চিঠি- ৪৫ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ০৮ অক্টোবর, ২০১৬, ০১:০৩:০৭ দুপুর
শীতকালীন বন্ধ শুরু হয়েছে। সে বাড়িতে চলে গেল। আর যাবার সময় মনে করে তার মেয়ের কাপড়ের ছোট্ট পুটলিটা ও জুতা জোড়া নিয়ে গেল। কারণ সে জানে এগুলো ছাড়া ঘুমুতে পারবে না। বাড়িতে গিয়ে কাপড় খুলতেই মা চমকে উঠে আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘একি রে, তোর স্বাস্থ্য এত ভাঙ্গল কেমনে, শরীরের একি অবস্থা। মোবারক তো ঠিকই বলেছে তুই ঠিকমত খাস না, ঘুমাস না। তোর আর চাকরি লাগবে না, এখন থেকে বাড়িতে থাকবি।’ হাসান বলল, কই দেখলেন স্বাস্থ্য ভেঙ্গেছে, আমি তো এমনই।’ মা বললেন, ‘তুই এমনই, আমার ছেলের শরীর আমি চিনি না, তুই আমার চোখকে ফাকি দিতে চাস, তিনি আহাজারি শুরু করলেন। হাসান মনে মনে হাসে, এখন তো শরীরটা মোটামোটি ঠিক হয়েছে, কিছুদিন আগে দেখলে তো এতক্ষণে মায়ের মাথায় পানি ঢালতে হত।
রাতে খেতে বসে মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘বউয়ের কি খবর রে? হাসান বলল, ‘আপাতত খবর নাই, তবে হতে আর বেশি দেরি লাগবে না। নতুন নতুন বোনদের বাসায় বাসায় ঘোরছে, আর খাচ্ছে। কিছুদিন পর বোনদের যখন বমি বমি ভাব হবে, তখন দেখবেন ফের ফের করে বাসায় এসে হাজির হবে।’ মা বললেন, ‘এভাবে আর কতদিন চলবে, অনেকদিন ধরে ভাবছি আমি যাব, গিয়ে বউকে নিয়ে আসব। হাসান চোখ বিস্ফারিত করে বলল, ‘আপনি তো খেয়ে দেয়ে আর চিন্তার বিষয় পান না, ওরা মানুষ নাকি যে ওদের কাছে যাবেন। আপনাকে কোন মূল্যায়ন তো করবেই না উল্টো অপমান করবে। আপনার যদি অপমানিত হওয়ার সাধ থাকে তাহলে যেতে পারেন। এরপরেও মা পিড়াপিড়ি করতে লাগলেন। হাসান বলল, ‘আচ্ছা আমি চেষ্টা করি, পীর সাব তো জামালপুর যায়ই তাকেও সুপারিশের জন্য বলব। এরপরেও যদি কাজ না হয় তখন আপনি যাওয়ার চিন্তা করেন যে খন। আচ্ছা আমাদের সেই এক হাজার দানার তাসবীহটা আছে না? মা বললেন আছে। হাসান বলল, ‘তাহলে যাওয়া টাওয়া বাদ দিয়ে আসল জায়গায় তদবির করেন। সবাইকে নিয়ে একটা খতমে ইউনুস পড়ে ফেলেন। মা খাওয়ার পড়েই তাসবীহ নিয়ে বসে পরলেন।
স্ত্রী যাওয়ার পর থেকে হাসান একদিনও তাহাজ্জুদ মিস করেনি। বাড়িতেও তাহাজ্জুদ পড়ল, কিছুক্ষণ তাসবীহ পড়ে শুয়ে পরল। কিন্তু ঘুম আসছে না। ব্যাগ খুলে মেয়ের কাপড়ের পুটলি ও জুতা নিয়ে বুকে চেপে ধরে শুয়ে থাকল। তবুও ঘুম হল না। শেষ রাত্রে একটু তন্দ্রার মত হল।
হাসানের ছয় ভাইয়ের মধ্য তিন ভাই বাড়িতে থাকে, আর তিন জন বাইরে থাকে। তার দ্বিতীয় ভাইটা কলেজে উঠে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পরে, বি এন পির প্যানেলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন করে অনেক টাকা পয়সা নষ্ট করে, ডাব্বা মেরে ভন্ডামি শুরু করে দেয়। তারপর হাসান নিজের বিয়ের আগে তাকে বিয়ে করিয়ে সংসার দেখা- শুনার কাজে লাগিয়ে দেয়। এর ছোট দুইটার একজন মাদরাসায় ও একজন কলেজে পড়ে, বাইরে থাকে। তারপরের দু’জন কলেজে পড়ে ও বাড়িতে থাকে। এরাই সংসার দেখাশুনা করে। এখন আর আগের দিন নাই, বছুরে ও মাসুহারা কামলা তো পাওয়া যায়ই না, রোজানা কামলাও পাওয়া যায় না, শিল্প বিপ্লবের ছোঁয়ায় সবাই এখন ঢাকা চট্টগ্রাম মুখি। চোকে বা চুক্তি ভিত্তিক গৃহস্থালি কাজ করাতে হয়। সব কিছুই যান্ত্রিক হয়ে উঠেছে, এখন আর লাঙ্গল নাই, কলের লাঙল হাল চষে, ধান মাড়াই করে, এমনকি বড় কৃষকরা লাঙলের মেশিনে ইস্পাতের পাত দিয়ে বানানো পাখা লাগিয়ে ধান উড়ানো মানে পরিস্কার করার কাজ করে। গ্রাম গঞ্জে হালও নাই, গরুও নাই। সচেতন লোকেরা দুধের জন্য দুয়েকটা করে গরু পালে। হাসানরা দুধের জন্য দুটি গাভী পালে। তখন একটি গাভী দুধ দিচ্ছিল। কাজেই মা আগে হাসানকে দুধ দিতেন জগ ভরে কিন্তু এখন দেন গ্লাস ভরে অর্থাৎ জগ থেকে গ্লাসে নেমেছে।
ফযরের পর মা এক গ্লাস দুধ, তিনটা ডিম আর কিছু পিঠা নিয়ে এলেন। মুনিরার বছর খানেকের বড় হাসানের ছোট ভাইয়ের একটা মেয়ে আছে, তাকে ছাড়া সে খেতে বসে না। বাচ্চাটাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে নিয়ে গিয়ে খেতে বসল। খাওয়ার পর কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করে ঘুমিয়ে পড়ল। সকাল নয়টার দিকে মা ডেকে তুলে খেতে দিলেন। কয়েক জাতের মাছের তরকারী। বিলের মাছ, সুস্বাদু মাছ। কিন্তু তার তো ক্ষুধা নাই, খেতে পারল না, কিছুক্ষণ বসে বসে খালি মাছ খেল। মা বললেন, ‘শহরে শুয়ে বসে থাকিস, এজন্য তোর ক্ষুধাও লাগে না, ঘুমও হয় না। বাড়িতে থেকে কিছুদিন কাজ কর তাহলে ঠিকমত খেতেও পারবি, ঘুমও হবে। তোর স্বাস্থ্যটাও ঠিক হয়ে যাবে। আল্লাহ্ শরীরটা দিয়েছেন খাটানোর জন্য, না খাটলে ঠিক থাকে না। খাওয়ার পর তিনি একটা কোদাল দিয়ে বললেন, ড্রেইনগুলি ঠিক করে আয়।
হাসানদের জমি হল, বাড়ির আশা পাশে, দক্ষিণ মাঠ ও পশ্চিমের বিলে। তিন জায়গায় তিনটি মটর চলে। তাদের পূর্ব গ্রাম পর্যন্ত বিদ্যুৎ গিয়েছে, সেখান থেকে কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে তারা কিনে এনেছে মোটর চালানোর জন্য। সব জমি সংকুলান করা যায় না, পশ্চিমের বিল ও দক্ষিণ মাঠের কিছু জমি তারা বর্গা দিয়ে দেয়, বাকিটুকু নিজেরা করে। কোদালটা কাঁধে নিয়ে দক্ষিণ মাঠে চলে গেল, ঠিক আদি আসল কৃষক। আজ তিন চার বছর পর কাজে নামল। আগের দিনের কথা স্বরণ করে উৎসাহ পেল, আগে দানবের মত কাজ করত। গিয়ে দেখে পুরাতন ড্রেইন, ঘাসে জঙ্গল হয়ে আছে, মটরের পানি ড্রেইন উপছে আশ পাশের ক্ষেতে যাচ্ছে। পানির অপচয় হচ্ছে। সে ভাইদের ও বর্গা চাষিদের ডেকে এনে কিছুক্ষণ গালাগালি করে কাজে লাগাল। শুকনা ড্রেইন হলে সাফ করা সহজ হয় কিন্তু ভিজা ড্রেইনে কোদাল চলে না। আলতো করে কুপিয়ে কুপিয়ে ড্রেনের তলা ও দুই সাইটের ঘাস আধা ইঞ্চি মাটিসহ তোলে ড্রেইনের দুই পাড়ে বসিয়ে দিতে হয়।
মিনিট বিশেক পর অন্যেরা ঠিকমতই করছে কিন্তু হাসানের কোমড় ধরে গেল, উবু হয়ে কাজ করলেই তার এ সমস্যাটা দেখা দেয়। সে কোমড়ে হাত দিয়ে শরীর বাকিয়ে, মাথা পিছনে নিয়ে ধনুকের মত কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল, এতে আরাম হয়। আবার কুপানো শুরু করল, আবার ধনুকের মত দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের দু’টি পতিত ভিটা আছে, একটা বাড়ির দক্ষিনে একটা পুর্বে। তারপর কিছুক্ষণ কোপায় আর কিছুক্ষণ দক্ষিন ভিটায় গিয়ে বিশ্রাম করে। এভাবে ঘন্টা দুয়েক পর সে অচল হয়ে পড়ল, শরীর কাঁপছে। সে কোদালটা কাঁধে নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিল। কিন্তু মনে হচ্ছে তার শরীরটা যেন একটা জাহাজ, ভীষণ ভারি, অতি কষ্টে চলছে, শরীরে কোন অনুভূতি নাই। পা দু’টি যেন হাতির পা, শুধু মাটির পরশে পায়ে শির শির একটা অনুভূতি জাগছে। বাড়িতে গিয়ে ধপ করে মায়ের খাটের কিনারায় বসে পরে বলল, ‘আই আক্ষেম, আমাকে দিয়ে কাজ করাতে চান, আমি শেষ, মনে হয় এক সপ্তাহের মধ্যে আর উঠতে পারব না। এখনো তার শরীর কাঁপছে। অল্পক্ষণেই মা দুধ গরম করে আনলেন, সে দুধুটুকু খেয়ে একটা বালিশ টান দিয়ে খাটের আড়াআড়ি শুয়ে পড়ল। কাদা মাখা পা খাটের বাইরে। আশ্চর্য্য, পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল।
বারটায় ঘুমাল তিনটার দিকে মা ডেকে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি উঠ, নামাযের সময় গেল। সে উঠে বসল কিন্তু বুঝতে পারছে না, এটা কি তার শরীর, নাকি হাতির শরীর, নাকি একটা জাহাজ। চিমটি কাটল, সঠিক অনুভূতি আছে বলে মনে হল না। খাট থেকে নামতেই মনে হল টাল খেয়ে পড়ে যাবে, পা দুটি ফুলে গেছে, যেন হাতির পা, দেহের ভার বইতে পারছে না। আস্তে আস্তে কিছুক্ষণ পা ফেলে পুকুরে চলে গেল, কিছুক্ষণ সাতার কাটল, শরীরটা বেশ চাঙ্গা মনে হচ্ছে, বহুদিন পর সে ক্ষুধা অনুভব করল, প্রচন্ড ক্ষুধা। নামাযের পর খেতে বসল, স্ত্রী যাওয়ার পর এই প্রথম সে দশাসই এক খান খাওয়া দিল। তারপর কিছুক্ষণ ঘোরাফিরা করল, শরীরটাতে যেন নতুন শক্তি সঞ্চয় হয়েছে। বাহু দু’টি নাড়িয়ে ভাবল, এবার আমি কোদাল মেরে পাকা রাস্তা ভেঙ্গে ফেলতে পারব। আসলে বহু বছর পর হঠাৎ কাজ করতে গেলে এমনটা হয়, শরীর বিকল হয়ে যায়।
বিকালে বাজারে চলে গেল। বাবার কবরে গিয়ে সুরা ফাতেহা, ক্বুল হুওল্লাহু তিনবার, বাকী দুই ক্বুল ও দুরুদ পড়ে বাবার জন্য, শ্বশুরের জন্য, দুই বোনের জন্য তারপর সকল আত্মীয় অনাত্মীয় মুর্দাদের জন্য দোয়া করল। তারপর বলল, ‘আব্বা, আমার কী হবে আব্বা, আমার স্ত্রী সন্তান অথচ আমি জানি না তারা কোথায় আছে, কেমন আছে। আল্লাহ্র কাছে দোয়া করেন, তিনি যেন উত্তম ফয়সালা করে দেন- আমার জন্য কল্যাণকর ফয়সালা, আমি যেন শীঘ্রই তাদেরকে ফিরে পাই। বাবার কবরের উপর পরে অনেক কাঁদল। তারপর মাগরিব থেকে এশা পর্যন্ত চেষ্টা করল পীর সাবের সাথে সাক্ষাৎ করে গোপনে তার বিষয়টা জানানোর জন্য, কিন্তু সম্ভব হলনা, অনেক ভিড়। সে বাড়িতে চলে গেল। রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর ঘুরতে বেরিয়ে পরল। চাঁদনি রাত, বোরো লাগানোর পূর্ণ মওসুম, মানুষ রাত দিন কাজ করছে, ট্টাক্টরে জমি চাষ করছে, পানি তুলছে। মাঠে শুধু তাদেরই মোটর আছে, অন্যরা স্যালু মেশিনে ডিজেল দিয়ে পানি তুলছে, সর্বত্র একটা হৈ হুল্লোর আনন্দ উৎসবের আমেজ।
মাধবি রাত, হাসান ঘুরতে ঘুরতে দক্ষিণ মাঠে চলে গেল। মাটি শুকানোর জন্য আগেই জমি চাষ দিয়ে রাখা হয়, তা শুকিয়ে চুনের মত সাদা হয়ে যায়। তখন জমিতে পানি তোলা হয়, মাটি চুনের মত গলে ফেনা উঠতে থাকে, ফেনায়িত সমুদ্রের মত তা পানির উপর ভাসতে থাকে। মাটি ঈষৎ কৃষ্ণ বর্ণ ধারণ করে। দেখেই বুঝা যায়, এই মাটি সোনা ফলাবে। পানি থৈ থৈ করে, হাসান ক্ষেতে নেমে পরে, ভর ভর করে কাঁদায় পা ঢুকে যায়, পাদবিক্ষেপে পাতলা কাদা পায়ের সাথে ঢেউ খেলে। সে আনন্দাভিভুত হয়ে পরে, ‘এই মাটি আমার সোনার বাড়া, এই মাটি সোনার মাটি, এই মাটি সোনা ফলাবে। খাটি সোনার চাইতে খাটি, সে যে আমার দেশের মাটি। এই মাটির কঠিন বুক চিরে ফলিয়েছি সোনার ফসল, প্রতিপালন করেছি একটা ইয়াতিম পরিবার, উন্নতি করেছি তাদের জন্য। আমি এই মাটির সন্তান, আমি সোনার সন্তান। হাসান আবেগ তাড়িত হয়ে উঠে, সে দুই হাত মেলে দেয়, মুক্ত বাতাসে ছাতি ফুলিয়ে নিঃশ্বাস টানে, প্রতিটা নিঃশ্বাসে বুঝি একটি করে রোগ বালাই ধ্বংস, এক বছর করে আয়ু বাড়ে, সকল ঔষধের মহৌষধ।
পরদিন সকালে খাওয়া দাওয়ার পর মা আবার কোদাল দিয়ে বললেন, ‘যা কাজ কর গিয়ে, তাহলে ঠিকমত খেতেও পারবে, ঘুমও হবে। তারপর দেখবে কয়েকদিনে তোর স্বাস্থ্য ঠিক হয়ে গেছে। সে কোদালটা কাঁধে নিয়ে বাখখা একখান কৃষক সেজে বেরিয়ে পরল। আজ আর দক্ষিন মাঠে না গিয়ে বাড়ির মাঠে থাকল। বাড়ি থেকে অনেকটা পুর্ব পর্যন্ত এক নাগাড়ে তাদের জমি। সে পুর্বের ভিটার পুব পাশের জমিগুলিতে চলে গেল। এ মাঠের ড্রেইন ঠিক আছে, ক্ষেতের আল বা আইল ছাটাতে হবে। গ্রামের ধার্মিক ও মুরুব্বী সাইজের লোকেরা যখন কাজ করে- তারা ফরয তরক হবে বলে কখনো নেংটি মারে না। তারা হাটুর নীচে দুই পায়ের মাঝে লুঙ্গির দুই প্রান্ত গিট্টু মারে- যাতে ফরয তরক না হতে পারে। কিন্তু হাসান গিট্টু মেরে কাজ করতে পারে না, দুই পা জড়িয়ে যায়। সে হাটু বরাবর লুঙ্গি পরে কাজ করে।
সে আল ছাটানো শুরু করল। আলের পার্শ্বে যে কান্দিটা, এটা হল আসল আল। আর ঢালুটুকু বর্ষাকালে আলের মাটি ভেঙ্গে তৈরি হয়, তার উপর ঘাস বেধে ক্ষেত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। তখন এই ঢালু অংশটুকু কেটে ঘাস মাটি আলে তুলে দিতে হয়, সংলগ্ন ক্ষেত থেকে আলে আরো মাটি দিতে হয়। বছরে দুইবার ফসল রোপণ করা হয়, দুইবার আল ঠিক করা হয়। সে কিছুক্ষণ কুপিয়ে কোমর ধরে ধনুকের মত বেকে দাঁড়িয়ে থাকল। আরো কিছুক্ষণ কুপিয়ে পুবের ভিটায় গিয়ে বিশ্রাম করল। তারপর কিছুক্ষণ কুপিয়ে ধনুকের মত দাঁড়িয়ে থাকে বা ভিটায় গিয়ে বিশ্রাম করে। ক্লান্তিতে তার শরীর কাঁপছে, বারোটার দিকে সে বাড়িতে চলে গেল। মা তাড়াতাড়ি দুধ এনে দিলেন, খেয়ে সে মায়ের বিছানাতেই ঘুমিয়ে পড়ল। ধূলা বালি যুক্ত পা খাটের বাইরে।
বোরো মৌসুমে কৃষকদের নিয়ম হল, জালা (ধানের চারা) তুলে মুঠি মুঠি করে খড় দিয়ে বেধে পুকুরে রেখে দেয়। তখন দুই তিন দিনে নতুন শিকড় গজায়। তারপর এই জালা নিয়ে রোপণ করা হয়। হাসানদের পুকুরে এক পাশে পানির উপর একটা বাঁশ ফেলে বেড়া দিয়ে তার মধ্যে জালা রাখা হয়। সে ঘুম থেকে উঠে গোসল করতে গিয়ে দেখে একটা গরু হাটু পানিতে নেমে জালা খাচ্ছে আর মোঠাগুলি খুলে ছড়িয়ে যাচ্ছে। দৌড়ে গিয়ে গরুটিকে তাড়াল। কিন্তু জালার মুঠি বাধতে গিয়ে দেখে প্রতি বছরের মত এবারও জালার গোড়ায় কার্প মাছে ডিম দিয়ে ভরে রেখেছে। সে জানে, কোন লাভ নেই কিন্তু এবারও পাগলামি করল। পুকুরের পাশে একটা পগার আছে, কিছু মোঠা নিয়ে সেই পগারের পানিতে ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে ডিম ছাড়ল। কিন্তু এগুলি ফোটে না, ফুটলেও পোনা থাকে না। বিকালে বাজারে গিয়ে বাবার কবর যিয়ারত করল।
রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর মা বললেন, ‘তুই বিলে যা তো, রাত বারোটা পর্যন্ত পাহারা দিয়ে মাছ নিয়ে আসবি। চোরেরা সব মাছ নিয়ে যায়। মা দশাসই একটা বালতি এনে দিলেন। সে গায়ে চাদর জড়িয়ে বালতিটা নিয়ে বিলের দিকে চলল। শালজান বিল, বাড়ি থেকে ঈশান কোণের দিকে আধা কিলো বা তার চেয়েও কম। এখানে তাদের বার একর জমি। সোজা করে পাড় তোলার জন্য আশা পাশ দিয়ে আরো কিছু জমি কিনতে হবে। তারপর সবটা মিলে একটা পুকুর দিবে, মাত্র একটা পুকুর, সবাই এটাকে বলবে সাগরদীঘি। এর বিশাল পাড় জুড়ে বিভিন্ন ফল-ফলাদি, কাঠ ও ঔষধি গাছ লাগাবে, আম কাঁঠাল লিচু ও কলা বাগান করবে, বিভিন্ন জাতের ফুলগাছও থাকবে। আনন্দে তার চোখ চকচক করে উঠে, একদিন চাঁদনি রাতে সে বউ বাচ্চাকে নিয়ে এখানে ঘুরতে আসবে, তার বউ বাচ্চা বিভিন্ন ফল ফলাদি পেরে খাবে, ফুল তুলবে, কলকাকলিতে বাগানটা ভরে তুলবে। তখন সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে দু’হাত আকাশে মেলে ধরে বউকে ডেকে বলবে, ‘এই শুনছ, শুনছ আমি আলেকজান্ডার। না, তার চেয়েও বড় বিজেতা। আরে আলেকজান্ডার তো বিশাল বাহিনী নিয়ে ভূমি জয় করেছিল কিন্তু আমি একা, শুধুই একা, এই দু’টি হাতে খেটে খুটে বাবার বিশাল সংসার চালিয়ে এই ভূমিরাজ্য জয় করেছি। এখানে আব্বার জমি ছিল মাত্র আট কাটা (চৌষট্টি শতাংশ)। আজ এখানে বার একর জমি, এই জমি আমি নিজ হাতে কিনেছি, একটি একটি পয়সা গুনে গুনে কিনেছি। সংসার সমরাঙ্গনে আমি আলেকজান্ডারের মত বিজেতা।
সাধারণত পানি দেয়ার সুবিধার্থে বিল পাড়ে বা নদীর ধারে পানির কাছে বোরো জালা পাট (বীজতলা) করা হয়। এ বিলের ধারেই গ্রামের মানুষের জালা পাট। চাঁদনি রাত, কামলারা রাতে জালা ভাঙ্গে (চারা তোলা) আর দিনে রোপণ করে। দিনের মত রাতেও বিলে মানুষের হৈ চৈ। জালা তোলা, ট্রাক্টরে ক্ষেত চাষ, পানি তোলা, মাছ মারা, সব দিক দিয়েই মানুষের ব্যস্ততা, কোলাহল, আনন্দ মুখোর পরিবেশ। মানুষের কর্ম তৎপরতা রাতের নির্জিবতাকে দিনের মত সজীব করে তুলেছে। শুল্কাপক্ষ, চাঁদের ঈষৎ লালাভ মিষ্টি আলোতে ভুবন প্লাবিত হচ্ছে, হালকা কুয়াশায় প্রকৃতি ধোয়াশাচ্ছন্ন। হাসান চাদর গায়ে বালতি হাতে মাঠের কোনা কোনি চলছে। পায়ের তলায় শুকনো মাটির চাকা (বড় ঢেলা) ঝোড় ঝোড় করে ভেঙ্গে যায়, পায়ে সুড়সুড়ি লাগে আরাম লাগে, তুলতুলে মাটি, হাটতেও আনন্দ। তবে কোন কোন মাটি এটেল, চাকা শক্ত, পায়ে ব্যথা লাগে, তখন নিরানন্দ। কামলারা তাদের জালা ভাংছে। তিন থেকে চার আঙ্গুলে কয়েক গাছি জালা ধরে তারপর বাম হাতটা ডান মুঠির উপর রেখে জালা টান দিয়ে তুলে। এভাবে আধা মুঠি হলে বাম হাতের তালু খাড়া করে গাদার উপর জালার গোড়া বারি দিয়ে বা মেরে শুকনো ঝুড়ঝুড়ে মাটি ছারিয়ে নেয়। তারপর এক মুঠ জালা হলে খড় দিয়ে পেছিয়ে মুঠি বাধে। তারা হাসানদের বাড়ি থেকে অনেকগুলি খড়ের আটি নিয়ে এসেছে। প্রত্যেকেই পিড়ির ন্যায় পাছার নিয়ে একটা করে আটি দিয়ে বসে জালা ভাঙ্গে, আর কিছু আটি পরে আছে এগুলি দিয়ে আগুন তাপাবে।
দুয়েকজন বসে বসে আগুন তাপাচ্ছে, হাসান বালতিটা রেখে চাদরটা ভাল করে সামলিয়ে আগুনের ধারে বসল। কামলারা একেক জন উঠে আর, ‘বাপরে, ঠাণ্ডায় আত টোন্ডা অয়া গেছে (হাত আড়ষ্ট হয়ে গেছে)’ বলতে বলতে আগুনের ধারে এসে বসছে। মাছের আলাপ উঠল। হাসান জিজ্ঞেস করল, বিলে কেমন মাছ আছে। তারা বলল, এখন কি আর আগের মত মাছ আছে। তারপর আগে কে কেমন মাছ মারত আলাপ শুরু হল। হাসানও নিজের মাছ মারার অতীত ইতিহাস বয়ান শুরু করল, ‘দক্ষিন মাঠের খালের সাথে আমাদের সবচেয়ে নিচু ক্ষেতটার পাশে ঐ খালে প্রতিবছর বাঁধ দিতাম বানা দিয়ে (বাঁশের শলাকা দ্বারা নির্মিত নেট)। ভাদ্র থেকে কার্তিকের শেষ পর্যন্ত মাছ মারা হত। এই মাছ জিইয়ে রেখে মাঘ মাস পর্যন্ত খাওয়া হত। তারপর শুরু হত বিলের মাছ মারা। এই মাছ জিইয়ে রেখে চলত আরো কয়েক মাস।
আব্বা তখনো বেঁচে আছেন, একদিন সন্ধ্যার সময় আমাদের কামলা হেলিম সেই বাঁধ থেকে পাগলের মত ডাকতে লাগল। আমি কিছুটা এগিয়ে গেলে সে বলল, একটা বালতি আর বাটি নিয়ে যেতে। এগুলি নিয়ে দৌড়ে গেলাম, দেখে তো আমার মাথা ঘুরিয়ে পরে যাওয়ার অবস্থা, উচা (মাছ গড়িয়ে পড়ার ফাদ) ভর্তি হয়ে উপছে মাছ গড়িয়ে পরছে। কৈ শিং মাগুর শৌল লাটি ইত্যাদি মাছ আল গড়িয়ে গড়িয়ে ভাটিতে যাচ্ছে অর্থাৎ এ রাতটা ছিল মাছের ভাটির রাত। ক্ষেত-খলার পানি কমে গেছে, এখন তারা ভাটিতে গিয়ে কোন জলাশয়ে আশ্রয় নিবে। মাছ সাধারণত বৈশাখ মাসে উজিয়ে যায় আর কার্তিক মাসে ভাটিতে যায়। হেলিম উচায় বাটি খেউ দিয়ে দিয়ে বালতি ভর্তি করে দিল, আমি নিয়ে দৌড়লাম বাড়িতে। আরেকটা বালতি নিয়ে এলাম, খালি বালতি দিয়ে ভরা বালতি নিয়ে যাই, ভরা বালতি নিয়ে খালি বালতি দিয়ে যাই। এভাবে টানা প্রায় ঘন্টা তিনেক চলল মাছ নিয়ে পারাপার। আর রাতের মাছ সাধারণত হয় কৈ শিং মাগুর শৌল টাকি এ জাতীয় দামি মাছ। বাড়ির হান্ডি পাতিল কোনটাই খালি নাই, মাছ ভর্তি। তার উপর উঠানে মাছের স্তূপ, গড়িয়ে গড়িয়ে এদিক সেদিক যাচ্ছে। অগত্যা কি আর করা, ঘরের সামনে উঠানে এক মানুষ পরিমান কোয়া খনন করে তাতে মাছ জিইয়ে রাখলাম। পরেও আরো মাছ মারা হল, এ মাছ কয়েক মাস চলল।
তখন আব্বা নাই, রোযার ঈদের দিন। কামলাটা সকালে বাড়ি ঘর পরিস্কার করে তাদের বাড়িতে চলে গেল। গ্রামের ঈদের নামায সাধারণত দশটা থেকে এগারটার মধ্যে পড়া হয়। সকাল নয়টায় ভাবলাম গোসলের আগে একটু বাধটা দেখে আসি। যাওয়ার পথে বাধের আগের ক্ষেতে যেখান দিয়ে পানি নামছে সেখানে দৃষ্টি গেল। চোখ তো ছানাবড়া। পানি দেখা যায় না। শুধু মাছ আর মাছ, মনে হচ্ছে প্রতিযোগিতা করে গড়িয়ে নামছে। ভাল করে দেখার জন্য আরেকটু অগ্রসর হলাম কিন্তু চমকে উঠলাম। অন্তত পাঁচ ছয় হাত লম্বা একটা সাপ, এত বড় সাপ আমি জীবনে দেখিনি। শুনেছি দুমুখো নাকি সাপ আছে, এ সাপটাকে দুমুখো মনে হল। সে মাছ ধরে ধরে গোগ্রাসে খাচ্ছে। ভয়ে গা শিউরে উঠল তাড়াতাড়ি চলে গেলাম। বাধে গিয়ে উচার নিকট একেবারে হামাগুড়ি দিয়ে বসে পরলাম। কারণ উচা উপছে মাছ গড়িয়ে পরছে। লাফালাফি করে আল ডিঙ্গিয়ে যাচ্ছে। খালি হাতে গিয়েছিলাম, লুঙ্গিতে যতদুর নেয়া সম্ভব নিয়ে দৌড়লাম বাড়িতে। বালতি নিয়ে এসে শুরু হল মাছ নিয়ে দৌড়াদৌড়ি। আমি একা, কামলাটা বাড়িতে গেছে, ভাইয়েরা সব ছোট। কিসের ঈদ, জহুর পর্যন্ত একটানা কুলির মত মাছ টানলাম। দিনের বেলার মাছ সাধারণত পুটি ও এ জাতীয় ছোট মাছ। গ্রামে সাধারণত মাছ কেটে ভাল করে ধোয়ে শুটকি দেয়া হয় কিন্তু আজ সে সুযোগ ছিল না। আমি বালতিটা নিয়ে ধাড়ির উপর (ধান শুকানোর ছাটাই) ঢেলে দিতাম। আম্মা সেগুলি শুকানোর জন্য ছড়িয়ে দিতেন। আশা পাশের সবাই মাছ নিল। আর বাড়িতে চাটাই পাটাই যা ছিল সব শুটকি মাছে ভর্তি। তখন মাছ বেচার নিয়ম ছিল না। বাড়িটা মাছের গন্ধে বিষময় হয়ে উঠল।
আব্বা থাকতেই বিলের সবচেয়ে নিচু ক্ষেতটা সেচ দিয়ে মাছও ধরতাম রোয়াও বপন করা হত। এ ক্ষেতটা সব সময় ছিল মাছের খনি। একবার আধা সেচ দিয়ে রাখলাম, সন্ধ্যায় ভাবলাম, এ সময়টা তো মাছ লাফিয়ে বা আল বেয়ে চলে যাওয়ার সময়, একটু দেখে আসি। ক্ষেতটার উত্তরাংশ ছিল উঁচু, আধা সেচের কারণে সে অংশটা শুকনা ছিল, আবার সেদিকের আল ছোয়ে ছোয়ে পানি আসছে। মাগরিবের পর গিয়ে দেখি শুকনা দুই কাটা (১৬ শতাংশ) পরিমান জায়গায় মাটি দেখা যায় না, শুধু কৈ শিং মাগুর শৌল ইত্যাদি মাছ, কাল হয়ে আছে, লাফিয়ে, আল গড়িয়ে যাচ্ছে। কি আর করব, এত মাছ ধরা তো সম্ভব নয়। আলের পাশ দিয়ে আনাগুনা করে কাদা ছিটিয়ে মাছগুলি ক্ষেতের পানিতে হাকিয়ে নিলাম। পরদিন বাকিটা সেচ দিয়ে মাছ ধরলাম। বর্তমান বাজার অনুযায়ী এ মাছ ন্যুনতম পঞ্চাশ হাজার টাকা তো অবশ্যি হবে। জিইয়ে রেখে কয়েক মাস চলল। আগে আমাদের একেকটা মান্দার যখন সিচা হত তখন গোরা (ছোট) মাছই পাওয়া যেত বিশ ত্রিশ খাচা, একেকটা বোয়াল পাওয়া যেত মানুষের মত বড়, শিং মাগুর কৈ পাওয়া যেত দশ পনের খাচা, শ দুয়েক শৌল পাওয়া যেত, এখন আর সেই দিন কোথায়। আজ কালের পোলাপানরা শুনলে বলবে আদি প্রস্তুর যুগের কল্প কাহিনী।
একজন বলল এখনো কিছু মাছ আছে। এই বিলে আপনাদের যে এড়িয়া, এর মাছ বেচে অনেক টাকা ইনকাম করা যায় কিন্তু আপনের ভাইদের মত অকর্মন্য আর দুনিয়াতে দেখি না। তারা কিছু ক্ষেত অল্প কয়েক টাকায় বিক্রি করে দেয় (পানির নীচের মাছ), আর কিছু ভাগে দেয় কিন্তু ভাগিদাররা সব মাছ চুরি করে নিয়ে বিক্রি করে দেয়, আপনাদের দেয় ছোলাটা। আর কয়েকটা ক্ষেত নিজে রাখছে কিন্তু বাইর (বাশের শলাকা দিয়ে তৈরি মাছ ধরার যন্ত্র) যা পেতেই রেখেছে, এসে দেখেও না, মানুষ নিজের মনে করে তুলে মাছ নিয়ে যায়। অথচ সব মাছ দেখে শুনে নিজেরা মারলে অনেক ইনকাম করা যেত। একজন বলল, ‘ওরা তো কিছুই করে না, সংসার তারা চালায় না এমনিতেই চলে। আমি ওদেরকে মাঝে মধ্যে কই, ‘বাপ- ভাইয়ের কামাই পাইছ তো গোয়ারের মত চললা, এত এত জমি না থাকলে তোমরা কুড়া খাইয়াও দিন পার করতে পারতা না। একজন জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা আপনে যে শহরে থাকেন গ্রামের মত এমন মাছ টাটকা তরি- তরকারি পাওয়া যায়? হাসান বলল, ‘আরে না, শহরে এত মাছ আর টাটকা জিনিসের তো কল্পনাও করা যায় না। সেখানে যা পাওয়া যায় সব পচা বাসী আর ভেজাল খাদ্যের সয়লাব। আসলে নগর সভ্যতাটাই খারাপ জিনিস, এটা একটা দাজ্জালি ব্যবস্থাপনা। কামলারা কথাটা বুঝল না, সে কথাটা বুঝিয়ে বাইর তুলতে উঠে গেল।
বিল পাড়ের উচু জমিগুলিতে তখন ধান লাগানো হচ্ছে, মূল বিলে এখনো অনেক পানি। এসব জমি অগ্রহায়ণ বা পৌষ মাসে বিলের কচুরিপানা দিয়ে আল উচু করে বেধে আটকিয়ে মাছ মারা হয়। তারপর পানি কমলে মাঘের শেষ বা ফাল্গুনের প্রথমে ধান লাগানো হয়। কচুরিপানা তুলে আল উচু করে রাখা হয়েছে, হেটে গেলে স্প্রিংয়ের মত কচুরিপানা ঝাম করে আর দুদিকে দুলতে থাকে। তখন শরীরের টাল না সামলাতে পারলে কাত বা চিত হয়ে একেবারে কোমর বা বুক পানিতে। দিনের বেলা একবার সে মাছ নিয়ে গেছে কিন্তু আল কোথায় জটিল তার খেয়াল নেই। এক জায়গায় গিয়ে আলের একপাশে পারা পরতেই কচুরিপানা দুলতে লাগল, সেও শরীর দুলাতে লাগল কিন্তু টাল সামলাতে না পেরে ঝপাং করে গিয়ে পানিতে পরল। চাদর লুঙ্গি গায়ের ঝাম্পার সব ভিজে লোটোপুটি। হঠাৎ জোকের কথা মনে হতেই তার আত্মা ধক করে উঠল। ছিটিয়ে উঠে আলে দাঁড়িয়ে সারা শরীর হাতরাল। না, এত তাড়াতাড়ি জোকে ধরতে পারেনি। সে বেচারা জোককে এত ভয় পায় যে বাঘ সিংহ সাপকেও মানুষ এত ভয় পায় না।
সে চাদর ও ঝাম্পার ছিপে কাঁধে রাখল। শীতে শরীর থরথর করে কাঁপছে। তাড়াতাড়ি গেল বাইর তুলতে। একেকটা বাইর পানি থেকে উপড়ে তোলে, হঠাৎ পানি শুন্য হয়ে মাছগুলি লাফাতে গিয়ে পরস্পরের গায়ে লেগে চরচর চরচর রব উঠে যায়। কোন বাইর অর্ধেক, কোনটা কিছু কম, কোনটা প্রায় মাছে ভর্তি। তারপর বাইর পাতল, ফোমের মত নরম কচুরিপানার শিকড় দিয়ে বাইরের নিচের ফাক ফোকর বন্ধ করল, নচেৎ সেদিক দিয়ে মাছ চলে যায়। এভাবে সাতটা বাইর তুলল। মাছে বালতিটা পূর্ণ ভরে গেছে, লাফিয়ে লাফিয়ে পরে যাচ্ছে। হাসান কচুরিপানা দিয়ে বালতির মুখ বন্ধ করে দিল। তারপর সোজা বাড়ির দিকে দৌড় লাগাল।
শীতে তার শরীর কাঁপছে, দাঁতে দাঁতে বারি লাগছে। কিন্তু বালতির ওজনে ও দ্রুত হাটার কারণে শীত অনেকটা কমে এসেছে। বালতি এত ওজন যে শরীর টানা দিয়ে তা বহন করতে হচ্ছে, আর ঘন ঘন হাত বদলাতে হচ্ছে। একবার মন চাইল কামলাদের কাছে গিয়ে আগুন তাফাতে কিন্তু তারা হাসাহাসি করবে বলে যায়নি। বাড়িতে পৌছতেই কাক ভেজা দেখে ভাইয়েরা হাসল। মা, ‘তোরা কাজের না রে, বেহুঁশ মানুষ’ তিরস্কার করতে করতে শুকনা কাপড় এনে দিলেন আর খড় দিয়ে আগুন ধরে দিলেন। হাসান বসল। উঠানের এক কোণায় গর্ত করে পানি দিয়ে মাছ জিইয়ে রাখা হয়, প্রচুর মাছ। দিনের বেলায় বাইরে পুটি জাতীয় কম দামি মাছ বাজে। কিন্তু রাতের বেলা শিং মাগুর কৈ চিংড়ি গুতুম চিকরা (বাইন মাছ) ইত্যাদি ভাল ভাল মাছ পাওয়া যায়। গর্তে মাছ জিইয়ে জিইয়ে মা ছেলেদেরকে বকছেন, ‘কত করে বললাম মাঝরাতে একবার গিয়ে বাইর তুলে আন, আমার কথা শুনিস না। একদিনও তো রাতে এত মাছ আনতে পারিস না, সব মাছ চোরের পেটে যায়।
এসব মাছ দিয়ে ভাজি, পেঁয়াজ দিয়ে শুকনা, চরচরি, ঝুল ইত্যাদি পাঁচ ছয় জাতের তরকারি রান্না করা হয়। মা বাটি দিয়ে নয়, ছোট ডিশ বা বড় বড় বাটি ভর্তি মাছ দিয়ে বলেন, ‘এই সবগুলি খা। তখন হাসান ভাত কি খাবে, বসে বসে খালি মাছ খায়। বিলের মাছ, টাটকা মাছ, পাতিলে দেয়ার সময়ও লাফালাফি করতে থাকে, এই মাছের স্বাদ অতুলনীয়। মাছের স্বাদে হাসানের প্রতিবার খাওয়া বেশি হয়ে যায়।
একটা রুটিনের মধ্য দিয়ে তার দিনগুলি কেটে যাচ্ছে। সকালে খাওয়ার পর মাঠে গিয়ে কাজ করে। দুপুরে ঘুমায়, বিকালে বাজারে গিয়ে বাবার কবর যিয়ারত করে, দোয়া করে দোয়া চায়। রাতে খাওয়ার পর বিলে গিয়ে বারটা পর্যন্ত মাছ পাহারা দেয়। তারপর তাহাজ্জুদ পরে ও দোয়া ইউনুস পড়ে ঘুমিয়ে পরে। খাওয়া ও ঘুমের কোন ব্যাঘাত হচ্ছে না।
হাসান এক সপ্তাহ চেষ্টা করেও পীর সাবের সাথে কথা বলতে পারল না। তিনি জিনে ধরা রোগীদের চিকিৎসা করতেন। সারা দেশের রোগীরা এখানে এসে ভিড় করত। তাছাড়া তিনি কওমী ধারার মাদরাসা গুলির মুরুব্বী ছিলেন, বিশেষত সিলেটের বিখ্যাত আলেম নুরুদ্দিন গওহর পুরির (রহঃ) মৃত্যুর পর তিনি সিলেট থেকে রাজশাহী পর্যন্ত দেশের উত্তরাংশের প্রধান মুরুবি হিসাবে পরিগণিত হন। কোন মাদরাসার মোহতামিম (অধ্যক্ষ) দরকার, শায়খুল হাদীস দরকার, কোন মাদরাসার গন্ডগোল ইত্যাদি সকল সমস্যা সমাধানের জন্য লোকেরা এখানে আসত। তাছাড়া তার মুরিদ ও ছাত্ররাও দেখা সাক্ষাৎ ও ফয়েজ-বরকতের জন্য আসত। এ জন্যই তার সাথে নিভৃতে কথা বলার সময় পাওয়া যেত না। অবশেষে হাসান সিদ্ধান্ত নিল তিনি মাগরিব বা এশার পর যখন বাসায় ফিরবেন তখন পথে কথা বলবে। একদিন এশার পর মসজিদ থেকে বেরোনোর সময় সালাম দিয়ে বলল, ‘আমি একটু আলাপ করব। তারপর হাটতে হাটতে তার সমস্যার কথা বলল।
স্ত্রীর জটিল অপরাধের কথা না বলে ঝগড়া ঝাটি করা, কাজ না করা ইত্যাদি কমন বিষয়গুলি বলল। হাসান পরামর্শ চাইছে মনে করে তিনি বললেন, ‘এটা তোমার এখতিয়ার, তুমি যদি মনে কর এই স্ত্রী নিয়ে তুমি জীবন কাটাতে পারবা, তোমার ইহকাল পরকালের জন্য কোন ক্ষতি হবে না, তাহলে নিজের স্ত্রীর ব্যাপারে কারো কাছে অভিযোগ করা উচিত না। আর যদি মনে কর তোমার ইহকাল পরকাল নষ্ট হবে তাহলে ইসলাম তালাকের বিধান রেখেছে। তবে মেয়েদের ক্ষেত্রে সব সময় ধৈর্য্য ধরতে হয়। হাসান বলল, ‘না, সমস্যা এটা না, আসল সমস্যা হল তাদের কাছে আমার স্ত্রীর কিছু জটিল অন্যায়ের নালিশ করেছিলাম কিন্তা তারা বিচার না করে উল্টো আমাকে সাল চিল্লার শর্ত দিল। তিনি অবাক হয়ে হাসানের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বউয়ের সাথে সাল চিল্লার কী সম্পর্ক? তুমি যাও, গিয়ে বউকে ফেরত চাও। হাসান বলল, ‘আমি তো চেষ্টা করছিই, লোকও লাগিয়ছি কিন্তু তারা তো আমার কথা শুনে না। তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে আমি যখন জামালপুর যাই তাদেরকে সাক্ষাৎ করতে বলো। হাসান বলল, ‘এরা যে অহংকারী, আপনার কাছে আসবে না। তিনি বললেন, ‘আচ্ছা তাহলে আমাকেই তাদের কাছে নিয়ে যেও। হাসান আশান্বিত হল, আনন্দচিত্তে বাড়িতে ফিরল। কারণ পীর সাব বললে তারা আর তার বউ আটকে রাখতে পারবে না। গ্রামীণ পরিবেশ, গৃহস্থালির ব্যবস্থাপনা, মাছ মারার নেশা ইত্যাদি কর্মব্যস্ততায় তার স্ত্রী সন্তানের শোক অনেকটা লাঘব হয়ে এল। ঘুম ও খাওয়া দাওয়া ঠিকমত হল। আর এ সময়ে তার আগের স্বাস্থ্য ফিরে এল। সে বাড়িতে বিশ দিন থাকল তারপর বাসায় চলে গেল।
বিষয়: সাহিত্য
১৫৭১ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন