চিঠি (কবর)-৬৫ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১১:২৮:৩২ সকাল

অনেকক্ষণ পর শিশুর কান্নার আওয়াজ পেয়ে তার চেতনা ফিরল। বাচ্চাকে দেখেই তার বুকটা ধক করে উঠল, হতভাগ্য বাবা এক বছর পর আজ সন্তানের মুখ দেখবে। লাফিয়ে উঠে অগ্রসর হল। দূর থেকেই পটেটো বাচ্চাকে তার কোলে নিক্ষেপ করে বলল, ‘নিয়ে যাও মিয়াঁ তোমার ধন’। হাসান ত্বরিতে অগ্রসর হয়ে পলকে ঝুকে পরে খপ করে বাচ্চাকে ধরল, নইলে মাটিতে পরে যেত। বাচ্চাকে নিয়েই বুকে চেপে ধরে সে ডুকরে কেঁদে উঠল, ‘আজ থেকে আমি ও আমার সন্তান নিঃস্ব হয়ে গেলাম, আমাদের আর কিছুই থাকল না, ওরা আমাদের বাঁচতে দিল না, মানুষের মত বাঁচতে দিল না’। পটেটো বাচ্চাকে ছোড়ে দেয়ার সময় ভয় পেয়ে কান্নায় বাচ্চার মুখটা বিকট হা করে উঠেছিল- অনেকক্ষণ পর্যন্ত মুখ বন্ধ করেনি, এক মিনিট পর দম ছেড়ে শুরু করল তীব্র কান্না। হাসান বাচ্চাকে বুকে চেপে ধরে ঝাকি দিতে লাগল, কিন্তু কান্না থামে না। পাশেই রেল লাইন, পূর্ব থেকে পশ্চিমমুখী চলে গেছে। সে কান্না থামানোর জন্য রেল লাইনে চলে গেল কিন্তু মেয়ে বাপের মুখের দিকে তাকিয়ে অপরিচিত মুখ দেখে আরো বেদম কান্না শুরু করল। সে বাচ্চাকে সোজা করে কোলে নিল। এক বছর পর সন্তানের মুখ দেখে সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না, পাগলের মত চুমুতে লাগল। কিন্তু বাচ্চা বেখাপ্পা চুমু আর গোঁফের গুতো খেয়ে কান্নার বেগ আরো বাড়িয়ে দিল।

তারপর সে কান্না থামানোর জন্য রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে বাচ্চার সাথে শুরু করল বাচ্চাপনা, আব্বু আব্বু ঐ যে গালি(গাড়ী), আ-লে বাবু আ, বাবু নিয়ে যা। আলে চাম মামা আ, চাদেল কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা। এই যে গলু(গরু), ঐ যে বুগগি (মুরগী)। কিন্তু না, কান্না থামে না। এলাকাটা বস্তির মত, রেল লাইনের ধারে একটা ফাঁকা জায়গায় বাচ্চারা খেলছে, মায়েরা এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষ সামাজিক জীব, বাচ্চা হল বাচ্চাদের সমাজ। শিশুদের খেলা দেখে মুনিরা কান্না থামিয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল। হাসানও কাছে গিয়ে তাকে কোল থেকে নামিয়ে দিল। আর অমনি নতুন সাথী পেয়ে কয়েকটা বাচ্চা তার কাছে দৌড়ে এল। এসে কেউ কোলে নিতে চাইল, কেউ হাত বুলিয়ে আদর করল, কেউ একটু মারতে চাইল, মুনিরাও অন্যদের হাত বুলিয়ে আদর করছে আর হাসছে। মুনিরার চেয়ে ছোট একটা বাচ্চা বাবু বাবু বলে মায়ের কোলে ধাপাধাপি শুরু করল। অর্থাৎ সে বাবু কোলে নিবে। মা তাকে ছেড়ে দিল। আর অমনি সে ছোটে এসে তার চেয়ে বড় মুনিরাকে জড়িয়ে ধরল কোলে নিবে। তার মা হাসতে হাসতে এসে মুনিরাকে একটু তুলে ধরল। আর বাচ্চাটাও জড়িয়ে ধরল। ব্যস এটাই কোলে নেয়া হল। মহিলাটা বলল, ‘বাচ্চা কাঁদতেছে তো বাচ্চার মা কোথায়? সহসা হাসানের মুখটা বিকৃত হয়ে গেল। কেউ যেন একটা বল্লম তার বুকে আমুল বিদ্দ করে দিল। সে কোন কথা বলতে পারল না, মেয়েকে কোলে নিয়ে ধীরে ধীরে আবার পশ্চিমমুখী হাটা শুরু করল।

দূর গ্রামগুলির সবুজ বনানীর উপর ধোয়া উঠছে, আর তা মিলিয়ে যাচ্ছে আকাশের নিলিমায়। গৃহবধুরা সান্ধ্য রন্ধন চালাচ্ছে, হয়ত কারো বাচ্চা কাঁদছে, রান্না ফেলে দৌড়ে গিয়ে বাচ্চাকে কোলে নিচ্ছে, তারপর স্বামীকে ডেকে এনে দুইটা ধমক লাগিয়ে, ‘দেখনা, আমি কাজ করছি, বাচ্চাটা রাখতে পার না’ বলে বাপের কোলে দিয়ে সে চলে যাচ্ছে। আর বাপ হয়ত আমারই মত বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ঘুরছে, চুমু খাচ্ছে আর এটা ওটা দেখাচ্ছে। তারপর আবার গিয়ে মায়ের কোলে দিবে। এভাবেই পৃথিবীর এই অবুঝ অজ্ঞানরা মায়ের কোলে বাপের বুকে হেসে খেলে নেচে গেয়ে বড় হবে, একদিন পৃথিবীর যোদ্ধা হবে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু আমার সন্তানের ক্ষেত্রে প্রকৃতির নিয়ম ভঙ্গ হল কেন। কেন আমার সন্তানের জীবন থেকে তার মায়ের কোল হারিয়ে গেল চিরদিনের জন্য।

সে বাচ্চার মাথাটা চেপে ধরে গালের সাথে গাল লাগিয়ে ফুফিয়ে কাঁদতে লাগল, নাকের দু’পাশ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরছে। চারদিকে পাখির ক্বুজন আর মানুষের কোলাহল। সবাই ছুটছে আপন নীড়ে। তারও নীড় আছে, কিন্তু ভেঙ্গে গেছে, কাল বৈশাখী লন্ড ভন্ড করে দিয়েছে। ঐ দূর দিগন্তে রেল লাইনের মাথায় দিক চক্রবালের কিনারে সুর্য অস্ত যাচ্ছে। আজকের সুর্যের সাথে ফ্যাকাশে মুখে সর্বশান্ত হয়ে তার ভাগ্য রবিও অস্তাচলে চলে গেল চিরদিনের জন্য।

বাচ্চা কখনো কাঁদছে কখনো স্থির থাকছে। হাসান নামায পড়ার জন্য আবার আগের জায়গায় ফিরে এল। মসজিদের সামনে এসে অযু করার জন্য বাচ্চাকে এ মাদরাসারই একটা ছাত্রের কোলে দিল আর সাথে সাথে বাচ্চা কান্নাকাটি শুরু করল। সে ঝটপট পানি ছিটিয়ে কোন রকম অযু করে বাচ্চাকে কোলে নিল। আরো কিছুক্ষণ ঘোরাফিরা করে ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে কান্না থামিয়ে মসজিদে ঢুকল। তারপর পায়ের কাছে বসিয়ে চটজলদি ফরযটুকু করতে পারল। বাচ্চা কান্না জুড়ে দিয়েছে। এটাই ছিল তার শেষ নামায।

বাচ্চার কান্না থামছেই না। সে মেয়েকে কিছু খাওয়ানোর জন্য হোটেলে ঢুকল। রুটি, ডীম, ভাত, গোশত মিষ্টি ও অন্যান্য জিনিস অল্প অল্প করে নিয়ে বসল যাতে বাচ্চা যেটা খেতে চায় সেটাই খাওয়াতে পারে। এসব দেখে বাচ্চা খাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেল। পাখির বাচ্চার মত হা করে থাকে সে একটু একটু করে ঘন ঘন মুখে দেয় আর বাচ্চা গোগ্রাসে গিলতে থাকে। সে বুঝতে পারল মেয়েটাকে অনেকক্ষণ ধরে কিছু খাওয়ানো হয়নি, এমনকি বিদায় বেলায়ও তার মা খাইয়ে দেয়নি। অন্তহীন যন্ত্রণায় তার বুকটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল, ডুকরে কাঁদতে মন চাচ্ছে। কিন্তু হোটেলে মানুষের সামনে লজ্বা থেকে বাঁচতে শরীরের শক্তি দিয়ে উথলে উঠা কান্না দমিয়ে রাখল কিন্তু গলা দিয়ে একটা ক্ষীণ শব্দ বের হচ্ছে, ঠোঁট কাঁপছে, নাকের দু’পাশ দিয়ে দরদর করে অশ্রু গড়িয়ে পরছে।

এতক্ষণে শান্ত হয়ে সে লক্ষ করল তার মেয়ে আগে ছিল মোটা নাদুস নুদুস কিন্তু সেই শরীর এখন আর নাই, শুকিয়ে গেছে। চেহারাটা মলিন, গায়ের রং ময়লা হয়ে গেছে। সে বুঝতে পারল তার মেয়ে কতটা অনাদরে ছিল সেখানে। ঐ দ্বিচারিণী মেয়ে লোকটা হিন্দুর ভ্রুন গর্ভে ধারনের জন্য আমার ভ্রুনকে সম্ভবত বহু আগেই পর করে দিয়ে ছিল। সে কাঁদছে আর মেয়ের মুখে লোকমা তুলে দিচ্ছে। মেয়ের খাওয়া শেষ হল। তারপর সে কিছু খেল। বাসায় খাওয়ার জন্য হোটেল থেকে ভাত, রুটি, ডিম, মাংস মিষ্টি ইত্যাদি নিয়ে বের হল। টাকার সমস্যা নাই, পকেটে যথেষ্ট টাকা আছে। এবার সে বেকারিতে ঢুকল। বাচ্চা কোনটা খেতে চায় না চায়- এ জন্য সব কিছুই অল্প অল্প করে কিনে নিল। দুইটা বড় পলিথিন ভর্তি হল। এরপর গেল ফলের দোকানে।

জুলাইয়ের তৃতীয় দশক। বর্ষা পক্ষ চলছে, বাতাস বন্ধ ভ্যাঁপসা গরম, সম্ভবত বৃষ্টি নামবে। সে মনে করল কিছু আপেল আঙ্গুর আর কমলা নিয়ে বাসায় চলে যাবে। কিন্তু ফলের দোকানে থাকতেই বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। সে খাদ্য সামগ্রী ভর্তি তিনটা বড় পলিথিন নিয়ে দৌড়ে গিয়ে তার পরিচিত স্থান ‘বাদল লাইব্রেরীর’ বারান্দায় দাঁড়াল। লাইব্রেরী বন্ধ হয়ে গেছে। সে পলিথিনগুলি দোকানের ঝাঁপ বা শাটারের সাথে চেপে রেখে নিজে শাটারে ঢেস দিয়ে দাঁড়াল। মেয়ে কোলে তার উপর পলিথিনের বোঝা নিয়ে দৌড়ে এসে সে হাফানি রোগীর মত হাফাচ্ছে, তার ক্ষীণ দুর্বল দেহটা কাঁপছে। মেয়েটা আম্মু আম্মু ডাকতে ডাকতে অনেক কান্নাকাটি করল, ধাপাধাপি করল, সে অনেক চেষ্টা করল কিন্তু কান্না থামাতে পারল না। অবশেষে সে নিজেই ক্লান্ত হয়ে বাপের কাধে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পরল। হাসান ঘটনার আকস্মিকতা ও মেয়ে সামাল দিতেই এতক্ষণ নার্ভাস থেকেছিল। এখন মেয়ে ঘুমিয়ে পরেছে, বৃষ্টি পরছে বাতাস বইছে, তার শরীর জুড়িয়ে এল মাথা ঠাণ্ডা হল। সে মেয়ের দিকে মনোযোগ দিল, মাথাটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কাধে রাখা মেয়ের মুখটা দেখে, পিঠে মাথায় হাত বুলায়, চুমু খায়, আদর করে। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাগ্যবিরম্বিত এক বাবার মুখে ছড়িয়ে পরে অনাবিল পবিত্র হাসি।

মোসল ধারে বৃষ্টি হচ্ছে, সেই সাথে বাতাসের ঝাপটা। মানুষ জায়গায় জায়গায় আটকা পরেছে। কেউ ছাতা নিয়ে, কেউ রিকশায় চড়ে, কেউ ভিজে বাড়ির দিকে চলেছে। কোন কোন দোকানের ঝাপ পরছে, বাতাসের ঝাপটায় তার দেহের নিম্নাংশ ভিজে যাচ্ছে, দুর্বল দেহে মেয়েকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তার জন্য কষ্টকর হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর পর পা বদল করে দাঁড়াচ্ছে। মন চাচ্ছে মাটিতে বসে পরতে কিন্তু এটা কোন শিক্ষিত লোকের জন্য বেমানান। মেয়েকে আদর করতে করতে হঠাৎ তার মনে হল এবং আফসোস করতে লাগল, পটেটো সন্ধ্যায় যখন মেয়েকে দিয়ে গিয়েছিল তখন যদি একটা মাইক্রো টাইক্রো রিজার্ভ নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা করত তাকলে এতক্ষণে বাড়িতে পৌঁছে যেত। কিন্তু সে নিজেকে শান্তনা দিল, ‘যাক গা একটা রাতই তো কাল ভোরেই রওয়ানা করব ইংশাআল্লাহ। কিন্তু যাব কোথায়? বোনের বাড়ি নাকি নিজের বাড়ি? বোনের বাড়ি নিয়ে গেলে বোন আছে ভাগ্নিরা আছে ওরা মেয়েকে আদর করে পালতে পারবে। আবার বাড়িতে নিয়ে গেলে মা আছে ছোট ভাই বউ আছে, ওরা পালতে পারবে। তাছাড়া ভাইয়েরা আছে ওরাও কোলে কোলে রাখবে, ছোট ভাইয়ের একটা মেয়ে আছে মুনিরার এক বছরের বড় ওর সাথে খেলাধূলা করতে পারবে। তাছাড়া দুধ টুধ সব কিছুই আছে। কাজেই আমার মেয়ের লালন পালন খাওয়া দাওয়া কোনটাই সমস্যা হবে না। বাড়িতে নিয়ে যাওয়াই ঠিক হবে। আমি প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবার গিয়ে দুই দিন মেয়েকে সময় দিয়ে আসব। তারপর এই তো মাত্র কয়েকটা দিন। দুগ্ধপোষ্য কাল মানে বছর খানেক গেলে মেয়েকে আমার কাছে নিয়ে আসব। দেখাশুনার জন্য আম্মাকে নিয়ে আসব। এরপর মেয়ে আরেকটু বড় হলে তো আমি নিজেই দেখাশুনা করতে পারব, কোন সমস্যাই থাকবে না। সে আশ্বস্ত হল, মনটা শান্ত হল, সিদ্ধান্ত নিল কাল ভোরেই বাড়িতে চলে যাবে।

তার অস্বস্তি লাগছে, বাসায় যাওয়ার জন্য উদগ্রিব হয়ে উঠেছে, কিন্তু বৃষ্টির তেজ আরো বেড়েই চলেছে, কমার কোন লক্ষণ নেই। মুষল ধারে বৃষ্টি হচ্ছে, আকাশ যেন চালনি হয়ে গেছ। রাত দশটা পার হয়ে গেছে, টানা কয়েক ঘন্টা ধরে বৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু না কমে শনৈ শনৈ তা বেড়ে চলেছে। লোকজন আস্তে আস্তে সবাই চলে গেছে, দোকান পাট প্রায় সব বন্ধ হয়ে গেছে, শুধু পাশের একটা দোকান খোলা। মালিক চলে গেছে একটা ছোকরা বোধ হয় গোমস্তা টোমস্তা হবে বসে বসে লাউড স্পিকারে গান বাজাচ্ছে। হাসানের অদুরেই দু’টা কুকুর গলাগলি জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে। প্রবল বর্ষণে ড্রেন উপছে রোডের উপর দিয়ে ব্রহ্মপুত্রের ধারা ছুটছে। ময়লা আবর্জনা পানির উপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। বিশ হাত দক্ষিণে রেল লাইন, লাইনের পাশে ময়লার স্তূপ। বৃষ্টিতে ছড়িয়ে পরে এতক্ষণ দুর্গন্ধ ছড়িয়েছে এখন কিছুটা কমে এসেছে। ময়লার স্তূপ থেকে রোডের উপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে, কাগজ, পলিথিন, ন্যাকড়া, ঠোঙ্গা, পচাফল- আপেল কমলা, একটা মরা বিড়াল ছানাও ভেসে যাচ্ছে। এ বৃষ্টি ধুয়ে মুছে পৃথিবীর আবর্জনা ও দুর্গন্ধ পরিস্কার করছে, কিন্তু আজ তার জীবনে যে ক্লেদ জমল, যে দুর্গন্ধ ও কলঙ্ক লাগল পৃথিবীর কোন বৃষ্টি তা ধুয়ে নিতে পারবে না, ব্রহ্মপুত্রের ঢল আর সাত সাগরের জল তা মুছে দিতে পারবে না।

ভাগ্য বিড়ম্বিত এক যুবক বিষণ্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পথের ধারে, তার জীবনের বিষ ছেয়ে ফেলেছে আকাশ, আর সেই বিষ ফোটায় ফোটায় ঝড়ে পরছে পৃথিবী পৃষ্ঠে, প্রকৃতি বিষণ্ণ হয়ে উঠেছে। বৃষ্টির রিনিঝিনি ছন্দ, মেঘ কন্যাদের নুপুরের নিক্কন প্রকৃতির বীণায় তুলেছে ব্যাথার রাগিণী। হাসানের হৃদয়ের বিষ প্রকৃতির বিষণ্ণতায় একাকার হয়ে সেখানকার পরিবেশ হয়ে উঠেছে বিষময়, যেন অতিপ্রাকৃত- ভৌতিক ভুবনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোন হতভাগা মৃত্যুর প্রহর গুনছে। পাশের দোকানে বেখাপ্পা গানের আওয়াজ ছাড়া আর কোন সাড়া শব্দ নেই, চারিদিকে ছুনছান নীরবতা। রাতের নীরবতায় মস্তিষ্ক নিথর হয়ে আসে, হৃদয়ে বুদবুদ ভাসে, স্মৃতিরা সচল হয়ে উঠে, তার স্মৃতিতে ভেসে উঠে এমনি এক গরমের রাতে বৃষ্টির সময় সে স্ত্রীকে নিয়ে ভিজেছিল। বারবার জড়িয়ে ধরেছিল, আলিঙ্গন করছিল, চুম্বন করছিল, পৌঁছে গিয়েছিল সুখের সীমানা পেরিয়ে অন্য কোন জগতে। এরপর স্ত্রীর সাথে তার মধুময় স্মৃতিগুলি একের পর এক চোখের সামনে ভাসতে থাকে। দেখতে পায় স্ত্রীর সেই করুণ মুখ খানা ইঞ্জিনিয়ারের বাসায় বিদায় বেলায় যে মুখে সে তার দিকে তাকিয়েছিল। তার আত্মাটা ছ্যাঁত করে উঠে। এসব এখন শুধুই স্মৃতি, শুধুই অতীত। সে এখন আর তার নয় অন্যের, আগামীকাল এই রাস্তা দিয়ে গাড়ি হাকিয়ে সে যাবে তার ফুল শয্যা রচনা করতে। তার মুখ থেকে একটা মৃদু আর্তনাদ বেরিয়ে আসে।

আর তখনো পাশের দোকানে গান বেজেই চলেছে, হঠাৎ একটা গানের দিকে তার মনোযোগ নিবিষ্ট হল। কোন চারুকন্ঠী বড় করুণ সুরে গেয়ে চলেছে-‘তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়। দুখের দহনে করুন রোদনে তিলে তিলে তার ক্ষয়’।

হাসান মনে মনে বলে, এই পৃথিবীর রনাঙ্গনে মানুষ আসে যায়, তাদের জীবনে কিছু থাকে পরাজয়ের গ্লানি আর সারা জীবন জুড়ে থাকে বিজয়ের আলো। এমন কোন মানুষ নেই যার জীবনে কোন জয়ের আলো নেই, আছে শুধু পরাজয়ের গ্লানি। কিন্তু একজন মানুষ আছে যার জীবনে কোন বিজয় নেই, আছে শুধু পরাজয়ের কালিমা। আজন্ম পরাম্পরাগত পরাজয়ের পাষানে ক্ষয়ে ক্ষয়ে সে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে জন্মের বিপরীত পরিনতির দিকে। মানব জাতি কখনো কি দেখেছে এমন হতভাগা, তারা যদি দেখতে চায় তাহলে আসুক, দেখুক আমাকে।

শিল্পি গাইল, ‘আমি তো দেখেছি কত যে স্বপ্ন মুকুলেই ঝড়ে যায়, শুকনো পাতার মর্মরে বাজে কত সুর বেদনায়, আকাশ বাতাসে নিস্ফল আশা হাহাকার হয়ে রয়।

সে ভাবে, একটা মানব শিশু পৃথিবীতে এল অন্য দশটা মানব সন্তানের মতই। সে বুক ভরা আশা, চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে আস্তে আস্তে বড় হল। কিন্তু তার স্বপ্নগুলি কোন দিন মুকুলিত হতে পারেনি, প্রস্ফুটিত হয়ে গোলাপের গন্ধ ছড়াতে পারেনি। নিষ্ঠুর পৃথিবীর কড়াল গ্রাস আমার আশার মুকুলগুলি ঝড়িয়ে দিয়েছে, মানবাকৃতির দানবেরা ছিঁড়ে ফেলেছে। আর আমার নিস্ফল কামনাগুলি বুকের পাজরে মাথা ঠুকে মরেছে, শুকনো পাতার মর্মরে আর বাতাসের শব্দে এর কান্নার সুর বেজে উঠেছে। আমার নিস্ফল আশা ও স্বপ্নগুলি ব্যথার রাগিনী হয়ে অনন্ত আকাশে বেজে চলেছে। পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষ শুনতে পাচ্ছ, শুনতে পাচ্ছ কি আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনি তোলা আমার ব্যর্থ হৃদয়ের হাহাকার।

শিল্পি গাইল, ‘প্রতিদিন কত খবর আসে যে কাগজের পাতা ভরে, জীবন পাতার অনেক খবর রয়ে যায় অগোচরে’।

সে ভাবে, ‘হ্যাঁ তাই তো, মানুষের খন্ড জীবনের খন্ডাংশ ব্যাথা নিয়ে প্রতিদিন খবরের কাগজগুলি ভরে উঠে। কিন্তু আমার সারা জীবনের পুঞ্জিভুত ব্যথাগুলি কোন সাংবাদিক লিখল না, অন্ধ ঐতিহাসিক ফিরেও তাকাল না, কোন কবি সাহিত্যিক আমার অব্যক্ত হৃদয়ের হাহাকার গুলি কলমের আচড়ে মুর্ত করে তুলল না অথচ তারা অমর সাহিত্য রচনা করতে চায়। এই মুর্খরা কিছুই না করে যদি আমার আত্মকথা অবলম্বনে কোন কাব্য- উপন্যাস রচনা করত, এক আর্ত- মানব হৃদয়ের আধার বিবরে বন্ধি ব্যাথাগুলি মানব জাতির সামনে তুলে ধরত, তাহলে তা হত পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ট্র্যাজেডি, শ্রেষ্ঠ সাহিত্য।

শিল্পি গাইল, ‘কেউ তো জানে না প্রাণের আকুতি বারেবারে সেকি চায়, স্বার্থের টানে প্রিয়জন কেন দূরে সরে চলে যায়। ধরনির বুকে পাশাপাশি তবু কেউ বুঝি কারো নয়।

সে ভাবে, এই পৃথিবীতে সবাই পাশাপাশি কাছাকাছি, মনে হয় যেন সবাই আপনজন। কিন্তু কত মানুষের দোয়ারে দোয়ারে ধর্না দিলাম, মিনতি করলাম, আমার ব্যথিত হৃদয়ের আকুতিগুলি তুলে ধরলাম কিন্তু কেউ আমার হৃদয়ের ব্যথা বুঝল না, আমার কাকুতি মিনতির কোন মূল্য দিল না, আমার স্ত্রীর সাথে ফয়সালা করে দিল না। এই পৃথিবীতে এত কাছাকাছি থেকেও কেউ কারো নয়। আমার দুঃখের কথা, মনের ব্যথা কেউ বুঝল না। আমার হাতে আমার স্ত্রীর হাতটি ধরিয়ে দিল না। ফলে আজ সে আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে , চলে যাচ্ছে তার স্বার্থের টানে, তার ভোগের ভাড়ার পূর্ণ করতে, যাচ্ছে সে আমার ও আমার সন্তানের লাশ মাড়িয়ে, আমাদের সমাধির উপর তার সাধের বাসর রচনা করতে।

স্বার্থের টানে প্রিয়জন কেন দুরে সরে চলে যায়। হা চলে গেছে, চলে গেছে সে, চলে যাচ্ছে, চলে যাবে, চলে যাবে সে আগামীকাল। চলে যাচ্ছে সে স্বার্থের টানে আমাকে ছেড়ে, চলে যাচ্ছে ভার্সিটি শিক্ষকের কোলে। এই রাস্তা দিয়ে, এই খান দিয়ে সে যাবে। যাবে সে আমার দেয়া শাড়ি গহনা পরে বধু বেশে গাড়ি হাকিয়ে, যাবে সে আমার ও আমার সন্তানের বুকের উপর দিয়ে, আমার শবদেহ মাড়িয়ে, আমার সমাধির উপর সে গড়ে তুলবে তার বাসর শয্যা। সে আমাকে ছেড়ে বিত্তবান স্বামীর গলার মালা হয়ে থাকবে। হর্ম প্রাসাদে মণি মানিক্য হীরা জহরত আর প্রবাল খচিত মখমলের ফরাসে যখন হবে তার বাসর শয্যা, তখন আমি ও আমার সন্তান রাস্তায় পরে থাকব। যখন ঐ হিন্দুর সন্তান তার গর্ভে নড়াচড়া করবে তখন আমরা রাস্তায় গড়াগড়ি করব, যখন সে হিন্দুর সন্তানের মুখে সোনার চামচ তুলে দেবে বা তার বুকে চেপে ধরবে তখন আমি ও আমার সন্তান পথের ধুলোয় লোটুপোটি খাব। না, আমি যাব না, এখান থেকে যাব না, এখানেই পরে থাকব। কাল তাকে তার বাসর শয্যায় যেতে হবে আমার ও আমার সন্তানের দেহ মাড়িয়ে। তীব্র যন্ত্রণায় সে দু’পাশে মাথা মারতে থাকে, সাটারের শব্দ বৃষ্টির শব্দে বিলিন হয়ে যায়। তার শরীর মিইয়ে আসতে থাকে আর পা ফসকে যেতে থাকে। এভাবে সে পা লম্বা করে মাটিতে বসে পরে।

চির হতভাগ্য যুবক নিঃসীম বেদনায় দু’পাশে মাথা মারতে মারতে আর্তনাদ করতে থাকে, ‘কোথায় জামালপুরের বাসিন্দারা, তোমরা স্ত্রী সন্তান বুকে জড়িয়ে আপন নীড়ে সুখ নিদ্রা যাচ্ছ আর আমি ও আমার সন্তান রাস্তায় পরে গড়াগড়ি যাচ্ছি। তোমাদের উপর আল্লাহ্‌র গজব পরবে, তোমরা আদ ছামুদ জাতিয় ন্যায় ধ্বংস হয়ে যাবে। আল্লাহ্‌র রাসূল (সাঃ) বলে গেছেন, যে জনপদে যুলুম হয় আর কেউ তার প্রতিবাদ করে না, সেখানে খোদার গজব অনিবার্য। অথচ তোমরা জামালপুর বাসীরা যুগের নিকৃষ্ট যুলুম থেকে আমাকে ও আমার সন্তানকে বাঁচাতে পারলে না, চেষ্টাও করলে না, উদ্যোগও নিলে না। তাহলে খোদার গজব থেকে তোমাদেরকে কে বাঁচাবে? দেখে যাও, উঠে এস, ছুটে এস তোমরা স্ত্রী সন্তান নিয়ে। দেখে যাও, রাস্তার ধারে একটা কুকুর পরে আছে, একটা কুকুর তার বাচ্চা বুকে জড়িয়ে পথের ধুলোয় লোটোপুটি খাচ্ছে, তাকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়ে যাও, তার সাথে তোমাদের লেনদেন চুকিয়ে দিয়ে দাও, তোমাদের সম্পর্ক মিটিয়ে দিয়ে যাও। তোমরা নিজেদের কর্তব্য পালন করলে না, তাহলে আরেকটা দায়িত্ব পালন করে যাও। এসো, ছুটে এসো, আমাকে একটা করে লাথি মেরে যাও, একটা করে লাথি মেরে যাও, লাথি মেরে যাও----। এটাই পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষের কাছে আমার প্রাপ্তি। এটাই তোমাদের সাথে আমার লেনদেন।

তারপর সে আর কথা বলতে পারল না, জবাই করা পশুর মত দু’পা মাটিতে আঁচড়াতে লাগল। গোঙ্গাতে লাগল আর সাটারের দু’পাশে মাথা মারতে লাগল । তার ক্ষীণ দুর্বল দেহের খাচাটা ছেড়ে পাখি উড়ে যাবার উপক্রম হল। অনেকক্ষণ পর গলায় একটা শব্দ হল, একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর আবার আর্তনাদ করে উঠল, ‘হায় আল্লাহ্‌, আল্লাহ্‌ গো, হায় আদল ও ইনসাফের মালিক, এই বুঝি তোমার ইনসাফ, এই বুঝি আমার নিয়তি, আমার স্ত্রী অন্যের স্ত্রী হয়ে যাবে, আমার সন্তানের মা অন্যের সন্তানের মা হয়ে যাবে, এটাই বুঝি তোমার ফয়সালা। তারপর তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে ঘুমন্ত মেয়ের হাতটা টেনে নিয়ে বুকে ঘষতে লাগল, ‘আব্বা, আব্বা রে আমারে একটু ধর, একটু ধর বাপ, আমি মরে যাচ্ছি। এই বুকটা চেপে ধর, শক্ত করে ধর, বুকটা আমার পোড়ে যাচ্ছে, কলজেটা গলে যাচ্ছে, আমি আর বাঁচব না বাপ, আর বাঁচব না’। এভাবে দুনিয়ার এক অসহায়, মজলুম হতভাগ্য যুবক রাস্তায় পরে মাতম করতে থাকে, হাত পা ছুড়তে থাকে, মাটিতে পা আঁচড়াতে থাকে, মাথা মারতে থাকে।

রাত সাড়ে এগারটা বাজে। পাশের দোকানের ছেলেটা চলে গেছে। আশপাশে আর কেউ নেই শুধু চারটি কুকুর ছাড়া। দু’টি চার পেয়ে কুকুর গলাগলি করে শুয়ে আছে। আর একটি দুপেয়ে কুকুর তার বাচ্চাকে কাধে নিয়ে মাটিতে বসে আছে। চারদিকে মধ্য রাতের নীরবতা। ষ্টেশনে হুইসেল শুনা গেল। ঢাকা থেকে আগত বাহাদুরাবাদ ঘাট গামী একতা এক্সপ্রেস দানবের মত বাঁশি বাজিয়ে আজদাহার মত মাটি কাপিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। হাসানের ঠোঁটের কোণায় হাসি ফোটে উঠে। জীবন যন্ত্রনা থেকে বেঁচে যাওয়া কত সহজ কত সুলভ। এই তো মাত্র বিশ হাত ব্যবধান, জীবন- মৃত্যুর ব্যবধান মাত্র বিশ হাত, সুখ- দুঃখের ব্যবধান মাত্র বিশ হাত, একটু হেঁটে গিয়ে লাইনে বসলেই হল, আর কোন যন্ত্রণা থাকবে না। পৃথিবীর সকল বিষাদ অবসাদ দুঃখ ব্যথা যন্ত্রনা চোখের পলকে উপশম হয়ে যাবে। গাড়ি কাছাকাছি এসে গেছে, সে উঠতে চাইল। কিন্তু বাশির তীব্র শব্দে মেয়েটা চমকে উঠল, তারপর এদিক সেদিক তাকিয়ে বাবার অপরিচিত মুখ দেখে আম্মু আম্মু বলে চেচিয়ে কান্না শুরু করল। হাসান চেতনা ফিরে পেয়ে নিজের চিন্তার কথা স্বরণ করে চমকে উঠল। তারপর আস্তাগফিরুল্লাহ বলতে বলতে ডানে বামে সমানে থুথু ফেলতে লাগল। কারণ রাসূল (সাঃ) বলেছেন, তোমাদের কারো মনে কুচিন্তা উদয় হলে বামে থুথু ফেলবে। কিন্তু হাদীসের উপর বেশি আমল করতে গিয়ে সে ডানে বামে এবং একাধিকবার থুথু ফেলল।

তারপর মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঝাকি দিতে লাগল, ‘আমার সাত রাজার ধন, আমার ইহকাল পরকাল, আমার ত্রি ভুবনের সেরা অলংকার, মানব জন্মের শ্রেষ্ঠ উপহার। কেন আমাকে মরতে হবে, কি না আছে আমার। আমার সন্তান আছে, আছে আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন আমার সন্তান। আমার সন্তানের বেঁচে থাকার অবলম্বন আমি। আমার মা, ভাই-বোন, ধন-সম্পদ, চাকরি-বাকরি সবই তো আছে। তাহলে আমি মরব কেন, কিসের অভাব আছে আমার। আমি মরলে আমার সন্তান বাঁচবে কাকে নিয়ে। না আমি বাঁচব, ভাল করেই বাঁচব। নিজ হাতে আমার মেয়েকে প্রতিপালন করব। নিজ হাতে রান্না করে মুখে তুলে খাওয়াব, কাপড় ধুয়ে দিব, স্কুলে নিয়ে যাব, সুয়ো- দুয়ো রানীর কিসসা শুনিয়ে শুনিয়ে ঘুম পারাব। আমি হব আমার সন্তানের একমাত্র বন্ধু এবং খেলার সাথী। আমার মেয়ে হবে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষিত। তারপর যখন আমার মেয়ে বড় হয়ে যাবে তখন ভাল দেখে একটা উচ্চ শিক্ষিত ছেলে ধরে এনে বলব কুত্তার বাচ্চা, মানুষের বাচ্চা হতে চাইলে আমাকে বাপ ডাকবি। আর বাপ ডাকবি এই অর্থে যে আমি তোর জন্ম দাতা, শ্বশুর নই। এরপর লোকেদের মধ্যে বলে বেড়াব আমার একটা ছেলে একটা মেয়ে।

একদিন আমার নাতি নাতনী হবে, আমি ওদেরকে পিঠে নিয়ে ঘোড়া সাজব, সারা দিনমান ধরে খেলা করব, টুলি পাতি খেলব, ধুলির মাংস পোলাও রান্না করব, পুতুলের বিয়ে দিব, মাঝে মধ্যে ঝগড়া করব। একটু একটু মারামারিও করব, ওরা আমাকে মারবে আমি ওদেরকে মারব। তখন আমার মেয়ে ওর বাচ্চাদেরকে ধ্মক দিবে, আমাকেও ধ্মক দিয়ে বলবে, ‘বাবা দুষ্টুমি করো না, আরেকবার দুষ্টুমি করলে কিন্তু মাইর দিমু। আমার মেয়ে প্রথম যে দিন আমাকে ধ্মক দিবে সে দিন থেকেই সে আমার মা হয়ে যাবে। আর তখন থেকে সে আমাকে তার বাচ্চাদের সাথে লালন পালন করবে, আমার সংসার হবে সোনার সংসার, সুখি সংসার। আমার কোন দুঃখ নাই কষ্ট নাই, আমি সুখি মহাসুখি, আই এম দ্য কিং অব দ্য ওয়ার্ল্ড। কাউকে আমার প্রয়োজন নাই, যে চলে গেছে সে জাহান্নামে গেছে, কোন জাহান্নামীকে আমার দরকার নাই।

মেয়েটা আম্মু আম্মু বলে কাঁদছে, সে মেয়েকে বুকে চেপে ধরে ঝাকি দিতে দিতে এভাবেই নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছে। পৃথিবীর বুকে এক ভাগ্যাহত যুবকের দুরাবস্থা দেখে মহাশুন্য কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে পরেছে তার চোখের জল শুকিয়ে গেছে, বৃষ্টি থেমে গেছে। বৃষ্টির ছাট ও বাতাসের ঝাপটায় তার দেহের নিম্নাংশ সম্পূর্ণ ভিজে গেছে। জামার নিম্নাংশ উল্টিয়ে মেয়ের গায়ে দিয়ে এতক্ষণ কোন রকমে মেয়ের শরীরটা বাঁচাতে পেরেছে। হঠাৎ তার শরীর কয়েকটা ঝাকুনি দিল। কাটা দিয়ে উঠল। তারপর ঠাণ্ডায় প্রচন্ড কাঁপুনি শুরু হল এবং দাঁতে দাঁতে ঠুকতে লাগল। আর টিকা যাচ্ছে না, সে এক হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু মনে হচ্ছে তার দুর্বল শরীরটা মুখ থুবড়ে পরবে। মাথা ঘুরছে। শাটারে ঢেস দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। একটু দুরেই মোড়ে রিকশা আছে। সে কয়েক পা এগিয়ে একটা রিকশা ডেকে পলিথিনগুলি তুলতে বলে নিজে চড়ে বসল। মেয়েটা রিকশার ঝাকুনিতে কান্না থামিয়ে দিয়েছে। ঠাণ্ডায় তার শরীর এমনভাবে কাঁপছে যে, মনে হচ্ছে রিকশা থেকে পরে যাবে, শক্ত করে ধরে রাখছে।

বাসার সামনে গিয়ে সে রিকশা ওয়ালাকে বলল দরজা পর্যন্ত টেনে নিতে। দরজায় পৌঁছে নামতে চাইল কিন্তু সাহস পাচ্ছে না, রিকশা ওয়ালাকে ধরতে বলল। রিকশাওয়ালা তাকে ধরে নামিয়েই বলল, আপনার শরীর তো জ্বরে পোড়ে যাচ্ছে, ডাক্তারের কাছে যান। সে কিছু না বলে পলিথিনগুলি নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। মেয়েকে বিছানায় বসিয়ে তাড়াতাড়ি একটা কাঁথা গায়ে জড়াল। নতুন ঘর নতুন জায়গা দেখে মেয়েটা আবার কান্না শুরু করল। তার শরীর টালমাটাল হয়ে উঠেছে। কোন রকম তাড়াতাড়ি মশারিটা টানিয়ে বাচ্চাকে নিয়ে শুয়ে পরল। কিন্তু বাচ্চা আম্মু আম্মমু বলে বিকট চিৎকার শুরু করল। সে কাথায় মাথামুরি দিয়ে কখনো শুয়ে কখনো বসে মেয়ের কান্না থামানোর চেষ্টা করে কিন্তু ব্যর্থ হয়। তারপর বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বিছানা থেকে নেমে একটু ঘুরতে চাইল কিন্তু বুঝল এটা সম্ভব নয়, মাথা ঘুরছে শরীর টলছে। অগত্যা পলিথিন থেকে একটা আঙ্গুরের থোকা এনে মেয়ের সামনে দিয়ে আবার শুয়ে পরল। তারপর সে একটা একটা করে আঙ্গুর মেয়ের মুখে দেয়, বাচ্চা চিবায় আর কাঁদে, এভাবে কিছুক্ষণ চলল। অবশেষে প্রচণ্ড জ্বরের প্রকোপে সে হয়ত বেহুশ হয়ে গেল অথবা ঘুমিয়ে পরল। বাচ্চাটা মায়ের জন্য কাঁদতে কাঁদতে শেষে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরল।

দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত।

বিষয়: সাহিত্য

১২৬৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File