চিঠি- ৪৯ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২৭ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:৫৪:৫৩ দুপুর
ইতিমধ্যে চা বিস্কুট এল, হাসান খেতে খেতে বলল, আব্বা সম্পর্কে আমার জানা ঘটনাগুলি বললে আধাআধি একটা লাইব্রেরী রচনা করতে হবে। কাজেই সময় নিয়ে আপনাকে ধীরে ধীরে সব শুনাব। এখন তার মানব সেবা সংক্রান্ত দুয়েকটা ঘটনা বলে শেষ করি, রাত অনেক হয়েছে। আমার আব্বার মাদরাসাটি ছিল কওমী মাদরাসা- যা বাংলাদেশের বিখ্যাত কয়েকটি মাদরাসার মধ্যে একটি। আর কওমীর হুজুররা যে কয় টাকা বেতন পায় তা কারো অজানা নয়। কাজেই আমাদের জীবিকার প্রধান উৎস ছিল কৃষি। আর আমার বাবা জমিদার ছিলেন না, মধ্যম পর্যায়ের একজন জমিওয়ালা ছিলেন। তবে আমাদের মাটি ছিল উর্বর, যে কোন জিনিস বাম্পার ফলন হত। তাছাড়া দানশীল পরিবারে আল্লাহ্র রহমত ও বরকত থাকে। ফল-ফসল, শাক-সবজি, তরিতরকারি প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন হত, মানুষ আসত প্রয়োজন মাফিক নিয়ে যেত। আম জাম কাঁঠাল প্রচুর ফলত, মানুষ প্রয়োজন মাফিক নিয়ে যেত, কোন বাধা ছিল না। দুধ সাধারণত কেউ কাউকে দেয় না কিন্তু গ্রামের কারো বাড়িতে বাচ্চা, রোগী বা বুড়াবুড়ি থাকলে আমাদের বাড়ি থেকে দুধ নিয়ে যেত অর্থাৎ আমাদের বাড়িটা ছিল সরকারি গুদাম।
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে গত শতকের ৮০ এর দশক পর্যন্ত দেশ ছিল কৃষি নির্ভর, গ্রাম ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থাই ছিল রাষ্ট্রের প্রাণ শক্তি। ৯০ এর দশক থেকে গার্মেন্টস ও অন্যান্য শিল্প কারখানা গড়ে উঠতে থাকে, গ্রাম ছেড়ে মানুষ শহরমুখি ধাবিত হতে থাকে। রুটি রুজির সন্ধানে বিদেশ পাড়ি জমাতে থাকে। এর আগে গ্রামীন অর্থনীতি সাধারণত পাট, আউস ও আমন এ দু’টি ফসলের উপর নির্ভরশিল ছিল। ফসল দু’টি লাগার আগে গ্রামে প্রচন্ড অভাব থাকত, এ সময়টাকে বলা হত আহাল (আকাল) আর রংপুর অঞ্চলে বলা হয় মঙ্গা। তখন বড় বড় কৃষকদের ঘরে ধান থাকত আর তারা দাদন ব্যবসা করত। অর্থাৎ ধরা যাক, পঞ্চাশ টাকা দরের একমন ধান নিলে ফসল উঠার পর পচাত্তুর টাকা দিতে হত। আর এই ব্যবসাটা বেশি করত আমার মাতুল গোস্টি অর্থাৎ চেয়ারম্যান বাড়িরা। কিন্তু আমার আব্বা শুধুমাত্র করযে হাসানা দিতেন, তাও কঠিন নিয়মে। অর্থাৎ ধরা যাক, এই মানের ধানটা আজ বাজার দর ৪০ টাকা, ফসল উঠলে ৪০ টাকাই দিবে। এটার আজ বাজার দর ৫০ টাকা, ফসল উঠলে ৫০ টাকাই দিবে, এক টাকাও বেশি না। তবে গ্রহিতারা দেয়ার সময় কম দিত, অনেকে আবার অভাবের কারণে দিতই না। এ নিয়ে আব্বার সাথে আম্মার ঝগড়া হত।
আবার আকালের সময় কৃষকরা অগ্রিম কামলা কিনে নিত। যেমন কামলার বাজার রোজ ২০ টাকা, তারা আকালের সময় শ্রমিকদের ১০ টাকা দিত আর কাজের সময় পুরা রোজানা কাজ করাত। কিন্তু তখন দরিদ্র লোকেরা আব্বার কাছে এসে বলত চাচা, দাদা বা ভাই, ঘরে খাওয়ার কিছু নাই। তখন আব্বা ঘর থেকে ধান বা চাউল দিয়ে দিতেন। আমরা জমিদার ছিলাম না, এভাবে দিতে দিতে আমাদেরই টান পরে যেত। তখন আম্মার সাথে ঝগড়া হত। উল্লেখ্য যে, আমার আব্বা আম্মা সাধারণ ভাবে কখনো ঝগড়া করতেন না। কিন্তু আব্বার এই ঢালাও দানশীলতার কারণে ঝগড়া হত। তখন আব্বা বাড়ি থেকে দিতে অপারগ হয়ে বাজার থেকে চাউল কিনে এনে উপোসিদের বাড়িতে গিয়ে দিয়ে আসতেন।
আমি যখন একটু বড় হলাম তখন আম্মা আমাকে গোয়েন্দা নিয়োগ করলেন। মসজিদটা ছিল আমাদের বাড়ির একটু পশ্চিম পাশে। প্রতিদিন আমি আসরের সময় বাড়ির পিছনে গিয়ে দাঁড়াতাম। দেখতাম আব্বা মাদরাসা থেকে আসতেছেন হাতে একটা ব্যাগ অর্থাৎ বাজার থেকে চাউল কিনে নিয়ে আসতেছেন। তারপর মসজিদে নামায পড়ে ব্যাগটা আমাদের বাড়ি থেকে আড়ালে রেখে- যাতে আমরা না দেখি- হয় সোজা উত্তর দিকে অথবা পশ্চিম দিকে চলে যেতেন। কারণ দরিদ্র বাড়িগুলি সেদিকে ছিল। তখনই আমি চিৎকার শুরু করতাম, ‘আম্মা আম্মা ঐ যে আব্বা চাউল লইয়া যাইতাছে। আম্মা কখনো বেড়ার উপর দিয়ে নিজেই দেখতেন। আব্বা বাড়িতে আসার সাথে সাথেই শুরু হত ঝগড়া, প্রচন্ড ঝগড়া। যেমন জমিদারি দান করতে চেয়ে লিউ টলস্টয়ের সাথে তার স্ত্রীর ঝগড়ার হত। তখন আব্বা কথায় কথায় বলতেন আমার সামনে যা আছে তোমাদের সামনে কি তা আছে? আমার মনে হয়, এ কথা দ্বারা তিনি সম্ভবত এখানে কোরআন হাদীসের নির্দেশ ইনফাক ও ইসলামী সমাজতন্ত্রের কথা বোঝাতে চাইতেন। কার্তিক মাসে পাইজাম বা এ জাতীয় কিছু ধান অগ্রিম কাটা পরত, তখন অন্যান্য কৃষকরা দাদন লাগাত। কিন্তু আমাদের ধান লাগল তো গ্রামবাসীরা এসে ভিড় করল, কাড়াকাড়ি পরে যেত। তখন একমন, আধামন, পাঁচ সের, দশ সের পর্যন্ত দিয়ে সকলের চাহিদা মিটানো হত। কিন্তু তারা নিত ভাল মানের পাইজাম ধান আর দিত ইরি বা এ জাতীয় মোটা ধান।
আমার দেখা সত্তরের দশকটা ছিল ভয়াবহ। অভাব কাকে বলে ঐ সময়টা যারা দেখেছে তারাই বুঝে। তখন দরিদ্র হতভাগ্য মানুষ কচু পাতা কচুর মোড়া, কলা গাছের ভিতরের নরম বেরেল, শাক, গাছের কচি পাতা, ঘাসের বীজ বৌ পিঠার মত বানিয়ে খেয়ে জীবন ধারন করত। এ সময়ে আমাদের গ্রামের অন্যুন পাঁচ ছয়টি পরিবার আমার আব্বা, একমাত্র আমার আব্বা বাচিয়ে রেখেছিলেন (আল্লাহ্র রহমতে)। এদের বাচ্চা কাচ্চা ছিল এক দেড় থেকে দুই হালি পর্যন্ত। উপার্জন করত একজন, তাও ঠিকমত কাজ পেত না। তখন আম্মা বড় পাতিলে ভাত রাধতেন, ওরা বড় ডিশ বা পাতিল নিয়ে আসত, আম্মা ভাত ও ভাতের ফেন দিয়ে তা ভরে ভরে দিতেন। ওরা এতই দরিদ্র ছিল যে লবণ পর্যন্ত কিনতে পারত না, কলা পাতা বা কচুপাতায় করে লবণ নিয়ে যেত।
সত্তর দশকের মাঝামাঝি, তখনো আমি স্কুলে যাই না। উত্তর পাড়ায় মোহাম্মদ নামে একটা লোক ছিল, বয়স বিশ প্লাস মাইনাস। সুঠাম দেহ, বলিষ্ঠ গড়ন, মাঝে মধ্যে আমাদের বাড়িতে কাজ করত। তাকে পিঠ মোড়া করে বেধে আমাদের পাশের বাড়িতে আনা হল। তারপর শুরু হল অন্তত আমার দেখা নৃশংসতম অত্যাচার, পৈশাচিক পীড়ন। সবাই কম বেশি মারল কিন্তু তিন জন লোক- আমার দুই জ্যাঠাত ভাই এবং হারেস উদ্দিন নামে নেতা গোছের এক লোক- গায়ের শক্তি ঝাড়ল। একেক জন করে যায় আর হাত দেড়েক লম্বা একটা বাঁশের লাঠি দিয়ে পিটাতে থাকে ১০, ২০, ৩০ মিনিট পর্যন্ত, যে পর্যন্ত না সে নিজে হাফিয়ে উঠে এবং মুহাম্মদ বেহুঁশ হয়ে মাটিতে ঢলে পরে যায়। মুহাম্মদের মা বাপ ভাই বোনেরা মাতম করতে থাকে, পানি টানি দিয়ে, পাখার বাতাস দিয়ে হুশ করে। আবার আসে আবার মারে, মুহাম্মদ চিৎকার পারে, মাতম করে, ধাপাধাপি করে, পায়ে উপোর হয়ে পরে যায়। সে তাদেরকে ভাই বলে ডাকত কিন্তু তখন, ‘তোমরা আমার ধর্মের বাপ, আমারে আর মাইর্যো না, আর মাইর্যো না’ বলে তীব্র আর্তনাদে বুঝি খোদার আসন- আরশ পর্যন্ত কাঁপিয়ে তোলে, কিন্ত কাপে না পাষণ্ডদের হৃদয়। পাষণ্ডরা পালাক্রমে আসে, মুহাম্মদ মার খেয়ে বেহুশ হয়, তার মা বাপ হুস করে, আসে আরেক জন, এভাবে চলতে থাকে।
উঃ কী যন্ত্রণা, কষ্টে আমার ছোট্ট বুকটা ফেটে গিয়েছিল। কোন মানুষ মানুষকে এভাবে মারতে পারে না। আমার মন বলে, ঐ পাষণ্ডরা যদি এখনো জীবিত থাকত তাহলে আমি ওদেরকে এখন রাস্তায় ফেলে কুকুরের মত পিটাতাম, মাথায় পারা মেরে দশ হাত মাটির নীচে পুতে ফেলতাম। কারণ এরা মানুষ না পশু বরং তার চেয়েও অধম। মুহাম্মদ কোন পেশাদার চোর ছিল না, চরিত্রহীন ছিল না, খারাপ ছেলে ছিল না। তার অন্যায়, অভাবের তাড়নায় জঠর জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে আমার জ্যাঠাত ভাই আয়্যুব আলীর শ্বশুর বাড়ি থেকে ৩৫ টাকা চুরি করেছিল- যা তৎকালীন সময়ে সম্ভবত এক মন ধানের দাম। এটুকু অপরাধের কারণে তাকে সাধারণ শাস্তি, সাধারণ মারধর করাই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু তা না করে নিজের গ্রামের একটা ভাল ছেলেকে কুত্তা ছাড়া কোন মানুষ সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এভাবে পিটাতে পারে না। একই তালে পালাক্রমে এই পিটনা চলল বিকাল পর্যন্ত।
গ্রামে আরো ধনী লোক আছে, নেতা আছে, এক কিলোর মধ্যে আমার মামা বাড়ি- চেয়ারম্যান বাড়ি আছে কিন্তু কেউ এগিয়ে এল না। কারণ এসব কান্ডে, টাকা ভর্তকির কাজে একজন ছাড়া কেউ এগিয়ে আসে না। সেইজন টাকা ভরতে মাদরাসা থেকে আসলেন, মসজিদেই তিনি ঘটনা শুনে দৌড়ে এলেন। ঐ বাড়িটা ছিল যৌথ বাড়ি, লম্বা উঠান, তিনি উঠানের দক্ষিণ প্রান্তে পা দিলেন। মুহাম্মদ উত্তর প্রান্তে, তার মাথাটা ঝুকে আছে, শরীর রক্তাক্ত, মুখ দিয়ে লালা ঝড়ছে, আমি পাশেই দাঁড়ানো। সেই মর্মছেদি দৃশ্য আমার চোখে এখনো লেগে আছে, হঠাৎ মুহাম্মদের মাথাটা সোজা হয়ে গেল, সে এক দৃষ্টে দক্ষিণে তাকিয়ে আছে। সহসা মৃত্যু মুখে পতিত ব্যক্তি হঠাৎ বেঁচে যাওয়ার কোন অবলম্বন পেয়ে গেলে তার যে অবস্থা হয় মুহাম্মদেরও সেই অবস্থা। সে সটান সোজা হয়ে বসেছে, মুখে খুশির আভা। আব্বা কাছে আসতেই সে উপুর হয়ে দুইপা জড়িয়ে পায়ের পাতায় কপাল ঠেকিয়ে মাতম করে উঠল, ‘চাচা, চাচাগো, ওরা আমারে মাইর্যা ফালাইছে চাচা, চাচা গো আমি আর বাঁচতাম না’ তার আর্তনাদে বুঝি আকাশ কেঁপে উঠল।
আমার চোখে লেগে আছে। আব্বা তাকে টেনে সোজা করে উপুর হয়ে তার মাথাটা বুকে চেপে ধরে উচ্চস্বরে কেঁদে উঠলেন, ‘এই ছেলেটাকে কে এভাবে মারল, সে কত বড় অন্যায় করে ফেলেছিল, অন্যায় করলে আমরা কি বিচার করতে পারতাম না, কারা এভাবে মারল’ বলতে বলতে কাঁদছেন, মুহাম্মদের রক্তাক্ত শরীরে হাত বুলাচ্ছেন। তার শতছিন্ন লুঙ্গি ধুনাধুনা হয়ে গেছে, লজ্বা নিবারনের জন্য গামছা পেছিয়ে রাখা হয়েছে, আব্বা তার কাপড় ঠিক করে দিচ্ছেন। আব্বা ছিলেন কোমল মনের মানুষ, কখনো রাগ করতেন না। কিন্তু এদিন দেখেছিলাম তার রাগ, তিনি চিৎকার দিয়ে উঠলেন, ‘কে এভাবে মারল? ততক্ষণে অপরাধিরা সবাই সটকে পরেছে। যারা কিছু মেরেছিল তারা গা ঝাড়া দিয়ে বলল, ‘আপনের ভাইস্তারাই মেরেছে। আব্বাকে পেয়ে মুহাম্মদের আর ভয় নাই, সে বারবার বলতে লাগল, ‘চাচা আমারে আয়ুব আলী, আশরাফ আলী আর হারেছ আলী বেশি মারছে। আব্বা রাগারাগী করছেন, ছোটাছোটি করছেন, যেন ওদেরকে ধরে আনতে চাইছেন।
টাকার মালিক কাচুমাচু করে বলল, ‘আমার ঘরে চুরি করেছে। আব্বা ধমকে উঠলেন, ‘চোর বলেন কেন, এই ছেলে কি চোর নাকি, আরো চুরি করেছে? অভাবের তাড়নায় না হয় একটা অন্যায় করেই ফেলেছে- তাই বলে নিজের গ্রামের একটা ছেলেকে আপনারা কিভাবে এতটা মাইর মারলেন? তারপর আরো কিছুক্ষণ গালাগালি ও হুমকি ধামকি দিয়ে ঘরে গেলেন। টাকা এনে মালিককে ৩৫ টাকা দিলেন এবং একজনকে টাকা দিয়ে পাঠালেন ডাক্তারের কাছে ঔষধ আনতে। তারপর মুহাম্মদকে একটা তক্তায় বসিয়ে কয়েক জন ধরাধরি করে বাড়িতে নিয়ে চলল, আব্বাও চললেন সাথে সাথে। এ মারের পর সাধারণত কোন মানুষ বেঁচে থাকার কথা নয়। কিন্তু মুহাম্মদ ছিল বলিষ্ঠদেহী, শক্তিশালী, ৬ ফুট বা তার চেয়েও বেশি উচু। সে দরিদ্রের সন্তান না হলে নিশ্চয় কর্নেল মেজর হতে পারত।
এবার শুনুন প্রকৃতির বিচার। আমার দুই জ্যাঠাত ভাই ও হারেছ মিয়াঁ বহু আগেই মরে ভুত হয়েছে। হারেছ আলীর সংসার তচনছ হয়ে গেছে। তার এক ছেলে সৌদি গিয়েছিল, এ্যাক্সিডেন্ট করে মুখ ও মাথা বিকৃত হয়ে কচ্চপাকৃতি ধারন করে অবচেতন অবস্থায় এখনো বেঁচে আছে প্রায় দুই যুগ ধরে (আল্লাহ সবাইকে মাফ করুন)। পক্ষান্তরে মুহাম্মদ পরবর্তীতে নেত্রকোনার পুর্বধলায় বিয়ে করে ঘর জামাই চলে যায়, রিকশা চালাত। তার অনেকগুলি ছেলে, সবগুলিকে মাদরাসায় দেয়। বড় ছেলেটা নারায়নগঞ্জ এক মাদরাসায় পড়ত। এক বাড়িতে লজিং থাকত, ঐ লোকের একটা মাত্র মেয়ে। সুদর্শন ভাল ছেলে দেখে বিয়ে দেয়। সেই সুবাদে মুহাম্মদ বড় লোক। শুনেছি মুহাম্মদ ও তার বউ হজ্ব করে এসেছে।
১৯৭১, আলেম ও ধার্মিক শ্রেণীর অনেকেই পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছে। মানবতার সেবক আমার আব্বা কোন দিকে না গিয়ে বাড়িতে বসে পরেছেন। মাদরাসা তখন প্রায় বন্ধ, তিনি টুকটাক মাদরাসায় যেতেন আর ঘুরে ঘুরে বিপন্ন মানুষ বিশেষত হিন্দুদের দেখাশুনা করতেন। সারা বাংলাদেশে কম বেশি হিন্দু নারী ধর্ষিত হয়েছে, বাড়ি লোট হয়েছে কিন্তু আমাদের এলাকায় কোন হিন্দু নারী ধর্ষিত হওয়া বা কোন বাড়ি লোট হওয়া তো দুরের কথা কারো গায়ে একটা আচরও লাগেনি। কোন সে যাদুর কাঠি যার পরশে যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে এ এলাকার হিন্দুরা মাতৃ- ক্রোড়ের নিরাপত্তা পেল। সেই যাদুর কাঠিটি ছিলেন আমার বাবা। এসব হিন্দুরা কেউ দিনে কেউ বা রাতে আমাদের বাড়িতে থাকত। মুসলমান ঘরে তারা ভাত খেত না, দুধ চিড়া দেয়া হত। তারপর সুবিধা মত হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে ভারত চলে যেত। হিন্দুরা যুবতি মেয়ে নিয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমাত, তাদের সম্পদ আব্বার কাছে জমা রাখত, কেউ সাথে করে ইন্ডিয়া নিয়ে যেত। তাদের সকল দায়িত্ব আব্বা পালন করতেন যার ফলে কোন হিন্দুর এক পয়সারও ক্ষতি হয়নি। এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছিলেন আমার মামা অর্থাৎ আম্মার ফুফাত ভাই এ্যাডভোকেট আবুল হাশেম। তাদের বাড়ি- শেখ বাড়ি পাক সেনারা জ্বালিয়ে দিয়েছিল, তখন সে আমাদের বাড়িতে থাকত।
১৯৭৪ সাল, দুর্ভিক্ষের কড়াল গ্রাস গোটা দেশ গিলে ফেলেছে। শুরু হয়েছে আবার ১১৭৬ এর মনন্তর। বহির্বিশ্বে সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশে হাজার হাজার মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা যাচ্ছে। তখন কঙ্কালসার অর্ধমৃত মানুষ রাস্তার ধারে পরে থাকত, ছোট ছোট বাচ্চা ফেলে মা চলে যেত। তখন মানবতার সেবক আমার বাবা ইউনিয়ন শুদ্ধু ঘোরে ঘোরে এসব হতভাগাদের আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসতেন। ঠিক যেন দাতা হাতেম তাঈ, যিনি দেশময় ঘোরে ঘোরে পিতার হাতে জীবন্ত প্রোথিতে উদ্যত ভাগ্যাহত কন্যাদের এক দুইটা উটের বিনিময়ে কিনে কিনে নিয়ে আসতেন, তারপর সন্তান বাৎসল্যে প্রতিপালন করে বিয়ে দিতেন। আমার বাবাও ঘোরে ঘোরে এসব অর্ধ্মৃত মানুষদের নিয়ে আসতেন। কেউ কেউ কিছুদিন থেকে সুস্থ হয়ে চলে যেত, নতুনরা আসত। এভাবে পুরাতনের গমন, নতুনের আগমন- এ ধারা অব্যাহতভাবে চলতে থাকত। ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ- ষাটজন অর্ধমৃত মানুষ সার্বক্ষনিক আমাদের বাড়িতে থাকত। আর এই প্রক্রিয়াটা চলছিল শ্রাবন থেকে অগ্রহায়ণ পর্যন্ত- দীর্ঘ প্রায় ছয়মাস কাল। আমাদের জমির পরিমাণও ছিল ভাল, ফসলও হয়েছিল প্রচুর, ঘরে প্রচুর ধান ছিল। এই সব কিছু খাইয়ে শেষ পর্যন্ত বীজ ধান পর্যন্ত খাইয়ে ছিলেন। এই কয়েকশ মানুষকে ছয়মাস পর্যন্ত লালন পালন করতে গিয়ে আমার আব্বা কপর্দকশুন্য হয়ে পরেছিলেন।
তখন বিভিন্ন জায়গায় লঙ্গরখানা গড়ে উঠেছিল। তবে আমার বাবা ঐসব ছিন্নমূলদের প্রতিপালনের জন্য সরকার বা অন্য কারো কাছ থেকে এক পয়সা সহযোগিতা পানও নি, চানও নি। কিন্তু আমার প্রশ্নটা হল, যেসব লোটেরার দল দেশটাকে তখন তলাবিহীন ঝুড়ি বানিয়ে ছিল ওরা কয়টা মানুষের জীবন বাঁচিয়ে ছিল। এই দুর্ভিক্ষ পীড়িত অর্ধমৃত পুরুষরা থাকত বাইরে- কাচারি ঘরে আর নারী ও শিশুরা থাকত রান্না ঘরে এবং উঠানে। এই নারী ও শিশুদের মধ্যে কেউ কেউ নড়া চড়া করতে পারত না, শুয়ে শুয়েই খাওয়া দাওয়া ও হাগা মুতা করত। ৭১ এর জাতক হিসাবে তখন আমার বয়স তিন সারে তিন হতে পারে, ঐসব স্মৃতি এখনো আমার কিছু কিছু মনে আছে। তখন আমরা বলতে ছিলাম আমি ও আমার বড় বোন, বাড়িতে আমাদের বড় জ্যাঠাত ভাই বোন ও আশপাশের ছেলে মেয়েরা ছিল। আমরা উঠানে বা রান্না ঘরের সামনে কিছুটা দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম- চামড়া শুকিয়ে হাড়ের মধ্যে ঢুকে গেছে, মাথা মোটা দেখা যেত, সারা শরীর খুজলি প্যাচড়ায় ভরা, স্বাধীনতার পর এ রোগটা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পরেছিল। কেউ ওদের কাছে যেত না, ঘেন্না লাগত। আমার আম্মাও ঘেন্নায় ওদের কাছে যেতেন না।
‘মানুষ মানুষের জন্য’ এ বুলি যেসব স্বার্থবাদী লোটেরারা আওড়ায় তাদের জন্য এখানে রয়েছে নিদর্শন, আত্নার খোরাক। প্রকৃত মানবতার সেবক তারাই যারা প্রকৃত ধার্মিক। জীবে দয়া করে যে সেইজন সেবিচে ইশ্বর। এ এক অপার বিস্ময়, একজন দেওবন্দী আলেম, উচু দরের আলেম- তিনি ফযরের পরেই ওদের সেবায় লেগে যেতেন। যারা নড়াচড়া করতে পারত না ওদের হাগা মুতা নিজ হাতে পরিষ্কার করতেন, কারণ অন্য কেউ কাছেও যেত না। ওরা ভাত খেতে পারত না, আম্মা নরম জাউ রেধে দিতেন আর আব্বা চামচ দিয়ে ওদের মুখে তুলে খাওয়াতেন। এভাবে নয়টা বা দশটা পর্যন্ত ওদের খেদমত করতেন। তারপর মাদরাসায় চলে যেতেন। যুদ্ধের সময় মাদরাসার অনেক ছাত্র শিক্ষক রাজাকার থাকার কারণে স্বাধীনতার পর তাদেরকে জেলে নেয়া হয়। তখন আব্বা ও পীর সাব দু’জনে মিলে মাদরাসাটা চালু রাখেন, তেমন ছাত্র ছিল না। কাজেই জহুরের সময় তিনি বাড়িতে এসে পরতেন, এসেই আবার কোমর বেধে আধমরাদের খেদমতে লেগে যেতেন। তখন আম্মা পানি গরম করে দিতেন আর আব্বা ওদেরকে গোসল করাতেন, কাপড় পালটিয়ে দিতেন। তারপর গায়ে খুজলি প্যাচড়ার ঔষধ লাগিয়ে দিতেন, তারপর খাওয়াতেন। এভাবে কিছুক্ষণ পর পর হয় হাগা মুতা পরিস্কার করতেন নয় খাওয়াতেন বা ঔষধ লাগাতেন। এভাবে সারাদিন চলত, আবার রাত্রে খাওয়ানো হাগা মুতা পরিস্কার, ঔষধ লাগানো ইত্যাদি কাজ চলত অর্ধেক রাত পর্যন্ত।
এইভাবে ছয়টা মাস তিনি অক্লান্ত অবিশ্রান্ত ভাবে স্বহস্তে বিপন্ন মানবতার সেবা করে যান। আর তার প্রচেষ্টায় কয়েকশ মানুষের জীবন বেঁচে যায়। তারা এখনো আছে, সংসার করেছে, সন্তানাদি আছে, কেউ কেউ ভাল অবস্থা ব্যবস্থা করেছে। পরবর্তিতে এদের অনেকেই এসে আব্বার হাত ধরে কান্নাকাটি করত। আব্বার মৃত্যুর পর এসে তার জন্য কাঁদত। একজন মহিলা পাড়ায় পাড়ায় মিষ্টি বিক্রি করত, আমরা বলতাম গোল্লাওয়ালী। সে এসেই আমাদের সবাইকে একটা করে মিষ্টি দিত আর আব্বার জন্য কাঁদত। কারণ আব্বা তাকে ও তার চার মেয়েকে বাঁচিয়েছিলেন, সে মিষ্টির দাম নিতে চাইত না। কিন্তু আম্মা জোর করে দিয়ে দিতেন। এই মহিলা ও তার মেয়েরা সবাই সুন্দরী, সবগুলির ভাল ভাল বিয়ে হয়েছে, তবে একটি মেয়ের বিয়ে হয়েছে ফুলপুর টাউনে, বড় লোক ঘরে।
৭৫ সাল, সবাই চলে গেছে শুধু একটি মেয়ে রয়ে গেছে। কাল, খাট, মোটা- নাদুস নুদুস, মানে ভাল ভাল খেয়ে মোটা হয়ে গেছে, আমার বছর দুয়েকের বড় হবে অর্থাৎ পাঁচ ছয় বছর হবে। মেয়েটির বাবা আগেই ফেলে চলে গেছে আর তার মা দুর্ভিক্ষের সময় হয়ত মরে গেছে অথবা অন্যত্র বিয়ে হয়েছে। নানি আর এক মামা আছে। মামাটা মাঝে মাঝে নিতে আসত কিন্তু মা বাপ নাই, তার উপর দরিদ্র বলে আব্বা দিতেন না। বলতেন, লালন পালন করে আমিই বিয়ে দিব। এক একরের মত আমাদের একটা উঁচু ক্ষেত দেখিয়ে বলতেন, মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে ঐখানে বাড়ি করে দিবেন। কিন্তু ঘটল আরেক বিপত্তি। তখন আমার বড় বোন স্কুলে যায়, আমরা দু’জন যাই না। কাছেই একটা হিন্দু বাড়ি ছিল, সেখানে খেজুর গাছ ছিল, কিন্তু আমি তখনো দেখিনি। আমি ছোট বিধায় বাড়িতে থাকতাম আর ঐ মেয়েটা গিয়ে হিন্দু বাড়ির গাছতলা থেকে খেজুর কুড়িয়ে এনে লুকিয়ে রাখত। তারপর আমার বোন এলে দু’জন বসে বসে খেত কিন্তু আমাকে দিত না। খেতে আমার খুব মন চাইত, আমি চাইতাম, কাকুতি মিনতি করতাম, কাঁদতাম তবুও আমাকে একটা খেজুরও দিত না। তখন আমি রাগে গিয়ে মেয়েটাকে কয়েকটা কিল মারতাম আর বোন আমাকে মারত। এ প্রক্রিয়াটা চলতে থাকল।
প্রতিদিন সে খেজুর কুড়িয়ে এনে আমার বোনকে নিয়ে খেত কিন্তু আমাকে দিত না এবং একটাও দিত না। আমি ওকে মারতাম, বোন আমাকে মারত। ধীরে ধীরে আমার জেদ বাড়তে থাকে, মারামারি বাড়তে থাকে। তখন বয়স একটু বেশি হলে কিশোর অপরাধের সম্ভাবনা প্রবল ছিল। কারণ তখন আমার পক্ষে ঐ মেয়েটাকে মেরে ফেলা বা আমার বোন আমাকে মেরে ফেলা কঠিন কিছু ছিল না। ঘরটা হয়ে উঠল ত্রিভুজ মারামারির একটা কুরুক্ষেত্র। সুযোগ পেলেই আমি মেয়েটাকে মারতাম আর বোন আমাকে মারত। আম্মা অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন। আম্মা ও আব্বা দুজনেই আমাদের যুদ্ধ থামানোর অনেক চেষ্টা তদবীর ও কৌশল করে ব্যর্থ হয়ে রণে ভঙ্গ দিলেন। অবশেষে আম্মার কথায় মেয়েটাকে তার মামার কাছে দিয়ে দেয়া হল। বড় হওয়ার পর আমার মধ্যে একটা অপরাধ বোধ জেগে উঠে। আমার জন্য মেয়েটাকে বিতারিত হতে হল। তবে ওর দোষটাই বেশি, আমাকে এক দুইটা খেজুর দিলে কী ক্ষতিটা হত। আজ বহু বছর আমি তাকে খুঁজছি, আমার বিশ্বাস সে বেঁচে আছে, যেখানেই হউক আছে। তার মামা ও নানীর সন্ধান পেলাম না। তবে অন্যদের বলে রেখেছি, তাকে পেলে আমি হেল্প করব। কারণ আব্বা তাকে মেয়ে হিসাবে ওয়ারিশ করতে চেয়েছিলেন। কাজেই আমার ভাইয়েরা রাজি না হলেও আম্মা আছেন, আমি আছি, আমাদের থেকে অন্তত একটা সন্তোষ জনক ভূসম্পত্তি তাকে দিব, বাপের ইচ্ছা পূরণ করব। আমি তার প্রতিক্ষায় আছি।
আমার বাবা শুধু মানবতার সেবকই ছিলেন না, জীব জন্তু পশু পাখিকেও মানুষের মত ভালবাসতেন। আমাদের একটা বিড়াল ছিল, খেতে বসলেই এসে পাতে মুখ দিত। একদিন ওটাকে ধরে আব্বার সামনেই জোরে মাটিতে থ্যাকনা মারলাম। আব্বা প্রচন্ড রেগে গেলেন। কিন্তু তার অভ্যাস ছিল কাউকে মারতেন না, রাগে দুঃখে গম্ভীর হয়ে থাকতেন, কথা বলতেন না। তিন দিন যায় তিনি আমার সাথে কথা বলেন না। আম্মা বললেন, মাফ চা গিয়ে। তারপর আমাকে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘এটুকু ছেলের দিকে আবার রাগ করতে হয় নাকি, সে কি বুঝে, বুঝিয়ে বললেই তো হয়’। তখন আব্বা জীব জন্তুর প্রতি দয়া সম্পর্কে অনেক উপদেশ দিলেন, বললেন, এক খারাপ মহিলা পিপাসিত কুকুর ছানাকে পানি খাইয়ে বেহেশতে গিয়েছিল। এক লোকের বিড়াল দুধ খেত বলে নির্জন দ্বীপে ফেলে চলে আসে, না খেয়ে বিড়ালটি মারা যায়। কয়েক দিন পর তার তিনটি গাভী মারা যায়। এ জাতীয় অনেক মজার মজার ঘটনা বললেন।
আমাদের গ্রামের এক হিন্দু লোক সব কিছু বিক্রি করে ইন্ডিয়া চলে যায়। কিন্তু দেশে তার একটি ছেলে ছিল পিয়ন পদে চাকরি করত। বছর দুয়েক পর ছেলের টানেই হউক বা যে কারণেই হউক- সে দেশে এসে যায়। কিন্তু সমস্যা হল তার বাড়ি বাধার জায়গা নেই। তার দুই ভাই ছিল, তাদের পর্যাপ্ত জমিও ছিল কিন্তু তাকে ঘর করার মত একটু জায়গা দিলনা। তখন আব্বা তাকে বাড়ি বাধার জন্য দশ শতাংশ জমি দিলেন। ২০০৪ সাল, তার একটা মেয়ে এলাকার একটা দরিদ্র মুসলমান ছেলের সাথে ভেগে গিয়ে বিয়ে করে। এতে নাকি তার জাত চলে গেছে বিধায় এখানে আর থাকবে না, কিছুটা পশ্চিমে হিন্দু পাড়ায় চলে যাবে। সে জমির টাকা দাবী করল, অগত্যা আমাদের জমি আমরাই তাকে বাজার মূল্য দিয়ে বিদায় করলাম।
হিফয বিভাগে পড়ার সময় কিছুদিন আমি মাদরাসায় থাকতাম। সন্ধার পর পীর সাবের বড় ছেলে আর আমি এক হারিকেনে পড়তে বসতাম। সে ছিল আমার বড়। হিফয ক্লাসে তৈয়ব সাব নামে একজন তরুণ শিক্ষক ছিলেন, তিনি ছেলেদের বেশি পিটাপিটি করতেন বলে তাকে কেউ দেখতে পারত না, কোরআনের আয়াত বিকৃত করে তাফশালা থেকে তৈয়বশালা ডাকত। একদিন আমরা পড়তে বসেছি তিনি বারান্দা দিয়ে যাচ্ছেন। তখন সে আমাকে চতুর্থ পাড়ার পঞ্চম পৃষ্ঠার প্রথম আয়াতটা দেখিয়ে পাঠ করল, ‘ইয হাম্মাত তায়িফাতানি মিনকুম আন তাফশালা’ তারপর বলল তাফশালার জায়গায় তৈয়বশালা পড়বি, জোরে জোরে পড়। আমি হাদারাম জোরে জোরে বারবার পড়তে লাগলাম আর তাফসালা এর জায়গায় তৈয়বশালা পাঠ করলাম। তিনি গিয়ে আব্বাকে জানালেন, আব্বা শোকে দুঃখে গম্ভীর হয়ে গেলেন আমার সাথে কথা বলেন না। বুঝতে পারছিলাম তিনি যেন আমাকে শত্রু ভাবছেন, বাপ ছেলেকে মারা ভাল কিন্তু কথা না বলাটা বড়ই হৃদয় বিদারক। কষ্টে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল কিছুক্ষণ পর পর কাঁদতাম।
পরদিন কয়েক ছাত্রকে বললেন, ‘আমার ছেলে ওস্তাদের সাথে এত বড় বেয়াদবি কেমনে করতে পারে, আমার তো মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। যাও ওকে নিয়ে গিয়ে মাফ চাইয়ে আন’। তৈয়ব সাব হুযুর বিকালে দপ্তরের বারান্দায় বসে আছেন। ছাত্ররা আমাকে নিয়ে গেল। আমার তো শুরু হল কান্না, বিষম কান্নায় উঠল হেঁচকি। হেঁচকির ছোটে কোন কথা বলতে পারলাম না, শুধু হুজুরের হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকলাম। ছাত্ররা বলল, ‘মুফতি সাব হুযুর খুব কষ্ট পেয়েছেন, ওকে মাফ করে দেন’। তৈয়ব সাব হুযুর বললেন, ‘যাও, ওস্তাদের সাথে বেয়াদবি করো না, আর ঐ খারাপ ছেলেদের সাথে মিশো না, ওরা মানুষ হবে না’। আল্লাহ্র কি মহিমা জানি না, বালিয়া মাদরাসার বড় হুজুরের ছেলেদের মধ্যে এই যে ভাঙ্গা চোরা যা আমিই, বাকীরা কেউই উল্লেখের তালিকায় নেই।
বিষয়: সাহিত্য
১১২০ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন