চিঠি-৫১(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ৩১ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:৩১:৫২ দুপুর
সৃষ্টির সূচনা থেকে পৃথিবীতে যত বিপত্তি আর অঘটন ঘটেছে, ঘটছে আর ঘটবে এসবের মূলে রয়েছে অহংকার ও অন্যকে পদানত করার প্রবনতা। এই অহংকারের কারণেই ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে দ্বন্ধ হচ্ছে, পরিবারে পরিবারে কলহ বেধে উঠছে, সমাজে নীরবে নিভৃতে কত অসহায় চোখের আশু ঝরে পরছে। এই অহংকারের যোপকাস্টে বলি হয়ে গেছে কত সন্তান, কত স্বামী, কত স্ত্রী আর কত নিরাপরাধ মানুষ। এ অহংকারের কারণে কত সংসার, কত সমাজ, কত গাঁও, কত দেশ- জাতি উজার হয়ে গেছে। আলেকজান্ডার ধ্বংস আর আগুনের পয়গাম নিয়ে পৃথিবীতে আবির্ভুত হয়েছিল কেন? এই অহংকার বসে মানব জাতিকে পদানত করার লক্ষেই। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট মস্কো ধ্বংস করতে গিয়ে শত্রু পক্ষের অগনিত আর নিজের চল্লিশ লক্ষ সৈন্য ধ্বংস করেছিল কোন মহৎ উদ্দেশ্যে? এই অহংকারের বশবর্তী হয়ে পৃথিবীকে পদানত করার জন্যই। হিটলার পৃথিবীকে ধ্বংস আর প্রলয়ের মুখোমুখি দাড় করিয়েছিল কোন পুন্যার্থে? এই অহংকারের বশে মানব জাতির প্রভু হওয়ার দুরাকাংখায়।
কাজেই পৃথিবীর সকল অনর্থের মূলে রয়েছে অহংকার। এজন্যই ইসলামে সবচেয়ে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ বিষয়টি হল অহংকার। কারণ অহংকার হল আযাযিলের বৈশিষ্ট। সে অহংকার বশে আদমকে সিজদা করেনি। আর করেনি বিধায় চির অভিশপ্ত হয়ে গেছে। এ জন্যই হাদীসে কুদসীতে এসেছে, ‘আল কিবরিয়াউ রেদায়ি, তা তানাযায়ু বিরেদায়ি’ অর্থাৎ আল্লাহ্ বলেন, অহংকার আমার চাদর তা নিয়ে টানাটানি করো না। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, আগুন যেভাবে শুষ্ক বৃক্ষপত্র পোড়িয়ে ভস্ম করে দেয় অহংকার মানুষের নেক আমল সেভাবেই পোড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়’। তিনি আরো বলেন, ‘মানুষ দুই প্রকার শক্বী ও সায়ীদ অর্থাৎ জাহান্নামী ও জান্নাতি। কেউ শক্বী বা জাহান্নামী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে কোন মুসলমানকে হেয় জ্ঞান করবে অর্থাৎ অহংকার করবে। ফেরদৌসিদের পরিবার যদিও ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত নয় বটে কিন্তু তারা ছিল কট্টর তাবলীগি ও ধার্মিক। আর এমন একটি পরিবারের অহংকার ও অন্যকে পদানত করে রাখার প্রবনতা কয়েকটা জীবন ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিল।
মধ্য জুন, ২০০৬ সাল। মেইন রোড থেকে বিশ ফুট পুর্ব পাশে একটি বাসা। রোডের দিকে বাসার দরজা খোলা। রোড থেকেই দেখা যায় বিছানায় শুয়ে আছে একটি যুবক, শুয়ে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে মজলুম, সবচেয়ে বঞ্চিত, সবচেয়ে ভাগ্যাহত মানুষটি। তার শরীর বিছানায় লেপটে গেছে। মনে হচ্ছে যেন মরা চামড়া দিয়ে একটি কঙ্কাল জড়িয়ে রাখা হয়েছে। দেহের হাড়গুলি আঙ্গুলে ছোয়ে ছোয়ে গুনা যায়। গায়ের চামড়া ঢিলা হয়ে গেছে। পা ও বাহুর মাংস পেশি শুকিয়ে শিরাগুলি ভেসে উঠেছে। পেট পিঠের সাথে লেগে আছে। হাত পায়ের আঙ্গুলে মাংসল জায়গা শুকিয়ে গিরাগুলি বেখাপ্পা মোটা হয়ে আছে। বুকের হাড়গুলি বিকট বিশ্রিভাবে হা করে আছে। গাল বসে গিয়ে মুখের হাড়গুলি চামড়ার নীচে বিশ্রিভাবে উচু টিলা হয়ে আছে। শরীর শুকিয়ে মাথাটা কার্টুনের ছবির মত বড় হয়ে গেছে। চোখের নীচে কালি পরে গেছে। গর্তে ঢুকে যাওয়া দু’টি চোখে আশার আলো জ্বলজ্বল করছে, সাত সাহারার তৃষা নিয়ে দু’টি চোখ তাকিয়ে আছে রাস্তার পানে- এ পথ ধরেই আসবে, আসবে একজন বোরকাওয়ালী, দীর্ঘদেহী, যার কোলে একটা বাচ্চা।
একজন দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষ, কংকালসার এক হতভাগা- যে মানুষের হিংস্রতার শিকার। মানুষের নিষ্ঠুরতা এক টগবগে যুবককে পৌছে দিল জীবনের অন্তিম শয়ানে। বাসাটা হয়ে আছে এক ভূতুড়ে পোড়ো বাড়ি। চারপাশের দেয়াল আর সিলিং মাকড়সার জাল আর ঝুলে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। বিছানার চাদর কুচকে কুচকে আধপোড়া লাইলনের কাপড়ের মত কুচকে ছোট হয়ে গেছে। বালিশে তেলছিটা পরতে পরতে কালো আস্তর পরে গেছে। ঘরের মেঝে ও রান্নাঘরে বিভিন্ন হান্ডিপাতিল বিক্ষিপ্ত পরে আছে। কোনটাতে তরকারি পচে ছাতিয়ে আস্তর পরে গেছে। কোনটাতে চারটে ভাত, কোনটাতে ঝোটা পানি, কোনটাতে হোটেলের একটু তরকারি বা একটু ডাল বা একটু ডিম ভাজি বা চারটে চিড়া বা মুড়ি বা অন্য খাদ্য পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, ছাতিয়ে ছাতিয়ে আস্তর পরে গেছে, মশা মাছি ভেন ভেন করছে। রান্নাঘরে দেয়াল ঘেঁষে ডিমের খোসার স্তূপ পরে আছে। বিক্ষপ্তভাবে পেঁয়াজ রসুন মরিচ পরে পচে আছে। একটা বালতিতে আধা খাওয়া ডিম, ক্রমে ক্রমে জমে উঠা ভাত, তরকারি, ডাল, রুটি, বিস্কুট পচে পচে কালো হয়ে গেছে। পোকা কিলবিল করছে। অনেকগুলি বৈয়াম বিস্কুট চানাচুরে ভরা কিন্তু মুখ খোলা পরে আছে, ইঁদুর চোহা খেয়ে খেয়ে যাচ্ছে। বাথরুমের কোণায় একটা কাপড় পচে ছাতিয়ে সজারুর কাটার মত হয়ে আছে। একটা সাবান মাটিতে পরে গলে যেতে যেতে প্রায় শেষ হয়ে গেছে।
পেশাবের বেগ পেয়েছে। হাসান উঠতে চাইল, দু’হাতে ভর দিয়ে ক্ষীণ দুর্বল দেহটা বিছানা থেকে টেনে তুলল। তারপর ধীরে ধীরে হেটে গিয়ে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে থাকল। হুস নাই, চেতনা নাই, দাঁড়িয়ে আছে। অনেকক্ষণ পর হঠাৎ চেতন পেয়ে, ‘আমি এখানে কেন, কী জন্য জানি এসেছিলাম, মনে নেই। তারপর আস্তে আস্তে গিয়ে টেবিলের সামনে চেয়ারে বসল। মানুষ দুঃখ ভুলে থাকার জন্য নেশা ধরে। বই পড়া আগে থেকেই তার নেশা, লেখালেখিতেও কিছুটা নেশা আছে। সে পড়া ও লেখার নেশায় ডুবে থাকতে চায় কিন্তু পারে না। বহু আগেই মাদরাসায় পাঠ্য কঠিন কিছু কিছু কিতাবের অনুবাদ ও ব্যাখ্যার কাজ শুরু করেছিল। কোনটার অনুবাদ শেষ হয়েছে কিন্তু ব্যাখ্যা বাকী আছে, কোনটা আধা আধি ব্যাখ্যা লেখা হয়েছে, বাকী কাজ শেষ করতে চাইছে কিন্তু পারছে না, মনোযোগ বসাতে পারে না। শামায়েলে তিরমিযিটা (রাসূল (সাঃ) এর আকৃতি প্রকৃতি) নিয়ে বসল, মনোযোগ দিতে চাইল পারল না, চেষ্টা করল পারল না। মনের পটে যে স্ত্রী সন্তানের চিত্র অঙ্কিত হয়ে আছে তা ভেদ করে অন্য কোন কিছুতে মন নিবিষ্ট হয় না। কিছুক্ষণ বসে বসে শুধু পৃষ্ঠা উল্টাল। তারপর বুঝল তার পেশাব করতে হবে।
বাথরুম থেকে এসে গিয়ে খাটের পাশে বসল। স্ত্রীর ছেড়া কাপড়ের পুটুলিটার দিকে নির্মিশেষ তাকিয়ে থাকল। হঠাৎ গেয়ে উঠল, ‘আমাকে পোড়াতে যদি এত লাগে ভাল, জ্বালো আগুন আরো জ্বালো, ঢালো আরো ব্যাথা ঢালো। সেই বিয়ের পর থেকেই আমাকে কষ্ট দিয়ে শান্তি পাও, এখন আমার কষ্টের ভাঁড়ার তো পূর্ণ হয়ে গেছে, তোমার জেদের ভাঁড়ার এখনো পূর্ণ হয়নি, কবে আসবে? তারপর মেয়ের পুরাতন কাপড়ের পুটুলিটা কোলে নিল, হাত বুলাল, আদর করল চুমু দিল। তারপর বুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকল। হঠাৎ কেঁদে উঠে, ‘মা, মারে, তোরা কোথায়, আজ দশটা মাস হয়ে গেল তোদের দেখা নাই। এভাবে তো আর জীবন চলে না। বাপ আমার, তোরা কবে আসবি, আমি মারা যাওয়ার পর? বুকটা যে আমার ফেটে যাচ্ছে, তোদেরকে কবে দেখব, কবে আসবি? হ্যাঁ আসবি, একদিন আসবি, হয়ত সেদিন আমি আর থাকব না। তখন তোদের চোখের জলে নদী হবে, কিন্তু সেই নদীতে সাতরিয়ে মরেও আর আমাকে খুঁজে পাবি না। কাপড়ের পুটুলিটা বুকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকল।
আসরের আযান দিয়েছে অযু করে নামায পড়ল এবং জায়নামাজে শুয়ে থাকল। মাগরিবের আযান হল নামায পড়ে উঠে গেল, বাইরের রুমের দরজা খোলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকল। আসবে তার স্ত্রী সন্তান, এ পথ ধরেই আসবে একজন বোরকাওয়ালী, লম্বাটে গড়ন, যার কোলে বাচ্চা। মাদরাসা বন্ধ হওয়ার পর বারটা দিন এভাবেই কেটে গেছে। এই শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে বাইরে বা বন্ধু মহলে যেতে লজ্বা পায়। বন্ধু বান্ধবরা দেখলেই কেউ বলে, ‘এই যে আমাদের মজনু সাব এসে গেছে। কেউ শ্লেষের সুরে বলে, ‘দুনিয়াতে বউ ওয়ালা উনি একজনই আছেন, আর কেউ নেই। কেউ বলে, ‘আরে উনি হলেন আদর্শ স্বামী, বউয়ের জন্য নিজেকে একেবারে শহিদুল্লাহ করে দিচ্ছেন। কেউ বলে, ‘আরে তার বউয়ের মত এমন বিশ্ব সুন্দরী বউ আর কারো আছে নাকি, শহীদ হবে না কেন। এভাবে স্ত্রৈণতার জন্য বন্ধুরা তাকে তিরস্কার করে, উপহাস করে, হাসাহাসি করে। সে অপমান বোধ করে, এজন্যই বাইরে বেরোয় না।
বাড়িতে মোবাইল নাই। মায়ের তাকীদে তার ভাইয়েরা বাজারে গিয়ে দোকানের মোবাইলে কল করে, তখন সে তাদেরকে আশাব্যঞ্জক কথা বলে শান্ত করে দেয়। মাঝে মধ্যে বাজার থেকে মোবাইল বাড়িতে আনিয়ে মা নিজেই কল করে আর প্রশ্ন করতে করতে অতিষ্ঠ করে তোলে। তখন সেও দক্ষ অভিনেতার মত অভিনয় চালিয়ে যায়। কখনো নায়কের মত আত্নভোলা হাসি দিয়ে বলে, ‘হাঁ হাঁ, আগের চেয়ে এখন আরো বেশি খাই, স্বাস্থ্য আগের চেয়েও ভাল। কখনো ভিলেনের মত হাসি দিয়ে বলে, না না, আপনার আসতে হবে না, আমার মামলার ব্যাপারে ওরা ভয় পেয়ে গেছে, বউকে আর আটকাবে না। তাছাড়া বউও তো বোনদের ঝাঁটা পেটা খেতে খেতে এখন আসার জন্য লাইন খুঁজছে। কখনো বলে, না না, এখন আসব কেমনে, মাদরাসা খোলা, ঝামেলা আছে, লম্বা বন্ধ হলে পরে আসব। এভাবে সে মাকে পট্টি মেরে মেরে শান্ত রাখে।
সারাদিন একাকিত্ব ঘরে সময় কাটায়, নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অভিশপ্ত জীব মনে হয়। জীবন জীবনের উপর বোঝা মনে হয়। যে স্ত্রীকে এত ভালবাসল, যে ভালবাসার জোরে এত অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করল, দশটা মাস হয়ে গেল সে একটিবারও তার খোজ খবর নিল না, ফিরেও এল না। কি হবে আর বেঁচে থেকে, মরাই ভাল। অভিশপ্ত জীবন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। জীবনের প্রতি ঘৃণা ধরে গেছে, বিতৃঞ্চা জন্মে গেছে।
রাত বারটার পর উঠে এসে রান্না ঘরে গেল, পাতিল থেকে ভাত নিল, ভাত বলতে সকালে রান্না করা বাসী পোড়া ভাত, কিছু সাদা আর কিছু লালচে ও কালছে হয়ে আছে। সে সাধারণত গ্যাসের চুলায় ভাত বসিয়ে এসে পরে। তারপর যখন ভাত পোড়ে ধোয়ার কুন্ডলি ঘর আচ্ছন্ন করে ফেলে তখন খোজ পেয়ে গিয়ে পাতিল নামায়। বাটিতে একটু ঝুল এক টুকরা গোশত আছে। গতকাল হোটেল থেকে এনে একটু খেয়েছিল আরেকটু ছিল, পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। কিন্তু তার নিস্কৃয় অনুভুতিতে সুগন্ধ দুর্গন্ধ কিছুই টের পায় না, তা দিয়ে কয়েক লোকমা খেল। তবে ছোট বেলা থেকেই তার পেট ভয়ঙ্কর শক্ত, কোন দিন পেটের অসুখ হয়নি।
তারপর নিয়মানুযায়ী অযু করে তাহাজ্জুদে দাঁড়াল। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, ক্লান্ত হয়ে যায়। দুরাকাত বা চার রাকাত পর পর কিছুক্ষণ শুয়ে থাকে। তারপর আবার দুরাকাত বা চার রাকাত পরে বিশ্রাম করে। আবার নামাযে দাড়ায়। এভাবে নামায শেষ করে কোরআন শরীফ নিয়ে বসল, তারপর তাছবীহ টিপে টিপে দোয়া ইউনুস পড়ল। তারপর অভ্যাস অনুযায়ী দোয়ায় বসল। প্রথমে রাসূল (সাঃ) এর নামে দুরুদ পড়ল, তারপর পিতা, শ্বশুর ও মৃত অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের জন্য দোয়া করল, দোয়া চাইল। তারপর স্ত্রী সন্তানের জন্য দোয়া করল, উত্তম ও কল্যাণকর ফয়সালার জন্য আল্লাহ্র দরবারে অশ্রুপাত করল। তারপর বিছানায় গিয়ে কিছুক্ষণ স্ত্রীর কাপড়ের পুটুলিটার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর সহসা চেচিয়ে উঠল, ‘তুই নিষ্ঠুর, তুই পাষাণ, তুই গাদ্দার, তুই আমাকে ভালবাসিস না, আমার প্রতি তোর মনের কোন টান নাই। আমি তোকে ঘৃণা করি’ বলে পুটুলিটা ধরে বারান্দায় ছুড়ে মারল। কিছুক্ষণ নিথর হয়ে বসে থাকল, তারপর ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে পুটুলিটা নিয়ে এসে বুকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় শুয়ে পরল, ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদতে লাগল। তারপর পুটুলি খুলে পাগলের মত কখনো কাপড়গুলি মুখে চেপে ধরে কাঁদে, কখনো গায়ে জড়িয়ে হাসে, কখনো গায়ে মুখে ঘষে ঘষে আদর করে, চুম্বন করে, কখনো বুকে জড়িয়ে ধরে বা শিয়রে দিয়ে শুয়ে থাকে, হাসে, কাঁদে পাগলের প্রলাপ চলতে থাকে।
ফজরের আযান দিয়েছে। নামায পড়ে খাটে উঠে বসল। কাপড়ের খোলা পুটুলিটা বেধে তা শিয়রে দিয়ে বাচ্চার কাপড়ের পুটুলি ও জুতা বুকে চেপে ধরে কাত হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘণ্টা দুয়েক পর ঘুম ভাঙ্গল। উঠে গিয়ে বৈয়াম থেকে দুইটা বিস্কুট খেয়ে পানি খেল। তারপর কোরআন শরীফ পড়তে বসল। কিছুক্ষণ পর মনে হল তার তো অযু নাই। অযু করে আবার পড়তে বসল। কিছুক্ষণ পর উঠে গিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বাইরের রুমে শুয়ে থাকল। তারপর উঠে কিছুক্ষণ কোরআন পড়ে, কিছুক্ষণ শুয়ে থাকে, কিছুক্ষণ তাসবীহ পড়ে, দোয়া ইউনুস পড়ে, কিতাব পড়ার চেষ্টা করে।
হাসান কখনো ক্ষুধা অনুভব করে না, খাওয়া না খাওয়া তার কাছে সমান মনে হয়। খেতে মন চায় না, বমি আসে অস্বস্তি লাগে, তবুও যখন মনে হয় তখন শরীর স্বাস্থের জন্য কিছু খায় বা খাওয়ার চেষ্টা করে। আসরের পর মনে হল একটা কিছু খাওয়া দরকার। হোটেল থেকে দু’টি রুটি ও ডিম ভাজি নিয়ে আসল। একটা কোন রকম কষ্টে শিষ্টে পানি দিয়ে গিলে গিলে খেল, আরেকটা রাতের জন্য রেখে দিল। মাগরিবের পর আবার গিয়ে পাশের রুমে শুয়ে পড়ল। হাতে তাসবীহ নিয়ে দোয়া ইউনুস পড়ে আর রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কালো বোরকা দেখলেই চমকে উঠে, কোলে বাচ্চা দেখলে দৌড়ে দরজায় এসে দাড়ায়। কিন্তু প্রতিবার অন্তহীন হতাশা নিয়ে অবশ দেহটা বিছানায় ছেড়ে দেয়। রাত বারটার পর বাকী রুটিটা খেতে বসল। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও অর্ধেকের বেশি খেতে পারল না, বালতিতে ফেলে দিল। তারপর অযু করে নামায পড়তে দাঁড়াল, নামায পড়ে কোরআন শরীফ পড়ল। দোয়া ইউনুস পড়ল, স্ত্রী সন্তানের জন্য দোয়া করল। তারপর বিছানায় গিয়ে কাপড়ের পুটুলি নিয়ে চলতে থাকে হাসি কান্না ও মান অভিমানের পালা।
ফজরের নামায পরে শুয়ে ঘুমিয়ে পরল। দুই ঘন্টা পর ঘুম ভাঙ্গল। দু’টা বিস্কুট ও পানি খেয়ে অযু করে এসে কোরআন শরীফ নিয়ে বসল। তারপর বাইরের রুমে গিয়ে দরজা খুলে শুয়ে পরল। রাস্তায় পরিচিত দু’টি ছাত্র তার চোখে পরল, তারা বই পুস্তক নিয়ে মাদরাসায় যাচ্ছে। সহসা মনে হল আজ তো পহেলা জুলাই, মাদরাসা খোলার তারীখ। হাতের নখ দেখল, গোফে হাত দিল, তারপর আয়না দেখল। চেহারা দেখে তার কান্না পেল, নিজের প্রতি মায়া হল। নখ ও গোফ কেটে মাদরাসায় রওয়ানা হল। শিক্ষক কমন রুম বা ছাত্র শিক্ষকের সামনে যাওয়ার সে সাহস পেল না, লজ্বাবোধ করল। সোজা ক্লাসে গিয়ে নিথর হয়ে বসে থাকল। দুয়েক জন করে ছাত্র সালাম দিয়ে ক্লাসে ঢুকে কিন্তু উস্তাদের মুখের দিকে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে বেরিয়ে গিয়ে বারান্দায় দাড়ায়। এভাবে একে একে সবাই বারান্দায় জড়ো হয়ে কানাঘোসা করছে, পরামর্শ করছে। মাঝে মধ্যে দুয়েকটা কথা তার কানে আসছে। স্যারের কী হল, এ অবস্থা হল কেন। স্যার তো মরে যাবে। না, এ অবস্থা আর মেনে নেয়া যায় না। আমাদের একটা কিছু করা দরকার।
তারপর সালাম দিয়ে সবাই একসাথে ক্লাসে ঢুকল। কিন্তু তারা গম্ভীর হয়ে বসে রইল। আনোয়ার নামের একটি ছেলেকে হাসান বহু আগে গ্রামার পড়িয়েছিল। গ্রামার পাঠের কৌশল শিখিয়ে অতি সহজে তার মধ্যে আরবি গ্রামার ঢুকিয়ে দিয়ে ছিল। তারপর আরবী ইংরেজি ও বাংলা এ তিন ভাষার গ্রামারের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে সহজেই তার আয়ত্বাধিন করে দিয়েছিল। সেই প্রথম মুখ খুলল, ‘স্যার আপনের কী হইছে, নিজের শরীরের অবস্থা দেখেছেন, দুর্ভিক্ষের মানুষেরও তো এ অবস্থা হয় না। স্যার আপনি তো বাঁচবেন না। কার জন্য আপনি নিজেকে এভাবে তিলে তিলে ধ্বংস করে দিচ্ছেন। হাসানের মধ্যে কোন ভাবান্তর নেই। সে জড় বস্তুর মত নিথর বসে আছে।
ছেলেটি হঠাৎ রেগে গেল। ক্ষ্যাপা কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আপনার ওয়াইফকে আমরা জানি না, পুরুষালি গড়নের একটা মেয়ে লোক, চেহারা সুরতের নাই কোন সুরত ছিরি, যে নিজের স্বামী ফেলে ঢাকা ভার্সিটির শিক্ষকের বউ হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। বাঙালী মেয়েরা কখনো স্বামী ফেলে চলে যায় না। আপনি কম কিসে, আপনার মত একজন শিক্ষিত, একজন আদর্শ শিক্ষক এখনো বিয়ে করলে ঐ মহিলার চেয়ে হাজার গুণ ভাল বিয়ে করতে পারবেন। তা না করে এমন একটা খারাপ মহিলার জন্য আপনি নিজেকে ধ্বংস করে দিচ্ছেন- তাও আমাদের সামনে, এটা আমরা কি করে মেনে নিব’ বলে ছেলেটি দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠল। আর সাথে সাথে রুমটিতে বিষাদের ছায়া পরে গেল। ছাত্ররা গম্ভীর হয়ে বসে আছে, মুখ থমথমে। আরেকটু হলেই সবগুলি কেঁদে উঠবে, মাতম শুরু করে দেবে।
আনোয়ার রুমালে চোখ মুখ মুছে নাকি সুরে বলল, ‘স্যার ঐ মহিলার চিন্তা বাদ দেন, সে এখন আপনার নয় অন্যের। আপনি নতুন চিন্তা করেন, না হয় আমাদেরকে দায়িত্ব দেন আমরাই আপনার ব্যবস্থা করব। মুকাদ্দাস বলে উঠল, ‘কিন্তু স্যার তো এটা বিশ্বাস করেন না। আনোয়ার তাকে ধমকে উঠল, ‘কেন বিশ্বাস করেন না? এই রমযান যা, ওমর আলীকে ডেকে আন’। ওমর ফাযিলে পড়ে, সে এসে সালাম দিয়ে ভীতু ভীতু মুখে দরজার সামনে দাঁড়াল। আনোয়ার জিজ্ঞেস করল, ‘এই ওমর স্যারের ওয়াইফের খবর কি? ছেলেটা স্যারের দিকে একটু এগিয়ে এসে বলল, ‘আমাদের এলাকার সবাই জানে যে, স্যারের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। তবে কেউ বলে যে ঢাকা ভার্সিটির এক শিক্ষকের সাথে বিয়ে হয়ে গেছে, আর কেউ বলে এখনো হয় নি, শীঘ্রই হবে।
হাসান বিষণ্ণ হেসে বলল, ‘তোমরাই পাগল নাকি আমিই পাগল ? স্ত্রী আমার, আর আমার বউকে আমি চিনি, সে আমার সাথে ইঁদুর বিড়াল খেলছে। স্বামী ছেড়ে যাওয়ার মত মেয়ে সে নয়। একদিন দেখবে ঠিকই এসে হাজির হয়ে গেছে। কী তোমরা উদ্ভট আলাপ সালাপ কর, তালাক হয়নি আর তোমরা বলছ অন্যত্র বিয়ে হয়ে যাবে। সে ছাত্রদের সাথে বউ নিয়ে আলাপ করতে লজ্বা পায়, তাই বলল, ‘ওমর যাও, হ্যাঁ শুরু কর, কিতাব দাও’। ওমর চলে গেল, বারান্দায় আরেক ছাত্রের সাথে কথা বলছে। হাসানের কানে এল, ‘হুঃ, ‘বিশ্বাস করে না, যেদিন ধরে জোর পূর্বক তালাক নিয়া বিয়া দিয়া দিবে সেদিন বিশ্বাস করবে। হাসান কথা বলতে পারছে না। মুখ থেকে ঠেলে গায়ের জোরে কথা বের করছে, তার কষ্ট হচ্ছে। ছাত্ররা বুঝতে পেরে বলল, ‘স্যার আজকে ক্লাস থাকুক চলেন আপনার বাসায় যাব আপনি কিভাবে থাকেন কি খান সব দেখব। এখন থেকে আমরাই আপনার তদারকি করব’ বলে সবাই উঠে পরল। তারপর বলল, চলেন আগে সেলুনে যাই, চুল গোফে আপনাকে চেনাই যায় না, একেবারে পাগলের মত দেখা যায়। মুকাদ্দাস বলল, ‘তোমাদের যাওয়ার দরকার নাই আমিই যাচ্ছি। তারা বলল, ‘ঠিক আছে তুইই যা, সমস্যা হলে আমাদেরকে জানাবি। একটা ছাত্র বলল, ‘স্যার এই সানগ্লাসটা চোখে দেন তাহলে চোখটা আড়াল থাকবে লজ্বা থেকে বাঁচতে পারবেন। ‘ঠিকই বলেছ’ বলে সে চশমাটা নিল। ছাত্ররা স্যারকে বাসায় পাঠিয়ে দিল।
মুকাদ্দস সুন্দর, লম্বাটে, একহারা গড়নের নজরকারা সুন্দর যুবক। মাদরাসায় এ ছেলেটিই সবচেয়ে সুদর্শন । ছাত্রদের বিষয় ওস্তাদের জানার সুযোগ কম, তবুও ভাব- ভঙ্গি ও উড়ো কথায় হাসান বুঝতে পারে ছেলেটির পিছনে মেয়েদের উপদ্রব আছে। কিন্তু মুকাদ্দস সৎ, চরিত্রবান ও আদর্শবান ভাল ছেলে, এসব সে প্রশ্রয় দেয় না। বাসায় পৌঁছে হাসান কিছু টাকা দিল, সে বাজার থেকে মাছ ও গোশত কিনে নিয়ে এল। ছেলেটা বাসায় ঢুকেই আবর্জনার স্তূপ দেখে তার মাথা ঘুরিয়ে গেল। সে অবাক হয়ে বলল, ‘স্যার একি পরিবেশ, আমাদেরকে ডাকলেই তো আমরা এসে সব ঠিকঠাক করে দিয়ে যেতাম। তারপর সে একঘণ্টা পর্যন্ত বাসা পরিস্কার ও গোছানোর কাজ করল। তারপর বলল, ‘চলেন সেলুনে যাই, চুল কাটিয়ে আনি। সে বলল, ‘আজ দরকার নাই, কাল আমিই কাটাব নে। ছেলেটা জোড়াজোড়ি করল কিন্তু সে গেল না। তারপর উস্তাদকে বলে কয়ে গোসল করাল, পনের দিন পর তার গোসল হল।
এরপর রাধতে গেল। মাছ ভাজি করল ও গোশত ভুনা করল। রান্না শেষ হলে বলল, ‘স্যার আমি অবশ্যি খেতাম না কিন্তু আপনি কী খান কিভাবে খান তা দেখার জন্য আপনার সাথে বসে খাব। হাসান বলল, ‘না না, আমি এখন খাব না, তুমি খেয়ে চলে যাও। ছেলেটি মুচকি হাসল, ‘আমি খেয়ে চলে যাই তারপর আপনি ইচ্ছামত না খেয়েই থাকতে পারবেন, তাই না? দৃঢ় কণ্ঠে, ‘আসেন স্যার আমার সাথে খেতে হবে’ বলে সে দু’টি প্লেটে ভাত বেড়ে স্যারকে খেতে বাধ্য করল। মাছ ভাজি দিয়ে তিন লোকমা খেল, চতুর্থ লোকমায় বমি এসে গেল। তাড়াতাড়ি মুখে পানি নিয়ে ঢুক গিলল। লজ্বায় ও অপরাগতায় কেঁদে ফেলল, ‘আমি তো খেতেই চাই কিন্তু ঠিকমত খেতে পারি না, কি করব বল। ছেলেটা সমব্যথী হয়ে করুণার চোখে কিছুক্ষণ উস্তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। দরদ ভরা কণ্ঠে বলল, ‘স্যার খান একটু কষ্ট করেই খান, ধীরে ধীরে অভ্যেসটা ফিরে আসবে। তারপর মা যেভাবে শান্তনা দিয়ে দিয়ে শিশুকে খাওয়ায় সেভাবে যাচনা করতে লাগল আর মাছের কাটা বেছে দিল এবং হাড়বিহীন নরম গোশতগুলি পাতে দিল। হাসান পানি দিয়ে ঢোক গিলে আর কয়েক লোকমা খেয়ে ভাত ও তরকারি ছেলেটার পাতে দিয়ে বলল, ‘আল হামদুলিল্লাহ যথেষ্ট খেলাম, এভাবে কয়েকদিন খেতে পারলে আমার শরীর ঠিক হয়ে যাবে ইংশাল্লাহ।
মুকাদ্দস বলল, স্যার ম্যাডাম সম্পর্কে আমি জানি তেমন সুন্দর না, নাক বুচা, শুটকি মাছের মত শুকনা, পুরুষালি গড়ন, তাহলে তার জন্য কেন আপনি এত ত্যাগ স্বীকার করছেন। হাসান অবাক হয়, আসলেই কি তার স্ত্রী পুরুষালি গড়ন ছিল, বিষয়টাতো সে কোনদিন চিন্তা করেনি। সে ছিল লম্বাটে, আর কিছু কিছু লম্বা মেয়েদের নারী সুলভ কোমলতা, কমনীয়তা ও রমণীয়তা থাকে না। ফেরদৌসীও কি তাই ছিল কিন্তু ছেলেরা এতসব জানল কি করে। জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা এতকিছু জান কেমনে? সে উত্তর দিল, ‘আপনাদের আয়া এসব আলাপ করে, সে নাকি মাঝে মাঝে আপনার বাসায় আসত। এবার সে রহস্যটা বুঝল। ছেলেটা আবার বলল, ‘স্যার ঐ মহিলার চিন্তা বাদ দিয়ে অন্য চিন্তা করেন। আপনি তো অনেক ছাত্রের বাড়িতে বেড়ালেন অথচ আমি কয়েক বার দাওয়াত দিলাম কিন্তু আপনি যাননি। এবার যেতে হবে, বলেন কবে যাবেন। হাসান ভাবল, এ সময়ে একটু বেড়ালে ভালই হবে, চল তাহলে আগামি বৃহস্পতিবারেই যাই, শনিবার এসে ক্লাস ধরব।
বৃহস্পতিবার ছাত্রটা এসে ওস্তাদকে জামা কাপড় ও চশমা পড়িয়ে বলল, ‘জামার কারণে আপনার শরীর দেখা যায় না, আর চশমা চোখে থাকলে চশমা ও দাড়ির কারণে আপনার মুখের অবস্থাও বুঝা যায় না। দেখে সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান বলেই মনে হয়। আপনি বাইরে গেলে কখনো চশমা খুলবেন না, আর আমাদের বাড়িতে গিয়ে একটু কষ্ট হলেও জামাও খুলবেন না চশমাও খুলবেন না। হাসানও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখল, ভালই তো হৃষ্ট- পোষ্ট স্বাস্থ্যবান মনে হয়, দুর্ভিক্ষ পীড়িত কঙ্কাল বলে বুঝা যায় না। এরপর থেকে সে আর চশমা ছাড়া বাইরে বের হত না, আর জামা তো এমনিতেই থাকত, এ জন্য লোকেরা তাকে দেখে তার শারীরিক অবস্থা বুঝতে পারত না।
পূর্ব মুখী বাড়ির উত্তর দক্ষিণা একটা লম্বা টিনের ঘর, সামনে প্রশস্ত উঠান, উঠানের এক পাশে দুইটা খড়ের গাদা। দেখেই বুঝা যায় স্বচ্ছল কৃষক পরিবার। টিনের ঘরের সর্ব দক্ষিণের রুমটি তারা বৈঠক ঘর হিসাবে ব্যবহার করে। এখানেই হাসানের ঠাই হল। বিকালে আসার সাথে সাথে সেমাই ও আঞ্চলিক কিছু পিঠা খাওয়াল। এখন রাতের খাবার এনেছে। অনেকগুলি বাটি, দেশী চিংড়ি, চিরকা ও বিভিন্ন জাতের ছোট মাছের তরকারি। এ জাতীয় মাছ দেখলে হাসানের ক্ষুধা না থাকলেও ক্ষুধা লেগে যায়। তার উপর আছে দেশী মুরগী ও গরু গোশত। বুঝল খানাটা জমবে ভাল।
মুকাদ্দসের বাবা বিকালে একবার সালাম কালাম করে গেছেন। এখন আবার এসেছেন। অতিশয় বৃদ্ধ মানুষ, চুল দাড়ি এমনকি চোখের ভ্রু পর্যন্ত পেকে সাদা হয়ে গেছে। বয়সের ভারে কিছুটা ক্বুজো হয়ে গেছেন, তবে এখনো শক্ত সামর্থ। মুকাদ্দস তার থলে ঝাড়া (সর্ব কনিষ্ঠ) সন্তান। তিনিও হাসানের সাথে খেতে বসলেন এবং আলাপ শুরু করলেন, ‘সংসারের সুখ শান্তি নির্ভর করে মেয়েদের উপর। মেয়ে মাইনসের স্বভাব চরিত্র ভাল না হলে অশান্তি হয়, সংসার টিকে না। তারপর তিনি কয়েকটা দুষ্ট মেয়ে লোকের উদাহরণ দিলেন। তারা স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির লোকদের সাথে দুর্ব্যবহার করত, ঝগড়া হত, অশান্তি হত, অবশেষে ছাড়াছাড়ি হয়। তারপরেই এদের ভাগ্যে নেমে আসে নির্মম পরিণতি। তাদের একজন এখন দর্জিগিরি করে খায়, আরেক জন বাপের বাড়ির কামলার সাথে ভেগে গিয়ে তার সাথেই আছে, একজনের নাকি এগারোটা বিয়ে হয়েছে, আরেকজন তৃতীয় বিয়ের পর দ্বিতীয় স্বামীর বন্ধু বান্ধম মিলে ধর্ষণ করে মেরে ফেলে।
পুরাতন অভিজ্ঞ মানুষ, এ ধরণের অনেক চমকপ্রদ ঘটনা বললেন, তারপর হাসানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ভাল করেছেন, এ ধরণের মেয়ে লোক নিয়ে ঘর করা যায় না, ত্যাগ করাই ভাল। আপনার ছাত্রের কাছে সব কিছুই শুনেছি। তা মেয়েটার শুনেছি বিয়ে হয়ে গেছে, এখন বাচ্চাটা কোথায় আছে? হাসান অবাক হয়ে গেল, মৃদু হেসে বলল, ‘না ছাড়াছাড়িই তো হয়নি বিয়ে হবে কেমনে। বৃদ্ধ একবার হাসানের দিকে তাকালেন তারপর চোখ বিস্ফারিত করে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুই না বললি বিয়ে হয়ে গেছে? মুকাদ্দস থতমত খেয়ে গেল, বিধ্বস্ত গলায় বলল, ‘আমি আগে শুনেছিলাম তালাক হয়ে গেছে। পরে জানতে পারলাম এখনো হয় নি তবে খুব শীঘ্রই হয়ে যাবে। বৃদ্ধ ‘ও আচ্ছা’ বলে শান্ত হয়ে গেলেন। কিন্তু হাসানের খুব রাগ হল, ছেলেটা এমন মিথ্যা বলছে কেন, এটা তো বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, আগে থেকেই সে সীমালঙ্গন করছে। উপযাচক হয়ে বলে, ‘স্যার ম্যাডামের তো অন্যত্র বিয়ে হয়ে যাচ্ছে আপনি অন্য চিন্তা করেন অর্থাৎ ওস্তাদকে আবার বিয়ের জন্য উদ্বুদ্ধ করে। ছাত্রের প্রতি মনটা তিক্ত হয়ে উঠল। কিন্তু বাপের সামনে কিছু বললে ছেলেটা লজ্বিত হবে বিধায় সে আর কিছু না বলে নীরব থাকল। হাসান প্লেটে প্রথম বাড়ার ভাতের সাথে শুধু তরকারি খেল, নতুন করে ভাত নিল না। মুকাদ্দস জানে বলে উস্তাদকে ভাতের জন্য পিড়াপিড়ি না করে বেশি বেশি তরকারি দিল। তার বৃদ্ধ বাবাও মেহমানের খাওয়ার দৈন্যতা সম্পর্কে কিছুই বুঝতে পারল না। খাওয়া দাওয়ার পর বৃদ্ধ আরো কিছুক্ষণ আলাপ করে চলে গেলেন।
পরদিন বেলা বারটার দিকে মুকাদ্দস ত্রস্ত পায়ে ঘরে ঢুকে বলল, ‘স্যার জামাটা পরেন চশমাটা চোখে দেন, তাকে পেরেশান দেখাচ্ছে। তারপর কাচুমাচু করে বলল, ‘স্যার আপনার শরীরটা খুব শুকিয়ে গেছে চোখও গর্তে পরে গেছে। এ অবস্থায় কেউ দেখলে লজ্বার বিষয় হবে। তাই বলছিলাম, আমাদের এখানে যতক্ষণ আছেন জামা আর চশমা পরা থাকলে মনে হয় ভাল হবে। তারপর সে চলে গেল। শীঘ্রই হাসান বুঝতে পারল পাশের রুমে যাওয়ার জন্য ঘরের ভিতরে যে দরজা- তার আড়ালে দাঁড়িয়ে কেউ তাকে পর্যবেক্ষন করছে, অনেকক্ষণ ধরে দেখছে। কিছুক্ষণ পর মুকাদ্দস এল, তার সাথে সাথে একজন বোরকাওয়ালী মহিলা সালাম দিয়ে ঢুকে কুশল বিনিময় করল। ছেলেটি পরিচয় করিয়ে দিল, ‘আমার বোন, সকলের বড়, দক্ষিণ পাড়ায় বাড়ি। মহিলাটি বলল, ‘স্যার জুমার পর আমার ওখানে দাওয়াত রাখেন। হাসান মুচকি হেসে বলল, ‘আমার মুনিব তো এখন মুকাদ্দস, দাওয়াত রাখব কি না সেই জানে। সে বলল, ‘তুমি যাও, স্যরকে নিয়ে বিকালে আসব। মহিলাটি নাছোড় বান্দা। মুকাদ্দস ধমকের সুরে বলল, ‘আরে যাও, বললাম তো বিকালে আসছি। অগত্যা তার বোন চলে গেল।
বিষয়: সাহিত্য
১৫৩১ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন