কবর-৬৮- ৬৯ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ০২ জানুয়ারি, ২০১৭, ১১:২২:৩৭ সকাল
দিক সীমানাহীন উন্মুক্ত প্রান্তর। যার পশ্চিম দিগন্তে সুর্য অস্ত যাচ্ছে। আর অস্তগামী সুর্যের দিকে হেঁটে যাচ্ছে এক কান্তিময় পুরুষ, যুল ওক্বার, জ্যোতির্ময় চেহারা। শ্বেত-শুভ্র পোশাক, সাদা পাগড়ী, সাদা আল খাল্লা, তার হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে একটি শিশু। তারা হাঁটছে দিনের পর দিন বছরের পর বছর, শিশুটি বড় হয়ে উঠছে। দেখতে দেখতে সে শিশু থেকে বালক, বালক থেকে কৈশোরে পৌঁছে গেছে। হাত ছেড়ে সে একা একা হাঁটছে। হঠাৎ সেই জ্যোতির্ময় পুরুষ অন্তর্ধান হয়ে গেল, কিশোরটি তার খোজে দৌড়াচ্ছে। দৌড়াচ্ছে উর্ধ্বশ্বাসে। অস্তগামী সুর্যের দিকে দ্রুত ধাবিত হচ্ছে। প্রান্তরের পশ্চিম সীমান্তে বিশাল সমুদ্র তার পথ আগলে দাঁড়াল, কিন্তু সেই মহাপুরুষের কাছে তাকে পৌঁছতেই হবে, তাই সে সমুদ্রে ঝাপ দিল। সে সাঁতরাচ্ছে, সাঁতরাচ্ছে সে অস্তগামী সুর্যের দিকে। সহসা অনুভব করল সমুদ্রের হাঙ্গর কুমির রাক্ষুসে মৎস তার পিছু তাড়া করছে, সে প্রাণপণে ছুটছে, মরিয়া হয়ে সাঁতরাচ্ছে। অবশেষে উপকূলে পৌঁছে গেল।
তারপর শুরু হল মরুভূমি, সাহারা মরুভূমি, যার কোন দিক সীমানা নাই। মরুভূমির বালিকাপূর্ণ চাটানে শুরু হল তার যাত্রা, সে দৌড়াচ্ছে, প্রাণপণ দৌড়াচ্ছে, মরুভূমির হিংস্র বুভুক্ষু রাক্ষস খোক্ষসেরা তার পিছু নেয়। তাকে ধরার জন্য লাফিয়ে লাফিয়ে এগুতে থাকে। হঠাৎ ঝড় উঠে, মরুঝড় তাকে আঘাত হানে। চোখের সামনে অন্ধকার, দু’হাত সামনে দেখা যায় না। ধুলিময় হয়ে উঠে পৃথিবী। সে বালিয়াড়ির আড়ালে আশ্রয় নেয়। ঝড়ের দাপট হালকা হলে আবার ছোটে, ঝড় প্রবল হলে উট পাখির মত বালিতে মাথা স্থাপন করে সেজদার মত কুন্ডুলি মেরে পরে থাকে। কখনো বালিয়াড়ির আড়ালে আশ্রয় নেয়, তার দেহের উপর ধুলির আস্তর জমে উঠতে থাকে। বালুকা সমাধি থেকে বাঁচার জন্য ঘন ঘন স্থান পরিবর্তন করে। হিংস্র বুভুক্ষুরা তার পিছু ছেড়ে জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। কেউ উৎ পাতার মত মাটিতে গা বিছিয়ে দিয়ে বাঁচতে চেষ্টা করছে, কেউ বালিয়াড়ির আড়ালে আশ্রয় নিচ্ছে, তার গায়ের সাথে গা ঠোক্কর খাচ্ছে কিন্তু আক্রমণ করছে না। কারণ বিপদের সময় সবাই জীবন নিয়ে ব্যস্ত থাকে, কেউ কারো ক্ষতি করে না। পথিক বালিয়াড়ি ও টিলার আড়ালে আড়ালে দৌড়াচ্ছে, আশ্রয় নিচ্ছে, বিশ্রাম করছে। অবশেষে ঝড়ের তান্ডব কমে এল, সে আবার দৌড়াতে লাগল।
দিবাকার মধ্য গগনে উঠে মরুভূমির বুকে অগ্নিবর্ষণ করছে। মরুপ্রান্তর অগ্নিময় হয়ে উঠেছে। শুরু হয় লু হাওয়া। লু হাওয়ায় শরীর জ্বলে যেতে থাকে, গলা জিহ্বা শুকিয়ে যায়, তারপর ক্রমে ক্রমে দেহের রস চোষে নেয়, এমনকি নাড়ী ভুরি শিরা উপশিরা পর্যন্ত শুকিয়ে যায়। তৃঞ্চায় তার চাতি ফেটে যেতে থাকে, সে পানির জন্য উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে থাকে। ঐ তো সামনে পানি দেখা যায়, সে পানির জন্য দৌড়ায়, কিন্তু পানি সরে যায়। সে দৌড়াতে থাকে, পানিও তার সাথে সমান দূরত্ব বজায় রেখে পশ্চিমে দৌড়াচ্ছে। পানির দূরত্ব সে ঘোচাতে পারে না। এভাবে পথিক মরীচিকার পিছনে দৌড়ছে তো দৌড়ছেই। অবশেষে তার দেহ অবসন্ন হয়ে এল, ধীরে ধীরে সে চেতনা হারাতে লাগল। এক সময় ঢলে পরল।
তারপর যখন চেতনা ফিরল তখন নিজেকে আবিষ্কার করল একটা মরুদ্যনে মুখ থুবড়ে পরে আছে। উঠে দাঁড়িয়ে কিছুটা অগ্রসর হতেই তার চোখের তারা ঝিকমিক করে উঠল। সামনেই মিষ্টি পানির ঝর্না ছুটছে। সে ঝাঁপিয়ে পরল কিন্তু তীব্র যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল মুখটা বিকৃত হয়ে গেল। কারণ অঞ্জলি দিয়ে মুখে পানি নিতেই তার ঠোঁট ও জিহ্বা যেন পোড়ে গেল, সে বুঝতে পারল এটা মরুভূমির বৈশিষ্ট। তারপর পানিতে আঙ্গুল ভিজিয়ে ঠোঁটের উপর ঘষল, জিহ্বার উপর ঘষল, কিছুটা সহ্য মাত্রায় আসার পর কয়েক ঢুক পানি খেয়ে বাগানে ঢুকল। পাকা পাকা খেজুর ও দ্রাক্ষা খেয়ে পেট ভরিয়ে ফেলল। তারপর আবার ঝর্নায় এসে তৃপ্তি মত পানি পান করল কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, মরুদ্যানের যত ভয়ঙ্কর বিরাট কৃষ কালো সাপ, বড় বড় বিষাক্ত বিচ্ছু ও নরখাদক মাকড়সা ঝর্নার তীরে জড়ো হয়েছে। আক্রমনের জন্য তার দিকে ধেয়ে আসছে। সে দৌড় লাগাল, প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে, এখন আর সে কিশোর বালক নয়, ইতিমধ্যে যুবক হয়ে গেছে। সে যুবক, যৌবনের মধ্য গগনে পৌঁছে গেছে। সে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে, ছুটছে সে বিরামহীন বিশ্রামহীন ভাবে, ছুটছে জ্যোতির্ময় পুরুষের খোজে অস্তগামী সুর্যের দিকে।
অবশেষে পৌঁছে গেছে মনুষ্য জনপদে। কিন্তু এ জনপদের বাসিন্দারা তাকে অভ্যর্ধনা করা, আশ্রয় দেয়া বা অন্ন জল দেয়া দুরের কথা বরং দা-কুড়াল, লাঠি-বল্লম, তলোয়ার ও মারাত্মক অস্ত্র- সস্ত্র নিয়ে তাড়া করল। কী ভয়ঙ্কর জংলি মানুষ, দানবের মত দাঁত বেরিয়ে আছে, কয়লা কাল শরীরে সিংহের কেশরের মত লম্বা লম্বা পশম ঝুলছে। গলায় মানুষের হাড় হাড্ডি ও মস্তকের মালা। মাথার চুল ভুত পেত্নির চুলের মত লম্বা জটা ধারি। এরা সবাই অস্ত্র হাতে তাকে তাড়া করছে। সে ছুটছে দ্রুততর গতিতে, ছুটছে ঝড়ের বেগে, ছুটছে তার গন্তব্যে। এভাবে সে কত লোকালয়, কত শহর, নগর বন্দর পেরিয়ে গেল, কত জনপদ, কত দেশ কত মহাদেশ অতিক্রম করে গেল, অবিরাম অবিশ্রান্ত ধারায় ছুটল। তবুও গন্তব্যে পৌছতে পারল না, জ্যোতির্ময় পুরুষের সাক্ষাৎ পেল না। পৃথিবীর কেউ তাকে অভ্যর্থনা করল না, আশ্রয় দিল না, সবাই তাকে তাড়া করল, দুনিয়ার যত মানব, দানব, পশু পাখি, সাপ বিচ্ছু, জঙ্গলের হিংস্র প্রাণী, কুকুর, শিয়াল সবাই তাকে তাড়া করল। পুরো জীব জগৎ তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কারণ এই পৃথিবী ও পৃথিবীর বাসিন্দারা তাকে চায়না তাকে দুনিয়া থেকে তাড়াতে চায়, পাঠিয়ে দিতে চায় পৃথিবীর সীমানার বাইরে।
যুবক দৌড়াচ্ছে, দৌড়াচ্ছে সে উল্কার গতিতে, তার পা চড়কার মত ঘোরছে, মাটি ছুয়ে ছুয়ে যাচ্ছে। সেই জ্যোতির্ময় পুরুষের সন্ধানে সে অস্তগামী সুর্যের দিকে ছুটছে। অবশেষে সে একটি জঙ্গলে গিয়ে পৌঁছল। জঙ্গলের পশু পাখি বাঘ সিংহ হায়েনা সাপ বিচ্ছু সবাই তার দিকে তেড়ে এল, সে প্রাণ পনে ছুটল। জঙ্গলের এক প্রান্তে আলোর ঝলক অনুভব করল। সহসা আবিষ্কার করল সে এক অপ্সরীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে হাত তুলল আর সাথে সাথে জঙ্গলের প্রাণীরা পালিয়ে গেল। ‘আমি এই জঙ্গলের রাণী’ বলে অপ্সরী হাসল, সেই হাসি পথিকের মন তোলপাড় করে গেল, অপ্সরীকে তার পসন্দ হল এবং বিয়ে করল। অপ্সরী তাকে আশ্রয় দিল অন্ন জলের ব্যবস্থা করল। সে ছিল অদ্ভুত সুন্দরী, ভৌতিক সুন্দরী, মর্মর পাথেরের মত শুভ্র, রক্ত শুন্য। পথিক প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ঘাড়ে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করে, হাত দিয়ে ঘাড়ের পাশে দু’টি ক্ষত আবিষ্কার করে কিন্তু কিছুই বুঝতে পারে না। একদিন তার দেহের উপর কোন কিছুর চাপে তার নিদ্রাভঙ্গ হল, সে বুঝতে পারল কেউ তাকে চেপে ধরে ঘাড় থেকে রক্ত চোষে নিচ্ছে। তারপর রাতের আবছা আলোয় দেখল অপ্সরীর পোশাক পরা এক ডাইনী বুড়ি, ঠোঁটের দু’পাশে হাতির দাঁতের মত লম্বা দাঁত বেরিয়ে আছে, রক্তমাখা। কৃষ কালো কোচকানো চামড়া, জটাময় চুল, কোলার মত কান, ভয়ঙ্কর কুৎসিত চেহারা। সে বুঝতে পারল এটা কোন অপ্সরী নয় এ জংলের ডাইনি। পথিক চোখ বন্ধ করে মরার মত পরে থাকল। সে ঘুমে থাকতেই ডাইনি প্রতিদিন বাইরে চলে যায়, রাতে শুবার সময় পথিকের পাশে এসে শয়ন করে।
ভোর হতেই পথিক জীবন বাঁচাতে দৌড় শুরু করল। সাথে সাথে জঙ্গলের বাঘ সিংহ সাপ বিচ্ছু ইত্যাদি হিংস্র প্রাণীরা তার পিছু ধাওয়া করল। সে ছুটছে, ঝড়ের বেগে ছুটছে, পা লাঠিমের মত ঘুরছে। হিংস্র প্রাণীরা একে একে পিছনে পরে যাচ্ছে আর ফিরে যাচ্ছে কিন্তু বিশাল বপু একটা সিংহ কেশর ফুলিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে দৌড়াচ্ছে আর ক্ষণে ক্ষণে তার নিকটতর হয়ে আসছে। সব প্রাণী ফিরে গেছে শুধু দৈত্যাকৃতির সিংহটা তাকে তাড়া করছে। সে দিকচিহ্ন হীন মরুভূমিতে দৌড়াচ্ছে। পথিক ক্লান্ত পরিশ্রান্ত, ঘর্মাক্ত, তার প্রাণ ওষ্ঠাগত, পিঠের উপর সিংহের নিশ্বাস পরছে, আর মাত্র দুই পা ব্যবধান অথচ জ্যোতির্ময় পুরুষের সাথে এখনো তার সাক্ষাৎ হলো না। সে মরিয়া হয়ে উঠেছে, মরার আগে সেই মহামানবের সাথে তাকে সাক্ষাৎ করতেই হবে।
সুর্য অস্ত যাচ্ছে। যুবকের ঘাড়ের উপর সিংহের নিশ্বাস পরছে। সে আর্তনাদ করে উঠল আর তখনি সামনে একটা গর্ত বা কুয়া দেখতে পেল। সাথে সাথে ঝাপ দিল। কুয়ার মুখে দু’পাশ দিয়ে একটা দড়ি বাধা, সে দড়িটা ধরে ঝুলে রইল। বিশাল বপু সিংহ পাড়ের চারধারে ঘুরছে। তার লালায়িত জিহ্বা থেকে লালা ঝরছে, জিহ্বা ঘুরিয়ে নাক মুখ ঠোঁট চাটছে আর তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কলিজা ফাটানো হুঙ্কার ছাড়ছে। সহসা সে নিজেকে আবিষ্কার করল- পাড়ে সিংহ, তার ঝুলে থাকা রশির দুই ধারে সাদা ও কালো দুইটি ইঁদুর কুট কুট করে অনুক্ষণ রশিটা কেটে যাচ্ছে, নীচে তাকিয়ে দেখল বিশাল এক আজদাহা সাপ বিরাট বিবর মুখ খোলে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইঁদুরের রশি কাটা শেষ, শুধু একটি সূত্র বা নাল বাকী আছে। সুর্য অস্ত গেল। যুবক আস্তে আস্তে রশিটা বেয়ে কুয়ার পাড়ে গিয়ে দিল ছুট। তীরের বেগে ছুটে চলল, রাত্রি নেমেছে, ঘন ঘোর অন্ধকার ধেয়ে আসছে। তার সময় শেষ, আজ রাতের মধ্যেই সেই কান্তিময় পুরুষের সাথে তার সাক্ষাৎ হতে হবে।
পথিক উল্কার বেগে ছুটে চলেছে, কত মরুভূমি কত মরুদ্যান কত বিরান প্রান্তর পেরিয়ে যাচ্ছে, নিকষ কালো অন্ধকার ছেয়ে ফেলেছে পৃথিবী। মরু ঝড়ের তান্ডব চলছে তবুও সেই কান্তিময় পুরুষের দেখা নাই। যুবক হতাশার সাগরে ডুবে গেল, তার হাত পা অবশ হয়ে আসছে, চোখ বোজে আসছে, চলৎ শক্তি হারিয়ে ফেলছে। সে মাটিতে পরে যাওয়ার উপক্রম হল।
সহসা দিক চক্রবালে ক্ষীণ আলোক রশ্মি দেখা গেল। ধীরে ধীরে দিগন্ত আলোক উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। একটা জ্যোতি চারদিকে ছড়িয়ে পরল, আরো স্পষ্ট হল, একটা আলোর মিনার এগিয়ে আসছে, হা তার দিকেই এগিয়ে আসছে। যুবক ঝড়ের দাপট ছিড়ে ফেরে উল্কার বেগে ছোটে চলেছে। হঠাৎ আলোর মিনারটা নীচে চলে গেল, উপরে শুধু আলোর আভা দেখা গেল। যুবক ধেয়ে যাচ্ছে, সে দেখতে পেল আলোর মিনার একটা নদী পেরিয়ে আসছে। হঠাৎ তার চোখ ধাধিয়ে গেল। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে এক কান্তিময় পুরুষ, যুল ওক্বার, জ্যোতির্ময় চেহারা, জ্যোতির্ময় পোশাক। তার দেহ থেকেই আলোক রশ্মি ঠিকরে বেরুচ্ছে। যুবক তির বেগে আগ্রসর হল, জ্যোতির্ময় পুরুষের চেহারার দিকে তাকাল, থমকে দাঁড়াল, আবার ছুটল, আবার থমকে দাঁড়াল, মুখের দিকে তাকাল । তারপর ঝড়ের বেগে ছুটে গিয়ে জ্যোতির্ময় পুরুষের বুকে আচড়ে পরল, ‘আব্বা, আব্বা গো, এতদিন কোথায় ছিলেন। সেই যে ছোট বেলায় আমার ছোট্ট হাতটি ছেড়ে দিয়ে পলায়ন করলেন, এরপর আমার এই ছোট্ট দেহটির উপর দিয়ে পৃথিবীর কত নৃশংসতা, কত যুলুম, কত ঝড় বয়ে গেছে, একটি বারও ফিরে তাকালেন না। সেই থেকে আমি আপনাকে খুঁজে ফিরছি পৃথিবীর ঘাটে ঘাটে, পথে-প্রান্তরে, বনে-বাদারে, জলে-স্থলে। যেখানেই গিয়েছি সেখানেই তাড়া খেয়েছি, জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ আমাকে তাড়িয়ে ফিরেছে, মরুদ্যানের বিষাক্ত প্রাণী, জঙ্গলের হিংস্র প্রাণী, মরুভূমির দানব, লোকালয়ের মানব, সবাই আমাকে তাড়িয়েছি কেউ আমাকে একটু আশ্রয় দিল না, ভালবাসল না। এই পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষ আমাকে চায়না, আমি অভিশপ্ত। এই পৃথিবীর পথে আমি যেখানেই গিয়েছি সেখানেই আমাকে তাড়িয়েছে যুলুম করেছে, আঘাত করতে চেয়েছে, হত্যা করতে চেয়েছে। কেউ আমাকে চায়না, সবাই আমাকে ঘৃণা করে।
টুটে গেছে বন্ধন, এই পৃথিবীর সাথে আমার সূত্র ছিড়ে গেছে বাবা, ছিড়ে গেছে। ও চলে গেছে, চলে গেছে আমাকে ও আমার সন্তানকে ফেলে, চলে গেছে তার সুখের ঠিকানায়। আর আসবে না, সে আর আসবে না আমার নীড়ে’ বলতে বলতে সে বাবার বুক থেকে মাটিতে গড়িয়ে পরল। তারপর মাটিতে গড়াতে থাকে আর আর্তনাদ করতে থাকে, ‘এই পৃথিবীর সাথে আমার সম্পর্ক টুটে গেছে বাবা, আমার কোন ঘর নেই আশ্রয় নেই ঠিকানা নেই, আমার সব ধ্বংস হয়ে গেছে। আজ আমি নিঃস্ব আমি সর্বহারা, আমার সন্তান ইয়াতিম হয়ে গেছে বাবা, ইয়াতিম হয়ে গেছে’ সেই বুক ফাটা আর্তনাদে নির্জন প্রান্তর কেঁপে কেঁপে উঠে, আকাশ যেন ভেঙ্গে পরে।
ব্যথিত বাবা কিছুক্ষণ শোকার্ত সন্তানের প্রতি তাকিয়ে থাকে। তারপর মাটিতে বসে ধুলায় লুটিয়ে পরা সন্তানের মুমূর্ষু দেহটি টেনে তুলে প্রচণ্ড জোরে বুকে চেপে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন, ‘বল পৃথিবী বল, কেন আমার সন্তানকে এত কষ্ট দিলে। আমার সন্তানকে তো তোমার বুকে আমানত রেখে এসেছিলাম। কৈফিয়ত দাও পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষ, কেন তোমরা আমার আমানত রক্ষা করলে না, কেন আমার সন্তানের প্রতি যুলুম করলে। কী অন্যায় ছিল আমার বাবার, কেন এত কষ্ট ছিলে। আমার যক্ষের ধন, আমার সোনার প্রতিমা কেন আজ ধুলির ধরায় লুটিয়ে পরেছে, জবাব দাও পৃথিবী, জবাব দাও মানবতা’। সন্তানের দেহ বুকে জড়িয়ে ধরে এক অসহায় বাবা আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে।
পুত্র বলে, ‘আব্বা, আব্বা গো, আপনি চলে আসার পর কেউ আমার সাথে ভাল আচরণ করেনি। আমি কুকুরের মত মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি। আমার বালক হৃদয় একটু আশ্রয়, একটু শান্তনা, একটু ভালবাসা, একটু স্নেহের পরশ পাওয়ার জন্য কত আকুলি বিকুলি করেছে কিন্তু এই পৃথিবীর কেউ আমার ইয়াতিম ললাটে একটু মমতার হাত বুলিয়ে দেয়নি, কেউ বুকে টেনে একটু ভালবাসা দেয়নি, কেউ একটু শান্তনার আশ্রয় দেয়নি, আমার আপন পর সবাই আমাকে কষ্ট দিয়েছে, ব্যথা দিয়েছে। আমি যখন পৃথিবীর পথে হাঁটতে শিখেছি তখন থেকে মানুষের উপকার করতে চেয়েছি, মানবতার কল্যাণের কথা বলেছি, আর তখনই পৃথিবীর পশু শক্তি আমাকে তাড়া করেছে, আমার জীবন বিষিয়ে তুলেছে, আমাকে বলি দিতে চেয়েছে। পশু শক্তির মোকাবেলায় আমি বারবার অপমানিত হয়েছি, লাঞ্চিত হয়েছি। এভাবে পৃথিবীর প্রতিটা ঘাটে ঘাটে পদে পদে আমি বিপর্যস্ত হয়েছি। আমার দেহ মন ক্ষত বিক্ষত হয়েছে।
সর্বশেষ বাবা, আপনার পুত্র বধু, ওকে আমি ভালবেসেছিলাম বাবা, অনেক ভালবেসেছিলাম। দু’টি তনু মন এক হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সে আমার দেহটা কেটে ছিড়ে চলে গেছে, চলে গেছে সে অন্যের ঘরে, এখন সে অন্যের, শুধুই অন্যের, আমার কেউ না কিচ্ছু না। আমার চোখ আর ওকে দেখবে না, কেউ আর আমাকে ও আমার সন্তানকে দেখবে না, আমরা এখন লা ওয়ারিশ রাস্তার কুকুর। আব্বা আব্বা গো, এই যে দু’টি হাত থেকে দু’টি হাত হয়েছে, এই চোখ থেকে চোখ হয়েছে, এই কান থেকে কান হয়েছে, এই পা থেকে পা হয়েছে, আমার থেকে আরেকটা মানুষ হয়েছে। আমার দেহের প্রতিবিম্ব, আমার সন্তান, আমার কলিজা, আমার মাটির ময়না। ঐ দানবগুলি আজ কতদিন, কতদিন হয়ে গেল আমার সোনার প্রতিমার চাঁদ মুখখানা আমাকে দেখতে দেয়নি। বাবা গো, আমার বুকটা পোড়ে যাচ্ছে, আমার বুকটা একটু ধরেন আব্বা, একটু চেপে ধরেন’ ভাগ্যাহত সন্তান যন্ত্রণায় কুকড়ে উঠে, তীব্র কান্নার গমকে তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে যায়।
যে বাবা এমন ভাগ্যাহত সন্তানকে পৃথিবীতে এনেছে তিনি নিজেকে অভিশপ্ত মনে করলেন। সন্তানের মাথাটা দু’বাহুতে জড়িয়ে এমন ভাবে বুকে চেপে ধরেছেন যেন তিনি সন্তানকে নিজের কলিজায় পোরে নিতে চাচ্ছেন। হতভাগ্য বাবা উর্ধ্বে তাকিয়ে নিঃস্বের মত জার জার হয়ে কাঁদছেন আর আর্তনাদ করছেন, ‘কেন এমন হল আমার রব, কেন এমন হল। আমার মাধ্যমে আমার সন্তানকে পৃথিবীতে পাঠালে, সন্তান লালন পালনের সুযোগ না দিয়ে আমাকে তুমি পৃথিবী থেকে উঠিয়ে আনলে। আমিও আমার সন্তানদের তোমার হাওলায় রেখে চলে এলাম। তবে কেন আজ আমার সন্তানের এত কষ্ট, কেন আজ আমার সন্তান মাটিতে পরে গড়াগড়ি খায়, জবাব দাও পৃথিবীর মালিক জবাব দাও। সন্তান জন্ম দিয়ে কেন আজ সন্তানের সামনে আমায় অপরাধী বনালে’।
পুত্র আবার আর্তনাদ করে উঠে, ‘আব্বা গো, কেন আমায় পৃথিবীতে আনলেন বাবা, কেন আনলেন। এই নরক পুরীতে আসার জন্য আমি তো কাউকে ডাকিনি, কারো কাছে তো আবেদন নিবেদন করিনি, তবে কেন আনলেন। পৃথিবীর যত দুঃখ ব্যথা লাঞ্চনা গঞ্চনা ভোগ করার জন্য? এ জন্যই কি এনেছিলেন, এই কি আমার ভাগ্যলিপি, এই কি আমার প্রাপ্তি। ভব দরিয়ার কিনারে পিতা পুত্রের মাতম উঠে। তাদের কান্নার রুল একাকার হয়ে উর্ধ্বে জগতে প্রতিধ্বনি তুলে। তাদের অশ্রু একাকার হয়ে পৃথিবী পৃষ্ঠে ঝরে পরে। জনক জাতকের শোকে প্রকৃতি নীরব নিথর। কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই। দুঃখি মানুষের দুঃখে রাতের রূপ কৃঞ্চবর্ণ ধারণ করেছে। আকাশ শোকে গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে আছে পিতা পুত্রের দিকে। বাতাস হু হু করে কেঁদে যাচ্ছে। বিষণ্ণ প্রকৃতি নির্বাক তাকিয়ে আছে ভব দরিয়ার কিনারে। সেখানে ঝরে পরছে সৃষ্টির বিষাদের অশ্রু।
৬৮
পুত্র ডাকল, আব্বা। পিতা সাড়া দিলেন, বল বাপ। সন্তান বলল, ‘আব্বা, নরকের এই পুরীতে আমি আর থাকব না, আমি আপনার সাথে চলে যাব। পিতা বললেন, ‘না বাপ, তুমি থাক। তোমার যে এখনও সময় হয়নি। সন্তান বলল, ‘না বাবা, এই নরক কুণ্ডে কী করে আমাকে থাকতে বলেন। এই পৃথিবীর কুৎসিত রূপ আমি দেখে ফেলেছি। এখানে সবল দুর্বলের ঘাড় মটকে রক্ত খায়। এখানে স্বার্থবাদী লোটেরা শ্রেণী দরিদ্র জনগোস্টির রক্ত চোষে নিয়ে দেশে বিদেশে হর্ম প্রাসাদ নির্মাণ করে, বিলাস- ব্যাসনে গা ভাসিয়ে দেয়। আর তখন বুভুক্ষু মানুষ এক মুঠো ক্ষুধার অন্ন জোটাতে বিদেশ পাড়ি জমায়। তারপর বিদেশের জঙ্গলে তাদের গন কবর পাওয়া যায়। এখানে কেউ আকাশ চুম্বি অট্টালিকায় মদ মাৎসর্য্য নারীর জলসা ঘরে মাতাল হয়ে থাকে, আর কেউ ডাস্টবিনের বর্জ্য খেয়ে ফুটপাতে পরে ঘুমায়। এখানে নিরন্ন দিগম্বরের আহ আর্তনাদ বায়ু মন্ডল দোষিত করে। এখানে বঞ্চিত মজলুমের অশ্রু ধরার মাটি বিষাক্ত করে। এখানে একদিকে শুনা যায় রক্ত পিপাসু লোটেরা দানবের হুঙ্কার অন্য দিকে দেখা যায় অসহায় নিঃস্ব মজলুমের আহাজারি। এসব আমি দেখতে পারিনা বাবা। আমি নিজেও তো মজলুম, এজন্য এসব সহ্য করতে পারি না। আমার খুব কষ্ট বাবা, খুব কষ্ট। প্রভু ভৃত্যের এই দুনিয়া আমার জন্য নয় বাবা, আমি এর উপযোগী নই। কাজেই এখানে আর আমার থাকা চলে না, আমি আপনার সাথে থাকব।
আপনার খুব সুখ তাই না বাবা। বাগানের শীষ মহলে থাকেন, ফল মূল খান। ফুলের গন্ধ, পাখির কূজন, দুধ মধু শরাবের নহর, সুর ও সঙ্গিতের মন মাতানো ছন্দ, কত সুখ কত আনন্দ। আমি আর পৃথিবীতে যাব না বাবা, আপনার সাথে থাকব। পিতা বললেন, ‘না বাপ, তুমি থাক, মানুষ ও মানবতার সেবা কর। আমার দায়িত্বটা তুমি পালন কর, আমাকে তো আমার প্রভু সুযোগ দিলেন না, মধ্য বয়সে উঠিয়ে নিয়ে আসলেন। আমি মানবতার সেবা করতে পারিনি, পৃথিবীতে তুমি আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন কর। বিপন্ন মানবতার সেবা কর, এখানেই মানব জন্মের স্বার্থকতা। এখানেই সুখ, এখানেই বেহেশত, এখানেই আল্লাহ্র সন্তুষ্টি। পুত্র রুঢ় কণ্ঠে বলল, ‘কী হবে মানব সেবা করে। আপনি তো খুব মানব সেবা করে এলেন, দরিদ্র মানুষকে খুব খাওয়ালেন। স্বাধীনতার সময় বহু মানুষকে খাওয়ালেন জীবন বাঁচালেন, দুর্ভিক্ষের সময় মানুষের জীবন বাঁচালেন। কিন্তু কি লাভ হল, এই গাদ্দার জাতি তো ইতিহাসের পাতায় আপনার নামটা লিপিবদ্ধ করেইনি এমনকি একদিন স্বরণ পর্যন্ত করে না যে, তিনি একজন যথার্থ মানবতার সেবক ছিলেন। এখানে কোন মানবতাবাদীর মূল্যায়ন করা হয় না। আজ যদি খুনি লোটেরা হতেন তাহলে ঠিকই ইতিহাসের ললাটে আপনার নাম লিখা হত স্বর্ণাক্ষরে। কাজেই এসব মানব টানব সেবার পিছনে যে অর্থ ব্যয় করেছেন সেই অর্থ দিয়ে যদি আমাদের জন্য সম্পদ কিনে রেখে আসতেন তাহলে আমরা এখন ইয়া পেল্লাই বড় লোক থাকতাম। এ জন্যই আমার আর মানব সেবার দরকার নাই।
পিতা মুচকি হেসে সন্তানের ললাট চুম্বন করে বললেন, ‘পাগল ছেলে আমার কয় কি, কে আমাকে ইতিহাস করবে, কে আমার নাম নিবে আর কে স্বরণ করবে এজন্য আমি বিপন্ন মানুষের সেবা করেছি নাকি । আমি মানুষ হিসাবে আমার মানবিক দায়িত্ব পালন করেছি, আর যার সন্তুষ্টির জন্য করেছি, তার সন্তুষ্টি ও পুরুস্কার আমি পেয়ে গেছি। আমার আল্লাহ্ আমাকে অনেক প্রতিদান দিয়েছেন। কাজেই বাপ আমার তুমিও যাও, বিপন্ন মানুষের সেবা কর, মজলুমের অশ্রু মুছে দাও, নিরন্নের মুখে অন্ন তুলে দাও, দিগম্বরকে বস্ত্র দাও, দুখী মানুষের ললাটে তোমার মমতার হাতটি বুলিয়ে দাও, অসহায়ের সহায় হও। মানুষ হিসাবে এটাই তোমার দায়িত্ব ও কর্তব্য, এখানেই তুমি আল্লাহকে খুঁজে পাবে। কারণ আল্লাহ্ বিপন্ন মানবতার মাঝে বসবাস করেন। কাজেই বাপ আমার, তুমি পৃথিবীতে যাও, মানবতার সেবা কর।
পুত্র পিতার কোল থেকে উঠে বসল, তারপর বলল, ‘আমার পক্ষে কিভাবে বৃহত্তর মানবতার সেবা করা সম্ভব, আমার তো প্রয়োজনীয় অর্থ ও ক্ষমতা নাই। মানুষের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য চাই ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা ও বিচার ব্যবস্থা। কারণ এর মধেই পুর্নাংগ মানবাধিকার নিহিত রয়েছে। (বিস্তারিত- এক বিংশতির যীশু)। কাজেই আমি যদি ঘোষণা দেই, ‘শুন বঙ্গবাসী, আমি তোমাদের নিহত, ধর্ষিতা ও ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলিকে মুজরিমের নিকট থেকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ আদায় করে দিব। রাষ্ট্রের মুস্তাদআফ শ্রেনীকে (ইয়াতিম, বিধবা, বয়োবৃদ্ধ, প্রতিবন্ধি) রাষ্ট্রীয় ভাতায় প্রতিপালন করা হবে, নিঃস্ব দরিদ্র শ্রেণীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে স্বনির্ভর করা হবে। দেশে অথবা বিদেশে পাচার হওয়া অবৈধ, আয় বহির্ভুত সকল সম্পদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা করা হবে। তোমাদের আর্থিক ও বৈচারিক সকল মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হবে, তোমরা আমাকে ভোট দাও।
তখন এই অপরিনামদর্শি জাতি অট্টহাসি দিয়ে বলবে, ‘দেখ দেখ নিজের নাম ফাটানোর জন্য একটা মুসিক বেরিয়ে এসেছে, আমাদেরকে প্রাচীন প্রাগৈতিহাসিক ইসলামের গপ্প শুনাচ্ছে, রং নাম্বার, এটাকে ঝেটিয়ে বিদেয় কর। দাজ্জালি শাসন ব্যবস্থায় আমরা কত ভাল আছি, সুখে আছি। আমাদের শাসকরা যখন ইচ্ছা তখন আমাদেরকে রাজপথে পুড়িয়ে ভস্ম করে দেয়, বুলেট বোমায় ঝাঁঝরা করে দেয়। আমাদের ধন-সম্পদ, বাড়ি-ঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য, গাড়ি-ঘোড়া সব কিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়। কাজেই বৈশ্বিক দাজ্জালি ব্যবস্থায় আমরা খুব ভাল আছি, ইসলাম টিসলাম দরকার নাই।
তারপর পুত্র হেসে বলল, ‘আব্বা, আপনি তো অনেকদিন ধরে পৃথিবীতে নাই, এরই মধ্যে পৃথিবী কতদুর এগিয়েছে তা আপনাকে বলছি। আগের দিনে রাজায় রাজায় সৈন্যে সৈন্যে যুদ্ধ হত, রাজা ও সৈন্য মরত, জনসাধারণের কোন ক্ষতি হত না, কেউ তাদের ক্ষতি করত না। কিন্তু বর্তমানে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি, যুদ্ধের সিস্টেমও পাল্টেছে। এখন আমাদের দুইটা করে রাজা থাকে। এক রাজা মসনদে (সরকারী দল) আরেক রাজা রাজপথে। রাজপথের রাজা মসনদে যাওয়ার জন্য হরতাল অবরোধ ধর্মঘট জ্বালাও পোড়াও এর ডাক দিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তারপর উভয় রাজা নিজ নিজ উযির নাজির কর্তাল ও মোসাহেব পার্টি নিয়ে গিয়ে দূরদর্শনের (টিভি) সামনে বসে। এরপর বসে বসে দোয়া করতে থাকে, আল্লাহ আজ বিরোধীদলের হাতে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষ মরুক আর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে সর্বাধিক পরিমাণ সম্পদের ক্ষতি করুক। যখন তাদের আশা পুর্ণ হয় তখন তারা উঠে কোমরে হাত দিয়ে ব্রাজিলের মেয়েদের মত খাম্বা নৃত্য শুরু করে দেয়। তারপর জনগণের মাঝে গিয়ে গলা ফাটিয়ে ঘোষণা দেয়, ‘ভায়েরা আমার, বিরোধিদল দেশ, জাতি ও মানবতার শত্রু। ওদের দেশ শাসন করার কোন অধিকার নেই, এটা একমাত্র আমাদের অধিকার। আমাদের জন্মগত অধিকার।
আবার বিরোধি দলও টিভির সামনে বসে দোয়া করতে থাকে, ‘আল্লাহ্ গো সরকারি দলের বৈতনিক ও অবৈতনিক (বাহিনী ও দলীয় পান্ডা) গুণ্ডাদের বুলেট বোমায় হাজার হাজার লাশ পরুক। যখন তা হয় তখন তারা উঠে খাম্বা নৃত্য করে। তারপর জনগণের মাঝে গিয়ে ঘোষণা দেয়, ‘সরকারি দল জাতি ও মানবতার দুষমন, ওদের মসনদে থাকার কোন অধিকার নেই। ওরা সরকারি বুলেটে দেশের মানুষ মারে। কাজেই দেশ জাতি বাঁচাতে হলে আমাদেরকে মসনদে যেতে হবে’। এই হল সভ্যতার যুগে যুদ্ধের নমুনা। রাজা উজিররা সপ্তস্তর নিরাপত্তা বেষ্টনীতে থেকে টিভির পর্দায় মানুষের লাশ দেখে খাম্বা নৃত্য নাচে। তাদের সন্তান ও ধন সম্পদ থাকে নিরাপদ দুরত্বে। কিন্তু খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের পোড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া বা বুলেটে ঝাঁজরা হয়ে যাওয়া লাশ কুকুরের মত মুখ গুজে পরে থাকে রাস্তার ধারে। কাজেই এমন মানবতাহীন দাজ্জালি শাসন ব্যবস্থায় কোন মানুষ থাকতে পারে না, অন্তত আমি থাকতে রাজি নই।
আবার রাসূল (সাঃ) পৃথিবীতে এসেই প্রভু ভৃত্যের প্রাচীর গুড়িয়ে দিয়ে মানুষের মাঝে সাম্য প্রতিষ্ঠা করে দিলেন এবং অর্থনৈতিক ও বৈচারিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করে মানব জাতির শান্তির পথ দেখিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর সমগ্র পৃথিবীতে এই সাম্য শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব তার ওয়ারিশদের উপর অর্পন করে গিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তার ওয়ারিশ- আল্লামা শ্রেণী দেখল হাজার বছর ধরে ইসলাম পৃথিবী শাসন করছে আর কত। এবার তো বেচারা দাজ্জালকে একটু সুযোগ দেয়া দরকার। কিন্তু এ সুযোগটা কিভাবে দেয়া যায় সেজন্য তারা পরামর্শ সভায় বসল। সভার আলোচনায় বেরিয়ে আসল, উম্মাহ ঐক্যবদ্ধ থাকলে কোন দিনই ইসলাম ধ্বংস হবে না, মুসলিম জাতিও বিশ্ব নেতৃত্বের আসন থেকে বিচ্যুত হবে না। কাজেই পৃথিবীতে দাজ্জালের খিলাফত প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে মুসলিম জাতির মধ্যে ভাঙ্গনের সৃষ্টি করতে হবে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সে ভাঙ্গন সম্ভব নয়, তা করতে হবে ধর্মীয়ভাবে। কারণ রাজনৈতিক ভাঙ্গন আজ থাকলে কাল মিটে যাবে কিন্তু ধর্মীয় বিভক্তি চিরস্থায়ী হবে।
এবার সবাই পরামর্শ শুরু করল ধর্মীয় ভাঙ্গন কিভাবে সৃষ্টি করা যায়। বিষয়টা খুব কঠিন। কারণ ইসলামের মৌলিক বিষয়ে হাত দিলে জনগণ পিটিয়ে মেরে ফেলবে। যেমন নামায সাত ওয়াক্ত পড়, যাকাত দিতে হবে না, রোযা পনেরটা রাখ- এভাবে বিকৃত করতে চাইলে আর রক্ষে নেই। অবশেষে সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হল, ইসলামের মধ্যে, ইসলামের নামে ইসলাম বহির্ভুত বিষয়াদি ঢুকিয়ে দিতে হবে, অর্থাৎ বিদআত সৃষ্টি করতে হবে। তারপর একেকটা বিদআত অবলম্বন করে একেকটা ফিরকার জন্ম হবে। উম্মাহ বিভক্ত হয়ে দুর্বল হবে, বিশ্ব নেতৃত্বের আসন থেকে বিচ্যুত হবে, ইসলাম ধ্বংস হবে। আর এই সুযোগে দাজ্জাল বিশ্বময় তার খিলাফত প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। কাজেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক আলেম আল্লামা শ্রেণীর একদল ঘোষণা মারল, রাসূল (সাঃ) নুরের সৃষ্টি। আরেক দল হুঙ্কার ছাড়ল, রাসূল (সাঃ) মাটির সৃষ্টি। ব্যস দুই দল মারামারি কাটাকাটি লেগে গেল, দাজ্জাল সুযোগ পেল। তারপর একদল ঘোষণা দিল সাহাবায়ে কেরাম সমালোচনার উর্ধ্বে, আরেক দল হুংকার ছাড়ল, সাহাবায়ে কেরাম সমালোচনার মধ্যে। ব্যস তারা লাঠালাঠি শুরু করল, আর দাজ্জাল সুযোগ পেল।
এভাবেই একদল বলল, ইসলাম থাকে মাজারে, আরেক দল বলল, শিরক থাকে মাজারে। একইভাবে একদল বলল, গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদী ধারায় ইসলাম প্রতিষ্ঠা কর, আরেক দল বলল, পুঁজিবাদ ইসলামের জন্য এইডস তুল্য। এভাবেই আলেম নামধারী একেকটা শ্রেণী একেকটা বিদআত সৃষ্টি করে, ফিরকা গঠন করে উম্মাহকে হাজারটা ভাগে বিভক্ত করে ফেলেছে, ইসলাম ও মুসলিম জাতিকে ধ্বংস করেছে এবং দাজ্জালের খিলাফত প্রতিষ্ঠায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতা দিয়েছে। কাজেই যুগের মূর্খ, অসহিঞ্চু, কুটিল ও আল্লাহ্- রাসূল (সাঃ) এর দুষমনরাই ইসলামের নেতৃত্ব দিচ্ছে। এরা কখনোই ইসলাম ও উম্মাহর মিত্র নয় বরং এরাই প্রধান শত্রু। আবার যুগের নিকৃষ্ট ইতর, চরিত্রহীন ও লোটেরা মনোবৃত্তির মানুষগুলিই রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব দিচ্ছে। কাজেই এটা কোন যুগ? এটা মানবতাহীন পশুত্বের যুগ, জাহেলিয়্যাতের যুগ, এটা কোন সভ্যতার যুগ নয়।
আর এমন যুগ সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) বলে গেছেন, ঐ যুগে ভূপৃষ্ঠ থেকে ভূঅভ্যন্তর মানুষের কাছে প্রিয় হয়ে উঠবে। কাজেই আব্বা, আমি আর ভূপৃষ্ঠে থাকতে চাই না, আমি আপনার সাথে চলে যাব। আমার আর মানব সেবার দরকার নাই, বরং সারা জীবন যে কষ্ট করেছি এখন আমারই সেবার দরকার। কাজেই আমি আপনার প্রাসাদে থাকব, সেখানে অনেক হুর গেলমান আছে তাদের সেবা নিব আর বসে বসে মদ খাব। (পরকালে মদ জায়েয থাকবে)
পিতা ডাকলেন, বাপ। পুত্র সাড়া দিল, জ্বি আব্বা বলেন। পিতা বললেন, বাপ তুমি পৃথিবীতে যাও, বিপন্ন মজলুম মানুষকে আলোর পথ দেখাও। ইসলাম যে মানবাধিকার, নারী অধিকার, অর্থনৈতিক ও বৈচারিক অধিকার দিয়েছে সেগুলো মানব জাতির সামনে তুলে ধর। আমি দোয়া করব তুমি সফলকাম হতে পারবে। আবার বিভিন্ন ফেরকায় বিভক্ত মুসলিম উম্মাহর মাঝে তুমি ঐক্যের ডাক দাও, কেন্দ্রীয় খিলাফত বা মুসলিম জাতিসঙ্ঘের ডাক দাও। সমগ্র উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করে একটা কেন্দ্রীয় সংস্থা- সংগঠন তৈরি কর, তাহলেই দাজ্জালের হাত থেকে এ জাতির মুক্তি জুটবে। অন্যথায় এ হতভাগ্য জাতির ধ্বংস কেউ রুখতে পারবে না। যারা ঐক্যের পথে আসবে না, তাদেরকে এ হাদীস অনুসারে হত্যা করবে » নবী করীম (সাঃ) বলেন, ঐক্যবদ্ধ আমার উম্মতের বিরুদ্ধে যদি কেউ বের হয় এবং তাদের মধ্যে বিভক্তি আনয়নের চেষ্টা করে তাহলে তোমরা তাকে হত্যা কর। সে যত বড় কেউ হউক না কেন। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা)
বাপ, তুমি কি পেলে, পৃথিবী তোমাকে কি দিল, সেটা বড় কথা নয়, মানুষের জন্য মানবতার জন্য তুমি কি করলে এটাই বড় কথা। কাজেই পৃথিবীতে যাও বাপ, মানুষের সেবা কর, বিপন্ন মানবতার খেদমত কর, তাহলেই মানুষ হিসাবে তোমার জন্ম স্বার্থক হবে। যাও, আমি তোমার জন্য দোয়া করব, তুমি সফল হতে পারবে।
পুত্র ডাকল, আব্বা। পিতা সাড়া দিল, বল বাপ। পুত্র বলল, ‘আব্বা, আমাদের দেশে এক কবি (জীবনানন্দ) ছিল, সে বাংলার প্রকৃতি দেখে গাইল, ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে চাইনা আর’। এই কবি বাংলার প্রাকৃতিক রূপ সৌন্দর্য দেখে পাগল হয়ে কামনা করল, ‘আবার আসিব ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়, হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে; হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে, কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব কাঁঠাল– ছায়ায়; হয়তো বা হাঁস হ’ব- কিশোরীর- ঘুঙুর রহিবে লাল পায়’।
এ কবি আকাশের নীলিমায় ঢাকা বাংলার সবুজ দেখে বারবার ফিরে আসার কামনা করেছে। স্রষ্টার কাছে তার আরাধনা, মানুষ হিসাবে না পাঠাতে পারলেও যেন অন্তত চিল, শালিক, কাক, বক, প্যাঁচা ইত্যাদি কোন ইতর প্রাণী হিসাবে হলেও জন্মান্তরে তাকে বাংলায় পাঠানো হয়। কিন্তু আব্বা, আমি মনে করি এই কবি অন্ধ, বধির অথবা পাষাণ হৃদয় ছিল। অন্যথায় পথের ধারে পরে থাকা নিরন্ন দিগম্বরের কঙ্কাল দেহ, রাস্তায় কুকুরের মত মুখ গুজে পরে থাকা রাষ্ট্রীয় হত্যার স্বীকার মানব দেহ দেখার পর, অসহায় মজলুমের আহ কানে পৌছার পর কোন মানুষ এখানে দ্বিতীয় বার আগমনের অভিলাস পোষণ করতে পারে না। কাজেই আমি অন্ধও নই, বধিরও নই, পাষাণ হৃদয়ও নই, আমি মানুষ। আর মানুষ বলেই আমি গাই, ‘বাংলার কুৎসিত মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর বীভৎস রূপ খুজিতে চাইনা আর’। সুতরাং এই হানাহানি রক্তারক্তির পৃথিবীতে আমি আর ফিরে যাব না।
পিতা ডাকলেন, বাপ। পুত্র সাড়া দিল, জ্বি আব্বা বলেন। পিতা বললেন, বাপ তুমি কি জান, এপারে আমার প্রভু আমাকে কত উচ্চ মকাম দান করেছেন। কেন করেছেন জান, পৃথিবীতে আমি আমার কিঞ্চিৎ সামর্থানুযায়ি কিছু ভুখা মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিয়েছিলাম, আমার সীমিত সামর্থানুযায়ি কিছু দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের জীবন বাঁচিয়ে ছিলাম। এই সামান্য কর্মের জন্য আমার প্রভু আমাকে অকল্পনীয় প্রতিদান দিয়েছেন। এজন্যই বিপন্ন মানুষের সেবার প্রতি আমার অন্তহীন লোভ, অনেক আশা আকাঙ্ক্ষা। আর আমি চাই তুমিও এমনি উচ্চ মকাম প্রাপ্ত হও। কাজেই বাপ আমার তুমি যাও, দুস্থ মানবতার সেবায় নিজেকে উতসর্গ কর।
আবার দেখ বাপ, পৃথিবীতে একজন পিতা কত কষ্ট করে, নিজের সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে, সীমাহীন মমতায় সন্তান প্রতিপালন করে পৃথিবীতে রেখে চলে আসে। কেন করে জান, সন্তানের কর্মের মাধ্যমে একজন বাবা পৃথিবীতে বেঁচে থাকে আর পরকালে পায় উত্তম পুরুস্কার। কাজেই বাপ আমার, তোমার নিজের জন্য এবং আমার জন্যও কিছু কর। মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ কর। তখন লোকেরা তোমার প্রতি আঙ্গুল উচিয়ে বলবে, ‘ঐ দেখ যাচ্ছে অমুকের সন্তান’। তারা তোমার নামের আগে আমার নাম উচ্চারণ করবে। মানুষ বলবে, ‘আহ কতই না ভাগ্যবান পিতা, যে এমন সন্তান জন্ম দিয়েছে’। তখন আমার প্রশংসা মানুষের মুখে মুখে ফিরবে। মহাকাল ব্যপিয়া মানুষের মুখে মুখে তোমার নামের সাথে আমার নামও উচ্চারিত হবে। আর পরকালে তোমার সাথে আমিও পাব তোমার সৎকর্মের উত্তম প্রতিদান। এভাবে তোমার কর্মের মাধ্যমে আমি ইহলোকে ও পরলোকে অমরত্ব লাভ করব। স্বার্থক হবে আমার পিতৃত্ব, স্বার্থক হবে মানব কুলে তোমার জন্ম। কাজেই বাপ আমার, তুমি পৃথিতে যাও, মানুষের জন্য মানুষের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দাও।
কিন্তু পৃথিবীতে ফিরে যাবার জন্য যখনি সে মনস্থির করল তখনই স্বরণ হল, সে কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে, তার তো ঘর নেই, আশ্রয় নেই, কেন্দ্র নেই, স্ত্রী নেই, বেঁচে থাকার অবলম্বন নেই। মানব সৃষ্টির বৈশিষ্ট হল সে সঙ্গিনী ছাড়া একা বেঁচে থাকতে পারে না। স্ত্রী কর্তৃক পরিত্যক্ত তার বিভীষিকাময় পৃথিবীর কথা স্বরণ হতেই সে আঁতকে উঠল, সে কোনভাবেই আর পৃথিবীতে ফেরত যেতে চায় না। এখানে বাবার কোলে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে চায়, বাবার কোলে শুয়ে ঘুমিয়ে তার অতীত জীবনের দুঃখ- কষ্টগুলি পুষিয়ে নিতে চায়। তাই বাবা যেন আর তাকে ফেরত যেতে না বলেন, এজন্যই সে বাবাকে জব্দ করতে চাইল। সে ডাকল, ‘আব্বা। পিতা সাড়া দিলেন, বল বাপ। পুত্র বলল, আব্বা আপনি তো ভাবছেন, আমি পৃথিবীতে না গেলে আপনার ছোট ছোট সন্তানদের কে দেখবে, কে লালন পালন করবে। এজন্যই আমাকে ফেরত পাঠাতে চাইছেন কিন্তু না ওরা এখন আর ছোট্ট খোকাটি নয়। ওরা এখন একেকটা দানব হয়ে গেছে। তারা দানবের মত গিরিদরি সিন্ধু সৈকত, পর্বত দাবড়িয়ে বেড়ায়। পাহাড়ের চুড়ায় দাঁড়িয়ে ঝাকি মেরে পাহাড় ধ্বসিয়ে দেয়। পৃথিবীর পথে এখন তাদের পা শক্ত হয়ে গেছে। কাজেই এখন আর তাদের আমাকে দরকার নেই, তারাও আমাকে চায় না। এই পৃথিবীও আমাকে চায়না। কাজেই আমারও আর পৃথিবীকে কোন দরকার নেই।
তারপর পুত্র ডাকল, আব্বা। পিতা সাড়া দিলন, বল বাপ। পুত্র বলল, আব্বা আপনাকে একটা প্রশ্ন করি। পৃথিবীতে মানব সন্তান কে আনে? পিতা বললেন, কেন বাবাই তো আনে। পুত্র বলল, তাহলে বাবার দায়িত্ব ও কর্তব্য কি? পিতা বললেন, যথার্থরুপে সন্তান লালন পালন। পুত্র বলল, এখানেই আমার প্রশ্নটা। আপনি তো আমাদেরকে পৃথিবীতে আনলেন কিন্তু লালন পালন করেছিলেন? আমাকে না হয় কিছুটা করেছেন কিন্তু বাকীগুলির তো আপনি কিছুই করেননি বরং আপনার সকল দায়িত্ব আমার কাধে চাপিয়ে দিয়ে চুপ করে পালিয়ে এসে এখানে খাও দাও স্ফুর্তি করেছেন। নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছেন আর ভোগ বিলাসে গা ভাসিয়ে দিচ্ছেন, কিন্তু আমাদের কী হচ্ছে না হচ্ছে ফিরেও দেখছেন না। কাজেই আমাদেরকে পৃথিবীতে এনে দায়িত্ব পালন না করে উল্টো হিমালয়ের মত আপনার বিরাট সংসারের বোঝা আমার মত একটা বালকের কাধে চাপিয়ে দিয়ে চলে এসে আপনি মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছেন। সুতরাং আপনি যদি আরেকবার আমাকে পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার কথা বলেন, তাহলে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের কারণে আল্লাহ্র আদালতে আপনার উপর মোকাদ্দমা দায়ের করে দেব। তখন বুঝতে পারবেন সন্তান জন্ম দিয়ে লালন পালন না করার মজাটা।
পিতা নির্বাক হয়ে গেল। ভবদরিয়ার কিনারে এক দুঃখী পিতা ভাগ্যাহত সন্তানের দেহ কোলে নিয়ে গুমরে গুমরে কাঁদেন। কারণ তার আর বুঝতে বাকী নেই যে, তার সন্তানের সময় শেষ, সে আর পৃথিবীতে ফিরে যাবে না, পৃথিবীর প্রতি তার ঘৃণা ধরে গেছে। সন্তানের ব্যথায় যন্ত্রণাক্লিষ্ট বাবা আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে আর তার নির্বাক অশ্রু গড়িয়ে গড়িয়ে পরে সন্তানের দেহের উপর।
পুত্র বাবার উরুর উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে, বাবা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। তার গায়ের উপর ফোটায় ফোটায় পানি পরছে, সে বুঝতে পারছে তার বাবা কাঁদছেন। কিন্তু এতে তার কোন দুঃখ নাই বরং সে আজ খুশি পরম খুশি। কারণ সে এখন বাবার আশ্রয়ে, বাবার কোলে। সে পাশ ফিরে শুয়ে ভাবে, আহ কি শান্তি, কত নিরাপত্তা। পৃথিবীতে এই একটা মাত্র আশ্রয়, একটা মাত্র কোল যেখানে শুয়ে থাকলে আর কোন চিন্তা ভাবনা নাই, খাওয়া-পরার চিন্তা নাই, বিপদ-আপদের চিন্তা নাই, যা করার বাবাই করবে। একশ সিংহ তেড়ে আসুক, পৃথিবীর যত কাল বৈশাখী ধেয়ে আসুক, সাত সমুদ্দুর তের নদীর জলোচ্ছাস আসুক-কোন চিন্তা নাই, সন্তান নিরাপদ, যা করার বাবাই করবে।
বাবা না থাকলে মানব সন্তানের এই পৃথিবীতে আর কি আছে, বাবাই একমাত্র সম্বল। বাবা না থাকলে সন্তান কি করে বেঁচে থাকে, কেন বেঁচে থাকে। ঐ হতভাগারা বাবার সাথে মরে যায় না কেন? তার মনে পরল, তার বাবাকে কবর দেয়ার সময় সে দু’মুঠো মাটি দিয়ে আব্বা আব্বা বলে কবরে ঝাঁপিয়ে পরতে চেয়েছিল কিন্তু লোকেরা তাকে টেনে নিয়ে যায়। সেদিন সে ভুল করেছিল, যদি বাবার সাথে কবরে থাকত তাহলে জীবনে এত দুঃখ কষ্ট পোহাতে হত না। কাজেই সে আগের ভুল আর করবে না। এখন আর সে বাবার আঙ্গুল ছাড়বে না, সবসময় বাবার আঙ্গুল ধরে ধরে হাঁটবে। এক মুহুর্তের জন্যও বাবার লগ ছাড়বে না। বাবাকে পেয়ে পুত্র প্রশান্ত, আত্মতৃপ্ত। সে একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল, তারপর পরমানন্দে বাবার কোলে ঘুমিয়ে পরল। পৃথিবীর সবচেয়ে মজবুত বাধন, একমাত্র বাধন, পিতা-পুত্র। পুত্র পিতার কোলে ঘুমায়, পিতা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। প্রকৃতি অবাক তাকিয়ে রয়, তারকাপুঞ্জ মিটিমিটি হাসে। বাতাস শোঁ শোঁ শব্দে হর্সধ্বনি তুলে, সৃষ্টি জগত গেয়ে উঠে, জয় জয় পিতা পুত্র, জয় তাদের স্বর্গীয় বাধন।
নিশীথিনীর তৃতীয় জাম। হঠাৎ পুত্রের ঘুম ভেঙ্গে যায়, সে একা মাটিতে শুয়ে আছে, তার বাবা নেই। সহসা আমীর থেকে ফকির হয়ে যাওয়া সর্বরিক্তের মত আর্তস্বরে সে ডাকল ‘আব্বা আব্বা’ বলে বাবাকে ধরার জন্য উত্তরমুখী দৌড় দিল। কিন্তু শীঘ্রই পেছন দিক- দক্ষিণ দিক থেকে আলোর বিচ্ছুরণ অনুভব করল। সে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখতে পেল, তার বাবা সাম্পানে চড়ে নদী পার হয়ে যাচ্ছেন, কিনার থেকে কিছুটা দুরে চলে গেছেন। সে তীব্রনাদে ডাকল, ‘আব্বা আব্বা আমাকে নিয়ে যান। এই অভিশপ্ত পুরীতে আমি আর থাকবনা, আমি আপনার সাথে চলে যাব’ বলে দৌড়ে গিয়ে সুউচ্চ কিনার থেকে বহু নীচে বাবার সাম্পানের উদ্দেশ্যে ঝাপ দিল।
হাসানের খাটের শিয়রের দিক দুই রুমের মধ্যস্থিত দেয়াল সংলঘ্ন। স্বপ্নে খাট থেকে ঝাঁপিয়ে পরতে গিয়ে তার মাথা দেয়ালের সাথে ভীষণ ভাবে ঠুকে গেল। এমনিতেই আধা বেহুশ তার উপর মাথায় প্রচণ্ড আঘাতে বেহুশ হয়ে ঘরের মেঝেতে পরে থাকল। কিছুক্ষণ পর চেতনা ফিরতেই স্বরণ হল তার বাবা তাকে ফেলে চলে যাচ্ছেন। সে লাফিয়ে উঠে, ‘আব্বা আব্বা, আমাকে নিয়ে যান, আমি এখানে থাকবনা। আপনার সাথে থাকব, আমি আসছি আব্বা’ বলে কাঁথার পার্শ্বটা কাধের উপর নিক্ষেপ করে মেয়েকে টান দিয়ে কোলে নিয়ে রওয়ানা করল, বাইরের রুমের দরজা খোলে বেরিয়ে গেল আর তার পিছনে দরজা খোলাই পরে থাকল।
হায় জামালপুর, আজ থেকে সাড়ে তিন বছর আগে যে টগবগে যুবক তোমার বুকে এসেছিল শিক্ষক হয়ে, তোমার বুকে বসে বসে জাতির একটা অংশকে শিক্ষা দিবে, জাগতিক ও পারলৌকিক জ্ঞানদান করবে, সেই যোগ্যতা নিয়েই সে এসেছিল। কিন্তু আজ সে লাঞ্চিত হয়ে অভিশাপের ডালি মাথায় নিয়ে ধুকে ধুকে বিদায় নিচ্ছে। তাকে স্যালুট কর জামালপুর, স্যালুট কর একজন আদর্শ শিক্ষককে। তাকে বিদায় জানাও বন্ধু, বিদায় জানাও পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী মানুষটিকে।
হাসান মেয়েকে কোলে নিয়ে হেটে যাচ্ছে। তিনদিন পর বাইরে এসে মুক্ত বাতাসে তার বাহ্যিক চেতনা ফিরে এল। এই রাস্তা, এই দোকান-পাট, এই গাছ-গাছালি, এই শহর তার কত পরিচিত, কত আপন জন। তার স্মৃতিগুলি সচল হয়ে উঠে। এই রাস্তা দিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে সে রিকশায় চড়ে কত আনাগুনা করেছে। আবার এই পথেই রিকশা গাড়িতে স্ত্রীকে কত খুঁজেছে। এই শহরের আকাশে বাতাসে মিশে আছে তার কত হাসি কান্না। এই শহরের চেনা মুখগুলির মাঝে আছে তার কত বন্ধু, কত আপন জন। তার বাসা থেকে রেল ষ্টেশন বেশি দুরে নয়। ষ্টেশনের কাছাকাছি গিয়ে সে পেছন ফিরে তাকাল, সবুজে ঢাকা শহরের উপর দিয়ে দৃষ্টি বুলাল। আর সাথে সাথে ডুকরে কেঁদে উঠল, ‘আমার জামালপুর, বন্ধু আমার, মা আমর, ক্ষমা কর মা, ক্ষমা কর। তোমার বুকে কত হেসে খেলে বেরিয়েছি। তোমার অন্ন জল খেয়ে জীবন ধারণ করেছি, তোমার বাতাস সেবন করে পথ হেঁটেছি কিন্তু আজ চলে যাচ্ছি মা। তোমার মমতার কোল ছেড়ে চলে যাচ্ছি। মাগো একদিন তোমার বুকে এসেছিলাম একা কিন্তু আজ তোমার বুক থেকে নিয়ে যাচ্ছি মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ- আমার সন্তান। তোমার অন্ন জল খেয়ে এই সন্তান জন্মিয়েছি, আজ এই উপহার নিয়ে চোরের মত লাঞ্চিত হয়ে তোমার বুক থেকে বিদায় নিচ্ছি মা, বিদায়। বিদায় মা বিদায়। এ জন্মে হয়ত আর দেখা হবে না মা, ক্ষমা কর। সালাম জামালপুর, সালাম জামালপুরের বাসিন্দারা, সালাম। তারপর সে শিশুর মত উচ্চস্বরে কাঁদতে কাঁদতে আবার হাঁটা শুরু করল।
ঢাকাগামী একতা এক্সপ্রেস ট্রেন ষ্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। সে নিয়ত করল ট্রেনে ময়মনসিংহ যাবে, সেখান থেকে বাড়িতে চলে যাবে। সে ট্রেনে উঠার জন্য অনেক চেষ্টা করল কিন্তু দুর্বল শরীরে মেয়েকে নিয়ে উঠতে পারল না। অনেককে অনুরোধ করল মেয়েটাকে ধরার জন্য, তাকে সাহায্য করার জন্য, কিন্তু কাঁথা গায়ে জটাধারি চুল, শ্মশ্রুতে মুখ ঢাকা একটা পাগলের সাহায্যে কেউ এগিয়ে এল না। দুঃখীরাই দুঃখীর দুঃখ বুঝে। অবশেষে ট্রেনের একটা ভিখারিনি বলল, এই পাগল বাচ্চাটাকে আমার কাছে দিয়ে তুমি উঠ। সে মেয়েকে নিল এবং হাসানকে হাত ধরে উঠতে সাহায্য করল। হাসান উঠে মেয়েকে কোলে নিয়ে দাঁড়াল। ট্রেন ছেড়েছে, সে ট্রেনের তালে তালে দুলছে কিন্তু শীঘ্রই বুঝতে পারল দুর্বল দেহে মেয়েকে কোলে নিয়ে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। কাজেই টয়লেটের সামনে ফাঁকা জায়গায় মেঝেতে বসে পরল। কিছুক্ষণ পরই তার কাশি শুরু হল, প্রচণ্ড কাশি, কাশির সাথে প্রচুর রক্ত যাওয়া শুরু হল। কাশতে কাশতে একসময় সে বেহুঁশ হয়ে পরে থাকল।
বিষয়: সাহিত্য
১২৫২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন