চিঠি- ৫০ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২৯ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০৫:১৩ দুপুর
এবার আব্বার মৃত্যু কাহিনী বলে শেষ করব। মৃত্যুর বছর দেড়েক আগে থেকেই তিনি বলতেন তার ভিতরে ক্ষয় রোগ শুরু হয়েছে, বেশি দিন বাঁচবেন না, এ কথা প্রায় প্রায়ই বলতেন। অতিরিক্ত ইবাদত ও কান্না এই ব্যধির কারণ হয়। মৃত্যুর তিন মাস আগে স্বপ্ন দেখলেন আকাশ থেকে শ্বেত-শুভ্র পোশাক ধারি এক জ্যোতির্ময় পুরুষ একটা বোরাক নিয়ে আসছেন। তার মাথায় সাদা ধবধবে পাগড়ি, সাদা জুব্বা, সাদা দাড়ি, চেহারা থেকে জ্যোতি ছড়িয়ে পরছে। অপার্থিব সুন্দর বোরাকের পিঠে স্বর্ণের গদি আটা। আব্বা বহির্বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে আছেন। সেই জ্যোতির্ময় পুরুষ এসে তার সামনে নামলেন, তাকে শুন্যে উঠিয়ে স্বর্ণের গদিতে বসিয়ে আবার আকাশের দিকে উড়াল দিলেন।
পরদিন তিনি স্বপ্নের কথা বললেন, কিন্তু আম্মা গায়ে মাখলেন না। আর আমি তেমন বুঝতামও না, মনোযোগ দেয়ার প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু তিনি আমাকে আর আম্মাকে সতর্ক করার জন্য ঘনঘন স্বপ্নের কথা উল্লেখ করে বলতেন, ‘তিনি আর বাঁচবেন না। আমরা মনে করতাম তিনি হুদাই এসব বলেন, মনোযোগও দিতাম না, সতর্কও হতাম না। তিনি মাঝে মধ্যে আমাকে সংসারি বিষয়াদি বুঝাতে চাইতেন। জমির হিসাব দিতেন, এজমালি মানে পৈত্রিক সম্পত্তির হিসাব দিতেন। তখন আম্মা ধমকে উঠতেন, ‘আপনের তো আর কাজ নাই, এইটুকু ছেলেকে জমির হিসাব দেন, ও কি বুঝে’। তখন আব্বা লজ্বিত হয়ে উৎসাহ হারিয়ে ফেলতেন। আমরা কখনো বিশ্বাস করিনি, করতে পারিনি বা করা সম্ভব ছিল না যে, ঐ অবস্থায় আব্বার ইন্তেকাল হতে পারে।
কারণ এ অবস্থায় কোন পরিবারের কর্তার মৃত্যু কল্পনা করা সম্ভব নয়। কারণ তখন আমার বড় বোনের সদ্য বিয়ে হয়েছে, তারপর আমি, আর আমার বয়স তখন পনের বছর। বর্তমানে পনের বছরের ছেলেরা নিজেই কম্পিউটার। কিন্তু আশির দশকে পনের বছরের ছেলেরা হাফ প্যান্ট পরত, আর এর চেইন খোলা থাকত। নাক দিয়ে শিট বেরুত, নারী পুরুষ কাকে বলে, পার্থক্য কি বুঝত না। নয়টি ভাই বোন, সবাই ছোট। কামলা লজিং সব মিলিয়ে বিশাল ব্যয়বহুল পোষ্য ভারাক্রান্ত পরিবার। এ অবস্থায় পরিবারের কর্তা থাকবে না, এটা কল্পনা করা অন্তত আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তখন বুঝিনি কিন্তু পরে বুঝতে পেরেছিলাম, আসলে স্বপ্ন দেখার পর থেকেই আব্বার মধ্যে পরিবর্তন আসতে থাকে। দীর্ঘ সময় তিনি নামায ও কোরআন তিলাওয়াতে কাটাতেন। বেশির ভাগ সময় মসজিদে থাকতেন, বাড়িতে কম সময় কাটাতেন। সাংসারিক ঝামেলা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। হাট বাজার কামলা ও লজিংকে দিয়ে করাতেন। টাকা পয়সার হিসাব থাকত আম্মার কাছে। কথা কম বলতেন সব সময় গম্ভির হয়ে থাকতেন।
১৯৮৬ সালের শবে বরাতের পর থেকে তার মধ্যে আমুল পরিবর্তন এসে যায়। তখন তিনি নামায পড়তেন বেশি বেশি কিন্তু নামাযের মধ্যে ঘুমিয়ে পরতেন। আমার এখনো চোখে লেগে আছে, অধিকাংশ বৈঠকের সময় মানে আত্তাহিয়্যাতুর সময় ঘুমিয়ে পরতেন। তখন তিনি আত্মভোলা- অপ্রকৃতিস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। দেখে মনে হত যেন তিনি পৃথিবীর মানুষ নয়, ভীন গ্রহের মানুষ।
৭ রমজান, ১৭ মে ১৯৮৬ সাল। শনিবার দিবাগত রাতে স্বপ্নে দেখলেন তাকে সাপে কেটেছে, রবিবার জহুরের পর থেকে ঘাড়ে ব্যথা অনুভব করলেন। আসরের পর অসুস্থ বোধ করলেন। এ দিন ছিল হাটবার। কামলা বাজারে যাবে, কী একটা ঔষধ আনার কথা বললেন। আমিও কামলার সাথে বাজারে যাব, আম্মা একটা বৈয়াম দিয়ে বললেন কিছু মিষ্টি কিনে আনতে। আগে গ্রামের অবস্থাপন্ন বাড়িগুলির বহির্বাড়িতে আলাদা ঘর থাকত- যাকে আমরা কাচারি ঘর বলি। সেখানে লজিং, কামলা বা মেহমান আসলে থাকত। আব্বা মাগরিব পরে গিয়ে কাচারি ঘরে শুইলেন, ঘরে যাবেন না। আম্মা রাতে আনতে গেলেন কিন্তু তিনি বললেন, ‘আমার সামনে এসো না, আমি ঘরে যাবো না। তাহলে স্ত্রী সন্তান সংসারের প্রতি আমার মনোযোগ বসে যাবে, আল্লাহ্র যিকিরে বাধা হবে’ এ কথা বলে তিনি আম্মাকে সামনেই আসতে দিলেন না। এশার নামায আদায় করলেন কাচারি ঘরে বসে বসে। তারাবির পর মুসুল্লিরা সবাই দেখতে এল। তারা বলে কয়ে জোর করে ঘরে পাঠাল।
৯ রমজান, সোমবার। তিনি সারা শরীরে বিষ বা ব্যথা অনুভব করলেন। মিসুল্লিরা ও গ্রামবাসীরা ভাবল স্বপ্নে সাপে দংশন করেছে এই বিষ শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে, ঝাড়- ফুক দিলেই ঠিক হয়ে যাবে। উত্তর ময়মনসিংহে সাপে কাটা রুগীর বিখ্যাত ওঝা ছিল আমাদের পাশের বাড়ির, আমাদের মসজিদের মুসুল্লি। জহুরের পর ওঝা নিয়ে সব মুসুল্লী এল আব্বাকে ঝাড় ফুক করাবে কিন্তু তিনি বেকে বসলেন। কারণ তারা হিন্দুয়ানি মন্ত্রে ঝাড়ত এবং প্রতিটা মন্ত্রের পর বিষ নামানোর জন্য ‘মা পদ্মার তলব’ এই দোহাই দিত। তিনি কঠোরভাবে জানিয়ে দিলেন, কুফুরি মন্ত্রে ঝাড় ফুক নিবেন না। মুসুল্লিরা সন্ধ্যা পর্যন্ত অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। তখন আম্মার জ্যাঠাত ভাই চেয়ারম্যান, তিনি ও আব্বা সমবয়স্ক ছিলেন। নিজেদের মধ্যে হাসি মসকরাও করতেন, ছোট ভগ্নিপতি হিসাবে আব্বাকে মওলানা ডাকতেন। তারাবীহর পর তিনি এসেই বললেন, ‘মওলানা কোথায়, আপনের কথায় তো হবে না, অসুখ হয়েছে আমরা যেভাবে পারি সেভাবে চিকিৎসা করাব। হাদীসে আছে না ঔষধ হিসাবে মদ খাওয়াও জায়েয, তাহলে আপনি বাধা দেন কেন’ ইত্যাদি বলে আব্বাকে ঘর থেকে তুলে এনে ওঝা দিয়ে ঝাড়ালেন। কিন্তু কোন কাজ হল না। রাতে অবস্থার আরো অবনতি হল। সমস্ত শরীরে প্রচন্ড ব্যথা, সেই সাথে ঘাম। পানি ঝড়া ঘাম নয়, স্যাতস্যাতে ঘাম, সেটাকে আমরা মরঘামনি বলি। ত্বক স্যতাস্যাতে ঠাণ্ডা কিন্তু ভিতরে প্রচণ্ড গরম। তিন চারটা হাত পাখায় অনবরত বাতাস দিতে হয়।
১০ রমজান, মঙ্গল বার। এলাকায় ছড়িয়ে পরল মুফতি সাবকে স্বপ্নে সাপে কেটেছে, এখন শরীরে বিষ ছড়িয়ে পরেছে। যে যেখান থেকে পারল ফকির কবিরাজ নিয়ে আসতে লাগল। তখন রমজান উপলক্ষে মাদরাসা বন্ধ, ছাত্ররা সবাই বাড়িতে চলে গেছে, কিছু যারা আছে তারা আসতে শুরু করল। বালিয়া মাদরাসার এক হুজুর এসে পিঠে তামার থালা বসালেন বিষ তুলে নেয়ার জন্য। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। আমার আপন মামা একজন, আম্মার ছোট। তিনি সব সময় আব্বার কাছে থাকেন। অবশেষে সিদ্ধান্ত হল ময়মনসিংহ চরপাড়া হাসপাতালে নেয়া হবে, এ্যান্বুলেন্স আনা হবে। কিন্তু আব্বার এক কথা, তার আর বেশি সময় নাই, তিনি বাড়ি ছাড়বেন না, কোথাও যাবেন না।। মঙ্গলবার বিকাল থেকে সারা রাত সবাই অনুরোধ করল কিন্তু তিনি বাড়ি ছেড়ে বাইরে যাবেন না।
১১ রমজান, ২১ মে, ১৯৮৬ সাল। তখন এম বি বি এস ডাক্তার বলতে একজনই ছিল, ফুলপুর টাউনে থাকে। সকালে মামা গেলেন তাকে আনতে। ডাক্তার একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে বলল এটা কাউকে দিয়ে পুশ করান, আমি পরে আসছি। অবশ্য পরে এসে সে ঘোরে যায়। বুধবার সকালে আব্বার অবস্থা নাজুক হয়ে উঠল। তখন আম্মা বুঝতে পারলেন যে তার সময় শেষ। তিনি শিয়রের কাছে বসে কেঁদে উঠলেন, ‘আপনে বলতেছেন আপনের সময় শেষ, তাহলে এই ছোট ছোট পোলাপানগুলির কি হবে। চেয়ারম্যান আছে, পোলাপানের মামারা আছে, চাচা জ্যাঠারা আছে, তাদেরকে কিছু বলে যান। আব্বা রেগে উঠলেন, ‘তুমি এটা কি বললে, আমার পোলাপানকে আমি মানুষের হাওয়ালায় রেখে যাব? আমার পোলাপানকে আমি আল্লাহ্র হাওয়ালায় রেখে গেলাম’। ইতিমধ্যে এলাকার সবার কাছ থেকে তার মাফ চাওয়া ও দাবী ছাড়ানোর কাজ শেষ। টুকটাক লেন- দেনের হিসাব নিকাশ লিখার কাজ শেষ। তিন চারটা পাখায় অবিরত বাতাস করা হচ্ছে, তিনি শুয়ে শুয়ে কখনো তওবা পড়েন, কখনো কোরান শরীফ, কখনো যিকির আযকার করেন।
১১ই রমজান, বুধবার। বেলা দশটার দিকে মামা বাজার থেকে গ্রাম্য ডাক্তারকে নিয়ে এলেন ইঞ্জেকশন পুশ করার জন্য। আব্বার গরম ও ঘাম চূড়ান্ত রূপ ধারন করেছে। শরীর ঘামছে, গরমে তিনি ছটফট করছেন। চার পাঁচটা পাখা দিয়ে অবিরত প্রবল বাতাস দেয়া হচ্ছে, ভিজা কাপড় দিয়ে শরীর মোছা হচ্ছে। তবুও তিনি গরম গরম বলে অস্থিরতা করছেন। আব্বার শিয়র থেকে দুই হাত ব্যবধানে আমি দাঁড়িয়ে আছি। মামা এসে বললেন, ‘উঠেন, কাচারি ঘরে যেতে হবে, ডাক্তার এসেছে’ কথাটা তিনি বারবার বলছেন কিন্তু আব্বার এদিকে মনোযোগ নাই। তিনি গরম গরম বলে হা পিত্তিশ করছেন। অবশেষে মামা মাথার নিচে হাত দিয়ে টেনে তুললেন। তখন তিনি চরম বিরক্তি ও অসহ্যের সুরে হুবহু এই কথাটা বললেন, ‘আহ, আমাকে বিরক্ত করছ কেন, এখন জোরে একটা বাতাস এসে বৃষ্টি হত, আমার শরীরটা ঠাণ্ডা হত, আমি চলে যেতাম’। ব্যস, এইটুকু কথা কিন্তু এই কথাটাই আমার জীবনে আজন্মের প্রশ্ন হয়ে থাকল।
তারপর ধরাধরি করে কাচারি ঘরে নেয়া হল, তিনি উত্তর দিকে মাথা দিয়ে বিছানায় শুইলেন। পুর্ব পশ্চিমা কাচারি ঘরের দরজা পুর্ব দিকে, চৌকি পশ্চিম পাশে। এর বেড়া পাট কাঠির ন্যায় এক প্রকার শলার- যেটাকে আমরা বাতা বলি। আমি চৌকির নিকট আব্বার পাশে পশ্চিম মুখি হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ডাক্তার সুই সিরিঞ্জ ধুয়ে আব্বার পাশে এসে দাড়িয়েছে ইঞ্জেকশন পুশ করার জন্য। ঘর থেকে এখানে আনা হয়েছে মিনিট পাঁচেক হবে। আমি আব্বার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। আকাশে কোন মেঘ নেই, সাঁজ নেই, ডাক নেই, চিহ্ন নেই এবং নেই বহু দিন ধরে। সহসা ঈশান কোণ থেকে একটা প্রবল বাতাস ছুটল- যা বাতাসও নয় ঝড়ও নয় মাঝামাঝি ধরনের একটা ঝঞ্ঝা। আমি চেয়ে আছি, বাতাসটা বাতার বেড়া ভেদ করে আব্বার গায়ে লাগার সাথে সাথে তার উর্ধ্বশ্বাস উঠল অথচ তার কোন শ্বাস কষ্ট ছিল না। সাথে সাথে ডাক্তার কী একটা ইঞ্জেকশনের কথা বলল। মামা আমাকে বললেন তাড়াতাড়ি তুই একটা সাইকেল নিয়ে ডাক্তার বাড়ি বা সাংবাদিকের বাড়ি থেকে নিয়ে আয়।
ডাক্তার বাড়ি হল আমার খালুর বাড়ি, আমাদের বাড়ি থেকে পাঁচশ হাত পশ্চিমে। সেখানে পৌছতেই প্রবল বৃষ্টি, মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হল। এখানে না পেয়ে ছোটলাম পাঁচশ হাত দক্ষিণে- সাংবাদিকের বাড়ি। সেখানে না পেয়ে ফিরে আসছি। আর বৃষ্টি নাই, আকাশে ও মাটিতে বৃষ্টির চিহ্ন পর্যন্ত নাই অর্থাৎ পাঁচ মিনিট বাতাস হল তারপর পাঁচ মিনিট বৃষ্টি হল। বাড়ির পিছনে মসজিদের সামনে আসতেই দেখি মানুষের দৌড়াদৌড়ি, আমার আর বুঝতে বাকী রইল না, সাইকেল থেকে পরে গেলাম। তারপর আর কিছু বলতে পারব না। এরপর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মাত্র দু’টি স্মৃতি আমার মনে আছে। আমি আব্বার পায়ের উপর পরে কাঁদছি, নুরুজ্জামান নামে একটা লোক আমাকে টেনে ধরে বাইরে নিয়ে গেল। আরেকটা দৃশ্য হল, বাড়িতে গিয়ে দেখি আমার ছোট একটা বোন বার বার বেহুশ হচ্ছে আর তার মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। এই দিন থেকে যে দুর্ভাগ্য আমার পিছু নিয়েছিল তা আজো আমায় তাড়িয়ে ফিরছে। আব্বার আগে থেকে কোন রোগ ছিল না। তবে মৃত্যুর সময় কি হয়েছিল তা আজ পর্যন্ত কেউ বলতে পারে নি। মাত্র দুই দিনে উপযুক্ত চিকিৎসা দেয়াও সম্ভব হয়নি। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৪৮ আটচল্লিশ বছর (১৯৩৭ - ১৯৮৬)। (রাব্বিরহাম হুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা)।
এবার আপনার সাথে আমার একটা প্রশ্ন শেয়ার করব, মৃত্যুর তিন মাস আগে আব্বা স্বপ্ন দেখেছিলেন, এক অপার্থিব পুরুষ স্বর্ণের গদি আটা বোরাকে চড়িয়ে তাকে উর্ধ্ব জগতে নিয়ে গেছেন। এ জাতীয় আরো কিছু বিষয় আছে যে গুলি আমাদের এলাকার লোকেরা, আব্বার ছাত্ররা সবাই বিশ্বাস করে। একইভাবে তারা বিশ্বাস করে মৃত্যুর মুহুর্তে তার ইচ্ছানুযায়ি শরীর ঠাণ্ডা হওয়ার জন্য বাতাস ও বৃষ্টি হয়েছিল। তারা মনে করে, আল্লাহ্র এক খাটি বান্দার অন্তিম ইচ্ছা তিনি পূরণ করে ছিলেন। কারণ তাদের যুক্তি হল তিনি সাহাবায়ে কেরামের মত জীবন- যাপন করতেন, ফেরেশতার মত নিষ্পাপ ছিলেন। তার কোন পাপ বা অন্যায় আছে বলে কেউ বলতে পারে না। তিনি আল্লাহ্র অলী ছিলেন। আর আল্লাহ্র অলীকে তার অন্তিম ইচ্ছা পূরণ করে ঠাণ্ডা ও শান্ত করে উঠিয়ে নিয়ে গেছেন। আমিও একইভাবে একই কারণে বিশ্বাস করেছি।
কিন্তু আমার শিক্ষা জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে আমি হয়ে উঠি শুধু বাস্তববাদী নয় অতিবাস্তববাদী। হযরত শাহ জালাল (রঃ) আযান দিলেন আর গৌর গোবিন্দের প্রাসাদ ভেঙ্গে পরল, জায়নামাজে দাঁড়িয়ে ৩৬০ জন সহচরসহ সুরমা নদী পেড়িয়ে গেলেন। আবার খাজা মইনুদ্দিন চিশতি (রঃ) অযু করতে দিতে অস্বিকার কারী হিন্দুর পুকুর থেকে এক পাতিল পানি এনে গোটা এলাকা পানি শুন্য করে ফেলেন, এমনকি মায়েদের স্তন পর্যন্ত শুকিয়ে ফেলেন। এই সব আমার আজন্মের বিশ্বাসগুলি ফিকে হয়ে আসে। অতিপ্রাকৃত গল্প বলেই মনে হতে থাকে। সেই সাথে আব্বার ঘটনাটাও আমার কাছে কাকতালিয় মনে হল। কিন্তু আমার সকল চিন্তা ও সংস্কার মুখ থুবড়ে পরে একটা প্রশ্নের সামনে, সেই দিন ঐ মুহুর্তে কেন বাতাস ও বৃষ্টি হল, আগে- পিছে হতে পারল না অথচ আব্বার মৃত্যুর আগে প্রায় মাস খানেক, পরে প্রায় মাস খানেক এক ফোটা বৃষ্টি নেই। টানা দেড় থেকে দুই মাস প্রচণ্ড খড়া চলছে, কোন বৃষ্টি নেই।
১৯৮৬ সালে বৈশাখের এ খরায় আগাম আউশ ধান সব পোড়ে গিয়েছিল। আমার মনে আছে প্রথম মাড়াই করা চার কাটা (৩২ শতক) জমিতে ধান হয়ে ছিল মাত্র ১০ থেকে ১২ সের। লোকেরা বলাবলি করত মুফতি সাব মারা যাবে এজন্য এই খরা হয়েছে। অবশ্য পরে বৃষ্টি হওয়াতে নামিলা বা পিছিয়ে রোপিত ক্ষেতগুলিতে মোটামোটি ধান হয়েছিল। এখন প্রশ্নটা হল, এই সর্বদাহি খরার মধ্যে ক্ষনিকের এই বাতাস ও বৃষ্টিটা কেন হয়েছিল? আমি তো এর প্রত্যক্ষদর্শি এবং সাক্ষী, বিছানা থেকে তোলার পর তিনি রাগত স্বরে বললেন, ‘আহ আমাকে বিরক্ত করছ কেন, এখন একটা বাতাস এসে বৃষ্টি হত, শরীরটা ঠাণ্ডা হত, আমি চলে যেতাম’। তারপর তাকে কাচারি ঘরে নেয়া হল, আল্লাহ্র মর্জি হল না বিধায় তাকে পার্থিব কোন চিকিৎসা বা ইনজেকশন দেয়া গেল না। আর তখন আকাশে কোন মেঘ নেই, সাঁজ নেই, চিহ্ন নেই, ডাক নেই, বিজলি নেই, বাতাস নেই হঠাৎ ঈশান কোণ থেকে ঝড়ের বেগে বাতাস, এ বাতাস গায়ে লাগার সাথে সাথে উর্ধ্বশ্বাস শুরু হল। পাঁচ মিনিট বাতাসের পর শুরু হল বড় বড় ফোটায় প্রবল বৃষ্টি। পাঁচ মিনিট বৃষ্টির ঠিক মাঝখানেই তিনি ইন্তেকাল করেন।
তারপর আবার কাঠফাটা রুদ্দুর, মেঘের কোন চিহ্ন না আছে আকাশে আর না আছে মাটিতে, ক্ষনিকের বৃষ্টি চুনের মত মাটি চোষে নিয়েছে। বৃষ্টির মাঝ পথে কেন মৃত্যু হল, আগে পিছে হতে পারল না? এটা কি কাকতাল নাকি আধ্যাত্মবাদ বা অলীদের কারামত? আমি চিন্তার অনেক খড় কাঠ পুড়িয়েছি। অগত্যা আমিও এ সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য হয়েছি যে, অলীদের কারামত সত্য আর এটাও আল্লাহ্র এক অলীর কারামত। ঈমানদাররাও হয়ত এ কথাই বলবে। কিন্তু যারা নাস্তিক মুরতাদ আধ্যাত্মবাদ স্বীকার করে না বা যারা অতিবাস্তববাদী তারা এই ঘটনার কী ব্যাখ্যা দিবেন? তাদের ব্যাখ্যা আমার জানার কৌতুহল।
(তিলকা উম্মাতুন ক্বাদ খালাত, লাহা মা কাসাবাত ওয়া আলাইনা মাকতাসাবনা- তারা অতীত হয়ে গেছেন, তাদের কর্মের উত্তম প্রতিদান আল্লাহ তাদেরকে দিয়েছেন এবং দিবেন, আর আমাদের কর্মফল আমরা পাব।)
বালিয়া মাদরাসাটি বাংলাদেশের বড় কয়েকটা মাদরাসার মধ্যে একটি। এই মাদরাসা বৃহত্তর ময়মনসিংহে প্রায় এককভাবে এবং সারা বাংলাদেশে ইসলামী শিক্ষা ও দাওয়ার প্রসার ঘটিয়েছে। আমার বাবার হাজার হাজার হয়ত বা লক্ষ ছাত্র যারা বাংলাদেশ এমনকি বহির্বিশ্বেও ইলমে দ্বীনের খিদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে, ইসলামী শিক্ষা ও দাওয়ার প্রসার ঘটাচ্ছে। দেশের অধিকাংশ মানুষ তার ইলমের সাথে সম্পৃক্ত। কারণ দেখা যাবে, তারা হয়ত তার কোন ছাত্র বা অধস্তন কোন ছাত্রের কাছে কায়দা আমপারা বা কোরান শরীফ শিখেছে। তাদের কারো পিছনে নামায পড়েছে, বিয়ে পরিয়েছে, কোন মাসয়ালা মাসায়েল জেনে নিয়েছে। তাছাড়া তখন তিনি ছিলেন বৃহত্তর ময়মনসিংহের একক মুফতি, দেশের বৃহত্তর অংশের মুসলিম পারিবারিক বিধানাবলি, ফারায়েয ইত্যাদি তার ফতোয়ায় মিমাংসা হত। এভাবেই দেখা যাবে দেশের অধিকাংশ মানুষ তার ইলমের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে আছে। এসবই হল সদকায়ে জারিয়া, তার ছাত্রদের মাধ্যমে চক্রবৃদ্ধিহারে কিয়ামত পর্যন্ত দ্বীনের খিদমত চলতে থাকবে আর এর নেকি তার নামে লিখা হতে থাকবে কিয়ামত পর্যন্তই।
তিনি দুনিয়াদার আলেম ছিলেন না, মানুষ নয়- ছয় কত কিছু করে কত বৈধ অবৈধ অর্থ উপার্জন করে অথচ তিনি বিপন্ন মানুষের সেবায় যে অর্থ ব্যয় করেছেন তা জমিয়ে রাখলে অনেক কিছু হত। যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের সময় কয়েক সের চাউল দিয়ে এক কাটা জমি পাওয়া যেত। সে সময় তিনি দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের জন্য যে অর্থ ব্যয় করেছেন, তা দিয়ে যদি জমি কিনতেন তাহলে আমরা জমিদার থাকতাম। এসবই তিনি করেছেন খ্যাতির জন্য নয়, আল্লাহ্র রেজামন্দির জন্য। আর আল্লাহ্র সন্তুষ্টি তিনি পেয়ে গেছেন।
যাই হউক আজ আর নয়, ক্ষান্ত করলাম। তবে আপনাকে প্রথমেই বলেছিলাম ধার্মিকতা ও মানব সেবায় যদি পুরুস্কার দেয়া হয় তবে আমার বাবাই এর প্রাপক হবেন, বিষয়টা আপনিও চিন্তা করতে পারেন। ফুরকান সাব এতক্ষণ হাসানের দিকে তাকিয়ে হা করে ছিলেন, তার প্রত্যেকটা কথা গোগ্রাসে গিলছিলেন। চমক ভেঙ্গে বললেন, ‘হ্যাঁ তিনি তাকওয়া ও মানব সেবায় প্রবাদ পুরুষ। আপনি বন্ধ করবেন না, চালিয়ে যান। এ ধরণের কথা বই পুস্তকে পাওয়া যায় না। এসব মহান ব্যক্তিদের জীবনি বলা উচিত, ব্যাপকভাবে প্রচার করা উচিত, তাহলে এ ফেতনার যুগে মানুষ উপদেশ গ্রহন করতে পারবে, শিখতে পারবে, কিছুটা হলেও ভাল থাকবে। হাসান বলল, ‘না ভাই, অনেক রাত হয়ে গেছে। এ লম্বা ইতিহাস, অন্য সময় ধীরে ধীরে শুনাব। তবে আপনি বলেছেন এ জাতীয় কথা ব্যাপকভাবে প্রচার করা উচিত। এ বিষয়ে আমার একটা বক্তব্য আছে।
আমরা দেখি আলেকজান্ডার, নেপোলিয়ন, হিটলার, মাও সেতুং, লেনিন ইত্যাদির নাম ইতিহাসে অমর হয়ে আছে, একটা শিশুও তাদেরকে চিনে, জানে। এরা তো মানবতার সেবক ছিল না- তাহলে তাদের এত সম্মানের কারণ কী? কারণ একটাই, এরা পৃথিবীতে ধ্বংস আগুন আর নৃশংসতার পয়গাম নিয়ে আবির্ভত হয়েছিল। এদের লক্ষ একটাই ছিল, পৃথিবীকে আর মানব জাতিকে পদানত করা, মানুষের প্রভুত্বের আসন দখল করা। এদের তৎপরতায় নিরীহ নিরাপরাধ মানুষের আশুর নদী প্রবাহিত হয়েছে, খুনের স্রোতে ভেসে গেছে হাতি, ঘোড়া, মানুষ পাথর পর্যন্ত। এরা মনুষ্যত্ব পদদলিত করেছে। এরা মানব জাতির আশির্বাদ নয় কলঙ্ক, মানব প্রজন্মের দুষ্ট তিলক।
পক্ষান্তরে ঐসব রক্ত পিপাসু দানবেরা যখনি পৃথিবীতে অশান্তির আগুন জ্বালিয়েছে তখনই কিছু সংখ্যক মানবতার সেবক নিজেদের রক্ত সিঞ্জন করে সেই আগুন নিভিয়েছে। এরা লোক চুক্ষুর অন্তরালে, নীরবে নিভৃতে ছোটে গেছে মুমূর্ষু মানবতার দোয়ারে দোয়ারে। অসহায় মানুষের চোখের আশু মুছে দিয়েছে, আহতের মুখে পানি তুলে দিয়েছে, দুখি মানুষের ললাটে হাত বুলিয়ে দিয়েছে, অন্ধের হাতটি ধরে নদী পার করে দিয়েছে। গরীব, ইয়াতিম, অসহায় পরিবারটির মুখে ক্ষুধার অন্ন তুলে দিয়েছে। সংখ্যায় সিমীত কিন্তু এরা আছে। এরা আছে হয়ত রণক্ষেত্রের এক কিনারে, সভ্য নগর জনপদের কোন পরো বাড়িতে, নদীর কিনারে, হাসপাতালের বারান্দায় বা পল্লির কোন ঝুপড়িতে। এই মহান মানবতাবাদীরা অন্তহীন মমতায় মানবতার মুমূর্ষু চারা গাছটিতে নিজের বুকের রক্ত সিঞ্জন করে করে এক সময় নিঃচিহ্ন হয়ে যায়। কিন্তু তাদের প্রতি কেউ ফিরে তাকায় না, স্বরণ করে না, পৃথিবীর কোন চোখ তাদের জন্য কাঁদে না, ইতিহাসের পাতায় তাদের জন্য একটু ঠাই হয় না। এখানে, ঠিক এখানেই আমার প্রশ্নটা। যেখানে ইতিহাসের ললাটে রক্ত পিপাসু দানবদের নাম লিখা হয় স্বর্ণাক্ষরে, সেখানে ঐসব মানবতার সেবক- যারা জীবন নদীর উপরে নিজের দেহটা পেতে দিয়ে অন্যদের বলে, ‘ভাই তুমি সাকো পেরিয়ে যাও’ তাদের নাম কেন লিপিবদ্ধ হয় না, তাদের জন্য কেন একটু ঠাই বরাদ্দ দেয়া হয় না। ঐতিহাসিকের দৃষ্টি তাদের প্রতি কেন অন্ধ, কলম কেন উদাসিন, মানব জাতি কেন তাদের প্রতি অকৃতজ্ঞ। এই পাপের শাস্তি হিসাবেই কিছুদিন পর পর পৃথিবীতে শুনা যায় রক্ত পিপাসু দানবের পৈশাচিক উল্লাস।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলি, ইতিহাসের পাতায় অনেকের ঠাই হয়েছে, আমরা ঘটা করে তাদের জন্ম মৃত্যু দিবস পালন করি। কিন্তু সেখানে কয়জন মানবতাবাদি মানব সেবকের নাম উঠেছে। যারা পাঠ্য পুস্তক প্রণয়ন করে তারা বুদ্ধিজীবী, কিন্তু গুদামে বুদ্ধি কতটুকু আছে তা আমাদের বুঝে আসে না। কারণ তারা গল্প উপন্যাস কবিতা জীবনী ইত্যাদি দিয়ে পাঠ্য গ্রন্থ সংকলন করে। এগুলির মধ্যে কোন মানব সেবকের জীবনী নেই। ফলে এই পাঠ্য সুচি পড়ে জাতির সন্তানরা ছাত্র কাল থেকে গুন্ডা, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, চরিত্রহীন, খুনি লোটেরা হয়ে গড়ে উঠছে। এরা যাদের টাকায় শিক্ষিত হচ্ছে সেই দরিদ্র জন গোস্টির পেটে লাথি মেরে দেশের সম্পদ বাইরে পাচার করছে, দেশ বিক্রি করে দিচ্ছে। পক্ষান্তরে ত্যাগী মানব সেবকদের জীবনী যদি পাঠ্য তালিকায় থাকত তাহলে জাতির সন্তানরা এভাবে দুর্নীতিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়ে পরত না। বরং গল্পের শেষের নীতি বাক্য ‘আমরাও বড় হয়ে তার মত ধার্মিক, দানশীল ও মানব সেবক হব’ পাঠ করে শিশুদের মনে প্রভাব পরত, সেই আদর্শ ব্যক্তির ন্যায় নীতিবান হওয়ার চেষ্টা করত। আর তখন দেশ ও জাতি এতটা রসাতলে যেত না।
কাজেই জাতির কাছে আমার প্রশ্ন, জাতি কি আমার বাবা নামের ঐ মানুষটি এবং এ জাতীয় মহান ব্যাক্তি- যাদের সংখ্যা নিতান্তই কম, তাদের অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছে, তাদের নাম ইতিহাসে লিপিবিদ্ধ করেছে, তাদের নাম কি স্বরণ করে? করে না। ইসলামিক ফাউন্ডেশন ‘ফতোয়া ও মাসায়েল’ নামক একটা মাসলা- মাসায়েল সংক্রান্ত গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। ঐ গ্রন্থে এ দেশে ফতোয়ার দায়িত্ব পালন করেছেন এমন কিছু দেওবন্দি আলেমের সংক্ষিপ্ত জীবনী এসেছে। কিন্তু আমার আব্বার জীবনীতে উল্লেখিত অনেক তথ্য ভুল। সংশোধনীর জন্য আমি দুইবার মৌখিক ও একবার লিখিত আবেদন জানিয়েছি। কিন্তু তারা সংশোধন করেনি। জাতিকে যারা দ্বীনের আলো দেখাল, বিপন্ন মানবতার সেবা করল- এটা কি তাদের প্রতি অবহেলা নয়? আর জাতির এই গাদ্দারি ও বেইমানির প্রতিফল হচ্ছে, রাজনৈতিক হানাহানির নামে তাদেরকে রাজপথে পুড়িয়ে মারা হয়, তাদের ধন সম্পদ, বাড়ি ঘর, ব্যবসা বাণিজ্য, গাড়ি বাড়ি সব কিছু পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়, তাদের পেটে লাথি মেরে তাদেরই সম্পদ বাইরে পাচার করা হয়। এটাকেই বলে প্রকৃতির প্রতিশোধ।
যাই হউক, আমি ছোটলোক, নিচু জাত তা প্রমাণের জন্য আমার পরিচয় তুলে ধরলাম মানুষের বিবেকের আদালতে, তারাই সিদ্ধান্ত নিবে। সেই সাথে আত্মস্বীকৃতি দিচ্ছি আমি কুলাঙ্গার। গ্রাম্য প্রবাদে বলে ‘পথে হেগে বাপের গাইল’ অর্থাৎ কোন শিশু পথে হাগলে পথিকরা সেখান দিয়ে যায় আর গালি দেয়, ‘উহ, কোন কুত্তার বাচ্চা এখানে হেগে গেল’। আমিও এ পরিবারে বিয়ে করে এমনি এক কীর্তি করলাম, মা বাপকে গালির উপলক্ষ করলাম। কারণ যারাই তাদের কথা শুনবে, তারাই জ্ঞাতে- অজ্ঞাতে আমার মা বাপকে নিচু ভাববে, হেয় প্রতিপন্ন করবে। আর যে স্ত্রী স্বামীর ঘর না করার জন্য এমন বাহানা লোক সমাজে প্রচার করে বেড়ায় পুরুষের প্রকৃতি হচ্ছে এমন স্ত্রীর মাথা কামিয়ে চুনকালি মেরে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু আমি তা পারছি না, কারণ আমি স্ত্রৈণ, আমি ক্রীতদাস, আমি সেই শিশু যে পথে পায়খানা করে বাপকে গালি শুনায়। এ জন্যই আমি কুলাঙ্গার।
ফোরকান সাব ধরা গলায় বললেন, ‘এখন বুঝতে পারলাম আপনি কত বড় ছোট লোকের সন্তান। এমন ছোট লোকের সন্তান হতে পারলে পৃথিবীর যে কেউ নিজেকে ধন্য মনে করবে। এবার আমার ব্যাখ্যাটা শুনেন, আপনার ভায়রাগুলি সবাই কামলা বা বর্গা চাষির ছেলে আর আপনার বাবা কে এবং কী তা আমরা আগে থেকেই জানি, এ জন্যই আপনি ছোটলোক নিচুজাত। আবার আপনার ভায়রাগুলির শিক্ষার দৌড় হল ম্যাট্রিক ইন্টার পাশ, ইঞ্জিনিয়ার তো বোধ হয় ইংরেজিতে ইঞ্জিনিয়ার শব্দটাও লিখতে পারবে না আর আপনি দেশের ত্রিমুখি ধারায় শিক্ষিত, এ জন্যই আপনি ছোট লোক। তিনি প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা আপনার ভাইয়েরা কি কেউ মুরগি টুরগি বেঁচে? হাসান বুঝল এবং হাসল। তিনি বললেন আপনার শালা ও সম্বন্ধি মুরগির ব্যবসা করে, এজন্যই আপনি নিচুজাত। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা আপনার মা কি মেয়েদের বাসায় বাসায় থাকেন? এবারও সে বুঝল এবং হাসল। তিনি বললেন, আপনার শ্বশুর ফ্যামিলির কিছুই নাই, তারা আত্মীয়স্বজন ও জামাইদের উপর নির্ভরশীল। আপনার শাশুড়ি মেয়েদের বাসায় বাসায় ঘোরে সময় কাটায়। এ জন্যই আপনারা ছোটলোক। আপনার ভায়রাদের ছেয়ে সর্বদিক থেকে আপনি ব্যতিক্রম এজন্যই তাদের দৃষ্টিতে আপনি ছোটলোক নিচুজাত। এদের কুফু (বৈবাহিক সমতা) হল অর্ধ শিক্ষিতের স্ত্রী হওয়া, কামলার পুত্রবধু হওয়া। কিন্তু আপনার স্ত্রীর ক্ষেত্রে হয়ে গেছে ব্যতিক্রম, এ জন্যই সে এমন স্বপ্ন দেখেছে। কুয়োর ব্যাঙ সাগরে পরে গেছে’ বলে তিনি হাসলেন।
হাসান বলল, ‘আসলে কি জানেন, আমার ভায়রাগুলি নিতান্ত দরিদ্র পরিবারের ছেলে, কিছুটা শিক্ষিত হয়েছে, নামি দামি মানুষের মেয়ে বিয়ে করেছে। এদের যেহেতু কোন পৈত্রিক বা সামাজিক পরিচয় নাই তখন তারা সামাজিক মর্যাদার লক্ষে শ্বশুর বাড়ি কেন্দ্রিক বউ নির্ভর একটা পরিবার ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। আমার বউ দেখল তার দুলা ভাইরা কোনদিন তাদের মা-বাপের নাম মুখে নেয় না, বাড়িতে যায় না, কিন্তু আমি মা-বাপকে শ্রদ্ধা করি, বাড়িতে যাই। এজন্যই এ বোকা মূর্খ মেয়েটা মনে করেছে আমি প্রথা ভঙ্গ করেছি, আর আমাকে নিচু ও ছোট লোক ভাবতে শুরু করেছে। ফোরকান সাব বলল, ‘আপনি বলছেন নামি দামি লোক কিন্তু আপনার শ্বশুর কোন নামি দামি লোক ছিলেন না, তিনি একজন দরিদ্র স্কুল মাস্টার ছিলেন। তার মৃত্যুর পর পরিবারটি সম্পূর্ণ অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে পরে। মেয়েগুলি দুলাভাইদের বাসায় বাসায় থাকত, আপনার শাশুড়িটা মেয়েদের বাসায় দিন কাটায় অথচ ওরা অহংকারে বাঁচে না, আমাকে ও আমার বউকে পর্যন্ত পাত্তা দেয় না।
হাসান বলল, ওদের আট বোনের মধ্যে চারজন চুড়ান্ত পর্যায়ের অহংকারী, হিংস্র, মুখরা ও বদমেজাজি, তন্মধ্যে আমার বউটা শ্রেষ্ঠ। আমি চিন্তা করি ওরা এসব গুণাবলি পেল কোত্থেকে, মায়ের জিন পেল নাকি বাবার? কিন্তু আমার শাশুড়ি তো অতীব সহজ সরল একজন বোকা মানুষ। তার একটা ঘটনা বলি। তার ভাগ্নে অর্থাৎ বড় বোনের ছেলে জাহাঙ্গির একজন চোখের ডাক্তার, খালার সাথে তার খুব আন্তরিকতা। একদিন সে বলল, ‘আচ্ছা খালা, ঐ যে কারেন্টের খামটা দেখছেন? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, দেখছি। - ঐ গাছটা দখছেন? –হ্যাঁ, দেখছি। - ঐ লোকটা দেখছেন? – হ্যাঁ, দেখছি। এরপর বলল, ‘আচ্ছা আপনি লোকটাকে দেখলেন অথচ আপনাকে দেখতে দিচ্ছেন না, এটা কি স্বার্থবাদি হল না, মুনাফেকি হল না? তিনি আমতা আমতা করে বললেন, ‘তাই তো হল। সে বলল, ‘মুনাফিকদের ব্যাপারে আল্লাহ্ কি বলেছেন জানেন? - কী বলেছেন? - আল্লাহ্ বলেছেন, ‘মুনাফিকদের স্থান হবে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে। কাজেই জাহান্নাম থেকে বাঁচতে চাইলে আর মুনাফেকি করবেন না আর এভাবে পায়ের পাতা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢেকে চলবেন না। আপনি যাদেরকে দেখবেন তাদেরকেও আপনাকে দেখতে দিবেন।
এবার তিনি সতর্ক হলেন, আর মুনাফেকি করবেন না। বোরকা পরতে চাইতেন না, পরলেও মুখ মাথা উদোম রাখতেন যাতে তিনি যাদেরকে দেখবেন তারাও যেন তাকে দেখতে পারে, নইলে যে মুনাফেকি হবে। প্রায় ৭০ বছরের মুরুব্বী মানুষ, তার দিকে মানুষ তাকায় পথিক হিসাবে বা মা, চাচী, দাদি, নানী হিসাবে। তার মেয়েরা এ অবস্থা দেখে ভিরমি খেল। তারা ভাবল, মরার বয়সে মাকে আবার কোন ভিমরতি ধরল। তারা মাকে ধমক দিল, ‘বাইরে গেলে ভাল করে পর্দা করে যাবে। কিন্তু তিনি ঝংকার দিয়ে উঠলেন, ‘না না, জীবনে বহু মুনাফেকি করেছি, আর নয়। তোদের কথায় আরো মুনাফেকি করে জাহান্নামে যেতে পারব না। তোরাও জাহান্নামে যেতে না চাইলে মোনাফেকি ছাড়। মেয়েদের চোখ কপালে উঠল, ‘তুমি এসব কী বলছ, পর্দা মুনাফেকি নাকি? - মুনাফেকি নয় তো কি? আমি যাদেরকে দেখবো তারা তো আমাকে দেখতে পায় না। তোরাও তো মানুষকে ঠিকই দেখিস কিন্তু নিজেদেরকে দেখতে দিস না, এটা মোনাফেকি না? - এসব কথা তোমাকে কে বলেছে? -জাহাঙ্গির বলেছে।
এবার তারা হাসতে হাসতে একে অন্যের উপর গড়িয়ে পরে আর বলে, ‘তুমি ঐ ভন্ডটার মুরিদ হয়েছ। সে ঠিকমত নামাযটা পড়ে না, তার বউটাকে ছেড়ে দেয় পেট পিঠ উদোম করে মার্কেটে মার্কেটে প্রদর্শনি করে বেড়ায়। তারপর মাকে বুঝাল কিন্তু মা তো বুঝ মানে না, তার এক কথা- জীবনে অনেক মোনাফেকি করেছেন আর করবেন না। অগত্যা জাহাঙ্গিরকে মোবাইল করে এনে তাকে দিয়ে বুঝাল। সে বলল, ‘খালা আমি ঠাট্টা করেছিলাম। এতেই বুঝা যায় তিনি কতটা সরল মানুষ। তার বাবার পরিবারের সবাই সহজ সরল ভাল মানুষ। কিন্তু আমার শ্বশুর কেমন ভাল মানুষ ছিলেন জানি না। তার মেয়েদের এসব বদ স্বভাব কোত্থেকে এল তাও জানি না। তবে একটা বিষয় জানি, ওদের বোনগুলি চেতনাহীন, বেহুশ। আর এ ব্যধিটা আমার শ্বশুরের ছিল। আমার সম্বন্ধিটা লেখাপড়া করত না, ভন্ডামি করত। তখন সে ভাল হওয়ার জন্য আমার শাশুড়ি না খেয়ে রোযা রাখত, তাও এক দুই দিন নয় বছরের পর বছর। এই না খেয়ে রোজা রাখার কারণে তিনি চিরদিনের জন্য রোগী হয়ে যান। অথচ একই বিছানায় থেকে তিনি স্ত্রীর অবস্থা বুঝলেন না। এতেই বুঝা যায় তিনি কতটা বেহুশ ছিলেন।
যাই হউক মোটের উপর কথা হল কোন ভাল বাবা মায়ের সন্তান এদের মত কুৎসিত চরিত্রের হতে পারে না। আমার বউটা আমার সাথে শুয়ে থেকে পর পুরুষের জন্য কাঁদত।
যাই হউক অনেক আলাপ হয়ে গেল। আমি যে জন্য এসেছি, আপনি ইঞ্জিনিয়ারের সাথে আলাপ করে আমার বিষয়টা ফয়সালা করে দেন অথবা আমার বউ কোথায় আছে ঠিকানাটা অন্তত সংগ্রহ করে দেন। ফোরকান সাব বলল, ‘ঠিক আছে যান, আমার সাধ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করব। তারপর হাসান বেরিয়ে গেল। দু’দিন পর বিকাল বেলা আবার গিয়ে উপস্থিত হল, ফোরকান সাব বললেন, অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু ফয়সালা কি করব আপনার বউই নাকি আপনার ঘরে আর আসবে না, সে অন্যত্র বিয়ের ধান্ধায় আছে। জানতে পারলাম ঢাকা ভার্সিটির এক শিক্ষকের সাথে নাকি তার বিয়ের আলাপ হচ্ছে, সত্য- মিথ্যা জানি না। হাসান কিছুটা চমকে উঠে বলল, ‘এসব উড়ো কথা উড়িয়ে দেন, ওর ঠিকানাটা সংগ্রহ করে দেন। তিনি বললেন, ঠিকানা তো দুরের কথা ওদের ভিতরের কথা জানতে পারবে কোন বাপের পোলার এমন সাধ্যি নাই। হাসান হতাশ হয়ে চলে গেল।
তারপর গেল ফেরদৌসির স্কুল মাস্টার সেই চাচীর কাছে। বেচারিকে সে কয়েকদিন দৌড়ের উপর রাখল। কয়েকদিন দৌড়াল ফেরদৌসির মা ও বড়াপার সাথে আলাপ করে বিষয়টা ফয়সালার জন্য কিন্তু ব্যর্থ হল। তারপর দৌড়াল ফেরদৌসির ঠিকানা সংগ্রহের জন্য তাও ব্যর্থ হল। তারপর অন্তত মোবাইল নাম্বারটার জন্য চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। অবশেষে সকল দিক থেকে নিরাশ হয়ে সে ঘর বৈঠক হয়ে পরল। কিন্তু স্ত্রী সন্তানহীন নিঃসঙ্গ ঘর তার কাছে কবরের মত মনে হয়, দম বন্ধ হয়ে আসে।
একটা কিছু করা দরকার, কিন্তু কী করবে? বেড়ানো যায়। কিন্তু কোথায়? ছাত্রদের বাড়ি, হ্যাঁ ছাত্রদের বাড়ি বাড়ি বেড়ানোর সিদ্ধান্ত নিল। ছাত্ররা উস্তাদকে দাওয়াত দেউক বা না দেউক ‘এই অমুক দিন তোদের বাড়িতে যাব’ বলে দুয়েক কেজি মিষ্টি হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে গিয়ে হাজির হয়ে যায়। সকাল দশটায় আবার এসে মাদরাসায় হাজির হয়। পরদিন আবার কোন ছাত্রের বাড়ি চলে যায়। তারপর হয়ত দুয়েকদিন মিস যায়, আবার ছাত্রের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হয়। কিন্তু খুব শীঘ্রই বুঝল এটা আর সম্ভব নয়, কারণ অনেক ছাত্র এতে রাজি থাকে না, মুখ লজ্বায় উস্তাদকে মানাও করতে পারে না। আবার কোন কোন ছাত্রের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা নেই, অভিভাবক বিরক্ত হয়, তখন ঘুম তো দুরের কথা ঠিকমত শুয়াই যায় না। এক ছাত্রের বাড়িতে গিয়ে তো মসজিদে থাকতে হয়েছিল।
আবার কোন ছাত্রের বাড়িতে গিয়ে খাওয়ার জন্য লজ্বা পেতে হয়। অভিভাবকরা ছেলের উস্তাদের জন্য ভাল মন্দ রান্না করে কিন্তু সে খেতে পারে না। দু’চার লোকমা খেয়ে ব্যস হয়ে গেছে বলে হাত ধুয়ে ফেলে বা পানি দিয়ে গিলে গিলে কয়েক লোকমা খায়। তখন অভিভাবকরা মনে করে রান্না ভাল হয়নি বিধায় খায়নি। তখন মেজবান ও মেহমান উভয়েই লজ্বিত হয়। আবার কোন কোন ছাত্রের বাড়িতে ঝাল খায়, আর সে ঝাল একদম খেতে পারে না। কাজেই ছাত্রদের বাড়িতে বেড়ানোর ধান্ধা বাদ দিল। মুকাদ্দস নামের ছাত্রটা কয়েক দিন ধরে তাদের বাড়িতে বেড়ানোর দাওয়াত দিচ্ছে, হাসান তাকেও বলে দিল, ‘আপাতত আর কোথাও বেড়াব না।
এবার সে বাসায় শুয়ে বসে সময় কাটায়, বাইরে তেমন বের হয় না। মহিলাদের মত রাত দিন বাসাতেই পরে থাকে। ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে বন্ধু মহলে যেতেও লজ্বা পায়। ঘুম খাওয়া লোপ পেল। স্ত্রী সন্তানের ছেড়া কাপড় নিয়ে বসে থাকে, ধ্যান করে। কখনো শিয়রে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে, কখনো বুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে। এভাবে তার সময় যেতে লাগল। স্বাস্থ্য আরো দ্রুত ভেঙ্গে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে দু’সপ্তাহের জন্য মাদরাসা বন্ধ হল। সে এই শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে মায়ের সামনে যাওয়ার সাহস পেল না। বন্ধু মহলেও যেতে সাহস পায় না, অষ্ট প্রহর বাসায় নিঃসঙ্গ একাকি সময় কাটাতে লাগল।
বিষয়: সাহিত্য
১৭৩০ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন