চিঠি (কবর)- ৫৪-৫৫ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২১ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০৫:২৬ দুপুর
১। আস- সালামু আলাইকুম, দেড় মাস অনুপস্থিতির কারণে দুঃখিত, সিরিজটার নিয়মিত পাঠকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আসলে বিভিন্ন ঝামেলায় সময়টা কেটে গেছে। এখন এক নাগারে শেষ করব ইংশাআল্লাহ।
২। গ্রাম্য প্রবাদ- সারাদিন গেল আলে জালে, সন্ধ্যায় ধরল মরিচের ঝালে। আসলে সবকিছুতে শেষ মুহুর্তেই ঝালটা শুরু হয়। গ্রন্থটাতেও মূল ঝাল শুরু হয়ে গেছে। কাজেই বাকী লেখাটুকু টুক্করু মেরে নয় সবাই মিয়মিত পড়ুন।
৩। আপনি পড়বেন জানার জন্য। কারণ কোন হতভাগার আত্মজীবনী কেন্দ্রিক এ এক ব্যাতিক্রমি ট্রাজেডি। কাজেই ব্যতিক্রমি স্বাদ আস্বাদন আপনার দরকার আছে।
৪। আর আমার স্বার্থ হল, সিরিজটা গ্রন্থাকারে প্রকাশ করা আমার একান্ত ইচ্ছা, পাঠকদের সমালোচনা থেকে বুঝা যাবে এটা কি আসলে প্রকাশের যোগ্য নাকি চুলোয় দেয়ার যোগ্য। কাজেই চাঁছাছোলা সমালোচনা করুন, সমালোচনার বন্যা ছুটিয়ে দিন, কিন্তু দয়া করে কাল বৈশাখী ছুটাবেন না, যাতে আমার পাত-তাড়ি গুটিয়ে ব্লগটা ছেড়েই পালাতে হয়।
৫। এ লাইনে আমি নতুন লেখক। কাজেই সাহিত্যামোদিগণ সাহিত্যিকানা সমালোচনা করুন। লেখাটায় খোদাদ্রীহিতা ও অশ্লীলতা আছে, সাহিত্য হিসাবে এ ডুজ কতটুকু দেয়া যায়- এর উপরও সমালোচনার সাইক্লোন চালিয়ে দিন। তাতে আমি নিজ সম্পর্কে ও লেখা সম্পর্কে আন্দাজ নিতে পারব। কাজেই শাকচুন্নির মত এসে ফিটফিট করে পড়ে মিটমিট করে চলে যাওয়া চলবে না। নো ছাড়াছাড়ি ডু মারামারি (মন্তব্য)।
৬। আল্লাহ তা’লা গ্রন্থাকারে প্রকাশ করার তাওফিক দিলে এর নাম হবে কবর। এই নাম করণের কারণ শেষ পর্বে গিয়ে বুঝা যাবে। অবশ্য প্রথম পর্বেও বুঝা যেত কিন্তু সেটা ব্লগে দেয়া হয় নি, গ্রন্থে দেয়া হবে। আসলে ৬ই মে-এর আকস্মিক একটা ঘটনায় অপরিকল্পিত ভাবে লিখাটা শুরু করেছিলাম। এখন গুছিয়ে নেয়া হচ্ছে।
৭। পাঠকদের মনে প্রশ্ন হল, এটা কি আসলেই সত্য ঘটনা নাকি কাল্পনিক। উত্তর হল, ৩৮ নং পোস্টে বলা হয়েছে হাসান ফেরদৌসির গন্ডগোলের সময় ইঞ্জিনিয়ারের ছেলে এসে বলল, খালু আগামি শুক্রবার বাসায় থাকেন যেন, সবাই বসবে। তখন স্ত্রীর প্রতি হাসান ছিল খুবই ক্ষিপ্ত, তাই সে বউয়ের অপকর্মগুলি সবাইকে জানানোর জন্য সিদ্ধান্ত নেয়। তখন তাদের আড়াই বছরের দাম্পত্য জীবনে স্ত্রী যেসব অপকর্ম করেছিল- যেগুলি স্বরণ ছিল, সেসব খাতায় টুকে নেয়। কিন্তু সব ঘটনা স্বরণও ছিল না লিখাও হয়নি। এখন ঐ খাতাটাই এই সিরিজ, লেখক নতুন করে কিছু লেখেনি। কাজেই মিথ্যার কিছু নাই, বিশ্বাস না হলে আসুন, সেই খাতা ও ফেরদৌসির লিখা তালাকের কাগজগুলি এখনো আছে, এ গুলির ডি এন এ টেস্ট করিয়ে দেখতে পারেন।
৮। দ্বিতীয় পর্ব পর্যন্ত সব সত্য। তবে দুর্ভিক্ষ পীড়িত কংকালসার হয়ে যাওয়া- এটুকু ফানুস জড়ানো হয়েছে তৃতীয় পর্বের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য। মূল ঘটনাটাই ট্রাজেডি, এরপরেও গ্রন্থটিকে একটা চূড়ান্ত ট্রাজেডি হিসাবে রুপদানের জন্য তৃতীয় পর্বে আধাআধি মিশ্রন থাকবে। এবার সমালোচনার কুড়াল নিয়ে মাঠে নামুন।
(৫৩ থেকে ৫৮ পর্যন্ত একই প্রেক্ষাপট, মিলিয়ে পড়ুন) ।
কেন এমন হল, অমন তো কথা ছিল না। কেন আমি ও আমার সন্তান এই করুণ ভাগ্যবরণ করতে যাব। আমি তো কোন অন্যায় করিনি। স্ত্রীকে কোন দিন মারিনি, অত্যাচার করিনি অথচ মেয়েরা কত অত্যাচার সহ্য করে স্বামীর ঘর করে। গ্রামাঞ্চলে মুর্খ লোকদের মধ্যে দেখা যায় স্বামী হালের লাঠি দিয়ে, মুগুর দিয়ে পিটিয়ে স্ত্রীর হাত, পা, পাজরের হাড় ভেঙ্গে ফেলে, মাথা ফাটিয়ে দেয়, থাবড়িয়ে থাবড়িয়ে কান ঠসা করে দেয়। বিড়ালের মত ছেঁচা মেরে নাক থেতলে দেয়, গরুর চাড়ির পানিতে মুখ মাথা ঠেসে ধরে, চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে রাস্তায় নিয়ে লাথাতে থাকে আর বলতে থাকে, ‘যা, তোর বাপের বাড়ি যা’। অথচ সেই সতী-সাধ্বী-লক্ষীরা স্বামীর দু’টি পা জড়িয়ে ধরে আর্তনাদ করে, ‘আমাকে এই দু’টি পায়ের উপর থেকে মরতে দাও। আমি তোমার ভাত কাপড় চাই না, আমি বাড়ি থেকে এনে খাব, হাস-মুরগী, গরু-ছাগল রেখে খাব, বাদীর মত তোমার সব কাজ করে দেব তবুও আমাকে তোমার গোয়ালের কোণায় একটু ঠাই দাও, তোমার বারান্দায় একটু আশ্রয় দাও, আমি তোমার পায়ের উপর পরে মরব তবুও তোমাকে ছেড়ে যেতে পারব না’। এই মহীয়সীরা নিজের জীবন বিপন্ন করে তবুও স্বামী ফেলে চলে যায় না।
আবার শিক্ষিত সমাজের মেয়েরাও কত অত্যাচার সহ্য করে। কত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার মেয়েদের উপর স্বামী অত্যাচার করে, সিগারেটে সুখটান মেরে স্ত্রীর শরীরে চেপে ধরে, মদের বোতল মুখে ঠেসে ধরে, গায়ে পিঠে গরম ইস্ত্রি চালিয়ে দেয়, কারেন্টের চ্যাকা দেয়, স্ত্রীর সামনে অন্য মেয়েদের নিয়ে কাতুকুতু করে, তবুও এসব বিদুষী মহীয়সীরা স্বামী ফেলে চলে যায় না। স্বামীকে রোজগার করে খাওয়ায় অথচ স্বামীর পাশবিক অত্যাচার সহ্য করে তারই সাথে কাঁঠালের আটার মত লেগে থাকে। স্বামী শাশুড়ি ননদির অত্যাচারে কত নারীর রক্তাশ্রু ঝড়ে পড়ছে অথচ স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে, একটি সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে দাসী বাদীর মত পরে থাকে। কত নারী বিধবা হয়ে একটি সন্তানকে বুকে জড়িয়ে স্বামীর ভাঙ্গা ঝুপড়িতে মানবেতর জীবনের পরাকাষ্টা দেখায়। ওরা কেউ স্বামী ফেলে চলে যায় না। অথচ আমার স্ত্রী বিনা কারণে স্বামী- সন্তান ফেলে চলে যাচ্ছে, কেন এমন হল? ঐ উর্ধ্ব জগতের বিধায়ক, জবাব দে, কেন এমন হল? আমি তো কোন অন্যায় করিনি, অত্যাচার তো বহুদুর, বরং স্ত্রীই আমার উপর চালিয়েছে অমানুষিক নির্যাতন। তার কথার জ্বালায় নীরবে চোখের জল ফেলেছি, তার ঝগড়ায় জীবন তাতিয়ে উঠেছে, সে আমাকে ও আমার পরিবারকে অন্যায় ভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে, আমাকে লাথি মারার কথা বলেছে, আমার মাকে চুলে ধরার কথা বলেছে। এতসব অমার্জনীয় অপরাধের পরেও কোনদিন তাকে গালি দেইনি, মারিনি, ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা বলিনি। এরপরেও সে আমাকে ফেলে চলে গেল, কেন, কেন? কে দেবে এর জবাব?
সে আবার গাছে হেলান দিয়ে বসল। স্ত্রীর সাথে তার অতীত স্মৃতিগুলি চোখের সামনে ভাসতে লাগল, ‘সেও তো আমাকে ছেড়ে যেতে চায় না, যদি চাইতই তাহলে সেই বিদায় বেলায় ইঞ্জিনিয়ারের বাসায় ঐ করুণ চাহনির কী অর্থ, সেই ব্যকুলতার কী মানে?
বিয়ের দুই মাস পর সে ঢাকার উত্তরায় তার ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে গেল, আমার যেতে কয়েকদিন দেরি হল। এর মধ্যে সে পাগল হয়ে আমাদের বাড়িতে ছুটে যেতে চাইল। সেদিন আমি না গেলে পরদিন সে অথবা তার ভাই আমাদের বাড়িতে থাকত। সে তাদের বাড়িতে থাকলে ভয় পেত যে, আমি তাকে ফেলে চলে যাব। শহরে থাকলে সে আমার সাথে ঝগড়া করত, আমি উঠতে চাইলেই সে মনে করত আমি তাকে ফেলে চলে যাচ্ছি, আর তখন সর্বহারার মত আমাকে ঝাপটে ধরত, চেপে ধরত, আমার পিঠে কংকনের খাজ বিধে যেত, ব্যথা পেতাম, সে আমার বুকে মাথা রেখে কাঁদত, ‘আমার আর কিছুই থাকল না’। আমাদের বাড়িতে থাকলে আমার যাওয়ার দেরি হলে কাঁদত। তাকে জামালপুর রেখে আমি বাড়িতে গেলে কাঁদত, তাকে ফেলে চলে গেছি কিনা। কিন্তু আসার সাথে সাথেই বৃষ্টির পর সূর্যমুখীর হাসি ফুটে উঠত। তাহলে এমন হল কেন। সেও আমাকে ফেলে যেতে চায় নি, আমিও তাকে ছেড়ে দিতে চাইনি, তবুও কেন এমন হল। তাহলে এটা কি নিতান্তই ভাগ্য। ললাট লিখন?
সে গভীরভাবে চিন্তা করল, তারপর স্বগতোক্তি করল হ্যাঁ নিতান্তই ভাগ্য লিপি, ললাট লিখন। ভাগ্যের লিখন না যায় খণ্ডন। আর ভাগ্য লিখা হয় ঘটিতব্যের আগেই, আমার ভাগ্যও লিখা হয়েছে বহু আগে।
আমার পরিবার বলতে তিনজন- আমি, আমার স্ত্রী এবং অভিভাবক হিসাবে শাশুড়ি। আমার ভাগ্যে যা ঘটতে যাচ্ছে এ তিন জনকেই পরাম্পরায় স্বপ্নে দেখানো হয়েছে। আমার স্ত্রী স্বপ্নে দেখল কেউ মোমবাতি জ্বালিয়ে তার জন্য দাঁড়িয়ে আছে, অপেক্ষা করছে। আবার ঢাকার উত্তরায় তার ভাইয়ের বাসায় গিয়ে স্বপ্নে দেখল- সে তার বাবার সাথে শুয়ে আছে। তারা ব্যাখ্যা করল মুনিরার স্থলে মুনির হবে, অর্থাৎ আমার ছেলে হবে। কিন্তু পরের রাত্রে আমার শাশুড়ি স্বপ্নে দেখলেন, তার মেয়েকে অন্যত্র বিয়ে দিচ্ছেন আর আমার কথা বলছেন, ‘আমার আগের জামাইটা তো ভালই ছিল তাহলে মেয়েকে অন্যত্র বিয়ে দিচ্ছি কেন? এ স্বপ্নের কথা শুনার পর আমার বালিকা বধু পাগল হয়ে উঠল। সে ভাবল আমি চলে গেছি আর তার কাছে যাব না। তখনি সে পাগলের মত আমাদের বাড়িতে ছোটে যেতে চাইল। তাকে থামিয়ে রাখা হল। সেদিনই সন্ধায় আমি গিয়ে হাজির হলাম আর বাসাটা কলহাস্যে মুখর হয়ে উঠল।
আমার নব বধুকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে প্রথম বেড়ানোর সময় স্বপ্নে দেখলাম, আমাদের পুরাতন সিন্ধুকটার উপর একজন প্রৌঢ় লোক আমার বউকে নিয়ে শুয়ে আছে। উভয়কে হত্যা করার জন্য ছুটাছুটি শুরু করেছিলাম কিন্তু জাগ্রত হয়ে দেখলাম ঘামে নেয়ে গেছি। কাজেই তিন বছর আগে আমার ভাগ্যের যে ফয়সালা করা হয়েছে এখন আমি শুধু তার বলির পাঠা হচ্ছি। কিন্তু আর কতকাল বলির পাঠা হতে থাকব। একই পাঠাকে আর কত বার বলি দেয়া হবে। জন্মের পর থেকে তো বলিই হচ্ছি শুধু বলিই হচ্ছি। এই পৃথিবীতে কোনদিন আমি সুখের পায়রা ছিলাম না, আজন্মই আমি ভাগারের কুকুর। সোনার চামচ মুখে নিয়ে নয়, বিষের চামচ মুখে নিয়ে দুনিয়াতে আমার আগমন। জন্ম থেকে জ্বলছি আর কতকাল জ্বলব।
প্রথম বলি হয়েছিলাম আমার বাবার মৃত্যুর দিন। নয়টি ইয়াতিমসহ বিরাট বিশাল পোষ্য ভারাক্রান্ত ব্যয়বহুল একটি পরিবার- যার মাসিক খোরাকই লাগত শুধু ২৪ মন ধান, অবলম্বন শুধু কৃষি জমি। পনের বছরের এক বালকের পক্ষে সেই হিমালয়ের বোঝা কাঁধে নিয়ে পৃথিবীর পথে হাটা কতটা আরামদায়ক আর আনন্দপ্রদ পৃথিবীর খুব কম ননীর পুতুলরাই তা বুঝে। যে বয়সে ফুলের সাথে আর পাখির সাথে আমার গান গেয়ে বেড়ানোর কথা সেই বয়সে পৃথিবীর চোরাবালিতে আমার পা আটকালো কেন? আমার কি কোন অন্যায় ছিল, আমার বাবার মৃত্যুর পিছনে কি আমার হাত ছিল? এটা ছিল নিতান্তই আমার ভাগ্যলিপি। দ্বিতীয়বার বলি হলাম পর পর দু’টি বোন মারা গেল- যাদেরকে সন্তান বাৎসল্যে লালন- পালন করেছিলাম। এরপর থেকে নিত্য দিন বলি হতে থাকলাম। দুনিয়ার কমন দৃশ্য হল, বাবা না থাকলে আপনজনেরা দেখা শুনা করে, প্রতিপালন করে কিন্তু আল্লাহ্ আমাকে এমন কিছু আপনজনের নিয়ামত দিয়েছিলেন, যাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা এবং আন্তরিক আকাংখা ছিল আমাকে এবং আমার পরিবারকে পৃথিবীর সীমানা থেকে মুছে ফেলা। কেন, আমি তো তাদের কোন অন্যায় করিনি, অনিষ্ট করিনি, অনিষ্ট চিন্তা করিনি। তাহলে কেন পৃথিবীর নিকৃষ্টতম চশমখোর আত্নীয়-স্বজন আমার ভাগ্যে জুটল- যারা ছিল বিচ্চুর মত? হ্যাঁ এটা ছিল আমার ভাগ্যলিপি।
আমি একজন শিক্ষক। কাজেই আমি বলতে পারি, আই অ্যাম দ্য আর্কিটেক্ট অব এ নেশন। যে কোন শাস্ত্রের যে কোন ছাত্রকে জ্ঞান দান করার মত কিছু না কিছু আল্লাহ্ আমাকে দিয়েছেন, কিন্তু এটাই আমার জন্য কাল হল। আমি যে প্রতিষ্ঠানেই গিয়েছি, যারা পড়ায় না, পড়াতে পারে না, পড়ানোর যোগ্যতা নেই, তাদেরই আমি শত্রু হলাম। আমি যখনি বলেছি পড়ান, ছাত্রদের হক আদায় করেন, বেতনটা বৈধ করেন তখন তারা নিজেদের সংশোধন না করে আমাকে বলি দিতে উদ্যত হয়। আর আমাকে সংগ্রাম করতে হয়। এটা আমার ভাগ্যলিপি।
আমার শিরাগুলি যে ব্যক্তির রক্ত বহন করছে সেই রক্ত কখনো কোন বাতিলের সাথে, অন্যায় যুলুম অবিচার শোষণ ত্রাসনের সাথে আপোষ করে না, করতে পারে না। সঙ্গত কারণেই যালিমের হাতটি ধরে বলেছি ভাই যুলুম করো না, সে আমাকে বলি দিতে চেয়েছে। শোষকের হাতটি ধরে বলেছি শোষণ করো না, অপরাধীর হাতটি ধরে বলেছি ভাই অপরাধ করো না, ইভটিজারের হাতটি ধরে বলেছি ভাই ইভটিজিং করো না, আর তখনই তারা আমাকে প্রতিপক্ষ ভেবেছে, বলি দিতে চেয়েছে। এমনিভাবে জীবনের প্রতিটা পদে পদে, ঘাটে ঘাটে, বাকে বাকে আমি মানুষের কথা বলেছি, ন্যায়ের কথা বলেছি, ইনসাফের কথা বলেছি, শিক্ষার কথা বলেছি, বিপন্ন মানুষের অধিকারের কথা বলেছি, আর তখনি মানুষ নামের হিংস্র শ্বাপদেরা আমার পিছু নিয়েছে, যোপকাস্টে টেনে নিতে চেয়েছে, আমার জীবন করে তুলেছে যন্ত্রনাদায়ক। এসব আমার অন্যায় নয়, এসবই আমার ভাগ্যলিপি।
সর্বশেষ ভাগ্য আমাকে এনে দাড় করিয়েছে আমার স্ত্রীর মোখোমুখি। স্বামী ত্যাগের অনুবিন্দু কারণ না থাকা সত্ত্বেও সে আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কাজেই আমি মানুষ নয়, কুকুর, জীব-জন্তু, পোকা-মাকড়- যার না আছে পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষের কাছে কোন অধিকার, কোন আশা, কোন প্রাপ্তি আর না আছে আল্লাহর কাছে। আছে শুধু লাঞ্চনা, গঞ্জনা আর বঞ্চনা। দুনিয়ার যত দুঃখের পেয়ালা, আল্লাহ্ একটা একটা করে আমাকে পান করাচ্ছেন। ট্রাজেডি, ট্রাজেডি, আপাদমস্তক ট্রাজেডি, আমার জীবনটাই ট্রেজিক। কিন্তু শেক্সপেরীয় ট্রাজেডি নয়। কারণ ম্যাকবেথ ভুল করেছিল, লোভ করেছিল। সে স্ত্রীর প্ররোচনায় তার রাজাকে হত্যা করে রাজা হয়েছিল। এজন্যই পরবর্তীতে তাকে নির্মম পরিণতি বহন করতে হয়েছিল। কিন্তু আমি তো কোন অন্যায় করিনি, ভুল করিনি। আমি মানুষের ভালোর জন্য কল্যাণের জন্য উপদেশ দেই, উপকার করি আর তারা আমার অপকার করে। আমার কোন ভুলের কারণে মধ্য বয়সে আমার বাবার মৃত্যু হয়নি। আমার কোন অন্যায়ের কারণে স্ত্রী আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে না। এটা নিতান্তই আমার ভাগ্যলিপি যা লিখা হয়েছে তিন বছর আগে। কাজেই এটা গ্রীক ট্রাজেডি।
গ্রীক পুরানানুযায়ি অলিম্পাসের দেবতারা মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলত, খেয়াল খুশির বশে মানুষকে শাস্তি ও ভোগান্তির দিকে ঠেলে দিত। অলিম্পাসের দেবতারা ইডিপাসের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলল। হতভাগ্য ইডিপাস অজ্ঞাতসারে তার বাবাকে হত্যা করে পৃথিবীর অভুতপূর্ব এবং পর সেই জঘন্য কর্মটিই শুধু করল না পাঁচ পাঁচটি সন্তানও জন্ম দিল। তারপর বাহ্যত স্ত্রী উহ্যত ভিন্ন সম্পর্কের অভিশপ্ত নারী যুকাস্ট্রা আত্মহত্যা করল। আর তারই মাথার ক্লিপ দিয়ে ইডিপাস নিজের দু’টি চোখ উপড়ে ফেলে সিংহাসন ছেড়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে গেল। অথচ এসবের পিছনে রাজা ইডিপাসের কোন লোভ বা অন্যায় ছিল না, সে ছিল শুধু দেবতাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার বলি। একইভাবে সেই একক দেবতা- যিনি এই মহাবিশ্বের মহাধিশ্বর, আমি ও আমার পূর্ব পুরুষরা আজন্ম যার পূজা করেছি, পূজা করেছি দৈনিক পাঁচবার- তিনি আমার ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন। আমাকে তার খেয়ালিপনার ক্রীড়নক বানিয়েছেন। পৃথিবীর যত বিষাদ আর অস্বাদ সিন্ধু আছে সবগুলিই তিনি আমাকে দিয়ে আস্বাদন করিয়েছেন এবং করাচ্ছেন।
তিনি আমাকে এতই ভালবাসেন যে, পৃথিবীর যত দুঃখ, ব্যথা, যন্ত্রনা, লাঞ্চনা, গঞ্চনা, বঞ্চনা আছে সবগুলির পেয়ালা তিনি আমাকে একটার পর একটা গোট গোট করে পান করাচ্ছেন। আর পৃথিবীর সুখ শান্তি আরাম আয়েশ ও ভোগ বিলাসের জন্য তো অন্যরাই আছে, সেখানে আমার দরকার নাই। আমার প্রভু আমাকে স্বরণ করেন যখন তার হাতে দুঃখ কষ্ট ও লাঞ্চনার পেয়ালা লবালব হয়ে যায়। এই হল সেই সত্তার সাথে আমার সম্পর্ক- সারা জীবন একনিষ্ঠভাবে আমি যার পূজা করেছি। সারা জীবন তার ইবাদাত, তার আরাধনা উপাসনা করে এই আমি প্রতিদান পেলাম।
আমি ও আমার পূর্ব পুরুষ প্রভুর সন্তুষ্টির জন্য সারা জীবন যে তপস্যা করেছি, যে দাসত্ব করেছি এখন তিনি আমাকে এর পুরুস্কার দিচ্ছেন। পুরুস্কার দিচ্ছেন তিনি আমার দেহটা করাত দিয়ে চিড়ে দু’ভাগ করে অর্ধেকটা দেহ এবং কলিজার বোঁটাটা চিড়ে আমার কলিজাটা দিয়ে দিচ্ছেন অন্যকে। দিয়ে দিচ্ছেন ঢাকা ভার্সিটির এক শিক্ষককে আর আমাকে ও আমার সন্তানকে বলছেন, ‘মর গিয়ে ভাগারে’। এর চেয়ে বড় স্বৈরাচারীতা, এর চেয়ে স্বেচ্ছাচারীতা, এর চেয়ে বড় জুলুম আর কি হতে পারে? এ জন্যই তো ইডিপাসের সন্তান দেবতাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল।
হাসানের মেরুদন্ড সোজা হয়ে আসে। গ্রীবা ফুলে উঠে। নিঃশ্বাস ঘনতর হয়। ঘনঘোর অন্ধকারে অক্ষি গোলকের পরিধি ব্যপ্ত হয়। বুকের ছাতি ফুলে উঠে। শরীর স্ফীত হয়ে উঠে। মানবিক চেতনা ও অনুভূতি বিলুপ্ত হয়, পশুত্বের অনুভূতি ও শয়তানী শক্তি তীব্রতর হয়। ব্রহ্মপুত্রের তীর, ঐ জায়গাটুকু আযাযিল ও তার দলবল দখল করে নেয়। হায় চির হতভাগ্য হাসান, বদবখত হাসান ক্রোধে ফেটে পরে। গুরি গুরি বৃষ্টি হচ্ছে, বহুদিন যাবত সে চুল কাটে না, শাখা প্রশাখা বিশিষ্ট গাছের মত তার মাথার চুল ঝাঁকড়া হয়ে আছে। সহসা সে ক্রোধোন্মত্ত হয়ে হিংস্র পশুর মত মুখে একটা বিকট শব্দ তুলে ভেজা সিংহ যেভাবে কেশর ঝাড়া দেয় সেভাবে তার ভেজা ঝাঁকড়া চুল দু’দিকে ঝাড়া দিয়ে মাটিতে হাত মারল। আর হাতের নীচে কোন ইটের টুকরা বা মাটির ঢেলা পেয়ে তা উর্ধ্বে ছুড়ে মেরে উঠে দাঁড়াল, যেন একটা দানব পাতাল ফেরে উঠে মেঘ লোকে শির তুলল। তারপর দক্ষিণ হস্ত উর্ধ্বে নিক্ষেপ করে সহসা গর্জে উঠল, ‘ঐ স্বৈরাচার’। ব্রহ্মপুত্রের তীর, সেই গর্জনে উন্মুক্ত প্রান্তর থর থর করে কেঁপে উঠে, তীরের বন-বনানিতে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে দূর নক্ষত্র লোকে ছড়িয়ে পরে।
কোন গোলাম বিনা দোষে প্রচন্ড মার খাওয়ার পর যেভাবে ক্রোধ ও কৈফিয়তের দৃষ্টিতে মালিকের দিকে তাকিয়ে থাকে সেও উর্ধ্ব লোকে সেভাবে তাকিয়ে রইল। তার ঠোঁট দু’টি কাঁপছে, দাঁতে দাঁত পিষে আছে। উর্ধ্বে তর্জনি তুলে ধরে আবার গর্জে উঠল, ‘ঐ স্বৈরাচার, তুই আমাকে এই পাপ পংকিলময় পৃথিবীতে পাঠালে কেন? এই বিষাক্তপুরীতে আসার জন্য আমি তো লালায়িত ছিলাম না, মহাবিশ্বের এই নরককুণ্ডে আগমনের জন্য আমি তো কারো কাছে আবেদন নিবেদন করিনি। কেন আমাকে পাঠানো হল? আর পাঠালেই যদি তবে মানুষ বানিয়ে পাঠালে কেন, রাস্তার কুকুর বানিয়ে পাঠাতে পারলে না, যার কোন ঘর সংসারের প্রয়োজন হয় না। নর্দমার কীট বানিয়ে পাঠাতে পারলে না- যার কোন জীবন সাথীর দরকার হয় না। আমাকে নপুংশক বানিয়ে পাঠালে না কেন, তাহলে মনে এই শান্তনা থাকত যে একটা মেয়ে নপুংশকের ঘর কেন করবে, কেন নিজের জীবন নষ্ট করবে। ভিক্ষুক বানিয়ে পাঠালে না কেন, তাহলে এই যুক্তি থাকত যে, স্ত্রীর মুখে দু’মুঠো অন্ন তুলে দেয়ার মত যার মুরোদ নাই একটা মেয়ে কেন তার ঘরে জীবন বিপন্ন করবে। মুর্খ নিরক্ষর বানিয়ে পাঠালে না কেন, তাহলে এই শান্তনা থাকত যে, অজ্ঞতার অন্ধকারের চেয়ে জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত কোন ঘরে চলে যাওয়া যুক্তিপূর্ণ। আমার যদি কোন অযোগ্যতা না থাকে কোন অন্যায় না থাকে তাহলে কেন আমার স্ত্রী আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছে। জন্মের পর থেকে কেন আমার এত শাস্তি। কেন একের পর এক আমাকে বিষাদের পেয়ালায় চুমু দিতে হচ্ছে। কি আমার অপরাধ, আমি কত বড় অপরাধী। এভাবে এক বিদ্রোহী একটা একটা করে অভিশংসন পেশ করতে থাকে আর উর্ধ্ব জগতে কৈফিয়ত তলব করতে থাকে, ব্রহ্মপুত্রের তীর, তার গর্জনে শনৈ শনৈ কাঁপতে থাকে ।
শ্রাবণের মধ্যরাত, বর্ষাপক্ষ চলছে। বিদ্যুৎ চমকে আকাশ ঘন ঘন ফেটে ফেটে যাচ্ছে। সহসা গুরু গম্ভীর স্বননে আকাশ যেন ভেঙ্গে পরল। শুরু হল মুষল ধারে বৃষ্টি আর প্রচণ্ড প্রভঞ্জন, সেই সাথে শুরু হয় এক হতভাগ্য বিদ্রোহীর অট্টহাসি। একদিকে বৃষ্টি কন্যাদের নুপুরের নিক্কন, আরেক দিকে এক বিদ্রোহীর অট্টহাসি। শয়তানের আসর জমজমাট হয়ে উঠে। ব্রহ্মপুত্রের তীর, এর পরিবেশ হয়ে উঠে বিভীষিকাময়। সেই বিদ্রোহী হাসতে হাসতে ধনুকের মত পিছনে বেকে যায়, আবার তীব্র হাসির গমকে উবু হয়ে যায়। ব্রহ্মপুত্রের তীর, সেই হাসি বন বনানিতে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে পরে উর্ধ্বে। হঠাৎ সে হাসি থামিয়ে কোন বিচারককে বা বোকা লোককে যেভাবে বুঝায়- সেভাবে উর্ধ্বে তর্জনি নাচিয়ে নাচিয়ে বলল, ‘হা হা বুঝেছি বুঝেছি, আমি অপরাধী, অনেক অপরাধ আমার অনেক, এজন্যই আমার এত শাস্তি। সে আবার গর্জে উঠল, ‘ঐ ডিক্টেটর, নে আমার অপরাধের ফিরিস্তি নে।
আমার প্রথম অপরাধ, যেদিন আমার বাবা মারা গিয়েছিলেন সেদিন আটটি ইয়াতিমকে গলা টিপে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে সব কিছু দখল করে বসিনি। আমার সবচেয়ে বড় অপরাধ, আটটি ইয়াতিমকে আমার দু’টি দুর্বল অথচ আয়রন পেটা বাহুতে আটকিয়ে মুরগির মত বুকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। আর পৃথিবীর সকল ঝড় ঝঞ্জা নিজের উপর দিয়ে বইয়ে গিয়ে আমার পিঠের খাল তুলে নিয়ে গেছে, মাথার চুল উড়িয়ে নিয়ে গেছে, আমি ক্ষত বিক্ষত, রক্তাক্ত, বিপর্যস্ত অথচ ওদের গায়ে কোন আচড় লাগতে দেইনি। নিজের মুখের গ্রাস ওদের মুখে তুলে দিয়েছি, নিজে না পরে ওদের পরিয়েছি। পৃথিবীর সকল দুঃখ ও গ্লানি চুম্বকের মত টেনে নিয়ে ওদের মুখে হাসি ফুটিয়েছি। কাজেই এই ইয়াতিমদের যথার্থ লালন পালনটাই সম্ভবত আমার সবচেয়ে বড় অপরাধ।
আমার অপরাধ, বাল্যে, কৌশোরে, যৌবনে, মধ্য যৌবনে কখনো কোন পরনারী স্পর্শ করা তো দুরের কথা, প্রেম তো দুরের কথা, পত্র লিখা দুরের কথা, চোখ টিপা দুরের কথা, কোন মেয়ের প্রতি আমি কামনার দৃষ্টিতে কখনো তাকাইনি। আমার অপরাধ, আমি স্বজ্ঞানে কখনো কাউকে ঠকাইনি নিজে ঠকেছি, অনিষ্ট করিনি, অনিষ্ট চিন্তা করিনি, সকলের কল্যাণ কামনা করেছি। যুলুম করিনি, নিজে মজলুম থেকেছি। আমার অপরাধ, আমি কখনো মুনাফেকি করিনি, যখন আমি অভিভাবক তখন নিজের জীবন বিপন্ন করেও সদস্যদের সর্বোচ্চ কল্যাণ করার চেষ্টা করেছি। যখন আমি কৃষক তখন সর্বোচ্চ ফসল ফলিয়ে আমার পরিবার ও দেশের মানুষের গ্রাসাচ্ছনের ব্যবস্থা করেছি (উদ্বৃত্ত ফসল বিক্রি)। যখন আমি ছাত্র তখন পরীক্ষা পাশের জন্য পড়িনি, সমগ্র পাঠ আমার নখের দর্পনে স্থাপন করেছি। যখন আমি শিক্ষক তখন আমার অর্জিত জ্ঞান ঢেলে দিতে চেয়েছি কিন্তু নেওয়ার লোক পাইনি, বাধার সম্মুখিন হয়েছি। যখন আমি সামাজিক জীব তখন মানুষ ও মানবতার সর্বোচ্চ কল্যাণ করতে চেয়েছি। কিন্তু পৃথিবীর মুনাফিকেরা আমাকে পদে পদে বাধা দিয়েছে, আমাকে নিল কণ্ঠ করে তুলেছে, টেনে নিতে চেয়েছে যোপকাস্টে। এই হল আমার অপরাধের ফিরিস্তি। কাজেই তোর আদালতে আমার শাস্তি তো অনিবার্যই, তাই না?
কিন্তু তারা অপরাধী নয়, তোর শাস্তির যোগ্য নয়- যারা সম্পদের লোভে সহোদরের বুকে আমুল ছুরিবিদ্ধ করে দেয়। যারা নিরীহ মেয়েদের কৌশলে ধর্ষণ করে করে সেঞ্চুরি উৎসব পালন করে রাষ্ট্রীয় বাহবাও পায় আবার বিদেশ গমনের টিকেটও পায় (মানিক ভাই/চাচা)। যারা অবৈধ উপার্জন করে বস্তা ভরে ভরে চালান করে (কালো বিড়াল কাহা), যারা দরিদ্র জনগোস্টির রক্ত শোষণ করে বিদেশ পাচার করে দেয়। যারা ইচ্ছাপূর্বক দেশের বৃহত্তর জনগোস্টিকে গোলাম বানিয়ে রাখে। ঐ ডিক্টেটর, ওরা তোর দৃষ্টিতে অপরাধী নয়, মুজরিম নয়, তোর শাস্তির যোগ্য নয় বরং ওরা তোর নিয়ামতের যোগ্য। এ জন্যই তো ওরা ব্রান্ডের পোশাক পরে ফুল বাবু সেজে, হর্ম প্রাসাদে মখমলের বিছানায় ঘুমায়। তাদের জন্ম মৃত্যু হয় সোনার চামচ মুখে নিয়ে, আর জীবন কাটায় দুধে ভাতে। কিন্তু আমরা যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বৈধ উপায়ে দু’মুঠো পান্তা খেয়ে ‘আল- হামদু লিল্লাহ’ বলে মাটিতে পরে নিদ্রা যাই, তোর পথে চলার জন্য বদ্ধ পরিকর হই, জীবন বাজি রাখি, তাদের উপরই নেমে আসে তোর যত ক্রোধের খড়গ আর শাস্তির কোরা।
অনন্তর, আমার সবচেয়ে বড় একটা অপরাধ আছে- যাকে বলে ‘জন্মই আজন্ম পাপ’। কারণ আমি যার জাতক তার কোন অন্যায় অপরাধ পাপ আছে বলে কেউ বলতে পারে না। কিন্তু যারা বার পাত্রে পানি ছিটিয়ে ঘরে এসে সন্তান জন্মায়, যাদের হাজারটা থাকে উপপত্নি, যারা হারাম খেয়ে হারাম সন্তান জন্মায়, যারা পাপে জন্ম নেয় জন্ম দেয়, যারা অবৈধ রোজগার খেয়ে অবৈধ সন্তান পয়দা করে, যাদের উপপতি থাকে হালি হালি, তাদের সন্তান জন্মায় সোনার চামচ মুখে নিয়ে, তারা হয় ননীর পুতুল। ঐ মুজরিমরা যেখানে স্ত্রীর সাথে কুত্তির মত আচরণ করে সেখানে আমরা স্ত্রীকে অর্ধাঙ্গিনী হিসাবে গ্রহণ করি, তবুও ওদের বউ চলে যায় না কিন্তু আমাদের অন্তত আমার বউ চলে যায়। এই হল তোর দাসত্বের, তোর আনুগত্যের, তোর পথে চলার পুরস্কার। আর এই হল তোর ইনসাফ। দুনিয়ার হারামজাদারা তোর নায- নিয়ামত ভোগ করবে আর আমরা যারা তোর দরবারের কুকুর তাদের ভাগ্যে শুকনো হাড্ডিটাও জুটবে না। এই তো তোর বিচার, তোর ইনিসাফ। যারা তোর অবাধ্য তাদেরকে পুরস্কৃত করা, আর যারা তোর অনুগত তাদেরকে শাস্তি দেয়া এটাই তোর কাজ, এটাই তোর রুল।
৫৫
তুই বলেছিস, ‘মা কানাল্লাহু বিযাল্লামিল লিল আবিদ- বান্দার উপর তুই তিল মাত্র যুলুম করিস না। তুই অসত্য প্রভাষক (নাউযুবিল্লাহ)। প্রমাণ হিসাবে তোর আদালতে ইনসাফ-এ একটা মোকাদ্দমা দায়ের করছি, সিদ্ধান্ত তুইই দিবি, এটা কি আমার উপর যুলুম করলি নাকি ইনসাফ করলি।
আমি স্বপ্নে দেখলাম, আমার স্ত্রী একজন প্রৌঢ় লোকের সাথে শুয়ে আছে। এর ব্যাখ্যা হল, তার দ্বিতীয় স্বামী হবে প্রৌঢ় বয়সের। আবার আমার বউ স্বপ্নে দেখল, কেউ তার জন্য মোমবাতি জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অর্থাৎ কেউ তার অপেক্ষায় আছে। আরো দেখল যে, সে তার বাবার সাথে শুয়ে আছে। এর ব্যাখ্যা হল, তার বাবার সাথে তার দ্বিতীয় স্বামীর কোন না মিল থাকবে, যেমন বয়সের দিক থেকে হউক, নামের দিক থেকে হউক বা অন্য যে কোন প্রকারে হতে পারে। ব্যস মিয়াঁ বিবির জানা শেষ হল এবার কাজ হল অভিভাবকের। তাই আমার শাশুড়ি তার মেয়েকে স্বপ্নে বিয়ে দিয়ে দিলেন। কিন্তু এই দ্বিতীয় বিয়ের কারণ যে আমি নয়, আমার কারণে বিয়ে ভাঙ্গেনি, আমার কোন অন্যায় নেই- এর সনদ দিলেন এই বলে যে, ‘আমার আগের জামাইটা তো ভালই ছিল তাহলে মেয়েকে আবার বিয়ে দিচ্ছি কেন’। সুতরাং এসব স্বপ্নের মাধ্যমে বুঝা গেল ভবিষ্যতে যা ঘটতে যাচ্ছে বহু আগেই তা আমাদের ভাগ্যে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে, আর তিন বছর আগে তা আমাদেরকে জানিয়েও দেয়া হয়েছে।
( মহা বিস্ময়ঃ স্বপ্ন গুলি সম্পুর্ন সত্য, আর পরবর্তিতে তাই ঘটেছিল। ফেরদৌসির বাবার নাম উবায়দুল্লাহ মাস্টার, তার দ্বিতীয় স্বামীর নামও ডঃ উবায়দুল্লাহ- যে প্রায় বাবার বয়সী প্রৌঢ় ছিল। কিন্তু গ্রন্থের সকল নাম ঈষৎ পরিবর্তন করা হয়েছে বিধায় ডঃ উবায়দুল্লাহ-কে ডঃ আব্দুল্লাহ নামে দেখানো হবে)।
এখন প্রশ্নটা হল, তিন বছর আগে এই অদৃশ্য জগতের সংবাদ কে আমাদেরকে জানালো। কোন নবী, রাসূল, গওস কুতুব, অলী, আওলিয়া, ফেরেশতা বা শয়তান জানিয়েছিল কি? না, তারা অদৃশ্য জগতের সংবাদ জানে না। যেমন তুই বলেছিস, লা ইয়া’লামুল গায়বা ইল্লাল্লাহু- অদৃশ্যের সংবাদ আল্লাহ্ ছাড়া কেউ জানে না অর্থাৎ তুইই আমাদের ভাগ্যলিপি অগ্রিম আমাদেরকে জানিয়ে ছিলে। এখন তোর আদালত থেকে রায় ঘোষণা কর, এটা কি আমার উপর এবং আমার স্ত্রীর উপর তোর ইনসাফ হল নাকি যুলুম হল। কারণ আজ যা ঘটতে যাচ্ছে তা লিখে রেখেছিস আমাদের জন্মের সময়, জানিয়ে দিয়েছিস তিন বছর আগে। আর তোর এই কর্মের দায় বহন করতে হচ্ছে আমাদের। আজ আমার ও আমার সন্তানের জীবন ধ্বংস হতে যাচ্ছে। তাছাড়া এই অপকর্মের জন্য আমার পরিবার ও পরিচিত বলয় ফেরদৌসিকে দোষারুপ করছে, গালি দিচ্ছে। আবার আমার স্ত্রীর পরিবার ও পরিচিত বলয় আমাকে গালি দিচ্ছে, দোষারুপ করছে। অথচ আমরা ভাগ্যের হাতে জিম্মি, যার দায় সম্পূর্ণ তোর আমাদের নয়। অলিম্পাসের দেবতারা যেভাবে মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলত সেভাবে আমার ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলাটা কি তোর যুলুম হলো না? আজ তোকে কৈফিয়ত দিতে হবে। তুই শুধু মানুষের কৈফিয়ত নিবি কিন্তু তোর কৈফিয়ত দিবি না তাতো হতে পারে না, সেই দিন হয়েছে বাসি। আজ তোকে কৈফিয়ত দিতে হবে।
সে আবার গর্জে উঠে, ‘ঐ স্বৈরাচার! তোর স্বৈরাচারিতার বিচার হবে। বিচার হবে ঐ উর্ধ্ব জগতে অথবা পৃথিবীর মাটিতে। তোর আদালতে যেভাবে মানুষের বিচার হয় এখন মানুষের আদালতে তোর বিচার হবে। তবে পার্থক্য এই যে, তোর আদালতে মানুষের ক্ষমা আছে কিন্তু মানুষের আদালতে তোর ক্ষমা নেই। আর এ জন্যই তো পাগলা নজরুল বলেছিল, ‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগমান বুকে এঁকে দিই পদ- চিহ্ন। আমি স্রষ্টা- সুদন, শোক- তাপ হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন। আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগমান বুকে এঁকে দিব পদ- চিহ্ন। আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন। আমি চির বিদ্রোহী বীর, বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির- উন্নত শির (বিদ্রোহী)।
আবার সে পাগলের মত অট্টহাসিতে ফেটে পরে। সে স্রস্টার বিচার করবে- যে স্রষ্টা তার ও মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। বিচার করবে এই পৃথিবীর মাটিতে। হাসির গমকে কখনো সে চিৎ হয়ে যায় কখনো উবু হয়ে যায়। ব্রহ্মপুত্রের তীর, শুরু হয় মস্তি মাতঙ্গের নাচন। বৃষ্টির রিনিঝিনি ছন্দ, বিদ্যুৎ চমক, মেঘের গর্জন, ভু কাপানো বজ্রনাদ, ঝড়ের দাপট, সেই সাথে এক বিদ্রোহীর অট্টহাসি ও নর্তন কুর্তন। ব্রহ্মপুত্রের তীর, এর পরিবেশ হয়ে উঠে নরকের মত বিভীষিকাময়, শয়তানের তাণ্ডব চলতে থাকে। ব্রহ্মপুত্রের তীর, আযাযিল তার দলবল নিয়ে সেখানে নৃত্য গীতের আসর জমায়। খোদাদ্রোহীর মচ্ছব পূর্ণ হয়ে উঠে।
এক হতভাগ্য খোদাদ্রোহীর বিরুদ্ধে প্রকৃতি ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে। বৃষ্টির তোড় আর ঝড়ের ঝাপটা খোদাদ্রোহীর ভুখা ক্ষীণ দুর্বল দেহটা উড়িয়ে নিতে চায়, নিয়ে যেতে চায় পৃথিবীর সীমানার বাইরে, আচড়ে মারতে চায়। তার দুর্বল দেহ ব্রহ্মপুত্রের তীরে ছিটকে পড়ে, পা পিছলে পরে যায়, সে উঠে দাঁড়ায়, আবার স্রস্টার বিচারের বার্তা শুনায়, আবার হাসিতে ফেটে পরে। আবার ঝড়ের ঝাপটায় বা পা পিছলে পরে যায়, আবার উঠে এসে হাসি ও বিচারের ঘোষণা দেয়। আবার পরে যায়, আবার উঠে নাচতে থাকে। আর আযাযিল তার দলবল নিয়ে ঢুল তবলা বাজিয়ে খোদাদ্রোহীতার আসর তুঙ্গে তুলে নেয়, এ অভিনয় চলতে থাকে। ব্রহ্মপুত্রের তীর, জন-মানবহীন প্রান্তরের পরিবেশ নরকে পরিণত হয়।
কিছুক্ষণ পর সে ক্লান্ত হয়ে এল। ব্রহ্মপুত্রের তীর, প্রমত্ত ভঙ্গিতে পায়চারি করছে আর ভাবছে স্রস্টার বিচার কিভাবে করা যায়। সে কোরআন, পুরান, বেদ বেদান্ত, বাইবেল, ত্রিপিটক জেন্দাবেস্তা ইত্যাদি তার জানা ধর্ম গ্রন্থগুলিতে পাতি পাতি করে খুজতে লাগল স্রস্টার বিচারের কোন পথ ও পদ্ধতি আছে কিনা কিন্তু কোন সূত্র পেল না। তারপর সে হাদীস শাস্ত্রে দৃষ্টি বুলাতে লাগল। সে স্রষ্টার বিচার করবেই, কোন ছাড় দিবে না। কিন্তু হঠাৎ মিশকাত শরীফের একটা ছত্রে গিয়ে তার দৃষ্টি আটকে গেল, সামনে মৃত্যু ফাঁদ দেখার মত সে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। কারণ তার চোখের সামনে ভেসে উঠল, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘মানুষ নেক আমল করতে করতে জান্নাতের দ্বার প্রান্তে পৌঁছে যাবে কিন্তু তখন সে এমন কোন কাজ করে বসবে যে, সেখান থেকে জাহান্নামে ছিটকে পরবে। আবার মানুষ পাপ করতে করতে জাহান্নামের দ্বার প্রান্তে পৌঁছে যাবে কিন্তু তখন সে এমন এক আমল করবে যে, সেখান থেকে ছিটকে গিয়ে জান্নাতে পরবে। হাসানের মনে হল রাসূল (সাঃ) দেড় হাজার বছর আগে তার উদ্দেশ্যেই এ হাদীসটা বলে গেছেন। কারণ সারা জীবন সে নেক আমল করে এখন খোদাদ্রোহীতা করে বসেছে। তার দেহটা চুপসে গেল।
আবার তার দৃষ্টি বুখারি শরীফের একটা পৃষ্ঠায় গিয়ে স্থির হল। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘বনী ইসরাইলের এক যাজক ছিল। তার একটা খেজুর বাগান ছিল। সেখানে প্রচুর খেজুর উৎপাদন হত আর সে রাত দিন ইবাদত করত। একদিন তার কাছে সংবাদ এল বজ্রপাতে তার বাগানটা পোড়ে গেছে। সাথে সাথে সে গির্জা ছেড়ে বেরিয়ে এল এবং তুচ্ছ ক্ষতির জন্য খোদাদ্রোহীতা করে বসল, ‘তুই আমার জীবিকা কেড়ে নিলি, আমি তোর ইবাদাত করব না’ বলে তার গলায় ঝুলানো রুদ্রাক্ষের মালা ধরে উর্ধ্বে নিক্ষেপ করল। সেই মালা সাপ হয়ে তার গলায় এসে ঝুলে পরল। আর সেই সাপের দংশনেই সে মারা গেল এবং জাহান্নামে গেল। হাসান আতঙ্কে দুইপা পিছিয়ে গেল। তার মনে হল দেড় হাজার বছর আগে রাসূল (সাঃ) তার উদ্দেশ্যেই এই রুপক গল্পটি বলে গেছেন। কারণ সেও ইসলামের যাজক- মুহাদ্দিস, তার কাজ খোদাদ্রোহীদের পথে আনা। অথচ সে নিজেই খোদাদ্রোহীতা করে বসেছে। তাও আবার অতীব তুচ্ছ অতীব নগন্য এক নারীর জন্য। তাহলে কি তার আখেরাত নষ্ট হয়ে গেল।
মুসলমানের পার্থিব যত বড় ক্ষতিই হউক পরকালের সামনে এসব কোন ক্ষতিই না, তার আসল ক্ষতি হল পরকালিন ক্ষতি। দুনিয়াতে মানুষের বঞ্চনা যত বেশি হয় আখেরাতে তার প্রাপ্তির পাল্লা তত ভারি হয়। ইহলোকে মানুষ যত বেশি মজলুম নিঃস্ব সর্বহারা হয় আখেরাতে সে ততবেশি প্রাপ্তির হকদার হয়ে উঠে। হাসান জীবনে যত আঘাত পেয়েছে, যত যুলুম ও বঞ্চনার শিকার হয়েছে, ততবেশি সে আখেরাতের প্রতি আশান্বিত হয়ে উঠেছে। কিন্তু আজ সে ক্রোধের বসে অবচেতন হয়ে ক্ষনিকের তরে যে মহা অন্যায় করে বসল তাতে তো তার আজন্মের আমল বরবাদ হয়ে গেছে, তার পরকাল নষ্ট হয়ে গেছে।
হঠাৎ যেন তার কাশফ খুলে গেল। আরশ কুরসি লওহ কলম তার চোখের সামনে ভেসে উঠল, ইল্লিন সিজ্জিন, স্বর্গ, মর্ত, পাতাল, জান্নাত, জাহান্নাম, আরাফ সবকিছুই তার চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়ে উঠল, খুটে খুটে দেখল, নিজেকে খুজল, কিন্তু কোথাও দেখতে পেল না। কারণ সে বিদ্রোহী, খোদাদ্রোহী। সহসা যেন তার দেহের হাড়গুলি মোমের মত গলে যেতে লাগল। রাবারে আগুন জ্বালিয়ে তুলে ধরলে যেভাবে গলে গিয়ে ফোটায় ফোটায় বিন্দু বিন্দু পরতে থাকে তেমনি যেন তার দেহের রক্ত, মাংস, মাংসপেশি, অস্থিমজ্জা, পরমাণু পরমাত্মা গলে গলে পড়তে লাগল। কোষ্ঠ রোগীর মত মাংস শরীর থেকে ঝরে ঝরে খসে খসে পড়তে লাগল। পাহাড়ে ডিনামাইট মারলে যেভাবে ধুলি-ধুনা হয়ে উড়ে যায় সেভাবে তার দেহের অনু পরমাণু উড়ে উড়ে যাচ্ছে, হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে।
সে নৈরাশ্যের চরমে পৌঁছল। আতঙ্কে দুই পা পিছিয়ে গেল, দু’হাতে মাথা চেপে ধরে সর্বরিক্তের মত মুখটা বিকট হা করে উঠল। তারপর ‘অহ হ হ না’ বলে তীব্র আর্তনাদ করে তার দুর্বল দেহটা ছিন্নমূল বিটপীর ন্যায় মাটিতে ঢলে পরল আর সাথে সাথে মাটি কামড়ে ধরল। তার আর্তনাদ উর্ধ্ব জগতে প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল। তারপর গড়াতে লাগল আর মাটি কামড়াতে লাগল। অনুশোচনার তীব্র দহন তাকে মানবানুভুতির এমন স্তরে পৌঁছে দিল যার বর্ণনা দেয়া কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। পৃথিবীর কোন ডাক্তার, কবিরাজ, মনোবিজ্ঞানি কবি, শিল্পি, সাহিত্যিক আজো সে অনুভূতির চিত্র অংকন করতে পারেনি। পারেনি কারণ ঐ চরমাবস্থায় পৌঁছে গেলে মানুষ আর ফিরে আসে না, বেঁচে থাকে না কলিজা ফেটে মারা যায়। ব্রহ্মপুত্রের তীর, সে গড়াচ্ছে, গড়াচ্ছে আর মাটি কামড়াচ্ছে। গড়াচ্ছে সে সাপ বিচ্ছু কেচো ইত্যাদি উরগ জাতীয় প্রাণী মরার সময় যেভাবে শরীর মোচড়াতে থাকে আর মাটির উপর গড়াতে থাকে হাসানও চেতনা হারিয়ে অনুশোচনার তীব্র দহনে দগ্ধ হয়ে গড়াচ্ছে আর মাটি কামড়াচ্ছে। প্রবল বারিবর্ষণ চলছে। প্রতি কামড়ে ঘাস কাদা মাটি পানি তার মুখে ঢুকছে, বেরিয়ে যাচ্ছে, আবার ঢুকছে বেরিয়ে যাচ্ছে, কিছু কিছু পেটেও যাচ্ছে। ব্রহ্মপুত্রের তীর, এভাবে দুনিয়ার সবচেয়ে বদবখত যুবকটি নির্জন প্রান্তরে নিশীথের অন্ধকারে গড়াতে থাকে আর মাটি কামড়াতে থাকে।
প্রবল বর্ষণ আর ঝড়ের তাণ্ডব অনেকটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। বুভুক্ষু নিশাচরেরা খাদ্যের অন্বেষণে ছোটা ছোটি করছে। শিয়ালের কয়েকটা ঝাক আশপাশে দাঁড়িয়ে বিস্ময় চোখে দেখছে, সামনে এটা কি গড়াচ্ছে, মানব দানব নাকি ভুত পেত্নি, নাকি তাদের খাদ্য উপযোগী কোন প্রাণী। গড়াতে গড়াতে তার দেহটা অবশ হয়ে গেল, চলৎ শক্তি হারিয়ে ফেলল। সহসা তার মনে হল অথবা আওয়াজ হল, তার কানে বাজতে লাগল, ‘লা তাকনাতু মির রাহমাতিল্লাহ- আল্লাহ্র দয়া থেকে নিরাশ হয়ো না। তার মনে পরল বেদুইনরা এসে আজে বাজে প্রশ্ন করে রাসূল (সাঃ) কে রাগিয়ে তুলত। আর রাসূল (সাঃ) এর চেহারায় রাগ দেখলেই হযরত উমর (রাঃ) তার সামনে গিয়ে হাটু গেড়ে বশে পাঠ করতেন, রাজীতু (বা রাদীতু) বিল্লাহি রাব্বা, ওয়া বিল ইসলামী দ্বিনা, ওয়া বি মুহাম্মাদিন নাবিয়্যা। এই দোয়া সে অস্ফুট স্বরে আবৃত্তি শুরু করল, এরপর চোখ খুলল। শুয়ে শুয়ে কিছুক্ষণ আবৃত্তি করল। তারপর বসে আবৃত্তি করল। সহসা দাঁড়িয়ে ভিক্ষুকের মত দু’হাত উর্ধ্বে বাড়িয়ে পাঠ করতে লাগল, ‘ইয়া রব, ইন্নাকা আনতা ইলাহুনা, লা ইলাহা ইল্লা আনতা, লা শরীকা লাকা। লা জিদ্দা লাকা, লা নিদ্দা লাকা, লা মিছলা লাকা, ওয়া লা মাছিলা লাকা, লা শরীকা লাকা। লা ওলাদা লাকা, লা ওয়ালিদা লাকা ওয়া লা যাওজাতা লাকা, লা শরীকা লাকা। লা খালিকা, লা মালিকা, লা রাজ্জাকা ইল্লা আনতা, লা শরীকা লাকা। এভাবে সে উর্ধ্বে দু’হাত তুলে আয়াত ও অযিফা বানিয়ে কুড়িয়ে, ভুল শুদ্ধ, জানা অজানা সমানে পাগলের মত আবৃত্তি করতে লাগল। তার চোখ দিয়ে ব্রহ্মপুত্রের ধারা ছুটছে। স্বীকৃত পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে সে লজ্বা ও অনুশোচনার এমন স্তরে পৌঁছে গেল যেখানে পৌছলে, ‘না মানাদ চেড়া পর্দা ইল্লা জালাল- বান্দা ও আল্লাহ্র মধ্যে কোন পর্দা থাকে না তার বড়ত্বের ব্যবধান ব্যতিত।
সে আর্তনাদ করে উঠল, ‘মালিক আমার, আমি হলাম সেই কুকুর যার প্রভু থাকার জন্য তাকে উত্তম ব্যবস্থা দিয়েছে, প্রতিদিন হাড় বিহীন মাংস খেতে দিয়েছে। কিন্তু একদিন প্রভু তাকে একটি শুকনো হাড্ডি না দেয়ার কারণে রাগে সে তার মালিকের বাড়ি ছেড়ে জঙ্গলে গিয়ে বিস্টা খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। আমিও তেমনি শুকনো হাড্ডির ন্যায় এক নিকৃষ্ট নারীর জন্য তোমার সাথে গাদ্দারি করেছি, তোমার সকল নায ও নিয়ামত অস্বীকার করেছি। অথচ আমার উপর তোমার কত নিয়ামত। কত মানুষ এক মুঠি ক্ষুধার অন্ন পাচ্ছে না, লজ্বা নিরাবনের জন্য এক টুকরা ছেড়া ন্যাকড়া পাচ্ছে না, একটি অক্ষর জ্ঞান অর্জন করতে পারছে না। অথচ এসব নিয়ামত তুমি আমাকে অঢেল দিয়েছ। কত হতভাগ্য আদম সন্তানের দু’টি চোখ নেই, এ সুন্দর পৃথিবীটাকে দেখতে পারছে না। দু’টি কান নেই পৃথিবীকে শুনতে পাচ্ছে না, দু’টি পা নেই এই মাটির মায়া আস্বদন করতে পারছে না, দু’টি হাত নেই পৃথিবীকে স্পর্শ করতে পারছে না, একটু মেধা- জ্ঞান নেই পৃথিবীকে জানতে পারছে না। অথচ এসব নিয়ামত তুমি আমাকে পুর্ণ করেই দিয়েছ।
প্রভু আমার, তোমার দরবার থেকে ভেগে যাওয়া কুকুর ফিরে এসেছে, এখন তুমি যদি তার মুখের উপর লাথি মার তবুও সে তোমারই বান্দা, তাকে যদি শুকনো হাড্ডি চিবুতে দাও বা মৎস কলিজার কাবাব খেতে দাও তবুও সে তোমারই বান্দা। হেদায়েত ও গুমরাহির মালিক, রক্ত মাংসের মানুষ আমি, ক্রোধের বসে অবচেতন হয়ে মহা অন্যায় করে ফেলেছি, তোমার অবাধ্যতা করে ফেলেছি। মাফ করো, আমাকে মাফ কর। তুমি শাস্তি দিলেও তোমারি দাস, নিয়ামত দিলেও তোমারি দাস।
ইজ্জত ও লাঞ্চনার মালিক, আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি সেই হতভাগার জন্য- যে সারাটা জীবন শুধু কষ্টই করেছে, পৃথিবীর অন্ধকার দিকের দুঃখ ব্যাথা লাঞ্চনা ও বঞ্চনাটুকুই শুধু ভোগ করেছে, আলোর দিকের সুখ সম্মান শান্তি ও সান্তনা সে কোন দিন পায়নি। সারাটা জীবন যে শুধু পেয়েছে পৃথিবির কান্নার অংশ, হাসির অংশটুকু পায়নি। অন্তর্যামী ওগো, তুমি তো জানই, এই দুনিয়ায় তুমি ছাড়া তার আর কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। তুমিই তার একমাত্র সম্বল। এখন তুমিই পার তাকে সর্বস্ব করতে অথবা নিঃস্ব করতে। তুমি যদি তাকে ক্ষমা কর তাহলে সে মহাসুখী সৌভাগ্যবান, আর যদি না কর তাহলে সে চরম বদনসীব। যার ইহকাল এমনিতেই নাই এখন যদি পরকালও না থাকে তাহলে তুমিই বল সে কে, পৃথিবীর কততম স্তরের হতভাগা, তোমার দুনিয়ায় তার মত বদ নসীব আরো কেউ আছে কিনা। তুমিই যার একমাত্র সম্বল তাকে তুমি এমনতরো লাঞ্চিত কারো না, সর্বশেষ স্তরের বদবখত করো না, ক্ষমা কর।
ক্ষমা ও শাস্তির অধিকারী, আর তো কোন দরবার নাই, আর তো কোন ইলাহ নাই, আর তো কোন আশ্রয়স্থল নাই যে অন্যত্র আশ্রয় নিব। তোমাকে ছাড়া তো আর কাউকে প্রভু হিসাবে জানি না, চিনি না, মানি না। বেহেশত দোযখ চিনি না, জানি না, শুধু তোমাকে চিনি, তোমাকে চাই, তোমার সন্তুষ্টি চাই, তোমার ক্ষমা চাই। কাজেই মাফ কর, একটু দয়া কর। তোমার একটু দয়া পেয়ে কত অযোগ্য যশ খ্যাতি সম্মান বিত্ত বৈভব ও ভোগ বিলাসে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে। আর তোমার একটু উপেক্ষায় কত হতভাগা ডাস্টবিনে উদর পুর্তি করছে আর রাস্তায় পরে ঘুমাচ্ছে।
কাজা ও কদরের মালিক, আজ আমি নিঃস্ব, আমি সর্বহারা, নৈরাশ্যে চেতনা হারিয়ে তোমার দ্রোহিতা করে ফেলেছি। আজ আমার এই দেহটা কেটে, আমার কলিজাটা ছিড়ে আমার স্ত্রীকে নিয়ে যাচ্ছে ঢাকা ভার্সিটির এক শিক্ষক। আমি বেঁচে থাকতে সে আমার স্ত্রীকে নিয়ে শবে-নায করবে আর আমি রাতের অন্ধকারে চোখের জলে বুক ভাসাব। আমার স্ত্রী ঐ লোকের সন্তান লালন পালন করবে আর আমার সন্তান তখন পথে পরে গাছ তলায় বসে বসে কাঁদবে। তার শরীরের জোরাগুলি ছেড়ে দিল। সে হাটু গেড়ে বসে পরল। এরপর মাটিতে দু’হাত রেখে পশুর মত চারজানু পেতে উবু হয়ে থাকল। তারপর ‘আমি ভাগারে পরে কাঁদব, আমার সন্তান পথে পরে কাঁদবে, গাছ তলায় বসে বসে কাঁদবে’ বলতে বলতে অন্তহীন বেদনায় আর কথা বলতে পারল না, শুধু ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল। তারপর আবার হাটু গেড়ে বসে দুহাতের মুষ্টি মুহুর্মুহু বুকে মারতে লাগল আর, ‘আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম, আমার সন্তান নিঃস্ব হয়ে গেল, আমার আর কিছুই থাকল না’ আর্তনাদ করতে লাগল। ব্রহ্মপুত্রের তীর, শেষ রাত্রের আধারে নির্জন প্রান্তরে সর্বস্ব খোয়নো এক হতভাগার কান্নার প্রতিধ্বনি উঠে।
সহসা তার ক্ষীণ দুর্বল ক্ষুধা তৃষ্ণা কাতর দেহটি ধপাস করে মাটিতে পরে গেল, কষ্টাতিশয্যে তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল। শুধু জবাই করা পশুর মত গোঙ্গানোর শব্দ পাওয়া গেল, চার হাত পা চার দিকে ছুড়ছে, ঠোঁটের দু’পাশ দিয়ে মুখের ফেনা ও লালা গড়িয়ে পরছে, চোখের জলে কান ভরে উঠছে, দু’পাশের মাটিতে মাথা মারছে। মর্তলোক থেকে অনন্ত লোক পর্যন্ত শুধু কান্না, মাতম, রোদন আর আর্তনাদ। তারপর সে বেহুঁশ হয়ে গেল।
ব্রহ্মপুত্রের তীর, সেখানে ছিন্নমুল এক অবাঞ্চিত কুকুরের দেহ নিথর হয়ে পরে আছে। বিষাদের কালিমা ছেয়ে ফেলেছে পৃথিবী, কৃষ কালো অন্ধকার। সৃষ্টিকুল স্তব্ধ, ব্যাকুল, মুক। ঝিল্লির রব নেই, পাখির ডাক নেই, শিয়ালের হুক্কাহুয়া নেই, কুকুরের ঘেউ নেই। প্রাণী জগত শোকের সাগরে ভাসছে, নির্বাক তাকিয়ে আছে ব্রহ্মপুত্রের তীরে। বাতাস হু হু করে কেঁদে ফিরছে, ব্রহ্মপুত্রের ধারা কলকল রবে মাতম তুলছে। দুঃখী মানুষের ‘আহ’ কাল মেঘ হয়ে ঢেকে ফেলেছে আকাশ, ঝুপ ঝুপ করে তার কান্না ঝড়ে পরছে, শুরু হয় বৃষ্টি।
বিষয়: সাহিত্য
১৬৮৮ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সুন্দর শিক্ষণীয় লিখনি। তবে লিখাটি ছোট হলে মনে হয় ভাল হতো।
মন্তব্য করতে লগইন করুন