চিঠি (কবর)-৬৪ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:১৪:৫০ দুপুর
২৩ জুলাই, ২০০৬ সাল। অবশেষে এল সেই অভিশপ্ত দিনটি। এ দিনেই ঘটল ঘটনাটা। পীর সাবের নাম শুনে সত্যি সত্যিই জোকের মুখে চুন লবণ পরে গেল। ইঞ্জিনিয়ার তখন ফেরদৌসির চিন্তা গোল্লায় নিক্ষেপ করে নিজের জীবনেরই আশংখা বোধ করতে লাগল। কারণ সে জানে পীর সাব যেখানে যায় সেখানেই তার সাথে প্রচুর লোকজন থাকে, বিভিন্ন জন বিভিন্ন দরকারে আসে। তিনি এসেই লোকজন নিয়ে দরবারে বসবেন এবং ভর মজলিসে জন সমক্ষে তাকে প্রশ্ন করতে শুরু করবেন, ‘ছেলে বিচার দিল বউ তার মাকে চুলে ধরার কথা বলেছে আপনি বিচার না করে সাল চিল্লার শর্ত দিলেন কেন? স্বামীর অনুমতি ছাড়া তার স্ত্রী সন্তানকে সুদূর খুলনায় পাঠালেন কেন? তালাক ছাড়া এক বছর স্বামী স্ত্রীর সাক্ষাৎ বন্ধ রাখলেন কেন? বাপ থেকে সন্তানকে এক বছর আড়ালে রাখলেন কেন? বাপকে সন্তানের মুখটা পর্যন্ত দেখতে দিলেন না কেন? শরীয়ত ও বিবেক সম্মত কারণ ছাড়া তালাক চাচ্ছেন কেন? তালাকের সাথে সাথে ইদ্দত ছাড়া বিয়ে দিতে চান কেমনে? আপনারা কোন ধর্মের অনুসারী? মুসলিম হলে ইসলামের আলোকে এ প্রশ্নগুলির উত্তর দেন। নিশ্চয়ই পীর সাব এসকল বিষয়ে কৈফিয়ত তলব করবেন। কিন্তু সে তো কোন উত্তর দিতে পারবে না। আর তখন লোকজন ক্ষেপে গিয়ে তাকে ধরে জুতা পেটা করবে, তারপর মুখে চুনকালি মাখিয়ে গলায় জুতার মালা ঝুলিয়ে শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘোরাবে। তার মেজাজ বিগড়ে গেল। স্বগোক্তি করল, ‘ফেরদৌসী জাহান্নামে যাক, আগে আমাকে বাঁচতে হবে।
সে চিন্তায় বসল এখন কি করা যায়, পীর সাব আসবে পঁচিশ তারিখ, এখনো দুই দিন বাকী আছে। যা করার এ দুই দিনেই করতে হবে। কিন্তু কাকে দিয়ে করাবে? তার উম্মত বা দাস ভায়রাগুলি একেকজন থাকে একেক জায়গায়। এখানে থাকে মাত্র দু’জন। এডি তো কোন কাজেরই না, তাকে ফুঁ মারলে উড়ে যায়, বজলুটা কাজের কিন্তু সে একা কী করবে। অহংকার ও রুক্ষ স্বভাবের কারণে তার পক্ষে এমন কোন আত্মীয়- স্বজন বা বন্ধু মহল ছিল না- যাদের নিয়ে সে কাজ করবে। হঠাৎ মনে হল তার কিনা গোলামদের দিয়ে কাজ করাতে হবে। পাটগুদাম মাদরাসার কয়েকজন শিক্ষক ছিল তার কিনা গোলাম। জহুরের পর সে মাদরাসায় গিয়ে শুরু করল মস্তি মাতঙ্গির নাচন আর নর্তন কুর্দন। আমরা জামালপুরের শ্রেষ্ঠ লোক, মানি মানুষ, আর কোথাকার একটা ফেউ ময়মনসিংহ থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। আমাদের ভাত খেয়ে আমাদের উপর হাত ঘোরায়, ওর হাত কেটে ফেলব। ঐ হারামজাদা গর্তে ঢুকে সাপের লেজে পাড়া দিয়েছে, ওর দেহটা নিল হয়ে যাবে। পীর সাবকে আনবে, কিসের পীর কোথাকার পীর, আমাদের সামনে এসব পীর টিরের খাওয়া নাই, আমাদের উপরে কোন কুতুব নাই, আমরাই জামালপুরের বড় পীর। কোন পীরের পীর ওকে বাঁচাতে পারবে না। ওর দেহের রক্ত মাংস কুত্তা দিয়ে খাওয়াব।
সে এভাবে অকথ্য ও অশ্রাব্য ভাষায় হাসানকে গালাগালি করতে করতে ও নাচতে নাচতে ক্লান্ত হয়ে গেল। তারপর ঘরে ঢুকে শিক্ষকদের গালাগালি শুরু করল, ‘ঐ মুন্সির দল, বসে বসে পরের উপর খেয়ে খেয়ে তো ভূরি মোটা করে ফেলেছেন, এতদন ধরে বলছি তালাকটা নিয়ে দেন। তালাকের জন্য মেয়ের বিয়েটা আটকে আছে। অথচ এইটুকু কাজ করতে পারলেন না। দাওয়াত খাওয়া, সদকা ফেতরা কুড়ানো, মাদরাসা মসজিদের টাকা মেরে খাওয়ার সময় তো খুব পারেন, ছেলেদের খুব পাছা মারতে পারেন কিন্তু এই সাধারণ কাজটুকু করতে পারলেন না। (উল্লেখ্য যে, এই মাদারাসার এক শিক্ষক তার ছাত্রের সাথে পুং মৈথুন করে, বিষয়টা পত্রিকায় আসে। ইঞ্জিনিয়ার একথার দিকেই ইঙ্গিত করেছে)। তারপর বলল- আজকের দিনের মধ্যে যদি তালাক না আনতে পারেন তাহলে মুন্সিগিরি ছুটাইয়া ফালামু, একটারও চাকরি থাকবে না। এই আমার শেষ কথা’ বলে সে ব্যাঙের মত লাফিয়ে লাফিয়ে চলে গেল।
ইঞ্জিনিয়ারের এ হুমকি দানের অথরিটি হল সে এই মাদারাসার কমিটির লোক, এলাকায় প্রভাবশালী ব্যক্তি। আর এ মাদরাসায় কয়েকজন শিক্ষক আছে যাদের পরিচয় নজরুলের ভাষায়, ‘আমপারা পড়া হামবড়া ওরা এখনো বেড়ায় ভাত মেরে’। অর্থাৎ এরা আমপারা পরে এমনই হামবড়া- দাম্ভিক হয়ে গেছে যে, তারা মনে করে খুব ইলমদার হয়ে গেছে। আসলে এরা আমপারার কোন সুরার অর্থটা পর্যন্ত বলতে পারবে না। মাদরাসায় পাঠ্য কোন কিতাব দিলে দুই অক্ষর পড়াতে পারবে না- দাঁত ঝুর ঝুর করে ভেঙ্গে পরবে। আর সামস্টিক ইসলাম সম্পর্কে এদের তো কোন ধারনাই নেই। ওরা বিশাল বিশাল পাগড়ী লাগিয়ে আলখাল্লা পরে নাভি অবধি দাড়ি ঝুলিয়ে চলাফেরা করে। মানুষ মনে করে না জানি কত বড় আল্লামা হুযুর, তাদেরকে দাওয়াত খাওয়ায়, টাকা-পয়সা দেয়, সদকা-ফেতরা দেয়, তারা মনে করে এরা বুঝি রাসূল (সাঃ) এর প্রতিনিধি, বস্তুত এরা হল শুধু ভাত মারার কারিগর। এদের আরেক পরিচয় হল, ‘মৌ লোভি যত মৌলভি আর মোল-লারা (মূল নাই) কন হাত নেড়ে’। অর্থাৎ মৌ- লোভী মানে মধু লোভী এই শ্রেণিটা শুধু মৌমাছির মধু সন্ধানের মত দাওয়াত খুজে বেড়ায় আর টাকা পয়সার সন্ধানে বড় লোকদের চারধারে মাছির মত ভন ভন করে আর তেল মর্দন করে। আবার এদের কোন মূল নাই, মানে ইলম কালাম বিদ্যা বুদ্ধি নাই, না আছে ইসলামী জ্ঞান না আছে আধুনিক জ্ঞান, আছে শুধু অর্থের লোভ। তখন এরা ইঞ্জিনিয়ারের মত সমাজ পতিদের খুসিয়া বরদারি- ওল তোয়ানি করে কোন মসজিদের ইমাম হয়, মাদরাসার কোন গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে। তারপর এরা বিত্তবান ও সমাজপতিদের গোলামী করে আর সাধারণ মানুষের উপর হাত নেড়ে নেড়ে শাসন করে। এদেরকেই বলা হয় ধর্ম ব্যবসায়ী, এরা ইসলামকে কলুষিত করে, প্রকৃত আলেমদের মুখে কালিমা লেপন করে।
এ জাতীয় ভাত মারার তিন মৌ-লোভী (মৌলভী) আর মোল-লা (মোল্লা) নিজেদের ভাত লাটে উঠার আশঙ্কা করল। তাদের চোখে জল এসে গেল। এদের মধ্যে একজন হল নামধারী মুফতি, যে কিনা মুফতি শব্দের অর্থটাই বলতে পারে না। অগত্যা তারা গুমরাহ মুখে হাসানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করল। তারা আগেও যখন তার কাছে গিয়েছিল তখন সে তাদেরকে দু’টি বিষয় বুঝিয়ে ছিল, ‘প্রথমত, স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সমস্যা দেখা দিলে কোরআনের বিধান মতে উভয় পক্ষের সালিশ বসে ফয়সালা করতে হবে, এক পক্ষের ইচ্ছা অভিপ্রায় অনুযায়ী কাজ করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, আমার পক্ষের সালিশ হিসাবে আসছেন বালিয়ার পীর সাব। তিনি আপনাদের উস্তাদ, আলেম সমাজের মাথা, সারা দেশের একজন মুরুব্বী, কাজেই তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে’। তখন এই ভাত মারার দল মেনে নিয়ে চলে গিয়েছিল। কিন্তু এখন কোরআনের বিধান ও উস্তাদের মর্যাদা রক্ষার চেয়ে তাদের ভাত রক্ষার প্রশ্নটাই মুখ্য হয়ে উঠল। তাই তারা ইঞ্জিনিয়ারের হুকুম তামিল করতে এমন এক ব্যক্তির উপর নাক গলাতে গেল যার ছাত্র হওয়ার যোগ্যতা এদের ছিল না।
না খেয়ে অভুক্ত থাকতে থাকতে কয়েকদিন ধরে হাসানের গ্যাস্ট্রিকটা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আর গ্যাস্ট্রিক চূড়ান্ত রুপ নেওয়ার পর যা হয় তা হয়ে গেছে। দুপুরে মাদরাসা থেকে এসে দুইটা বিস্কুট খেয়ে এক গ্লাস পানি খেল। তারপর খুসখুসে একটু কাশল, বারান্দার বাইরে থুথু ফেলল, থুথুর রং লাল। কিন্তু সে তা দেখল না, দেখলেও লাভ নেই কারণ এ নিয়ে চিন্তা করার মত মন মানসিকতা ও চেতনা তার মধ্যে ছিল না। সে এখন স্ত্রীর চিন্তায় বিভোর। বিছানায় শুয়ে চিন্তা করতে লাগল পীর সাব আসবেন, বসবেন, হয়ত উভয় পক্ষের কথা শুনবেন। কিন্তু যখন আমার কোন দোষ পাওয়া যাবে না, তখন বলবেন ছেলেকে বউ দিয়ে দেন। তখন বউ আসবে, আসবে আমার সাথে রিকশায় চড়ে এই বাসায়। ঘরটা আমার ভরে উঠবে, আবার আমার বাচ্চার কলকাকলিতে মুখর হয়ে উঠবে। হতভাগ্য যুবকের চর্মাচ্ছাদিত কঙ্কালসার মুখ খানিতে শিশুর মত নিষ্পাপ হাসি ফুটে উঠে। গর্তে ঢুকে যাওয়া দু’টি চোখ স্বপ্নময় হয়ে উঠে।
তার চিন্তার পাতাগুলি ভাজে ভাজে পরতে থাকে, স্ত্রীর সকল আবদার সে পুর্ণ করবে, কোন ইচ্ছা অপূরণ রাখবে না, ফার্নিচার বানিয়ে দিবে, যা খেতে চায় উপরি স্তূপ দিয়ে রাখবে, শীঘ্রই বাসা করে দিবে, স্ত্রীর ইছানুযায়ি শ্বশুর বাড়িতে সাহায্য সহযোগিতা করবে, বউ বাচ্চা নিয়ে কক্সবাজার, জাফলং, কোয়াকাটা ইত্যাদিতে বেড়াতে যাবে। এমনিভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে বদবখত যুবকটি বউকে নিয়ে মধুময় স্বপ্নের জাল বুনতে থাকে। কিন্তু চিন্তায় ছেদ পরল। হঠাৎ মনে হল, পীর সাবের কথায় যদি তারা বউ না দেয় তাহলে কি হবে। এই ‘কি হবে’ এরপর চিন্তা করার শক্তি তার ছিল না। শরীরটা অবশ হয়ে গেল। দেহের জোড়াগুলি যেন ছেড়ে দিয়েছে। ঘরে যেন অক্সিজেন শুন্যতা দেখা দিয়েছে, দম বন্ধ হয়ে আসছে, অস্বস্তি লাগছে। সে উঠে কাপড় চোপড় পরে বাইরে বেরিয়ে গেল।
একটি প্রকাশনীর অধিনে লেখা এ পর্যন্ত তার কয়েকটি গ্রন্থ বেরিয়ে ছিল। এছাড়া সে আলিয়া মাদরাসার সবচেয়ে কঠিন সাবজেক্ট আরবি সাহিত্যের নোট লিখে ছাত্রদের দিত। এসব বই ও নোট রেলগেট সংলগ্ন ‘বাদল লাইব্রেরী’ নামের একটি লাইব্রেরীতে বিক্রি হত। সে বিকালে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়ে বাদল লাইব্রেরীতে বসল। কিছুক্ষন পর দেখল একটা রিকশায় চড়ে পাটগুদামের শিক্ষকরা দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে। ওরা তার কাছেই যাচ্ছে কিনা সন্দেহে বারান্দায় এসে ডাক দিল। তাকে দেখেই শিক্ষকরা রিকশা বিদায় করে তার কাছে এল। এসেই তার হাত ধরে বলল, ‘আপনি কেন এমন করতেছেন, এসব করে তো আপনি নিজেও বিপদে পরতেছেন আমাদেরকেও ফেলতেছেন। চলেন, নিরিবিলি বসে আলাপ করি’ বলে তার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলল। সাধারণ আলাপ সালাপ হবে মনে করে হাসান হাঁটতে হাঁটতে তাদের সাথে চলল। এর মধ্যে একজন পিছিয়ে গিয়ে ইঞ্জিনিয়ারকে কল করল। একটু পশ্চিমেই মসজিদ সংলগ্ন ছোট্ট একটা হাফেজি মাদরাসা। বিকালে ছাত্র নেই, তারা ক্লাস রুমে গিয়ে বসল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সিনেমার ব্লাকমেইলের ন্যায় কয়েকটা মোটর সাইকেলে ইঞ্জিনিয়ার, পটেটো, তাদের অন্যান্য ভায়রা, বিসিকের লোকটা ও আরো কয়েকজন লোক এসে মাদরাসার ফিল্ডে তাকে ঘেরাওয়ের মত করে দাঁড়াল। বুঝাই যাচ্ছে তারা আগে থেকেই তৈরি হয়েছিল, কারণ পরদিন ফেরদৌসির বিয়ের তারিখ। হাসানের চক্ষু স্থির হয়ে গেল, এতক্ষণে বুঝতে পারল সে ফাঁদে আটকা পরেছে। আর এই মৌ লোভী- ভাত মারার দল তাকে ফাঁদে ফেলেছে। সে কিছুক্ষণ বিমর্ষ হয়ে বসে থাকল, এখন কি করা যায়? হঠাৎ তার মনে হল এই সমস্যার সমাধান এখনো পীর সাবের হাতে, সে তাকে কল করে ঘটনা জানাবে, তারপর হয়ত তিনি উল্টো কল করে তাদেরকে থামিয়ে দিবেন নয়তো সঠিক কোন পরামর্শ দিবেন। সে বারান্দায় এসে কল করল কিন্তু পটেটো পেছন থেকে ছোঁ মেরে মোবাইলটা নিয়ে গেল। সে এমনভাবে থাবা দিল যে, হাসান আঙ্গুলে ব্যথা পেয়ে পিছন ফিরে তাকাল। পটেটো মোবাইলটা নিয়ে একপাক ঘুরল, শরীরটা দুইটা মোচড় দিল, বার কয়েক বাহু দুলাল, তারপর জাহাজের পটাতনের মত চওড়া বুকটা চিতিয়ে দাঁড়াল এবং মোবাইলটা বন্ধ করে পকেটে রাখল।
হাসান বুঝল এ লোকের শরীরে সন্ত্রাসপনা জোশ এসে গেছে, কারণ সন্ত্রাসীরা গায়ে জোশ না আসা পর্যন্ত খুন বা কোন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করতে পারে না। তখন তার স্ত্রীর কথা বিশ্বাস হল, এ লোক আগে সর্বহারা করত এবং কয়েকবার জেল খেটেছে। পটেটোর অবস্থা দেখে হাসানের সামনে পৃথিবীটা যেন লাঠিমের মত ঘুরতে লাগল, মাটিতে তার পা দু’টি দৃঢ় হয়ে বসেছে, শরীর বেলুনের মত ফুলে উঠছে, বুক স্ফীত হয়ে উঠেছে, কান শোঁ শোঁ শব্দ করছে, হয়ত ধোয়া বের হচ্ছে। নিজের এ অবস্থাটাকে সে চিনে, এটা তার চরম অবস্থা, হয় বাঁচবে নয় মরবে। তখন তার অবস্থা হয় সেই ঈগলের মত-যে মহাশুন্যে থেকে উল্কার বেগে ভাসমান কোন মাছের উপর চোঙ্গল মেরে পরে, মৎস গাত্রে তার সম্পূর্ণ নখর বিধিয়ে দেয়, তারপর মাছটি যদি তার আয়ত্বের বাইরে হয় তাহলে সেই মাছ তাকে নিয়ে পানিতে তলিয়ে যায়, ঈগলের সলিল সমাধি হয়। আর যদি আয়ত্ত্বাধিন হয় তাহলে সেটা নিয়ে গিয়ে ডালে বসে ঠুকরে ঠুকরে খায়। তার অবস্থাও হল ঠিক তাই। সে এদেরকে চোংগল মেরে ধরবে, তারপর হয় ওদেরকে ঝারে বংশে নিপাত করে দিবে নয়তো নিজেই নিপাত হয়ে যাবে।
পটেটোর ভঙ্গিমা তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দিল। তার ভিতরটা গর্জে উঠল, ‘কুত্তির বাচ্চা, তোর মত একটা মুজুরের পোলা একটা মূর্খ সন্ত্রাসী আমাকে অপমান করলি, আমার হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিলি। এটা মানবতার লাঞ্চনা, মনুষ্যত্বের অবলামননা, এটা মূর্খ কর্তৃক শিক্ষিতের লাঞ্চনা। এ ঘটনা আমার দেশে করলে এতক্ষণে তোর দেহের প্রতিটা কোষ থেকে কোষ আলাদা হয়ে যেত। তোকে আমি খেয়ে ফেলব’। তার চোখে রক্ত জমা হতে লাগল, গায়ে জোশ এসে গেছে। সে পটেটোর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তিন হাত বলয়ের মধ্যে চক্রাকারে ঘুরতে লাগল আর মনে মনে হুঙ্কার ছাড়ল, ‘আমি তালাক দিব না, পৃথিবীর কোন শক্তি আমার থেকে তালাক নিতে পারবে না। আমার গায়ে কেউ হাত তুললে ওর বংশে প্রদীপ জ্বালাবার কেউ থাকবে না’। সে ভাবছে, এখান থেকে চলে যেতে হবে কিন্তু কিভাবে? এই অনাহার ক্লিষ্ট ক্ষীণ দুর্বল দেহে এতগুলি লোকের সাথে তো যুদ্ধ করে পারবে না।
হ্যাঁ, বুদ্ধি খাটাতে হবে, কৌশল করলে একজন দশজনের বিরুদ্ধে জয়ি হতে পারে। যে কোন একজনকে টার্গেট করতে হবে। তারপর সে মাথা উচু করে চারদিকে তাকাল, যেভাবে কোন সিংহ শির উত্তোলন করে তার শিকার শনাক্ত করে। তার কাছাকাছি পটেটোকেই সে টার্গেট নিল, আর তা তিনটি লক্ষে। হয়ত পটেটোর উভয় চোখে বা কোন একটা চোখে সহসা আঙ্গুল ঢুকিয়ে চোখ বের করে নিয়ে নিমিষেই এখান থেকে চলে যেতে হবে। তারপর কিভাবে এবং কত দুরত্ব থেকে আঙ্গুল ঢুকানো যায়- এর নিশানা ঠিক করল। অথবা নাকের উপর একটা ঘুষি মারতে হবে, আর তা হতে হবে অন্তত কয়েকটন ওজনের যাতে মোটর পাম্পের পাইপের মত তীর বেগে নাক থেকে রক্ত ছুটতে থাকে। তজ্জন্য সে পটেটোর কতটা দুরত্বে থেকে, হাতটা কোন পাশ থেকে ঘুরিয়ে এনে কিভাবে নাকের উপর অব্যর্থ হাতটা বসাবে তার একটা আন্দাজ নিল। অথবা অন্ডকোষে লাথি মারতে হবে। না, লাথি মারলে তেমন কিছু হবে না, গোড়ালি দিয়ে গোড়ি মারতে হবে। আর এমন প্রচন্ড গোড়ি মারতে হবে যাতে ওর অণ্ডকোষ ছিড়ে পরে যায়। তারপর হয় সাথে সাথেই মরে যায় বা অন্তত বেহুশ হয়ে পরে যায়। সে মনে মনে একটা প্রবাদ আওড়াল ‘কাউকে ধরলে মরণ ধরা ধর যাতে না মরলেও অন্তত জ্বর উঠে যায়’। তারপর ছোট্ট একটা দৌড়ে মাত্র কয়েক গজ দুরে বাদল লাইব্রেরীর সামনে গিয়ে পৌছতে পারলেই হল। কারণ রাস্তার উপর গিয়ে তারা মারামারি করার সাহস পাবে না, করতে চাইলেও লাভ হবে না। কারণ বাদল লাইব্রেরী ও আশ- পাশের দোকানদাররা তার পরিচিত এবং ঘনিষ্ঠ, তার হয়ে তখন তারাই লাঠি ধরবে।
আর তারপর? তারপরেই তো শুরু হবে আসল খেলাটা, ওদের উপর লোহার মই ছড়িয়ে দেব, লাল ঘোড়া দাবড়িয়ে দিব। গ্রামের নিয়ম হল কাউকে সাইজ করতে হলে ডজন খানেক মামলা ঠুকে দেয়া হয়। এ বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা আছে। এখানেও তাই করব, ওদের বিরুদ্ধে শত শত সত্য মিথ্যা মামলা ঠুকে দেব, ওদের নারী- পুরুষ সবগুলিকে আসামি করব, প্রতিদিন কয়েকটা করে মামলা দিব। এমন মামলা যাতে ওদের চাকরিটা চলে যায়। আর চাকরিটা চলে গেলেই এই ফকিন্নিরা স্ত্রী সন্তানসহ ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে মানুষের দোয়ারে দোয়ারে ভিক্ষায় নামবে। কারণ একে তো এদের এমন কোন সম্পদ নাই যা ওদের এক লোকমা গ্রাস জুটাতে পারে। আবার কাউকে এক অক্ষর পড়ানোর যোগ্যতাও নাই যে টিউশনি- ফিউশনি করে খাবে। ভিক্ষা ব্যতিত ওদের কোন গত্যন্তর থাকবে না। আর আমি? দেশের ত্রি ধারায় শিক্ষা প্রাপ্ত, পৃথিবীর প্রধান পাঁচটা ভাষাজ্ঞান আমার আছে। আমি যেখানেই বসব সেখানেই আমার ভাত আছে। কাজেই আমার শেষ রক্ত বিন্দু ও শেষ কপর্দকটিও ওদের পেছনে ঢেলে দেব। পৃথিবীর সীমানা থেকে ওদের অস্তিত্ব মুছে ফেলব, ওদের চৌদ্দপুরি নিপাত করে দেব। আগামি কালই কয়েকটা মামলা ঠুকে দেব। তারপর আমার বউকে নিয়ে আসব। কিন্তু----
এই কিন্তুটা স্বরণ হতেই বেলুনের মত তার শরীর চুপসে গেল, বুক স্তিমিত হয়ে এল, মাথা আবনত হয়ে গেল। যার জন্য এত সংগ্রাম, এত যুদ্ধের পরিকল্পনা সেই তো আমার নয়, সে তো এক হিন্দুর বাহু বন্ধনে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে। এখন আমি তার শত্রু। আমি কিছু করলে তো সেই আগে গিয়ে আমার নামে নারী নির্যাতন বা যৌতুকের মামলা ঠুকে দিবে, আমাকে জেলে পোরবে। নৈরাশ্যের ঘেরাটোপ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। শরীরটা নিস্তেজ হয়ে গেল, দেহের জোড়াগুলি যেন খুলে যাচ্ছে, সে মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে ঘরে গিয়ে ভাত মারা হুজুরদের মাঝখানে বসে পরল।
ইঞ্জিনিয়ারের কাছ থেকে পটেটো একটা সাদা কাগজ নিয়ে এসে বলল, ‘সই করেন’। হাসানের পিত্তিটা জ্বলে গেল, তার কণ্ঠ গমগম করে উঠল, ‘আমি সাদা কাগজে সই করব না’। কয়েকজন বলল, ‘না থাক, সাদা কাগজে সই করতে হবে না’। বিশ মিনিট পর নোটারি পাবলিক এল, লিখল, হাসান সই করল। তারপর সেই জঘন্য তিন কথা উচ্চারণ করল আর সাথে সাথে তার প্রতিটা দীর্ঘশ্বাসের সাথে এবং বুক ফেড়ে শুধুই একটা আর্তরব উঠল, সমগ্র ভুমন্ডল আর নভোমণ্ডল চাপিয়ে উঠল, ‘হায় আল্লাহ্, এ জন্যই কি পৃথিবীতে আমার জন্ম হয়েছিল, এই ঘৃণ্য তিন কথা আমার মুখ থেকে টেনে বের করা হল। এমন একটা জঘন্য কাজের চেয়ে আমার দ্বারা কি তুমি সম্মান জনক কোন কাজ করাতে পারলে না’।
তার সেন্স ও অনুভূতি শক্তি মরে গিয়েছিল, আশপাশে কি হচ্ছে না হচ্ছে চেতনা ছিল না। হঠাৎ তার নজরে পরল সবাই মিষ্টি খাচ্ছে। একজন বিয়ে অনুষ্ঠানের মত মিষ্টি বিতরন করছে। তার সামনে এসে দুইটা মিষ্টি বাড়িয়ে দিল। সে অন্তহীন ঘৃণায় ঠোঁট বাকিয়ে নাক ঘুরিয়ে ভ্রু কুচকে ভেংচি কাটল, ‘আমি মিষ্টি খাই না’। লোকটা ভয়ে বা লজ্বায় পিছিয়ে গেল। সে তাজ্জব হয়ে ভাবতে লাগল এরা কি পিশাচ নাকি খোদ আযাযিল। এরা তাকে ও তার সন্তানকে কবর দিয়ে সমাধির উপর বসেই বিয়ে অনুষ্ঠানের মত আনন্দ স্ফুর্তিতে মিষ্টি গিলছে। অকস্মাৎ দুর্ঘটনার তীব্র যন্ত্রণায় পাথর হয়ে যাওয়া ব্যথাতুর দু’টি চোখে হাসান ওদেরকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। তামাম ইনসানিয়্যাতের শত্রু, জাহান্নামের এই কুকুরগুলি এমন একটা ট্র্যাজিক মুহুর্তে কত স্বাচ্ছন্দে মিষ্টি চিবুচ্ছে। আল্লাহ্ এদের মধ্যে ন্যুনতম মনুষ্যত্ব বোধ দেননি।
হঠাৎ তার দৃষ্টি গেল ইঞ্জিনিয়ারের উপর। এ লোকটার চেহারা এমনিতেই কুৎসিত। একে তো কয়লা কাল, তার উপর মুখে বসন্ত বা এ জাতীয় কোন কিছুর দাগ, কুকুরের মুখের মত লম্বাটে মুখ। কুকুর যেভাবে হাড্ডি বা শুকনা গু চিবায়, সেও সেভাবে মিষ্টি চিবাচ্ছে। হাসানের মনে হল লোকটা আসলেই শুকনা গু চিবাচ্ছে। আর আজ সে বুঝতে পারল ইঞ্জিনিয়ার কেন মানুষের সামনে বা বাইরে খায় না। খাওয়ার সময় তাকে বিশ্রি দেখায়, পুরো মুখাবয়ব নড়ে, চিবানোর প্রতিটা ফাকে মুখ বিবর বিকট হা করে উঠে। হাড় চিবানোর সময় কুকুরের চোয়ালের মত তার চোয়ালও নড়ে। অন্যেরা জানে এটা হাসানের তালাক উপলক্ষে মিষ্টি, কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার এই মিষ্টি খাইয়েছে হিন্দু নওমুসলিমের সাথে ফেরদৌসির বিয়ের উদ্ভোধন বা সূচনা পর্ব উপলক্ষে।
মিষ্টি খাওয়ার পর ইঞ্জিনিয়ার প্রশ্ন তুলল বাচ্চার কি হবে? হাসান একটু চিন্তা করে বলল, আমার বাচ্চা তো আমি নিয়েই যাব। কিন্তু সমস্যা হল, বাচ্চার বয়স মাত্র দুই বছর, আর শরীয়ত নির্ধারিত দুগ্ধপোষ্যকাল আড়াই বছর। কাজেই বাচ্চাকে আর ছয়মাস তার মা দুধ পান করাক, তজ্জন্য আপনারা আমাকে যা বলবেন, যা শর্ত দিবেন, যে কোন ত্যাগ শিকার করতে বলবেন, যত টাকা দিতে বলবেন, আমি তাই করব। তখন পটেটো খেকিয়ে উঠল, ‘না না না, আমরা এসব ঝামেলায় নেই। আপনার বাচ্চা আপনি নিয়ে যান’। জামালপুরে একজন লোক আছে, সবাই তাকে শন্ডা হুযুর নামে ডাকে। লোকটা আসলে ম্যাট্রিক পাশ কিন্তু বেশ- ভুষায় আলেম সেজে আলেমদের সাথে ঘোরাফিরা করে আর গোন্ডামি করে, এ জন্য তাকে সবাই শন্ডা হুযুর ডাকে। এই লোক ইঞ্জিনিয়ারের একজন চাটুকার। সে বলল, ‘আপনার বউয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, নতুন জামাই হচ্ছে। আর বাচ্চা দেখার জন্য আপনি যাবেন, তখন নতুন জামাই পুরান জামাই- এক মেয়ের দুই জামাই একত্র হয়ে যাবেন, বিষয়টা কেমন হবে? তাছাড়া বাচ্চা দেখে আপনি ‘বাচ্চার এটা নাই ওটা নাই, ভাল জামা কাপড় নাই, পোশাক নাই’ কত কিছু বলবেন, এসবের দরকার কি, আপনার মেয়ে আপনি নিয়ে যান’। সর্বশেষে ইঞ্জিনিয়ার ঘোষণা দিল, ‘না, আমরা আপনার ঝামেলা পোহাতে পারব না, আপনার মেয়ে আপনি নিয়ে যান’। তারপর তার ক্রীতদাস পটেটোর দিকে ফিরে বলল, ‘তালুকদার বাচ্চাটা এনে ওকে দিয়ে দেন’। পটেটো হাসানের দিকে ফিরে বলল, ‘আপনি অপেক্ষা করেন, আমি এখনি নিয়ে আসছি’। তারপর তারা সবাই বেরিয়ে চলে গেল, হাসান একা একা বসে থাকল।
সে বসে আছে, তার অবস্থা হল সেই ব্যক্তির ন্যায় হঠাৎ বোমায় যার হাত পা উড়ে গেছে, শুধু শরীর ও মাথাটা আছে। এই ব্যক্তি যেমন জানে না, সে জীবিত নাকি মৃত, সে কোথায় আছে, স্বর্গে মর্তে নাকি পাতালে। সে জানে না, পৃথিবীর সাথে তার বন্ধন আছে নাকি টুটে গেছে, সে কিছুই দেখে না, কিছুই শুনে না, কিছুই বুঝে না, শুধু মানুষের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। হাসানের অবস্থাও তাই হল। সে জানে না, সে জীবিত নাকি মৃত, সে কোথায় আছে পৃথিবীতে নাকি অন্য কোথাও। পৃথিবীর সাথে তার সম্পর্ক আছে কি নেই, সে কিছুই জানে না, কিছুই দেখে না, কিছুই শুনে না, শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। দুয়েকজন মানুষ আসছে যাচ্ছে তাদের সাথে সে কথা বলতে চায় কিন্তু বলতে পারে না, তার মুখে শব্দ আসে না। কি বলতে হবে জানে না। সে শুধু বসে আছে, বসে আছে বোবা হয়ে। মানুষের দিকে বোকার মত, নির্বোধের মত ফ্যাল ফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে থাকে। মুসলিম জাতির ইতিহাসে কোন মুহাদ্দিসকে আটকিয়ে, বাধ্য করে তালাক নেয়া সম্ভবত এটাই প্রথম।
বিষয়: সাহিত্য
১৫২১ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন