চিঠি (কবর)-৬১ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১১:৩১:৩৯ সকাল
দিনমান অস্ত যাচ্ছে, মহামার্তন্ড দিগন্তে উদিত হয়ে নিজের হাইড্রোজেন ফুয়েল পুড়িয়ে পুড়িয়ে মধ্য গগনে এসে সমগ্র ভূপৃষ্ঠে ছড়িয়ে দেয় তার আলোক রশ্মি, তৈরি করে দেয় জীব জগত, প্রাণী জগত ও উদ্ভিদ জগতের খাদ্যোপাদান। অনুজীব পর্যন্ত সকল প্রাণীর জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় তাপ ও আলো বিতরণ করে। সে নিজেকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে এ বাস্তুজগতকে একদিনের আয়ু দান করে ক্রমে ক্রমে নিস্তেজ হতে থাকে, পৃথিবীকে দেয়ার পুঁজি নিঃশেষ হয়ে আসে, অন্যের তরে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য হয়ে সেই দুর্দন্ড প্রতাপ দিবাদুতের ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, অবসন্ন দেহটি হারিয়ে যায় যবনিকার আড়ালে। হাসান ভাবে, ক্লান্ত পরিশ্রান্ত সৈনিকের মত অস্তাচলগামী এই সুর্যটির সাথে আমার কত মিল। আমি প্রতিদিন একটা বটবৃক্ষের ছায়ায় খেলা করতাম। হাসতাম, খেলতাম, গাইতাম, একদিন হঠাৎ অনুভব করলাম বটবৃক্ষটি আর নেই। তখন নিজের জন্য আশ্রয় খোজব কিনা বুঝে উঠার আগেই আন্ডা বাচ্চা আটটা ইয়াতিম বেঁচে থাকার তাগিদে অক্টোপাসের অষ্ট ডানায় আমাকে আষ্টে পৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। তখন নিজেই হলাম বটবৃক্ষ। ধীরে ধীরে হয়ে উঠলাম মহিরুহ, ধারন করলাম শাখা প্রশাখা, পক্ষের বিস্তার ঘটালাম। মেঘলোকে শির তুলে পত্রপল্লবের ডানায় তাদেরকে জড়িয়ে ঝঞ্জাবিক্ষুদ্ধ পৃথিবীর লু-হাওয়া থেকে নিরাপদ রাখলাম, জীবন ধারনের প্রয়োজনীয় আলো- ছায়া, বাতাস ও অক্সিজেন সরবরাহ করলাম।
ঐ সুর্যের ন্যায় যৌবনের মধ্য গগনে উদিত হয়ে ফুয়েলের মত নিজেকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে একটি পরিবার, একটি সংসারকে যোগান দিয়েছি জীবনের জীবনোপকরন, বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় আলো ও তাপ। কিন্তু না, এখন আর আমাকে ওদের প্রয়োজন নাই, ওরা এখন আর আন্ডা বাচ্চা নয়। তারা এখন মাঠ-ঘাট, বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত, গিরি-দরি, উপাত্যকা, মরু-মরুদ্যান দাবড়ে বেড়ায়, তারা এখন পৃথিবীর দক্ষ শিকারী, আর আমাকে ওদের প্রয়োজন নাই। আমার কোন ঘরও নাই, আশ্রয় নাই। কাজেই আমার উপযোগিতা নিঃশেষ হয়ে এসেছে, আমার ফুয়েল ফুরিয়ে গেছে। ঐ মহামার্তন্ডের ন্যায় এবার বুঝি আমারও নিঃস্ব সর্বহারা হয়ে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত অবসন্ন দেহে অস্তাচলে চলে যাওয়ার সময় আসন্ন। এ পৃথিবীতে যখন যার উপযোগিতা নিঃশেষ হয়ে গেছে তাকেই চলে যেতে হয়েছে। এমনকি রাসূল (সাঃ) কেও তাওহীদের দাওয়াত পূর্ণ করার পরে চলে যেতে হয়েছে। আমারও উপযোগিতা নিঃশেষ হয়ে গেছে। আমাকে অবলম্বন করার, উপলক্ষ করার পৃথিবীতে আর কেউ নেই। দরজার পাশে, জানালার ধারে আর কেউ আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে না, কোন মন প্রতিক্ষার প্রহর গুনবে না, কোন চোখ আমার স্বরণে কাঁদবে না। এই পৃথিবীতে আমি আর কারো নয়, কেউ আমার নয়। এখন আমার হারিয়ে যাওয়ার সময় হয়েছে, আমিও হারিয়ে যাব দূর অচেনায়, জানি কেউ মনে রাখবে না আমায়, চির চেনা এই প্রাণের মেলায়। সেই জীব জগতের পয়দায়েশ থেকে যে খেলা শুরু হয়েছিল তা চলছে আজো অবিক্রিত অবিরত।
ঐ দূর দিগন্তে ঝাকে ঝাকে পাখিরা কিচির মিচির রব তুলে উড়ে যাচ্ছে। উড়ে যাচ্ছে তারা আপন নীড়ে। যেখানে পঙ্খি- পঙ্খিনী এক্ত্র হবে, এঁকে অন্যের বুকে চঞ্চু বুলিয়ে বুলিয়ে পরস্পরকে জানাবে নিঃসীম ভালবাসার অন্তহীন আবেগ। বাচ্চাদের গায়ে ঠোঁট বুলিয়ে স্নেহ ও বাৎসল্যের পরশ জাগিয়ে তুলবে। তারপর এঁকে অন্যের গলায় গলা লাগিয়ে ঘুমিয়ে থাকবে। পরদিন আবার খাদ্যের সন্ধানে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পরবে। আবার এই যে জীবন বৃত্তে আবর্তিত মানুষ ছুটছে, উর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে, ঝাপিয়ে পরছে পৃথিবীর রণাঙ্গনে। বৈধ অবৈধের সীমানা পেরিয়ে, অন্যের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে, মজলুমের গর্দানে পা রেখে তার শেষ সম্বলটি হাতিয়ে নিয়ে, অন্যের ভাণ্ডার লুট করে নিজের ঝুলনাটা পূর্ণ করে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে তারা আপন আলয়ে। রণক্লান্ত, ঘর্মাক্ত, সিক্ত বসন ভূষণ, গায়ে বোটকা গন্ধ কিন্তু তার মুখ খুশির আভায় চকচক করছে। কারণ কেউ তার পথ পানে তাকিয়ে আছে, সে পৌছতেই যার খুশির বান ডেকে যায়। একজন বরফ শুভ্র দাঁতে ভুবন মাতানো হাসি দিয়ে এগিয়ে আসে। ভালবাসার পরশ বুলিয়ে তার জামা কাপড় খুলে দেয়, ওয়াশরুমে গেলে গামছা এগিয়ে দেয়, চেয়ারে বসলে গরম- ঠাণ্ডা একটা কিছু খেতে দেয়। কিচিরমিচিরেরা তার চারপাশ ঘিরে তাকে মাতিয়ে তুলে। তার মাথা ধরে না বরং বিমুর্ত সঙ্গিতের মুর্ছনায় তার হৃদয় তন্ত্রিরা ঝংকার দিয়ে উঠে। তারপর কিচিরমিচিরের দল ঘুমিয়ে পরে। গভীর রাতে কারো মায়াবি পরশ তার ক্লান্ত দেহটি সজিব করে তোলে। গোলাপ রাঙা ওষ্ঠাধর চেপে বসে তার কপোল দেশে, নিঃশ্বাস গরম হয়, কাছাকাছি হয়, এক হয়, একাকার হয়ে যায়, তারা পৌঁছে যায় শারীর বৃত্তিয় অপার্থিব পবিত্রতার কোন স্বপ্নময় ভুবনে।
কিন্তু আমি? আমি তো শুধু হাটছি, হাটছি আমি যুগ যুগ ধরে একটি নদীর সৈকত ধরে। এ নদীটার নাম জীবন নদী। কত যুগ যুগান্তর কেটে গেছে আমি হেটে চলেছি কিন্তু তীরের নাগাল পেলাম না। হঠাৎ অনুভব করলাম অনন্ত বালুকারাশি আমার দু’পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। আমি বাঁচার জন্য যতই আকুলি বিকুলি করছি আমার পা ততই জড়িয়ে যাচ্ছে। শত চেষ্টার পর যখন গলা পর্যন্ত ডুবে গেল তখন বুঝলাম আমি জীবন নদীর চোরাবালিতে আটকে গেছি। দলে দলে মানুষ আনাগুনা করছে, পৃথিবীর পথে হেটে যাচ্ছে অগনিত পথিক। আমি দু’হাত প্রসারিত করলাম, ডাকলাম, চিৎকার করলাম, মাতম করলাম। কিন্তু কেউ এগিয়ে এল না। মানুষের দোয়ারে দোয়ারে হানা দিলাম, মানবতার দোয়ারে করাঘাত করলাম কিন্তু কেউ আমাকে বাঁচাতে এগিয়ে এল না। আমার হাতটি ধরে কেউ বলল না, ‘মানুষ মানুষের জন্য জীবন জীবনের জন্য’। আমি তলিয়ে যাচ্ছি, আমি হারিয়ে যাচ্ছি, হারিয়ে যাচ্ছি আমি আরেক পৃথিবীতে। জামালপুর শহরের পশ্চিম প্রান্তে উত্তর-দক্ষিনা একটা খাল প্রবাহমান। হাসান এসব চিন্তা করতে করতে খাল পাড়ে পৌঁছে গেল। হাটতে হাটতে একটা নির্জন জায়গায় পৌছল। সেখানে কোন জন- মানব নেই, নেই কোন বসতি, নীরব প্রান্তর। সে খালের পাড়ে মাটির উপর বসে পরল, হাটু খাড়া করে তার উপর দুবাহু জড়িয়ে মাথা পেতে বসল। তারপর চিন্তায় ডুবে গেল, স্ত্রীর সাথে তার স্মৃতিগুলি একটার পর একটা চোখের সামনে ভেসে উঠল।
প্রথম রাত, বাসর রাত। সে বসে আছে, সামনে তার বালিকাবধু চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। সে গায়ে হাত রাখল আর অমনি নববধু আকুল হয়ে কেঁদে উঠল। তারপর বলল, আমার যা কিছু সব আপনাকে দিলাম। সে বসে আছে, বসে আছে চেতনা- নিসিক্ত হয়ে। নিজেকে মনে হল অ্যাকিলিস, ঘাতক অ্যাকিলিস- যে কোমরে হাত দিয়ে বীরদর্পে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আছে। আর তারই সামনে হেক্টর, মহাবির হেক্টরের রক্তাক্ত দেহটি ধুলির ধরায় মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। কেন এমনটা মনে হয়েছিল সে জানে না। তবে হতে পারে এ জন্য যে, সে ঘাতক অ্যাকিলিসের মত বসে আছে, আর তার স্ত্রী পরাজিত সৈনিকের মত বা ভীতা হরিণীর মত নিরুপায় হয়ে নিজের দেহটি তাকে নিবেদন করছে। তখন স্ত্রী সম্পর্কে তার যতটা সন্দেহ জাগল তার কান্নায় ততোধিক মমতায় স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরল, সে কাত হয়ে শুয়ে স্ত্রীর পিঠের পিছনে হাত দিয়ে কাঁধে ধরে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরল। নতুন আনকোরা দু’টি ঠোঁট, দু’টি গণ্ড, অনেক আদর দিয়েছিল, অনেক অনেক আদর।
বিয়ের কিছুদিন পর শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে গেল। ফেরদৌসি সেখানে কিছুদিন থাকল, সে দুয়েকদিন পর পর মাদরাসা করে চলে যেত। একদিন কোন কারণে তার মেজাজ বিগড়ে ছিল, বিপর্যন্ত অবস্থা, বিষণ্ণ মন নিয়ে শ্বশুর বাড়ি গিয়ে হাজির হল। প্রথম পর্যায়ে তার বউ পসন্দ ছিল না, স্ত্রীকে সহ্য করতে পারত না। মাগরিবের পর সে চিন্তাক্লিষ্ট হয়ে বসে আছে আর স্ত্রী এসে তার সাথে মনোরঞ্জন করতে চাইছে, গায়ে হাত বুলাচ্ছে, মাথায় হাত বুলাচ্ছে, জড়িয়ে ধরছে। কিন্তু তার অসহ্য লাগছে, সে বারবার বলছে, যাও যাও, এ সব আমার ভাল লাগছে না। তার বউটি ছিল বোকা, স্বামীর মানসিক অবস্থা বুঝত না বা বুঝতে চাইত না। সে দস্তুর মত ঢলাঢলি মাখামাখি চালিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ তার রাগ উঠে গেল, আর স্ত্রীকে এমন এক কথা বলে বসল যা কোন ভদ্র স্বামী স্ত্রীকে কোনদিন বলে না, বলতে পারে না। এ কথাটার জন্য সে বহুবার স্ত্রীর হাত ধরে ক্ষমা চেয়েছে। যতবার এ কথাটা তার স্বরণ হয়েছে লজ্বায় মিইয়ে পরেছে। স্ত্রী তার কাঁধে মাথা রেখে দু’হাতে গলা জড়িয়ে আছে। সহসা সে বলে উঠল, ‘আরে যাও, সর, বিশ টাকায় তোমার মত মেয়ে রাস্তা ঘাটে ভুরি ভুরি পাওয়া যায়’। সে স্বামীর কাধ থেকে আস্তে আস্তে মাথা তুলল, হাত ছাড়িয়ে আনল, তারপর হাটু খাড়া করে স্বামীর পিঠের সাথে পিঠ লাগিয়ে বসে কাঁদতে লাগল, কান্না চলতে লাগল। সেদিন তার বালিকা বধুটি তারই পাশে বসে এক ঘণ্টা পর্যন্ত কেঁদেছিল। এক ঘন্টা পর তার মানসিক অবস্থা স্থিতি লাভ করল। তখন স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরল আর তার নববধুটি বিনা অভিমানে, বিনা বাক্য ব্যয়ে কাংখিত প্রত্যাশার ন্যায় নিজেকে স্বামীর বুকে সমর্পণ করল।
আর সাথে সাথে হাসান ডুকরে কেঁদে উঠে প্রলাপ বকতে লাগল, ‘আর কেউ আমার পাশে বসে আমার একটু আদর, একটু সোহাগের জন্য কাঁদবে না। আমি বকলে, মারলে, কাটলেও আর কেউ বিনা অভিমানে, খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠা চাঁদের মত মুখখানা আমার বুকে পেতে দিবে না, আর কেউ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে না’। সে প্রলাপ বকছে আর কাঁদছে। কাঁদছে সর্বরিক্ত, সর্বহারার মত, মেয়েদের মত রাগিনী টেনে টেনে কাঁদছে। সেই কান্না বড়ই হৃদয়বিদারক, মর্মভেদি, সে কান্না অন্যের চোখেও আশুর ঢল নামায়।
খালের তীরে রাত্রি নেমেছে কৃষ্ণ- ঘন আল্পনার রঙ্গে। কৃষ কালো অন্ধকার পৃথিবী ঢেকে ফেলেছে। নিশাচরেরা গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে তাদের জীবিকার সন্ধানে। খালের তীরে নির্জন প্রান্তরে ঘন তমসার ঘেরাটোপে বসে বসে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যহত যুবকটি নিজের অতীত মধুময় স্মৃতিগুলি মন্থন করে ফিরছে। তার মনে পরে, বাড়ি গিয়ে তার বউ পুকুরে গোসল করত, সে পাড়ে দাঁড়িয়ে পাহারা দিত। বউ বুক পানিতে নেমে গায়ের জামা খুলে শরীর মাজত আর তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে শিশির শুভ্র দাঁতে অপ্সরীর মত হাসত, তাকে পাগল করে তুলত। গোসল সেরে ঘাটে এসে দাঁড়িয়ে থাকত আর দুষ্টুমি নিয়ে মিটিমিটি হাসত। সে এসে স্ত্রীর গৌরাঙ্গে কাপড় পরিয়ে দিত আর খুনসুটি করত- যে খুনসুটি পৃথিবীর খুব কম স্বামী স্ত্রীই করে থাকে।
তার মনে পরে, ঢাকার উত্তরায় একটি বাসা। সে সোফায় বসে আছে, একজন একটা আদর্শ নারী পত্রিকা হাতে দরজা দিয়ে ঢুকল। তার দিকে একটা অপাংক্তেয় দৃষ্টি মেরে পত্রিকাটা বিছানায় ছোড়ে মারল। তারপর খাটে লাফিয়ে উঠে উপোর হয়ে শুয়ে কান্না জুড়ে দিল, আমাকে ভালবাসে না, মনের টান নাই, এতদিন ধরে ফেলে রেখেছে ইত্যাদি বকবকানি চলতে থাকল। সে উঠে দরজা বন্ধ করে খাটে উঠে গেল। তার নববধু উপোর হয়ে শুয়ে আছে। তার বুক স্ত্রীর চওড়া পিঠে চাপল, ডান হাতে চিবুক ধরে গোলাপের পাপড়ির মত তাজা লাবন্যময় ফর্সা দু’টি কপোল চুমিয়ে চুমিয়ে লাল করে তুলল। এ রাতটি ছিল তার বিনিদ্র রজনি। দীর্ঘ একমাস পর সাক্ষাৎ। স্ত্রীকে সে দেখেছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী স্বর্গের অপ্সরীর মত। স্ত্রীর ঘুমন্ত দেহটি সামনে নিয়ে সে বকের মত সারা রাত বসে বসে তপস্যা করেছে। উর্বশি যৌবনা স্ত্রীর রূপ যৌবন বারবার তাকে টালমাটাল করে তুলেছে, আর বারবার সে বুভুক্ষু সিংহের ন্যায় স্ত্রীর ঘুমন্ত দেহটির উপর আচড়ে পরেছে। সর্বোপরি এ রাতটিই ছিল তার জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত। এ রাতেই সে জানতে পেরেছিল তারই অস্তিত্ব থেকে আরেকটি অস্তিত্ব আসছে পৃথিবীতে। আসছে তার সন্তান, তার মুনীরা, ইহলোকে তার জন্ম স্বার্থক। আজ এসবই তার কাছে স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন, দুরাশা।
খালের পাড়, তার বুকে কলকল রবে ঘোলা জলের ধারা ছুটছে, এ বিশাল জলরাশি মহাগর্জনশীল কোন মহাসমুদ্রের সঙ্গমে ধেয়ে যাচ্ছে। তারই কিনারে বসে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখি, সবচেয়ে বদবখত এক যুবক, হাটু খাড়া করে দু’হাতে পেছিয়ে তার উপর মাথা স্থাপন করে সে হারান্ত স্ত্রীর তপস্যায় বসেছে। তার জ্বালাময় দু’টি চোখ থেকে কাল নোনা জলের দু’টি নদীর ধারা ছুটছে, সে ধারা শব্দহীন, ছন্দহীন, সেধারা পৃথিবীর কোন সাগর- মহাসাগরে মিলিত হয় না। সে ধারা পৌঁছে যায় ঐ শব্দাতিত নক্ষত্র লোক পেরিয়ে উর্ধ্বে, আরো উর্ধ্বে, নিঃসীম কোণ জগতে, যেখানে পৃথিবীর সকল আহ, সকল আর্তনাদ, সকল যন্ত্রণা, সকল আশু আশ্রয় গ্রহণ করে।
হাসান হাটুতে মাথা স্থাপন করে স্ত্রীর সাথে তার স্মৃতির পৃষ্ঠাগুলি একটার পর একটা উল্টিয়ে যাচ্ছে আর বিষাদের সিন্দুতে তলিয়ে যাচ্ছে। তার মনে পরে, সে বাড়ি থেকে আসলে স্ত্রীর চেহারা উচ্ছসিত হয়ে উঠত, তার মুখে খুশির আভা ছড়িয়ে পরত। বাহির থেকে এলে দরজা খোলেই একটা হাসি উপহার দিত- যে হাসিতে মুক্তা ঝড়ে পরত। অনেক রাতে বাসায় ফিরলে দরজা খোলেই রাগে বিছানায় শুয়ে পরত, অভিমান করত, রাগ করত কখনো কাঁদত। তখন তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে অনেক আদর দিয়ে, সোহাগ দিয়ে মানভঞ্জন করতে হত। এভাবে সে একটার পর একটা স্মৃতির মালা গাঁথতে থাকে।
রাত গভীর হয়ে যায়, প্রায় মধ্যরাত, খালের কিনারে ঘোর অন্ধকার গাঢ় হয়ে উঠে, হাতের তালু দেখা যায় না, দুয়েকটা খেচর ভীতিকর রব তুলে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। নিশাচরেরা বেরিয়ে এসেছে খাদ্যের সন্ধানে, হাসান একবার চকিতে বাম দিকে তাকাল, অবাক হল কিন্তু ভয় পেল না। অসংখ্য জোড়া পকেট টর্চ তার দিকে আলো ফেলছে, ঝকঝক করছে, তিনটি স্থানে তিনটি দল। একেকটা দলে বিশ- ত্রিশ জোড়া টর্চ তাকে ফলো করছে। অন্য সময় হলে ভয়ে হয় পরিমরি দৌড় লাগাত, না হয় ভুত ভুত বলে ডাক চিৎকার শুরু করে দিত। কিন্তু তখন তার সেই মানসিক অবস্থা ছিল না, তার অনুভূতি তখন বিকল হয়ে পরেছে। সে শুধু হুস করে একটু শব্দ করল এমনি সেগুলি পিছন ফিরে পলায়ন করল। আসলে এগুলি ছিল শিয়ালের তিনটি ঝাক আর ওদের চোখগুলি টর্চের মত চকচক করছিল। ওরা হাসানকে দেখে মানব নাকি দানব শনাক্ত করার চেষ্টা করছিল বা ভয় পাচ্ছিল বা আক্রমণের পরামর্শ করছিল
হাসান আবার চিন্তায় ডুব দিল, আর তখনই তার মনে পরল সেই অবিস্মরণীয় ঘটনাটা। আলট্রাসনো করা হল, ডাক্তার ডেলিভাবির ডেট দিল সাড়ে নয় মাসের মাথায়। তখন সাড়ে আট চলছে, সে বাড়িতে গেল। পাঁচদিন পর বাড়ি থেকে ফিরল। দিনটি ছিল সোমবার, ১০ মে, ২০০৪ সাল। শুক্রবারের পর এদিনটিই ছিল তার সবচেয়ে পসন্দনীয়। কারণ এদিনটি রাসূল (সাঃ) এর জন্ম ও মৃত্যু দিবস। সে ইঞ্জিনিয়ারের বাসায় গিয়ে দরজায় টোকা দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল, বরাবরের মত তার বউ এসে উচ্ছসিত হাসি দিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানাবে কিন্তু নিরাশ হল। অথচ বউয়ের গলা শুনা যাচ্ছে, ক্ষীণ কণ্ঠে কি জানি বলছে বোঝা যাচ্ছে না। সে বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। ক্ষনেক পর ইঞ্জনিয়ারের দ্বিতীয় মেয়েটা এসে অন্য সময়ের মত ফাজলামোর সুরে বলল, ‘খালু আপনার ঘরে ঢোকতে মানা। আগে মিষ্টি নিয়ে আসেন, তারপর ঘরে ঢুকতে পারবেন’। হাসানের দেহমন শিহরিত হয়, কী জানি একটা খুশির সংবাদ কিন্তু এখনো তো সময় হয়নি, আরো একমাস বাকী। সে ভ্যাবাচেকা খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।
তখন তার শাশুড়ি এসে বলল, তোমার মেয়ে হয়েছে, কিছু মিষ্টি নিয়ে আস গিয়ে। হাসান ‘আল- হামদুলিল্লাহ’ বলে স্থবির হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল। এ এক নতুন অনুভূতি, নতুন অভিজ্ঞতা- যে অভিজ্ঞতার স্বাদ মানুষ মাত্র একবারই আস্বাদন করতে পারে। প্রথম সন্তানের পিতা, প্রথম সংবাদ। তার বাহু দু’টি যেন পাখা হয়ে গেছে, সে আকাশে উড়ছে। মর্তের মাটিতে তার জন্ম আজ স্বার্থক হল। এখন একজন এসেছে- যেজন পৃথিবীতে একমাত্র তারই পরিচয় বহন করবে, তারই প্রতিনিধিত্ব করবে। তার মরুময় জীবনটাকে মরুদ্যানে পরিনত করবে। কিচির মিচির কলরবে তার নিস্তরঙ্গ বক্ষে সাত সাগরের ঢেউ তুলবে। আনন্দাতিশয্যে সে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেল, তার চিন্তা ও দেহ বিকল হয়ে গেছে। দু’পা এগিয়ে গিয়ে ঈশান কোণে বারান্দার ছোট্ট রুমটিতে বসল। কেন বসল জানে না, তবে সম্ভবত মধুবর্ষিনী স্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের জন্য।
কিছুক্ষণ পর সেইজন কিছুটা কুজো হয়ে আস্তে আস্তে সেই গৌরবময় হাসি মুখে নিয়ে এগিয়ে এল, পাশে বসল, স্বামীর কাঁধে মাথা রাখল। হাসান আজন্মই আবেগ উত্তেজনা ও চরম মুহুর্তে সঠিক কাজটি করতে পারে না। যে মুহুর্তে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে আদর আহলাদ ও শান্তনা দেয়ার কথা তখন সে শুধু আবুলের মত তাকিয়ে থাকল, কোন কথা বলতে পারল না, শুধু স্ত্রীর চিবুক ধরে একটা চুমু উপহার দিতে পারল। স্ত্রীই আস্তে আস্তে কথা শুরু করল, আর শুরু করল তো করলই, ‘হঠাৎ সকালে ব্যথা শুরু হল, বড় দুলাভাই গিয়ে দাই বেটিকে ডেকে আনল। ওমা গো কি ব্যথা, মনে হচ্ছিল আমি মারা যাচ্ছি। বাচ্চা বের হচ্ছে না। তখন দাই বেটি বলল, ‘নতুন প্রসূতি, বাচ্চা তো আসছে না, এখন তো মা ও বাচ্চা উভয়ের জীবন হুমকির মুখে। অনেক্ষণ হয়ে গেল, বাচ্চার মাথা লাল হয়ে গেছে। আর কিছু সময় গেলে বাচ্চা বাঁচানো যাবে না। এমনিও মরা অমনিও মরা শেষ চেষ্টা কর। তুমি বাঁচ আর মর তোমার বাচ্চাটিকে বাঁচাও’।
তারপর ফেরদৌসী বলল, ‘আমি তখন মনে করলাম আমি তো মারাই যাচ্ছি, আমার বাচ্চাটা বেঁচে থাকুক, শরীরের সর্ব শক্তি প্রয়োগ করলাম। যন্ত্রণায় দু’হাত মাটিতে মারতে লাগলাম। তখন বড়াপা এসে হাতে পারা দিয়ে ধরল। কিছুক্ষণ পর মেয়ে আসল দুনিয়ায়’। এটুকু শুনেই হাসানের মনটা বিষিয়ে উঠল, এটা কি করে সম্ভব এমন একটা মুমূর্ষু অবস্থায় হাতে পা দিয়ে পারা দেয় কেমনে, এটা কি জীব- জন্তু নাকি, ঐ হারামজাদির কি হাত ছিল না, হাতে ধরতে পারল না, আমি থাকলে তো ওর পা- টা কেটে ফেলতাম। সে রাগে ভুত হয়ে বসে থাকল, কোন কথা বলল না। ওদিকে তার বউ লম্বা ফর্দ খুলে বসেছে, আলাপের আর শেষ নাই। রাত অনেকটা হয়ে গেছে, কিছুক্ষণ পর মিষ্টির দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। সে উঠতে চায় কিন্তু বউ উঠতে দেয় না। অবশেষে জোর করে নিজেকে স্ত্রীর বাহুবন্ধন থেকে ছাড়িয়ে মিষ্টি আনতে বেরিয়ে গেল। বাসায় তেমন কেউ নেই, পাঁচ কেজি মিষ্টি নিয়ে এসে হাজির হল।
দরজা খোলা হল, সে গিয়ে বাচ্চার উপর উপোর হয়ে পরল। বাঃ, একটা চাঁদ, মর্মর পাথরের মত সাদা ধবধবে, চোখ দু’টি বন্ধ, ঠোঁট ঝামটি কেটে আছে। মাথায় লেপটানো চুল, গায়ে পশম। বাচ্চার নানী মেয়েকে কাপড়ে জড়িয়ে বাপের কোলে তুলে দিল। বাপ মুচকি হাসে আর ভাবে কি আশ্চর্য্য, আমার থেকে আরেকটা মানুষ হয়ে গেল? আমি কি করলাম, কি দিলাম? সে বাচ্চার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবে আর নিজেকে খুব গর্বিত পুরুষ মনে করতে থাকে। ওমা, হঠাৎ ঠা ঠা করে চিৎকার জুড়ে দিল, বাচ্চার মা তাড়াতাড়ি নিয়ে দুধ খাওয়াতে লাগল। কিন্তু তার মনে হল বাচ্চা বুঝি তাকে গালি দিল, এই কণ্টকময় বিষাক্ত পৃথিবীতে আনয়নের জন্য সে বাপকে গালি দিচ্ছে। তখন তার মনে পরল ঢাকার উত্তরার বাসায় সে গর্ভের ভ্রুনের সাথে একটা অঙ্গিকার করেছিল। আবার সে সুকান্তের সেই কবিতাটা আবৃত্তি করল, ‘এসেছে নতুন শিশু তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান, জির্ন পৃথিবীতে মৃত্যু আর ধ্বংসস্তূপ পিঠে চলে যেতে হবে আমাদের----। কবিতা শুনে বাচ্চার মা- বাপ, নানী সবাই হাসে। খাওয়ার পর বাচ্চাকে বিছানায় রাখল। আবার সে বাচ্চার উপর উবু হয়ে পরল। কার মত হবে? বাপের মত না মায়ের মত? না, বুঝা যাচ্ছে না, এরপর সে বাচ্চার সাথে আলাপ করে, সুকান্তের কবিতা আবৃত্তি করে, বাচ্চার মায়ের সাথে আলাপ করে, কখনো জল্পনা কল্পনা করে, এভাবে দীর্ঘ সময় কেটে গেছে।
রাত প্রায় বারটা। ততোক্ষণে বাচ্চার উপর উবু হয়ে থাকার নেশা অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছে। সে কিছুক্ষণ নীরব হয়ে বসে থাকল, তার মনের ক্ষোভটা ভিতরে গুতাগুতি করতে লাগল। বউকে বলল, ‘আচ্ছা এমন একটা রিক্সি মুহুর্তে ডেলিভারি রোগী নিয়ে কেউ ঘরে বসে থাকে নাকি, কাছেই মাতৃসদন, সেখানে নিতে পারল না? বউ বলল, ‘কার এত ঠেকা পরছে আপনার বউকে নিয়ে হসপিটালে দৌড়াদৌড়ি করতে। - কেন তাদের কোন ঠেকা নাই? আর বড়াপা এত আদর মাড়ায় তোমার হাতে পাড়া দিয়ে ধরল কেমনে। তুমি কি জীব জন্তু নাকি, তার হাত নাই, হাতে ধরতে পারল না?- বড়াপাকে কিছু বলেন না যে, সে অনেক করেছে। - আচ্ছা ঠিক আছে। এত কিছু করল কিন্তু এই যে এত কাছে হাসপাতাল- সেখানে নিল না কেন বা কোন ডাক্তার ডাকল না কেন, যদি কোন এ্যাকসিডেন্ট হয়ে যেত, তখন কি হত। আর টাকা তো তাদের দিতে হত না, আমিই তো দিতাম। - এত টাকার গরম দেখান কেন, তাদের পিছে আপনি কয় টাকা খরচ করেছেন? ব্যস অন্যান্য সময়ের মত তাদের মধ্যে শুরু হয়ে যায় কথা কাটাকাটি। তা থেকে ঝগড়া, ঝগড়া থেকে মনোমালিন্য।
তবে তারা যশ নিয়ে তৃপ্তি সহকারে ঝগড়া করতে পারছে না, উচ্চ স্বরে কথা বলতে পারছে না, নিম্ন স্বরে বলতে হচ্ছে। কারণ পূর্ব পাশের রুমে ইঞ্জিনিয়ার ও বড়াপা শুয়ে আছে। মাঝখানের দেয়াল সংলঘ্ন লম্বালম্বি দু’পাশে দুই খাট। উভয় খাটের শিয়রের ধারে দরজা। একপাশে সাধারণ স্বরে কথা বললেও অপর পাশ থেকে স্পষ্ট শুনা যায়, তাই ঝগড়াটা জমে উঠল না। তবে ঝগড়ায় সেই পরাজিত হল। কারণ অসুস্থ স্ত্রীকে সে কোন কটু কথা বলার সাহস পেল না কিন্তু স্ত্রী বাঘিনীর মত আগের অভ্যাস অনুযায়ী যা বলার বলে গেল। অবশেষে ঝগড়ায় স্ত্রীর হাতে নাস্তানাবুদ হয়ে বিরক্তি নিয়ে উঠে বলল, ‘ঠিক আছে আমি গেলাম’। কিন্তু এই বোকা মেয়েটা ভেবেছে স্বামী তাকে ফেলে চলে যাচ্ছে। তারপর সে ও তার সন্তান অকুল পাথারে ভেলায় চড়ে ভাসতে থাকবে, তাদের কোন আশ্রয় থাকবে না, অবলম্বন থাকবে না, তাদেরকে দেখার মত কেউ থাকবে না। তখন সে স্বামীকে ধরার জন্য সর্ব রিক্তের মত কেঁদে উঠে দু’টি হাত বাড়িয়ে দিয়ে মুখটা এমন বিকট হা করে উঠল যা সপ্ত সাম্রাজ্যহারা কোন সর্বহারার পক্ষেও সম্ভব নয়, এমন বিকট হা সে জীবনে কখনো কাউকে দেখেনি।
সে ছিল স্ত্রীর নাগাল থেকে কিছুটা দুরে, চোখের পলকে ছোটে এসে স্ত্রীর দু’টি হাত ধরল। সে স্বামীকে লজ্বার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তার দুর্বল দেহের সর্বশক্তি নিয়োগ করে ভিতর থেকে উথলে উঠা কান্না ও আর্তনাদ রোধ করল। কারণ কান্নার আওয়াজ পেলে তারা পাশের রুম থেকে দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করবে কি হয়েছে, কেন হয়েছে? তারপর সর্বশক্তি দিয়ে স্বামীকে দু’হাতে ঝাপটে ধরে আবার বিকট হা করে নিম্ন স্বরে আর্তনাদ করে উঠল, ‘আমার আর কিছুই থাকল না, আমার সব শেষ হয়ে গেল, আমার আর কিছুই থাকল না, আমার আর... বারবার বলতে লাগল। হাসান তীব্র অনুশোচনায় স্ত্রীর মুখটা এত জোরে বুকে চেপে ধরল যেন সে বুক চিরে নিজের বুকের মধ্যে, কলিজার মধ্যে, হৃদয়ের মধ্যবিন্দুতে স্ত্রীকে ভরে রাখতে চায়। সেই রাতে সে আর বাসায় যায়নি, স্ত্রীর শান্তনার জন্য তাকে জড়িয়ে ধরে সেখানেই শুয়ে থাকল।
খালের তীরে স্ত্রী বিয়োগান্ত এক যুবক ধ্যান মগ্ন। তার চোখের সামনে ভেসে উঠে স্ত্রীর সেই বিকট হা, তার কানে বাজতে থাকে স্ত্রীর আর্তনাদ, ‘আমার আর কিছুই থাকল না, আমার.....। তার অভুক্ত ক্ষীণ দুর্বল দেহটিতে এই মানসিক পীড়ন সহ্য করার ক্ষমতা ছিল না। সে দু’হাতে মাথা চেপে ধরে বার কয়েক ‘না না না’ বলে হৃদয় ফাটা আর্তনাদ করে মাটিতে চিত হয়ে গড়িয়ে পরল। সেই আর্তনাদ খালের তীরে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠে উর্ধ্বে, রাতের নীরব আকাশ খান খান হয়ে ভেঙ্গে পরে। মাটিতে পরে সে তীব্র যন্ত্রণায় দু’পাশে মাথা মারতে থাকে, মাটিতে দু’হাত মারতে থাকে। তার মনে হয় স্ত্রীর সাথে তার বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেছে, পৃথিবীর সাথে তার সম্পর্ক চুকে গেছে। সে পরে যাচ্ছে, পৃথিবী থেকে পরছে, পরছে, শুন্যে পরছে, অসীম অতলান্তের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বাঁচার জন্য সে দু’হাতে দু’দিকের মাটি খামছে ধরছে। ঘাস কাদা মাটি মুঠি ভরে আসছে, আবার খামছে ধরছে, আবার মুঠি ভর্তি মাটি ঘাস আসছে।
সে বারবার হাত মারে আর আর্তনাদ করতে থাকে, ‘না না, আমি বেঁচে থাকতে তুমি নিঃস্ব হতে পার না, তুমি বেঁচে থাকতে আমি নিঃস্ব হতে পারি না। আমরা বেঁচে থাকতে আমাদের সন্তান নিঃস্ব হতে পারে না। তুমি চলে গেলে আমি নিঃস্ব হয়ে যাব, আমার সন্তান নিঃস্ব হয়ে যাবে, আমাদের আর কিছুই থাকবে না, কেউ থাকবে না। তুমিও নিঃস্ব হয়ে যাবে, তুমি অগ্নি গোলা, তোমাকে নিয়ে কোন পুরুষ ঘর করবে না, করতে পারবে না, তুমি পরিত্যাক্ত হবে, তখন তুমি আমায় খুঁজতে বেরুবে কিন্তু সে সময় হয়ত তোমার হাতটি ধরার জন্য আমি আর বেঁচে থাকব না। তখন আমরা সবাই নিঃস্ব হয়ে যাব, সর্বহারা হয়ে যাব, আমাদের আর কিছুই থাকবে না, আমাদের সন্তান আশ্রয়হীন হয়ে পরবে। তুমি যেয়ো না, আমাদেরকে সর্বহারা করে তুমি যেয়ো না, আমার ও আমার সন্তানের শবদেহ মাড়িয়ে তুমি অন্যের ঘরে যেয়ো না। আরে ডাইনি, আরে রাক্ষসী, তোর কি মনে পরে না তুই আমার জন্য কিভাবে কেঁদেছিলে। তাহলে আজ কেন আমাকে ছেড়ে অন্যের ঘরে চলে যাচ্ছিস। এটা হতে পারে না, আমাদের সমাধির উপর তুমি বাসর রচনা করতে পার না। এটা হয় না, এটা হতে পারে না, এটা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। এইখানে নিখিল নর- নারীর চিরন্তন বিশ্বাসের দুনিয়ায় রাত্রি নামে, এইখানে রাত্রি নামে। এইখানে মনুষ্যত্বের কবর রচিত হয়। এইখানে ইনসানিয়্যত মাথা ঠুকে মরে। তুমি ফিরে এসো, যেয়ো না, আমাদের ছেড়ে যেয়ো না। তুমি চলে গেলে আমাদের সন্তান বাঁচবে না, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না, মরে যাব মরে যাব, মরে.....।
এরপর সে আর কথা বলতে পারল না। দুঃখ, যন্ত্রণা ও ব্যথার তীব্রতায় জবাই করা পশুর মত কাতরাতে লাগল, গোঙ্গাতে লাগল, কলে পরা জন্তুর মত ধাপরাতে থাকে। দু’টি হাত উর্ধ্বে মেলে ধরল, শুন্য দু’টি হাত এনে বুকে মারল। আবার মেলে ধরে, শুন্য হাত আকাশে মেলে ধরে, আবার শুন্য হাত এনে বুকে মুখে মাথায় মারে, মারতে থাকে, হাত বাড়াতে থাকে আর মারতে থাকে। গলা দিয়ে গরগর শব্দ বের হচ্ছে, দু’পাশের ঠোঁট বেয়ে মুখের ফেনা ও লালা গড়িয়ে পরছে, চোখের কোন বেয়ে অশ্রু কানে জমা হচ্ছে, দু’পাশে মাথা ঝাকাচ্ছে, হাত পা ছুঁড়ছে, কাতরাচ্ছে, গোঙ্গাচ্ছে। অবশেষে তার ক্ষীণ, দুর্বল, ক্লান্ত- পরিশ্রান্ত দেহটি নিথর হয়ে খোলা আকাশের নীচে পরে থাকে।
রাতের তৃতীয় প্রহর চলছে। অনেকক্ষণ পর তার চেতনা ফিরে এল, উঠে বসল। তার শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে, কিছু চিন্তা করতে পারছে না, ভাবতে পারছে না। কিছুক্ষণ পর উঠে ধীরে ধীরে হাটা শুরু করল। খালপাড় দিয়ে হেটে হেটে গিয়ে মুল রাস্তায় উঠল। গ্রামের পথ, শহর তলির পথ ধরে সে এগিয়ে যাচ্ছে। নীরবতা পৃথিবী গ্রাস করে নিয়েছে, কোন সাড়া শব্দ নেই। প্রাণী জগত নিদ্রা দেবীর কোলে নিজেকে সপে দিয়েছে। জন মানবের চিহ্ন নাই, দুয়েকটা কুকুর ঘুরছে, বুভুক্ষু নিশাচরেরা এদিক সেদিক বিক্ষিপ্ত ঘোরে বেড়াচ্ছে। প্রকৃতি বিষণ্ণ নিথর। বিষণ্ণ প্রকৃতি তার তনুমন বিষায়িত করে তুলেছে, সর্বাঙ্গে বিষ, নাগ নাগ জ্বালা। দুঃখ ও কষ্টের সময় মানুষ গান গাঁয়, ব্যথার তীব্রতা তার গলায় সুর তুলে দেয়, কণ্ঠে বেজে উঠে বিষাদের রাগিণী। পথে ঘাটে শুনা একটা গান তার কণ্ঠে সুর তুলল। হঠাৎ দাঁড়িয়ে উর্ধ্বে তাকিয়ে দু’পাশে তর্জনি নাড়িয়ে নাড়িয়ে গাইল, ‘এমন তো কথা ছিল না, জীবন আমার আহত পাখীর মত পথের ধুলোয় লুটোবে, সাত রঙ্গে রাঙ্গা স্বপ্ন বিহঙ্গ সহসা পাখনা গুটোবে। তার কণ্ঠ ছিল সুমধুর, তার বাবার কণ্ঠও ছিল মধুময়, তারা সবাই বংশগত চারুকণ্ঠী। ধর্মীয় পরিবার না হলে হয়ত সুরের জগতে তারা তারকাখ্যাতি পেত।
সে গাইল, ‘আলোর কামনাগুলি সুর্য শিখা হয়ে আনন্দ ফুল ঝুড়ি ঝড়াত। গানের বাশরি হয়ে সুরের আকাশখানি তারার জোছনায় ভরাত। বৈশাখী মেঘে মেঘে চন্দ্র সুর্য ঢেকে আচমকা আধার জুটোবে। তার কণ্ঠ ধীরে ধীরে উচ্চতর হচ্ছে, সুরের মুর্ছনায় প্রকৃতি আন্দোলিত হচ্ছে।
সে গাইল, ‘মনের বাসনাগুলি গন্ধ গোলাপ হয়ে অন্ধ মাতাল করে দিত। সবুজ পাতারা ওগো অবুঝ প্রথম প্রেমে আদরে কাছে ডেকে নিত, বাউড়ি উদাসী বায়ু, গোলাপেরা ঝড়ে গিয়ে এ হৃদয়ে কাঁটা ফুটোবে। বড় করুন সুরে সে গেয়ে চলেছে। রাস্তার দু’পাশে বাড়ি-ঘর। রাতের নীরবতায় বিষাক্ত সুরের ছন্দে হয়ত কোন শিশুর ঘুম ভেঙ্গে কান্না জুড়ে দিয়েছে, তার মা বিরক্তি জানাচ্ছে, ‘কোন মরাটা আমার বাচ্চার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিল। গৃহকর্তা ভাবছে, হায় কোন হতভাগা এই শেষ রাতে নিজের জীবনের বিষ চলার পথে ছড়িয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে। বুড়া- বুড়ি হঠাৎ নিদ্রা ভেঙ্গে ভাবছে, না জানি কোন হতভাগিনী মায়ের সন্তান কেঁদে ফিরছে, মানব হৃদয় তোলপাড় করে যাচ্ছে, চোখে আশু নামাচ্ছে।
সে গাইল, ‘এমন তো কথা ছিল না, জীবন আমার আহত পাখীর মত পথের ধুলোয় লুটোবে, সাত রঙ্গে রাঙ্গা স্বপ্ন বিহঙ্গ সহসা পাখনা গুটোবে। তার কণ্ঠ বিষ ঢেলে যাচ্ছে, সেই বিষ ছড়িয়ে পরেছে প্রকৃতিতে, বিষের তেজস্ক্রিয়তায় রাতের আধার গলে গলে পরে বৃক্ষপত্রে, সেখান থেকে ফোটায় ফোটায় ঝড়ে পরে পৃথিবী পৃষ্ঠে। ব্যথাতুর প্রকৃতি নীথর মুক।
বিষয়: সাহিত্য
১১৬৩ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন