই মাগী এত তালাক তালাক করস, তালাক দিলে কি করে খাবি, তোর বাপের তো জমিদারিও নাই, তখন তো ভিক্ষা অথবা বেশ্যাবৃত্তি ছাড়া কোন উপায় থাকবে না’। কাজেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠল নিজের হাতে ভিক্ষার ঝুলনা অথবা বেশ্যালয়ের পতিতা। আর তখনই সে কান্নাকাটি জুড়ে দেয়। অবশেষে মামার সহয়তায় তালাক থেকে রক্ষা পেয়ে যায়। হঠাৎ তার জীবন নষ্ট হওয়া থেকে বেঁচে যাওয়ায় সে আনন্দিত হল।
সন্ধ্যার পর তার স্বামী এল, খুলনায় না যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে বলল, ‘আমি সাল চিল্লায় না যাওয়া পর্যন্ত তুমি থাক। কিন্তু সে স্বামীর কাকুতি মিনতির কোন মূল্যায়ন করল না। তারপর স্বামী বিদায়ের বেলায় মেয়েকে নিয়ে জানালার ধারে দাঁড়াল শুধু একটা সৌজন্যে এবং মেয়েকে তার বাপকে দেখানোর জন্য। কিন্তু হাসান মনে করল স্ত্রী তার প্রতি অসহায় হয়ে করুণভাবে তাকিয়ে ছিল। পাত্রের রংয়েই পানির রং হয়। আসলে এটা ছিল স্ত্রী অন্তপ্রাণ হাসানের মনের ধারনা। ফেরদৌসি নিরুত্তাপ সাধারণভাবেই স্বামীর প্রতি তাকিয়ে ছিল। বস্তুত ফেরদৌসি স্বামীকে ভালবাসত না, তার প্রতি কোন আকর্ষণও ছিল না, ছিল শুধু অবলম্বন। যখন সে সোলেমান থেকে নিরাশ হয়ে যেত এবং দরিদ্র পরিবারের মেয়ে হিসাবে অন্য কোন অবলম্বনও চিন্তা করতে পারত না, একমাত্র তখনই সে স্বামীর উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠত।
ফেরদৌসিদের জামাইরা প্রায় সবাই ছিল স্ত্রৈণ। এজন্য তার বোনেরা বিশ্বাস করত, যারা তাবলীগ করে এবং কট্টর তাবলীগী এরা স্ত্রীর অনুগত হয়। একারণেই তারা হাসানকে সাল চিল্লার শর্ত দিল। তাদের ধারণা হাসান স্ত্রীর অনুগত নয় কিন্তু সাল চিল্লাটা দিয়ে আসলে সেও অনুগত হয়ে যাবে, স্ত্রী যেমনি নাচায় তেমনি নাচবে। হাসান রাজী হল অথচ সে যেখানে তিন দিন সাত দিনের জন্যও তাবলীগে যেতে চায় না সেখানে কিনা এক বছরের নির্বাসনে যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে গেল। আর তা শুধু তারই জন্য একমাত্র স্ত্রীকে পাওয়ার জন্য। কাজেই তখন স্বামীর প্রতি ফেরদৌসির একটা সাময়িক ভালবাসা পয়দা হয়ে যায়।
শালিসির রাত্রেই সে পটেটোর সাথে ঢাকায় চলে যায়। সেখানে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেয় স্বামী যদি সাল চিল্লায় যায় তাহলে স্বামীর ঘরেই আসবে অন্য কোন চিন্তা করবে না। আর যদি চিল্লায় না যায় তাহলে আর আসবে না। আর এ সিদ্ধান্তটাই সে পটেটোর মোবাইল দিয়ে হাসানের বন্ধুকে জানিয়ে দিল কিন্তু হাসানের সাথে কথা বলল না, কারণ তাহলে সে স্বামীর সামনে ছোট হয়ে যাবে। কিন্তু খুব শীঘ্রই দুলা ভাইদের মারফত সে জানতে পারল হাসান চিল্লায় যায়নি। তখন সে স্বামীর উপর সত্যি সত্যিই ক্ষেপে গেল, হাসানের প্রতি উৎকট ঘৃণায় তার মন বিষিয়ে উঠল। সে স্বগতোক্তি করল, ‘আমি মরে গেলেও এই কুত্তা চোদার ঘরে আর যাব না’। এভাবেই কিছু দিন কেটে গেল, ফেরদৌসি ঢাকায় ও খুলনায় ঘোরে ঘোরে সময় কাটাতে লাগল আর প্রতিক্ষা করতে লাগল সোলেমানের পক্ষ থেকে কোন আহ্বান পাবে। কিন্তু সোলেমানের সাড়া শব্দ নাই, পটেটো-নূরানিও শুধু ইঙ্গিতে কথা বলে, স্পষ্ট কিছু বলে না। আবার উপযাচক হয়ে তার নিজের কিছু বলাও সম্ভব নয়। কারণ তার বোনদের কারো এমন দৃষ্টান্ত নাই যে স্বামীর ঘর ছেড়ে প্রেমিকের ঘরে চলে যাওয়ার মত কলংক করেছে। কাজেই সে সাহস পায় না, কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পরে।
আবার সে নিরাশ হয়ে পরল। স্বামী ছাড়া আর কোন গত্যন্তর দেখতে পেল না। সে অনেক চিন্তা করল যদি স্বামীকে ত্যাগ করে তাহলে কি হতে পারে। তখন যদি সোলেমান তাকে গ্রহণ করে তাহলে ভাগ্যের তো সীমা নাই, তার উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে। আর যদি গ্রহণ না করে তাহলে সে তো শিক্ষিত নয় যে চাকরি করবে, তার বাপ ভাইয়ের এমন কিছু নাই যে বসে বসে খাবে। কাজেই তখন হয়ত গার্মেন্টস শিল্পি হতে হবে অথবা বেশ্যালয়ে শত পুরুষের সোহাগিনি হতে হবে। সে চমকে উঠে, তার ব্হ্মরন্দ্র কেঁপে উঠে। যে করেই হউক স্বামীর ঘরেই তাকে ফিরে আসতে হবে। কাল বিলম্ব না করে সে ঢাকা থেকে বড় বোনের বাসায় এসে হাজির হয়।
বুলগোরিয় প্রবাদ, ‘মেয়েদের মুখটা হয় দেবীর মত আর মনটা হয় সাপের মত’। এই প্রবাদ সকল নারীর জন্য প্রযোজ্য নয়। কারণ বৃহত্তর নারী সমাজের মমতা, বাৎসল্য, প্রীতি ও ভালবাসায় জড়িয়ে পৃথিবী এক মধুর বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আছে, টিকে আছে। কিন্তু তাদের মধ্যে কিছু কিছু নারী আছে যারা উক্ত প্রবাদের যথার্থ প্রযোজ্য। এর মধ্যে ফেরদৌসির বড়াপা ওরফে সাজেদা খাতুন একজন। এ মহিলার মুখটা দেখতে ফুলের মত কোমল, কমনীয়, কুমারী সুলভ কচি। বয়সের তুলনায় তার মুখটা কুমারীদের মত কচিকাচা দেখা যায়, দেবির মত নিষ্পাপ মনে হয়। কিন্তু এর মনটা হল বিষ, সাপের চেয়েও ভয়ঙ্কর বিষাক্ত। নিষ্ঠুর, চূড়ান্ত পর্যায়ের দাম্ভিক এই মহিলা পৃথিবীর কাউকে মানুষ হিসাবে গন্য করে না, অন্যদের ছোট ভাবে, একমাত্র নিজেকেই বড় মনে করে। মানুষকে পদানত করে রাখা তার নিশা।
ডাইনি শব্দটা রুপক, কাল্পনিক। যদি এটাকে বাস্তবে ধরা হয় তাহলে এই মহিলা একজন ডাইনি। সে নিজের বশিকরণ যাদু দিয়ে স্বামীকে কৃতদাসের মত ভেড়া বানিয়ে রেখেছে। যাদুর পুতুলের মত স্বামীকে দিয়ে তার সকল ইচ্ছা উদ্দেশ্যগুলি পূরণ করে নেয়। সকল আত্মীয় স্বজনসহ নিজের পরিবার ও স্বামীর পরিবারের সবাইকে সে পদানত করে রাখে। অন্যকে পদানত করার ক্ষেত্রে সে একটা অনন্য প্রতিভা। সে ছিল ধর্মীয় পরিবারের মেয়ে এবং নিজেও কম বেশি ধার্মিক বলে রক্ষে। অন্যথায় তার প্রতিভাই তাকে টেনে নিয়ে যেত রাজনীতির ময়দানে। আর রাজনীতির ইতিহাসে এমন কিছু নারীর সাক্ষাৎ পাওয়া যায় যারা সত্যিকার অর্থেই রাক্ষুসী ও ডাইনি। এরা নিজেদের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের জন্য ধ্বংস আগুন ও রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়। অভীষ্ট লক্ষে পৌছার জন্য নিজেদের রূপ যৌবনকে সিড়ি হিসাবে ব্যবহার করে। যেমন মিসরের রাণী ক্লিউপেট্রা ক্ষমতার জন্য নিজের অফুরন্ত রূপ যৌবনকে পুঁজি হিসাবে ব্যবহার করেছিল। আর ফেরদৌসির বড়াপা ছিল এই জাতীয় মহিলা।
তার প্রধান বৈশিষ্ট হল নিজে শুকনা গু চিবিয়ে অন্যের মুখে থু থু দেওয়া অর্থাৎ সে এতটাই জেদি যে, নিজের ক্ষতি স্বীকার করে হলেও অন্যকে ঘায়েল করায় সে ছিল পারদর্শী। আর তার এ স্বভাবটাই প্রয়োগ করেছিল হাসানের উপর। ফেরদৌসি তার নিজের মেয়ে ছিল না, তার পরিণতি নিয়ে চিন্তা ছিল না। কাজেই ফেরদৌসি যখন ঢাকা থেকে এসেই বলল, ‘বড়াপা আমি আর এভাবে থাকব না আমার জামাইয়ের ঘরে চলে যাব। সে যদি আর না নেয় তখন আমার কি হবে।
তখন এই মহিলা গর্জে উঠল, ‘না, সাবধান! তুই আর ওখানে যেতে পারবি না। ঐ হারামজাদাকে সাল চিল্লার শর্ত দিলাম আর সে আমার অবাধ্যতা করেছে। এর পরিনাম ফল তাকে ভুগতে হবে। আমার অবাধ্যতার পরিণাম কত নির্মম এখন সে হাড়ে হাড়ে টের পাবে। ওকে আমি এমন ভাবে শায়েস্তা করব যে এটা ইতিহাস হয়ে থাকবে। তুই চিন্তা করিস না, আমি তোর ব্যবস্থা করব, এর চেয়েও ভাল ব্যবস্থা করব, আরো বড় চাকরিজীবি দেখে বিয়ে দিব’। ব্যস ফেরদৌসি ঠাণ্ডা হয়ে গেল। তার আর চিন্তা নাই, কারণ তাদের পরিবার তাদের বড়াপাকে ইশ্বর মনে করে। আর ইশ্বর যখন দায়িত্ব নিল তখন আর কোন চিন্তার কারণ থাকল না। এখন সে সোলেমানের ঘরে যাওয়ার জন্য একনিষ্ঠ ভাবে চেষ্টা করবে, যদি সোলেমান তাকে গ্রহণ নাও করে তবুও সমস্যা নাই। কারণ বড়াপা আছেই, সেই তাকে দেখে শুনে অন্যত্র বিয়ে দিবে কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি করল অন্যান্য আত্মীয় স্বজনরা।
একমাত্র ইঞ্জিনিয়ার দম্পতি ও পটেটো ছাড়া আর কেউ চাচ্ছিল না যে বিয়েটা ভেঙ্গে যাক। কারণ ঘর ভাঙ্গা মেয়েদের পরিণতি ভাল হয়না। কাজেই তারা চাপ দিতে লাগল, হাসান চিল্লা দিক বা না দিক ফেরদৌসি তার ঘরেই থাকুক। কারণ হাসানের একে তো তেমন কোন দোষ নাই, আবার স্ত্রীর সাথে সাল চিল্লার কোন সম্পর্কও নাই। কিন্তু ফেরদৌসি তখন সোলেমানের জন্য রীতিমত পাগলা হয়ে উঠেছে। সে স্বামীর নামটা পর্যন্ত শুনতে পারে না, কারণ স্বামীকে সে ভালবাসে না, তার দিকে মনের কোন টান নেই। কাজেই সে কৌশল অবলম্বন করল, সকলের কাছে প্রচার করে দিল যে, সে স্বপ্নে দেখেছে তার জামাই ছোট লোক, নিচু পদে একটা ঘৃণিত চাকরি করে, অবৈধ পয়সা রোজগার করে, এ জন্য তার স্বাস্থ্য হয়না। এখন এই লোকের ঘরে গেলে সে মরে যাবে। কাজেই স্বামীর ঘরে যাওয়ার আর প্রশ্নই উঠে না। এভাবে সে স্বামীর ঘরে আর না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে একনিষ্ঠভাবে সোলেমানের জন্য সাধনা করতে লাগল।
আর এই ব্যক্তি যদি আগেই বা ইতিমধ্যে বিয়েটা করে ফেলত তাহলে হাসান ফেরদৌসির সংসারটা ভাঙ্গত না। যখনই তার কথা ফেরদৌসির মনে পরত তখনই সে ভাবত, সোলেমান বুঝি তার জন্যই অপেক্ষা করছে, আর তখন সে নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারত না। আগে সে স্বামী ও সোলেমান দুটানায় দুদুল্যমান ছিল। কিন্তু এখন সে স্বামীর চিন্তা বাদ দিয়ে এককভাবে সোলেমানের চিন্তা করতে লাগল। তবে সোলেমান বা পটেটো বা নূরানি কারো কাছে থেকে সে আশানুরূপ কোন ইঙ্গিত পাচ্ছে না। তাই অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল এভাবে আশায় আশায় আর কত দিন কাটাবে, বিষয়টা একটা ফয়সালা করা দরকার। সে রীতিমত ক্ষেপে উঠল, এবার হ্যাঁ বা না একটা কিছু এস্পার ওস্পার করেই ছাড়বে। এই আশা নিয়ে সে জামালপুর থেকে ঢাকায় পটেটোর বাসায় চলে গেল।
বিষয়: সাহিত্য
১৮৬৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন