চিঠি- ৪৭ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১২ অক্টোবর, ২০১৬, ১০:৪৬:০৮ সকাল
‘একজন বোরকাওয়ালী, দীর্ঘদেহী, কোলে একটা বাচ্চা’ হাসান রেলস্টেশন ও শহরময় ঘুরাফিরা করে আর খুঁজে বেড়ায়। কখনো দুপুরে, কখনো মধ্যরাতে নামায ছেড়ে, কখনো ভোরে ঘুম ভেঙ্গে দৌড়ে যায় দরজায় কি যেন শব্দ হল। কিন্তু এক রাশ নৈরাশ্য তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। অবসন্ন শরীরটা তখন সে রুমের বিছানায় এলিয়ে দেয়। খোলা দরজা দিয়ে প্রতিক্ষার দু’টি চোখ তাকিয়ে থাকে- এ পথ ধরেই আসবে, আসবে একজন বোরকাওয়ালী, দীর্ঘদেহী, কোলে একটা বাচ্চা। এসেই তার বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পরবে, ‘নিষ্ঠুর, পাষাণ, আমাকে একটুও ভালবাসে না, মনের টান নেই। অথবা বলবে, ‘চোখের আড়াল হলেই বুঝি বউ বাচ্চার কথা মনে থাকে না। অথবা মুখ ভেংচিয়ে বলবে, ‘আমাকে বিদায় করে তুমি আরেকটা বিয়ে করতে চাও, না? কর, কর দেখি আরেক বিয়ে, তোর ---টা কাইট্যা ফালামু। অথবা কেঁদে কেঁদে বলবে, ‘এটা আমার সংসার, আমার সংসার ফেলে আমি কোথাও যাব না, কোথাও না’ বলে বুকে মাথা রেখে কাঁদতে থাকবে, কাঁদতেই থাকবে। তখন সে অন্তহীন মমতায় স্ত্রীকে বুকে চেপে ধরবে কিন্তু কোন কথা বলবে না, একটা কথাও বলবে না। তার চোখ দিয়ে নোনা জলের ধারা ছুটবে। শুধু বলবে, ‘ওয়াদা কর, আর কোনদিন আমাকে এভাবে ফেলে চলে যাবে না’।
এভাবেই সে কল্পনা করে আর খোজে বেড়ায় একজন বোরকাওয়ালী যার কোলে একটা বাচ্চা। অনুক্ষণ স্ত্রী সন্তানের চিন্তা তার অধ্যাবসায়ে পরিনত হয়, অধ্যবসায় থেকে সাধনা, সাধনা থেকে ধ্যানে পরিনত হয়। অনুভূতি ও চেতনার জগতজুড়ে শুধুই স্ত্রী সন্তান, তার মন মস্তিস্ক আচ্ছন্ন করে রাখে। রাস্তায় বেরুলে কখন গাড়ি যাচ্ছে, কি হচ্ছে না হচ্ছে তার হুস থাকে না। কত সাইকেল রিকশা বেল বাজাতে থাকে, মোটর সাইকেল, গাড়ি হর্ন বাজাতে থাকে কিন্তু সে শুনে না। এভাবে কত রিকশা গাড়ি বা সাইকেল কোনদিন তার গা ঘেঁষে চলে যায়, কোনদিন গায়ে বাজিয়ে দেয়, হালকা ব্যথা পায়। আর তখন তার হুস আসে, সতর্ক হয়। তখন লোকেরা তিরস্কার করে, গালাগালি করে, সে লজ্বা পায়।
তখনো জামালপুরে সি সন জি খুব একটা দেখা যায় না, সবে মাত্র আসা শুরু হয়েছে। এ গুলো দেখে মনে হয় শব্দের চেয়ে গাড়ির গতি বেশি। অধিকাংশ এ্যাকসিডেন্ট এগুলিই করে। একদিন সে রোডের পাশ দিয়ে হাটছে। হঠাৎ একটা সি এন জি তার বাম পাশে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ফুস করে চলে গেল। না, সে পড়ে যায় নি, ধাক্কা খেয়ে রাস্তার পার্শ্বে কয়েক পা সরে গেছে। আশ পাশের মানুষ হায় হায় করে উঠল। কেউ দৌড়ে এসে তাকে ধরল। ‘না আমার কিছু হয়নি’ সে ভীত ও লজ্বিত কণ্ঠে হেসে বলল। তার শরীর ভীষণ ভাবে কাঁপছে। একে তো নাওয়া খাওয়াহীন দুর্বল শরীর, তার উপর হঠাৎ ভীতি তাকে বিকল করে দিল। তার পা কাঁপছে, দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। রাস্তার পাশে একটা চায়ের দোকানে বাইরের টুলে বসে পড়ল। একটা ছেলে জামার পিছনে ঝুলে থাকা অংশটা ধরে বলল, ‘আপনার পাঞ্জাবি ছিঁড়ে গেছে। সুতির জামা, গাড়ির কোন অংশে লেগে পিছনের অর্ধেকটা ছিড়ে ঝুলে আছে।
লোকেরা বলছে সি এন জি টা বহুদুর থেকেই হুইসেল দিয়ে আসছে। একটা ট্রাককে সাইড দিতে গিয়ে রাস্তার পাশে চলে আসে। আপনি কি কানে কম শুনেন? তারপর একেক জন একেক কথা বলতে লাগল। হাসান লজ্বিত হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকল। শরীরের কাঁপুনি বন্ধ হলে উঠে বাসায় চলে গেল। ‘রাস্তায় বেরুলে আমার হুস থাকে না, গাড়ি বাঁশি বাজায় অথচ আমি শুনি না। এভাবে তো একদিন বেঘোরে মারা পরব। আবার বাইরে না গিয়ে শুধু ঘরে বসে থাকাও তো সম্ভব নয়’ সে অনেক চিন্তা ভাবনার পর সিদ্ধান্ত নিল বাইরে কোন রিকশা বা গাড়ীতে ‘একজন বোরকাওয়ালী যার কোলে একটা বাচ্চা’ এমন কাউকে খুজবে না, তখন স্ত্রী সন্তানের চিন্তা বাদ দিয়ে শুধু গাড়ির দিকে খেয়াল রাখবে, এছাড়া বাঁচার উপায় নেই। এ পদ্ধতি অবলম্বন করল। রাস্তায় চলার সময় স্ত্রী সন্তানের চিন্তা মন থেকে দুরে সরিয়ে রাখে, রিকশা বা গাড়িতে কোন বোরকা ওয়ালী খোজে না। হঠাৎ বাচ্চা কোলে কোন বোরকাওয়ালী দেখা গেলে সে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে নিরীক্ষণ করে, তারপর হতাশ হয়। এভাবে কিছুদিন চলল।
কিন্তু কয়েকদিন পর সেই আগের অবস্থা। পথ হাটতে থাকে আর তার মন পরে থাকে স্ত্রী সন্তানের কাছে। তারা কোথায় আছে, কেমন আছে, কবে আসবে। শীঘ্রই আসবে অথবা এসে পরেছে। আবার রিকশা ও গাড়ির প্রতি তাকিয়ে থাকে, রেল ষ্টেশনে গিয়ে বসে থাকে। আবার তার মন মস্তিস্ক আচ্ছন্ন হয়ে থাকে, সে স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে খেলায়, তারাও তাকে নিয়ে খেলায়, তার মনটা উলট পালট করে, সে আত্নভোলা হয়ে যায়। একদিন রাস্তার পাশ ধরে হাটছে। এ এলাকাটায় গাড়ী ঘোড়ার ঘিঞ্জি কম। সে আনমনে হেটে রাস্তার একপার্শ্ব থেকে অন্য পার্শ্বে যাবে, এমনি তার ডান পায়ের গোড়ালিতে চাকার ঘর্ষণ অনুভব করল, পাশে তাকাল একটা বাইক স্থির দাঁড়িয়ে, কঠিন ব্রেক কষার কারণে চালক অনেকটা ঝুকে পড়েছে। সে ধমকে উঠতে চাইল কিন্তু তার আগেই, ‘ঐ মিয়াঁ, আপনি ঠসা নাকি, কতগুলি হুইসেল দিছি শুনেন না? চোখেও দেখেন না? কান ঠসা তো রাস্তায় নামেন কেন?’ লোকটা মাথা থেকে হেলমেট নামিয়ে রাগে গড়গড় করতে করতে বলতে লাগল। ‘এখনিতো আপনার পা-টা ভাঙ্গত, আর তখন দোষ হত গাড়ি ওয়ালার’। সে চারপাশের লোকদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই সব অপদার্থ লোকগুলিই যত অঘটন ঘটায়। এসব বেহুঁশ লোকগুলি মেয়ে মানুষের মত ঘরে বসে থাকতে পারেনা, হুঃ’ বলে লোকটা এক রাশ ঘৃণা ছড়িয়ে দিয়ে চলে গেল।
হাসান রাস্তার পাশে হতভম্ভের মত দাঁড়িয়ে থাকল। একটা কথাও বলতে পারলনা। সামান্য চামড়া উঠে গিয়ে পা থেকে রক্ত ঝরছে। চার পাশের লোকেরা তাকে দেখছে, হাসি মশকরা করছে, কেউ তিরস্কার করছে, সে লজ্বায় যেন মাটির সাথে মিশে গেল। বাসায় এসে সিদ্ধান্ত নিল আর সে ঘর থেকে বের হবে না। পরদিন রিকশা নিয়ে মাদরাসায় গেল। আবার রিকশা নিয়ে বাসায় ফিরল। সে আগেই মাদরাসা জগতের কঠিন কিতাবগুলির অনুবাদ শুরু করেছিল। এখন মনস্থির করল ঘরে বসে লেখা লেখির কাজ করবে, আর বাইরে বের হবে না। কিন্তু নিরাশ হল, লিখায় মনোযোগ দিতে চাইলেই স্ত্রী সন্তানের চিন্তা মনে উকি মারে। কোনভাবেই শব্দ চয়ন ও বাক্য বিন্যাস ঠিক করতে পারেনা। উঠে গিয়ে কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে বিছানায় গড়াগড়ি করে। তারপর আবার লিখতে বসে কিন্তু চিন্তা এলোমেলো হয়ে যায়। এভাবে তিনদিন পর্যন্ত চেষ্টা করল কিন্তু তিনটি পৃষ্ঠাও লিখতে পারল না।
এভাবে আবদ্ধ থেকে তার দম বন্ধ হয়ে এসেছে, মনে হয় যেন কোন কবরে সে বন্ধি- যার অক্সিজেন প্রায় শেষের পথে। নিজের কাছে সে অসহায় হয়ে পরল, ‘এভাবে আবদ্ধ থাকলে তো আমি এমনিতেই মারা যাব। এভাবে কোন মানুষ বাঁচতে পারেনা। যাদের জন্য এই অবস্থা অবশেষে তারা হবে ইয়াতিম আর বিধবা। কাজেই বাঁচার জন্যই আমাকে বাইরে ঘোরাফিরা করতে হবে’। স্ত্রী যাওয়ার পর থেকে তার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল বিকাল থেকে রাত দশটা এগারটা পর্যন্ত বাইরে কাটানো। অবশেষে অনেক চিন্তা ভাবনার পর সে স্থির করল এখন থেকে রাস্তায় নেমে সে গাড়ি গুনবে। শুরু হল নতুন পদ্ধতি। ক্য়টা গাড়ি আপ- এ যাচ্ছে তা ডান হাতের আঙ্গুলে গুনে, আর যেসব গাড়ি ডাউনে যাচ্ছে তা বাম হাতের আঙ্গুলে গুনে। একটা গাড়িও মিস হতে দেয় না, দু’লাইনের গাড়ি গুনে গুনে সে রাস্তা হাটে। বাঃ চমৎকার কাজে দিল এই কৌশল। এখন গাড়ির প্রতিই তার মনোযোগ থাকে। এ্যাকসিডেন্টের সম্ভাবনা আর থাকল না। এভাবেই তার সময় যেতে লাগল।
মুহাদ্দিস বলা হয় যিনি হাদীস পড়ান। উপমহাদেশের মাদরাসাগুলিতে হাদীস শাস্ত্রের সকল কিতাব পড়ানো হয় না, এটা সম্ভবও নয়, শুধুমাত্র সিহাহ সিত্তাহ পাঠ্য রয়েছে। বুখারি, মুসলিম, তিরমিযি, নাসায়ি, ইবনে মাজাহ ও শরহে মায়ানিল আছার-এ ছয়টি বিশুদ্ধ কিতাবকে সিহাহ সিত্তাহ বলা হয়। এগুলি কওমী মাদরাসার দাওরা ও আলিয়া মাদরাসার কামিল শ্রেনীতে পাঠ্য রয়েছে। হাসান একজন মুহাদ্দিস, সে কামিল শ্রেনীর শিক্ষক অর্থাৎ হাদীস পড়ায়। সাধারণত মাদরাসা শিক্ষকদের লোকেরা হুযুর বলে ডাকে। কিন্তু জামালপুরের নিয়ম হল কওমী মাদরাসার শিক্ষক ও মসজিদের ইমামদের হুযুর ডাকে আর সরকারি চাকুরেদের স্যার ডাকে, তা হুযুর হউক বা মুজুর হউক। কাজেই হাসানকে ছাত্ররা স্যার বলে সম্ভোধন করে। কামিল শ্রেণীর ছাত্ররা সাধারণত বয়স্ক হয়, তারা ওস্তাদকে ভয় পায় না বরং শ্রদ্ধার সাথে হাসি মশকরা ও কৌতুক করে। সম্প্রতি নিয়োগ প্রাপ্ত হাসানের ছাত্ররাও ছিল তার প্রায় সমবয়স্ক, সমসাময়িক।
তারা হাসানের আড়ালে আবডালে কৌতুক করে, ‘স্যার তো বউয়ের জন্য মজনু হয়ে গেছে, আমরা মজনু হলেই দোষ, স্যারকে আরেকটা বিয়ে করানো দরকার। এভাবে তারা হাসি তামাশা করত। হাসান ক্লাসে যাচ্ছে, কিছু ছাত্র ক্লাসে আর কিছু বারান্দায় দাঁড়িয়ে আলাপ করছে। দরজা দিয়ে ঢোকার সময় তার কানে এল, ‘এই স্যারের অবস্থা দেখিছিস, কেমন কাহিল হয়ে গেছে, বেচারা তো মরে যাবে। স্যারের জন্য একটা কিছু করা দরকার’। তারপর তারা ক্লাসে ঢুকেই বলল, ‘স্যার আয়নায় আপনার বেচারা দেখেছেন? চোখ কোঠরে চলে গেছে। এভাবে থাকলে তো আপনি বাঁচবেন না, ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করেন না? হাসান লজ্বিত হল, শুষ্ক হাসি হেসে বলল, ‘খাওয়া দাওয়ার তো একটু সমস্যাই, রান্নার লোক নাই, কখনো নিজেই রাধি, কখনো হোটেলে খাই।
মুকাদ্দস নামে একজন ছাত্র বলল, ‘স্যার ম্যাডাম তো আসবে না, শুনলাম ঢাকা ভার্সিটির এক শিক্ষকের সাথে বিয়ের আলাপ হচ্ছে, তার জন্য অপেক্ষা না করে অন্য কোন চিন্তা ভাবনা করেন’। অর্থাৎ সে অন্যত্র বিয়ের ইঙ্গিত করল। হাসান ছাত্রটার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি কোথায় শুনলে? সে উত্তর দিল, ‘উমর আলী বলেছে’। উমর হল তার শ্বশুর এলাকার সেই ছাত্র- একদিন স্ত্রীকে নিয়ে বাসে উঠার সময় যার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল এবং বলেছিল ‘আপনার শ্যালক কি করে, ওরা মানুষ হবে না’। ছাত্রদের সাথে স্ত্রী সম্পর্কে আলোচনা করতে হাসান লজ্বা পায়। তাই বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বলল, ‘আমার স্ত্রী তালাক হয়নি, আর তুমি বলছ ঢাকা ভার্সিটির শিক্ষকের সাথে তার বিয়ের আলাপ হচ্ছে, যতসব গাজাখুরি গপ্প, বাদ দাও চলো’ বলে সে পড়ানো শুরু করল।
বাসায় এসে কাপড় চোপর খুলে শরীরের দিকে তাকাল, নিজের প্রতি তার মায়া হল। বুকের ও পাজরের হাড় ভেসে উঠেছে। আয়নায় চেহারা দেখল, চোখ গর্তে ঢুকে গেছে, গাল বসে গেছে। হতাশায় সে চেয়ারে বসে পরল, কি করা যায় চিন্তা করতে লাগল। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল, কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসবে। দু’দিন পর ছুটি নিয়ে বাড়িতে চলে গেল। হাসানের অভ্যাস হল বাড়িতে গিয়ে সোজা মায়ের রুমে চলে যায়, কাপড় চোপর খুলে মায়ের আলনায় রেখে কিছুক্ষণ আলাপ সালাপ করে। মা একটা না একটা কিছু খেতে দেন। মায়ের কৌটা থেকে একটু পান খেয়ে সে নিজের রুমে বা মাঠের দিকে বেরিয়ে যায়।
হাসান বিকালে গিয়ে বাড়িতে পৌঁছল। অভ্যাসানুযায়ি সালাম দিয়ে মায়ের রুমে ঢুকল। ‘ওয়ালাই কুমুস সালাম’ বলে মা শুয়া থেকে উঠে বসলেন। সে গিয়ে মায়ের খাটের পাশে বসল। মা ছেলের মুখের দিকে তাকালেন, তাকিয়ে আছেন, গভীর ভাবে তাকিয়ে আছেন, অপলক তাকিয়ে আছেন। তারপর ছেলের দিকে ঝুকে পরে একেবারে নিঃস্ব সর্বহারার মত, ‘তোর কি হইছে’ বলে সহসা এগিয়ে এসে নাকে মুখে হাত বুলিয়ে কেঁদে উঠলেন, ‘তোর এ অবস্থা কেন, চোখ গর্তে পরে গেছে, মুখে এক ফোটা গোশত নাই, ‘হায়রে আমার কপাল, আজ বউয়ের জন্য আমার ছেলেটা মরতে বসেছে’। হঠাৎ তিনি বিলাপ শুরু করে দিলেন। তারপর শক্ত কণ্ঠে বললেন, ‘না না, অনেক হয়েছে আর না। আমি আর কারো কথা শুনব না। আমি নিজে গিয়ে বউকে হাতে ধরতে হয়, পায়ে ধরতে হয় আমিই নিয়ে আসব। আমি তোদের আর কোন মানা শুনব না। আর এখন থেকে তুই বাড়িতে থাকবি, চাকরি অনেক হয়েছে আর দরকার নাই। জীবন না বাঁচলে চাকরি কিসের।
হাসান ভীষণ লজ্বিত হয়ে গেল। মনে মনে ভাবছে এই শরীর নিয়ে বাড়িতে এসে তো আরেক ফ্যাসাদ হয়ে গেল, না আসাটাই ভাল ছিল। মায়ের সামনে বসে থাকতে অস্বস্তি লাগছে, হঠাৎ দাঁড়িয়ে ‘আপনে হুদাই আবুল তাবুল বকতাছেন। কি হইছে আমার, দেখেন তো’ বলে মুচকি হেসে হাত দু’টি উপরে তুলে ঝাকি দিয়ে ‘আমার শক্তি কমে গেছে নাকি? একাই একটা গরু মাটিতে ফেলে একাই জবাই করতে পারব’। মা গম্ভীর সুরে বললেন, ‘তুই ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করস না, স্বাস্থ্য এত খারাপ হল কেন? হাসান হেসে উত্তর দিল, ‘আপনে সারাটা জীবন খালি স্বাস্থ্য স্বাস্থ্য করলেন। স্বাস্থ্য কি সব সময় এক রকম থাকে নাকি, কখনো বাড়ে কখনো কমে। নিজে রানা বান্না পারি না, খাওয়া দাওয়ার কিছুটা সমস্যা, স্বাস্থ্য তো একটু আধটু কমতেই পারে। এটা কোন ব্যাপার হল, আবার ঠিক হয়ে যাবে।
মা বললেন, ‘তুই আর জামালপুর যেতে পারবি না, এখন থেকে বাড়িতে থাকবি। হাসান হেসে, ‘আচ্ছা যান’ বলে জামা খুলতে চাইল কিন্তু মনে পরল মুখের অবস্থা দেখেই মায়ের যে হালত জামা খুললে বুক আর পাজরের হাড় দেখলে তো আর রক্ষে নেই, মাটিতে পরে বিলাপ শুরু করে দিবেন। কাজেই জামা খোলার সাহস পেল না। মায়ের টেবিলের উপর প্লেটে কয়েকটা সিদলের পিঠা দেখা যায়। পুটি মাছ বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হয়, এটাকে সিদল বা চ্যাপা শুটকি বলে। গ্রামাঞ্চলে এর ভর্তার কদর আছে। এই ভর্তা ভিতরে দিয়ে পুরির মত পিঠা বানানো হয়, যেমনি ঝাল তেমনি সুস্বাদু। হাসান দুইটা পিঠা খেয়ে নিজের রুমে চলে গেল। জামা খুলল কিন্তু গেঞ্জি খোলার সাহস পেল না। অন্যেরা শরীরের ছিরি দেখলে লজ্বায় পরতে হবে। কখনো খালি গা হওয়া যাবে না।
পুর্বমুখী বাড়ির উত্তর পাশে একটি টিনের ঘর। তাতে হাসানের দ্বিতীয় ভাই বউ নিয়ে থাকে। পুর্ব পাশে উত্তর দক্ষিণা পঁয়তাল্লিশ হাত লম্বা হাফ বিল্ডিং, এর মাঝের রুমে মা থাকেন আর দু’পাশে অন্যান্য ছেলেরা থাকে। হাসান বাড়িতে গেলে মায়ের রুমে মাটিতে চাটাই ফেলে মা ছেলে একসাথে খেতে বসে। রাতে তারা খেতে বসল। হাসানের পাতে বড় বড় আস্ত দুইটা মাগুর মাছ ভাজি, সামনে বিভিন্ন তরকারির কয়েকটা বাটি সাজানো। মা বললেন, ‘নে, সবগুলি খা। হাসান জানে সে বাড়িতে গেলে মা তার জন্য অতিরিক্ত মাছ গোশতের ব্যবস্থা করেন। তখন মাছ গোশত একটু বেশি খেতে হয়। প্রতি লোকমায় অর্ধেক মাছ, অর্ধেক ভাত, সেভাবেই চালাল। তারপর তিনি বললেন, ‘শুন আমাকে আর না করিস না, এ তারিখে আমি তোর সাথে যাব, আমি গিয়ে বউকে নিয়ে আসব। হাসান মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হুঃ আপনে যাবেন, কোথায় যাবেন, ওরা মানুষ নাকি? এরা তো সব হিংস্র জানোয়ার। মানুষ হলে না হয় যেতেন কিন্তু জানোয়ারের কাছে মানুষ যেতে পারে না, অপমান করবে। ওরা আপনাকে কোন মূল্যায়নই করবে না।
মাগুর খেয়ে হাসানের প্রায় পেট ভরে গেছে, এবার আধা বাটি চিকরা মাছের ভুনা মা তার পাতে ঢেলে দিলেন। আহ, এই একখান তরকারি। বিশেষ করে পিঁয়াজের মৌসুমে পিঁয়াজের পাতা দিয়ে চিকরা (ছোট বাইন জাতীয় মাছ) ভোনা দিয়ে খেতে বসলে ঘাড়ে কিলালেও খোজ পাওয়া যায় না। মা তিরস্কারের স্বরে বললেন, ‘মূল্যায়নের দরকার কি, আমিতো কারো সম্মান পাওয়ার জন্য যাচ্ছি না। আমি গিয়ে বউয়ের হাত ধরব, তখন আর না এসে পারবে না। ‘বাঃ আপনের আন্দাজ তো ভালই’ সে বলল, যে বউ বিনা কারণে শাশুড়ির চুলে ধরে কোমরে কয়েকটা লাগিয়ে দেয়ার মত জঘন্য কথা বলতে পারে তার হাত ধরলেই এসে পরবে না? যত সহজ মনে করছেন তত সহজ নয়। ওরা আপনাকে অপমান করে তাড়াবে’। এই তুই আর কথা কইস না, মা ঝাঝিয়ে উঠলেন। তুই এভাবে তিলে তিলে মরবি আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখব। এ তারিখে আমি আর কারো কথা শুনবনা, যাবই। এতটা দিন হয়ে গেল তোদের কথা না শুনে যদি আগেই যেতাম তাহলে আজ তোর শরীরের এই অবস্থা হত না’ বলে তিনি ছেলের পাতে কার্প মাছের ভুনা দিতে চাইলেন।
হাসান বলল, ‘না না, আর খেতে পারব না’ বলে প্লেটের উপর হাত পেতে আড়াল করল। কিন্তু মা বড় বড় কয়েকটা টুকরা দিয়ে বললেন, ‘এই চড়ুই পাখির আধার খাস বলেই তো শরীরের এই অবস্থা, নে এই সবগুলি খেতে হবে’। অগত্যা হাসান শুধু মাছ খাওয়া শুরু করল এবং মাকে শান্তনা দেয়ার জন্য বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে একটা আলোচনা চলছে, এ তারিখে যদি না আনতে পারি তাহলে আপনের চেষ্টা আপনে করবেন, আমি আর না করব না’। মা বললেন, ‘তোর এসব ছেলে ভোলানো কথা অনেকদিন ধরে শুনছি আর শুনব না’ বলে তিনি ছেলের পাতে এক বাটি মাগুর মাছের ঝুল ঢেলে দিলেন। হাসান পেটটা টানা দিয়ে, ‘ওরে বাঃ আমি আক্ষেম, আই আর পাত্যান নো’। মা হাসলেন, ‘পাত্যান নো কইলে হবে, বেশি বেশি না খাইলে স্বাস্থ্য ঠিক হবে না।
বস্তুত আগে থেকেই মায়ের অভ্যাস হল একটা তরকারি দিয়ে বলবেন না যে আরো কিছু আছে কিনা। এটা শেষ হলে দিবেন আরেকটা কিন্তু বলবেন না যে আরো আছে কিনা। তারপর দিবেন আরেকটা। আগে থেকেই তিনি এ কৌশল অবলম্বন করেন ছেলেদেরকে বেশি করে খাওয়ানোর জন্য। তারপর দিলেন মুরগির গোশত। হাসান দু’তিন টুকরা মুখে পোরে বাকিটা মায়ের পাতে উঠিয়ে দিয়ে স্বগতোক্তি করল, ‘আল হামদুলিল্লাহ, আল্লাহর রহমতে আমরা যে মাছ খাই, শহরে সিন্দুকের সিন্দুক টাকা ওয়ালারা এই মাছ কল্পনাও করতে পারেনা। টাটকা মাছ, পাতিলে দেয়ার সময়ও লাফালাফি করতে থাকে, এই স্বাদ ওরা পাবে কোথায়। খেতে চাও গ্রামে যাও, তবে সম্পদ থাকতে হবে। ভোগ বিলাস চাও শহরে যাও, তবে টাকা থাকতে হবে’। সে মাকে বলল, ‘আচ্ছা আমাকে একমাস সময় দেন, এর মধ্যে যদি না আনতে পারি তখন আপনে যাবেন। মা কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে থেকে বললেন, ‘আচ্ছা যা, পনের দিন সময় দিলাম। হাসান আর কথা না বাড়িয়ে খাওয়া শেষ করল।
খেয়ে উঠে তো বেচারা পেট নিয়ে নড়তে পারেনা, হাতে ভর করে উঠে টানা মেরে দাঁড়াল। বহুদিন ধরে পাকস্থলি খালি পরে আছে। হঠাৎ বেশি খাওয়ায় পেট ব্যথা করছে, অস্বস্তি লাগছে, পেটটা ফুটবলের মত টান টান হয়ে আছে। সে অবাক হল, ‘আজ তো খাওয়ার সময় বমি এল না। রহস্যটা বুঝতে পারল মায়ের সান্নিধ্য এবং ভাল তরকারি। পেটটা সাইজ করার জন্য বাইরে ঘোরাফিরা করল, একটু পেশাব করল তবুও স্বস্তি হচ্ছে না। অগত্যা ঘরে এসে একটু আদা লবণ খেয়ে আবার বাইরে চলে গেল। রাত বারটার পর এসে তাহাজ্জুদ পড়ে শুয়ে পড়ল কিন্তু ঘুম হলনা।
হাসানের নানার দুই সন্তান, তার মা এবং এক মামা। তার মা মোটা দাগের পৈত্রিক সম্পত্তি পেয়েছিল। হাসানের বাবাও এই সম্পদ সংসারে ব্যয় না করে আলাদা হিসাব রেখে বছর বছর জমি কিনে স্ত্রীর নামে দিতেন। আলেম হিসাবে তিনি ইনসাফপুর্ণ দায়িত্ব পালন করে গেছেন। এভাবে তিনি অনেক ভুসম্পত্তির মালিক হয়ে যান। কাজেই তার উপর হজ্ব ফরয ছিল। সকালে খেতে বসে মা বললেন, ‘দেখ আমার বয়স হয়ে যাচ্ছে কখন কি হয় না হয় বলা যায় না, আমি নিয়ত করেছি আগামী বছর তোকে নিয়ে হজ্বে যাব, এখন থেকে তুই প্রস্তুতি নে। হাসান নতুন খুশির সংবাদ শুনে প্রফুল্ল মুখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মাশাল্লাহ, আল্লাহ্ কবুল করুক। আপনি তো এমনিতেই জমিদার মানুষ- বহু আগেই আপনের উপর হজ্ব ফরয হয়েছে। হ্যাঁ আমি রাজি, আপনার উসিলায় আল্লাহ্র ঘর আর রাসূলের রওজা মোবারক যিয়ারতের ভাগ্যটা আমার খুলে গেল। কিন্তু আপনে যাবেন কেমনে, আপনে তো গাড়ি ঘোড়ায় চরলেই মাথা ঘোড়ায়, বমি হয়, আধমরা হয়ে যান। মনে আছে একবার জামালপুর গিয়ে আপনার কি অবস্থা হয়েছিল? মা বললেন, ‘বাঁচি আর মরি, আগামীতে যাবই, যা করার আল্লাহই করবে, মক্কায় গিয়ে মরতে পারলে তো আমার নসিব।
খাওয়া দাওয়ার পর মা বললেন, ‘যা কাজ কর গিয়ে, কাজ করলে ঠিকমত খেতেও পারবি, ঘুমও হবে। মাড়াই কলে গিয়ে ধান মাড়াই কর’। সেই আদি প্রস্তর যুগের পর থেকে দুই হাজার শতক পর্যন্ত অন্তত ময়মনসিংহ অঞ্চলের কৃষি ব্যবস্থা ছিল প্রায় একই পর্যায়ের। আদিম প্রথা অনুযায়ী লাঙ্গলে জমি চাষ করা, গরু দিয়ে ধান মাড়াই করা, হাতে ঝেড়ে ধান পরিস্কার করাই ছিল কৃষি কাজের সাধারণ পদ্ধতি। এভাবে কঠোর পরিশ্রম করে, হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে কৃষকরা সোনার ফসল ঘরে তুলত। কিন্তু দুই হাজারের পর বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আবিষ্কার- উদ্ভাবনের বদৌলতে কৃষি ব্যবস্থা হয়ে উঠে সহজ, আরামদায়ক, আনন্দপ্রদ এবং উপভোগ্য। বৈশাখের শেষ, গ্রামে বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। হাসান ধান মাড়াই করতে গেল।
ইস্পাতের চারটি খুটির উপর ঢাকনি দেয়া মাথা সমান উচু আড়াআড়ি একটা লোহার খাচা। খাচার মধ্য অনেকগুলি পাত বসানো, প্রত্যেক পাতে আধাফুট লম্বা পাঁচটি করে লোহার কাঠি লাগানো। স্যালু মেশিনের সাথে ফিতা লাগিয়ে খাচাটি ঘোরানো হয়, এক পাশ দিয়ে ধানের আটি ঢোকানোর ফাকা আছে। তারপর সেই লোহার কাঠির আঘাতে খড় থেকে ধান আলাদা হয়ে লম্বা চুঙ্গি দিয়ে খড় অনেক দুরে নিক্ষিপ্ত হয়, আর ধান নীচে পড়তে থাকে। নীচে আবার পাখা লাগানো আছে, পাখার বাতাস ধান থেকে সিটা আলাদা করে দেয়। বাঃ কী চমৎকার কৌশল। অথচ আগে উঠানে একটা খুটি গেড়ে তার সাথে সাত আটটা গরু জুড়ে দিয়ে একজন হিরি হিরি ঢিরি ঢিরি করে খুটির চারপাশে গরুগুলি ঘুরাত, আরেকজন ধানের আটি ভেঙ্গে ছড়িয়ে দিত, গরুর খুরের আঘাতে ও চাপে খড় থেকে ধান আলাদা হত। তারপর খড় থেকে ঝেড়ে ঝেড়ে ধান পৃথক করা হত। এখন মেশিনই সব কাজ করে দিচ্ছে।
একজন কামলা ধানের আটি এনে ভাজ করে দিচ্ছে আর হাসান সেগুলি ফাকা দিয়ে মেশিনের খাচায় ঢুকাচ্ছে। এভাবে কিছুক্ষণ ধান মাড়াই করল কিন্তু খুব শীঘ্রই বুঝতে পারল সে কতটা দুর্বল হয়েছে, কতটা স্বাস্থ্যহানি হয়েছে। হাতে আর শক্তি পাচ্ছেনা, শরীর কাঁপছে। কামলার হাতে ছেড়ে দিয়ে সে বারান্দায় গিয়ে একটা চেয়ারে বসল। শরীর এমন ভারি মনে হচ্ছে যেন চেয়ার ভেঙ্গে পড়ে যাবে। বিশাল উঠান শুদ্ধু ধান রোদে দেয়া হয়েছে, সে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে একটা ছাতা মাথায় দিয়ে ধান নাড়তে গেল। দুই পা দু’দিকে ছড়িয়ে ধানের উপর হেঁচড়ে হেঁচড়ে হেটে যাওয়া- এটাই ধান নাড়া। তাতে উপরের শুকনা ধান নীচে পড়ে যায় আর নিচের ভিজা ধান উপড়ে উঠে আসে, এভাবেই ধান শুকানোর কাজ চলে।
শুকানোর কাজ শেষ হলে শুরু হয় ধান পরিস্কার করার কাজ, এটাকে তাদের এলাকায় বলে ধান উড়ানো। আগে এ ধান দুভাবে পরিস্কার করা হত। একটা প্রাকৃতিক নিয়ম অন্যটা কৃত্রিম উপায়। যারা ছোট কৃষক ধান কম সাধারণত তাদের মহিলারা প্রবল বাতাসের সময় কোলায় ধান নিয়ে মাথা বরাবর উচুতে তুলে ধরে ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে কোলার ধান মাটিতে ফেলত। তখন বাতাসে ধান থেকে সিটা আলাদা হয়ে যেত। এটা প্রাকৃতিক নিয়ম। আর কৃত্রিম পদ্ধতি হল লাশ বাও। লাশ মানে যা লম্বালম্বি ভাবে মাটিতে পরে থাকে, আর বাও মানে বাতাস। অর্থাৎ লাশকে বাতাস দেয়া। যারা বড় কৃষক ধান বেশি তারা এ পদ্ধতি অবলম্বন করত। এক্ষেত্রে দুইজন মানুষের দরকার হত। একজন কোলায় ধান ভরে সোজা করে দশ পনের হাত লম্বায় ছেড়ে ছেড়ে যেত। অন্যজন ডান হাতে একটি কোলা ধরে, মাথার উপড়ে তুলে, বাম হাত কোলার পিছনে রেখে বিশেষ কৌশলে ঘুরিয়ে এনে কোলায় কৃত্রিম বাতাস সৃষ্টি করে ধানের উপর ফেলত। সেই বাতাসে ধান থেকে কোড়া সিটা আলাদা হয়ে যেত। এভাবে একজন ধান ছাড়তে থাকে অন্যজন কৃত্রিম বাতাস দিতে থাকে। এভাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই দশ পনের হাত লম্বা সোজা একটা লাশের মত ধানের স্তূপ হয়ে যায়, এটাকেই লাশ বাও বলে। এটা খুব কষ্ট সাধ্য কাজ। যে বাও দেয় তার হাতের খবর হয়ে যায়।
কিন্তু এখন যুগের পরিবর্তন হয়েছে, কষ্ট সাধ্য কাজগুলি মেশিন করে দিচ্ছে। জমি চাষের ট্রাক্টরের মেশিনে একটা বড় চাকা থাকে। ইস্পাতের পাত দিয়ে সিলিং ফ্যানের মত তিন হাতা বিশিষ্ট একটা পাখা বানিয়ে তা নাট লাগিয়ে মেশিনের চাকায় আটকাতে হয়। তারপর মেশিন ছাড়লেই চাকায় লাগানো পাখার ঘুর্ননে প্রবল বাতাস সৃষ্টি হয়, মোটামোটি ঝড়ের মত বাতাস। তখন কয়েকজন লোকের প্রয়োজন হয়। পাখার সামনে দু’জন দাঁড়িয়ে ধান ছাড়তে থাকে, আরো চারজন পায়লা বা কোন পাত্র ভরে ভরে এ দু’জনের হাতে তুলে দিতে থাকে। পাখার বাতাস কোড়া সিটা পনের বিশ হাত দুরে নিয়ে ফেলে আর ধূলা দু তিনশ হাত দুরে উড়িয়ে নিয়ে যায়। ধান এ পদ্ধতিতে সবচেয়ে বেশি পরিস্কার হয়। এভাবে প্রতি মিনিটে একমন করে ধান উড়ানো সম্ভব। তবে ধনীরাই সর্বক্ষেত্রে সুবিধা ভোগ করে। যারা দরিদ্র কৃষক- মেশিন নাই, তারা এ সুবিধা পায় না।
ধান কাটার ধুম পড়ে গেছে, কর্ম মুখর হয়ে উঠেছে গ্রামীণ পরিবেশ। হাসান নিজের ইচ্ছা ও সামর্থ অনুযায়ী কখনো মাড়াই কলে ধান মাড়াই করে, কখনো ছাতা মাথায় উঠানে ধান নাড়ে। তারপর বিকালে শুরু হয় ধান উড়ানোর কাজ। পুর্ণ শুকনা ধান উড়িয়ে অর্থাৎ পরিস্কার করে গোলায় তোলা হয়। আর আধা শুকনা বা কিছুটা ভিজা ধান পরিস্কার করে বিক্রি দেয়া হয়। কারণ ধান বিক্রি করে কামলার মজুরি দিতে হয়, আবার প্রত্যেকেরই দোকান বাকী থাকে, ধান কাটার মৌসুমে দোকানদাররা হালখাতা করে। তখন কৃষকরা ধান বিক্রি করে বাকী লেনদেন পরিশোধ করে। তাছাড়া বড় বড় কৃষকরা যে পরিমাণ ধান পায় সব ধান ঘরে রাখার মত জায়গা কারো নেই। এজন্যই তারা প্রয়োজন মত ধান বিক্রি করে দেয়, বাকী ধান উচ্চ মুল্যের আশায় গোলাজাত করে রাখে। হাসানের বাবা ছিলেন দেওবন্দি আলেম। কওমী মাদরাসার শিক্ষক, সরকারি চাকুরে নয়। এজন্য তাদের পরিবার আগে থেকেই ছিল কৃষি নির্ভর। বিশেষত তার বাবা মারা যাওয়ার পর কৃষিই হয়ে উঠে পরিবারটির একমাত্র জীবন জীবিকার উৎস। ধান কাটার মৌসুমে ভাইয়েরা সবাই বাড়িতে থেকে ধান সামলানোর কাজ করে। হাসান ভাই ও কামলাদের দিয়ে সব কাজ করায়, নিজেও কিছু কিছু করে।
মা আর সময় দিতে চাচ্ছেন না, প্রতি বার খেতে বসে ছেলেকে তোষামোদ করেন, ‘আমি যাই, আমি না গেলে বউ আসবে না। হাসান নিবৃত্ত করে, ‘আমি যদি জানতাম যে আপনাকে তারা অপমান করবে না, গেলেই আপনার সাথে বউ এসে যাবে তাহলে বাধা দিতাম না’। আমাকে কয়েক মাসেক সময় দেন, যদি আমি না আনতে পারি তারপর আপনি গিয়ে শেষ চেষ্টা করে আসবেন। বস্তুত এখানেই হাসান ও ফেরদৌসিদের পারিবারিক পার্থক্য। তার পরিবারের সবাই জানে ত্রিমুখি শিক্ষাধারায় সুশিক্ষিত স্বশিক্ষিত ও উচ্চ শিক্ষিত হাসানের বিয়ে হয়েছে অতীব নিম্নমানের । ফেরদৌসি সুন্দরী নয়, নাক বুচা, তিনবারে এস এস সি পাস, হত দরিদ্র নিঃস্ব পরিবারের মেয়ে। সে কোন এঙ্গেলেই হাসানের যোগ্য নয়। এতদসত্ত্বেও বিয়ে হয়ে গেছে, বাচ্চা হয়ে গেছে, এখন বউ কুৎসিত কদাকার বদকার, পাগল ছাগল যাই হউক না কেন অন্য কোন চিন্তা করা যাবে না, এ বউ নিয়েই জীবন কাটাতে হবে। এটাই তাদের পারিবারিক শিক্ষা ও নৈতিক আদর্শ।
পক্ষান্তরে ফেরদৌসিদের পারিবারিক শিক্ষা হল, জামাই যতই গুনবান ধনবান, নেককার পুন্যাত্না মহাত্মা হউক না কেন সে যদি শ্বশুর পরিবারের প্রতি অনুগত না হয়, তাদের আদর্শের অনুগামী না হয় তাহলে বাচ্চা একটা না একশটা হলেও অবলীলায় বিয়ে ভেঙ্গে দিবে। এমনকি আরো উন্নত, আরো ভাল জামাই পাওয়া গেলে তারা অন্যত্র বিয়ে দিতে দ্বিতীয়বার ভাববে না। এটাই হল ফেরদৌসিদের পারিবারিক বৈশিষ্ট। ২০০৬ সাল। তখনো গ্রামাঞ্চলে মোবাইল তেমন পৌঁছেনি। বাজারের ব্যবসায়িক মোবাইল ভরসা। মা বললেন, ‘তোর চিন্তায় আমি অস্থির থাকি, কোন খোজ খবর পাই না, ছেলেদেরকে বারবার বলতেছি আমাকে একটা মোবাইল কিনে দিতে কিন্তু তারা দিচ্ছে না, তুই একটা মোবাইল কিনে দে। হাসান ভাবল, ‘খাইছে আমারে, মোবাইল দিলে তো, ‘কী খাইছস, কী করছস, ক্য় তরকারি দিয়ে খাইলি, ডিম কয়টা দুধ কতটুকু খাইলি, কয় ঘণ্টা ঘুমাইছস’ সারাক্ষণ আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখবে। বলল, ‘মোবাইলের যে খরচ- পাঁচ টাকা কলরেট, কিছুদিন পর দেব নে। মা বাধা দিয়ে বললেন, ‘কিছুদিন পর না, কয়েক দিনের মধ্যে কিনে দিবে। হাসান এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বলল, ‘আচ্ছা দেখি কী করা যায়।
মা প্রতিবার খাওয়ার সময়, ঠিকমত নামায পড়া, তাবলীগে যাওয়া, তাহাজ্জুদ পড়া, খতম পড়া ইত্যাদি উপদেশ দিতে কখনো ভুলতেন না। বিদায়ের দিন আবার এসব উপদেশ বারবার স্বরণ করিয়ে দিলেন। একটা মোবাইল কিনে দেয়া ও ঠিকমত খাওয়া দাওয়ার কথা তাকীদ দিলেন। হাসান মাকে দোয়া ইউনুস পড়ার অনুরোধ জানিয়ে সালাম দিয়ে বিদায় নিল। পাঁচদিন বাড়িতে থেকে তার খাওয়া দাওয়াটা প্রায় ঠিক হয়ে এসেছিল। কিন্তু বাসায় পৌঁছে আবার একাকিত্বের বিষণ্ণতা তাকে গ্রাস করে নিল। এই নিঃসঙ্গতা থেকে বাঁচার জন্য সে জামাতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু জামাতের গদবাধা আলোচনা তার ভাল লাগেনা। তাই পরিচিতদের মধ্যে গাশত করে ও কিছু ছাত্র নিয়ে জামাত গঠন করে তিনদিনের জন্য চলে গেল।
ইসলামের মৌলিক যেসব বিষয় চাপা পড়ে গেছে- ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা, অর্থ ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার, নারী অধিকার ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সে জামাতে আলোচনা করে, কোরআন হাদীস ও তাফসীরের আলোকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে। মানুষ তন্ময় হয়ে শুনে, তাদের কাছে ভাল লাগে। সে বুঝায় দরিদ্র জনগোস্টির অধিকার আদায়ে ইসলাম তিনটি অর্থ ব্যবস্থা দিয়েছে। প্রথম হল যাকাত, কিন্তু এতে প্রয়োজন না মিটলে ইনফাক, অর্থাৎ বিত্তশালীদের কাছ থেকে রাষ্ট্র আরো অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে দরিদ্র জনগোস্টির প্রয়োজন পূরণ করবে, তাতেও যদি প্রয়োজন না মিটে তাহলে ইসলামী সমাজতন্ত্র অর্থাৎ সম্পদ কেউ জমা করতে পারবে না, সকল নাগরিকের মাঝে সমবন্টন করা হবে। এভাবে সে বুঝায় মানুষ উৎসাহিত হয়।
পরের সপ্তাহে আবার তিন দিনের জামাত নিয়ে গেল। দশটায় মাদরাসায় আসে, ছুটি হলে আবার জামাতে গিয়ে হাজির হয়। আলোচনা করে, ফিরকাবাজি হারাম। এই ফিরকাবাজির কারণেই আজ ইসলাম ও উম্মাহ ধ্বংস হচ্ছে- কোরআন হাদীসের আলোকে এ সম্পর্কে সে বিষদ আলোচনা করে। এভাবে পরপর চার সপ্তাহ জামাতে গেল কিন্তু পঞ্চম সপ্তাহে আর জামাত গঠন করতে পারল না তারও যাওয়া হল না। অগত্যা বাসায় বসে থাকল।
আবার আগের অবস্থা দেখা দিল। নাওয়া খাওয়া হয়ে পরল অনিয়মিত। কোনদিন হোটেলে দুয়েকটা রুটি খেয়ে দিন চলে যায়, কোনদিন বাসায় চারটে ভাত ফুটিয়ে ডিম ভাজি করে দুয়েক লোকমা খায়। কোন দিন একবেলা, কোন দিন দু’বেলা খাওয়া হয়। আর খাওয়া বলতে দু’চার লোকমা, বেশি খেতে চাইলে বমি আসে। তাহাজ্জুদ পড়ে জায়নামাজে শুয়ে বসে কখনো দোয়া ইউনুস পড়ে, কখনো কোরআন শরীফ পড়ে, কখনো স্ত্রী সন্তান ফিরে পাওয়ার জন্য দোয়া করে। বউ বাচ্চার ছেড়া ময়লা কাপরের পুটলি মাথায় দিয়ে, কখনো জড়িয়ে ধরে ঘুমুতে চায় কিন্তু ঘুম আসে না।
বিষয়: সাহিত্য
১৩৯৬ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
বউয়ের জন্য সবকিছু বিসর্জন দিবে..
এটা কি ইসলামের শিক্ষা...
যে গেছে তার জন্য ধৈর্য আল্লাহর সাহায্য বাদ দিয়ে মজনু হতে হবে. এটা তো ইসলামের শিক্ষা নয়.এটাকে আমি ঈমানে্ও কমতি মনে করি....
মন্তব্য করতে লগইন করুন