চিঠি- ৪৬ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১০ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:৫৯:১৬ দুপুর

হাসান বাড়ি থেকে আসার পর একাকিত্বের নিঃসঙ্গতা তাকে গ্রাস করে নেয়। স্ত্রী সন্তানের স্মৃতিরা তাকে তাড়িয়ে ফিরে। মাদরাসা থেকে আসার পর চারটে ভাত ফোটায়। কোনদিন হোটেল থেকে তরকারি নিয়ে আসে, কোনদিন দু’তিনটা ডিম ভাজি করে। তারপর খেতে বসলেই স্ত্রী সন্তানের সাথে বসে খাওয়ার দৃশ্যগুলি তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে। তখন আর খেতে পারেনা, পানি দিয়ে ঢোক গিলে দু’চার লোকমা খায়। তারপর রাতে কোনদিন এই বাসী ভাত তরকারি খায় কোন দিন না খেয়ে থাকে। সকালে কোনদিন দু’চারটা বিস্কুট খায়, কোনদিন হোটেলে রুটি খেয়ে মাদরাসায় চলে যায়। তারপর বিকালে বন্ধু বান্ধবদের আসরে চলে যায়। সেখানে ধর্ম, দেশ, জাতি, রাষ্ট্র নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হয়। কিন্তু এসব কিছুই তার ভাল লাগেনা, বেরিয়ে গিয়ে বাইরে ঘোরাফিরা করে। অনেক সময় মানুষের কোলাহল তার ভাল লাগে না

নির্জনতা প্রিয় হয়ে উঠে। তখন কখনো চলে যায় শহরের পুর্ব পাশ দিয়ে প্রবাহিত ব্রক্ষ্মপুত্রের তীরে। কখনো বা পশ্চিম পাশ দিয়ে প্রবাহিত খালের পাড়ে, সেখানে ঘোরাফিরা করে বা গাছ তলায় বসে গৌতম বুদ্ধের মত স্ত্রী সন্তানের ধ্যান করে, গভীর রাত্রে বাসায় ফিরে। তারপর কোন দিন খেয়ে কোনদিন না খেয়ে তাহাজ্জুদে বসে, তারপর জায়নামাযে শুয়ে বসে দীর্ঘক্ষন পর্যন্ত দোয়া ইউনুস পড়ে। তারপর স্ত্রী সন্তানকে ফিরে পাওয়ার আশায়, আল্লাহ্‌র তরফ থেকে উত্তম ফয়সালার জন্য দীর্ঘ দোয়া করে। তারপর ঘুমুতে যায়। স্ত্রী সন্তানের পুরাতন কাপড়ের পুটলি দু’টি কখনো শিয়রে দিয়ে- শিতান দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে, কখনো সন্তানের জুতা বুকে চেপে ধরে, কখনো কাত হয়ে পুটলি দু’টি জড়িয়ে ধরে ঘুমুতে চায় কিন্তু ঘুম আসে না। পুটলি দু’টিতে ঘুমের উপযোগিতা তখন ফিকে হয়ে আসছে। শুধু স্ত্রী সন্তানের চেহারা তার চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়।

ইঞ্জনিয়ারের বাসায় সেই বিদায় বেলায় স্ত্রীর ঐ করুণ চাহনি অনুক্ষণ তার কলিজায় সুচের মত বিধতে থাকত। তখন ঘুম উড়ে যেত দূরে, বহুদুরে। ফযরের পর হয়ত কোনদিন কিছুটা ঘুম হত কোনদিন হত না। ফলে ধীরে ধীরে আবার তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পরতে লাগল, সাথে সাথে তার ভিতরটাও ক্ষয়ে যেতে লাগল। এভাবে এক হতভাগ্য যুবক ক্রমে ক্রমে এগিয়ে যাচ্ছিল তার ললাট নির্ধারিত পরিণতির দিকে, যে মানুষের পৃথিবীতে এসেছিল মানুষ হয়ে কিন্তু মানুষের অধিকার সে কোন দিন পায়নি।

মার্চ, ২০০৬ সাল। হাসান তাহাজ্জুদের পর জায়নামাযে শুয়ে শুয়ে তাসবীহ জপছে। তার কিছুটা তন্দ্রা ভাব এসে গেছে। সহসা সে স্বপ্ন দেখল অথবা মনে হল দরজায় টোকা পড়েছে, লাফিয়ে উঠে দৌড়ে দরজা খুলতে গেল। তার বিশ্বাস, তার স্ত্রী এসে গেছে। দরজা খুলল, বাইরে শেষ রাত্রির ছুনছান নীরবতা, হতাশা আর নৈরাশ্যের এক রাশ দমকা হাওয়া হু হু করে ঘরে ঢুকে, এক অব্যক্ত বেদনায় তার হৃদয়টা হাহাকার করে উঠে। দেহের প্রতিটা জোড়া যেন খসে গেছে, শরীরটা অবশ হয়ে আসে। পাশেই রাখা বিছানায় সে শুয়ে পরে। বাকী রাত সে অপলক নেত্রে খোলা দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। এ পথ ধরে আসবে, আসবে একজন বোরকা ওয়ালী, দীর্ঘদেহী, যার কোলে একটা বাচ্চা।

একদিন মাদরাসায় ক্লাস নিচ্ছে, হঠাৎ মনে হল তার স্ত্রী সন্তান এসে বন্ধ দরজার সামনে অপেক্ষা করছে। সে তাড়াতাড়ি ক্লাস শেষ করে উর্ধ্বশ্বাসে বাসায় ছুটল। কিন্তু পৌঁছে হতাশার শুন্যতায় তার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কাছেই একজন মহিলাকে পেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আপা এখানে একজন বোরকা ওয়ালী দেখেছেন, দীর্ঘদেহী, কোলে বাচ্চা। না দেখে নাই। এরপর থেকে সে যেখানেই যেত তার তৃষ্ণার্থ দু’টি চোখ শুধু খুঁজে ফিরত, একটা বোরকা ওয়ালী, দীর্ঘদেহী, কোলে একটা বাচ্চা। যখনই বাসায় ফিরত, কাউকে সামনে পেলেই জিজ্ঞেস করত, ‘ভাই বা আপা, একজন বোরকাওয়ালী দেখেছেন, লম্বাটে, কোলে একটা বাচ্চা। এক সময় মনে হল তার স্ত্রী খুলনা বা ঢাকা থেকে ট্রেনে আসবে, ষ্টেশনে গেলেই তাকে পাওয়া যাবে। তখন থেকে সে প্রতি দিন সন্ধ্যার পর থেকে রাত প্রায় একটা দুইটা পর্যন্ত ষ্টেশনে গিয়ে বসে থাকে, প্রতিটা ট্রেন এলেই সে গেইটে দাঁড়িয়ে অন্তহীন পেরেশানি নিয়ে লক্ষ করে- একজন বোরকাওয়ালী, দীর্ঘদেহী, কোলে একটা বাচ্চা।

যাওয়া আসার সময় সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রিকশা বা গাড়িতে তাকিয়ে থাকে। কোথাও বাচ্চা কোলে বোরকাওয়ালী কোন মহিলা দেখলেই তার মনটা ছ্যাত করে উঠে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে পর্যবেক্ষন করে, মহিলার চারপাশে ঘুরে তার স্ত্রী সন্তানকে শনাক্ত করার চেষ্টা করে। আর প্রতিবারই হতাশায় তার মন ডুকরে কেঁদে উঠে। একদিন ষ্টেশন থেকে ফিরে নামাযের পর জায়নামাযে বসে চিন্তা করল, এভাবে তো খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। সে কোথায় আছে, খুলনায় নাকি ঢাকায়। যেভাবেই হউক তার ঠিকানাটা সংগ্রহ করতে হবে, ঠিকানা না পেলেও অন্তত মোবাইল নাম্বারটা যেভাবেই হউক নিতে হবে। ঠিকানা পেলেই সে গিয়ে তার বউকে নিয়ে আসবে, তখন পৃথিবীর কোন শক্তি তাকে আটকাতে পারবে না। এটাই সহজ পদ্ধতি বলে মনে হল। কিন্তু বিষয়টা কঠিন। কারণ এদের ভিতরের কথা অন্যেরা জানতে পারে না।

কিন্তু না, তার সেই চিন্তা নেই। কারণ সেখানে তার একটা মজবুত খুটি আছে। সে গিয়ে কিছু বলুক আর না বলুক, আগেই দারদা তার হাতের আঙ্গুল ধরে নাচতে থাকবে আর বলতে থাকবে, তার খালামনি কোথায় আছে, কি করছে, তার কথা কি কি বদনাম বলছে, মুনিরা কি করছে, সব কিছুই গলগল করে বলতে থাকবে। পাট গুদাম মোড় থেকে পঞ্চাশ হাত উত্তরে গিয়ে ডান পাশে একটা ফাঁকা মাঠ, এখানে বাচ্চারা খেলাধুলা করে। মাঠের পুর্ব পাশেই ইঞ্জিনিয়ারের বাসা। হাসান বিকালে গিয়ে মোড়ের সামনে একটি চা স্টলে বসে থাকল, তারপর মাঠে গিয়ে খেলারত ছেলেদের মধ্যে খুজল কিন্তু দারদার কোন হদিস নাই। ঘন্টা খানেক সে মোড়ে ও খেলার মাঠে দৃষ্টি রেখে বসে রইল কিন্তু দারদাকে পেল না।

অবশেষে উঠে গিয়ে খেলার মাঠে একটা ছেলেকে জিজ্ঞেস করল, ‘দারদাকে দেখেছ?’ ছেলেটা বলল, ‘দারদার অসুখ। তারপর একটা তরুন ছেলেকে জিজ্ঞেস করলে সে বলল, ‘দারদার পায়ে অপারেশন হয়েছে। কথাটা শুনে হাসান চমকে উঠল, সঠিক সংবাদটা পাওয়ার জন্য সে দাঁড়িয়ে আছে। ইঞ্জিনিয়ারের পাশের বাসার একজন পরিচিত মুরুব্বি আসছে দেখে সে এগিয়ে গেল, সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘দারদার কোন খবর রাখেন? ‘আহ আর বলেন না যে, এইটুকু একটা ছেলে পায়ে দুইবার অপারেশন হইছে। এখন ঢাকায় কোন হাসপাতালে ভর্তি আছে, ডাক্তার নাকি বলেছে পা কেটে ফেলতে হবে’ বলে তিনি আফসোস করতে করতে চলে গেলেন। হাসান মৃদু আর্তনাদ করে দু’পা পিছিয়ে গেল, ‘না না, এটা হতে পারে না, এইটুকু একটা মাসুম বাচ্চার এত বড় শাস্তি হতে পারে না, তার কন্ঠ পর্যন্ত কান্না ফেনায়িত হয়ে উঠে। তারপর সে আরো কয়েক জনকে জিজ্ঞেস করল সবাই একই কথা বলল।

দুঃখে তার অন্তরটা ফেটে যাচ্ছে, ধীরে ধীরে হেটে গিয়ে মোড়ের চা স্টলে বসল। সে চিন্তা করছে একটা নিষ্পাপ বাচ্চার কেন এমন হল, আমার জন্য কি! ‘অভাগা যে দিকে চায় সাগর শুকিয়ে যায়’। ওদের মধ্যে একমাত্র এ ছেলেটাই ছিল আমার আপন জন। এজন্যই কি আমার দুর্ভাগ্য তাকেও স্পর্শ করল। না না, তা হবে কেন। বরং সম্ভাবনা তো এটাই বেশি যে, ইঞ্জিনিয়ার ও তার বউ- এই দুই পাপিস্টের পাপের মাসুল দিতে হচ্ছে আজ তাদের সন্তানকে। এই দুই পিশাচের পাপের শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে একটা মাসুম বাচ্চাকে। ওরা আমার স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, এতটা দিন ধরে আমার সন্তানকে আমার বুক থেকে আড়াল করে রেখেছে। এখন আল্লাহ এই পাপের শাস্তি দিচ্ছেন তাদের সন্তানকে। হাসান আর্তনাদ করে উঠে, ‘না না আল্লাহ, তুমি ঐ খবিচদের শাস্তি একটা নিষ্পাপ বাচ্চাকে দিতে পার না। চাঁদের মত একটা মুখ, ফুলের মত হাসে, ওকে তুমি সুস্থ করে দাও আল্লাহ’ সে মনে মনে দোয়া করতে করতে বাসার দিকে রওয়ানা হল।

সে বিছানায় শুয়ে শুয়ে দারদার স্মৃতিগুলি রোমান্থন করতে লাগল। ছেলেটি তাক দেখেই উচ্ছসিত হয়ে হাসত, তার গায়ে ঢলাঢলি করত, কোলে শুয়ে থাকত, খিলি পান এনে দিত, তার হাতের আঙ্গুল ধরে নেচে নেচে হাটত। দারদার সাথে তার স্মৃতির জোনাকিগুলি মিটিমিটি জ্বলছে আর তার চোখের কোনা বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরছে, পানিতে কান ভরে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর উঠে দারদার জন্য কোরান শরীফ পড়তে বসল। রাত বারটা পর্যন্ত পড়ে ছেলেটার সুস্থতার জন্য দোয়া করল। বারটার পর তাহাজ্জুদে দাঁড়াল, তারপর তাসবিহ পড়ল। শেষ রাত্রে হাত উঠাল সেই দরবারে- যে দরবার হতে কেউ ফেরে না খালি হাতে। তার চোখ বেয়ে অশ্রুর ধারা নামল, ‘কাযা ও ইনসাফের মালিক, তুমিই তো বলেছ ‘লা তাযিরু ওয়াযিরাতুন বিযরা উখরা- একে অন্যের পাপের বোঝা বহন করবে না’। তাহলে এই ফুলের মত পবিত্র মাসুম বাচ্চাটিকে কেন শাস্তি দিচ্ছ, সে তো কোন পাপ করেনি। তার মা বাপের পাপের বোঝা কেন তার উপর অর্পন করছ। দয়াময়, তুমি বাচ্চাটিকে মাফ করে পূর্ণ সুস্থ করে দাও। যে অবুঝ শিশু আজো পৃথিবীর পথে পা ফেলেনি আগেই তার পা-টা কেড়ে নিতে পার না মালিক, আগেই তাকে বিকলাঙ্ঘ করতে পার না। এরপর সে আর কথা বলতে পারল না, বোবা কান্নায় তার কণ্ঠ বন্ধ হয়ে গেল। শুধু ঠোঁট কাঁপছে, চোখ দিয়ে কালো জলের ধারা ছুটছে।

দারদাকে সে ভালবাসত কিন্তু কতটুকু ভালবাসত সে জানত না। আজ জানল যে, অন্যের সন্তানের পা কাটা যাচ্ছে না, কাটা যাচ্ছে তার নিজের সন্তানের পা, দারদা তার সন্তান বা সন্তানের মত। কিছুক্ষণ নির্বাক দোয়ার পর হঠাৎ সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘দারদা, দারদা, আমর দারদা, বন্ধু আমার, সন্তান আমার, ইংশাল্লাহ তোমার কিচ্ছু হবে না। মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহর রহমত মেঘের মত তোমার মাথার উপর থাকবে, আমার দোয়া ছায়ার মত তোমার সাথে থাকবে। পৃথিবীতে তুমি সম্মান ও শান্তির জীবন যাপন করবে। সন্তান আমার, স্বরণ রেখ, তোমার পিতা মাতার পরে যদি এই দুনিয়ায় তোমার কেউ শুভাকাঙ্ক্ষী ও আপনজন থাকে তাহলে জানবে সেই লোকটি আমি। আরো কিছুক্ষণ দোয়ার পর তার ক্লান্ত দেহটি জায়নামাযে ছেড়ে দিল, অল্পক্ষণ পর ঘুমিয়ে পরল। পরের দিন ভাবছে, দারদা তো নাই এখন স্ত্রী সন্তানের ঠিকানা কার কাছ থেকে কিভাবে সংগ্রহ করবে।

হঠাৎ তার মনে হল ইঞ্জিনিয়ারের একটা ছেলে পাট গুদাম মাদরাসায় পড়ে। ছেলেটাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে তার খালামনির ঠিকানা বা অন্তত মোবাইল নাম্বারটা সংগ্রহ করতে পারলেই কেল্লা ফতেহ। ছেলেটি হাফেযি পড়ে। হাসান মাগরিব পড়ে গিয়ে হিফজ বিভাগের শিক্ষকের সাথে বসল। ছেলেটির কথা বলতেই হাফেজ সাব তাকে ডেকে দিল, আর হাসান তাকে নিয়ে ক্লাসের বাইরে চলে গেল। এরা হাসানকে দেখতে পারে না, রাস্তায় দেখা হলে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে চলে যায়, কথা বলেনা। আজ তার হুযুর ডেকেছে বলে এসেছে কিন্তু গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাসান জানে এদের মা বাবা যেমন ধুর্ত এরা তার চেয়েও চতুর, কথা বের করা কঠিন হবে। প্রথমে সে তার ও তার অন্যান্য ভাইদের পড়ার খোজ খবর নিল। ছেলেটা কর্কশ ভাষায় জবাব দিয়ে যাচ্ছে।

এর কনিষ্ঠ বোনের নাম বুশরা যে মনিরার সমবয়সী। কথা বের করার জন্য হঠাৎ সে জিজ্ঞেস করল, ‘মুনিরা বুশরার সাথে মারামারি করে না? ধুর্ত ছেলেটি থমকে দাঁড়াল, কোন কথা বলল না। হাসান আবার জিজ্ঞেস করল, ‘মুনিরার জন্য দুধ কিনে আনে? সে উত্তর দিল না। এরপর সে একটি একটি প্রশ্ন করে আর ছেলেটি জানিনা, জানিনা বলে উত্তর দেয়। সর্বশেষ সে প্রশ্ন করল, ‘তোমার খালামনি কই, বাড়িতে না ঢাকায়, নাকি খুলনায়? ছেলেটি কর্কশ ভাষায় বলে উঠল, ‘একশ বার তো বললাম আমি কিচ্ছু জানিনা। হাসান লজ্বা পেয়ে, ‘আচ্ছা ঠিক আছ যাও, পড় গিয়ে’ বলে সে বাসায় চলে গেল। পরদিন আবার এসে বিভিন্ন কৌশলে কথা আদায় করতে চাইল কিন্তু ব্যর্থ হল। তারপর দিন আবার আসল কিন্তু নিরাশ হল। এ মাদরাসার অধিকাংশ শিক্ষক হাসানের বাবার ছাত্র। চতুর্থ দিন আসার সাথে সাথে মাদরাসার তালিমাত (শিক্ষা সচিব) তাকে ডেকে নিয়ে বলল, ‘আজ আসরের পর ইঞ্জিনিয়ার খুব গরম দেখাল, আপনি এসে তার ছেলের পড়া নষ্ট করেন’। হাসান লজ্বিত হয়ে চলে গেল।

এখন উপায়? উপায় তো একটা খোজে বের করতেই হবে, হাল ছাড়লে তো চলবে না। এবারে তার চিন্তা হল স্ত্রীর নিকটাত্মীয় ও ইঞ্জিনিয়ারের ঘনিষ্ঠ জনদের কাছে যাবে। কয়েকদিন বিকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত খুব ঘোরাফিরা করল কিন্তু কোন লাভ হল না। কারণ ফেরদৌসিরা আট বোন মিলে ছিল তাদের সমাজ। এর বাইরে কোন আত্মীয় স্বজনের সাথে তারা সম্পর্কও রাখত না, যোগাযোগও করত না। ফলে তাদের ভিতরগত বিষয় কারো জানার সুযোগ হত না। তাছাড়া ইঞ্জিনিয়ারের ব্যবহার ছিল রুক্ষ, ভাষা কর্কশ। এ জন্য আত্মীয় স্বজনরা যেমন তাকে এড়িয়ে চলত তদ্রুপ ঘৃনাও করত। কাজেই হাসান যখন শ্বশুর পক্ষের আত্মীয়ের কাছে স্ত্রী কোথায় আছে, কেমন আছে জানতে চাইল এবং তার ঠিকানা চাইল- তখন কেউ তা জানাতে পারল না। সবশেষে গেল ফেরদৌসিদের নিকটাত্নীয় ফোরকান সাবের কাছে, তারপর গেল স্কুল শিক্ষিকা ফেরদৌসির এক চাচীর কাছে কিন্তু তারা সবাই ব্যর্থ হল। ওদের কাছ থেকে ফেরদৌসির ঠিকানা এমনকি মোবাইল নাম্বারটা পর্যন্ত সংগ্রহ করে দিতে পারল না। অবশেষে প্রত্যেককেই সে অনুরোধ করল বিষয়টা ফয়সালা করে দিতে, স্ত্রীকে এনে দেয়ার ব্যবস্থা করে দিতে। তখন কেউ কেউ সরাসরি অস্বীকার করল, কারণ তারা ইঞ্জিনিয়ারকে ভয় পায় ও ঘৃণা করে। আর কেউ কেউ আলাপ করে শুধু ব্যর্থই হয়নি, অপমানিতও হয়েছে। হতাশায় তার মন বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ভিতরে ক্ষয় রোগ শুরু হয়ে গেছে।

মাদরাসা থেকে এসেই স্ত্রী সন্তানের খোজে বেরিয়ে যায়, স্ত্রীর আত্মীয় স্বজনের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে গভীর রাত্রে বাসায় ফিরে। তারপর বাকী রাত জায়নামাযে শুয়ে বসে কাটিয়ে দেয়। এভাবে না খেয়ে না ঘুমিয়ে তার দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ কেটে যাচ্ছে। কোনভাবেই স্ত্রী সন্তানের ঠিকানা এমনকি মোবাইল নাম্বারটুকুও সংগ্রহ করতে পারল না। এখন কোন পথে এগুবে, অনেক চিন্তা ভাবনার পর সিদ্ধান্ত নিল জামালপুর মারকাযের মুরুব্বীদের কাছে যাবে। তাবলিগী পরিবার হিসাবে হাসান- ফেরদৌসির বিষয়টা তাবলীগ সংশ্লিষ্ট সকলেরই জানা ছিল। আর প্রত্যেক শ্রেণীর মধ্যেই আসাবিয়্যত তথা স্বগোত্র বা স্বমতবাদের দিকে আলাদা টান থাকে। ফলে হাসান যার সাথেই আলাপ করল, অধিকাংশই তাকে তিরস্কার করল এই বলে, ‘আপনাকে সাল চিল্লার কথা বলেছিল আপনি যান নাই কেন? নিজের প্রয়োজনেও তো আপনার সালটা লাগিয়ে আশা উচিত ছিল, আপনি আলেম মানুষ আপনারই উপকার হত’। তারপর ইঞ্জিনিয়ারের সাথে আলাপ করার অনুরোধ করলে কেউ বলল, পারবে না, কেউ বলল, ইঞ্জিনিয়ার একরোখা মানুষ সে কারো কথা শুনবে না। কেউ বলল বউয়ের সাথে সালের কোন সম্পর্ক নাই, আপনি চুপ করে গিয়ে বসে থাকেন। বউ না আসলে বিয়ে আরেকটা করে নিবেন, নিজের আত্মমর্যাদা বিকিয়ে দেয়ার দরকার নাই।

একদিন গিয়ে দেখে মসজিদের সামনে মারকাযের ইমাম ও আরো কয়েকজন মুরুব্বী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আলাপ করছে। ইমামের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, অন্যদের সাথেও ভাল সম্পর্ক। তাকে দেখেই একজন বলে উঠল, ‘আসেন ভাই আসেন, কুকুররকে মুগুর না দেখালে শান্ত হয় না। আপনার ভায়রাগুলি হল কুকুর, এদেরকে মুগুর দেখান, একটা মামলা করে দেন, দেখবেন সব সাইজ হয়ে গেছে, আপনার বউও এসে গেছে। তারপর ইমাম সাবের দিকে ফিরে বলল, ‘চিন্তা করছেন ইঞ্জিনিয়ারটা কত বড় বদমাইশ। নিজের ভাই বোনগুলি ভাত বেগড়ে মরছে সেদিকে ফিরেও তাকায় না অথচ শালিদেরকে নিয়ে কেমন বাড়াবাড়ি করতাছে। এই বেচারাকে কেমন বিপদে ফেলেছে। আরেকজন হাসতে হাসতে বলল, ‘উনি গেলেন বউয়ের বিচার দিতে আর ইঞ্জিনিয়ার তার উপরই উল্টা বিচার চাপিয়ে দিল। সাল চিল্লা না দিলে বউ দিবে না, বাঃ চমৎকার।

ইমাম সাব বলল, ‘এইসব লোকেরাই তো তাবলীগটা ধ্বংস করছে, বদনাম করছে। যুবক মানুষ বউ ফেলে এক বছরের জন্য বাইরে চলে যাবে, এটা তাবলীগের কথা নাকি? আপনি যান, মামলা করে দেন, তারপর দেখেন বউ কিভাবে আসে। হাসান বলল, ‘ভালাই কইছেন, যে মেয়ে দুলা ভাইদেরকে আমার উপর প্রাধান্য দেয়ার জন্য সারাক্ষণ ঝগড়া করত, এখন সেই দুলা ভাইদের উপর মামলা দিলে আসবে তো নয়ই বরং পরদিনই আমার বিরুদ্ধে যৌতুক ও নারী নির্যাতনের মামলা ঠুকে দিবে। মামলা ছাড়া আর কোন তদবীর থাকলে বলেন। একজন বলল, আছে। হাসান জিজ্ঞেস করল কি? সে বলল, ‘বিয়ে, এটাকে বাদ দেন, আপনাকে আরেকটা বিয়ে করাই, আমরাও অনেক দিন ধরে বিয়ে খাই না’। ‘ঠিক আছে, আপনারা বিয়ে দেখতে থাকেন আমি আমার রাস্তা মাপতে থাকি’ বলে সে চলে গেল। সে বুঝল আসলে এরা কেউ ইঞ্জিনিয়ারকে দেখতে পারে না।

সে মসজিদের ভিতরে চলে গেল। তার সাথে তাবলীগে গিয়েছে এমন দু’জন সাথী বলল, ‘আজ আপনাকে নিয়ে একজন মুরুব্বীর কাছে যাব, তিনি এরশাদ সরকারের আমলে বড় ধরনের নেতা ছিলেন’। মুরুব্বীকে ঘটনা বলে কয়ে তারা অনুরোধ করল ইঞ্জিনিয়ারের সাথে একটা ব্যবস্থা করতে। তিনি বললেন, ‘ইঞ্জিনিয়ার লোকটা একরোখা, তবুও আলাপ করে দেখি কি করা যায়। আপনি দুই তিন দিন পর আমার বাসায় দেখা করবেন’। দুই দিন পর হাসান তার বাসায় গিয়ে দেখা করল, তিনি বললেন, ‘ভাই আমি দুঃখিত, আপনার জন্য কিছুই করতে পারলাম না। ঐ লোকটা হল ভয়ঙ্কর জেদি আর একরোখা, সে যা বুঝে তাই করে, কারো কথা মানে না। তার এক কথা, আপনি তাদের কথামত সাল চিল্লা দিলেন না কেন, এজন্য আপনার বউ দিবে না, তালাক নিয়ে অন্যত্র বিয়ে দিবে, একটা ভাল পাত্রের সন্ধানও নাকি পেয়েছে। এখন আমার পরামর্শ হল আপনি নিজে গিয়ে ইঞ্জিনিয়ারের সাথে আলাপ করেন, হয়ত একটা ফয়সালা বেরিয়ে আসতে পারে।

হাসান ফিরে গেল কিন্তু ‘অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দিবে’ কথাটা শুনে তার কণ্ঠনালি উঠানামা করতে লাগল। আজও সে তাহাজ্জুদের পর জায়নামাজে বসে বসে চিন্তা করতে লাগল কি করা যায়। ইঞ্জিনিয়ারের কাছে গেলে তো নিশ্চয়ই সে কটু কথা বলবে। আর তখন সে বলবে, ‘আমার বউয়ের অন্যায়ের ব্যাপারে আমি বিচার চাইলাম কিন্তু আপনারা বিচার না করে আমাকে সাল চিল্লার শর্ত দিলেন। আমার অনুমতি ছাড়া আমার স্ত্রী সন্তানকে নাগালের বাইরে নিয়ে রেখেছেন। এটা কোন ইসলাম, এটা কোন তাবলীগ? নিশ্চয়ই তখন ঝগড়া বেধে যাবে, হাতাহাতিও হতে পারে। বিরাট একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে, কাজেই ওখানে না যাওয়াই ভাল। আবার বজলুর কাছে গিয়েও লাভ নাই, সেই তো এই কেলিটা বাজিয়েছে। বাদ থাকল এডি, তার কাছে যাওয়া যায়। লোকটা সহজ সরল, আর যাই হউক অন্তত কথাটা শুনবে।

পরদিন বিকাল তিনটায় হাসান তার অফিসে গিয়ে সালাম দিল। সে সালামের উত্তর দিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে রইল, কোন কথা বলে না। কিছুক্ষণ পর হাসান বলল, ‘এভাবে আর কত দিন চলবে একটা ব্যবস্থা করে দেন। সে খেকিয়ে উঠল, ‘কেন তোমার তো ভালই চলছে, বেতন তুলছ খাচ্ছ দাচ্ছ স্ফুর্তি করছ, তোমার আবার সমস্যা কি। অন্যায় করবা আর আমার কাছে আসবা ব্যবস্থা করে দিতে, আমি তো তোমার গোলাম হইছি। হাসানের মন চাচ্ছিল লোকটার গালে যদি একটা থাপ্পড় মারতে পারত তাহলে তার মনের ক্ষেদ কিছুটা হলেও প্রশমিত হত। এই শালা এডিই মিথ্যা কথা বলে একটা নাক বুচা, অসুন্দরী, তিনবারে ম্যাট্রিক দেয়া, বদমেজাজি, পাগলা একটা মেয়ে তার কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে তার জীবনটা জাহান্নাম বানিয়ে তুলেছে, আবার তাকেই উল্টো দোষ দিচ্ছে। সে বলল, ‘আমি কি অন্যায় করলাম?- তুমি রাত দিন ঝগড়া করবা, বউকে অত্যাচার করবা আর আমরা মেয়েকে এভাবে ফেলে রাখব, না? হাসান বুঝল এই স্ত্রৈণদের সাথে আলাপ করে লাভ নেই। সে চেয়ার থেকে উঠে, ‘দেখেন কিছু করার থাকে তো করেন’ বলে বেরোনোর জন্য ঘুরল।

তখন এডি স্বর নরম করে বলল, ‘বস। একবার আমি বালিয়া মাদরাসায় পড়তে গিয়েছিলাম। তখন তোমার আব্বা আমার লজিং করে দিয়েছিলেন এবং সব সময় খোঁজ- খবর নিতেন। এ জন্য আমি উনার প্রতি কৃতজ্ঞ। তুমি তার সন্তান, আমি চাই না তোমার কোন ক্ষতি হউক। কিন্তু এখন তো দেখছি তাই হতে চলেছে। তোমার বউয়ের তোমার চেয়ে ভাল জায়গায় বিয়ের আলাপ চলছে। এখন আর কারো কিছু করার নাই। তুমি যদি তাবলীগের বড় কোন মুরুব্বী ধরে সুপারিশ করাতে পার তাহলে কাজ হতে পারে। তুমি কাকরাইল গিয়ে বড় কোন মুরুব্বীর সাথে আলাপ কর। নইলে বড় দুলাভাই অন্য কারো কথা শুনবে না। এডির আরো কিছু পরামর্শ নিয়ে হাসান চলে গেল। কিন্তু বিয়ের আলাপ চলছে শুনে তার আত্না ধক করে উঠল, শরীর ঘামছে। বাসায় গিয়ে সে সিদ্ধান্ত নিল ময়মনসিংহ তাবলীগের আমীর উসমান গণি সাবের কাছে যাবে। ইঞ্জিনিয়ার তার কথা ফেলতে পারবে না। দু’দিন পর সন্ধ্যায় তার বাসায় গিয়ে জানতে পারল তিনি মারকায মসজিদে গেছেন। হাসান মসজিদে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ পর দেখল একজন লোক কোজো হয়ে যাওয়া অশীতিপর এক বৃদ্ধকে ধরে ধরে রোডের দিকে যাচ্ছে। হাসান বলল, ‘আমার কাছে দেন, আমি উনাকে বাসায় পৌঁছে দেই’। লোকটা বৃদ্ধকে হাসানের হাতে দিয়েই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল, সোজা মসজিদে ঢুকে গেল এজন্য যে, রিকশায় নিয়ে গেলে তার দশ টাকা খরচ হবে। হাসান অবাক হয়ে গেল, এরা মুরুব্বী মানে অথচ একটা অপরিচিত মানুষের হাতে এমন একজন বুড়া মানুষকে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে চলে গেল।

হাসান রিকশাওয়ালার সহায়তায় মুরুব্বীকে রিকশায় তুলে শক্ত করে ধরে বসে বসে ভাবতে লাগল, তার বাবা ইনার ছাত্র ছিলেন, ইনার পরামর্শেই তার বাবা দেওবন্দ গিয়েছিলেন, আবার দু’জনের নামও এক। ইনি এখনো বেচে আছেন অথচ তার বাবা সেই ৮৬ সালে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। তিনি হাটতে পারেন না, হাসান রিকশা থেকে নেমে শক্ত করে ধরে বাসায় নিয়ে গিয়ে দুজন পাশাপাশি চেয়ারে বসল। হাসান বারবার উচ্চস্বরে বলে, ‘আমি আপনার কাছে এসেছি। তিনিও শুনতে চান এবং বুঝতে চান কিন্তু কানে শুনেন না। কিছুক্ষণ পর তার বড় ছেলে আসল, হাসানকে ডেকে নিয়ে গিয়ে একটা রুমে বসল। হাসান তার সমস্যাটা সংক্ষেপে জানিয়ে বলল, ‘আমি উনার সুপারিশের জন্য এসেছিলাম। কিন্তু লোকটার চাহনি দেখে তার সন্দেহ হল, অন্যান্য লোকেরা তার সম্পর্কে যে ধারনা করে এ ব্যক্তিও তাই মনে করছে কিনা। তাই সে বলল, ‘না, বিষয়টা এমন নয় যে আমার কোন শারীরিক দুর্বলতার কারণে বউ চলে গেছে। লোকটা মুচকি হেসে বলল, ‘এটা আপনাকে বলতে হবে না, মানুষের চেহারা দেখেই বুঝা যায়। তারপর বলল, ‘আব্বার অবস্থা তো দেখলেনই, একশো বিশের উপড়ে বয়স হয়ে গেছে, কানেও শুনেন না, কথাও বলতে পারেন না। আপনি স্থানীয় মুরুব্বীদের ধরে ফয়সালা করেন, আরো কিছু পরামর্শ দিয়ে সে হাসানকে বিদায় জানাল।

বাঙালি মেয়েদের চিরন্তন চরিত্র হল, স্বামী মদারু জোয়ারু লোচ্চা যাই হউক, স্বামী মারুক, কাটুক বাটুক কোন অবস্থায়ই স্বামী ছেড়ে যায় না। বরং স্বামীরাই লক্ষ্মী সাবোধ স্ত্রীদের উপর অত্যাচার নির্যাতন করে, কথায় কথায় তালাক দেয়। বাঙালীর এ বাস্তবতার মধ্যে ফেরদৌসি স্বামী ছেড়ে চলে গেছে। আবার বাঙালী প্রবাদ, ‘নদীর জল ঘোলাও ভাল জাতের মেয়ে কালোও ভাল’। অর্থাৎ মানুষ কুলিন দেখে বিয়ে করে এজন্য যে, এরা কোনরূপ কলঙ্ক করবে না, জীবন দিবে তবুও বদনাম ডেকে আনবে না। ফেরদৌসি ফকির বংশের মেয়ে হিসাবে নিজেকে কুলিন ভাবত। অথচ সে কোন কারণ ছাড়াই স্বামী ছেড়ে চলে গেল। সর্বত্র রাষ্ট্র হয়ে গেল হাসানের বউ চলে গেছে। আর বাঙালীর মধ্যবিত্ত সমাজ জানে যে, বউকে বিড়ালের মত চেচলেও যায় না, তাও হাসানের বউ গেল কেন। তার তো খাওয়া পরার অভাব নাই, তাহলে সমস্যাটা কোথায়, শরীরে?

তার মাদরাসার শিক্ষকরা সন্দেহ করতে লাগল। কেউ কেউ কম্পোজ করার ভান করে বজলুর কম্পিউটার দোকানে গিয়ে জানতে চাইল, কেউ কেউ তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে, আপনার কি শারীরিক সমস্যা আছে? সে মুচকি হেসে জবাব দেয় ‘এটা আমি কি করে বলব, আমার বউ-ই ভাল বলতে পারবে’। সমগ্র সৃষ্টি জগতের মধ্যে পুরুষ জাতি অশিক্ষা, দারিদ্রতা, প্রতিবন্ধিত্ব, পঙ্গুত্ব ইত্যাদি কোন কিছুতেই লজ্বাবোধ করে না, একমাত্র লজ্বা পায় নপুংশকতা বা কাপুরুষত্বে। কারণ এদেরকে সমাজ মানুষ হিসাবে গন্য করে না। হাসান মাঝে মধ্যে বিষণ্ণ হয়ে উঠে, ‘হায় আল্লাহ্‌, এই অপবাদটাও বুঝি আমার ভাগ্য লিপিতে ছিল । একটা সিংহকে বড়জোর নেকড়ে বলা যায় কিন্তু শৃগাল বললে এটা নিতান্তই সিংহের দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছু নয়। তখন তার স্ত্রীর কথা মনে পরত, সে প্রায় প্রায়ই বলত, ‘এ জন্যই তো পুরুষরা তিন চারটে বিয়ে করে’। আজ সেই স্ত্রীই তার ললাটে এটে দিল নপুংশকের কলঙ্ক তিলক। এই হল কুলিন বংশ ও ধর্মীয় পরিবারের মেয়ের পক্ষ থেকে স্বামীর জন্য তোহফা।

বেচারা হাসান, খাওয়া নাই ঘুম নাই। ফজরের পর কোনদিন কিছুটা ঘুম হয়, কোনদিন হয় না, সারারাত জায়নামাজে কাটায়। কখনো নামায পড়ে, কখনো তাসবিহ টিপে, কখনো শুয়ে থাকে। অনেক চিন্তা ভাবনার পর সে স্থির করল কাকরাইলের মুরুব্বী ডাঃ সাইনুদ্দিন সাবের কাছে যাবে। তার বাড়ি ময়মনসিংহের তারাকান্দায়, তাদের এলাকায়। তিনি কয়েকবার বালিয়া পাড়া মাদরাসায় এসেছেন। দেশের মানুষ পরিচয় পেলে তিনি অবশ্যি একটু নাড়া চাড়া করবেন। একদিন মধ্যরাতের ট্রেনে চড়ে কাকরাইল মসজিদে পৌছাল বটে কিন্তু হৃদয়তলে আশার সে প্রদিপটি পতপত করে জ্বলছিল- সহসা ধপ করে নিভে গেল। অনেক অনুসন্ধানের পর জানতে পারল ডাক্তার সাইনুদ্দিন বিদেশ সফরে গেছেন। কিছুক্ষণ বিমর্ষ হয়ে বসে থেকে অন্যান্য মুরুব্বীদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করল কিন্তু বিষয়টা সহজ ছিল না।

সাধারন কয়েকজনের সাথে কথা হল। কেউ তো পাত্তাই দিলেন না, কেউ এসব দুনিয়াদারি কথা শুনতে রাজি নয়। কেউ সরাসরি বলে দিল, ‘মিয়াঁ বউ গেছে তো কি হইছে, দেশে কি মেয়ের দুর্ভিক্ষ দেখা দিল নাকি, একটা গেছে তিনটা করেন। কেউ স্থানীয় মুরুব্বীদের দিয়ে ফয়সালা করার পরামর্শ দিল। কেউ বলল, ‘সাইনুদ্দিন সাব কয়েক মাসের মধ্যে এসে পরবেন, অপেক্ষা করুন। হাসান যেটুকু আশা নিয়ে কাকরাইল গিয়েছিল ততোধিক নৈরাশ্য নিয়ে বাসায় ফিরে এল।

(দ্রষ্টব্যঃ অবশেষে উরু সন্ধিস্থল থেকে দারদার একটা পা কেটে ফেলতে হয়েছিল।)

বিষয়: সাহিত্য

১৪৭৯ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

378533
১০ অক্টোবর ২০১৬ দুপুর ০৩:১৭
আফরা লিখেছেন : কমেন্ট না করলেও আপনার গল্পটা আমি নিয়মিত পড়ি ভালই লাগে পড়তে ।

তবে একটা জিনিস বুঝতে পারলাম না হাসান সাহেব তো বউকে তালাকই দিতে চেয়েছিল তো এখন সে এরকম করছে কেন ? বলবেন তো উনি মেয়ের জন্য এমন করছেন !!
এটা কোন ব্যাপার না মেয়ে বড় হয়ে ঠিকই বাপ এর কাছে চলে আসবে ।

আসলে একজন মানুষ যত খারাপ ই হোক তার মাঝেও কিছু গুন থাকে যেটা কাছে থাকলে বুঝা যায় না বা আমরা অনুভব করিনা ।

আর হাসান সাহেব কেও খুব ভাল লোক বলতে পারছি না কারন একটা সংসার কখনো একার দোষে ভাংগে না ।

উনাকে এবার শিক্ষিত ,সুন্দুরী গুনবতী মেয়ে দেখে বিয়ে দিয়ে দেন সব ঠিক হয়ে যাবে ।
378534
১০ অক্টোবর ২০১৬ দুপুর ০৩:১৮
আফরা লিখেছেন : উঃ ভুলে গিয়েছিলাম আপনার লিখার হাত ভাল ।ধন্যবাদ
378535
১০ অক্টোবর ২০১৬ বিকাল ০৪:২৭
আবু নাইম লিখেছেন : আপনি এ পর্যন্ত যা লিখেছেন. তা সবই পক্ষ ও পক্ষের মন্তব্য জানলাম না। তা ছাড়া

আমিও এটা বলি.....
‘মিয়াঁ বউ গেছে তো কি হইছে, দেশে কি মেয়ের দুর্ভিক্ষ দেখা দিল নাকি, একটা গেছে তিনটা করেন।
১০ অক্টোবর ২০১৬ বিকাল ০৫:১৬
313605
স্বপন২ লিখেছেন : Here the link. You will get there
http://islamisomaj.org/, Please review it.
378564
১১ অক্টোবর ২০১৬ সকাল ১১:২৬
নকীব আরসালান২ লিখেছেন : ধন্যবাদ সবাইকে

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File