চিঠি (কবর)-৬০ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১০:০৬:৪২ সকাল
পরদিন বিকালে সে ঐ মহিলার বাসায় গিয়ে উপস্থিত হল। তিনি একজন মধ্য বয়স্ক মহিলা। ‘কি গো জামাই বিয়ের দাওয়াত দিতে এলেন বুঝি’ তিনি আসতে আসতে হাসতে হাসতে প্রশ্ন করলেন। হাসান একটা ধাক্কা খেল, ‘বিয়ে, কিসের বিয়ে? – ‘কেন আপনার বউয়ের ঢাকা ভার্সিটির শিক্ষকের সাথে বিয়ে হয়েছে, আপনিও তো নিশ্চয়ই কোন ভার্সিটির শিক্ষিকা বিয়ে করছেন, এখন দাওয়াত দিতে এলেন বুঝি’ বলে হাসতে লাগল। হাসানের ভিতরটা যেন পোড়ে গেল, সে তিক্ত কণ্ঠে বলল, ‘আপনিই পাগল নাকি আমিই পাগল বুঝতে পারছি না। আমার বউ, আমি তালাক দেইনি আর আপনি বলছেন বিয়ে হয়ে গেছে’। মহিলা লজ্বিত হয়ে অবাক কণ্ঠে বলল, ‘আশ্চর্য্য, আমি যে শুনলাম বিয়ে হয়ে গেছে। আপনি কি এখনো তালাক দেননি’? – না। - আপনার কাছে তালাক চাচ্ছে না?- তাতো চাচ্ছেই, বেশ কিছুদিন ধরে খুব বিরক্ত করছে।– তাহলে ঘটনা এটাই, আসলে দশ বারো তারিখ বিয়ে হয়ে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু আপনি তালাক দেন নাই বিধায় হতে পারে নি। - অবাক কথা, তালাক দিলে ইদ্দত ছাড়া সাথে সাথেই কি বিয়ে দিয়ে দিবে, এটা জায়েয হবে? – জায়েয না জায়েয তাতো আর আমি জানি না, তারা ধার্মিক, তাবলীগ করে, তারাই ভাল জানে। তবে এ কথাটা আমি আপনাদের বড়াপাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে বলল, স্বামী সাথে থাকলে পেটে বাচ্চা আছে কিনা তা বুঝার জন্য ইদ্দতের প্রয়োজন হয় কিন্তু এখানে এর প্রয়োজন নাই। কারণ এক বছর ধরে স্বামী স্ত্রীর সাক্ষাৎ নাই, এখানে তো এক বছরই ইদ্দত হয়ে গেল, নতুন ইদ্দতের দরকার কি?
- হায়, এরা এত জঘন্য, ভাল পাত্র পেয়েছে বলে একটা সংসার ভেঙ্গে দিচ্ছে, আবার ইসলামও বিকৃত করছে, এরা মানুষ নাকি?- মানুষ না কি তাতো আপনিই আমার চেয়ে ভাল জানেন, তবে আমি কোন মন্তব্য করব না।– যাই হউক, আপনার কাছে যে জন্য এসেছি, আল্লাহ্র ওয়াস্তে, সে মরিয়া হয়ে বলল, আল্লাহ্র ওয়াস্তে আমার শাশুড়ির কাছে যান, তাকে গিয়ে বুঝান, একটা সংসার, তিনটা জীবন বাঁচান। তাকে গিয়ে বলবেন, ‘আপনারা একটা সংসার কেন ভাঙ্গতে চাচ্ছেন, ইসলামী দৃষ্টি কোন ও মানবিক দৃষ্টি কোন থেকে এমন কি কারণ ঘটল যে, আপনার মেয়েকে আনতে চাইছেন? জামাইকি শারীরিক ভাবে অক্ষম, সে কি আপনার মেয়েকে ভাত কাপড় দিতে পারে না, সে কি মদ গাজা খায়- নেশা করে, যৌতুক চায়, মেয়েকে মারপিট করে। এমন কি কারণ আছে যে, বিয়েটা ভেঙ্গে দিবেন। বড়লোক জামাই পেয়েছেন বলে? কিন্তু এর কি গ্যারান্টি আছে যে, ঢাকা ভার্সিটির একজন শিক্ষক আপনার মেয়েকে বিয়ে করে তাকে নিয়ে জীবন কাটাবে, দু’দিন পর লাথি মেরে তাড়িয়ে দিবে না বা আরেকটা বিয়ে করবে না। কারণ আপনার মেয়ে তো তেমন সুন্দরীও নয়, শিক্ষিতও নয়, নাক বুচা, আপনিও দরিদ্র মানুষ, তাহলে কোন ভরসায় বিয়ে দিবেন। এখানে ভাল মন্দ যাই হউক ওরা সংসার করে যাচ্ছে, একটা বাচ্চাও আছে, এমন একটা সোনার সংসার ভাঙ্গবেন কেন? তাছাড়া মেয়েটা হবে মা হারা, এই বাচ্চার অভিশাপেই তো আপনারা ধ্বংস হয়ে যাবেন। যে সবটাই চায় সে সবটাই হারায়। ভার্সিটি শিক্ষক দেখে বিয়ে দিবেন তারপর কিন্তু একুল ওকুল দুকুলই হারাতে হবে।
তারপর হাসান বলল, আমি মূল পয়েন্টটুকু বললাম, আপনি নিজের বুদ্ধিমত্তায় আরো সাজিয়ে গুছিয়ে তাকে ভাল করে বুঝাবেন। আমার শাশুড়ি সরল মানুষ, আশা করি তিনি বুঝ মানবেন। আর বড়াপাকে গিয়ে বলবেন, ‘বড়লোক জামাই পেয়েছেন বলে একটা সংসার ভেঙ্গে দিচ্ছেন, এটা তো ব্যবসা। আর ব্যবসা করতে চাইলে ভাল করেই করেন। আপনার বোনকে সাজিয়ে গুছিয়ে একটা ঘরে রাখুন, তারপর ঘরের সামনে সাইন বোর্ড টানিয়ে দিন ‘এখানে সুলভে দেহ ভাড়া পাওয়া যায়’।আর আমার বউকে যদি পান তাহলে বলবেন যারা স্বামী সন্তান সংসার নিয়ে থাকে তারা সম্মানিত গৃহকর্ত্রি। যারা বিনা কারণে একজন ছেড়ে আরেক জনের কোলে বসে ওরা বেশ্যা, নারী জাতির কলঙ্ক। এখন তুমি কোনটা হতে চাও? তারপর হাসান মহিলার দিকে হাত জোড় করে বলল আল্লাহ্র দোহাই আপনি যান তাদেরকে গিয়ে বুঝান, আমাকে বাঁচান, আমার মেয়েটাকে আল্লাহ্র ওয়াস্তে’ বলে সে হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলল।
মহিলাটি করুণভাবে তার প্রতি তাকিয়ে আছে। সে চোখের পানি মোছার জন্য যেই চশমা খুলল অমনি তিনি আতকে উঠে বললেন, একি আপনার অবস্থা, চোখ গর্তে চলে গেছে। স্বাস্থ্য এত খারাপ হল কি করে, বউয়ের জন্য কি দেবদাস হয়ে যাবেন নাকি, এমন একটা খারাপ মেয়ের জন্য এভাবে নিজেকে তিলে তিলে নিঃশ্বেষ করার কোন মানে হয় না। এটা তো আত্মহত্যা। হাসান লজ্বা ও কান্না লুকানোর জন্য উঠে ‘আপনি কিন্তু কালই চাবেন’ বলে দ্রুত বেরিয়ে গেল। মহিলা ডাকল, ‘আরে চা তো খেয়ে যাবেন’। হাসান গেইটের কাছ থেকে উচ্চ স্বরে বলল, ‘আমি চা খাই না। আল্লাহ্র ওয়াস্তে আপনি কিন্তু কালই গিয়ে ফয়সালা করে আসবেন। আমি কাল আবার আসছি’ বলে সে দ্রুত হাটতে লাগল।
পরের দিন – ১৭ জুলাই। হাসান গিয়ে চাচী শাশুড়ির বাসায় উপস্থিত হল। তিনি সোফায় বসে শুরু করলেন, ‘ছিঃ মানুষ এত নীচ কী করে হতে পারে, নিজেদের ওয়াইড বাড়ানোর জন্য এমন একটা মিথ্যা কথা বলে বেড়াচ্ছে’। হাসান ভড়কে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আমাকে কিছু বলছেন? তিনি বললেন, ‘না, আপনাকে না, বলছি আপনার শ্বশুর পরিবারকে। ওরা নিজেদেরকে খুব দামী বুঝানোর জন্য বলে বেড়াচ্ছে ঢাকা ভার্সিটির শিক্ষকের সাথে আপনার বউয়ের বিয়ে হচ্ছে। আসলে বিয়ে হচ্ছে এশিয়ান ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষকের কাছে। ওরা কেমন মানুষ, এসব বিষয়ে কেউ মিথ্যে কথা বলে নাকি’। হাসান যেন ঘোর অন্ধকারে ক্ষীণ একটা আলোক শিখা দেখতে পেল, খুশিতে তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আগ্রহ ভরে বলল, ‘কী আলাপ হল।– আরে আলাপ আর কী করব। আমি গেলাম, আপনাদের বড়াপার কাছে আন্তরিকতা নিয়ে বসলাম। তারপর বললাম, আমি একটা আলাপ করতে এসেছিলাম। সে জিজ্ঞেস করল কী আলাপ? আমি বললাম, ফেরদৌসির ব্যাপারে আপনারা এসব কী করতেছেন, একটা বাচ্চা আছে, জামাইটাও তো খারাপ না। এখন একটা ঘর ভেঙ্গে আরেক জায়গায় বিয়ে দিবেন। এটা কি ঠিক হচ্ছে। ওখানে বিয়ে দিলেই ভাল হয়ে যাবে এর কী নিশ্চয়তা আছে, দুর্ঘটনাও তো ঘটতে পারে, তখন কী করবেন’। সে ঝংকার দিয়ে, ‘যে চেপ (থুথু) ফেলে দিয়েছি তা আর মুখে তুলব না, যে জুতা পায়ে দিয়েছি তাতো আর মাথায় নেয়া যায় না। দুয়েকদিনের মধ্যে বিয়ে হবে, এখন এসব আলাপ করে লাভ কী’ বলে হন হন করে পাশের রুমে চলে গেল। আমি অবাক হয়ে গেলাম, আমি যে তার চাচী- বেটিটা এর বিন্দুমাত্র কোন সম্মান তো দেখালই না, উল্টো তেজ মাড়িয়ে চলে গেল।
আমি চলে আসতে উদ্যত হলাম কিন্তু হঠাৎ মনে হল, জামাইটা এত অনুনয় বিনয় করে বলল, আল্লাহ্র দোহাই দিল, এখন আমার শেষ চেষ্টা না করলে বিষয়টা অমানবিক হবে। কাজেই আপনার শাশুড়িকে খুজলাম, সে পাশের রুমেই ছিল। সেখান থেকে ইঞ্জিনিয়ারের মেয়েদের বের করে দিয়ে তার সাথে নিরিবিলি বসলাম। অনেক বুঝালাম, আমার নিজের অভিজ্ঞতার কিছু উদাহরণ দিলাম, আমার দেখা কয়েকটা মেয়েকে আগের স্বামীর ঘর থেকে এনে অন্যত্র বিয়ে দেয়ার পর তাদের ভাগ্যে কী নির্মম পরিণতি হয়ে ছিল সেসব তাকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে বললাম। কিন্তু কামার লোহাকে শতভাবে শত পিটালেও যেমন লোহা লোহাই থাকে আপনার শাশুড়ির অবস্থাও তাই। সে বলল, ‘ভাঙ্গা হাড়ি কখনো জোড়া লাগে না, সবাই চিন্তা ভাবনা করে যা বাদ দিয়েছে এখন আর তা মিলানো সম্ভব না। এখন এসব আলাপ করে লাভ নেই। তাছাড়া আমার মেয়ে ওর নামই শুনতে পারে না, ওকে ঘৃণা করে। মেয়ে ঐ ছেলেকে (নতুন জামাইকে) খুব পসন্দ করে আর ছেলেও মেয়ে দেখে খুব পসন্দ করেছে’ বলে হাসতে লাগল। আমি ভাবলাম আপনার শাশুড়ি তো সোজা টাইপের মানুষ তার কাছ থেকে সব কিছু জানা যাবে। তাই আমি জিজ্ঞেস করলাম ছেলে কোথায় থাকে, কি করে? সে বলল, ‘ছেলে এশিয়ান ইউনিভার্সিটির শিক্ষক, হিন্দু নওমুসলিম, আমরা ছাড়া তার কেউ নাই। মেয়ে ঢাকায় বরিশালের জামাইয়ের বাসায় থাকত তখন ছেলে এসে মেয়েকে দেখে পসন্দ করেছে, কথা বার্তা, আলাপ সালাপ করেছে। ছেলে মেয়েকে দেখার অনেক দামি একটা মোবাইল গিফট করেছে। সারাদিনই কথাবার্তা বলে। মাঝে- মধ্যে দুজনে মিলে ঘুরতে যায়। দোয়া করেন যেন, বিয়েটা হলে খুব ভাল হবে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম বিয়ে কবে? সে বলল, বিয়ে তো কবেই হয়ে যেত, ঐ শয়তানটা তো তালাক দিচ্ছে না, আপনি বলে কয়ে তালাকটা নিয়ে দেন, ঝামেলাটা শেষ হয়ে যাক’। তারপর ওদেরকে আর আমার কাছে মানুষ বলে মনে হল না। এখনো তালাক হয়নি অথচ মেয়ে অন্য পুরুষের সাথে কথা বার্তা বলে, ঘুরতে যায়, মেয়ে নিয়ে ব্যবসায় নেমেছে। ফেরদৌসিকে মনে হল যে মেয়েটা বেশ্যা হয়ে গেছে। দু’কথা বলার জন্য খুজলাম কিন্তু পেলাম না, ঢাকায় আছে। তারপর আমার মিশনে ব্যর্থ হয়ে চলে আসলাম।
ঐ ছেলের সাথে মোবাইলে সারাদিনই কথা বলে, এটুকু শুনার পর হাসানের কানে আর কোন কথা প্রবেশ করে নি। আমি জীবিত, তালাক দেইনি অথচ আমার স্ত্রী অন্যের সাথে গাড়িতে চড়ে, পার্কে পার্কে ঘোড়ে, অন্যের কাঁধে মাথা রেখে হানিমুন করে বেড়ায়, আরো হয়ত কতকিছু করে, হায় আমার মৃত্যু কতদুর। তার গলা শুকিয়ে গেছে, কণ্ঠ তালু লেগে গেছে। ঢোক গিলার চেষ্টা করছে কিন্তু শুকনা গলায় ঢোক চলছে না। এক গ্লাস পানি চাইল। মহিলা দু’তিনটা মিষ্টি আর এক গ্লাস পানি এনে দিল। সে এক নিশ্বাসে পানিটা খেয়ে বলল, তারা মেয়ে নিয়ে ব্যবসা করবে কিন্তু ব্যবসায় তো এখানে প্রমোশন হচ্ছে না ডিমোশন হচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তো আমিও হতে পারি। তিনি বললেন, ‘প্রমোশন ডিমোশন তো কথা না, আসল কথা হচ্ছে আপনি তো আর নও মুসলিম হতে পারবেন না। - মানে? - মানেটা খুব কঠিন না, সহজ যা আপনিও বুঝেন। ঐ বেটা নওমুসলিম, মা বাপ ভাই বোন কিছুই নেই। শুধু বউ নিয়ে বাসায় থাকবে আত্মীয় স্বজনের ঝামেলা নেই। এদিকে আপনার শাশুড়ি একা মানুষ, যাও বা একটা ছেলে আছে মায়ের দিকে ফিরেও তাকায় না। বেচারি মেয়েদের বাসায় বাসায় থাকে। এখন নওমুসলিম জামাই তার কেউ নাই, মা হিসাবে শাশুড়ি ছোট মেয়ের কাছে থাকবে। এটা আপনার শাশুড়ির বিরাট একটা অবলম্বন। এজন্যই সে বিয়ে দিতে এত আগ্রহী আর এত খুশি।
আমিও তো সিদ্ধান্ত করেছিলাম তাকে আমার কাছে নিয়ে আসব। এখানেই তো তিনি থাকতে পারতেন। - হ্যাঁ পারতেন। তবে আপনার মা, ভাই বোন আছে। তারা এ নিয়ে খোটাখাটি করত। - যে অভিশপ্ত নারী আমার মত ত্রিধারায় শিক্ষিত লোককে স্বামী হিসাবে, আমার বাবা- মার মত মহান ব্যক্তিদ্বয়কে শ্বশুর শাশুড়ি হিসাবে মেনে নিতে পারত না, ডাকত না, তার শ্লাঘায় বাজত, পদানত করে রাখতে চাইত এখন হিন্দুকে স্বামী এবং শ্বশুর শাশুড়ি হিসাবে কী করে মেনে নিবে, শ্লাঘায় লাগবে না? - আরে শুনেন হিন্দু মুসলিম কথা না, নারী চায় টাকা পয়সা, গহনা- গাটি, বিলাস ব্যাসন, আনন্দ- স্ফুর্তি। আর এসব আপনার চেয়ে ঐ লোকের বেশি আছে। কাজেই সে আপনাকে গ্রহন করবে কেন, সে বুদ্ধিমতি মেয়ে, আমাদের মত বোকা নয়।
হাসানের মন মস্তিস্ক বিকল হয়ে গেছে। সে কি করবে না করবে, কি বলবে চিন্তা করতে পারছে না। হঠাৎ সে চেচিয়ে উঠল, ‘চাচী আল্লাহ্র কসম ইঞ্জিনিয়ার ও তার বউ যদি আমার বউকে ঐ হিন্দুর সাথে বিয়ে দেয় তাহলে আমিও ইঞ্জিনিয়ারের বউকে একটা হিন্দুর সাথে বিয়ে দিব। না না একটা ইহুদির সাথে বিয়ে দিব। আর ঐ হিন্দু আমার স্ত্রীর গর্ভে যতটা সন্তান পয়দা করবে আমিও ইঞ্জিনিয়ারের বউয়ের পেটে ইহুদিকে দিয়ে ততটা সন্তান পয়দা করাব। শুনে তো চাচী হাসতে হাসতে ফেটে পরলেন। তারপর হাসতে হাসতে বললেন, ‘আচ্ছা এমন কথা মানুষে বলে নাকি। ওরা সব সময় বলত আপনি নাকি বোকা, আমি বলতাম একটা উচ্চ শিক্ষিত মানুষ আবার বোকা হয় কেমনে। এখন তো দেখছি ওরা ঠিকই বলত। আপনি আবার আরেক জনের বউকে বিয়ে দিবেন কেমনে?
হাসান বলল, ‘আমি তো একথা বলিনি যে, ইহলোকে বিয়ে দিব, ঐ মহিলার বিয়ে দিব পরকালে। পরকালে বিচার দুই প্রকারের হবে। মানুষের হবে হিসাব ও বিচার। কিন্তু সাধারণ প্রাণী জগতের হিসাব হবে না, শুধু বিচার হবে, বিচার মানে কিসাস। দুনিয়াতে সবল গরুটা দুর্বল গরুকে যে গোতাটা দিয়েছিল সেই গুতাটাই দুর্বল গরু তাকে ফিরিয়ে দিবে। সবল কুকুরটা দুর্বল কুকুরকে যে কামড়টা দিয়েছিল, দুর্বল কুকুর সেই কামড়টাই তাকে ফিরিয়ে দিবে। কাজেই আমিও আল্লাহ্র কাছে গিয়ে বলব, মালিক আমার, এ ইঞ্জিনিয়ার ও তার বউ আমার বউকে একটা হিন্দুর কাছে বিয়ে দিয়েছে, আমার স্ত্রীর গর্ভে হিন্দুর বাচ্চা উৎপাদন করেছে। কাজেই তুমি আমাকে অথরিটি দাও আমি ইঞ্জিনিয়ারের বউকে একটা ইহুদির সাথে বিয়ে দিব। তার গর্ভে ইহুদিকে দিয়ে ততটা সন্তান উৎপাদন করাব যতটা ঐ হিন্দু আমার স্ত্রীর গর্ভে উৎপাদন করেছে। তারপর ইঞ্জিনিয়ারকে ঐ বাড়ির খুটির সাথে বেধে রাখব। সে চেয়ে চেয়ে দেখবে ইহুদির সাথে তার স্ত্রীর বাসর শয্যা, আলিঙ্গন, বাহুবন্ধন, গর্ভধারন এবং ইহুদির সন্তান লালন পালন।
একদিন আমি যাব, গিয়ে জিজ্ঞেস করব কি হে মশাই ইঞ্জিনিয়ার, নিজের স্ত্রীকে অন্যের বাহু বন্ধনে দেখে কি বুকে খুব খুশি খুশি-আরাম আরাম লাগছে নাকি চোখে পানি ঝরছে। তখন সে যদি বলে, ‘আহঃ এত আনন্দ আমি জীবনে কোন দিন অনুভব করিনি। নিজের স্ত্রীকে অন্যের শয্যায় দেখলে যে এত মজা- এটা যদি আমি পৃথিবীতে বুঝতে পারতাম তাহলে দৈনিক একটা করে বিয়ে করে পাঠিয়ে দিতাম অন্যের শয্যায়। ভাই আপনার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ, আপনি আমাকে মজার খেলা দেখালেন’। সে যদি এই মনোভাব প্রকাশ করে তাহলে আমি তাকে ছেড়ে দিব এবং বেধে রাখার জন্য মাফ চাইব। কিন্তু সে যদি আর্তনাদ করে, ‘আহঃ আমি আর পারছি না। আমি বেঁচে থাকতে আমার চোখের সামনে আমার স্ত্রী অন্যের বিছানায়, এই দৃশ্য আমি আর দেখতে পারব না। আমায় অন্ধ করে দাও, আমায় মেরে ফেল, আমাকে নিস্কৃতি দাও’। তখন তাকে পাকড়াও করব।
তারপর যাব তার স্ত্রীর কাছে, জিজ্ঞেস করব ইহুদির সাথে ঘর সংসার কেমন চলছে? সে যদি বলে চমৎকার, খুব সুখে আছি, ইহুদি যখন বিছানায় ঝড় তুলে তখন আমি আনন্দ সরোবরে তলিয়ে যাই। তাহলে তাকে ছেড়ে দেব। সে ইহুদির ঘর সংসার করতে থাকবে। কিন্তু যদি বলে নিজের স্বামী ফেলে ইহুদির শয্যা আমার জন্য কণ্ঠক, আমায় মেরে ফেল। তখন তাকেও পাকড়াও করব। তারপর উভয়টাকে টেনে হেচড়ে নিয়ে হাজির করব সেই আদালতে- যে আদালত ন্যায় বিচারে প্রতিশ্রুতিশীল। যার বিচারক মহামহিয়ান, কাদেরে মুতলাক। বলব, ‘ইয়া মালিকুল কাহহার, এই সেই দুই মুজরিম- যারা আমার স্ত্রীকে আমার বুক থেকে কেড়ে নিয়েছে। আমার অর্ধেকটা দেহ কেটে নিয়ে গেছে, আমার সন্তানকে মাতৃহারা করে আমার স্ত্রীকে হিন্দুর শয্যায় পাঠিয়েছে। অনন্তর প্রভু আমার! তুমি বলেছ মায়ের খিদমত ফরয, তোমার ইবাদাত তুল্য। কিন্তু আমার স্ত্রী বলেছে আমার মায়ের চুলের মুঠি ধরে কোমরে কয়েকটা লাগিয়ে দিবে। আর এই নালিশটাই আমি করতে গিয়েছিলাম। এই নালিশের অপরাধেই তারা আমার ঘর ভেঙ্গে আমার বউকে দিয়ে একটা হিন্দুর ঘর বাধাল, তুমি মহীয়ান ও গরিয়ান, তামাম সৃষ্টি তোমার, তুমি তাদের ইনসাফ দাতা। এই দুই মুজরিমের বিচার তোমার এখতিয়ারে ন্যস্ত থাকল।
তারপর সে চাচীর দিকে ফিরে তাকাল, তার চোখ থেকে আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে, ‘চাচী সত্যিই যদি ইঞ্জিনিয়ার আর তার বউ আমার স্ত্রীকে ঐ হিন্দুর সাথে বিয়ে দেয় তাহলে ইহলোকে যদি আমি ওদের বিচার নাও করতে পারি তাহলে পরলোকে ওদের এই বিচারটাই হবে, আপনাকে সাক্ষী রাখলাম। দুর্বল দেহে একটানা কথা বলায় সে ক্লান্ত হয়ে গেল, আরেকটু পানি খেয়ে সোফায় ঢেস দিয়ে বসল।
চাচীর অবস্থা কাহিল। সে হা করে এক দৃষ্টে হাসানের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মনে হল পৃথিবীর কোন মানুষ এমন ব্ক্তব্য দিতে পারে না, একমাত্র ভীন গ্রহের প্রাণী ছাড়া। নিজেকে তার অপরাধী মনে হল। চোখের সামনে এমন একটা মানুষের সংসারটা ভেঙ্গে যাচ্ছে অথচ সে কিছুই করতে পারল না। ধরা গলায় বলল, ‘আমাকে মাফ করবেন, আমি আপনার জন্য কিছুই করতে পারলাম না। - তাহলে কি ঐ লোকটার সাথে বিয়ে হয়েই যাবে?- তাই তো মনে হচ্ছে। হাসানের চোখের সামনে ভেসে উঠল, ইঞ্জিনিয়ারের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিভিন্ন ফুলে সুসজ্জিত একটি পাজেরু, ঘরের দরজা দিয়ে বের হল একজন হিন্দু- যে সদ্য মুসলমান হয়েছে। তার গায়ে শেরওয়ানি, গলায় মালা, মাথায় মুকুট। না, সে একা নয়। সে মেহেদি রাঙ্গা একটি হাত ধরে আছে, যে হাতে আগের স্বামীর দেয়া বালা পরা, দেহে তারই দেয়া শাড়ি পরা, তারই দেয়া অন্যান্য অলংকার পরা। তারা পাজেরুর দিকে হাঁটছে। সে তার সন্তান, তার বাচ্চা মুনিরাকে কোলে নিয়ে দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। নব দম্পতি তাদের সোজাসোজি হচ্ছে, নববধুর মুখটা তাদের বরাবর হয়ে গেছে। সহসা তার সন্তান দু’হাত বাড়িয়ে দিয়ে ‘আম্মু আম্মু’ বলে কেঁদে উঠল, আর সাথে সাথে হাসান দু’হাতে মুখ চেপে ডুকরে কেঁদে উঠল, ‘সব শেষ হয়ে গেল, আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম, আমার আর কিছুই থাকল না, আমার সন্তান মা হারা হয়ে গেল, আমি অভিশপ্ত’ বলতে বলতে সে উঠে বেরিয়ে যেতে লাগল।
মহিলাটি করুণ কণ্ঠে পিছন থেকে ডাকল, ‘আরে বসেন বসেন আরো কথা আছে। কিন্তু তার কানে কোন কথা পৌছল না, সে হাঁটছে, শুধু হাঁটছে। না সে বুঝতে পারছে না, সেকি হাঁটছে নাকি গড়িয়ে যাচ্ছে। কারণ সে অনুভব করছে তার দেহে কোন অস্থি নেই, সব বরফের মত গলে পানি হয়ে গেছে, শুধু একটা মাংসের দলা টলছে, গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। হাতির পায়ের মত অস্থিহীন তার দু’টি পা যেন থপ থপ করছে। সে যাচ্ছে, কোথায়, কেন কিভাবে যাচ্ছে সে জানে না। শুধু যাচ্ছে।
বিষয়: সাহিত্য
১৮১৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন