কবর-৬৬-৬৭ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ০১ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:২২:১০ দুপুর

তৃতীয় পর্ব

ঠিকানার সন্ধানে

১) আর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সংগিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে। (রুম/২১)

২) মানবকূলকে মোহগ্রস্ত করেছে নারী, সন্তান-সন্ততি। (আল-ইমরান/১৪)

৩) হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গীনীকে সৃষ্টি করেছেন; আর বিস্তার করেছেন তাদের দু’জন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী। (নিসা/১)

২/১৮) তারপর প্রভু ইশ্বর বললেন, মানুষের নিঃসঙ্গ থাকা ভাল নয়। আমি ওকে সাহায্য করার জন্য ওর মত আর একটি মানুষ তৈরি করব। ২/২১) তখন প্রভু ইশ্বর সেই মানুষটিকে খুব গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন করলেন। মানুষটি যখন ঘুমাচ্ছিল তখন প্রভু ইশ্বর তার পাজরের একটা হাড় বের করে নিলেন। তারপর প্রভু ইশ্বর যেখান থেকে হাড়টা বের করে ছিলেন- সেখানটা চামড়া দিয়ে ঢেকে দিলেন। ২২) প্রভু ইশ্বর মানুষটির পাজরের সেই হাড় দিয়ে তৈরি করলেন একজন স্ত্রী। তখন সেই স্ত্রীকে প্রভু ইশ্বর মানুষটির সামনে নিয়ে এলেন। ২৩) তখন মানুষটি বলল, অবশেষে আমার সদৃশ একজন হল। আমার পাজর থেকে তার হাড়, শরীর থেকে তার দেহ তৈরি হয়েছে। যেহেতু নর থেকে তার সৃষ্টি, সেহেতু নারী বলে এর পরিচয় হবে, ২৪) এইজন্য পুরুষ পিতা মাতাকে ত্যাগ করে স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয় এবং এই ভাবে দু’জনে এক হয়ে যায়। (ওল্ড টেস্টামেন্ট, জেনেসিস, ২য় অধ্যায়)

মহা প্রভু আল্লাহ্‌ আদমকে সৃষ্টি করে জান্নাতে আদন- এডেন বাগানে রাখলেন। বাগানের নয়নাভিরাম বৃক্ষরাজি, ফল ফুলের সমাহার, ফুলের মন মাতানো মৌ, স্বচ্ছ স্ফটিক নহর, নির্মল মলয়, বৃক্ষপত্রে বেজে উঠা মলয় সঙ্গিত, বিহঙ্গ গীত, গীতের মোহময়তা- এসব কোন কিছুই আদমের মন ভরাতে পারল না, কিছুই তার ভাল লাগল না। তার মনে শুন্যতা, মহা শুন্যতা। সে নিঃসঙ্গ একাকি, সে বিষণ্ণ, ব্যথিত। মহা প্রভু আল্লাহ্‌ আদমের ব্যথা বুঝলেন। তিনি তার পাজর থেকে সৃষ্টি করলেন এক মানবি, তার নাম দিলেন হাওয়া বা ইভ। তিনি হাওয়াকে তার সামনে উপস্থিত করলেন, সাথী পেয়ে আদম আনন্দিত হল, আত্মহারা হল। আর আত্মহারা হয়েই ভুল করে বসল। যার ফলে তারা পঙ্কিল পৃথিবীতে নিক্ষিপ্ত হল। আদম দুঃখিত হল, আফসোস করল, অনুতপ্ত হল, কাঁদল, কাঁদতে কাঁদতে আপন সাথীকে খুজতে লাগল। আরাফায় গিয়ে সাথীকে খুঁজে পেল। ইভকে বুকে জড়িয়ে ধরে ভুলে গেল তার যত দুঃখ ব্যথা লাঞ্চনা আর গ্লানি। তারপর তারা প্রেম করল, পরস্পরকে ভালবাসল, ধুলির ধরায় রচনা করল সুখের স্বর্গ।

এরপর কত কাল মহাকাল কেটে গেছে, অতীত হয়ে গেছে লক্ষ লক্ষ হয়ত বা কোটি বছর। আজো সেই প্রেম বেঁচে আছে, আজো সেই প্রেম অম্লান। আদম ইভের প্রেম তাদের সন্তানদের মাধ্যমে বেঁচে আছে, বরং যুগে যুগে কালে কালে সেই প্রেম চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে বেড়ে সহস্র কোটি গুণে বর্ধিত হয়ে অমরত্ব লাভ করেছে। আদম ইভ প্রেম করেছিল এজন্যই আদম সন্তান প্রেম করে।

প্রেমের প্রতিক নারী, নারীর প্রতিক ফুল, ফুলের প্রতিক সৌন্দর্য্য। সুতরাং নারীর প্রতিক সৌন্দর্য্য। এই বাস্তু জগতে যা কিছু সুন্দর আর মনোহর সবই নারী ও নারীর জন্য। নারী আছে বলেই ফুল ফোটে অলি গায়, কলি ফুল হয় মুকুল ফল হয়। নারী আছে বলেই প্রজাপতি ডানা মেলে, হংস বলাকা উড়ে বেড়ায়, রংধনু সাত রঙ্গে সাজে। নারী আছে বলেই ফুলের এত সুবাস, পৃথিবীর এত রং রস গন্ধ, হেমন্ত বসন্ত ফিরে ফিরে আসে। নারী আছে বলেই পৃথিবীর মাঠ ঘাট ফুলে ফলে ভরে উঠে। নারী আছে বলেই তার গাত্র শোভায় মৃত্তিকা গর্ভের বেমূল্য স্বর্ণ রৌপ্য অমুল্য হয়েছে। নারী আছে বলেই তার প্রেমে ব্যর্থ-স্বার্থ হয়ে বাউন্ডুলে হয়েছে কবি। নারী আছে বলেই তার সৌন্দর্য্য বিকশিত করতে সুর্যোদয় হয়। নারীর হাসি চন্দ্র তারায় লেগে চাঁদ তারা হাসে, নারীর রুপের ছটায় চন্দ্র তারা আলোকিত হয়ে রাতের ভুবনে স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়ে দেয়। নারী আছে বলেই পুরুষ গোফ শ্মশ্রুর ঝালরে বন মানব না হয়ে সভ্য মানব হয়েছে। নারী আছে বলেই পুরুষ ঘর বাধে, আলিশান বালাখানা, হেরেম, প্রাসাদ নির্মাণ করে, বাস করে সাততলায়, নারী না থাকলে সে থাকতো গাছতলায়। নারী আছে বলেই রৌদ্র দগ্ধ পুরুষ শীতল ছায়া পায়। পুরুষকে পৃথিবীতে এনেছে নারী, নারীই রাত্রি নিশীথে যোগিয়েছে পুরুষের ক্ষুধার সুধা, দিয়েছে শান্তির আশ্রয়। আবার কন্যারুপি এই নারীই তার হৃদয়ের মরু চাটানকে ফুলে ফলে শস্য শ্যামল করে তুলে। কাজেই সৃষ্টি বলে জয় জয় নারী, নারীর জয়।

নারী হল প্রেমের প্রতিক। যুগে যুগে নারী প্রেম মানব হৃদয়কে আলোড়িত করে, চোখে অশ্রু ঝড়ায়, হৃদয় মথিত করে। এজন্যই নারী প্রেম হয়েছে শিল্প। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিল্প। এ শিল্পকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর কবি সাহিত্যিকরা সাহিত্য রচনা করেছে। যে কবি ও শিল্পি নর নারীর প্রেমকে যত বেশি সিঞ্চিত করতে পেরেছে তার কাব্য- সাহিত্য পৃথিবীতে অমরত্ব লাভ করেছে। এভাবেই রচিত হয়েছে বিশ্ব সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ- লাইলি মজনু, শিরিন ফরহাদ, আলিফ লায়লা, ইলিয়ড, রুমিও জুলিয়েট, এন্টনিও ক্লিউপেট্রা, আন্না কারেনিনা, দেবদাস ইত্যাদি অমর সাহিত্যকর্ম। আবার এই শিল্প অবলম্বন করে নির্মিত হচ্ছে অগনিত চলচ্ছিত্র। যে চলচ্ছিত্রে নারী প্রেমের যত বেশি সার্থকতা ও ব্যর্থতা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সেটাই হয়েছে ভুবন খ্যাত, ব্যবসা সফল।

নারী হল সৌন্দর্য্যের প্রতিক। যুগে যুগে মানুষ নারী সৌন্দর্য্যের উৎকর্ষ সাধনের জন্য নিজেদের শ্রম, শক্তি, মেধা ও অর্থ ব্যয় করেছে। কালে কালে মানুষ নারীর প্রসাধন, বস্ত্র সামগ্রী ও অলংকার নির্মাণকে জীবিকার উৎস হিসাবে গ্রহণ করেছে, পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক বাণিজ্য ও অর্থনিতি আবর্তিত হয় নারীর রুপচর্চা কেন্দ্রিক।

আবার পৃথিবীর যা কিছু সুন্দর, মহৎ সৃষ্টি ও বিস্ময়কর তার মূলে রয়েছে নারী। পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম হল ব্যবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান। সম্রাট নেবুচাদ নেজার স্ত্রীর প্রতি ভালবাসার নিদর্শন হিসাবে এটি নির্মাণ করেন। নিনেভ দখল করার সময় মিডিয়ানের রাজা তাকে সাহায্য করেন। সম্রাট মিডিয়ান রাজকন্যার প্রেমে পরে তাকে বিয়ে করেন। কিন্তু মিডিয়ানের পাহাড়ি পরিবেশে বেড়ে ওঠা রাজকন্যার সমতল ব্যবিলনকে ভাল লাগল না। সম্রাট তা বুঝতে পেরে স্ত্রীর বিনোদনের জন্য ৬০০ খৃষ্ট পুর্বাব্দে নির্মাণ করেন ঝুলন্ত উদ্যান। ৪০০০ শ্রমিক রাতদিন পরিশ্রম করে মাটি থেকে ৮০ ফুট উপড়ে ৮০০ বর্গফুট আয়তনে নির্মাণ করে উদ্যানটি। এই বিস্ময়কর বাগানের মালি ছিল ১০৫০ জন এবং ছয় হাজার বিভিন্ন প্রজাতির ফুল ছিল।

আরেক আশ্চর্য্য হল তাজমহল। সম্রাট শাহজাহানের প্রিয়তমা স্ত্রী আরজুমান্দ বানু উরফে মমতাজ মহল তার চতুর্দশ কন্যা গৌহর বেগমকে জন্মদানের সময় মৃত্যু বরণ করেন। সম্রাট প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর বিচ্ছেদে মুহ্যমান হয়ে পরেন। তখন স্ত্রীর প্রতি তার অফুরন্ত ভালবাসাকে অমরত্ব দানের জন্য, তাদের প্রেমকে পৃথিবীবাসীর দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার লক্ষে মমতাজ মহলের সমাধির উপর নির্মাণ করেন স্থাপত্য শিল্পের এক অপূর্ব নিদর্শন, নারী প্রেমের এক অনন্য দৃষ্টান্ত ‘তাজমহল’। যা দেখে শুধু পৃথিবীবাসীই বিস্মিত হয় না, আকাশবাসীও বিস্ময়ে অভিভূত হয়। তৎকালীন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্থপতি উস্তাদ আহমেদ লাহোরির তত্বাবধানে ১৬৩২ থেকে ১৬৫৩ এর মধ্যে এটি নির্মিত হয়।

উমর বিন আব্দুল আজিজের মৃত্যুর পর খলীফা হন ইয়াজিদ বিন আব্দুল মালিক। খেলাফত প্রাপ্তির কয়েক দিনের মধ্যে তার সুন্দরী স্ত্রী মারা যায়। স্ত্রী বিচ্ছেদে সে এতটাই শোকে মুহ্যমান হয়ে পরে যে, দাফন কাফন না করে স্ত্রীর মরদেহটা কোলে নিয়ে রুদ্দদ্বার গৃহে দুনিয়া বিচ্ছিন্ন হয়ে নিঃসঙ্গ একাকি কয়েকদিন কাটিয়ে দেয়। তারপর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে শীঘ্রই গিয়ে স্ত্রীর সাথে মিলিত হয়। খোদার সৃষ্টি কুলের মধ্যে অন্য কোন প্রাণীর ক্ষেত্রে মানব মানবির ন্যায় প্রেমের এমন দৃষ্টান্ত দেখা যায় না।

আবার এই নারীর জন্যই পৃথিবীতে কত যুদ্ধ বিগ্রহ সংঘটিত হয়েছে, বয়ে গেছে কত ধ্বংসলীলা। কত দেশ, কত জাতি, রাষ্ট্র, নগর জনপদ ধ্বংস হয়ে গেছে, কে রাখে তার পরিসংখ্যান। স্পেনের রাজা রডরিক। তৎকালীন সময়ে একটা প্রথা ছিল, এলিট শ্রেণীর ছেলে মেয়েদের কূটনীতিক শিষ্টাচার ও রাজসিক আদব কায়দা, নিয়ম কানুন শিখানোর জন্য রাজ পরিবারে শিক্ষানবিশ হিসাবে রাখা হত। নিয়মানুযায়ী কূটনীতিক ফ্রেডারিকের কন্যা স্পেনের আগের রাজার নাতনি ফ্লোরিন্ডাকে রাজ পরিবারে রাখা হল। কিন্তু রডারিক তার শ্লিলতাহানি করল। ফ্রেডারিক সময়মত মেয়েকে আনতে গেল। মেয়ে বাবাকে ঘটনা খুলে বলল। ফ্রেডারিকের বিদায়ের সময় রডারিক অনুরোধ করল তার জন্য একটা শিকারি বাজপাখি পাঠাতে। সে বলল, ‘হ্যাঁ আমি দেরি করব না, এখান থেকে সোজা গিয়ে আপনার জন্য একটা বিদেশী দক্ষ শিকারি বাজপাখি পাঠিয়ে দিব’। কথা মত ফ্রেডারিক বাড়িতে না গিয়ে সোজা চলে গেল আফ্রিকায়। সেখানে মুসলিম বাহিনীর সিপাহসালার মুসা বিন নুসাইয়ের দরবারে পৌঁছেই তার মেয়ের ইজ্জতের মূল্য দাবী করল।

মুসা তারেক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে একটা সেনাদল পাঠিয়ে দিল রডারিকের বিরুদ্ধে। তারিক অত্যাচারির প্রাসাদ ধুলিস্মাত করে দিল। রডারিক ও তার কয়েক লক্ষ সেনা বাহিনীর ধ্বংস স্তুপের উপর উড়িয়ে দিল ইসলামের বিজয় পতাকা। একটি নারীর ইজ্জতের মূল্য আদায় করা হল, সেই সাথে ইউরোপ পেল ইসলামের আলো, মানবতার আলো।

ইরাকের রাজ দরবার। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ একটা চিঠি পড়ে ভর দরবারে সিংহের মত গর্জে উঠল, ‘আমি আসছি আমার মেয়ে, আমি আসছি’। চিঠিটি ছিল সিন্ধুর রাজা দাহিরের কারাগরে আটক এক আরব বালিকার। এই অসহায় বালিকা তার দিগ্বিজয়ি জাতির অভিভাবকের কাছে জীবন বাঁচানোর আবেদন জানিয়েছিল। কিন্তু তখন ইসলামের ফরযন্দরা পৃথিবীর দুই প্রান্তে চাঁদ তারা খচিত পতাকা নিয়ে ঝড়ের বেগে ধেয়ে যাচ্ছে। প্রাচ্যে কুতায়বা বিন মুসলিম চীনের প্রাচীর গুড়িয়ে অভ্যন্তরে ঢুকে গেছে। ইউরোপে তারিক বিন জিয়াদ স্পেনের মানচিত্র অতিক্রম করে মরু ঝড়ের তান্ডব নিয়ে ফ্রান্সের কেন্দ্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে। কাজেই নতুন আরেকটি যুদ্ধ ফ্রন্ট খোলার মত সামর্থ ও ইচ্ছা কেন্দ্রীয় খেলাফতের ছিল না। হাজ্জাজ অপারগ হয়ে লোকজনদের ডেকে নিয়ে মসজিদে বক্তৃতা করে বলল, ‘তোমাদের এক কন্যা, তোমাদের এক বোন সাহায্যের আবেদন জানিয়েছে এখন তোমরা ভেবে দেখ কি করবে’।

ইসলামের অস্ত্র ভান্ডারে তখন কিছু ভাঙ্গা ও অকেজো তীর পরেছিল। কিন্তু আত্মসম্ভ্রমশীল জাতীর কয়েক হাজার বালক ও বৃদ্ধ তরবারি কোষ মুক্ত করে ফেলল। সমস্যা হল তখন এই ক্ষুদ্র বাহিনীকে নেতৃত্ব দেয়ার মত যোগ্য কোন সালার ছিল না, সবাই পূর্ব পশ্চিমের রণক্ষেত্রে। হাজ্জাজ অপারগ হয়ে তার ভাতিজা ও জামাতা সতের বছরের এক বালককে এই বাহিনীর সালার করে পাঠালেন। মুসলিম জাতি ইতিহাসের ইতিহাস রচনা করল। সেদিন দিবসের সুর্য আর রাতের নক্ষত্ররাজি প্রথমবারের মত দেখল পৃথিবীর বুকে এক অপার বিস্ময়। ঐতিহাসিকের কলম মহা সমরবিদদের তালিকায় সতের বছরের এক বালকের নাম লিপিবদ্ধ করতে বাধ্য হল। তাওহীদের বলে বলিয়ান সতের বছরের মুহাম্মাদ বিন কাশিমের ইস্পাত বাহুর তরবারি দাহিরের মস্তকে বজ্রের মত আপতিত হল। দাহিরের উদ্ধতশির সিন্ধুর ধুলায় লুটিয়ে পরল। অন্ধকারের রাজত্ব সমাপ্ত হল, আলোর যাত্রা শুরু হল, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হল। এক বালিকার আহ্বানে ভারতবাসী প্রথমবারের মত ইসলামের আলোক শিখা দেখতে পেল।

প্রাচীন গ্রিস। স্পার্টার রাজা মেনেলাউসের স্ত্রী বিশ্ব সুন্দরী হেলেন। ট্রয়ের রাজা প্রায়ামের পুত্র এবং মহাবির হেক্টরের কনিষ্ঠ ভ্রাতা প্যারিস তাকে প্রেম নিবেদনের মাধ্যমে অপহরন করে নিয়ে আসে। এতে গ্রিসবাসীর আত্মসম্ভ্রমে আঘাত লাগে। সমগ্র গ্রিস তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে। তারা এক যোগে ট্রয় আক্রমণ করে। অ্যাকিলিস মহাবির হেক্টরকে বধ করে। ট্রয় নগরী জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয়া হয়। সকল নাগরিক হত্যা করা হয়। প্যারিস নিহত, হেলেন ভিকোবাসের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। মেনেলাউস ও ওডিউস হেলেনের সন্ধানে বের হয়। মেনেলাউস ভিকোবাসকে হত্যা করে স্ত্রীকে হত্যা করার জন্য রক্তাক্ত তরবারি হেলেনের প্রতি উদ্যত করে। কিন্তু যুগে যুগে চির বিজয়ী তরবারি নারী প্রেমের সামনে পরাজিত হয়। মেনেলাউসের হাত থেকে তরবারি পরে গেল, সে তরবারির বদলে স্ত্রীর হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল। হেলেন যাচ্ছে, যাচ্ছে সে ট্রয়ের ধ্বংস স্তূপের উপর দিয়ে হেটে হেটে গ্রিসের উদ্দেশ্যে, স্বামীর ঘরে। একজন নারীর প্রেমে একটা দেশ একটা জাতি একটা জনপদ ধ্বংস হল। উভয় পক্ষের লক্ষ লক্ষ বীরের জীবনপাত ঘটল।

কাজেই এ ধুলির ধরায় যা কিছু সুন্দর আর যা কিছু অসুন্দর তার মূলে রয়েছে নারী। নারীই মূল, নারীই আসল। নারী কেন্দ্রিক এই পৃথিবী ও সৃষ্টি জগত আবর্তিত হয়। বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। (নজরুল)

ধর্ম গ্রন্থ বলে, পুরুষ দেহ থেকে নারী দেহের সৃষ্টি। অর্থাৎ নারী পুরুষ দেহের অর্ধেক। এজন্যই পুরুষ পিতা মাতাকে ছেড়ে নারীর সাথে ঘর বাধে। দু’টি দেহ মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়, এক দেহ হয়ে যায়। কিন্তু যখনি নারী পুরুষ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তখন সেই পুরুষ অর্ধাংশ দেহ নিয়ে বেঁচে থাকে না, বেঁচে থাকতে পারে না। হাসানও অর্ধাংশ দেহ হয়ে গেছে।

২৪ শে জুলাই, ২০০৬ সাল। মেয়েটা সকালে ঘুম থেকে উঠে আধো ঘুম আধো চেতন অবস্থায় দুধ খাওয়ার জন্য কাথামোড়া দেয়া বাবার শরীরে মুখ গুজে গুজে মায়ের দুধ খুঁজল, পেল না। শুয়ে শুয়ে কান্না শুরু করল, হাগা মুতা করল, মায়ের জন্য কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পরল। ঘুম ভেঙ্গে আবার কান্না শুরু করল। বাবাকে হাতরিয়ে দুধ খেতে চাইল। বিছানায় গড়িয়ে গড়িয়ে মাকে খুঁজল, পায়খানা পেশাব বিছানায় ছড়িয়ে পরল। তার গলা শুকিয়ে গেছে, কাঁদতেও পারছে না। অবশেষে মাকে খুঁজে খুঁজে বিছানায় গড়াতে গড়াতে বাবার পায়ের পিছন দিয়ে খাটের কিনারে চলে গেল। খাট থেকে বের হওয়ার জন্য তোশকের নীচে গুজা মশারী ধরে টানতে লাগল। মশারী ফসকিয়ে নামতে চাইল, আর এমনি উল্টে গিয়ে চিৎ হয়ে ফ্লোরে পরে গেল। সাথে সাথে চিৎকার দিয়ে চার হাত পা উপরে তুলে মুখটা বিকট হা করে দম বন্ধ করল। তার ছোট্ট শরীরটা কাঁপছে, মুখটা কালো হয়ে গেছে, আল জিহ্ববা দেখা যাচ্ছে।

হাসান রাত্রে শুয়ার পর আর চেতন পায়নি, নাকে মুখে কাঁথামোড়ি দিয়ে বেহুশ হয়ে পরে আছে। তার শরীরের তাপমাত্রা ১০৪ ডিগ্রি। ঠাণ্ডায় শরীর কাঁপছে, গোঙ্গানির শব্দ হচ্ছে। কিন্তু দুপুরে বিকট চিৎকারে চেতনা ফিরে পেয়ে লাফিয়ে উঠল, খাট থেকে গড়িয়ে মশারির নিম্নাংশসহ মাটিতে গড়িয়ে পরল। চোখের পলকে মেয়েকে টান দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরল, কান্না থামানোর জন্য ঝাকাতে লাগল, তার মাথা ঘুরাচ্ছে, বসে থাকতে পারল না, খাটের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে বসল। মেয়েটা আকুল হয়ে কাঁদছে, এক অসহায় বাবা অন্তহীন বেদনা নিয়ে বাচ্চাকে ঝাকাচ্ছে আদর করছে, আর তার চোখের পানি টপটপ করে মেয়ের শরীরে ঝরে পরছে।

কিছুক্ষণ পর মেয়ের তীব্র কান্নাটা কিছু কমে এল। সে বাচ্চাকে ফ্লোরে বসিয়ে খাওয়ার জন্য একটা কিছু আনতে উঠে দাঁড়াল কিন্তু সাথে সাথে মাথা ঘুরিয়ে পরে গেল। তার চোখের সামনে ঘরটা লাঠিমের মত ঘুরছে, মাথার ভিতরটা ফাঁকা মনে হল। কিছুক্ষণ এভাবেই পরে থাকল। তার শরীর কবুতরের শরীরের মত থরথর করে কাঁপছে, হামাগুড়ি দিয়ে খাটের পাশে এল, কাথাটা নিয়ে গায়ে জড়াল। তারপর চতুষ্পদ প্রাণীর মত দুই হাত ও হাটুতে ভর করে হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে একটু দূর থেকে পলিথিনগুলি আনল, রুটি, পাউরুটি, বিস্কুট, আপেল আঙ্গুর ইত্যাদি বাচ্চার সামনে খুলে দিল। মেয়েটা ক্ষুধার জ্বলায় খাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। সে খাটে হেলান দিয়ে বাচ্চার মুখে তুলে তুলে সবগুলি থেকে একটু একটু করে খাওয়াল। বাচ্চা মাম মাম (পানি) শুরু করল। সে আবার হামাগুড়ি দিয়ে বাথরুমে গেল, কাথাটা সামলিয়ে অতিকষ্টে আস্তে আস্তে টিউবওয়েল চেপে গ্লাস দুয়েক পানি নিয়ে এল। বাচ্চাকে খাওয়াল, এবার মেয়েটা শান্ত হল।

সে বারবার মেয়েকে আব্বা আব্বা ডাকতে ডাকতে মেয়েও ডাক শিখে গেছে অথবা পূর্বের ডাক স্বরণ হয়ে গেছে, খাওয়ার পর মেয়েটা হাটাহাটি করছে আর হাসছে। হাসান মৃদু কণ্ঠে আব্বা আব্বা বলে ডাকছে। হঠাৎ মেয়েটা তার কাছে এসে বাবার নাকে হাত লাগিয়ে বাব্বা বলে উচ্ছসিত হাসি মারল। এই হাসি এক মুমূর্ষু বাবাকে টেনে নিল সুখ উল্লাসের এক অনন্ত বিবরে। সাথে সাথে সে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল। বাবার কান্নায় হঠাৎ মেয়েটাও একটু কেঁদে উঠল। কিন্তু এখন তার খেলার সময়, বাবার কোল থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সে আপেল নিয়ে খেলায় মত্ত হল।

হাসান এই প্রথম দেখল বাচ্চার শরীরময় পায়খানা লেগে আছে। পরিস্কার করার কাপড়ের অভাব নাই। মা মেয়ের পুরাতন কাপড়ের একটা পুটলি নেয়ার জন্য বিছানায় উঠল কিন্তু তার মাথা ঘুরিয়ে গেল। বিছানায় বাচ্চার হাগা মুতা ছড়িয়ে আছে। সে একটা পুটলি খোলে আগে বাচ্চার শরীর পরিস্কার করল। তারপর বিছানায় উঠে পুরাতন কাপড়ে পায়খানা মুছে মুছে ঘরের কোণায় নিক্ষেপ করল। তারপর আবার ফ্লোরে গিয়ে বসল। মেয়েকে ডেকে ডেকে কাছে এনে কয়েকটা আঙ্গুর খাওয়াল কিন্তু মেয়ে তার কোলে থাকে না, আপেল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে আর খেলছে। সে নিজেও কিছু রুটি ও আপেল খেল। এরপরই তার পেট কামড় দিয়ে উঠল। সে গায়ের কাঁথা রেখে বাথরুমে যেতে চাইল। কিন্তু কাঁথা খোলার সাথে সাথে গা শিউরে উঠল, শরীরে কাঁপুনি শুরু হল। তাড়াতাড়ি আবার কাঁথা গায়ে দিয়েই চৌথাঙ্গে হেটে হেটে বাথরুমে গেল।

টিউবওয়েল চেপে বদনা ভরা সম্ভব না। বালতিতে কাপড় ধোয়া পচা পানি ছিল। সে বসে বসে মগ দিয়ে বালতির পানি দিয়ে বদনা ভরল। তারপর দেয়ালে হাত ঠেকিয়ে উঠে দাঁড়াল, পাদানিতে এক পা রাখল, দেয়াল থেকে হাত ছেড়ে দিয়ে আরেক পা রাখার সময় মাথা ঘুরিয়ে পরে গেল, ডান পা কমোডে ঢুকে গেল। দেয়ালে প্রচণ্ড জোরে মাথা ঠুকে গেল। তীব্র আঘাতে সে ককিয়ে উঠল, পা বুঝি ভেঙ্গে গেল। দু’পাশের দেয়ালে হাত ঠেকিয়ে বসে অতিকষ্টে পা টেনে বের করল। আর তারপরেই অচেতন হয়ে বাথরুমেই পরে থাকল।

মেয়েটা কিছুক্ষণ খেলাধুলা করল, হাসল। তারপর আবার মায়ের জন্য কান্নাকাটি শুরু করল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদল, তারপর কাঁদতে কাঁদতে মাকে খোজা শুরু করল। মায়ের খোজে পাশের রুমে গেল, বারান্দায় গেল, রান্না ঘরে গেল, বাথরুমে গিয়ে উকি দিল কিন্তু মাকে কোথাও খুঁজে পেল না। অবশেষে বাইরের রুমের দরজায় গিয়ে কাঁদতে লাগল আর দরজায় হাত মারতে লাগল, এভাবে অনেকক্ষণ পর্যন্ত কাঁদল। মা আসে না কেন- রাগে মেঝেতে পরে গড়াগড়ি করে কাঁদতে লাগল। এক সময় ক্লান্ত হয়ে সেখানেই ঘুমিয়ে পরল।

পড়ন্ত বিকেল। হাসান চেতনা পেয়ে উঠে বসল। তারপর অতিকষ্টে কাঁথা ও কাপড় সামলিয়ে কমোটে বসল। তার পা ভাঙ্গেনি মচকে গেছে। তারপর বাম পাশের দেয়ালে ঢেস দিয়ে কোন রকমে পানি খরচ করে বসে বসে ব্যাঙের মত হেটে বাথরুম থেকে বের হল। শরীরের তাপমাত্রা ১০৪ ডিগ্রি অতিক্রম করেছে। ব্যাথায় মাথা ছিড়ে যাচ্ছে, মাথায় যেন হিমালয় চেপে আছে। বারান্দায় গিয়ে দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়াতে চাইল কিন্তু আবার মাথা ঘুরিয়ে পরে গেল। তারপর চারজানু হয়ে হেটে হেটে ঘরে ঢুকল কিন্তু মেয়েকে দেখতে পেল না। চমকে উঠে খোলা দরজা দিয়ে পাশের রুমে তাকাল, মেয়েটা কাত হয়ে মাটিতে ঘুমিয়ে আছে, সে হামাগুড়ি দিয়ে বাচ্চার কাছে গেল। কোন নির্জন দ্বীপে মৃত্যু পথযাত্রী বাবা যেমন অসহায় হয়ে তার শিশু সন্তানের দিকে তাকিয়ে থাকে সেও মেয়ের দিকে এভাবেই কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তারপর মেয়ের মুখের উপর উপোর হয়ে পরল, সর্বরিক্ত বাবার শেষ সম্বল তপ্তঅশ্রু মেয়ের মুখে ও মাথায় টপটপ করে পরতে লাগল। বাচ্চাকে আলতো করে চুম্বন করল। তারপর তার পাশেই শুয়ে পরল। মেয়ের একটা পা তার মুখের সামনে, একজন বাবার চোখে পৃথিবীতে এর চেয়ে সুন্দর ও মূল্যবান কোন সম্পদ নাই। সে পা- টা টেনে এনে পায়ের পাতা চোখে লাগাল, নাকে মুখে ও গালে ঘষল, তারপর ঠোঁটে লাগিয়ে পাগলের মত অনবরত চুম্বন করতে লাগল, চোখের কোণা বেয়ে নোনাজল ফ্লোরে জমে বেয়ে চলল। এক সময় সে দুঃখ ব্যথা ও যন্ত্রণা নিয়ে ঘুমিয়ে পরল বা অচেতন হয়ে পরল।

সন্ধার পর মশার কামড়ে মেয়েটা জাগ্রত হয়ে ছটফট করতে লাগল। হাত পা ছুড়ে মাটিতে শুয়ে শুয়েই কাঁদতে লাগল। কিন্তু কেউ তাকে কোলে নিল না, মাকে পেল না, মা এল না। অবশেষে উঠে কাঁদতে কাঁদতে মাকে খুঁজতে লাগল। গতরাতে বাতি জ্বালানো হয়েছিল আর নিভানো হয়নি, ঘর আলোকিত। নিভানোর মত হুস ও চেতনা তার নেই। মেয়েটা ঘরময় ঘুরল কিন্তু মাকে পেল না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ কাঁদল। তারপর মায়ের খোজে বাথরুমে ঢুকল আর পা পিছলে পরে গেল, ফ্লোরে মাথার আঘাতে পুরা বাসাটা কেঁপে উঠল। হাসান বিকট চিৎকার শুনে উঠে দৌড় দিতে চাইল কিন্তু মাথা ঘুরিয়ে পরে গেল। হামাগুড়ি দিতে চাইল কিন্তু তাড়াতাড়ি হচ্ছে না, এবার গড়াতে শুরু করল। মেয়ের কান্না শুনে গড়িয়ে আঙ্কুরা দিয়ে বাথরুমে গেল এবং মেয়েকে টান দিয়ে কোলে নিল। তারপর বারান্দার দেয়ালে ঢেস দিয়ে বসে কুকুরের মত হাফাতে লাগল, তার শরীর থরথর করে কাঁপছে।

ক্ষুধা তৃঞ্চায় মেয়েটা কাঁদতেও পারছে না, তার গলা শুকিয়ে গেছে। অনেকক্ষণ বসে থেকে শরীরটা শান্ত হওয়ার পর সে চারজানু হয়ে হেঁটে হেঁটে ঘরে গেল। খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে মেয়েকে রুটি, বিস্কুট ও ফল খাওয়াতে লাগল। মেয়ে আম আম শুরু করল। সে পানি খাওয়াল। মেয়েটা একটু শান্ত হয়ে বাপের কোলে বসে নিজেই খাওয়া শুরু করল। হাসান তন্দ্রাচ্ছন্ন হল। তারপর অচেতন হয়ে পরল। মেয়েটা শান্ত হয়ে কিছুক্ষণ বাপের কোলে কাটাল। তারপর আপেল আঙ্গুর নিয়ে খেলা শুরু করল। কিন্তু মশার কামড়ে অস্থির হয়ে উঠল। হাত পা নাচাচ্ছে আর খেলছে।। কিছুক্ষণ পর মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে কান্না শুরু করল। কাঁদে আর মাকে খুঁজে, এ ঘর থেকে ওঘরে যায়, শত শত মশা তার পিছনে পিছনে যায়, কামড়ায়, মেয়ে অস্থির হয়ে হাত নাচায়, পা ছোড়ে, মাকে ডাকে, ঘরময় ছোটে বেড়ায় কিন্তু মা আসে না। আকুল হয়ে কাঁদে, আম্মু আম্মু ডাকে কিন্তু মা সাড়া দেয় না।

অবশেষে বাচ্চাটা নিরুপায় হয়ে বাপের কাছে গিয়ে বাব্বা বাব্বা ডাকতে লাগল কিন্তু বাবা তাকে কোলে নিল না। তারপর মশার কামড় থেকে বাঁচতে বাপের কোলে বসে পরল। মেয়ে বসল আর হাতের উপর চাপ খেয়ে তার চেতনা ফিরল, সে দেখতে পেল অসংখ্য মশা মেয়েটাকে ঘিরে আছে, কামড়াচ্ছে, আর বাচ্চাটা হাত পা নাচাচ্ছে, শরীর মোচড়াচ্ছে। বাচ্চাটাকে কাঁথায় জড়িয়ে কোলে নিয়ে সে আকুল হয়ে কেঁদে উঠল। এক নিঃসহায় বাবা অসহায় হয়ে কাঁদতে থাকে। কিছুক্ষণ পর বুঝল পায়খানা বাচ্চার গায়ে ও ফ্লোরে ছড়িয়ে আছে। আবার পুরাতন কাপড় নিয়ে পায়খানা মুছে ঘরের কোণায় নিক্ষেপ করল। তারপর বাচ্চাকে আরো কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করল কিন্তু সে খেল না শুধু একটু পানি খেল। এরপর কিছু আপেল ও আঙ্গুর নিয়ে মশারির মধ্যে ঢুকে পরল। মেয়েকে শুইয়ে ঘুম পারানোর চেষ্টা করল কিন্তু সে শুয়ে থাকে না, উঠে বসে মায়ের জন্য কান্না জুড়ল। হাসান অনেকক্ষণ চেষ্টা করে এক সময় নিজেই ঘুমিয়ে পরল বা অচেতন হয়ে গেল। বাচ্চাটা অনেক কাঁদল তারপর ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরল।

মধ্যরাত। এক কান্তিময় পুরুষ, যুল ওক্বার, জ্যোর্তিময় চেহারা, শ্বেত-শুভ্র পোশাক, ধবধবে সাদা পাগড়ী, সাদা আল খাল্লা, হাতে বিশাল বড় এক কিতাব। একটি শিশু তার হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে আর প্রশ্ন করছে, আব্বা এটা কি? - কিতাব। - কি কিতাব? - বুখারি। - বুখারি কি? এভাবে শিশুটি বাবাকে প্রশ্নে প্রশ্নে বিরক্ত করছে। সারা রাত হাসানের চোখে এই মধুময় দৃশ্য ঘুরে বেড়াল।

৬৭

২৫ জুলাই। বাচ্চাটা সকালে ঘুম থেকে উঠে দুধ খাওয়ার জন্য শুয়ে শুয়ে কাঁদল, মায়ের খোজে বিছানায় গড়াগড়ি করল হাগামুতা বিছানায় ছড়িয়ে দিল। তারপর খাট থেকে নামতে চেষ্টা করল। বাচ্চার তীব্র কান্নায় হাসানের চেতন ফিরল। সে লাফিয়ে উঠে বাচ্চাকে ধরতে গেল। বাচ্চাটা খাট থেকে নামতে গিয়ে মশারির সাথে পেছিয়ে খাটের নীচে মাটি ছুই ছুই করে ঝুলে আছে। সে তাড়াতাড়ি বাচ্চাকে ধরল তারপর মাটিতে নেমে বাচ্চার সামনে রুটি, বিস্কুট ও ফল মেলে ধরল। বাচ্চা রুটি খেল না, তাতে গন্ধ উঠে গেছে কিন্তু সেই অনুভূতি তার ছিল না। বাচ্চা নিজেই বিস্কুট খেতে লাগল, সে আপেল কেটে আঙ্গুর ও আপেল জগের পানিতে ধুয়ে একটা কাগজের উপর রাখল। বাচ্চা নিজ হাতেই খেতে লাগল। তারপর সে পুরাতন কাপড় দিয়ে বাচ্চার শরীর ও বিছানার পায়খানা মুছে পরিস্কার করে ঘরের কোণায় ফেলল।

ব্যাথায় মাথাটা ছিড়ে যাচ্ছে, পাহাড়ের মত ভারি। দাড়াতে চাইল কিন্তু পারল না, মাথা ঘুরিয়ে বসে পরল। বাচ্চা পানি খেতে চাচ্ছে, সে জগটা নিয়ে চার হাত পায়ে কিছুটা গিয়ে তারপর কোমড় হেঁচড়ে হেঁচড়ে বাথরুমে ঢুকল। জগটা নীচে রেখে টিউবওয়েলের হাতলে ধরল। চার আঙ্গুল নীচে ও বুড়ো আঙ্গুল হাতলের উপরে রেখে মুঠি করে ধরে চাপ দিল কিন্তু পানি এল না। সে দাড়াতে পারে না, বসে চাপ দিচ্ছে। দ্বিতীয়বার হাতলটা তুলে একটু জোরে চাপ দিল। পানি এল মাত্র কয়েক ফোটা। এবার হাতল ধরে একটু হেচকা চাপ দিতে চাইল। আর অমনি বুড়ো আঙ্গুল ফসকে গিয়ে হাতলটা লাফিয়ে উঠে তার থুতনির নীচে প্রচন্ড আঘাত করল। সাথা সাথে বিকট আর্তনাদ করে সে বাথরুমেই গড়িয়ে পরল এবং বেহুশ হয়ে গেল। হাতলের প্রচণ্ড আঘাতে তার থুতনি ফেটে গেছে, দাঁতে দাঁতে বারি খেয়ে দাঁত নড়ে গেছে, ঠোঁট ও দাড়ি বেয়ে রক্ত ঝরছে। সে বেহুঁশ হয়ে বাথরুমেই পরে থাকল।

বাচ্চাটা একা একাই কিছুক্ষণ খেল তারপর মাম মাম (পানি) করে দরজার দিকে তাকিয়ে বাবাকে ডাকল। কিছুক্ষণ পর কান্না শুরু করল। অনেকক্ষণ কেঁদে কেঁদে আম্মু আম্মু বলে মাকে ডাকতে লাগল, ঘরময় খুঁজতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে দরজার কাছে যায়, দরজায় হাত মারে, মাকে ডাকে, আবার ঘরে আসে। বারান্দায় যায়, বাথরুমে যায় বাব্বা বাব্বা বলে বাবাকে ডাকে কিন্তু তার বাবা বেহুশ হয়ে পরে আছে। আবার দরজার কাছে গিয়ে মাকে ডাকে হাত মারে, বাথরুমে গিয়ে বাব্বাকে ডাকে গায়ে হাত মারে। এভাবে অনেকক্ষণ পর্যন্ত ঘুরতে ঘুরতে ও কাঁদতে কাঁদতে বাচ্চাটা ক্লান্ত হয়ে পরল। তারপর ঘরের মেঝেতে এসে বসে বসে কিছুক্ষণ কাঁদল। তারপর অসহায় হয়ে শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পরল। পিপাসায় তার জিহ্বা শুকিয়ে গেছে।

বিকালে বাচ্চাটার ঘুম ভাঙ্গল। কিছুক্ষণ শুয়ে শুয়ে কাঁদল। তারপর কাঁদতে কাঁদতে আবার ঘরময় ঘুরতে শুরু করল মাকে ডাকল, দরজায় হাত মারল। অবশেষে বাথরুমে গিয়ে বাব্বাকে ডাকতে লাগল আর গায়ে হাত মারতে লাগল। কিন্তু বাব্বা উঠে না, সে অসহায় হয়ে বাব্বার পাশে ঘুরতে লাগল। হঠাৎ পা পিছলে পরে গেল আর দেয়ালে মাথা ঠুকে গেল। বিকট কান্নায় হাসানের চেতনা ফিরল। সে মেয়েকে টান দিয়ে কোলে নিয়ে ঝাকাতে লাগল। তারপর মেয়েকে নিয়ে কোমর হেঁচড়ে হেঁচড়ে বারান্দায় গিয়ে বসল। অনেকক্ষণ পর বাচ্চার কান্না কিছুটা কমে এল। এই প্রথম সে বুঝতে পারল রক্তে দাড়ি জবজবা হয়ে ভিজে আছে, বুকের সামনের কাঁথা রক্তে আধা লাল হয়ে আছে কিন্তু এ নিয়ে ভাববার ও চিন্তা করার মত অনুভূতি তার ছিল না।

হঠাৎ বাচ্চাকে পানি খাওয়ানোর কথা স্বরণ হল। পানি আনার জন্য সে উঠে দাঁড়াতে চাইল এবং দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়িয়ে গেল, মাথা ঘুরিয়ে পরল না, আসলে একটা ব্যথা আরেকটা ব্যথার উপশম করে দেয়। সে আস্তে হেঁটে গিয়ে বাথরুমের চৌকাঠ ধরে দাঁড়াল একটু কাশল থুথু ফেলল, থুথু লাল কিন্তু সেদিকে মনোযোগ দেয়ার মত চেতনা তার ছিল না। তারপর বাথরুমের দেয়ালে হেলান দিল, এক হাতে চৌকাঠে ধরল, তারপর পায়ের তলা কলের হাতলের উপর রাখল, বুড়ো আঙ্গুল ও সংলগ্ন আঙ্গুলে হাতল চিমটি দিয়ে ধরে দিল চাপ। এবার গলগল করে পানি বেরিয়ে এল। আধা জগ ভরে এক হাতে জগ নিল অন্য হাতে দেয়াল ধরে ধরে ঘরে ঢুকল। পানির জন্য মেয়েটা পাগল হয়ে গছে, জগের উপর উপোর হয়ে পরতে চাইল। সে কাছেই গ্লাসটা টান দিয়ে মেয়েকে পানি খাওয়াল। মেয়েটা শান্ত হল আর সে খাটের সাথে ঢেস দিয়ে আবার অচেতন হয়ে পরল।

সন্ধার পর মেয়েটার উপর আবার মশার ঝাক হামলে পরল, শুরু হয় এক অসহায় শিশুর আরশ কাঁপানো আর্তি। সে আম্মু আম্মু বলে ঘরময় ছোটাছোটি করে, দরজায় গিয়ে হাত মারে, বাবার কাছে এসে ডাকে। এভাবে অনেক রাত পর্যন্ত বাচ্চাটা মশার কামড়ে অস্থির হয়ে হাত পা ছোড়ে ছোড়ে দৌড়াদৌড়ি করল আর কাঁদল। অবশেষে বাব্বা বাব্বা করে বাবার কোলে চেপে বসল। রাত এগারটার দিকে হাসানের চেতনা ফিরল। সে মেয়েকে আরো কিছু খাইয়ে বিছানায় নিয়ে গিয়ে শুয়ে পরল। মশার কামড়ে ও মায়ের জন্য কাঁদতে কাঁদতে বাচ্চাটার গায়ে জ্বর এসে গেছে। সে আরো কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে ঘুমিয়ে পরল।

এক কান্তিময় পুরুষ, যুলওক্বার, জ্যোতির্ময় চেহারা, শ্বেত-শুভ্র পোশাক পরা, একটা শিশু তার হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। হাঁটছে তারা এক উদ্যানে। সেখানে আছে দ্রাক্ষা বন, খর্জুর বীথিকা, বিভিন্ন ফল- ফুলের সমারোহ। যার তলদেশ দিয়ে নহরসমূহ প্রবাহিত। দুগ্ধ নহর, মধুর নহর, স্বচ্ছ স্ফটিক সুপেয় পানির নহর। পাখিদের কূজন আর মন মাতানো সঙ্গিত। হাসান সারা রাত সেই উদ্যানে ঘোরে বেড়াল।

এটাই হল গ্রাম আর শহরের পার্থক্য। গ্রামাঞ্চলে কেউ বিপদে পরলে গ্রামবাসী সবাই ঝাঁপিয়ে পরে। দুখি মানুষটির পাশে সবাই এসে দাঁড়ায়। তাকে ঘিরে রাখে, তার ব্যথিত ললাটে হাত বুলিয়ে দেয়, আশু মুছিয়ে দেয়, শান্তনা দেয়। রান্না-বান্নার প্রয়োজন থাকলে রান্না করে দেয়। আতুরে মা মারা গেলে একজন শিশুটির দায়িত্ব নেয় বাকীরা সবাই দেখাশুনা করে। বিপদগ্রস্ত হলে সবাই সম্মিলিতভাবে বিপদ প্রতিহত করে। অসুস্থ মুমূর্ষু হলে সবাই সেবা শুশ্রূষা করে, সাহস যোগায়। তখন দুঃখি মানুষের দুঃখ ঘোচে যায়, শান্তনা পায়, সাহস পায়।

পক্ষান্তরে শহর হল প্রাণহীন ইট, পাথর, বালি, সিমেন্টে গড়া কনক্রিটের জনপদ। আর এই কনক্রিটের সন্তানরা কনক্রিট হয়েই বেড়ে উঠে, ওদের বুকে মাংসপিণ্ড থাকে না, থাকে কনক্রিটের টুকরা। এ জন্যই সন্ত্রাসীরা যখন কোন মানুষকে মারে বা হত্যা করে তখন তারা সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে স্বচ্ছন্দে পাশ দিয়ে চলে যায়। তার বিলাস বহুল প্রাসাদের তলায় ডাস্টবিনে যে বুভুক্ষু বর্জ্য খেয়ে প্রাসাদের ছায়ায় পরে ঘুমিয়ে থাকে সেদিকে ফিরে তাকানোরও প্রয়োজন বোধ করে না। যুগ যুগ ধরে পাশাপাশি জায়গায় বসবাস করেও জানে না যে, পাশের বাসায় মানুষ বসবাস করে নাকি ভুত পেত্নি। পাশের বাসায় কান্নার রোল উঠলেও সুর ও সঙ্গিতের আসর বসেছে মনে করে পাশ কেটে চলে যায়। এই হল কনক্রিটের জনপদ, শহুরে জনপদে কনক্রিটের মানুষের জীবনাচার।

হাসান, একটি জলজ্যান্ত মানুষ। আজ কয়েক দিন ধরে তার কোন নাড়াচাড়া নাই, সাড়া শব্দ নাই, দেখা সাক্ষাৎ নাই, সে দিকে কারো কোন খেয়াল নাই, দায়িত্বশীলতা নাই। তার বাসায় একটি বাচ্চা কাঁদছে, আজ তিনদিন ধরে আকুল হয়ে কাঁদছে, অঝোরে কাঁদছে কিন্তু কেউ শুনে না, শুনেও না শুনার ভান করে চলে যায়। কেউ একটু দেখার, একটু খোজ খবর নেয়ার, একটু উকি মেরে দেখার প্রয়োজনবোধ করে না। এভাবেই সভ্য নগরীতে পৃথিবীর সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি বাসায় আবদ্ধ থেকে দু’টি প্রাণী তাদের নিয়তি নির্ধারিত পরিণতির দিকে ক্রমে ক্রমে এগিয়ে যাচ্ছে।

২৬ জুলাই, বাচ্চাটা সকালে ঘুম থেকে উঠল, মায়ের দুধ খেতে চাইল, কান্নাকাটি করল, হাগামুতায় বিছানা ও কাপড় চোপড় নষ্ট করল। তারপর নামতে চেষ্টা করে খাট থেকে পরে গেল, মাটিতে পরে অনেকক্ষণ কাঁদল, তারপর উঠে আম্মু আম্মু ডাকতে ডাকতে মাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করল। এরুম ওরুম বারান্দায়, বাথরুমে গিয়ে গিয়ে মাকে খুঁজল, বারবার দরজায় গিয়ে হাত মারল কিন্তু কেউ এগিয়ে এল না, মা তাকে কোলে নিল না, দুধ দিল না। বাব্বা বাব্বা ডাকে কিন্তু বাবা কোলে নিতে এগিয়ে এল না। অসহায় শিশু ক্ষুধা ও তৃঞ্চার জ্বালায় কাঁদতে কাঁদতে পুরা বাসাটায় চক্বর দিতে লাগল। হাসান বেহুশ হয়ে বিছানায় পরে আছে। আসলে সে তিনদিন ধরেই বেহুশ হয়ে আছে কিন্তু মেয়ের কান্না শুনলে সে অলৌকিকভাবে চেতনা ফিরে পায়।

গ্যাস্ট্রিক চরমে পৌছলে যা হয় তার সেটা হয়ে গেছে, খুসখুসি কাশ, কাশের সাথে রক্ত যায়। তার শরীরের তাপ মাত্রা ১০৫ ডিগ্রি এর বেশি। মাথার তীব্র ব্যথা ও তাপে মস্তিস্ক অকেজো হয়ে গেছে। কাজেই মাঝে মধ্যে সজাগ হলেও সে কোন কিছু চিন্তা করতে পারে না, কর্তব্য কি তা বুঝতে পারে না। বাড়িতে যাওয়া, কাউকে খবর দেয়া, ছাত্রদের ডেকে আনা বা অন্তত পাশের বাসার কাউকে ডাক দেয়া, এসব কিছুই তার মাথায় আসে না। তার চেতনা যেটুকু আছে তা শুধু মেয়ের দিকে, এ জন্যই মেয়ের কান্নার শব্দে তার চেতনা ফিরে আসে।

দুপুরে মেয়ের বিকট কান্নায় হাসানের ঘুম ভাঙ্গল। খাট থেকে লাফিয়ে নামতে গিয়ে কাঁথায় জড়িয়ে মাটিতে পরে গেল। তারপর দ্রুত হামাগুড়ি দিয়ে মেয়ের কান্নার শব্দ শুনে বাথরুমে গেল। মেয়েটা বাথরুমে উপোর হয়ে পরে ভীষণ ভাবে কাঁদছে। হাসান তড়িঘড়ি মেয়েকে কোলে নিল, বাচ্চাটার ঠোঁট কেটে ঠোঁট ও দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত বেরুচ্ছে। এক অসহায় বাবা তার সকল অনুভূতি চোখে জড়িয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, শুকিয়ে যাওয়া আখি সমুদ্র থেকে টপটপ করে রক্তাশ্রু ঝরে পরছে। সে কাঁথা দিয়ে মেয়েটার মুখ ও ঠোঁটের রক্ত মুছল। তারপর কোলে নিয়ে দেয়াল ধরে দাঁড়াল। না, মাথা ঘুরিয়ে পরে গেল না, হাঁটতে পারল এবং হেঁটে হেঁটে ঘরে গিয়ে মেয়েকে খাওয়াতে বসল। ফল ও বিস্কুটের প্যাকেট মেয়ের সামলে খোলে দিল। ক্ষুধার জ্বালায় বাচ্চা নিজেই খেতে লাগল। হঠাৎ মনে হল আজ তিন দিন ধরে ভাতের সাথে দেখা নাই। মেয়েটাকে চারটে ভাত খাওয়ানো দরকার। উঠে গেল ভাত রাধতে।

পাতিলে চারটে চাউল নিয়ে বাথরুমে গেল। টিউবওয়েলের হাতলে পায়ে চেপে কিছুটা পানি বের করল। চাউল না ধুয়ে এভাবেই নিয়ে চুলার উপর বসিয়ে দিল, সে চুলার কাছে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসল। মেয়ে আম আম (পানি) করতে করতে তার কাছে এল। সে উঠে জগ নিয়ে বাথরুমে গেল। আবার পায়ে চেপে একটু পানি এনে বাচ্চাকে খাওয়াল। হঠাৎ মনে হল, তার তো ভরসা নাই কখন বেহুশ হয়ে যায়, ওদিকে চুলায় আগুন জ্বালানো, বাচ্চা কখন চুলায় গিয়ে হাত পোড়ে বা বাথরুমে গিয়ে ব্যথা পায়। কাজেই আটকে রাখা দরকার। সে বাচ্চার মায়ের পুরাতন একটা ওড়না নিয়ে এক প্রান্ত বাচ্চার পায়ে অপর প্রান্ত খাটের পায়ায় বেধে দিল, তারপর ফল ও বিস্কুট বাচ্চার সামনে রেখে সে রান্না ঘরে চলে গেল। খুসখুসিয়ে কিছুক্ষণ কাশল, দেয়াল ঘেঁষে মাটিতে থুথু নিক্ষেপ করল, আর থু থু বলতে শুধু রক্ত কিন্তু সেদিকে তার কোন অনুভূতি নেই। তার শরীর কাঁপছে, কাঁথাটা ভাল করে গায়ে জড়িয়ে চুলার কাছেই দেয়ালে ঢেস দিয়ে বসে পরল। ভাত পোড়ে যায় কি না দেখার জন্যই সে বসল কিন্তু অল্পক্ষণেই অচেতন হয়ে পরল।

পাতিল থেকে ধোয়ার কুণ্ডলী উঠছে। ঘর ধোয়াশাচ্ছন্ন হয়ে গেছে। হাসানের নাকে মুখে ধোয়া ঢুকে দম বন্ধ হয়ে এল। কাশতে কাশতে জাগ্রত হয়ে দেখল পাতিল থেকে ধোয়ার কুণ্ডলী উঠছে। হায় হতভাগা, মানুষ যাকে শাস্তি দিল আল্লাহও তাকে শাস্তি দেয়। ভাত পোড়ে যাচ্ছে দেখে তাড়াতাড়ি পাতিলের দুপাশে খালি হাতে ধরে পাতিলটা নামাতে গেল আর সাথে সাথে তীব্র আর্তনাদ করে মাটিতে গড়িয়ে পরল। দু’হাত দুই উরুর চিপায় চেপে ধরে তীব্র যন্ত্রণায় মাথা ঝাকাতে লাগল, দু’পাশে শরীর কাতরাতে লাগল আর আর্তনাদ করতে লাগল, ‘আল্লাহ্‌ গো, আল্লাহগো, মা গো, মাগো’ বলে তরফাতে তরফাতে বেহুশ হয়ে গেল। হাতের সবগুলি আঙ্গুলের মাথা পোড়ে গেছে, ডান হাতের মধ্যমার আগাটা পোড়ে গোশত পাতিলের কান্দিতে লেগে আছে। বাকী সবগুলি আঙ্গুলে ফোসকা পরে গেছে।

শিশুদেহের উপর গত তিনদিনের অত্যাচার, মাতৃ বিয়োগ ও বাথরুমে পরে গিয়ে নাক মুখ চেচে গিয়ে মেয়েটির জ্বর উঠে গেছে। প্রচন্ড জ্বর, ঠাণ্ডায় শরীর কাঁপছে। সে অবসন্ন দেহে মাটিতে শুয়ে ঘুমিয়ে পরল। বিকালে জ্বরের প্রকোপে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে তার ঘুম ভাঙ্গল। শুয়ে শুয়ে কিছুক্ষণ কাঁদল, মাকে ডাকল। বাবাকে ডাকল কিন্তু কেউ এল না। অবশেষে তার ছোট্ট দুর্বল দেহটি নিয়ে দাঁড়াল হাঁটতে চাইল কিন্তু বাধা পায়ে টান লেগে মুখ থুবড়ে পরে গেল। আকুল হয়ে কাঁদতে লাগল। কিন্তু সেই কান্নার আওয়াজ অচেতন বাবার কানে পৌঁছল না। শিশুটির দেহে আর কোন শক্তি অবশিষ্ট নাই। সে শুয়ে শুয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে ঘ্যান ঘ্যান করে কাঁদতে লাগল।

প্রায় সন্ধ্যায় হাসানের ঘুম ভাঙ্গল। ভাতের পাতিলটা চুলোর ধারে কাত হয়ে পরে আছে। মেয়েকে খাওয়াতে হবে স্বরণ হতেই পাতিলটা নিয়ে সে ঘরে ঢুকল। কাছেই পরে থাকা প্লেটটা নিল। এ দীর্ঘ সময়ে পাতিল ও ভাত ঠাণ্ডা হয়ে আছে। প্লেটে ময়লা পরে আছে, ধুতে হবে কিন্তু তার হুশ নেই। পাতিল থেকে ভাত নেয়ার জন্য ডান হাত ঢুকাল কিন্তু মধ্যমার পোড়ে যাওয়া মাংসের কাঁচা ঘায়ে ভাতের গুতায় ককিয়ে উঠল। তারপর বাম হাতে ভাত বাড়ল। চামচ আনার মত চেতনা তার নেই। আর ভাত বলতে পাতিলের মাঝখানে কয়েকটা সাদা ভাত, চারিপার্শ্ব পোড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে, কাল ও লাল বর্ণ ধারণ করে আছে। কিন্তু কি দিয়ে খাওয়াবে। মনে হল বৈয়ামে চিনি আছে। বৈয়াম নিয়ে এসে চিনি ও একটু পানি দিয়ে বাম হাতে মাখাল। ভাত দেখে খাওয়ার জন্য মেয়েটা পাগল হয়ে গেছে, সে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বাম হাতে সাদা ভাতগুলি খাওয়াল, পানি খাওয়াল। তারপর নিজেও পোড়া ভাত বাম হাতে কয়েক লোকমা খেল, পানি খেল। তারপর কাঁথাটা ভাল করে জড়িয়ে খাটে হেলান দিয়ে বসল। বাচ্চাটা ভাত খেয়ে শান্ত হয়ে বসে আছে। সেও কিছুক্ষণের মধ্যে আবার চেতনা হারাল।

সন্ধ্যার পর ঝাকে ঝাকে মশা শিশুটার উপর আক্রমণ করল। অসহায় শিশু মশার কামড়ে হাত পা নাড়াল, শরীর মোচরাল কিন্তু মশার কামড় বেড়েই চলল। মাটিতে শুয়ে পরে, গড়ায় তবুও মশা নিস্কৃতি দেয়না। আম্মু আম্মু বলে কাঁদতে কাঁদতে মাকে ডাকে, বাব্বা বাব্বা বলে বাবাকে ডাকে কিন্তু কেউ আসে না। কামড়ের জ্বলায় অস্থির হয়ে সে উঠে ছুটতে চায় কিন্তু পা বাধা যেতে পারে না। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে মৃতবৎ মাটিতে শুয়ে থাকে। তার শরীরে আর শক্তি নেই, জ্বরে গা পোড়ে যাচ্ছে। ঘ্যান ঘ্যান করে কাঁদছে আর মশা স্বাধীনভাবে কামড়িয়ে যাচ্ছে। হাসান বাচ্চা থেকে কিছুটা দুরে মাটিতে বসে খাটে হেলান দিয়ে বেহুশ হয়ে পরে আছে। অবশেষে বাচ্চাটা অসহায় হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাবার কাছে গেল, কোলে উঠতে চাইল কিন্তু পা বাধা, সে কোল নাগাল পেল না। শরীরটা টানা দিয়ে বাবার হাটুতে মাথা রাখতে সক্ষম হল। তারপর বাব্বা বাব্বা বলে বাবার পায়ে হাত মারতে লাগল।

হাসান কিছুটা চেতন পেয়ে চমকে উঠল। মশার ঝাক মেয়েটাকে ঘিরে আছে। সে তাড়াতাড়ি মেয়ের পায়ের বাধন খুলল। তারপর কোলে নিয়ে পাগলের মত চুমুতে লাগল। অসহায় এক বাবার চোখের পানি ঝরে পরে বাচ্চার দেহে। আজ সে পায়খানা পরিস্কার করেনি স্বরণ নেই চেতনা নেই। বাচ্চার সমস্ত শরীরে পায়খানা লেগে আছে, বিছানায় ও ফ্লোরে পায়খানা ছড়িয়ে আছে কিন্তু তার হুস নাই। সে মেয়েকে নিয়ে মশারির মধ্যে ঢুকে গেল এবং অল্পক্ষণেই আবার ঘুমিয়ে পরল বা চেতনা হারাল। মেয়ের শরীরের শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে, কান্নার শক্তিটুকুও আর অবশিষ্ট নাই। মায়ের জন্য কিছুক্ষণ ঘ্যান ঘ্যান করে কেঁদে সেও ঘুমিয়ে পরল। পৃথিবীর দুই হতভাগ্য বাবা ও সন্তান বিস্টা ছড়ানো বিছানায় জামালপুরের শেষ ঘুমে আচ্ছন্ন হল।

বিষয়: সাহিত্য

১৩৭৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File