চিঠি (কবর)-৫৯ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১১:৩৪:১৫ সকাল

পরদিন আর কোথাও বের হল না, বাসায় শুয়ে থাকল। বিছানায় লেপটে আছে, যে কেউ দেখে ভয় পেয়ে যাবে। আসলে এটা কি কোন মানুষ নাকি চামড়ায় আচ্ছাদিত একটা কঙ্কাল, তারপর নাকে হাত ধরে হয়ত পরখ করতে চাইবে জীবিত নাকি মৃত। সে রাত বারটা পর্যন্ত বিছানায় শুয়ে বসে কাটাল। বারটার পর তাহাজুদে দাঁড়াল। শেষ রাত্রে জায়নামাজে শুয়ে শুয়ে ভাবছে, আমার স্ত্রী- তাকে আমি রাস্তা থেকে ধরে আনিনি, পথ থেকে কুড়িয়ে আনিনি, প্রেম করিনি, কোথাও থেকে তুলে আনিনি, হাইজ্যাক করিনি, কারো ঘর থেকে ভাগিয়ে আনিনি, বেশ্যালয় থেকে কিনে আনিনি, উত্তরাধিকার সূত্রে পাইনি, কেউ উপঢৌকন দেয়নি, তাকে আমি বিয়ে করেছি। আর বিয়ে করেছি পারিবারিক ভাবে, সামাজিক নিয়মে, রাষ্ট্রীয় আইনে, ইসলামী বিধান অনুসারে। তার পরিবার আমার হাতে তাকে তুলে দিয়েছে, সে স্বেচ্ছায় আমার পা ছুয়ে সেলাম করেছে, সে আমার সন্তানের মা, কাজেই তার উপর আমার একশ একশ মালিকানা প্রতিষ্ঠিত। আর প্রতিষ্ঠিত মালিকানা টিকিয়ে রাখার জন্য সংগ্রাম করলে তাকে জিহাদ বলে, আর মরে গেলে তাকে রাসূল (সাঃ) শহীদ বলেছেন। যেমন তিনি বলেছেন, কেউ নিজের ধন সম্পদ ও মালিকানা টিকিয়ে রাখার জন্য মারা গেলে সে শহীদ। কাজেই আমিও শহীদ হব। স্ত্রীর উপর প্রতিষ্ঠিত মালিকানা টিকিয়ে রাখতে গিয়ে যদি রক্ত গঙ্গা বইয়ে দিতে হয় অথবা শহীদ হতে হয় আমি তাই করব, আমি কাপুরুষ নয়। ঐ শালা বেটা ভার্সিটি শিক্ষকের তো আমার স্ত্রীর সাথে কোন সম্পর্কই নাই, যোগসূত্র নাই অথচ সে আসছে আমার সন্তানের মা, আমার স্ত্রীকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে। আহঃ কী আমার সোনার চান পিতলা ঘুঘু, সে আমার বউকে নিয়ে যাবে, আর আমি বসে বসে পিডার খাব, আয় শালা তুই ঢাকা ভার্সিটির শিক্ষক হয়ে গেছিস বলে মনে করেছিস তিস্তার নাক হয়ে গেছিস, শালা তোর নাক কেটে কর্তাল বানাব।

ফজরের পর তার কিছুটা ঘুম হয়। কিন্তু আজ আর ঘুমাল না, সে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে, পায়চারি করছে আর ভাবছে আচ্ছা যুদ্ধটা কিভাবে কার সাথে হতে পারে? হ্যাঁ, যুদ্ধটা হবে ইঞ্জিনিয়ারের সাথে, আর এর দু’টি অবস্থা হতে পারে। হয়ত আমি গিয়েই হুঙ্কার ছাড়ব শুয়োরের বাচ্চা, আমি নালিশ করলাম, বউ আমার মায়ের চুলে ধরার কথা বলেছে। আর এজন্য তুই আমাকে সাল চিল্লার শর্ত দিয়ে আমার বউকে নিয়ে উলু উলু করতে চাস। আমার বউ ফিরত দে, নইলে তোর ঘাড় ছিলা মোরগের ঘাড়টা ফাটিয়ে দিব। তখন নিশ্চয়ই সেই তিড়িং বিড়িং বুড়াটা আমার দিকে তেড়ে আসবে। আর আমিও যুবক হাতের কয়েকটা লৌহ মুষ্টি বসিয়ে দিয়ে তার চান্দিটা লাল করে দিব। ফল কী হবে? ফল হবে, আমার বউ দৌড়ে গিয়ে আদালতে নালিশ করবে, আমার ভাতার আমার স্বামীকে মেরেছে। সে তো আমাকে ভাতার (অন্নদাতা) মানে, স্বামী মানে না। কাজেই হিতে বিপরীত হবে। আর যদি অনুনয় করে বলি, ‘আমার বউটা দিয়ে দেন, অনেক দিন তো রাখলেন আর কত? এ লোকটা হল রুক্ষ এবং কর্কশ ভাষী। তখন সে খেকিয়ে উঠে বলবে, সাল চিল্লা না দিয়ে বউ পাওয়া যাবে না। নিশ্চয়ই তখন ঝগড়া শুরু হয়ে যাবে। হাতাহাতি মারামারি পর্যন্ত গড়াতে পারে। কাজেই সরাসরি তার কাছে না গিয়ে কোন সুপারিশ পাঠালেই ভাল হবে। এবার সে চিন্তা শুরু করল কার কাছে যাওয়া যায়, কার মাধ্যমে ইঞ্জিনিয়ারকে প্রভাবিত করা যাবে। অনেক চিন্তা ভাবনার পর সে সিদ্ধান্ত নিল বিসিকে যে লোকটা থাকে- সেই ইঞ্জিনিয়ারের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কাজেই তার কাছে গেলেই ভাল হবে।

১০ জুলাই, হাসান মাদরাসা থেকে আর বাসায় ফিরল না। জহুরের নামায পড়ে সরাসরি বিসিকে চলে গেল। কিন্তু লোকটা বাসায় নেই, সে কিচ্ছুক্ষণ ঘোরাফিরা করে রোডের উপর একটা চা স্টলে এসে বসে থাকল। তারপর কিছুক্ষণ পরপর বাসায় গিয়ে খোজ নেয় আর স্টলে এসে বসে থাকে। এতে তার একটা উপকার হল, কারণ তার খাওয়া বলতে গতরাতে কয়েকটা বিস্কুট খেয়েছিল, এ পর্যন্ত আর কিছু খায় নি। কিন্তু স্টলে এমনিতে বসে থাকা লজ্বাকর। তাই সে কিছুক্ষণ পরপর বাসায় যায়, এসে চা, বিস্কুট, কলা ইত্যাদি খায়। আবার যায় আবার এসে খায়। এভাবে তার সময়ও কেটে গেল পেটটাও ভরে গেল। সে বসে বসে ভাবে, ‘আগেও এ লোককে কিছু জানিয়ে ছিল কিন্তু এ তারিখে বউয়ের সব অপকর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরে অনুরোধ করবে ইঞ্জিনিয়ারকে জানাতে, যাতে সে বুঝতে পারে স্বামী নির্দোষ, সম্পূর্ণ দোষ স্ত্রীর। তারপর অনুরোধ করবে স্ত্রীকে এনে দেয়ার।

অবশেষে এশার পর লোকটা বাসায় এল। তার বাসা বলতে সামনে ঝাপ দেয়া দোকানের মত একটা ঘর, তারা সেখানে বসল। হাসান শুরু করল, ফেরদৌসির অপকর্মগুলি সংক্ষেপে একটার পর একটা বয়ান দিতে লাগল। এ লোকটা ছিল মূর্খ অশিক্ষিত এবং ইঞ্জিনিয়ারের মতই রুঢ় স্বভাবের। সে হাসানের দিকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। কারণ হাসানের মত একটা উচ্চ শিক্ষিত তার মত একটা মূর্খের সামনে অবনত হয়েছে, মিনতি করছে। এজন্য সে গর্বে স্ফীত হয়ে উঠেছে এবং হাসানকে হেয় ভাবছে। কিন্তু সে হাসানের কথাগুলি গোগ্রাসে গিলছে আর তা এজন্য যে, মানুষ সাধারণত অন্যের দুঃখের কথা, পারিবারিক বিষয়, স্ত্রী সংক্রান্ত বিষয় শুনতে আনন্দ পায়। লোকটার মধ্যে হিংস্র আনন্দের ভাব ফুটে উঠেছে। হাসান অনেকক্ষণ আলাপের পর তাকে অনুরোধ করল যেভাবেই হোক তার স্ত্রীর বিষয়টা ফয়সালা করে দিতে। লোকটা শেষে বিনয়ের সাথে বলল, আচ্ছা আপনি যান, আমি আব্দুর রউফের সাথে আলাপ করে বিষয়টা মীমাংসার চেষ্টা করব। আপনি দুই দিন পর আসেন। হাসান বেরিয়ে যাওয়ার সময় তার হাতটা ধরে সজল নয়নে করুণ কণ্ঠে বলল, ‘ভাই আল্লাহ্‌র ওয়াস্তে আমার জন্য একটা কিছু করুন। লোকটা বরফের ন্যায় গলে গিয়ে বলল, ‘যান, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব। পরদিন হাসান ঐ লোকের অপেক্ষায় বাসায় থাকল, কারো কাছে গেল না।

১২ জুলাই, সকালে মাদরাসায় গেল। তাদের মাদরাসায় স্থানীয় একজন শিক্ষক ছিল, এলাকার প্রতাবশালী লোক। সে হাসানকে ডেকে নিয়ে মাদরাসার পুকুর পাড়ে দাঁড়াল। তারপর হাসানকে বলল, ‘গত রাতে আপনার ভায়রা ইঞ্জিনিয়ার ও আরো কয়েকজন লোক আমার কাছে এসেছিল। তারা বলল আপনি বউয়ের উপর অত্যাচার করেন, মারেন, অহংকার করেন, শ্বশুর পক্ষের কাউকে মানুষ হিসাবে গন্য করেন না’ ইত্যাদি কারণে আপনার বউ আর আসবে না, আপনার ভাত খাবে না, অভিভাবকরাও আপনার ঘরে আর দিবে না। এখন তারা তালাক চাইছে। তবে তারা আপনার জন্য সহজ করে দিয়েছে, দেন মহরের টাকা দিতে হবে না। শুধু তালাকটা দিয়ে দিলেই তারা খুশি। আমাকে খুব রিকুয়েস্ট করে বলে গেল, যেভাবেই হউক বলে কয়ে হউক, চাপ দিয়ে হউক বাধ্য করে হউক আপনার কাছ থেকে তালাকটা নিয়ে দিতে। খেলা ধুলায় মত্ত হাসি খুশি কোন ব্যক্তিকে হঠাৎ সংবাদ দেয়া হল যে, তোমার বাবা অথবা মা বা সন্তান মারা গেছে- তার যে অবস্থা হয় হাসানেরও ঠিক সেই অবস্থা। তার মুখটা পান্ডুর হয়ে গেছে, ভয় ও ব্যথায় বিকৃত হয়ে গেছে। লোকটা তার মুখের দিকে তাকিয়ে নরম সুরে আবার বলল, একটা বছর তো হয়ে গেল আর কত অপেক্ষা করবেন, আপনার শরীরের অবস্থা দেখেছেন চিনাই তো যায় না, এভাবে কয়দিন বাঁচবেন, কাজেই আমি বলি তালাক দিয়ে আপনি আরেকটা বিয়ে করেন, নিজেকে বাঁচান। হাসান মুখ খুলল, ‘তালাক হলে তো তাকেও অন্যত্র বিয়ে দিবে আমাকেও অন্যত্র বিয়ে করতে হবে। এভাবে দুয়েরই বিয়ের চিন্তা করতে হবে। তারচেয়ে কি এটাই ভাল নয় যে আমরা একত্রেই থাকলাম, আমার বাচ্চাটা বেঁচে গেল।- যে আপনার বউ সেই তো আপনাকে চায় না। তাদের কথা মত বুঝা গেল আপনি স্বেচ্ছায় তালাক না দিলে শক্তি প্রয়োগ করবে, জোর পূর্বক তালাক নিবে। আমি বলেছিলাম তাহলে মেয়ে তালাক দিয়ে দিলেই তো হয় এত ঝামেলার দরকার কি। তারা বলল স্ত্রীর তালাক শুদ্ধ হয় না, তালাক স্বামীকেই দিতে হয়। এদিকে ক্লাসের সময় হয়ে গেছে। হাসান বলল, ‘ঠিক আছে পরে আপনার সাথে এ বিষয়ে কথা বলব, বলেন কখন আসব? লোকটা বলল, ‘বিকালে আসেন’।

হাসান বিকালে গেল। তারা আলাপ করতে করতে মাদরাসার পশ্চিম দিকে একটা আম বাগানে চলে গেল। সেখানে মাগরিবের নামায পরে একটা পুলের পুস্তায় গিয়ে বসল। হাসান তার তিক্ত ইতিহাস সংক্ষেপে বর্ণনা করে বলল, ‘হ্যাঁ আগে ওকে আমার পসন্দ হয়নি, ভালবাসতাম না। কিন্তু বিয়ে করেছি বউ ফেলে চলে যাওয়া তো সম্ভব নয়। এজন্য আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করতাম, কান্নাকাটি করতাম। কিন্তু এখন? সে চলে যাওয়ার পর এই একটা বছরে আমার যা অভিজ্ঞতা হয়েছে, নিজেকে যতটুকু বুঝতে পেরেছি ওকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকা সম্ভব নয়, এর প্রমাণ আমার শরীর- স্বাস্থ্য। তার দেহ আমার দেহে একাকার হয়ে গেছে, তার রক্ত আমার রক্তে বিক্রিয়া হয়ে গেছে। এখন সে আর আমি আলাদা সত্ত্বা নই, এক সত্ত্বা, এক দেহ, সে আমার অর্ধাংশ এবং অর্ধাঙ্গ। কাজেই এ অর্ধাঙ্গ আমার দেহ থেকে কেটে বিচ্ছিন্ন করার অর্থ হল আমাকে মেরে ফেলা। কারণ আমি তালাক দিলে আমার বউকে অন্যত্র বিয়ে দিবে। আর তখন আমি জীবিত থাকতে আমার বউ অন্যের বাহু বন্ধনে যাবে এটা যে আমি শুধু সহ্যই করতে পারব না তা নয়, নির্ঘাত আমি মারা যাব। আর তারা যদি একান্ত তালাক নিতে চায়, আমার স্ত্রীকে অন্যত্র বিয়ে দিতে চায় তাহলে একমাত্র আমাকে হত্যা করেই তা করতে হবে, তখন আর তাদের জন্য কোন বাধা থাকবে না। এ জন্যই আমার সামনে একটি মাত্র পথ খোলা, সেটা হল তারা শত চেষ্টা তদবির করলেও আমি তালাক দিব না। তখন আমার বউ এদিক সেদিক কিছুদিন ঘোরাফিরা করে অবশেষে বাধ্য হয়ে আমার ঘরে আসবে। তখন আমার জীবনটাও বাঁচবে, আমার মেয়ের জীবনও বাঁচবে। এমনকি আমার স্ত্রীর জীবনও বাঁচবে, কারণ অন্য কোন পুরুষের সংসার করে খাওয়ার মত যোগ্যতা এ মেয়েটির নেই। কাজেই আমার সাথে কেউ তালাকের আলাপ করে লাভ নেই।

লোকটা মাথা নিচু করে গম্ভীর হয়ে বসে আছে। কিছুক্ষণ পর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘না, আমি আর তালাকের কথা বলব না। তবে আনবেন কিভাবে, আপনার বউ–ই তো আসতে চায় না। হাসান বলল স্থানীয়ভাবে আমি চেষ্টা তদবির করছি ব্যর্থ হলে বালিয়ার পীর সাব ও আমার আত্নীয়- স্বজনদের নিয়ে আসব। তারাও ব্যর্থ হলে আমার আম্মা আসবেন। তিনিও ব্যর্থ হলে আল্লাহ্‌ ভরসা। তারপর তারা উঠে হাটা শুরু করল। লোকটা বলল, আমি যতটুকু জানি, আপনিও কিছু কিছু বলেছেন এ বউ নিয়ে তো আপনি জীবনেও সুখি হতে পারবেন না। হাসান হাসল, এখন সুখি হওয়ার চেয়ে জীবনে বেঁচে থাকার প্রশ্নটাই বড়। ‘আচ্ছা আরেকটা প্রশ্ন’ লোকটা বলল, আপনার শ্বশুর বাড়ি কেমন, কত বড় লোক। শুনেছি আপনার বউ তেমন সুন্দরীও নয়, শিক্ষিতও নয়, তার উপর বিবাহিতা, বাচ্চা আছে। এমন একটা মেয়েকে ঢাকা ভার্সিটির শিক্ষক ছেলের কাছে কেমনে বিয়ে দেয়। হাসান ঢুক গিলে শুকনা গলা ভিজিয়ে বলল, ‘আপনি কোথায় শুনলেন? - তারাই বলেছে, কিন্তু আপনাকে বলতে মানা করেছে, শুনে যদি আপনি তালাক না দেন। সে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, ‘আসলে ওদের গোস্টিটা অনেক বড়, এলাকায় ফকির বাড়ি নামে পরিচিত। ওদের মধ্যে আগে থেকেই শিক্ষিত লোক আছে, চাকরি বাকরি করে। সেই হিসাবেই হউক বা অন্য যে কারনেই হউক ঐ গোস্টির মেয়েদের ভাল ভাল বিয়ে হয়ে যায়। তবে আসল কথা হল, আমার শ্বশুর ফ্যামেলি তাবলীগ করে, আর তাবলীগিরা শিক্ষা সম্পদ কিছুই খোজে না, শুধু একটা তাবলীগি মেয়ে হলেই হল। কাজেই ভার্সিটির শিক্ষক যদি তাবলীগী হয় তাহলে এটা আশ্চর্যের কিছু না। বাসায় গিয়ে এক অজানা আশংখায় ইঁদুরের ন্যায় তার বুকটা দুরুদুরু কাপে। বিসিকের লোকটা থেকে সুসংবাদ শুনার প্রত্যাশায় সে আশায় বুক বেধে শুয়ে থাকে।

পরদিন হাসান মাদরাসা থেকে ফেরার সময় হোটেল থেকে রুটি ও গোশত কিনে নিয়ে বাসায় এল কিন্তু অতিকষ্টে কোন ভাবে অর্ধেকটা রুটি খেয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে চিন্তা করছে, ‘কী আছে ভাগ্যের ফয়সালা, ঐ লোকটা কী সংবাদ জানাবে’। দুশ্চিন্তায় তার মুখটা পান্ডুর হয়ে গেছে, অস্থি চর্মসার ক্ষীণ দেহটা বিছানায় লেপটে আছে। বুকটা দুরুদুরু কাঁপছে, এই কম্পন বুকের হাড়ের সাথে মিশে থাকা শুকনা মরা চামড়ার উপর দৃশ্যমান। সে রাতের জন্য প্রতিক্ষা করছে। কারণ লোকটা দিনের বেলায় বাসায় থাকে না। মাগরিবের পর গেল কিন্তু বাসায় পেল না। চা স্টলে গিয়ে সময় কাটাল। এশার পর দোকানের মত সামনে ঝাপ দেয়া একটা রুমে গিয়ে বসল। ঝাপটা আধাআধি খোলা। লোকটা পায়ের উপর পা তুলে ডান হাতে বাম হাতের কব্জি ধরে মাথার পেছনে ঠেকিয়ে চেয়ারে আয়েশ করে বসে আছে। হাসান তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে সেই ব্যক্তির ন্যায়- আপিলের পর দীর্ঘ শুনানি শেষে রায় ঘোষণার দিন আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কোন নির্দোষ ব্যক্তি তার ভাগ্যের ফয়সালা শুনার জন্য যেভাবে বিচারকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, হাসানও সেভাবেই তাকিয়ে আছে। তার কান শুনার জন্য উৎকর্ণ হয়ে আছে যে, তার কি মৃত্যু দন্ড হচ্ছে নাকি মুক্তি পাচ্ছে।

লোকটা চিবানো পানের চাবরাটা হাতে নিয়ে জানালার দিকে নিক্ষেপ করে ফেলে হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল- আপনি কি আসলে বউ নিবেন নাকি লোক দেখানো ভান করছেন? ঘোর অন্ধকারে আশার আলোয় হাসানের চোখ দু’টি চকচক করে উঠে। সে বিনয়ের হাসি দিয়ে বলল, ‘এমন প্রশ্ন করছেন কেন? লোকটা গম্ভীর সুরে বলল, ‘এই জন্য যে, আপনি আমার সাথে বউয়ের যে বদনাম করলেন, তাতে আপনি বউ নিবেন বলে তো মনে হচ্ছে না’। হাসানের মুখটা কালো হয়ে গেল। সে বলল, ‘একজন রোগী সে নারী হউক পুরুষ হউক, নিজের গোপন রোগের বিষয়ে কাউকে বলে না, লজ্বা পায়। কিন্তু একজন ডাক্তারের সাথে শুধু বলেই না, আরো বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলে। তদ্রুপ আমিও তো আপনার সাথে বউয়ের বদনাম করিনি, আমাদের ব্যধির বর্ণনা দিয়েছি মাত্র। লোকটা বলল, ‘যাই হউক আপনাকে একটা প্রশ্ন করি, আপনার বোন হউক বা মেয়ে হউক হাতে উচ্চবিত্ত পাত্র থাকতে মধ্যবিত্ত ঘরে বিয়ে দিবেন? প্রশ্নটা বুঝতে পেরে হাসান বলল, ‘আপনাকেও একটা প্রশ্ন করি, ‘আপনার বোন হউক মেয়ে হউক মধ্যবিত্ত ঘরে বিয়ে দিয়েছিলেন তারপর উচ্চ বিত্তের কেউ তার প্রতি হাত বাড়াল তখন কি তাকে এনে উচ্চবিত্তের নাগরের হাতে তুলে দিবেন? লোকটা বুঝল এখন যদি হ্যাঁ বলে তাহলে অনৈতিকতার দোষে সে তিরস্কৃত হবে। কাজেই সে হেসে বলল, ‘শুনেন, বাজে প্যাচাল পেরে লাভ নেই, আপনার বউ আসবে না, ঢাকা ভার্সিটির এক শিক্ষকের সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। এখন আপনি তালাকটা দিলেই ভালয় ভালয় শুভ কাজটা সম্পন্ন হয়ে যায়। আপনি একজন শিক্ষিত মানুষ, আলেম মানুষ, একটা শুভ কাজে ব্যাঘাত ঘটানো আপনার উচিত হবে না, আপনি তালাকটা দিয়ে দেন’।

হাসান বুঝল, লোকটা ইঞ্জিনিয়ারের দালাল হিসাবে কাজ করছে। তার শরীর ঘামছে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম লাইটের আলোতে চিকচিক করছে। শুকনো গলা ভিজানোর জন্য বারবার ঢোক গিলছে কিন্তু গলা ভিজছে না। অগত্যা অপারগ হয়ে বলল, ‘আমি এক গ্লাস পানি খাব। লোকটা বুঝল, মুচকি হাসল, তারপর ছেলেকে ডেকে পানি আনতে বলল। হাসান পানিটা খেয়ে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘বিয়েটা তো আর পুতুল খেলা নয় যে আজ করলাম কাল ভেঙ্গে দিলাম। আমার একটা বাচ্চা আছে, স্ত্রীর কত অত্যাচার সহ্য করেছি কিন্তু বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে কোনদিন তালাকের চিন্তা করিনি। কিন্তু এখন এমন কি কারণ ঘটল, আমি কি অন্যায় করলাম যে আমাকে তালাক দিতে হবে? লোকটা বলল, ‘অন্যায় টন্যায় কিছু নয়, আপনার বউ আসবে না। সে বলল, কেন আসবে না, এর কারণটা কি? আমি কি শারীরিকভাবে অক্ষম, আমি কি মদ গাজা খাই, বউকে অত্যাচার করি, বউকে ভাত কাপড় দিতে পারি না, নাকি যৌতুক চাই- যে কারণে আমার বউ আসবে না। আজ এক ভাতার কাল এক ভাতার এটা তো কোন ধার্মিক পরিবারের নীতি হতে পারে না। এরা তো সেক্যুলারিস্টদের চেয়েও জঘন্য।

লোকটা বলল, ‘বড় কথা হল, আপনার সাথে ওদের বনিবনা হচ্ছে না, তার উপর ভাল পাত্র পেয়েছে। হাসান বলল ঠিক আছে, ভাল পাত্র পেলেই যদি বিয়ে ভেঙ্গে দিতে হয় তাহলে এক্ষেত্রে কোরআনের বিধান মোতাবেক ফয়সালা হবে। মূর্খ লোকটা চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল কোরআনের বিধান কি? হাসান সুরা নিসার আয়াত পড়ে শুনায়, ‘ওয়া ইন খিপতুম শিক্বাক্বা বাইনাহুমা--- যদি তাদের মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ হওয়ার মত পরিস্থিতিরই আশঙ্কা কর, তবে স্বামীর পরিবার থেকে একজন এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন সালিস নিযুক্ত করবে। তারা উভয়ের মীমাংসা চাইলে আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছু অবহিত। (৪: ৩৫) কোরআনের বিধান শুনে লোকটার কপালে ভাজ পড়ল, কারণ সেও ধার্মিক ও তাবলীগি, মনে হচ্ছে যেন ভড়কে গেছে। বিরস কণ্ঠে বলল, ‘ঠিক আছে, কোরআনের হুকুম অনুযায়িই তো কাজ করতে হবে। হাসান বলল, ‘হ্যাঁ ইঞ্জিনিয়ারকে বলুন একটা তারিখ দিতে, সেই তারিখ মোতাবেক আমি আমার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধব ও শুভাকাংক্ষিদের বলব। তখন উভয় পক্ষ বসে সম্মিলিতভাবে যে সিদ্ধান্ত নেয়- সেই মোতাবেক কাজ হবে’ বলে সে উঠে হাত বাড়িয়ে দিল। লোকটা আগে মনে করেছিল হাসানকে বলে কয়ে নিজেই তালাকের ব্যবস্থা করতে পারবে কিন্তু কোরআনের নির্দেশ শুনে সে হীনবল হয়ে পরেছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও দাঁড়িয়ে হাসানের হাত ধরে বিরক্ত কণ্ঠে বলল, ‘ঠিক আছে আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার, যা ভাল মনে করেন সেভাবেই করেন। তবে কোন লাভ হবে বলে মনে হয় না। হাসান বলল, ‘আপনি আরেকটু চেষ্টা করুন যদি কোন ফয়সালা করতে পারেন তো ভাল। অন্যথায় আমাকে বসার তারিখ এনে দিবেন’ বলে সে বেরিয়ে গেল।

কোন বুভুক্ষু সরকারি গোদামে রিলিফের ঘোষণা শুনে গিয়ে শুন্য হাতে ফিরে এলে তার মনের যে অবস্থা হয় হাসানেরও সেই অবস্থা। সে হেটে যাচ্ছে, কিন্তু নেশা গ্রস্থের ন্যায় তার দেহটা টলছে, কোন রকমে বাসায় গিয়ে তার অবসন্ন ক্ষীণ দেহটা ধপাস করে বিছানায় ছেড়ে দিল। ১০ জুলায়ের পরে সে আর বাসায় ভাত রাধে নি। মাঝে মধ্যে হোটেল থেকে রুটি কিনে এনে খেত। কিন্তু এখন রুটি আনাও বন্ধ। কারণ সে রুটিও খেতে পারে না, উগলে আসে। কিনে আনা কয়েকটা রুটি পরে আছে, বাসী হয়ে ছাতা পরে গেছে। যখন একেবারে অচল হয়ে যায় তখন ঘরে বৈয়ামে রাখা কিছু চানাচুর খায়, দুয়েকটা বিস্কুট খায়। তাও খেতে না পারলে দু’তিনটা বিস্কুট গ্লাসে গুলিয়ে খায়। এভাবে অস্থিময় একটা দেহে কোন রকম প্রাণটা ধরে রেখেছে। বিসিক থেকে এসে সে বিছানায় শুয়ে থাকল। শুয়ে থাকা বলতে বিছানার উপর একটা কঙ্কাল পরে আছে, চামড়া শুকিয়ে হাড়ের ভিতর ঢুকে গেছে। পাখির বাসার মত কোটরের ভিতরে দু’টি চোখে আশার আলো চকচক করছে, তার স্ত্রী সন্তান আসবে, তাদেরকে সে ফিরে পাবে।

রাত বারটা পর্যন্ত নিথর হয়ে শুয়ে থাকল। বারটার পর নামায পড়ল, তাসবিহ পড়ল, তারপর জায়নামাজে শুয়ে শুয়ে ভাবছে, ‘একটা একটা করে আমার সকল আশার বাসা ভেঙ্গে গেল। কেউ বিষয়টা ফয়সালা করে দিতে পারল না, এখন কোন পথে যাব, মামলা করব? তাহলে তো উপায়ই নাই, তারা আরো ক্ষেপে যাবে, তখন আমার স্ত্রী উল্টো আমার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিবে। এখন একমাত্র উপায় হল সালিশ ডাকা, আমার আত্মীয় স্বজন ও জামালপুরের গন্যমান্য লোকদের নিয়ে বসা। কিন্তু এটা করলে তারা তো কোনভাবেই বসবে না। কারণ এতে আমার স্ত্রী ও ইঞ্জিনিয়ারের অন্যায়গুলি লোকসমক্ষে প্রকাশ হয়ে পরবে। কাজেই তারা তারিখও দিবে না বসবেও না। এখন উপায়? তাহলে কি আমার স্ত্রীকে আর ফিরে পাব না, খাচায় বন্ধি পাখির মত তার অসহায় আত্মাটা বুকের পাঁজরে মাথা ঠুকে মরে, খাচা ছেড়ে উড়ে যেতে চায়। চোখের কোণ বেয়ে ফোটা ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরে। সে জড় পদার্থের মত নিথর হয়ে জায়নামাযে পরে থাকে। নিজেকে মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃস্ব, অভিশপ্ত, মানব জাতির একটা বোঝা। হঠাৎ তার মনে পরল ফেরদৌসির স্কুল শিক্ষিকা চাচীর কথা। আনন্দে তার মুখটা ঝলমল করে উঠল। আবেগে সে জায়নামাজ থেকে উঠে পায়চারি করতে করতে ভাবল, ‘আমার শাশুড়ি একজন সহজ সরল মানুষ, ঐ মহিলাকে দিয়ে যদি তাকে বুঝানো যায় তাহলে অবশ্যি তিনি এই সর্বনাশা কান্ড থেকে বিরত থাকবেন। এমনকি বড়াপাকে বুঝালে সেও বুঝবে। আবার তার অন্ধকার ভুবনে আশার প্রদীপ জ্বলে উঠল।

বিষয়: সাহিত্য

১০০১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File