চিঠি (কবর)-৬২ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১১:৫১:২৭ সকাল

দেড় মাইল হাটার পর সে বাসায় পৌঁছল। দরজা খোলে বাসায় ঢোকার জন্য পা তুলল, কিন্তু তার দুর্বল দেহ পরিমাণ মত পা- টা উত্তোলন করতে পারল না, উপরের সিড়িতে ডান পায়ের জুতা বেজে মুখ থুবড়ে পরে গেল। দু’হাত বাড়িয়ে সে নাক মুখ থেতলে যাওয়া থেকে মাথাটা রক্ষা করল। কিন্তু তার দেহটা প্রবল বাতাসে বৃক্ষপত্রের ন্যায় থরথর করে কাঁপতে লাগল। সে অবচেতন হয়ে কিছুক্ষণ দরজার মুখে পরে থাকল। কেউ দেখে ফেললে লজ্বার বিষয় হবে ভেবে উঠে বসল। দাড়াতে চাইল কিন্তু পারল না, শরীর থরথর করে কাঁপছে। তারপর পঙ্গু মানুষের মত কোমরটা হেঁচড়ে হেঁচড়ে বিছানার কাছে গেল, এক হাত মাটিতে ও এক হাত বিছানায় রেখে ভর দিয়ে উঠে শরীরটা বিছানায় ছেড়ে দিল।

নিজের প্রতি তার মায়া হল। না না, নিজের প্রতি নয়, একটা মানুষের প্রতি, যে মানুষটা মানুষের পৃথিবীতে এসেছিল মানুষ হয়ে, মানুষের মধ্যে থেকেছিল মানুষের মত কিন্তু মানুষের কাছ থেকে মানুষের অধিকার কোনদিন পায়নি, পেয়েছে শুধু লাঞ্চনা আর বঞ্চনা। এই পৃথিবীকে সে দিয়েছে বা দিতে চেয়েছে মুঠি মুঠি আজলা ভরে, নিজেকে উজার করে কিন্তু পৃথিবী আর পৃথিবীর মানুষ তাকে দিয়েছে শুধু লাঞ্চনা গঞ্চনা আর অশ্রু। সে পৃথিবীর হিংস্রতা ও নিষ্ঠুরতার শিকার। মানুষের হিংসা বিদ্বেষ আর অহংকারের জ্বালানি। নিজের প্রতি করুনায়, নিজের দুঃখে সে শুয়ে শুয়ে অনেক্ষণ কাঁদল। দু’চোখের কিনার বেয়ে কান ভরে ফোটা ফোটা নোনাজল বালিশে গড়িয়ে পরল।

শরীরটা একটু স্থির হল, উঠে একটা কিছু খেতে গেল। আজ তিন দিন পেটে কোন দানা পরেনি, শরীরটা অচল হয়ে পরলে দুয়েকটা বিস্কুট, দুয়েক গ্লাস পানি- বিগত কয়েকদিন ধরে এই ছিল তার খাদ্য তালিকা। চারটে ভাত খাওয়ার প্রয়োজনবোধ করল। চাল কিছু আছে কিন্তু খাওয়ার মত ডাল ডিম কিছুই নাই। অগত্যা বিস্কুট ও চানাচুরের বৈয়াম নিয়ে এসে খাটের উপর বসল। একটা বিস্কুট মুখে দিয়ে বুঝল সে কতটা নির্জীব হয়ে পরেছে, হয়ত পৃথিবীর পথে তার যাত্রার শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে। তার জ্বিবা বিস্কুটটা চিবানোর মত খাদ্যরস যোগান দিতে পারল না। এক ঢোক পানি মুখে নিয়ে তা গিলতে হল। এভাবে একটা করে বিস্কুট মুখে দিয়ে এক ঢোক করে পানি দিয়ে গিলে গিলে সে চারটে বিস্কুট খেল, তারপর জোর করে তিন গ্লাস পানি খেল। ব্যস, পেট ভর্তি, সে আশ্বস্ত হল, অনেক দিন পর আজিমুশ্বান একটা খাওয়া খেল। এবার শান্ত হয়ে চেয়ারে বসল আর সাথে সাথেই ফজরের আযান দিল। কিছুক্ষণ পর উঠে গিয়ে অযু করে নামায পড়ে ঘুমানোর জন্য বিছানায় শুয়ে পরল। স্ত্রীর কাপড়ের পুটুলিটা শিয়রে দিয়ে বাচ্চার পুটুলিটা বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর চেষ্টা করল। কিন্তু ঘুম হল না।

স্ত্রীর সাথে অতীতের স্মৃতিগুলি তার অন্ধকার ভবিষ্যতের আকাশে তারাদের মত মিটিমিটি জ্বলছে। স্ত্রীর সাথে তার প্রথম রাতের ঘটনাটাই বেশি বেশি মনে পরতে লাগল। গায়ে হাত দেয়ার সাথে সাথে তার বালিকা বধুটি কেঁদে উঠে বলেছিল, ‘আমার যা কিছু সব আপনাকে দিলাম’। সে কিছুক্ষণ বিছানায় পরে থেকে নিবিষ্ট মনে ভাবল। অন্ধকার দিগন্তে দেখতে পেল ক্ষীণ একটা আলোক শিখা। তার ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটে উঠল। কিন্তু দেখা করার তো সুযোগ নেই, বউ তো সামনে আসবে না, তাহলে এই দাবী তোলার উপায় কি? হঠাৎ তার মনে হল চিঠি লিখবে। সে চটজলদি উঠে খাতা কলম বের করে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে চিঠি লিখা শুরু করল-

প্রিয় জীবন সাথী, ফেরদৌসি। সম্ভবত তুমি সুখে স্বাচ্ছন্দে আছ কিন্তু তোমার জন্য আমি ভাল নেই। কারণ একটা উড়ো কথা আমার কানে উড়ে বেরাচ্ছে- যা আমার ঘুম হারাম করে দিয়েছে। তুমি নাকি আমাকে ত্যাগ করে এক হিন্দু নও মুসলিমকে বিয়ে করতে যাচ্ছ, তোমার সাথে যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু কোন কিনার না পেয়ে অবশেষে পত্র লিখতে বসলাম।

বন্ধু আমার, তোমাকে কয়েকটা কথা বলছি। আল্লাহ তা’লা একটা মহাপবিত্র বাধনে আমাদেরকে বেধেছেন, এখন আমাদের কারো খামখেয়ালিপনা, স্বেচ্ছাচারিতা ও পাপচিন্তায় সেই বাধন ছিন্ন করে একটা পরিবার ধ্বংস করার অধিকার আমাদের নেই। বিশেষত আমাদের একটা বাচ্চা আছে, এই বাচ্চাকে ইয়াতিম করার অধিকার তোমার আমার কারো নেই। কারণ এই মানব শিশু আল্লাহ্‌র তরফ থেকে আমাদের কাছে আমানত। এখন এই আমানতের অনিষ্ট করা মানে আল্লাহ্‌র দরবারে বিচারের মুখোমুখি হওয়া। তাছাড়া তোমার ও আমার জীবন সম্পর্কেও চিন্তা করা উচিত। কাজেই সাথী আমার, ‘চলে এসো। আমরা আগের মত আবার আমাদের সন্তানের হাত ধরে সংসারের পথে যাত্রা শুরু করি। আমার অতীত ভুলগুলির জন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি এবং আত্মসংশোধনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। আর তোমার ভুলগুলি আমি মার্জনা করলাম।

প্রিয়ে, এরপরেও যদি তোমার মনে পাপচিন্তা থাকে তাহলে তোমার আত্মশ্লাঘার বিষয়ে তোমাকে সচেতন করতে চাই। পার্থিব অপার্থিব উভয় শিক্ষায় শিক্ষিত তোমার স্বামী, এ যুগের প্রবাদতুল্য ব্যক্তিত্ব তোমার শ্বশুর, গর্ভধারিনী মায়ের মত তোমার শাশুড়ি- এই আমাদেরকে তুমি কোনদিন মানতে না, ডাকতে না, তোমার শ্লাঘায় বাধত। এখন প্রশ্নটা হল, এমন একটা পরিবার ত্যাগ করে তুমি একটা হিন্দু পরিবারে যেতে চাচ্ছ, সেখানে হিন্দু স্বামী শ্বশুর শাশুড়িকে তুমি কি করে মেনে নিবে, তোমার শ্লাঘায় বাধবে না? সাধারণ নিয়ম হল, নও মুসলিমদের সবাই ভালবাসে সহযোগিতা করে কিন্তু বিয়ের ক্ষেত্রে কোন আত্মসম্ভ্রমশীল পিতা মাথা বা নারী রাজি হয় না। এখানে তোমার শ্লাঘা কোথায় গেল, ওটা কি শুধু আমার জন্যই রিজার্ভ ছিল? কাজেই বন্ধু আমার, তোমাকে শুধু একটা অনুরোধ করছি, ধার্মিক মুসলিম মেয়েদের ললাটে তুমি এই কলঙ্ক তিলক এটে দিও না যে ,তারা খৎনার চেয়ে বেখৎনা বেশি পসন্দ করে।

সখি আমার, এরপরেও যদি পাপ চিন্তা তোমাকে ঘায়েল করতে আসে, তাহলে তোমাকে আসল বিষয়টা স্বরণ করিয়ে দিচ্ছি। ইসলামে নারীর উপর দু’ভাবে মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্রয় সূত্রে মানে বিয়ের মাধ্যমে। বিয়ের ইসলামী সংজ্ঞা হল, আন- নিকাহু মিলকুল বুজয়া, অর্থাৎ স্বামী মহরের বিনিময়ে স্ত্রীর গুপ্তাঙ্গের মালিক হয়ে যায়। আবার কোন মহিলা যদি মহর ব্যতীত নিজেকে কোন পুরুষের জন্য হেবা (দান) করে দেয়, তাহলে ঐ পুরুষ স্বামী হয়ে যাবে অর্থাৎ তার মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। কাজেই বন্ধু, তোমার উপরও আমার দুই প্রকারের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। প্রথম প্রকার হল বিয়ে বা মহরের মাধ্যমে। দ্বিতীয় প্রকার মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় আমাদের প্রথম বাসর রাত্রে। স্বরণ আছে, যখন আমি তোমার গায়ে হাত দিয়েছিলাম তখন তুমি কেঁদে উঠে বলেছিলে, ‘আমার যা কিছু সব আপনাকে দিলাম’ অর্থাৎ নিজেকে আমার জন্য হেবা- দান করেছিলে, আর আমিও সেই দান গ্রহণ করে তোমার সাথে মিলিত হয়েছিলাম। কাজেই তোমার উপর দুই প্রকারেই আমার মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হল। এখন তোমার দুলাভাইরা যদি জোরপুর্বক আমার থেকে তালাক নিয়েও যায় তখন আমার ক্রয় সূত্রের মালিকানা রহিত হয়ে যাবে বটে কিন্তু দান সূত্রের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত থাকবে। এখানে, ঠিক এইখানেই কথাটা। তালাকের পরেও যেহেতু তোমার উপর আমার মালিকানা প্রতিষ্ঠিত থাকবে বিধায় ঐ নওমুসলিমের সাথে তোমার বিয়ে হলেও তা শুদ্ধু হবে না, সংসার করলে তা যিনা বলে গণ্য হবে, সন্তান হলে তা হারামজাদা- জারজ বলে গণ্য হবে।

আবার হেবার মালিকানা ভঙ্গ করার নিয়ম নাই। রাসূল (সাঃ) এটাকে বমি করে পুনরায় চেটে খাওয়ার নামান্তর বলে ঘোষণা দিয়েছেন। কাজেই হেবা সূত্রে তোমার উপর আমার মালিকানা ভঙ্গের কোন উপায় নাই। অনন্তর, তোমার চৌদ্দ গোস্টি এসে যদি আমার গলায় ছুড়ি ধরে তবুও আমার এ মালিকানা আমি ত্যাগ করব না। কাজেই ঐ নওমুসলিমের সাথে তোমার বিয়ের কোন সম্ভাবনাই নাই। এখন তোমার জন্য একটাই মাত্র পথ খোলা আছে, যথা শীঘ্র আমার কাছে চলে আস। আমি দরজা খোলে তোমার পথপানে তাকিয়ে প্রতিক্ষার প্রহর গুনতে লাগলাম। এরপরেও যদি পাপচিন্তা তোমাকে ঘায়েল করে ফেলে, আমাকে ছেড়ে ঐ নওমুসলিমের ঘরে যাও, তাহলে তুমি বেশ্যা হয়ে গেলে। কাজেই বেশ্যা আওরাত, তোর বেশ্যাবৃত্তির কারণে এবং আমার মেয়েকে ইয়াতিম করার কারণে তোকে আল্লাহ্‌র আদালতের কাঠগড়ায় দাড়াতে হবে। সুতরাং শেষবার মিনতি করছি, আমি তোমার প্রতীক্ষায় দরজা খোলে বসে থাকলাম, চিঠি পাওয়ার সাথে সাথে চলে আসবে। ইতি

তোমার হতভাগ্য স্বামী- হাসান।

তাং- ২০/ ৭/ ২০০৬

লেখার পর সে চেয়ারে বসে বসে ভাবনায় ডুবে গেল। এ চিঠি পাওয়ার পর নিশ্চয়ই তার বউয়ের নতুন বাসর রচনার স্বপ্নসৌধ ভেঙ্গে পরবে। কারণ তখন সে বুঝবে অন্যকে বিয়ে করার মত তার কোন সুযোগই নাই। কাজেই স্বামী ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই। স্বামীর ঘরে না গেলে একুল ওকুল দু’কুলই হারাতে হবে। আর তখন বাওয়ানো ছাগীর মত ভ্যা ভ্যা করে বাসায় এসে হাজির হবে। হাসান উচ্ছসিত হয়ে উঠে, আবেগাপ্লুত হয়ে ঘরময় পায়চারি করে আর ভাবে, স্ত্রী আসলে সে কেমন আচরণ করবে। নিশ্চয় বউ এসে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পরে আকুল হয়ে কাঁদতে থাকবে, তখন সে বউকে অনেক আদর করবে, অনেক। তারপর বউ ঝগড়া করলেও সে কোন কথা বলবে না, বোবার কোন শত্রু নাই। সে কথা না বললে বউ বকবক করতে করতে এক সময় আপনিই ক্ষান্ত হয়ে যাবে। বউ তাকে লাথি মারার কথা বলেছিল, এবার যদি সত্যি সত্যি লাথি মারেও, তবুও কিছু বলবে না, সে বউকে ইচ্ছা স্বেচ্ছা ও কৃচ্ছা অনুযায়ী থাকতে দিবে। সে বরং তিন রুমের একটা বাসা নিয়ে এক রুমে নির্বাসন গ্রহণ করবে, শাশুড়িকে নিয়ে আসবে। এভাবেই সে তার ভাঙ্গা সংসারটিকে স্বপ্নে জোড়াতালি দিতে থাকে।

হাসান প্রসন্ন বদনে খাটের কিনারায় বসে চারটে ভাত খেতে বিবেকের তাড়না অনুভব করল। অনেক দিন ধরে ভাত খায় না, না খেতে খেতে তার ক্ষুধা মন্দা দেখা দিয়েছে। খাওয়া না খাওয়া উভয়টাই সমান, কখনো ক্ষুধা অনুভব করে না। কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য তো খেতে হবে। তার বাসার কাছেই হোটেল আছে, সে ভাত আনতে গেল। বিভিন্ন তরকারি দেখে ভাবল, মাছ গোশত বাদ দিয়ে বাঙালী তরকারি দিয়ে খাবে, তাতে হয়ত চারটে খেতে পারবে। শুটকি মাছের তরকারি ও টাকি মাছের ভর্তা নিয়ে এল। শুটকি দিয়ে মাখিয়ে লোকমা মুখে দিল কিন্তু উগলে আসল। তারপর ভর্তা দিয়ে মাখিয়ে মুখে দিল, প্রচন্ড ঝাল, চিবুতে পারল কিন্তু পানি দিয়ে গিলে কয়েক লোকমা খেয়ে ভাত তরকারিতে হাত ধুয়ে উঠে পরল।

কারো কাছে কোন মূল্যবান জিনিস থাকলে যেমন বারবার দেখে হাসানের অবস্থাও তাই হল। সে চিঠিটা বারবার পড়ছে উলটাচ্ছে, ভাজ করছে। কখনো জামার পকেটে রাখছে আবার বের করে এনে পড়ছে। এটা হল এখন তার শ্রেষ্ঠ সম্পদ। কারণ তার বিশ্বাস, এই চিঠি স্ত্রীকে তার ঘরে এনে দিবে। এভাবে মাদরাসার সময় হয়ে গেল এবং সে রওয়ানা করল। তাদের মাদরাসাতেই পোষ্ট অফিস আছে। সে চিঠিটা খামে ভরে ঠিকানা লিখল। আর স্ত্রীর উপর যে এখনো তার মালিকানা প্রতিষ্ঠিত আছে, থাকবে এবং স্ত্রী যে তারই- এটা বুঝানোর জন্য সে বউয়ের নামের সাথে নিজের নাম জুড়ে দিল। সে লিখল, প্রাপক- ফেরদৌসি হাসান। c/o- ইঞ্জিনিয়ার আব্দুর রউফ। পাট গুদাম, জামালপুর। কিন্তু প্রেরকের ঠিকানা লিখল না। তারপর চিঠিটা পোষ্ট করে দিল।

এই মাদরাসার প্রিন্সিপ্যাল মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন, বিখ্যাত ব্যক্তি, তিনি আগে ময়মনসিংহের একটি কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ ছিলেন। আর সেখানে থেকেই হাসান কামিল পাশ করেছিল। সেই সুবাদে তিনি হাসানের উস্তাদ বিধায় তুমি বলে সম্ভোদন করতেন। তিনি যহুরের পর মাদরাসায় এসে হাসানকে ডাকলেন। সে চশমাটা ভাল করে চোখে লাগিয়ে তার রুমে গিয়ে বসল। প্রিন্সিপ্যাল কয়েকজন শিক্ষকের সাথে আলাপ করলেন, তারপর অফিসিয়ালি কিছু কাজ করে অবসর হয়ে কাছের একটা চেয়ারের প্রতি ইঙ্গিত করে হাসানকে বললেন, ‘এখানে এসে বস’। হাসান কাছে গিয়ে বসল। তিনি নিম্নস্বরে ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘তোমার ভায়রা ইঞ্জিনিয়ার ও আরো কয়েকজন গতরাতে আমার কাছে গিয়েছিল। তারা আমাকে জোর করে ধরল তোমার কাছ থেকে তালাক নিয়ে দিতে। তাদের মেয়ের অন্যত্র বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, এখন তুমি তালাক দিলেই তারা বিয়ে দিয়ে দিতে পারে। তোমাকে দেন মোহরের টাকা দিতে হবে না, শুধু তালাক দিলেই হল। এখন আমি বলি, বিষয়টা সহজই আছে, ওরা যেহেতু দেন মহরের টাকা চাচ্ছে না, তাই তালাকটা দিয়ে দাও। তারপর তুমি ভাল দেখে অন্যত্র বিয়ে কর, এ মেয়ের যে বিবরণ শুনি- এটাকে নিয়ে তোমার আর ঘর করা চলে না।

হাসান দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘আমি তালাক দিব না, আমার বাচ্চা আছে না, বাচ্চাকে আমি মা হারা হতে দিব না। প্রিন্সিপ্যাল কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কিন্তু মেয়ে তো আসবে না তালাক না দিয়ে কি করবে, তুমি না দিলেও ওরা তো জোর করে তালাক নিয়ে নিবে, তোমাকে অপমান করবে। তুমি ওদের সাথে পারবে না’। হাসান বলল, ‘এ বিষয়ে আপনার সাথে আলাপ করতে হবে। তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, তাহলে সন্ধ্যার পর বাসায় এস’। তালাকের কথা শুনলেই হাসানের দেহটা অবশ হয়ে পরে, শরীরের প্রতিটা জোড়া যেন খোলে যায়। সে অধ্যক্ষের রুম থেকে বেরিয়ে টলতে টলতে বাসার দিকে রওয়ানা করল। পা যেন শরীরের বোঝা বইতে পারছে না, মাতালের মত পা টেনে টেনে হাটছে, শরীরটা দুলছে, কাধ দু’টি নীচে ঝুকে পরেছে। হাটার সময় মানুষের হাত নড়ে কিন্তু তার হাত স্থবির। একহারা হয়ে হাটছে।

মুকাদ্দস উস্তাদকে দেখল মাদরাসার গেইট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। সে তাকে ধরার জন্য লম্বা পদপেক্ষে দ্রুত হাটতে লাগল। উস্তাদের কাছাকাছি গিয়ে পিছন থেকে সালাম দিল। হাসান পিছন ফিরে সালামের উত্তর দিল। ছেলেটা তার সামনে এসে মাথা নিচু করে মুখ কাচুমাচু করে জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার কিছু চিন্তা ভাবনা করলেন? হাসানের মেজাজ এমনিতেই খিচড়ে ছিল। সে কোন চিন্তা ভাবনা না করেই রাগত স্বরে বলে উঠল, ‘আরে তুমি একটা আস্ত পাগল, যাও, আমাকে বিরক্ত করো না’ বলে সে আবার হাটতে শুরু করল। সহসা ছেলেটার উজ্বল মুখে যেন কেউ পাতিলের তলা মুছে দিল, লজ্বায় লাল হয়ে দাঁড়িয়ে উস্তাদের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল, উস্তাদের সম্মানে তার দুরাবস্থা দেখে দয়া পরবশ হয়ে তাকে এমন একটা মেয়ে দিতে চাইলাম যার জন্য তার চেয়ে ভাল ভাল পাত্র দৈনিক কয়েকটা করে আসে। অথচ সে আমাকে অপমান করল। আসলে লোকটা পাগল হয়ে গেছে, এর কপালে না জানি কত শাস্তি অপেক্ষা করছে। ছেলেটা বুঝতে পারছে না উস্তাদের প্রতি করুণা করবে নাকি অবজ্ঞা করবে। সে ভাবতে ভাবতে মাদরাসায় চলে গেল।

প্রথমে বউ পসন্দ হয়নি, ভালবাসতে পারেনি, এমনকি স্ত্রীর মৃত্যু পর্যন্ত কামনা করেছে। তারপর শুরু হয় ভালবাসার সাধনা। আর এই সাধনার ফল হল তার কলিজায় স্ত্রীর প্রেম সিঞ্চিত হয়ে গেছে। দু’টি মন বিক্রিয়া হয়ে এক হয়ে গেছে, দু’টি দেহ দ্রবীভূত হয়ে একাকার হয়ে গেছে। সে স্ত্রীর ভালবাসার সরোবরে হারিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে চিরতরে। কিন্তু স্ত্রীর মুখরাপনা অত্যাচার নির্যাতনের কারণে এতদিন তা প্রকাশ পায়নি। এখন সে বুঝতে পারছে- স্ত্রীকে ছাড়া সে জীবন কল্পনা করতে পারে না। সে বেঁচে থাকবে আর তার স্ত্রী অন্যের শয্যাসঙ্গি হবে, অন্যের মনোরঞ্জন করবে, অন্যের ভ্রুন গর্ভে ধারণ করবে এটা অসম্ভব, অকল্পনীয়। এটা ভূমণ্ডল আর নভোমণ্ডল উলট পালট হয়ে যাওয়ার মত ব্যাপার, এটা তার কাছে মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ। সে বেঁচে থাকতে এ বিয়ে হতে পারে না, একমাত্র তার মৃত্যুর পরই এটা হওয়া সম্ভব। কাজেই মরতে হবে, কাউকে না কাউকে মরতে হবে। হয় তাকেই মরতে হবে, নয় তো ঐ শালা হিন্দুর বাচ্চা হিন্দু- যে দুনিয়া শুদ্ধু মেয়ে না পেয়ে তার বউটাকে নিয়ে টানাটানি শুরু করেছে, তার ঘর ভাঙ্গতে উঠে পরে লেগেছে। অথবা মরতে হবে সেই বেশ্যাটাকে- যে স্বার্থের টানে একজনের কোল থেকে আরেক জনের কোলে চড়ে বেড়ায়।

কিন্তু এসব কথা তো প্রিন্সিপালকে বলা যাবে না, তাকে গিয়ে কি বলবে? হ্যাঁ তাকে মেয়ের দোহাই দিয়ে ক্ষান্ত করে দেয়া যাবে। এসব চিন্তা করতে করতে সে মাগরিবের পর প্রিন্সিপালের বাসায় গিয়ে হাজির হল। কিছুক্ষণ পর তিনি কয়েকটা মিষ্টি নিয়ে এসে স্থির হয়ে বসলেন। হাসান স্ত্রীর সাথে এবং শ্বশুর পরিবারের সাথে এ যাবৎ যা কিছু ঘটেছে সংক্ষেপে বর্ণনা দিল। প্রিন্সিপাল একটি বিষয়ের উপর জোর দিল, ‘তোমার বউই তো আসবে না, অন্যত্র তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। বিষয়টা যদি এমন হতো যে, তোমার বউ রাজি অন্যরা রাজি নয় তখন হয়ত একটা সুরাহা করতে পারতাম। কিন্তু যেখানে বউই রাজি না সেখানে তালাক ছাড়া উপায় কি? তাছাড়া ওরা লোক হিসাবে ভাল নয়, বক ধার্মিক, একটা মনগড়া ইসলাম বানিয়ে নিয়েছে। তুমি তালাক না দিলে তো ওরা ছাড়বে না, হয়ত জোর করে তালাক নিবে, অপমান করবে। তার চেয়ে ভাল হবে, তুমি তালাক দিয়ে দাও, আমরা তোমাকে দেখে শুনে ভাল দেখে আরেকটা বিয়ে করাই। হাসানও একটা বিষয়ের উপর জোর দিল, যাই কিছু হউক আর ঘটুক কোন অবস্থাতেই সে তার মেয়েকে মা হারা হতে দিবে না। কিন্তু সে নিজেও যে বউ হারা হতে চায় না- সেটা বেমালুম চেপে গেল।

অবশেষে প্রিন্সিপাল বলল, ‘তাহলে তুমি কি করতে চাও, এটা কিভাবে মীমাংসা করবে? সে বলল, ‘আমি সালিশ ডাকব, আমার আত্মীয়-স্বজন আছে, পীর সাব আছে, আপনারা আছেন, সবাই বসবেন দেখবেন, উভয় পক্ষের কথা শুনবেন। তখন আমার যদি কোন দোষ পান, শালিস যদি তালাকের সিদ্ধান্ত দেয়, ব্যস তাহলে আমি তালাক দিয়ে দিব, টু শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করব না। তিনি বললেন, তুমি সালিশ ডাকবে কেমনে, ওরা তো বসবে না। তাদের কথা বার্তায় বুঝলাম, তালাক ছাড়া তারা আর কিছু শুনতে রাজি নয়। তারপর কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে চিন্তা করে বললেন, ‘হ্যাঁ তুমি একটা কাজ করতে পার, বালিয়ার পীর সাবকে নিয়ে আসতে পার, তিনি সকলের মুরুব্বী, তার কথা হয়ত মানলে মানতেও পারে। এখন এই একটি মাত্র পথ তোমার জন্য খোলা আছে। অবশেষে এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে সে যখন উঠল তখন রাত দশটা বাজে।

ডুবন্ত ব্যক্তি খড় কুটো পেলে যেমন জীবনের আশা খুঁজে পায়, হাসানও কোন আশার আলো খুঁজে বেড়ায়। বিসিকের নিকট দিয়ে আসার সময় হঠাৎ তার মনে হল ইঞ্জিনিয়ারের ঐ বন্ধুকে তো সে দরবারের তারিখ আনতে বলেছিল, যদি সে কোন কিছু করে থাকে। আশার আলোর সন্ধানে সে তার বাসায় গিয়ে উপস্থিত হল। লোকটা এসে সেই আগের ভঙ্গিমায় হাটুর উপর পা তুলে, দুই হাত মাথার পিছনে ঠেকিয়ে চেয়ারে ঢেস দিয়ে বসে একথা বুঝাতে চাইল যে, হাসানের মত শিক্ষিত ব্যক্তি তার মত অশিক্ষিতের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, সে কত উচ্চ মর্যাদাশীল ব্যক্তিত্ব।

হাসান ভূমিকা না করে সরাসরি বলল, আপনাকে দরবারের তারিখের কথা বলেছিলাম কিছু করলেন? লোকটা সোজা হয়ে বসে বলল, শুনেন আপনি তো দরবার ডাকতে চাচ্ছেন আপনার বউ কি কি অন্যায় করেছে মানুষকে জানাবেন। ঠিক আছে, ইঞ্জিনিয়ার সাব বলেছে, আপনি দরবার ডাকুন আমরা মাইক টানিয়ে দিব, তখন আপনি ও আপনার বউ মনের মত বলতে পারবেন কে কেমন অন্যায় করেছে। আর সারা জামালপুরবাসী শুনতে পাবে। তারপর কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে থেকে ভারিক্বি গলায় বলল, ‘শুনেন এসব দরবার টরবার করে কোন লাভ নাই, শেষমেস অপমানিত হয়ে জামালপুর ছাড়তে হবে। আপনি বিদেশী মানুষ বাড়াবাড়ি না করে তালাকটা দিয়ে দেন। আপনার তালাকের অপেক্ষায়, নচেৎ কবেই মেয়েটার বিয়ে হয়ে যেত।

হাসান বুঝল, এই মূর্খের সাথে আলাপ করে লাভ নেই। তাই সে নিজের অভিব্যক্তি জানাল, ‘তাহলে বুঝা যাচ্ছে তারা দরবারে বসবে না এজন্য যে, আমার স্ত্রী যেসব অন্যায় করেছে সেগুলি অন্যদের সামনে প্রকাশ পেয়ে যাবে। অর্থাৎ তাদের অভিপ্সা হল স্ত্রী আমাকে মারবে, কাটবে, বাটবে, ছিলবে যা খুশি তাই করবে ,আমি বিচারও চাইতে পারব না, নালিশও করতে পারব না, ক্রীতদাসের মত নীরবে সহ্য করতে হবে। আবার ইঞ্জিনিয়ার ও তার বউ আমার উপর যা খুশি তাই করবে আমি অন্যদের জানাতেও পারব না, নালিশও করতে পারব না। এজন্যই তারা সালিশিতে বসবে না, কোরআনের বিধান মানবে না। আর তাই যদি হয়, তাহলে কাবার রবের শপথ লিখে রাখুন, স্বরণ রাখুন আমার প্রফেসি, যদি তালাক হয়ে যায় আর তার অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায় তাহলে এরপরই এ মেয়েটার ভাগ্যে নেমে আসবে অমানিশার অন্ধকার, এর কান্নায় বৃক্ষপত্র ঝড়ে পরবে, রাস্তার কুকুর পর্যন্ত ভেউ ভেউ করে কাঁদবে। আর সে হবে অনাগত মহাকালে পৃথিবীর কলংকিত নারীদের প্রবাদ। যুগে যুগে মানুষ নষ্টা- ভ্রষ্টা নারীদেরকে ওর সাথে তুলনা করবে, উপমা দিবে’ বলে হাসান লম্বা পদক্ষেপে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

বিষয়: সাহিত্য

১২২১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File