চিঠি (কবর)-৬৩ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৬, ০৯:১৮:৩৬ সকাল
পরদিন, ২০ জুলাই। হাসান মাদরাসা করে বাড়ির উদ্দশ্যে রওয়ানা করল। সে ভাবছে এই অবস্থায় বাড়িতে যাওয়া যাবে না, এই শরীর দেখলে মা হুলুস্থুল কান্ড বাধিয়ে দিবেন। কাজেই বাড়িতে না গিয়ে পীর সাবের উদ্দেশ্যে বিকাল নাগাদ মাদরাসায় গিয়ে পৌঁছল। মাদরাসার উত্তর পাশেই বাজার। গতকাল সকালের পর এ পর্যন্ত আর তার কিছুই খাওয়া হয়নি, দেহটা আর চলছে না, মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না, পীর সাবের সাথে তো কথা বলতে হবে। তাই বাজারে গিয়ে একটা হোটেলে বসল। গ্রামের হোটেল, তেমন কিছুই নেই, দুইটা ডাল পুরি এবং একটু গোশতের ঝুল দিতে বলল কিন্তু গোশত তো দুরের কথা কোন তরকারিই নাই। অগত্যা পানি দিয়ে কোন রকম একটা পুরি গিলল। বাজারের উত্তর পাশেই মাদরাসার গুরস্থান, তারপর সেখানে চলে গেল। একটা নেম ফলকের উপর থুতনি ঠেকিয়ে হাটু গেড়ে বসে কবরের উপর একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। চোখে অশ্রুর ধারা বইছে, নেম ফলক ভিজে নোনাজল নীচে গড়িয়ে পরছে। সালাম নেই কালাম নেই, রা নেই, চেতনা নেই, শুধু চোখের ভাষা, ভাব আর আবেগ। সে ফুলে ফুলে কাঁদছে আর হঠাৎ মাতম শুরু করল, ‘আব্বা আব্বা গো, আমার কি হবে আব্বা। এভাবে প্রায় একঘন্টা বাবার কবরের উপর পরে থাকল। অবশেষে মাগরিবের আযানে তার ধ্যান ভঙ্গ হল। তারপর মসজিদে চলে গেল।
সে ভাবল, চেম্বারে তো পীর সাবের সাথে কথা বলার সুযোগ নাই, তাই মসজিদ থেকে বেরুনোর পর হাটতে হাটতে কথা বলবে। কিন্তু নিরাশ হল, মসজিদের ভিতর থেকেই কয়েক জন পীর সাবের পিছু নিল এবং আলাপ করতে করতে চলল। সে চেম্বারে চলে গেল। তিনি চেম্বারে ঢুকতেই অন্যরা হুড়মুড় করে ঢুকতে লাগল। হাসান রুক্ষস্বরে বলে উঠল দাঁড়ান, এক মিনিট, আপনারা পরে আসেন আমার একটু আলাপ আছে। সেখানে সে ছিল সকলের পরিচিত এবং গন্যমান্য। কাজেই তার কথা মানল। পীর সাব উঠে চৌকির মাঝে বসলেন আর সে এক কিনারে বসল। তাড়াহুড়া বিধায় ভূমিকা না করে সরাসরি বলল, ‘ওরা এখন তালাক চাইতেছে, আমার বউকে অন্যত্র বিয়ে দিবে’। বাঙালীর সাধারণ নিয়ম হচ্ছে স্ত্রী স্বামীর পিছু টেনে ধরে স্বামী নয়, স্বামীর ক্ষেত্রে এটা কাপুরুষতার লক্ষণ হিসাবে গন্য করা হয়। কাজেই কথাটায় যেন তিনি কিছুটা রুষ্ট হলেন, চড়া গলায় বললেন, ‘যাইতে চায় যেতে দাও, না আসতে চাইলে আনার কী দরকার। হাসান নিরাশ হল, সে এখন কি করবে কি বলবে কোন দিশা না পেয়ে হঠাৎ ‘আমার বাচ্চার কি হবে’ বলে দু’হাতে মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
তিনি অবাক হলেন এবং বুঝতে পারলেন ছেলেটা স্ত্রীর প্রতি একটু বেশিই অনুরক্ত। অসুস্থ সন্তানের প্রতি একজন বাবা যেভাবে তাকিয়ে থাকে- হাসানের দিকেও তিনি সেভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘এখন তাহলে কি করতে চাও?- আপনাকে যেতে হবে।– আজ কত তারিখ। - ২০ তারিখ। তিনি একটু চিন্তা করে বললেন, ‘২৫ তারিখে আমি টাঙ্গাইল যাব, সেখানে একটা মাদরাসায় বুখারির সবক উদ্ভোদন করব। সেখান থেকে ফিরার সময় আমি জামালপুর হয়ে আসব’।- এর মধ্যে এক ঘুরান যাওয়া যায় না? তিনি শান্তনার সুরে বললেন, ‘আমার তো সময় নাই, মাঝখানে চারটা দিনই তো মাত্র। তুমি যাও, আমি পঁচিশ তারিখ বিকাল বা সন্ধায় জামালপুর পৌঁছব। তুমি নিশ্চিন্তে যাও, আমি আসব ইংশাআল্লাহ’। হাসান আশ্বস্ত হল, খুশিতে তার মুখটা চাঁদের মত ঝকমক করে উঠল। সে সালাম দিয়ে বেরিয়ে গেল।
হাসান কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে একটা চা স্টলে গিয়ে বসল। চায়ের কাপ ফুকতে ফুকতে ভাবছে, এখন কি করা যায়, এই রাতে জামালপুর যাওয়া সম্ভব নয় কারণ গাড়ি পাওয়া যাবে না। আবার বাড়িতে যাওয়াও সম্ভব নয়, কারণ শরীরের যে অবস্থা মা দেখলে কোন কান্ড করে বসে কে জানে। কাজেই এখন একমাত্র পথ হল মাদরাসায় থাকা। কিন্তু মায়ের জন্য তার মন পোড়াতে লাগল, এত কাছে এসেও মাকে না দেখে চলে যাবে এটা কি করে সম্ভব। অবশেষে অনেক চিন্তা ভাবনার পর একটা রিকশা নিয়ে বাড়িতে চলে গেল। মায়ের দরজার সামনে গিয়ে ভাবল, জামার জন্য শরীর দেখতে পারবে না, চশমার জন্য চোখ দেখতে পারবে না, দাড়ির জন্য মুখ দেখতে পারবে না, সে হাসল- রাতের বেলা মা কিছুই বুঝতে পারবে না। সালাম দিয়ে ঘরে ঢুকল কিন্তু অভ্যাস অনুযায়ী মায়ের খাটে বসল না। সতর্কতার খাতিরে সে মায়ের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে, মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে রেখে হাটার উপর থাকল। মা খাটে বসে আছে। সে কখনো পানের কৌটার কাছে, কখনো চুনের কাছে, কখনো দরজার কাছে যায়। এভাবে স্থির না থেকে কোন রকমে পীর সাবের কাছে আগমনের সংবাদটা জানিয়ে সে নিজের রুমে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর মা খাওয়ার জন্য ডাকলেন। সে ভাবল প্রথম ধকল তো কেটেই গেল। এখন রাতের বেলা বয়স্ক মানুষ, ঠিকমত দেখতে পাবে না। কাপড় ও চশমা খুলে খেতে গেল। মা তার মুখের দিকে তাকালেন, তারপর হাত ধরে মুখের দিকে ঝুকে পরলেন। চামড়া শুকিয়ে হাড়ের ভিতর ঢুকে গেছে, শিরাগুলি সমতলের উপর সরকের ন্যায় স্ফীত হয়ে আছে। চোখ গভীর গর্তে পতিত। হাসান লজ্বায় লাল হয়ে উঠল। মা হঠাৎ ধপাস করে বিছানায় পরে, ‘হায় হায় আল্লাহ্ গো, এ আমার কি হল, আমার কোন সর্বনাশ হল, আমার মাইজ ঘরে ডাকাতি (ক্ষতি) হল। হায় আল্লাহ্ আমার চোখের সামনে আমার ছেলেকে তুমি কি করলা, সারাটা জীবন কত কষ্ট করল, এতগুলি ইয়াতিম লালন পালন করল, সংসারটা টিকায়া রাখল, তুমি এর কি প্রতিদান দিলা’। তিনি বিছানায় দু’হাত মারতে লাগলেন আর বিলাপ করতে লাগলেন। মায়ের কান্না শুনে ছেলেরা দৌড়ে এল। মা বললেন, ‘দেখ, তোরা চেয়ে দেখ একটা মরা মানুষ, একটা কঙ্কাল, এটা আমি কি করে সহ্য করব’ বলে তিনি আরো জুড়ে কাঁদতে লাগলেন।
ছেলেরা কিছুক্ষণ চিড়িয়াখানার প্রাণী দেখার মত ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখল, তারপর রাগে গালাগালি শুরু করল। একজন বলল, ‘ছি ছি এমন একটা খান্নাস বউয়ের জন্য মানুষ এভাবে নিজেকে শেষ করে নাকি, এটা তো আত্মহত্যা’। একজন বলল, ‘ঐ মাগিটার জন্য শরীরটা কি করেছে দেখেছ, এটা কোন মানুষের শরীর হল’। আরেক জন বলল, ‘এসব কথা তো বলা হচ্ছে অনেক দিন ধরেই কিন্তু লাভটা কি হচ্ছে, তাড়াতাড়ি মেয়ে দেখ, এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে করাতে হবে’। তারপর তারা আরো কিছুক্ষণ বিভিন্ন মন্তব্য করে অবশেষে একমত হল যে, কাল থেকে জোরে শোরে মেয়ে দেখা শুরু করবে এবং সর্বোচ্চ দশ দিনের মধ্যে বিয়ে করাবে।
হাসান পাথরের মত জমে গেছে। তার লোকানোর বা লজ্বা পাবার মত আর কিছুই নেই। কিছু বলার, কিছু করার বা চিন্তা করার মতও আর কিছুই নেই। খাটের পাশে গিয়ে বসল। মা অনেকক্ষণ বিলাপ করে ক্লান্ত হয়ে গেলেন। তারপর উঠে এসে তার নাকে, মুখে, মাথায় ও গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, ‘কেন তোর এই অবস্থা হল, আমি তো আগেই বলেছিলাম আমি যাই। আমার কথা তো শুনলি না’ বলে তিনি আবার কাঁদতে লাগলেন। হাসানের অবস্থা হলো সেই ব্যক্তির ন্যায়- যে চলন্ত গাড়ি থেকে তার মূল্যবান পন্য নামানোর চেষ্টা করছে, তখন হঠাৎ তার পা গাড়ির চাকার নীচে চলে গেল। এই ব্যক্তির সব চিন্তা উবে গিয়ে যেমন নিজের জীবন নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে উঠে-তার অবস্থাও সেই রূপ হল। এই প্রথম সে নিজের জীবনাশঙ্কাবোধ করল। সহসা সে মায়ের কাঁধে মাথা রেখে বেদনাতুর কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আম্মা আমি বোধ হয় আর বাঁচব না’। পাথরের মত নিশ্চল দু’টি চোখ, সেখানে কোন ভাষা নেই, কান্না নেই, অশ্রু নেই। আছে শুধু গাঢ় অন্ধকার, হতাশা, নৈরাশ্য আর অন্তহীন বেদনা।
যে মা এই সন্তানের কাঁধে ভর করে সংসার সমুদ্র পাড়ি দিয়েছেন, তিনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন, সহসা তার মুখটা বিকট হা করে উঠল, এক মিনিট পর্যন্ত দম টানলেন না, মনে হল মারা যাচ্ছেন, তারপর হেচকির মত একটা শব্দ হল, নিঃশ্বাস ফেললেন। তারপর তীব্র আর্তনাদ করে বিছানায় গড়িয়ে পরলেন, ‘তুই কী বললি, কী বললি তুই, কেন বললি, কেন বললি এমন কথা, আমার সামনে থেকে তুই চলে যাবি আর আমি বেঁচে থাকব? মা ছেলের জানাযা পড়ে নাকি ছেলে মায়ের জানাযা পড়ে? আল্লাহ্ গো, তুমি আমাকে কী শুনালে, কেন শুনালে এমন কথা। এমন কথা শুনানোর আগে আমাকে উঠিয়ে নিলে না কেন? আমার ছেলেটা সারা জীবন কত কষ্ট করছে, এতগুলি ইয়াতিমকে মানুষ করছে, এই সংসারটা টিকায়া রাখছে। আমার খেদমত করছে, কাউরে কোনদিন কষ্ট দেয়নি, কারো অন্যায় করেনি, কাউরে কোন দিন ঠকায়নি, কেন তুমি আমার ছেলেটাকে এত কষ্ট দিলা, মাফ কর আল্লাহ্ মাফ কর, তাকে সুখী কর’। তারপর তিনি শুরু করলেন তিরস্কার আর গালাগালি, ‘শয়তানের দলের কথা শুনেই আজ আমার এই সব সর্বনাশ হল, আগেই আমি যাইতে চাইছিলাম, আমি গেলে আজ এই সর্বনাশ হত না। এই সব বিলাপ করতে করতে হঠাৎ তিনি শান্ত হয়ে গেলেন, কোন কথা বললেন না, গুরু গম্ভীর হয়ে আধমরার মত শুয়ে থাকলেন। অবশেষে অনেকক্ষণ পর উঠে খেতে বসলেন।
না, আজ আর হাসানের জন্য আলাদা কোন তরকারির ব্যবস্থা নেই। মাছের সাধারণ একটা তরকারি ও ডাল। তার শুকিয়ে যাওয়া খাদ্যনালীতে লোকমা ঢুকতে চাইল না। পানি নিয়ে ঢোক গিলে কয়েক লোকমা খেল। মা গম্ভীর হয়ে আছেন, কোন কথা বলছেন না, চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছেন, মনে হয় যেন রাগে ফুলে আছেন। সে অতি কষ্টে কয়েক লোকমা খেয়ে উঠে পরল। কিন্তু অবাক হল, মা ‘আরো ভাত নে, তরকারি নে, আরো খা’ ইত্যাদি অন্যান্য দিনের মত কিছুই বললেন না। মায়ের গাম্ভির্যতা তার কাছে পীড়াদায়ক হয়ে উঠল, সে নিজের রুমে চলে গেল।
ঘন্টা দুয়েক পর মা গিয়ে এক গ্লাস গরম দুধ দিয়ে এলেন কিন্তু কোন কথা বললেন না, সে সারা রাত এপাশ ওপাশ করে ও বাইরে ঘোরাফিরা করে কাটাল কিন্তু ঘুম হল না। ফজরের পর মা দুইটা ডিম ও কয়েকটা পিঠা দিয়ে গেলেন তবে কোন কথা বললেন না। সে কোন রকম একটা ডিম খেয়ে বাকীগুলি পিচ্ছি ভাতিজিটাকে দিয়ে দিল। আবার ঘুমুতে চেষ্টা করল কিন্তু শুধু গড়াগড়ি করল ঘুম হল না। সকাল নয়টায় মা খাওয়ার জন্য ডাকলেন, হাসান ভাবল শরীরের যে অবস্থা দিনের বেলা খালি গায়ে থাকা ঠিক হবে না। সে জামা ও চশমা পরে খেতে গেল। কয়েক জাতের মাছের তরকারি ও নিজের খোঁয়াড়ের মোরগের গোশত। সে তেমন ভাত না খেয়ে কিছু মাছ ও গোশত খেয়ে হাত ধুয়ে উঠে পরল। অবাক কান্ড, অন্যান্য দিন মা তার পাতে তরকারির বাটি উপোর করে ঢেলে দেন, গালি দিয়ে জোর করে বেশি বেশি খাওয়ান অথচ আজ কিছুই করলেন না, কিছুই বললেন না, শুধু গম্ভীর হয়ে নিজের খাওয়া চালিয়ে গেলেন। বিষয়টা হাসানের কাছে পীড়াদায়ক হয়ে উঠল। মা বাপ এভাবে গুমরা মুখো হয়ে থাকলে শোভা পায় না, বড্ড খারাপ লাগে, তারচেয়ে বরং মারলে, গালাগালি করলেও অনেক ভাল। সে কিছুক্ষণ বিষণ্ণ হয়ে বসে থাকল, তারপর কৌটা খুলে পান খেতে বসল।
আর পরক্ষণেই মায়ের গাম্ভির্যতা ও নির্বাকতার কারণ বুঝতে পারল। তিনি বোরকা পরে সামনে এসে বললেন, ‘চল, আমি যাব তোর সাথে’ তার কণ্ঠ ঝনঝন করে উঠল। তার ভাব ও ভাষা এতটাই রুঢ় ও দৃঢ় যে হাসানের মনে হল একমাত্র এ কথাটাই সত্য, দুনিয়ার আর সব মিথ্যে। কথাটা এতই ভারি যে, হিমালয়ের উপর ছেড়ে দিলে তা ধুলিস্মাত হয়ে যাবে। সে ভড়কে গেল, কিছু বলার সাহস পেল না। শুধু পাগলের মত পান ছিড়ে ছিড়ে মুখে দিচ্ছে আর ছাগলের মত চিবাচ্ছে। মা গর্জে উঠলেন, ‘উঠস না ক্যা, চল’। সে ধমক খেয়ে আরো মিইয়ে গেল, গলা টেনে টেনে বলল, ‘পীর সাব পঁচিশ তারিখ যাবে, তারপর.....। ‘আর একটা কথা নয়, অনেক শুনেছি আর না, উঠ’ তিনি ঝংকার দিয়ে উঠলেন, তার রুঢ় কথাটা ঘরে প্রতিধ্বনি তুলল। ইতিমধ্যে তার ভাইয়েরা এসে হাসি তামাশা শুরু করল। আপনে কই যাবেন, আপনাকে দেখেই তো ওরা বাঘ ভাল্লুক মনে করে দরজা বন্ধ করে ফেলবে। যাইয়েন না ওরা মানুষ না। আরেকজন বলল, ঐ চোলামুখিটাকে আর আনা যাবে না, আমরা মেয়ে দেখা শুরু করেছি, দশ দিনের মধ্যে বিয়ে করাব। মা ধমকে উঠলেন, ‘যা, তোরা আমার সামনে থেকে। তোরা কত কামিলা পোলাপান তাতো এতদিন দেখলামই’।
ভাইদের কথায় হাসান কিছুটা সাহস পেয়ে বলল, ‘আচ্ছা পীর সাব যদি না আনতে পারে তারপর আপনি যাবেন নে’। কিন্তু তিনি তাকে উঠার জন্য ধমকাতে লাগলেন। আর হাসান বেচারা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে কখনো মুখে শুধু পান ঠেলছে কখনো খালি সুপারি, আর বেজান হয়ে ছাগলের মত চিবাচ্ছে। সকালে খাওয়ার পর গায়ের মহিলাদের কোন কাজ থাকে না। তখন তারা এ বাড়ি সে বাড়ি ঘোরে বেড়ায়। হাসানের মা কখনো দেউরির বাইরে যেতেন না, গায়ের মহিলারাই তার কাছে আসে, পান জর্দা খায়, আলাপ করে। আর তখন দুয়েকজন করে বেশ কজন মহিলা আসল, হাসান তাদের কাছে নালিশ করল এবং বুঝাল। তারাও তার মাকে বুঝাতে লাগল, ‘আচ্ছা পীর সাব যেখানে যাইতেছে সেখানে আপনের যাওয়ার দরকার কী? পীর সাব না আনতে পারলে তখন আপনে যাবেন, এখন যাওয়ার দরকার নাই’। কিন্তু তিনি কারো কথা শুনবেন না। শিশুর মত বায়না ধরছেন।
পশ্চিম পাড়ায় হাসানের এক খালা ছিল সে তার মায়ের বড়, তিনি মাঝে মধ্যে আসতেন আজও এলেন। সে ছিল দারোগা, খুব তেজি, সবাই তাকে ভয় পায়। হাসান তাকে বুঝাল, তিনি মাকে বুঝালেন কিন্তু মা কোন কথা মানবেন না, যাবেনই। অবশেষে সে খালাকে ইঙ্গিতে ডেকে ঘরের একপাশে নিয়ে কানে কানে ফিসফিসিয়ে কিছু বলল, তারপর খালা তার স্বভাব সুলভ গলা ছেড়ে দিলেন, ‘ছেলে এত করে বলতেছে তুই গেলে তারা অপমান করবে, তুই কাজের কাজ কিছুই করতে পারবে না, শুধু অপমানিত হবি। পীর সাব যাইতেছে, সে না আনতে পারলে তুই যাবি, এই চার পাঁচটা দিনই তো মাত্র। এখন যেতে পারবি না’ বলে তিনি ঘরের এক দরজা বন্ধ করে আরেক দরজায় দাঁড়ালেন। তারপর বললেন ‘এই হাসান তুই যা, দেখি তোর মা কি করে, ওকে আজ আমার দেখার আছে’। হাসান এক দৌড়ে বেরিয়ে তার রুমে গিয়ে ব্যাগ ও পাজামাটা বগলদাবা করে দৌড়ের উপর থাকল। ওদিকে দরজায় প্রচন্ড শব্দ ও বিলাপ শুনা যাচ্ছে, ‘ছাড়, ছাড় আমাকে, আমার চোখের সামনে আমার ছেলে মরে যাবে আর আমি বসে থাকব, আমার বেঁচে থেকে লাভ কি, যেতে দাও...’। কোন বাচ্চা বাবার সাথে বাইরে যাওয়ার বায়না ধরলে বাপের যে অবস্থা হাসানেরও সেই অবস্থা। এই বুঝি এসে পরল মনে করে সে বারবার পিছনে তাকাচ্ছে আর জোর কদমে হাটছে। কিছুক্ষণ চলার পর তার ক্ষীণ দুর্বল দেহটি ক্লান্ত হয়ে পরল, পিছন ফিরে বুঝল, নাঃ বিপদসীমা পেরিয়ে গেছে। একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে হাফাতে লাগল। কিছুক্ষণ পর একটা খালি রিকশা এল এবং সে তাতে চড়ে বসল।
পরদিন, ২২ জুলাই, ২০০৬ সাল। হাসান মাদরাসায় যাওয়ার পর প্রিন্সিপাল ডেকে নিয়ে খবর জিজ্ঞেস করল। হাসান বলল, পীর সাব পঁচিশ তারিখে আসবেন। তিনি বললেন, তোমার আরো তাড়াতাড়ি করা দরকার ছিল, ওদের তো মতিগতি ভাল নয়। গতরাতে ইঞ্জিনিয়ার ও আরো কয়েকজন আমার বাসায় গিয়ে বলল, রাতেই তালাক নিয়ে দিতে হবে। তালাকের জন্য দু’টা তারিখ পিছিয়েছে এখন আরেকটা তারিখ হয়েছে, এ তারিখ তারা মিস হতে দেবে না, রাতেই তালাক নিয়ে দিতে হবে। তারা আমার উপর চাপ দিতে লাগল। আমি বললাম, ‘ছেলে তো এমনিতে তালাক দেবে না, সালিশ ডাকবে। কোরআনের বিধান মতে স্বামী স্ত্রী উভয় পক্ষের লোকজন সালিশি বসে যে সিদ্ধান্ত দিবে সেই মোতাবেক কাজ করবে’। তখন তারা হৈ চৈ শুরু করে দিল, তারা সালিশে বসবে না, রাতেই তালাক নিয়ে দিতে হবে। আমি বললাম, ‘সে তো এখানে নেই, বাড়িতে গেছে পীর সাবকে আনতে’। পীর সাবের কথা শুনেই জোকের মুখে চুন-লবণ পরল। তারা বন্য গাধার মত চেচামেচি শুরু করল, ‘কিসের পীর সাব কোথাকার পীর সাব, আমরা কোন পীর টির মানি না। মেয়ে যাবে না, আমরাও দিব না, অন্যত্র বিয়ে হয়ে যাবে, এখন কোন পীর টির এসে লাভ নাই’। তারা কিছুক্ষণ লাফালাফি করে চলে গেল। তুমি একটু সাবধানে থেক, ওদের ভাবসাব ভাল নয়। হাসান প্রিন্সিপালকে পঁচিশ তারিখ বিকালে বা সন্ধ্যায় পীর সাবের সাথে থাকার জন্য জোর তাকীদ জানিয়ে বিদায় নিল।
সে বিকালে বিছানায় শুয়ে শুয়ে তাসবীহ পড়ছে। হঠাৎ দরজায় টোকা পরল। তার আত্মাটা চ্যাত করে উঠল। লাফিয়ে উঠে কি যেন এক দুরন্ত আশায় দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল কিন্তু নৈরাশ্যে তার মুখটা কাল হয়ে গেল। পাট গুদামের দুইজন শিক্ষক দাঁড়িয়ে। সে তাদেরকে আসতে বলে দৌড়ে গিয়ে জামা ও চশমা পরে এসে বসল। সেই একই কিচ্ছা। ইঞ্জিনিয়ার তাদেরকে পাঠিয়েছে তালাক নিয়ে দেয়ার জন্য। তারা বলল, ‘আগামি কাল বা পরশু মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে, শুধু তালাকের জন্য আটকে আছে, আপনি তালাকটা দিয়ে দেন’। তারপর তারা তালাকের পক্ষে যুক্তি দিতে থাকল আর হাসান বিপক্ষে যুক্তি দিতে থাকল। ঘন্টা খানেক বিতর্কের পর হাসান বলল, ‘তালাক টালাক এখন আর কিছুই আমার এখতিয়ারে নাই, পঁচিশ তারিখ পীর সাব আসবেন, তিনি এসে যে ফয়সালা দিবেন সেটাই চুড়ান্ত। পীর সাবের নাম শুনে দেখা গেল এদের মুখেও চুন লবণ পরল, তারা চুপ মেরে গেল। কারণ পীর সাব তাদের উস্তাদ, মুরুব্বী, তাদের মাদরাসার উপদেষ্টা পরিচালক সবকিছুই, তিনিই তাদেরকে এখানকার শিক্ষক বানিয়েছেন। একজন গলা টেনে টেনে বলল, ‘পীর সাব আসলে তো কোন কথাই নাই। অন্যজন মিনমিনিয়ে বলল, ‘তিনি আসলেও মনে হয় কাজ হবে না, ইঞ্জিনিয়ার যে অহংকারী আর দাম্ভিক পীর সাবকে মানবে না’। অন্যজন ক্ষেপে গেল, সে মুখ ভেংচিয়ে বলল, ‘হুঃ, পীর সাবকে মানবে না, আমাদের সাথে দুর্ব্যবহার করে অভ্যাস হয়ে গেছে, না? যখন তখন কামলার মত ধমকায়, গোলামের মত ব্যবহার করে। পীর সাবের সাথে তেরিবেরি করলে জামালপুরের মানুষ ওদেরকে ধরে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে ছাড়বে’। তারা আরও কিছুক্ষণ আলাপ করে চলে গেল।
বিষয়: সাহিত্য
১০৬৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন