চিঠি- ৪৩ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ০৪ অক্টোবর, ২০১৬, ১১:০৩:৩০ সকাল
হাসান নিসঙ্গতা অনুভব করে, বাসায় একাকিত্ব ভাল লাগে না। অধিকাংশ সময় বাইরে ঘুরাফিরা করে ও বন্ধু বান্ধবের সাথে গল্প-গুজব করে সময় কাটায়। খাওয়া ঘুম অনিয়মিত হয়ে পড়ে, গ্যাস্ট্রিক বাড়তে থাকে, বাসার জিনিসপত্র অগোছালো বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে থাকে। সেই সাথে তার মনে একটা অপরাধবোধ প্রকট হতে থাকে। তারা শর্ত দিয়েছিল এক সাল লাগাতে, মা বলেছিলেন সাল না লাগালেও অন্তত দুই তিন চিল্লা দিতে। অথচ সে এক দম চিল্লায় না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছে। দেওবন্দি ধারার লোকেরা তাবলীগ ও চিল্লাকে পুণ্য কাজ ও ভাল কাজ মনে করে। কাজেই তার মধ্যে কিছুটা অপরাধবোধ জেগে উঠে। সে ভাবে চিল্লায় না গিয়ে কি কিছু অন্যায় করছি? কেন অন্যায় হবে, এটা তো রাসূল (সাঃ) প্রবর্তিত কোন পদ্ধতি নয়। অশিক্ষিত লোকেদের নামায রোযা ইত্যাদি শিখার জন্য মুরুব্বিরা একটা পদ্ধতি প্রবর্তণ করেছেন। এটাকে আবশ্যিক মনে করলে তো বিদআত হয়ে যাবে, গুনাহ হবে। এটা ইসলামের বাধ্যতামূলক কোন বিষয় নয়, ফেরদৌসীদের মত অশিক্ষিত লোকদের ইসলাম শিখার জন্য উপকারি একটা ব্যবস্থা মাত্র।
চিল্লায় গিয়ে এ দীর্ঘ সময় আমি কি করব, এখানে তো আমার শিখার, জানার বা আমার আত্মার খোরাক যোগাতে পারে এমন কিছুই নাই। আবার আমি যে অন্যদের শিখাব সেই সুযোগও নাই। তাবলীগীরা তাদের উসুল ভেঙ্গে কোরআন হাদীস শিখতে চায় না। এমনকি এরা তো এতটাই গুমরাহ হয়ে গেছে যে, ফাযায়েলে আমল ছাড়া কোরানের তা’লীম পসন্দও করে না, হতেও দেয় না। তাছাড়া মসজিদে মসজিদে ঘোরে খাওয়া ঘুমের ব্যাঘাত, এগুলি তো আমার ধাচে একদম সয় না। কাজেই যেখানে আমার আত্মার খোরাক নাই, মনের সারা নাই সেখানে গিয়ে উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হবে। এ ছাড়া তাবলীগই তো এমকাত্র ইসলাম নয়। কেউ এটাকেই একমাত্র ইসলাম মনে করলে তো ঈমান হারানোর সম্ভাবনা প্রবল। এর চেয়ে আমি অন্য ধারায় ইসলামের কাজ করি। হাসান সব সময় ভাবে সে অন্য ধারায় ইসলামের কাজ করবে, কিন্তু কোন ধারায় সিদ্ধান্ত স্থির করতে পারে না। হঠাৎ তার মনে হল সে বালিয়ার পীর সাবের মুরীদ হবে। আসলে তিনি পীর নন, তার আসল পরিচয় হচ্ছে তিনি একজন যথাযোগ্য শায়খুল হাদীস এবং কোরআন হাদীস ও আরবী ভাষা সাহিত্যের এক অনন্য পণ্ডিত ব্যক্তি, একটা চলন্ত বিশ্ব কোষ এবং বাংলার অবিসম্বাদিত বুজুর্গ।
দেওবন্দী ধারার প্রায় সকল শায়খুল হাদীসই আত্মশুদ্ধির প্রক্রিয়ায় পীর হিসাবে খিলাফতপ্রাপ্ত। কিন্তু তারা এই পীর মুরীদিকে ব্যবসা হিসাবে, পেশা হিসাবে, জীবিকার মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেন না বিধায় তাদের তেমন খ্যাতি পরিচিতি গড়ে উঠে না। তাদের হাতে সাধারণত নিজেদের ছাত্র এবং পরিচিত মুষ্টিমেয় লোক মুরিদ হয়ে আত্মশুদ্ধি ও যিকির আযকার শিখে নেয়। তারা কখনো কোন বিদআত, অর্থোপার্জন বা নাজায়েয কাজ করেন না। অথচ এ পীর মুরীদি নিয়ে আহলে হাদীস, সালাফি ও অন্যরা দেওবন্দীদের সাথে সাংঘর্ষিক অবস্থানে চলে গেছে। রাসূল (সাঃ) বায়াতে আকাবা, হুদায়বিয়া ও অন্যান্য সময় বাইয়াত গ্রহণ করেছেন। কাজেই একটি জায়েয বিষয়ের জন্য তারা ফিরকাবাজির মত হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে গেছে। যদিও তাদের আকিদা বিশ্বাসগত কোন ফারাক নাই। এখন এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে ফিরকাবাজির কারণে দাজ্জালের হাতে তারা নিজেরাও ধ্বংস হচ্ছে, ইসলামও ধ্বংস করছে। আর এ জন্য তাদেরকে আল্লাহ্র দরবারে কঠোর জবাবদিহি করতে হবে। বস্তুত কোরআন হাদীসের আরশিতে তারা নিজেদের চেহারা দেখলেই আন্দাজ করে নিতে পারবে- তাদের ঠিকানা কি জান্নাত নাকি জাহান্নাম। এ জন্যই হাসান ফিরকাবাজি দেখতে পারে না, সে প্রত্যেক ফেরকার ভাল কাজগুলি সমর্থন করে এবং করার চেষ্টা করে।
বালিয়ার পীর সাবের মুরীদ হওয়ার জন্য হাসান বাড়িতে চলে গেল। এই পীর সাব ছিলেন তার বাবার সহপাঠী ও সহকর্মী। বাবার মৃত্যুর পর তিনিই ছিলেন তাদের অভিভাবক, তার পরামর্শক্রমেই হাসান সংসার চালাত এবং অন্যান্য কাজকর্ম করত। বাবার সংসার চালিয়েও নিজে যোগ্যরুপে গড়ে উঠার জন্য তিনি হাসানকে সন্তানের চেয়েও অধিক ভালবাসতেন। তিনি ছিলেন বালিয়া মাদরাসার মুহতামিম বা অধ্যক্ষ। মাদরাসার বায়ু কোণে (উত্তর পুর্ব কোণ) এবং বাজার ও মাদরাসার মাঝখানে ছিল তার চেম্বার। এখানে তিনি জ্বিনে ধরা রোগীদের চিকিৎসা করতেন এবং মুরীদ ও ছাত্রদের দেখা সাক্ষাৎ দিতেন। মাগরিবের পর হাসান ও তার সিনিয়র উক্ত মাদরাসার সাবেক দুই ছাত্র মুরীদ হওয়ার জন্য চেম্বারে গিয়ে বসল। পীর সাহেব তাদেরকে তওবা ও এস্তেগফার করালেন, তারপর কাদরিয়্যা, নকশেবন্দিয়া, সোহরাওয়ার্দিয়া ও চিশতিয়া তরিকায় মুরীদ করা হল। তারপর শপথ করালেন, তিনি বলে দিলেন মুরীদরা সাথে সাথে আবৃত্তি করল, আমরা কখনো মিথ্যা বলব না, চুরি-রাহাযানি করব না, যিনা করব না, খুন খারাবি করব না, কাউকে ঠকাব না ইত্যাদি। তারপর বললেন, ‘কিছু দিন পর এসে দ্বিতীয় সবক নিয়ে যেও, পরে ধীরে ধীরে অন্যান্য সবক দেয়া হবে’।
হাসান জানে বাইয়াতের পর পীর সাব টাকা নিবেন না কিন্তু তারা দিতে চাইল। তাই হাসান দিল পাঁচশ, বাকী দুইজনে পাঁচশ দিয়ে মোট এক হাজার টাকা তারা পীর সাহেবকে দিতে চাইল। তিনি হাসলেন, ‘আরে বোকার দল, বাইয়াত করিয়ে টাকা নেয়া জায়েয নাই। তারা বলল বাইয়াতের জন্য না, আমরা চা পান খাওয়ার জন্য দিতেছি। তিনি ছাত্রদের তুই বলে সম্ভোধন করতেন- তোরা এখন মুরীদ না হলে এই টাকা দিতে? কাজেই এটা জায়েয না। তারা আবার বলল, আমরা ছাত্র হিসাবে দিলাম। তিনি বললেন কোন ভাবেই দেয়া যাবে না, একান্ত দিতে চাইলে অন্য সময় অন্য কোন অসিলায় দিতে হবে। হুজরা থেকে বেরিয়ে একজন হাসতে হাসতে বলল, আমরা কি চুরি ডাকাতি, যিনা, খুন খারাবি করি নাকি আমাদেরকে এই শপথ দিয়ে লাভ কি হল? আমি মনে করেছিলাম যিকির আযকার ও বড় বড় অযিফা দেয়া হবে। হাসান বলল, ‘আরে এটা তো প্রথম সবক। আপনি চুরি, ডাকাতি করেন না বটে কিন্তু চুর, ডাকাত, লোচ্চা, মদারুরাও তো মুরীদ হতে আসে, সকলের জন্য তো একই সবক। ভালরা তাড়াতাড়ি সবক শেষ করে খিলাফত পেয়ে যায়, আর মন্দরা জীবনেও পার হতে পারে না। বড় বড় ওযিফা চান, না? কয়েক সবক পরেই বুঝা যাবে মেশিনের অশ্ব পাওয়ার কত’।
এশার আযান হয়ে গেছে, হাসান মাদরাসার পুকুরে অযু করতে গেল। ঘাট পাকা, চামড়ার জুতা, অযু শেষে জুতা পায়ে দিতে গিয়ে পানি নিংড়ানোর জন্য ডান পা ঝাড়া দিল, আর পা-টা উপরের সিড়িতে লেগে বুড়ো আঙ্গুলের নখটা সাথে সাথে উঠে পরল। সে প্রচন্ড আঘাতে মৃদু আর্তনাদ করে উঠল, ব্যথায় ককিয়ে উঠল, নখের তল থেকে গলগল করে রক্ত বেরুচ্ছে। সাথেই বাজার, তাড়াতাড়ি বাজারে গেল, ডাক্তার ব্যান্ডেজ করে কিছু বড়ি দিয়ে দিল। সে রিকশা নিয়ে সোজা বাড়িতে চলে গেল। ‘তারা সাল চিল্লার কথা বলল, আমি তিন চিল্লার কথা বললাম। তুই কারো কথা শুনলি না, চিল্লায় না গিয়ে মুরীদ হতে গেলি। এ জন্যই আল্লাহ্ নারাজ হয়ে তোকে এই শাস্তি দিয়েছেন। হাসান শুয়ে আছে, মা তার পায়ে ও আঙ্গুলে হাত বুলাতে বুলাতে ব্যথিত কণ্ঠে তিরস্কার করছেন। ব্যথায় তাঁতিয়ে থাকা হাসান কর্কশ কণ্ঠে জবাব দেয়, ‘কেন, চিল্লায় যাওয়া কি ফরয নাকি। ওখানে আছেটা কি, ইসলাম মানুষের যে অধিকার দিয়েছে ওরা তা বলে না, যাকাত ও ইনফাকের কথা বলে না, দরিদ্র মানুষের অধিকারের কথা বলে না, ইসলামের ন্যায় বিচারের কথা বলে না, ইসলামের কত সুন্দর বিধান অর্থব্যবস্থা ও বিচার ব্যবস্থা, এগুলি বাদ দিয়ে নিজেদের মন গড়া কিসের ছয় উসুল নিয়ে পরে আছে। যারা তাবলীগকেই একমাত্র ইসলাম মনে করে ওরা তো ইসলাম থেকেই খারিজ হয়ে গেছে, আমি ওখানে মরতে যাব কোন দুঃখে।
মা ফুসে উঠেন- তাবলীগের খারাপ বলবি না, সাবধান। ওখানে হাজার হাজার মানুষ গিয়ে নামায রোযা শিখছে, আমল আখলাক ঠিক করছে। তুইও যা, তোর আমলের অনেক ত্রুটি আছে। হাসান কোন কথা না বলে বিরক্তি নিয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছে। পায়ের ব্যথা ছড়িয়ে পরে সমস্ত শরীরটা ব্যথাতুর হয়ে উঠেছে। সেই সাথে শুরু হয়েছে মনের ব্যথা। কারণ সেও সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেছে যে, চিল্লায় না যাওয়ার কারণে তার উপর এ শাস্তি নেমে আসল কিনা। কাজেই সে সিদ্ধান্ত করে জামাতে যাবে। কিন্তু চিল্লায় যাওয়ার সাহস পায় না। কিছুদিন পর পর তিনদিন, সাতদিন, দশ দিন করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। জামালপুর গিয়ে সে পরিচিত অশিক্ষিত লোকেদের থেকে কিছু লোক জামাতের জন্য গাশত করল- যারা জীবনে কোন দিন হোচট খেয়েও পশ্চিম মুখী পরে না, নামায রোযা কিছুই জানে না। উদ্দেশ্য হল, এ লোক গুলিকে সুরা কেরাত, দোয়া দুরুদ শিখিয়ে সময় পার করা। এ ছাড়া জামাতে তো তার আর কোন কাজ নেই। মারকাযে যোগাযোগ করে জামালপুর থেকে নৈঋত কোণের দিকে কাছাকাছি একটা জায়গায় দশ দিনের জন্য জামাত দেয়া হল।
হাসান প্রতিদিন মাদরাসা করে আবার চলে যায়। জামাতে সময়টা তার ভালই কাটে। কারণ এ অশিক্ষিত লোকগুলি তাকে খুব মানে, যা বলে তাই শুনে। আর তখন সে তাবলীগি উসুল বাদ দিয়ে তাদেরকে সুরা কেরাত ও দোয়া দরুদ শিখিয়ে দশটা দিন ভালরুপেই পার করে দেয়। তারপর মাঝে মধ্যে তিন দিনের জন্য যায়। জামাত থেকে এসে একাকি বাসায় তার ভাল লাগে না, স্ত্রী সন্তানহীন শুন্য ঘরটা হাহাকার করে। সপ্তাহটা সে কাটায় অনেক রাত পর্যন্ত বন্ধু বান্ধবের সাথে আলাপ- সালাপ ও ঘোরাফিরা করে। রাত বারটার পর তাহাজ্জুদে বসে, দোয়া ইউনুস পড়ে, তাসবীহ পড়ে, তারপর পিতা, শ্বশুর ও অন্যান্য মৃত আত্নীয়-স্বজনের জন্য দোয়া করে, তারপর স্ত্রী সন্তানের জন্য দোয়া করে। শেষ রাত্রে ঘুমুতে যায় কিন্তু চোখে ঘুম আসে না, এপাশ ওপাশ করে সময় কাটায়। প্রতি বৃহস্পতিবার বাড়িতে অথবা বোনের বাড়ি চলে যায়। এভাবেই একটা নীড় ভাঙ্গা পাখির মত শুরু হয় তার আওয়ারা জীবন।
প্রকৃতির কানুন, জীব জগতের নিয়ম। কারো বাড়িতে দু’টি বিড়াল থাকলে, একটি মরে গেলে বা গৃহস্থ অন্যত্র ফেলে দিলে অপর বিড়ালটি খানা-পিনা ছেড়ে দেয়, মিউ মিউ করে বাড়ি শুদ্ধু ঘোরে বেড়ায়, কাঁদে, তার সাথীটিকে খোজে ফিরে। দুটি কুকুর থাকলে, একটি কুকুর মরে গেলে অপর কুকুরটি খাওয়া ছেড়ে দেয়। কখনো মৃতবত শুয়ে থাকে, কখনো গ্রাম শুদ্ধু সাথীটিকে খোজে বেড়ায়। কখনো ভর দুপুরে, মধ্যরাতে, নিশীথে অন্তহীন বেদনায় হো হো ডাক ছেড়ে তার শোকের জানান দেয়, সাথীটিকে ডাকে। দু’টি গরু থাকলে, গৃহস্থ একটি গরু বিক্রি করলে বা জবাই করলে অপর গরুটি ঘাস পানি ছেড়ে দেয়, তার চোখ থেকে নাক পর্যন্ত অশ্রুর ধারা নামে, শোকে নিথর মুহ্যমান হয়ে থাকে। দিন রাত হাম্বা হাম্বা করে সাথীটিকে ডাকে, তার দুঃখের জানান দেয়। সমগ্র প্রাণী জগতের মধ্যে এই দৃশ্য বিরাজমান।
বন্য প্রাণীর মধ্যে দু’টি সিংহ, দু’টি বাঘ, দু’টি চিতা, দু’টি ওরাংওটাং থাকলে, একটি সাথী মরে গেলে বা হারিয়ে গেলে অপর সাথীটি ভারসাম্য হারাতে থাকে, দানা পানি ছেড়ে দেয়, সাথীটিকে খোজে ফেরে, আস্তে আস্তে তিলে তিলে পলে পলে সে নিজেকে নিঃশেষ করতে থাকে, আত্মহত্যা করতে থাকে। এক সময় তার নিথর দেহটি খোলা আকাশের নীচে মর্তের পাটাতনে পরে থাকে, তারই মত অন্যান্য পশু পাখির খাদ্য হয়। এ নিয়ে পৃথিবীতে অসংখ্য শিল্প সাহিত্য ও সিনেমা রচিত হয়েছে। এটা জীব জগতের প্রাকৃতিক দৃশ্য, পশু পশুর জন্য, প্রাণী প্রাণীর জন্য, মানুষ মানুষের জন্য। বিপরীত লিঙ্গের দু’টি প্রাণী পরস্পর গলাগলি জড়িয়ে একে অন্যের সাহায্যে জীবন-নদী পাড়ি দিবে- এটা স্রষ্টার লিখিত সংবিধান, সংবিধিবদ্ধ কানুন।
হাসান, সে কোন ইতর প্রাণী নয়, একজন মানুষ। যে মানুষের বুকের মধ্যে রয়েছে একটি মাংসের টুকরা, যে মাংসের টুকরা থেকে উৎসারিত হয় মায়া মমতা, প্রিতি ভালবাসা, বাৎসল্য। যে ভালবাসার আবেশে অক্টোপাসের অষ্ট ডানায় সে জড়িয়ে ধরে ছিল একটি দেহ, যে দেহটি তারই দেহের অংশ, তারই প্রাণের অংশ, যে অর্ধাঙ্গিনী তার ইহলোক ও পরলোকের সম্বল ও সাথী। সেই অর্ধেকটি দেহ তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে, বিছিন্ন হয়ে আছে আজ অনেক দিন হয়ে গেল।
স্ত্রী যাওয়ার পর থেকে হাসানের খাওয়া দাওয়া অনিয়মিত হয়ে পড়ে। কারণ সে তরকারি পাকাতে পারত না। তার কমন রান্না ছিল চারটে ভাত ফুটিয়ে একটা ডিম লবণ মরিচ দিয়ে ভেজে কোন রকম ক্ষুন্নি নিবারন করা। অনেক সময় না রেধে হোটেল থেকে খেয়ে নিত, হয়ত দুয়েক বেলা না খেয়েও থাকত। কখনো ছাত্র ডেকে রান্না করাত। তবে এ সময় সাধারণত ক্ষুধার অনুভূতি ছিল, ক্ষুধায় কষ্ট করত না, ঘরেই হউক হোটেলেই হউক খেয়ে নিত। কিন্তু দশ দিনের জামাত থেকে আসার পর নিঃসঙ্গতা তার কাছে পিড়াদায়ক হয়ে উঠে। স্ত্রীর সাথে অতীত স্মৃতিগুলি মেঘের মত তার হৃদয় আকাশে উড়ে বেড়ায়। বিদায় বেলায় স্ত্রীর সেই করুণ চাহনি তার চোখ থেকে মুহুর্তের জন্যও আড়াল হয় না। সে আপন মনে মেয়েকে নিয়ে খেলায়, আনমনা হয়ে মেয়ের সাথে বিভিন্ন বুলি আওড়ায়, চেতনা পেতেই বিষণ্ণ হয়ে উঠে, ঘরটা তখন ব্যথা ও যন্ত্রণায় ভরে উঠত।
যখন খেতে বসত তখন স্ত্রী সন্তানের কথা মনে পড়ত, স্ত্রী তাকে ভাত তরকারি বেড়ে দিত, মেয়েটা কাছে বসা থাকত। সে কাটা বেছে বেছে মাছ, আঙ্গুলে চটকিয়ে গোশত নরম করে মেয়ের মুখে তুলে দিত। তার মেয়ে পুই ডাটা পসন্দ করত, বাচ্চার তখন সামনের দুটি দাঁত উঠেছে, সে মুখে পুই ডাটা ধরত আর বাচ্চা দুই দাতে চিবিয়ে চিবিয়ে খেত, খাওয়ার সময় এসব স্মৃতি তার মনে পড়ত আর খাওয়া হত না। কখনো প্রচন্ড ক্ষুধায় গোগ্রাসে দু’তিন লোকমা খেত, তারপরেই উগলে আসতে চাইত। তখন লোকমার সাথে মুখে পানি নিয়ে ঢোক গিলে গিলে আরো কয়েক লোকমা খেত। এভাবে তখন তিন বেলার জায়গায় এক বেলা বা দুবেলা খাওয়া হত, কখনো ঘরে কখনো হোটেলে তাও আবার দু’চার লোকমা করে। আবার তার নরমাল গ্যাস্ট্রিকটা মাত্রাছাড়া বেড়ে যেতে লাগল।
হাসান একদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চমকে উঠল, তার পেটানো স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ছে, বুকের হাড়গুলি বড় বিশ্রিভাবে ভেসে উঠেছে। সে ভয় পেয়ে গেল, নিজের উপর তার মায়া হল। সে মনে মনে বলল, না না এমনটা হতে পারে না, এভাবে আমি নিঃশেষ হয়ে যেতে পারি না। আজ হউক কাল হউক ওরা আসবে, আর আমি মরে গেলে ওরা বাচবে কি নিয়ে। এ অবস্থা চলতে থাকলে তো আমি মরেই যাব। হাসান সিদ্ধান্ত নেয়, এখন থেকে সে নিয়মিত খাওয়া দাওয়া করবে, ভাল মন্দ পেট ভরে খাবে। পরদিন রান্না করার জন্য মাদরাসা থেকে একটি ছেলে নিয়ে আসল। গরু গোশত ও কই মাছ ভাজা তার পসন্দের খাবার, বাজারে গিয়ে মাছ গোশত কিনল। সব সময় খাওয়ার জন্য কিছু বেকারি বিস্কুট চানাচুর এবং তার পসন্দনীয় মিষ্টি ও ছানার পায়েস নিয়ে এল। কিন্তু এ জিনিসগুলি তার আর কোন দিন খাওয়া হয়নি। মাঝে মধ্যে ছাত্ররা আসত- ওদের কাজে লেগেছিল।
গোশত ও মাছ কেটে সেও ছাত্রটাকে রান্নায় সহযোগিতা করল। রান্না শেষ হলে ছেলেটা বলল, স্যার আসি। হাসান খেয়ে যেতে বলল, কিন্তু সে খাবে না, চলে যেতে উদ্যত হল। হাসান তার হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে বলল, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যে ধোয়া খায় অর্থাৎ রান্না করে তাকে খানায় অংশ দিও। কাজেই হাদীসের উপর আমল করতে হবে। তুমি শুরু কর, আমি এখনো গোসল করিনি, গোসলটা সেরে তোমার সাথে শরিক হব। ছেলেটা হাড়ি পাতিল সামনে নিয়ে খেল, হাসান গোসলে চলে গেল। সে গোসল শেষ করে আসতেই ছেলেটা বলল, স্যার আমার খাওয়া শেষ, আপনার জন্য ভাত বেড়ে রেখেছি, তাড়াতাড়ি বসে পরেন, নইলে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে’ বলে সে চলে গেল। হাসান ঘরেই জুহুরের নামাযটা পড়ে খেতে বসল। বাহ চমৎকার, তার প্রিয় খাবার কৈ মাছ ভাজি ও গরু গোশত, কড়াই ভর্তি অনেকগুলি ভাজা কৈ মাছ, পাতিল ভর্তি গরু গোশত, গোশতের মধ্যে দুয়েকটা আলুর টুকরা সংখ্যা লঘুতার দুঃখে অপাংক্তেয় হয়ে পড়ে আছে। তার জিবের ডগায় জল এসে যায়, মনে মনে ভাবে আজ খাব, বহুদিন পর আজ মনের মত খাব।
সে কয়েকটা ভাজা মাছ পাতে নিয়ে বসল। একটা মাছ ভাংছে, অমনি সহসা তার মেয়ের কথা মনে পড়ল। সে মেয়ের মুখে মাছ দিতেই না চিবিয়ে গিলে ফেলত এবং সাথে সাথেই শালিকের বাচ্চার মত হ্যাঁ করে থাকত। হাসান মাছের কাটা বেছে দিতে দিতে সে কান্নাকাটি শুরু করত, আর হা করে একেবারে পাতের উপর এসে পড়ত, হাসান হাসত আর বউকে বলত, তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি কাটা বেছে দাও, তখন দু’জনে বেছে বেছে মেয়ের মুখে দিত, এটা স্বরণ হতেই তার দেহের প্রতিটা জোড়া যেন ছেড়ে দিল। স্ফীত হয়ে বসা শরীরটা অর্ধেকে নেমে এল। সে মাথা নিচু করে বসে আছে। নাকের দু’পাশ দিয়ে আশ্রু বেয়ে বেয়ে লুঙ্গিতে ঝড়ে পড়ছে। ক্ষনেক পর চেতনা ফিরে পেয়ে আবার শুরু করল। প্রায় অর্ধেকটা কৈ মাছ মাখানো লোকমাটা মুখে দিতেই যেন তার নাড়ি ভুড়ি উল্টে আসতে চাইল। দৌড়ে বাথরুমে গিয়ে কিছুটা বমিসহ লোকমাটা উগলে দিল।
তার পর কুল্লি করে এসে আবার প্লেটের সামনে বসেই কেঁদে ফেলল- হায়, আল্লাহ্ কি আমার রিযিক তুলে নিয়েছেন। এভাবে না খেয়ে আমি বাঁচব কি করে। আবার গ্লাসটা কাছে নিয়ে পরীক্ষামূলক আরেকটা লোকমা মুখে দিতেই বমি আসতে চাইল, আর সাথে সাথে সে গ্লাসটা মুখে লাগিয়ে এক ঢোক পানি নিয়ে লোকমাটা গিলে ফেলল। এরপর বারবার চেষ্টা করল চিবিয়ে খেতে কিন্তু বমি আসে। তখন লোকমার সাথে এক ঢোক করে পানি গিলে গিলে কয়েক লোকমা খেয়ে উঠে পড়ল। এরপর আর সে স্বাভাবিক ভাবে চিবিয়ে খেতে পারত না, পানি দিয়ে গিলে গিলে কোন রকম বেছে থাকার চেষ্টা চলল। এভাবে তার ক্ষুধা মন্দা দেখা দিতে লাগল। হঠাৎ মাঝে মধ্যে ক্ষুধা অনুভব করত অথবা ক্ষুধা অনুভব না করলেও যখন চেতনা জাগত যে, এভাবে না খেয়ে থাকলে তো আমি মরে যাব। তখন ঘরে কিছু থাকলে খেত না থাকলে হোটেল থেকে ভাত বা রুটি কিনে এনে ঘরে বসে খেত, হোটেলে খেত না। কারণ অন্যদের সামনে পামি দিয়ে ঢোক গিলে খাওয়া লজ্বাকর ব্যাপার।
বিষয়: সাহিত্য
১৩৫৬ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ লিখা মাশাআল্লাহ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন