চিঠি- ৪৮ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১৪ অক্টোবর, ২০১৬, ১১:৪৫:০৮ সকাল

তাহাজ্জুদের পর সে জায়নামাজে শুয়ে শুয়ে ভাবছে, এভাবে বসে থাকলে তো আর চলছে না, দরজা খোলে বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে প্রতিক্ষার চোখ অন্ধ হয়ে যাবে, তবুও হয়ত ওরা ফিরে আসবে না। কাজেই একটা কিছু করা দরকার। কী করা যায়, মামলা ঠুকে দেয়া যায়? তাহলে তো আর রক্ষে নেই, স্ত্রী ক্ষেপে গিয়ে উল্টো তার বিরুদ্ধেই মামলা ঠুকে বসবে। তাহলে কী করা যায়, ইঞ্জিনিয়ারের কাছে যাবে? গিয়ে বলবে, ‘বিচার দিলাম আমি, আর এই সুযোগে আপনি আমার বউটা দখল করে বসলেন নাকি? তখন হয়ত সে বলবে, ‘সাল চিল্লায় গেলে না কেন? তখন কথা কাটাকাটি হবে, রাগারাগি হবে, সেই সাথে হাতাহাতি ও মারামারিও হতে পারে। কাজেই এ ক্ষ্যাপা কুকুরটার কাছে যাওয়া যাবে না। তাহলে কার কাছে যাওয়া যায়? অনেক চিন্তা ভাবনার পর সিদ্ধান্ত নিল ফোরকান সাবের কাছে যাবে। ফেরদৌসিদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। আগেও কয়েকবার তার কাছে গিয়েছে। অনেক দিন তো হয়ে গেল, এখন হয়ত সে একটা কিছু ব্যবস্থা করতে পারবে, অন্তত মোবাইল নাম্বারটা তো সংগ্রহ করে দিতে পারবে। পরদিন বিকালে গেল তার কাছে। দু’জনে গেস্ট রুমে বসল।

তিনি কোন ভূমিকা না করেই সরাসরি বললেন, ‘আপনার বউতো আপনার বদনামে জামালপুরটা পচিয়ে ফেলেছে, এ বিষয়ে আমার কিছু প্রশ্ন আছে, সংক্ষেপে জবাব দিবেন। আচ্ছা আপনি অহংকার করতেন কেন, আপনিই বড় আর আপনার ভায়রারা আপনার সামনে ছোট? হাসান বিষণ্ণ হাসি দিয়ে বলল, ‘ঐ মিয়াঁ, কাকে কি বলছেন, আমি কিন্তু আপনার চেয়ে অনেক বড় শিক্ষিত, অনেক ধনী। লোকটা চমকে উঠে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে হাসানের দিকে তাকাল। এবার সে মুচকি হেসে বলল, ‘আচ্ছা এই যে আমি কথাটা বললাম এটা কি সামঞ্জস্যশীল হল, বাচনভঙ্গি ঠিক হল, আলাপের সঠিক ভঙ্গিমা হল? না, হল না। কারণ আপনি যদি কিছু বলতেন, অহংকার করতেন তারপরেই এই কথাটা বলা যেত। কাজেই আমি কখনো নিজেকে বড় বলিনি, কোন শিক্ষিত মানুষ কখনো নিজেকে বড় বলে না, বলতে পারে না। আমার স্ত্রী সর্বদা আমাকে তাদের পদানত করে রাখতে চাইত, তার দুলাভাইদের সর্বদা উচ্ছসিত প্রশংসা করত আর আমার ও আমার পরিবারের বদনাম করত। তাদের সামনে আমাদেরকে ইঁদুর-বিড়াল বানিয়ে রাখতে চাইত। তখন রাগে গোস্বায় মাঝে মধ্যে আমি বলতাম, ‘তোমার যে কোন দুলা ভাইয়ের চেয়ে আমার শিক্ষা ও সম্পদ বেশি। এটাই হলো আমার অহংকারের শানে নুযুল।

তিনি সশব্দে হেসে উঠে বললেন, ‘বাপ্পিসরে, বাঁচা গেল, আমি তো মনে করেছিলাম এবার বুঝি ভায়রাদের ছেড়ে আমার পিছু নিলেন। আচ্ছা যাক, আপনি বড়লোকি আলাপ করতেন কেন? হাসান বলল, ‘তখন আমি মাদরাসা জগতের সবচেয়ে কঠিন কিতাব শামায়েলে তিরমিযি, তাফসিরে বায়যাবি, মাকামাতে হারিরি ইত্যাদি কিতাবের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা গ্রন্থ লিখতে ছিলাম। বউকে কখনো বলতাম, ‘আমার লিখিত কিতাব কোন প্রকাশককে দিব না, নিজেই প্রকাশ করব, এভাবে ধীরে ধীরে একটা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলব। তাকে ঠাট্টা করে বলতাম, ‘দেখবে এভাবে একদিন আমি বড় প্রকাশক হয়ে যাব। তারপর সে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আচ্ছা আমি তো আগেও বহুবার আমার স্ত্রীর বিষয়গুলি আপনাকে বলেছি-সেগুলির সামনে এসব কোন দোষ হল, অন্যায় হল? তিনি শান্ত গলায় বললেন, ‘আসলে আপনার মধ্যে বড় ধরণের কোন দোষ ত্রুটি না পেয়ে একটা কিছু তো বলতে হবে। এজন্যই আপনার স্ত্রী সাধারণ মানবিক ত্রুটি বিচ্যুতিগুলোকে দোষ আকারে অন্যদের সামনে বর্ণনা করছে।

আপনি কি জানেন, আপনার স্ত্রী কি সব জঘন্য কথা বলে বেড়াচ্ছে। আমি অবাক হই, স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া-ঝাটি, মারামারি, ছাড়াছাড়ি কতকিছুই তো হয় কিন্তু নিজেদের গোপন কথা বলে বেড়ায় এমন স্ত্রী আমি কোথাও দেখিনি। তিনি বলে চল্লেন, আর লজ্বায় ঘৃণায় হাসানের মুখটা কালো হয়ে গেল। সে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে আর্তনাদ করে উঠল, ‘হায় আল্লাহ্‌, তুমি কি এই মেয়েটার বিচার করবে না’। তারপর তিনি সোফায় হেলান দেয়া থেকে টান টান সোজা হয়ে বললেন, ‘আচ্ছা বাদ দেন এসব বিষয়, আসল কথায় আসি, আপনার স্ত্রী স্বপ্ন দেখেছে আপনি ছোটলোক, নিচুজাত, আপনি নিচু পদে মানে পিয়ন পদে চাকরি করেন, অবৈধ পয়সা রোজগার করেন, আর এই অবৈধ উপার্জন খেয়ে আপনার স্ত্রীর স্বাস্থ্য হয় না। স্বপ্ন তো স্বপ্নই, এটা আপনাকে বলার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু তারা এ স্বপ্নটাকে মানুষের কাছে সত্য বলে বেড়াচ্ছে এবং যুক্তি দেখাচ্ছে, আপনি ছোট লোক, ছোট জাত, অবৈধ পয়সা রোজগার করেন বিধায় তারা মেয়ে দিবে না, অন্যত্র বিয়ে দিবে, আপনি সংক্ষেপে এর ব্যাখ্যা দিন।

হাসান হাসল, ‘ব্যাখ্যার কি আছে, ঠিকই তো আছে। হাসান হেয়ালি করছে দেখে লোকটা বলল, ‘ঠিক আছে মানে, আপনি পিয়ন পোস্টে চাকরি করেন নাকি, আপনি নিচুজাত নাকি? তাদের এই প্রচারটা শুনার পর আপনার জাত বংশ সম্পর্কে আমার সন্দেহ জাগল এবং জানার কৌতূহল হল। যদিও আমি আপনার ও আপনার পরিবার সম্পর্কে আগে থেকেই কিছু কিছু জানতাম, আরো জানার জন্য আপনার বাবার ছাত্রদের কাছে গেলাম। আর জামালপুর শহরে আপনার বাবার ছাত্রের অভাব নাই। তারা আপনার সম্পর্কে বলল, ‘সে ছোট বেলা থেকেই ভাল ছাত্র ছিল, কওমী, আলিয়া ও বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছে, একজন যোগ্য মুহাদ্দিস। কিন্তু আপনার বাবার নাম শুনেই তো তারা শ্রদ্ধায় গদগদ করে উঠল, তাদের মতে তিনি একজন ফেরেশতা ছিলেন। আর আপনার মাতুলরাও নাকি প্রতাপশালী, চেয়ারম্যান টেয়ারম্যান জাতীয় একটা কিছু। কাজেই আপনার ব্যাখ্যাটা শুনতে চাই।

হাসান বলল, ‘এটা ব্যাখ্যার কি আছে, প্রত্যেকেই নিজের অবস্থানকে বড় মনে করে, অন্যদের অবজ্ঞা করে- এটাই পৃথিবীর নিয়ম, মানুষের স্বভাব। যেমন একটা বেশ্যা কোন গৃহবধুকে দেখে নাক সিটকায়, ‘উহঃ, ঘরের কোনের বিড়াল। সুদখোর ঘোষখুর কোন সৎ মানুষকে দেখে নাক সিটকায়, ‘উহঃ পৃথিবীর অযোগ্য একটা গোবেচারা। ডাকাত সন্ত্রাসীরা একজন ভদ্র মানুষকে ভাবে ভীতু কাপুরুষ। এটাই মানুষের স্বভাব। তবুও আপনি যখন বলছেন সংক্ষেপে ব্যাখ্যা দিচ্ছি। তারা বলছে আমি নিচু পদে- পিয়ন পোস্টে চাকরি করি। এর ব্যাখ্যা বুঝতে হলে আপনাকে গোড়ায় যেতে হবে। সিপাহি বিপ্লবোত্তর ভারত বর্ষের মুসলমানরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একদল পার্থিব সুযোগ সুবিধার লক্ষে ইংরেজ প্রবর্তিত বাস্তুবাদি শিক্ষা গ্রহণ করে হিন্দুদের ন্যায় ইংরেজ তোষণ নীতি অবলম্বন করে। আরেক দল রাষ্ট্র ক্ষমতা হারিয়ে পার্থিব চিন্তা বাদ দিয়ে নিজেদের দ্বীন ধর্ম রক্ষার জন্য দেওবন্দ গিয়ে জড়ো হয়।

তারপর এই দুইদল মুসলমান সাংঘর্ষিক অবস্থানে চলে যায়। বাস্তুবাদি শিক্ষিতরা বলল, ‘বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে ওরা তখন বসে, বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজে কোরআন হাদীস চষে। ওরা বিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি কোন নীতিই জানে না, ওরা মুন্সি, মোল্লা, ভিক্ষুক। আবার আলেম শ্রেণী বলল, ‘ওরা ইংরেজি শিখে ইংরেজের কেরানি হয়েছে, ওরা ইংরেজের দাস, তিন টাকার কেরানি। আর এই ধারাটা এখনো বজায় আছে। আমার স্ত্রীর দুলাভাইরা সবাই কোন রকম ম্যাট্রিক ইন্টার পাশ দিয়ে একটা কেরানিগিরি জুটিয়েছে আর ভাবছে তারা ইংরেজ হয়ে গেছে। এজন্যই তারা মাদরাসা শিক্ষাকে ঘৃণা করে, আর যদিও পার্থিব শিক্ষায় আমি তাদের যে কারো চেয়ে কম নয় তবুও যেহেতু মাদরাসায় চাকরি করি তা মুহাদ্দিসই হই আর যা কিছুই হই এটা তাদের কাছে নিচু পদে চাকরি, পিয়ন পদে চাকরি, ঘৃণিত চাকরি। যদিও তাদের চৌদ্দ পুরীতে মুহাদ্দিস তো দুরের কথা উল্লেখ করার মত কোন আলেম নাই। এই হল ওদের ধার্মিকতা, ওরা যে প্রকৃতই বক ধার্মিক এখানেই এর প্রমাণ নিহিত।

আর আমার ব্যাপার হলো, যে কোন সেকশনে আমার চাকরি করার সুযোগ ছিল। কিন্তু আলেম পরিবারের সন্তান এবং বড় সন্তান হিসাবে বাবার ঐতিহ্য ধরে রাখা আমার কাছে পারিবারিক ও সামাজিক প্রধান প্রশ্ন। তাছাড়া হাদীসের খিদমত করার যোগ্যতা ও সুযোগ সবারই হয়না, ধার্মিক লোকেরা অন্য যে কোন চাকরির তুলনায় এটাকে নিয়ামত মনে করে। এই হল আমার মাদরাসায় চাকরির শানে নুযুল।

এবার আসুন অবৈধ রোজগার সম্পর্কে। একথা সবাই জানে, সমাজের সবচেয়ে সৎ শ্রেণিটা হল আলেমরা আর আলেমদের মধ্যে মুহাদ্দিসরা। একজন মুহাদ্দিস কখনো অবৈধ রোজগার করে না। সেই সুযোগও নেই, তবে মাদরাসার হিসাব কিতাবের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকলে হয়ত একটা সুযোগ থাকে কিন্তু আমি এসবের ধারে কাছেও যাইনা, এটা সবাই জানে। তবে হ্যাঁ, মুহাদ্দিস যদি পাঠদানে অযোগ্য হয়, তবে তার বেতনটা বৈধ হবে না। অবৈধ রোজগার বলে গণ্য হবে। এক্ষেত্রে নিজ সম্পর্কে আমার বক্তব্য হল, আলিয়ার বর্তমান সিলেবাসে মুহাদ্দিস জন্মাতে পারে না, মুহাদ্দিস হয় কওমী অথবা মক্বা, মদিনা, আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়ারা। আর কওমী মাদরাসায় আমি একটা খ্যাতিমান ছাত্র ছিলাম। আমার মুহাদ্দেসির ব্যাপারে কেউ কোথাও কখনো আপত্তি করেছে এমনটা আমি শুনিও নি জানিও না। বরং অনেকেই বলে যোগ্য বাবার যোগ্য ছেলে। কিন্তু সকল মুহাদ্দিসের ব্যাপারে আমার আপত্তি আছে। এক শ্রেণীর মুহাদ্দিস আছে যারা হরকত বিহীন হাদীস গ্রন্থগুলির রিডিংটাও পড়তে পারে না, এরা অযোগ্য। এদের প্রতি করুণা ব্যতিত আমি কোন মন্তব্য করব না।

দ্বিতীয় প্রকারের মুহাদ্দিস যারা যোগ্য, জ্ঞানবান, পন্ডিত। তাদের ব্যাপারেই আমার বড় আপত্তি। কারণ ইসলামের ধারক- বাহক ও রক্ষক হলো আলেম সমাজ। আর আলেম সমাজের পরিচালক হলো মুহাদ্দিসগণ। কারণ তারাই হলো কোরান হাদীসের মূল ভাষ্যকার। মুহাদ্দিসগণ ইসলামের যে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও মতবাদ প্রচার করে সাধারণ আলেমগণ তাই জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। উম্মাহ তাদের এই মতবাদ গ্রহণ করে। এখন প্রশ্ন হল, এই মুহাদ্দিসরা ইসলামের সঠিক দায়িত্ব পালন করেছে কিনা? যদি করত, তাহলে তো ইসলাম ও উম্মাহর এতটা পতন হওয়ার কথা নয়। কারণ ইসলাম হলো একটা ভুবনজয়ী মতবাদ, এর অনুসারীরা তো সর্বযুগে সর্বকালে পৃথিবীর শাসক থাকার কথা। এর উত্তর হল, এসব মুহাদ্দিসরা নিজেদের দায়িত্ব তো পালন করছেই না বরং এরাই হল আল্লাহ ও রাসূল (সাঃ) এর প্রধান শত্রু, ইসলাম ও উম্মাহকে ধ্বংসের প্রধান কালপ্রিট। আমি নিজে মুহাদ্দিস হয়ে এই সাক্ষ্য প্রদান করলাম। এটা বিরাট বিস্তারিত আলোচ্য বিষয়। তবে সংক্ষেপে আমি এখানে দুয়েকটা বিষয় উল্লেখ করছি।

১ ফিরকাবাজিঃ কোরান হাদীসের আলোকে ফিরকাবাজি হারাম, এটাকে জায়েয মনে করা কুফুরি। অথচ এ কথা সর্বজন বিদিত যে, এ ফিরকাবাজিই ইসলাম ও উম্মাহ ধ্বংসের মূল কারণ। মুহাদ্দিসরাই কোরআন হাদীসের নানামুখি ব্যাখ্যা দিয়ে বিভিন্ন ফেরকার জন্ম দিয়েছে। সালাফি, দেওবন্দ, তাবলীগ, জামাত, ব্রাডার হুড ইত্যাদি ফেরকার এভাবেই জন্ম হয়েছে। ইসলামের মূল ধারার এসব ফিরকা একেকটা মহীরুহ, এরা মুহাদ্দিস কিনে আনে না, জন্ম দেয়। আর এসব মুহাদ্দিসরা বেরিয়ে এসেই নিজের ফেরকাকে একমাত্র নির্ভুল ও শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে এবং অন্যদেরকে ভ্রান্ত ও গুমরাহ প্রমাণ করতে জীবন বাজি রাখে, সর্বশক্তি নিয়োগ করে। কিন্তু তারা সামগ্রিক ইসলাম ও উম্মাহর মুক্তির জন্য কোন কাজ করে না, করতে পারে না। অথচ এসব মুহাদ্দিসদের উচিত ছিল ফিরকাবাজির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করা। না পারলে অন্তত গলায় গামছা বেঁধে জনে জনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে জনগণকে সতর্ক করা যে, ভাই ফিরকাবাজি জায়েয নেই, এটা কুফুরি। রাসূল (সাঃ) বলে গেছেন, আমার উম্মত ৭৩ ফিরকা হবে, ৭২ ফিরকা জাহান্নামে যাবে আর একটা ফিরকা জান্নাতে যাবে। অর্থাৎ যারা ফিরকাবাজি করবে না, নিজে ঐক্যবদ্ধ থাকবে এবং অন্যদের ঐক্যের পথে ডাকবে- এরাই একমাত্র মুক্তি পাবে।

কাজেই বেরাদরানে ইসলাম, এখতেলাফ করো কিন্তু এফতেরাক(বিভক্তি) করো না। এখতেলাফের সাথে এত্তেফাক(ঐক্য) থাক। কিন্তু মুহাদ্দিসরা নিজেদের এই ফরয দায়িত্ব তো পালন করছেই না বরং তারা নামাযে আমিন বলা না বলা, রুকু সেজদায় হাত উঠানো, না উঠানো ইত্যাদি তুচ্ছাতিতুচ্ছ ও নগন্য বিষয় নিয়ে উম্মাহর মধ্যে বিভক্তির বিষ ছড়িয়ে দিয়েছে। এজন্যই এরা ইসলাম ও উম্মাহর দুষমন।

পৃথিবীর সকল মুহাদ্দিসের মুহাদ্দিস- যার নাম শুনলে মুহাদ্দিস মাত্রই মস্তক অবনত করে দেয়। ভারত বর্ষের সকল মুহাদ্দিসের উস্তাদ, যে মহাসাগর থেকে পরবর্তিতে মুহাদ্দিস নামের অন্যান্য শাখা প্রশাখাগুলি বেরিয়েছে, তিনি হলেন আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরি (রঃ)। সারা জীবন হানাফি মাযহাবের একনিষ্ঠ প্রবক্তা ছিলেন। কিন্তু শেষ বয়সে কী অনুভূতি জানিয়ে গেছেন তা প্রনিধান যোগ্য। ভারত বর্ষে মুসলিম উম্মাহর দুই দিকপাল আনোয়ার শাহ কাশ্মিরি (রঃ) ও মারেফুল কোরআনের লেখক মুফতি শফি (রঃ) এর একটা কথোপকথন পাকিস্তানের দৈনিক ‘নেদায়ে খেলাফত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এক ছাত্রের মাধ্যমে পত্রিকাটি আমার হাতে আসে। আমি উর্দু থেকে এর অনুবাদটি বলছি।

লেখাটার শিরোনাম, ‘উমর যায়ী’য় কর দি’ (জীবন বরবাদ করে দিলাম)।

মুফতি মোঃ শফি (রঃ) বলেন, ‘আমি একদিন আনোয়ার শাহ কাশ্মিরির খেদমতে হাজির হয়ে দেখলাম, হযরত দু’হাতে মাথা চেপে ধরে বিষণ্ণ হয়ে বসে আছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘হজরতের তবিয়ত ঠিক আছে তো? তিনি বললেন, ‘আরে ঠিক আছে কী জিগাচ্ছ, উমর যায়ী’য় করদি’ (জীবনটা তো বরবাদ করে দিয়েছি)। আমি বললাম, ‘হযরত আপনি তো ইলমে দ্বীনের খেদমতে ও দ্বীনের প্রচার প্রসারে সারাটা জীবন ব্যয় করেছেন, আপনার হাজার হাজার ছাত্র ও শাগরেদরা আপনার থেকে ইলম অর্জন করে দ্বীনের খেদমত করে যাচ্ছে। কাজেই আপনার জীবনই যদি বরবাদ হয়ে যায় তাহলে আর কার জীবন কাজে লাগবে?

হযরত বললেন, ‘আমার জীবন, আমার সকল বক্তব্য বিবৃতি, আমার সকল প্রচেষ্টার সার কথা তো এই, হানাফি মাযহাবকে অন্যান্য মাযহাবের উপর প্রাধান্য দেয়া, হানাফি মাসয়ালার পক্ষে দলীল অন্বেষণ করা এবং পতিপক্ষের দাঁত ভাঙ্গা জবাব দেয়া, এই তো হলো আমার প্রচেষ্টা ও ইলমি জিন্দেগীর ফলাফল। এখন চিন্তা করছি, কোন বিষয়ের পিছনে পরে জীবন বরবাদ করলাম। তারপর বললেন, ‘আরে মিয়া (মুফতি শফিকে), কোন মাযহাব সঠিক আর কোনটা ভুল এই রহস্য দুনিয়াতে তো উদ্ঘাটিত হবেই না, কিয়ামতের দিনও হবে না (কিয়ামতে শুধু মানুষের বিচার হবে)। আবার মুনকার নাকির কবরে এসে জিজ্ঞেস করবে না যে, নামাযে হাত উঠানো ঠিক না বেঠিক। আমিন জোরে বলা কি ঠিক নাকি বেঠিক। কবরে, বরযখে, হাশরে কোথাও এ জাতীয় প্রশ্ন করা হবে না। আবার হাশরে আল্লাহ তালা ইমাম আবু হানিফা, শাফেয়ি, মালেক, আহমদ ইবনে হাম্বল (রাহিমাহুমুল্লাহু আজমাইন) কাউকেই লজ্বিত করবেন না। আবার হাশরের ময়দানে তাদেরকে দাড় করিয়ে রেখে এ ফয়সালাও করবেন না যে, তাদের মধ্যে কে সঠিক বলেছিলেন আর কে বেঠিক বলেছিলেন।

কাজেই যেসব বিষয়ের না আছে দুনিয়াতে কোন গুরুত্ব, আর না আছে কবরে, বরযাখে, বা হাশরে কোন গুরুত্ব- এমন বিষয়ের পিছনে পরে জীবন ধ্বংস করে দিলাম। সঠিক ইসলামের দাওয়াত- যে বিষয়ে সকল দল-মত, ফিরকা ঐক্যবদ্ধ ও ঐক্যমত্য, দ্বীনের জরুরি বিষয়- যেগুলি সকলের নিকট সমান গুরুত্বপূর্ণ, আম্বিয়ায়ে কেরাম যে বিষয়ের দাওয়াত নিয়ে এসেছেন, যে বিষয়ের দাওয়াত ছড়িয়ে দেয়ার জন্য আমাদেরকে হুকুম দেয়া হয়েছে (তাওহীদ ও খিলাফত) এবং যে মুনকার (অন্যায়) কাজ মিটিয়ে দেয়া আমাদের উপর ফরয করা হয়েছে, এখন এ মৌলিক দুই বিষয়ে কোন দাওয়াতই দেয়া হচ্ছে না। দ্বীনের অত্যাবশ্যকিয় বিষয় আজ মানুষের দৃষ্টি থেকে আড়াল হয়ে গেছে, এখন আমরা ও অন্যরা সবাই মিলে দ্বীনের চেহারা পাল্টে দেয়ার চেষ্টায় আছি। যেসব মুনকার কাজ মিটিয়ে দেয়া আমাদের কর্তব্য ছিল- সে গুলি ছড়িয়ে পরেছে, গুমরাহি ছড়িয়ে পরেছে, নাস্তিক্যতাবাদ ও শিরক ছড়িয়ে পরেছে। মুর্তি- ভাস্কর্য পূজা আবার জারি হয়ে গেছে। হালাল হারামের পার্থক্য উঠে গেছে। অথচ আমরা তুচ্ছাতিতুচ্ছ শাখাগত মাসয়ালার বাদাবাদিতে লেগে আছি। এজন্যই আমি দুঃখিত হয়ে বসে আছি আর আফসোস করছি, উমর যায়ি’য় করদি।

মুহাদ্দিস কুল শিরোমণি আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরির এই আত্মস্বিকৃতিতে প্রত্যেক ফেরকাবাজের জন্য শিক্ষনীয় বিষয় রয়েছে, আত্মার খোরাক রয়েছে, আত্মসংশোধনের উপাদান রয়েছে।

২ ইসলামী অর্থ ব্যবস্থাঃ ইসলামী বিধান মতে মুস্তাদআফ-প্রলেতারিয়েত শ্রেণী রাষ্ট্রের পোষ্য। রাষ্ট্র তাদেরকে ভাতা দিয়ে প্রতিপালন করবে। এরা হল ইয়াতিম, বিধবা, বয়োবৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী, হিজড়া। এদের জন্য ইসলাম তিনটি অর্থব্যবস্থা প্রদান করেছে। যাকাত, ইনফাক ও সমাজতন্ত্র। অর্থাৎ যাকাতে যদি দরিদ্র জন গোস্টির চাহিদা পুরা না হয় তাহলে ইনফাক অর্থাৎ সরকার ধনীদের (মুস্তাকবির) থেকে আরো অর্থ আদায় করে দরিদ্রের প্রয়োজন পুরা করবে। তাতেও যদি প্রয়োজন না মিটে তাহলে ডাইরেক্ট সমাজতন্ত্র, মানে ইসলামী সমাজতন্ত্র। অর্থাৎ তখন আর কেউ সম্পদ জমা করতে পারবে না, সকল সম্পদ সকল নাগরিকের মাঝে সমানভাবে বন্টন করতে হবে। কিন্তু আপনি জিজ্ঞেস করলে দেখবেন অনেক মুহাদ্দিস অর্থনীতি কাকে বলে এটাই বুঝেনা। এদিকে নিঃস্ব সর্বহারা বুভুক্ষু মানুষ ডাস্টবিনে কুকুরের সাথে কাড়াকাড়ি করে বর্জ্য খাচ্ছে, আকাশচুম্বী অট্টালিকার ছায়ায় ফুটপাতে পরে নিদ্রা যাচ্ছে। দেশের অধিকাংশ মানুষ দু’বেলা দু’মুঠো ক্ষুধার অন্ন পাচ্ছে না অথচ লোটেরারা তাদের পেটে লাথি মেরে তাদেরই সম্পদ বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। তখন তো এসব মুহাদ্দিসদের উচিত ছিল রাজপথে দাঁড়িয়ে না’রা বুলন্দ করা আর লোটেরাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করা। কিন্তু তারা তা করে নি বিধায় এরা ইসলাম ও মানবতার দুষমন।

৩ বিচার ব্যবস্থাঃ অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি নিহত হলে তার পরিবারটি পথে বসে, ভিক্ষায় নামে। আবার কোন মেয়ে ধর্ষিতা হলে ধর্ষকটি পালিয়ে হউক বা সামাজিক বা আর্থিক প্রভাব খাটিয়ে হউক মুক্তি পেয়ে যায়। পক্ষান্তরে ধর্ষিতা মেয়েদের অনেকেই আত্মহত্যা করে, যারা বেচে থাকে এরা সমাজের ঘৃণা অবজ্ঞা আর অবহেলা নিয়ে জীবন কাটায়। পৃথিবী আর পৃথিবীর বাতাস তাদের জন্য বিষাক্ত হয়ে উঠে। কেউ তাদের বিয়ে করে না, অভিশপ্ত জীবন কাটায়। তারপর তিলে তিলে ধুকে ধুকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। অথচ এখানে ইসলামের পরিস্কার বিধান হচ্ছে ভিকটিম একশত উট বা সমমূল্য পাবে। এই বিপুল সম্পদ পেলে নিহত ব্যক্তির পরিবারটা বেচে যেত, ধর্ষিতা মেয়েটার একটা গতি হত, সম্পদের লোভে হয়ত কোন ছেলে তাকে গ্রহণ করত। এখন আমার প্রশ্ন হল, ইংরেজ প্রবর্তিত দাজ্জালি বিচার ব্যবস্থায় স্বাধীনতা উত্তর কয়টা হত্যা ও ধর্ষনের বিচার হয়েছে? কাজেই মুহাদ্দিসগনের কি উচিত ছিল না এই যুলুমের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করা? কিন্তু তারা তা করেনি, আর করেনি বিধায় এরা ইসলাম ও মানবতার শত্রু।

৪ রাসূল(সাঃ) সম্পর্কে প্রফেসিঃ কোরআনে বলা হয়েছে, পূর্ববতী কিতাবগুলিতে রাসূল (সাঃ) সম্পর্কে প্রফেসী রয়েছে। আর আমরাও দেখতে পাচ্ছি বেদ- বেদান্ত, পুরান, বাইবেল, ত্রিপিটক ইত্যাদিতে রাসূল (সাঃ) সম্পর্কিত ভবিষ্যৎ বাণীগুলি এখনো নক্ষত্রের মত জ্বল জ্বল করছে। উচিত তো ছিল মাদরাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সংক্রান্ত আলাদা বই- কিতাব পাঠ্য থাকা। কিন্তু তা নেই। মুহাদ্দিসদের উচিত ছিল ঐসব প্রফেসীগুলি ছাত্রদেরকে শিক্ষা দিয়ে জনগণের মাঝে ব্যাপক প্রচার প্রসার চালানো। তাহলে অমুসলিমরা সত্যটা বুঝতে পারত, ব্যাপক হারে ইসলাম গ্রহণ করত, পৃথিবীতে ইসলামের বিজয় ডঙ্কা বেজে উঠত। কিন্তু তারা এ দায়িত্ব পালন করেছেন না, পালন করছেন আহমদ দীদাত ও জাকির নায়েকের মত আধুনিক শিক্ষিতরা। কাজেই মুহাদ্দিসরা রাসূল (সাঃ) এর সাথে বেঈমানি করছে আর বেঈমানি করে রাসূল (সাঃ) এর উম্মত দাবী করা কি ঠিক হবে, এ দাবী ধোপে টিকবে?

এই দুই প্রকার মুহাদ্দিসের বর্ণনা দিলাম- যাদের তালিকায় আমি নেই। কারণ আমি রিডিং পড়তে পারি না, পড়াতে পারি না এমন কথা কেউ কোন দিন বলেনি, বলবেও না। আবার আমি ফিরকাবাজ ও ইসলাম বিকৃতকারী নই। এখন আমার জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে জনমত গঠন করে ঐসব ফিরকাবাজদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করা। কারণ এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ওয়াজিব।

এবার আসুন আমার জাত বংশের বিষয়ে। সৈয়দ, মোঘল, পাঠান আমাদের এ জাতীয় কোন বংশীয় উপাধি নাই। যারা এ উপাধি বহন করে তারা মিথ্যুক, কারণ হযরত ফাতেমার (রাঃ) বংশধর বাংলার গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পরেনি। অন্যান্য বাঙালী মুসলমানের মত আমরাও সাধারণ বাঙালী মুসলমান। .আর বাঙালী সাধারণত বাপ দাদার পরিচয় বহন করে। তাই আমি পৈত্রিক পরিচয় তুলে ধরছি। আমার বাবার দাদার নাম সুলতান মাহমুদ, তিনি প্রতাপশালী ছিলেন, কয়েক গ্রাম শুদ্ধু তার জমি ছিল কিন্তু পরবর্তিতে তার ছেলেরা এসব নষ্ট করে দেয়। বৃটিশ আমলে এতদাঞ্চলে কোন পুর্নাংগ মাদরাসা ছিল না বিধায় আমার দাদা ছিলেন আধা মাওলানা। কিন্তু তিনি নিজের নামের সাথে মুন্সি লিখতেন, কখনো মৌলভী, মাওলানা লিখতেন না। এলাকায় তিনিই একমাত্র ধর্মীয় মুরুব্বী ছিলেন। জুম্মা ও ঈদগাহের ইমামতি করা, ইসলামী সকল অনুষ্ঠান সম্পাদন করা ইত্যাদি ছিল তার কাজ। আবার এলাকার দেন দরবার বিচার আচার তাকেই করতে হত। তার ছেলে হল মুফতি, দেওবন্দি মুফতি। আমার জানা মতে ময়মনসিংহ অঞ্চলে তিনিই প্রথম দেওবন্দ থেকে মুফতি হয়ে আসেন।

আমার বাবা সম্পর্কে বলার আগে আপনাকে একটা কথা বলব। আমাদের দেশে বিভিন্ন বিষয়ের উপর পুরস্কার দেয়া হয়। যদি কখনো ধার্মিকতা এবং মানবসেবার উপর পুরুস্কার ঘোষিত হয়, তাহলে পুত্র হিসাবে নয়- তৃতীয় পক্ষ হয়ে বলছি সেটা আমার বাবা পাবেন। কেন পাবেন তা আন্দাজ নেয়ার জন্য কয়েকটা উদাহরণ দিচ্ছি- যাতে পাতিলের দুয়েকটা ভাত টিপে আপনি পুরো পাতিলের আন্দাজ নিতে পারেন। কারণ আমার বাবার সম্পূর্ণ জীবনি বললে কয়েকদিন লাগবে।

কিছু কিছু শিশুদের অভ্যাস থাকে স্যাতস্যাতে মাটি বা পানি দেখলে সেখানে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে গর্ত করে বা অর্ধচন্দ্রাকারে আঙ্গুল ঘোড়ায়। অন্তত আমার এ অভ্যাসটা ছিল। আর গ্রামাঞ্চলের মানুষ নামায পড়ে বাঁশের চাটাইয়ে। আমি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ঘরের মেঝেতে গিয়ে দেখতাম একটু সামান্য জায়গা স্যাতস্যাতে ভিজা, চাটায়ের দাগ লেগে আছে। সেই ভিজা মাটিতে আমি অর্ধচন্দ্রাকারে আঙ্গুল ঘোরাতাম আর আম্মাকে জিজ্ঞেস করতাম, আম্মা এখানে ভিজা কেন, চাটাইয়ের দাগ কেন?

এভাবে প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে গিয়ে আঙ্গুল ঘোরাতাম আর জিজ্ঞেস করতাম। আম্মা কি জানি উত্তর দিতেন মনে নেই, তবে একদিনের উত্তরটা ভাল করেই মনে আছে এবং যে অবস্থায় উত্তর দিয়েছিলেন সে দৃশ্যটাও চোখে ভেসে আছে। তিনি বলেছিলেন, তোর বাপে কান্দে। বলতাম, কেন কান্দে?- আল্লাহ্‌র কাছে কান্দে। তারপর বড় হলাম, নিজে দেখলাম, বুঝলাম। আম্মাও প্রায় প্রায়ই বলতেন, ‘আগে তোর বাপের তাহাজ্জুদ নামায কাযা হত না, পরবর্তিতে সংসারি চাপে মাঝে মধ্যে কাযা হত। তাহাজ্জুদের সময় সেজদায় পরে কাঁদতে কাঁদতে মাটি ভিজিয়ে ফেলত’। অর্থাৎ তিনি শেষ রাত্রে তাহাজ্জুদ পরে সেজদায় পরে থেকে এতই কাঁদতেন যে মুসাল্লা ভিজে মাটি পর্যন্ত ভিজে যেত। আল্লাহ্‌র ইবাদাত গুজার বান্দাদের জন্য এ এক বিরল দৃষ্টান্ত। এমনটা আর আমি কোথাও শুনিনি। আপনি হয়ত ভাববেন কোন পাপের কারণে হয়ত তিনি এভাবে কাঁদতেন। কাজেই তার বাকী জীবনের পাত্তা লাগানোর জন্য সংক্ষেপে দু’টি ঘটনা উল্লেখ করব।

বালিয়া পাড়া মাদরাসার শিক্ষক মাওঃ এমদাদুল হক সাব ছিলেন আমার আব্বার ছাত্র জীবনের সাথী ও সহকর্মি। আব্বার ইন্তেকালের পর একদিন তিনি কিছু ছাত্রের সামনে তার তাকওয়া ও পরহেজগারি নিয়ে আলোচনা করছিলেন, আমিও ছিলাম সেখানে। হঠাৎ তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, তোমার বাবার দেওবন্দ যাওয়ার ইতিহাস জান? উত্তরে আমি বললাম, না, জানি না। তিনি বললেন, ‘তোমার বাবা এক বাড়িতে লজিং থাকত। তার কণ্ঠ ছিল সুমধুর। লোকেরা তার কণ্ঠে আরবী ফারসি উর্দু শের আশ’র (কবিতা) শুনত। এই শের শুনেই হউক বা অন্য যে কারনেই হউক একটা মেয়ে তোমার বাবার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পরে। সে বিভিন্ন ভাবে তোমার বাবাকে ফুসলাতে থাকে, বিরক্ত করতে থাকে। কিন্তু তোমার আব্বা প্রশ্রয় দেয় না। তখনকার দিনে কাচারি ঘরের দরজা থাকত বাঁশের চাটাই দ্বারা নির্মিত। এটা টান দিয়ে বন্ধ করতে হত আর ধাক্কা দিয়ে খুলতে হত। একদিন রাতে মেয়েটি দরজা খুলে ঘরে ঢুকে গেল। তোমার বাপ তাকে তাড়িয়ে দিয়ে হারিকেন জ্বালিয়ে সারা রাত বসে থাকল। পরদিন সকালে পুটলা পাটলি মাথায় নিয়ে বাড়িতে এসে হাজির হল। তোমাদের বাড়ির পাশে যে আলিয়া মাদরাসাটি আছে আগে এটি কওমী মাদরাসা ছিল। এখানে শিক্ষকতা করতেন ময়মনসিংহ তাবলীগের আমীর উসমান গনী সাব। তিনি এসে তোমার দাদীকে বললেন, ‘আপনার ছেলেটা খুব মেধাবী, অনেক বড় আলেম হতে পারবে। ওকে দেওবন্দ পাঠিয়ে দিন। তখন তোমার দাদা মারা গেছে। তোমার দাদীই তাকে দেওবন্দ পাঠাল। তারপর হাসান বলল, ‘এই হল আমার বাবার চারিত্রিক সনদ।

আমি বাল্যকালে ভালই দুষ্টামি করতাম। তাই বলে বর্তমানকার ছেলেদের মত নয়। দুষ্টামি বলতে খেলাধুলায় বেশি মনো যোগ, পড়ায় ফাকি দেয়া, আর সুযোগ পেলে নামায না পড়া। একদিন সকালে লজিং মাস্টারের কাছে পড়তে বসেছি। এ সময় আব্বার কয়েকজন ছাত্র এল সাক্ষাতের জন্য। লজিং মাস্টার তাদের সাথে আমার সুনাম শুরু করল, ‘এইটা একটা বদমাইশ, ঠিকমত পড়ে না, আমি বলি পড়তে আর সে বসে বসে ঘুমায়’ বলে আমাকে মারার কঞ্চিটা দিয়ে সে আমার পেটে গুতা মারতে থাকে। তারপর শুরু হয় আমার গুনকির্তন। এর মধ্যে আব্বা এলেন, ছাত্ররা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ শুরু করল, লজিং মাস্টারও আমার উপর তার ক্ষোভের হাড়িটা উপোর করে ঢেলে দিল। দেখলাম আব্বার চেহারায় বিরক্তি ফুটে উঠল। তিনি বললেন, ‘আচ্ছা আমার ছেলে তো এমন হওয়ার কথা নয়। আমি জীবনে কোন দিন কোন অন্যায় করিনি। আমার যতদুর মনে আছে, তখন আমার বয়স ছয় সাত বছর। কয়েকটা পোলাপানের সাথে রাস্তায় খেলতে ছিলাম। হঠাৎ পিছন ফিরে দৌড় মারলাম কিন্তু একজন লোক আসতেছে আমি দেখিনি। তার গায়ের সাথে লেগে আমি মাটিতে পরে গেলাম আর লোকটা চলে গেল। কিছুক্ষণ পর উঠে দৌড়ে গিয়ে লোকটার হাতে ধরে বললাম, ‘আমি আপনাকে দেখি নাই, আমার অন্যায় হয়ে গেছে, আমাকে মাফ করে দেন। লোকটা অবাক হয়ে গেল, আমার মাথায় ও শরীরে হাত বুলিয়ে অনেক আদর করল আর বলল, ‘আলাহ তোমাকে অনেক বড় বানাবেন। এই হল আমার জানা মতে আমার জীবনের অন্যায়, তাহলে আমার ছেলে এমন হবে কেন? তারপর হাসান বলল, এখানে আমার বাবার জীবনে অন্যায়ের একটা আন্দাজ নিতে পারলেন। এমনকি আপনি চাইলে আমাদের এলাকায় গিয়ে আমার বাবার নামে মাইকিং করতে পারেন, ‘যদি কেউ প্রমাণ করতে পারে যে, তিনি কোনদিন একটি মিথ্যা কথা বলেছেন, কাউকে এক পয়সা ঠকিয়েছেন বা অনিষ্ট করছেন বা অন্তত কোন অনুচিত কাজ করেছেন তাহলে তাকে মোটা এমাউন্টের পুরুস্কার দেয়া হবে। নিশ্চিত বলা যায় ব্যর্থ হবেন।

আগের দিনে নাটক, সিনেমা, টি ভি ইত্যাদি ছিল না। মানুষ বিনোদনের জন্য খেলাধুলা, ষাঁড়ের লড়াই, মেলা, দলোয়া গান, জারি গান, ঘেটুগান, নাটক ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকারের আনন্দ উৎসব করত। গত শতকে ষাটের দশকের মাঝামাঝি আমার আব্বা দেশে আসার সময় আমাদের এলাকায় বড় একটা মাঠে মেলা চলছিল। মেলার দ্বিতীয় দিন চলছে, বিকালে মেলা জম জমাট হয়ে উঠেছে, মাঠ টইটুম্বুর হয়ে গেছে, লোকে লোকারন্য। এর মধ্যে প্রচার হয়ে গেল দেওবন্দ থেকে এলাকার নতুন মুফতি সাব আসতেছেন। কর্তৃপক্ষ তাড়াতাড়ি মেলা ভঙ্গের ঘোষণা দিল, মানুষ ছোটে ছিটিয়ে বাড়ির দিকে চলল। অল্পক্ষণেই মাঠ ফাকা হয়ে গেল। এই যে মেলা ভাঙ্গল, আমাদের এলাকায় আর কোন দিন মেলা বা গান বাজনা হতে পারে নি। আশপাশের এলাকায় বিভিন্ন প্রকারের গান মেলা ইত্যাদি হত, আমাদের এলাকার যুবক ও মাতব্বর শ্রেণীর লোকেরাও করতে চাইত কিন্তু আব্বার কারণে পারত না।

আগেকার দিনে গ্রামাঞ্চলে আশ্বিন কার্তিক মাসে কোন কাজ কর্ম থাকত না, লোকেরা নাটক, জারি, সারি, ঘেটু ইত্যাদি গান বাদ্যবাজনা করত। আবার ফাল্গুন চৈত্র মাসেও কাজ থাকত না, তখন ষাঁড়ের লড়াই, মেলা, অষ্টমী, বৈশাখী এ জাতীয় উৎসব করত। একবার কার্তিক মাসে চার দিকের এলাকায় নাটক ও গানের বন্যা ছোটে গেল। অন্যদের উৎসাহে আমাদের এলাকার মাতাব্বর ও যুব সমাজ ক্ষেপে গেল তারা গান করবেই। আব্বার বাধার মুখে তারা একাট্টা হয়ে গেল। আব্বার জন্য তারা নাটক ফাটক করতে পারে না, এবার করবেই, দেখবে কে ফিরায়। দুয়েক জন মুসুল্লি ছাড়া সবাই এক হয়ে গেছে। তখন আমার মামা চেয়ারম্যান, আব্বা গেলেন তার কাছে। কিন্তু যুব সমাজ আগেই তাকে নিজেদের মতামত জানিয়ে দিয়েছিল। কাজেই মামার অবস্থা হল কুল রাখি না শ্যাম রাখি। তিনি চোরকে বললেন চুরি কর গৃহস্থকে বললেন সজাগ থাক। আব্বা ব্যর্থ হলেন। অবশ্য মাদরাসার ছাত্র এনে তিনি তা প্রতিরোধ করতে পারতেন কিন্তু এলাকার লোককে না ক্ষেপিয়ে তিনি বিনয় ও উপদেশের পন্থা অবলম্বন করলেন।

নাটকের তিনদিন আগে মাইকিং করা হল। আমরা সমবয়সী ছেলেরা গবেষকের মত বিশ্লেষণ করি, এক ঝাক ডানা কাটা পরীর নৃত্য। ময়মনসিংহ থেকে টাকা দিয়ে পরী আনবে। তারা নাচবে, এরা যেহেতু পরী তাই কাপড় পরে না, কাপড় ছাড়া নাচবে। কেউ বলল, ওদেরকে টাকা দিলে আড়ালে গিয়ে কি জানি দেয়। কিন্তু কি দেয়- এটা আর কেউ বলতে পারল না। কারণ তখনকার দিনে পনেরর কম বয়সি ছেলেদের যৌনতা সম্পর্কে কোন ধারণা থাকত না।

ওদিকে আব্বার অবস্থা হল তিনি ভেঙ্গে পরেছেন। শোকে মুহ্যমান, গম্ভীর হয়ে থাকেন, কারো সাথে কথা বলেন না, দেখে বুঝা যায় রাজ্যের চিন্তা আর গ্লানি তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। মসজিদ আর বাড়িতে দৌড়াদৌড়ি করেন। মসজিদে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন, নামাযের পর দোয়া করেন আর কাঁদেন, ‘আল্লাহ্‌ এরা বুঝে না অবুঝ, এদেরকে মাফ কর, হেদায়াত কর, বুঝ দাও। কিছুক্ষণ পর পর বাড়িতে এসে আম্মার সামনে বলেন, ‘ওরা জাহান্নামের আগুনে ঝাঁপিয়ে পরছে, কে বাচায় ওদেরকে, কে বাচায়’ বলে ডুকরে কেঁদে উঠতেন। আসলে তিনি তখন এতটা অসহায় হয়ে পরেছিলেন যে, কিছুক্ষণ পরপর আম্মার কাছে এসে মনের ব্যথা ও অসহায়ত্ব প্রকাশ করতেন।

তারপর এল সেই অভিশপ্ত রাতটি। আমাদের বছুরে কামলা সাধারণত রাতের বেলায় গোয়ালে গরু তুলত। কিন্তু এদিন সে কর্ম চঞ্চল হয়ে উঠল, বিকালেই সব কাজ কর্ম শেষ করে আম্মাকে এসে বলল, ‘চাচী আমি একটু বাজারে যাব, সেখান থেকে বাড়িতে যাব, আজ রাতে খাব না’ বলে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল। আমি ও আম্মা বুঝলাম, আসলে সে আব্বার পাকড়াও থেকে বাঁচার জন্য আগেই ভাগাতানি দিল। এশার পর আমাদের বাড়িটাতে শোকের ছায়া নেমে এল। আব্বা কখনো মসজিদে যান, সেখানে কান্নাকাটি করেন। তারপর বাড়িতে আসেন, একটু পান খান, আম্মার সাথে দু’চার কথা বলেন। আবার মসজিদে যান, আবার আসেন, আম্মাকে বলেন, ‘জাহান্নামের আগুনে মানুষের কত লোভ, ওরা জাহান্নামে যেতে চায়, কে ওদের ফিরাবে। আল্লাহ্‌র গজব পরবে, কেউ বাঁচতে পারবে না, কেউ না ইত্যাদি বলে বলে তিনি অসহায়ত্ব যাহির করতেন আর কাদতেন।

এভাবে একেক সময় একেক কথা বলেন, বাড়ির পরিবেশটা এমন ভীতিকর হয়ে উঠেছিল যে, যেন সবাই আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে, এক ঘরে করে দিয়েছে। নাটকের আসর থেকে কিছুক্ষণ পরপর হৈ হল্লার আওয়াজ আসে। সাথে সাথে আব্বার চেহারাটা বিবর্ন হয়ে যায়, দেখে মনে হয় এর চেয়ে অসহায়, এর চেয়ে সর্বরিক্ত আর কোন মানুষ হতে পারে না। এভাবেই অস্থিরতার মধ্যে তিনি সারা রাত কাটালেন। নাটকের পর সবাই নিজেদের ভুল বুঝতে পারল। দলের প্রধান পান্ডা আয়ুব আলীসহ অনেকেই আব্বার হাত ধরে তওবা করল আর ওয়াদা করল, তারা আর কোন দিন গান করবে না, অন্যদেরও করতে দিবে না। তারা তাদের ওয়াদা রক্ষা করেছে। আব্বার জীবদ্দশায় তো নয়ই আজ পর্যন্ত আমাদের এলাকায় আর কোন দিন গান হয়নি। আয়ুব আলী এখনো বেচে আছে, এ ঘটনার জন্য এখনো কাঁদে। একটা গানের জন্য একজন আলেমের এতটা ব্যাকুলতা আমি ধারনাও করতে পারি না।

বালক বয়স, আব্বা ফযরের সময় ঘুম থেকে টেনে তুলে সাথে করে মসজিদে নিয়ে যেতেন। আমি ঘুমে টলতে টলতে যেতাম, কোথায় কি হচ্ছে না হচ্ছে চেতনা থাকত না। ফযরের নামায পড়াল আমাদের লজিং ছাত্র। আমি কাতারের দক্ষিণ প্রান্তে আব্বা উত্তর পাশে। সালাম ফিরানোর পরেই আব্বা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন, ‘হায় আল্লাহ, এই যে দুনিয়া থেকেই আগুন মুখে নিয়ে বিদায় হল, এই আগুনের আর শেষ নাই, অনন্তকাল এই আগুনেই থাকতে হবে’ বলতে বলতে তিনি কাঁদতেই থাকলেন। নামাযের পর মসজিদ থেকে বেরিয়ে দেখি শ্বশানে আগুন জ্বলছে। আমাদের পাড়ার অবিবাহিত হিন্দু যুবক মলয় মারা গেছে, তার চিতা জ্বলছে।

প্রাইমারীর পরেই আব্বা আমাকে নিয়ে মাদরাসায় ভর্তি করে দিয়েছিলেন। হিফজ ক্লাসে পড়তাম। একবার আমাদের বাড়ি থেকে মাইল খানেক দুরে মেলা বসেছে। দিনে ষাঁড়ের লড়াই, রাতে জোয়া, হাউজি, মাগিবাজি। ষাঁড়ের লড়াই দেখতেই হবে। কিন্তু মাদরাসা ছুটি হয় চারটায়, যেতে যেতে সন্ধ্যা, তখন মেলা ভেঙ্গে যাবে। কাজেই ক্লাসে বসে কয়েক বন্ধু মিলে পরামর্শ করলাম ভেগে যেতে হবে। জহুরের আযান হলে আমরা বেরিয়ে ঘোরাঘোরি করলাম। সুন্নত শুরু হলে ক্লাসে ঢোকে দরজার আড়ালে লুকিয়ে থাকলাম। ফরয শুরু হলে কোরআন শরীফ গলায় না ঝুলিয়ে বগলদাবা করে পশ্চিম দিক দিয়ে বেরিয়ে পরলাম। কারণ নামাযের সময় একজন পিয়ন বসা থাকে দেখার জন্য কে নামায পড়ে না এবং কে বাড়িতে চলে যায়। পরদিন তাকে রাম ধুলাই দেয়া হয়। বালিয়া মাদরাসাটি পুর্বমুখি। পশ্চিম পাশে বিশাল লম্বা বিল্ডিং এবং ঈশান কোণে মসজিদ। কাজেই কেউ যাতে না দেখতে পায় সেজন্য পশ্চিম দিকে বেরিয়ে বিল্ডিং ও মসজিদের পিছন দিয়ে মারলাম ভাগাতানি। বাড়িতে গিয়ে চারটে খেয়ে রওনা দিলাম মেলায়।

আব্বা জানেন মেলা আছে, তাই যহুরের নামাযের পরই তিনি আমার খোজে ক্লাসে গিয়ে দেখেন আমি নাই। অমনি ছুটলেন বাড়িতে। তিনি বাড়িতে গেলেন সড়ক দিয়ে আর আমি রওনা করলাম মাঠ কোণাকোণি, ফলে দেখা হয়নি। কিন্তু আমিও সড়ক ধরে গেলে দেখা হয়ে যেত। তিনি বাড়িতে পৌঁছেই আম্মাকে জিজ্ঞেস করলেন হাসান কোথায়? আম্মা বললেন, ‘কি জানি খেয়ে দেয়ে কই জানি গেল। তারপর আম্মা প্রায় প্রায়ই সে কথাটা বলেন, সাথে সাথে আব্বার চেহারাটা বিবর্ন হয়ে যায়, একদম অসহায় হয়ে পরেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, ‘দুনিয়ার মানুষ জাহান্নামের আগুনে ঝাঁপিয়ে পরছে, তাই বলে কি আমার ছেলেও আগুনে ঝাঁপ দিবে’। এখানে প্রতিপাদ্য বিষয় এই যে, নিজের নাবালক ছেলেকে একটু ষাঁড়ের লড়াই দেখা থেকে ফিরানোর জন্য দেড় মাইল পথ ছোটে গিয়েছেন এমন উচ্চ মার্গের মুত্তাকি ও পরহেজগার আলেম আরো আছেন কিনা আমার জানা নেই।

এখন আপনি ভাবছেন যে, তিনি বোধ হয় এমনই গোড়া ছিলেন যে পোলাপানের অধিকার দিতেন না। কাজেই দুটি ঘটনা বলি। প্রাইমারীর পর তিনি আমাকে মাদরাসায় নিয়ে যান। আমি প্রাইমারিতে বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্র ছিলাম, আব্বা সিক্সের অংক ও ইংরেজি বই কিনে দিয়ে বলেন, ‘তুই একসাথে দাওরা ও এম এ পাশ করবি, দ্বীনের খেদমত করতে হলে আধুনিক শিক্ষার দরকার আছে। তারপর পুর্ব পাড়ার একজন মাস্টার ঠিক করে দেন, তিনি বিকালে এসে পড়াতেন। কিন্তু কয়েকদিন পর বাদ দিয়ে দেই। স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে প্রতিদিন বিকালে নিয়মিত খেলার জন্য উপদেশ দিতেন। তবে মসজিদে মাগরিব পড়ার বাধ্যবাদকতা ছিল। তিনি প্রায় প্রায়ই বলতেন আমাকে একটা ফুটবল কিনে দিবেন আর একটা ফুল প্যান্ট বা মোটা কাপড়ের পাজামা বানিয়ে দিবেন খেলার জন্য। কিন্তু সেই ভাগ্য আমার হল না। কারণ তার সকল দায়িত্ব আমার কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে তিনি লুকিয়ে পরলেন চিরদিনের তরে ( রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগীরা)। আমার আব্বার তাকওয়া ও পরহেজগারি সংক্রান্ত কয়েকটা ঘটনা বললাম, এবার বলব মানব সেবার বিষয়ে।

দাদু কিসসা বলার সময় শিশুরা তার মুখের দিকে যেভাবে তাকিয়ে থাকে, ফোরকান সাব হাসানের মুখের দিকে সেভাবেই তাকিয়ে আছেন। প্রশান্ত চেহারা, অপলক চোখ, মুখটা হ্যাঁ করে আছে, যেন হাসানের কথাগুলি তিনি গোগ্রাসে গিলছেন। তিনি সচকিত হয়ে বললেন, ‘না না আরো বলেন। এখানে আত্মার খোরাক আছে, শিক্ষনীয় বিষয় আছে’।

দ্রস্টব্যঃ মা ও ভাই হজ্ব থেকে এসেছে। চলুন জমজমের পানি খেয়ে আসি। আচ্ছা ঠিক আছে আমিই নিয়ে আসব নে খন। লেখাটা কয়েকদিন বন্ধ থাকতে পারে।

বিষয়: সাহিত্য

১৩৫৫ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

378728
১৫ অক্টোবর ২০১৬ সন্ধ্যা ০৭:২০
সন্ধাতারা লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ ভালো লাগলো
378742
১৬ অক্টোবর ২০১৬ দুপুর ১২:৪৬
আবু নাইম লিখেছেন : বিরতী না দিয়ে এগিয়ে যান. এমনিতেই আপনি অনেক দেরী করছেন........
378765
১৭ অক্টোবর ২০১৬ দুপুর ১২:৫১
নকীব আরসালান২ লিখেছেন : ভায়া ধৈর্য়ে মেওয়া ফলে। অনেক ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File