চিঠি-৪১ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১১:০৬:৫২ সকাল
মধ্যরাত। হঠাৎ তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। এ ঘুম ভাঙ্গা ঢাকার উত্তরার কোন বাসায় স্ত্রীকে জড়িয়ে থেকে ঘুম ভাঙ্গা নয়, সর্ব প্রাপ্তির নিদ্রাভঙ্গ নয়। এটা প্রায় ১৯ বছর আগে ১১ই রমযান তার বাবার মৃত্যুর দিনের নিদ্রাভঙ্গ, এটা সর্বরিক্তের নিদ্রাভঙ্গ। ব্যাথা যন্ত্রনায় তার শরীরটা নীল হয়ে গেছে, বুকটা চিনচিন করে ব্যথা করছে, কেন এমন হল? অমন তো কথা ছিলনা। আমি তো কোন অন্যায় করিনি, স্ত্রীর অমার্জনীয় কিছু অপরাধের কথা তাদেরকে জানালাম। জানালাম বিচারের জন্য নয়, একটু বলে কয়ে তাকে সংশোধন করে দেয়ার জন্য। কিন্তু এ জানানোটাই আমার অন্যায় হল। আর এ অন্যায়ের জন্য ইঞ্জিনিয়ার, তার বউ ও পটেটোর আদালত আমাকে এক বছরের নির্বাসন দণ্ড দিল। হায় পোড়া কপাল, উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে, অন্যায় করল কে আর শাস্তি পায় কে?
আচ্ছা ইঞ্জিনিয়ার দম্পতি ও পটেটো না হয় নিষ্ঠুর, হিংস্র, অহংকারী, স্বেচ্ছাচারী কিন্তু অন্যান্য বোন ও বোন জামাইদের তো বলা উচিত ছিল- হাসানকে ডাকা হউক, তার কথাও শুনি, তার জবান বন্দি নেয়া প্রয়োজন। অথবা তাদের দুয়েক জন ব্যক্তিগত ভাবেও তো আমাকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারতো, মুল গঠনা জানতে পারতো। কিন্তু এটা তারা করেনি। অথচ সমাজের কমন দৃশ্য দেখা যায়- কোন পিতা নেতা বা কর্তা কারো প্রতি রাগ করলে অন্যরা অপরাধীর কাছে যায়, জিজ্ঞেস করে কিরে কি হইছে? আমরা যেভাবে বলব সেভাবে করবি, গিয়ে মাফ চাইবি। তখন মুজরেমকে নিয়ে কর্তার কাছাকাছি এসে ধমকাতে থাকে “হারামজাদা খুব বাড় বেড়ে গেছিস, তোর মত ছেলেকে কাচা চিবিয়ে খেলেও এক চিমটি লবণ খেতে হবেনা। তখন দুয়েক জনকে দেখা যায় খুব জোরে চড় থাপ্পড় মারছে, আসলে গায়ে আলতো করে লাগাচ্ছে। তারপর কর্তার নিকট এসে ঘাড় ধরে পায়ের কাছে বসিয়ে বলে মাফ চা শয়তান। এ ভাবেই সমাজের অধিকাংশ সমস্যার সমাধান করা হয়।
কাজেই ইঞ্জিনিয়ার ও পটেটো ব্যতিত অন্যান্য জামাইরা তো অন্তত আমাকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। অন্যায় থাকলে তারা আমার বিচার করতে পারত, মাফ চাওয়াতে পারত। কিন্তু তারা এটা করেনি, আর করেনি এ জন্য যে, তাহলে ফেরদৌসী ও ইঞ্জিনিয়ার দম্পতির দোষ প্রকাশ হয়ে যাবে। কাজেই ইঞ্জিনিয়ার এটা হতে দেয়নি। আর এরা সবাই স্ত্রৈণ, স্ত্রীর ক্রীতদাস, ইঞ্জিনিয়ারের বান্দা। এরা আল্লাহ্র বিধানের চেয়েও ইঞ্জিনিয়ারের কথাকে অগ্রগন্য মনে করে, অলঙ্গনীয় হিসাবে পালন করে। স্ত্রী ও ইঞ্জিনিয়ারের বিপক্ষে কথা বলা এদের সাধ্যাতীত। এজন্যই তারা নিজেরাও এগিয়ে আসেনি।
আর ম্যাট্রিক পাশ দেয়া ডিপ্লোমাধারি এ ইজিনিয়ারের একমাত্র সম্বল হল তিন শতাংশ জমির উপর তিন রুমের একটি বাসা, অবলম্বন হল একটা চাকরি। বাড়িতে পা রাখার মত এক তোলা জমি নেই, একটা ঘর নেই। তার হতদরিদ্র ভাই বোন ও তাদের সন্তানেরা এক মুঠো ভাতের জন্য একটা কাপড়ের জন্য কত কষ্ট করে। টাকার অভাবে ছেলেমেয়েদের লেখা পড়া করাতে পারে না, বিয়ে শাদি দিতে পারে না। তাদের কত ভুগান্তি পোহাতে হয়। তবে এরা অভাবি হত দরিদ্র বটে কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারের মত অভিশপ্ত নয়, এরা খেটে খুটে সৎ জীবন যাপন করে, কারো অন্যায় করেনা, কাউকে ঠকায় না, প্রতারণা করে না। এরা দরিদ্র কিন্তু মানুষ, প্রকৃত অর্থেই মানুষ, প্রকৃত ধর্ম কর্ম করে। আর ইঞ্জিনিয়ার মানবাকৃতির এই কুকুর স্ত্রীর এতটাই ক্রীতদাস যে, স্ত্রীর মনতুষ্টির জন্য সে নিজের ভাই বোনদের দিকে ফিরেও তাকায় না। তাদের ছেলে মেয়েদের একটু লেখা পড়ার সুযোগ করে দেয় না, এমনকি তাদের মেয়েদের বিয়ে শাদির ক্ষেত্রে কোন সহযোগিতা করে না। এর দুটি ভাগ্নির বিয়ে হচ্ছে না- সে কোন সহযোগিতা করে না, একটি মেয়েকে তার বাসায় পাত্র পক্ষকে দেখানোর কথা ছিল কিন্তু এ সুযোগটা পর্যন্ত সে দেয়নি।
অথচ তার সবগুলি শ্যালিকাকে নিজের বাসায় রেখে বিয়ে দেয়া, তাদের দেখা শুনা করা, বাপ ভাইয়ের বাসার মত তার বাসা ব্যবহার করা ইত্যাদি দস্তুর মতই চলছে, একেই বলে খাটি খান্দানি আদি আসল স্ত্রৈণ। হ্যাঁ চলুক আপত্তি নাই কিন্তু আমার স্ত্রীকে নিয়ে কেন? আমার স্ত্রী তো ভাত বেগাড়ে মরছে না, অথচ তার ভাই বোনের সন্তানগুলি জঠর জ্বালায় দগ্ধ হচ্ছে। সে আমার স্ত্রীকে আসতে দিবে না, তাকে বাসা করে দিবে, জীবন চলার ব্যবস্থা করে দিবে। অথচ আমার তো একটা চাকরি আছে, আমি মরে গেলেও তো সে বাড়িতে সন্তোষ জনক একটা উত্তরাধিকার পাবে। অথচ তার এতগুলি সন্তানকে একটি করে বাসা দেয়া তো দুরের কথা একটি করে রুমও দিতে পারবে না। একটি ছেলের চলার ব্যবস্থা করতে পারবে না। অথচ এই অভিশপ্ত নরকের কীট আমার স্ত্রীকে নিয়ে দাবা খেলছে, তিনটি জীবনের ভবিষ্যৎ জড়িত আমার সংসারটা ভাঙ্গার চেষ্টা করছে।
কিন্তু কেন, কী আমার অপরাধ? স্ত্রীর অন্যায়গুলি তাদেরকে জানানো আমার অপরাধ হয়ে গেছে। কিন্তু না জানিয়ে উপায় কি? ধরে নিলাম আমাকে লাথি মারার কথা বলেছে এটা কোন অন্যায় নয়। কারণ এ পরিবারের মেয়েরা যে চরিত্রের, স্বামীকে দু’চারটা লাথি মারা এরা নিজেদের অধিকারের শামিল মনে করে। কাজেই আমিও না হয় দু’চারটা খেলাম। বউয়ের লাথি খেয়ে মানুষ মারা যায় না, শুধু বীরের মত হজম করে নিলেই হল। এটা ছেড়ে দিলাম। কিন্তু মা? আম্মাকে যে চুলে ধরার কথা বলল, এটা তো আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মত কথা, সমুদ্র পচে যাবার মত কথা, এটা কুফুরি কথা, এমন কথা বলে তওবা না করলে কাফের হয়ে যাবে। কারণ আল্লাহ্ তালা মাতাকে নিজের পড়েই স্থান দিয়েছেন, পিতা মাতার খেদমত ইবাদাত বলে রায় দিয়েছেন (সুরা বনী ইসরাইল/২৩)। যীশু খৃষ্ট বলেছেন, তাকে পিতা মাতা সন্তান সন্তাতি ভাই বোন ও সকল মানুষের চেয়ে অধিক ভালবাসতে হবে (মথি)। কিন্তু রাসূল (সাঃ) সেখান থেকে মায়ের অধ্যায়টা বাদ দিয়ে দিয়েছেন, তিনি বলেন কোন ব্যক্তি মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে আমাকে তার পিতা সন্তান ও অন্যান্য মানুষ থেকে অধিক ভালবাসবে (সকল হাদিস গ্রন্থ)। এখানে তিনি মায়ের কথা উল্লেখ করেন নি। কাজেই এ হাদীস দ্বারা বুঝা যায় সন্তান রাসূল (সাঃ) এর চেয়েও মাকে বেশি ভালবাসবে। এছাড়া মায়ের অধিকারের ব্যাপারে জুরাইজের হাদিস একটা অশনি সঙ্কেত।
তদুপরি তিনি কখনো বলেন নি, হে আমার উম্মতেরা আমার পদতলে তোমাদের বেহেশত, দৌড়ে এসো। অথচ তিনি বলেছেন মায়ের পদতল সন্তানের বেহেশত। তাছাড়া জেহাদ বা অন্যান্য কোন ভাল কাজে নতুন কোন সাহাবী এলে তাকে জিজ্ঞেস করতেন তোমার কি মা আছে? উত্তর হ্যাঁ বাচক হলে বলতেন, যাও মায়ের খেদমত কর গিয়ে। কাজেই আমার বউ যখন মাকে ঐ কথা বলল তখন বুঝলাম এই বাঘিনীর জন্য আমার ইহকালের সুখ শান্তি সবই তো গেল, এখন তো দেখছি পরকালও যাবার উপক্রম হল। আর তখন প্রতিকারের জন্য তাদের কাছে গিয়েছিলাম। তারা প্রতিকার করল আমার এক বছরের নির্বাসন দন্ড দিয়ে। বউয়ের জন্য কি তাহলে এখন আমার ইহকাল পরকাল দু’কুলই হারাতে হবে? উহঃ যন্ত্রণা- বলে সে বিছানা ছেড়ে উঠে পায়চারি করতে লাগল। ওদের বোনেরা না হয় শাশুড়ি বিদ্বেষী, তারা শাশুড়িকে গালিগালাজও করতে পারে, মারতেও পারে। কিন্তু ওদের জামাইগুলি? বউ শাশুড়িকে এমন জঘন্য কথা বলেছে তা শুনার পরও এরা ঠিক থাকে কেমনে, নিজের মায়ের কথা কি স্বরন হয়নি? কোন মুসলমান তো দুরের কথা, কেউ মাকে বা শাশুড়িকে এমন কথা বলেছে তা শুনার পর পৃথিবীর কোন হিন্দু বৌদ্ধ ইহুদী খৃষ্টানও সহ্য করবে না। তাহলে কি এদের জন্ম কোন মায়ের গর্ভে নয়, কুকুরীর গর্ভে?
হাসান হঠাৎ স্থবির হয়ে যায়, সে খাটের পাশে বসে। কোন তথ্য উদঘাটনের ন্যায় সে একদিকে মনোনিবেশ করে। গভীর মনোযোগ সহকারে সে তার স্ত্রীর কথাগুলি স্বরণ করতে থাকে। ফেরদৌসী বলত, ইঞ্জিনিয়ারের মা মেয়ের জামাই আসতেই ভাত বেড়ে দিত, এটা ওটা দিত, চুরি করে টাকা দিত। আর তখন তার বোনের সাথে লাগত। লাগত মানে তার বোন শাশুড়িকে মারত, পেটাত। আরো বলত এ মহিলাটা নাকি ভাল ছিল না, কেউ তাকে দেখতে পারত না। এমনকি সে পিঠা বানিয়ে দিলে নাতি নাতনিরা সেই পিঠা ঢেলিয়ে কুত্তাকে দিত। সবাই তাকে ঘৃণা করত। তাহলে সম্ভবত মহিলাটা ভাল ছিল না, সবাই ঘৃণা করার অর্থ দাড়ায় চরিত্র ভাল ছিল না। কারণ চরিত্র ছাড়া অন্য বিষয়ে সন্তান ও নাতিরা অন্তত ঘৃণা করে না। তদুপরি এ দরিদ্র মহিলা অল্প বয়সে বিধবা হয়, অন্যের বাড়িতে হয়ত ঝিয়ের কাজ কর্ম করে পেট চালিয়েছে, আর এ জাতীয় মেয়েদের চরিত্র ভাল হয় না। তাহলে এই চরিত্রহীনা মহিলার ছেলে হল ইঞ্জিনিয়ার আঃ রউফ।
আবার তার স্ত্রী পটেটোর কথা বলত, তাদের শুধু বাড়িটা ছাড়া আর কিছুই নেই, কিন্তু তালুকদারের জমি কিনেছিল বলে নামের সাথে লিখে তালুকদার। তারা দরিদ্র মানুষ। স্ত্রীর কথায় বুঝা যায় পটেটোর মা অন্যের বাড়িতে কাজ-কর্ম করত। আর এ জাতীয় মেয়েদের চরিত্র ভাল থাকে না। কাজেই দুশ্চরিত্রা মেয়ে লোকের সন্তান হল পটেটো। আর এ জাতীয় পোলারা মাকে রাস্তায় ফেলে পিটায়, এরা কখনো মায়ের প্রতি, মাতৃজাতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় না।
আস্তাগফিরুল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ, আলাহ তুমি মাফ কর। সে চমকে উঠে- ঐ সব মহিলারা আমার মুরুব্বী, গুরুজন, আমি তো জানি না তারা ভাল ছিলেন কি মন্দ ছিলেন। মন্দ থাকলেও তাদের সম্পর্কে ভাল বিনে খারাপ ধারনা করা আমার জন্য উচিত নয়, জায়েজ নয়। তবে এখানে একটি রহস্য আছে। একবার বাংলার অবিসংবাদিত ইসলামী চিন্তাবিদ মাওঃ মুহিউদ্দিন খান ময়মনসিংহ বড় বাজারের ধর্ম সভায় নাস্তিক মুরতাদ সম্পর্কে আলোচনা করেছিলেন। সালমান রুশদির উদাহরণ টেনে তিনি বলেছিলেন অধিকাংশ নাস্তিক মুরতাদ জারজ, অবৈধ সন্তান। আলোচনার শেষ পর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, সমাজে এমন কিছু লোক দেখা যায় যারা বাহ্যিকভাবে ভাল সৎ ধার্মিক কিন্তু বাস্তবে এরা সমাজ ধর্ম ও নীতি বিরোধি কাজ করে। এরাও এক প্রকারের জারজ। এদের পিতা মাতারা ভাল মানুষ হওয়া সত্ত্বেও এমন কর্মকান্ড করে যার ফলে তাদের সন্তানরা প্রত্যক্ষ জারজ না হলেও পরোক্ষ জারজ হিসাবে জন্ম নেয়। কাজেই ইঞ্জিনিয়ার ও পটেটো প্রত্যক্ষ জারজ না হলেও পরোক্ষ জারজ তো অবশ্যই।
কারণ এরা ধর্ম, সমাজ ও নীতি বিরোধি কাজ করে, পৃথিবীর প্রচলিত রিতি নীতি পাল্টে দিচ্ছে। যেমন সামাজিক ও ইসলামিক বিধান হল বাবা না থাকলে ক্রমান্বয়ে ভাই ও মামা চাচারা মেয়েদের অভিভাবক হবে। অথচ ফেরদৌসিদের বাবা ছাড়া সবাই আছে কিন্তু কর্তা হয়েছে দুলা ভাইরা। ইঞ্জিনিয়ার ও পটেটোরা সুন্দরী শ্যালিকাদের নিয়ে উলু উলু করে। আমাদের এত বড় ঘঠনাটা স্ত্রীর ভাই মামা চাচারা জানলও না, মাতব্বরি করল ইঞ্জিনিয়ার ও পটেটো। আর দুলা ভাইরা কর্তা হলে যা হয় এখন তাই হতে যাচ্ছে। পৃথিবীর নিয়ম হল কর্তা স্বামী, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। কিন্তু তাদের নিয়ম হল কর্তা স্ত্রী, নারী কেন্দ্রিক সমাজ। আর এমন সমাজে বিপত্তি অনিবার্য যা ঘটতে যাচ্ছে আমার কপালে। সামাজিক ও ইসলামিক বিধান মতে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা, প্রয়োজনে তাদের দেখবাল করা ওয়াজিব, কেতয়ে রেহমী (সম্পর্কচ্ছেদ) হারাম। অথচ এদের প্রত্যেকটা জামাই স্ত্রীর প্রভাবে নিজের পরিবারের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছে, স্ত্রীর গোলাম হয়েছে, শ্বশুর পরিবারের ক্রীতদাস হয়েছে।
ইসলামী বিধান মতে পিতা মাতার খেদমত করা তাদের দেখা শুনা করা মৃত্যুর পর তাদের জন্য দোয়া করা ফরযে আইন। অথচ এরা পিতা মাতার খেদমত তো দুরের কথা তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বউ নিয়ে আলাদা বাসায় থাকে। তাদের স্ত্রীদেরকে শাশুড়ির খেদমতের কথা বললে ঝাঁঝিয়ে উঠে- কোরান হাদীসে আছে নাকি শাশুড়ির খেদমত করতে হবে। এরা শাশুড়িকে শত্রু মনে করে। এমনকি নিজের মাকে দিয়ে এরা কাজের মেয়ের মত কাজ করায় আর নিজেরা বসে থেকে ঠ্যাং নাচায়। এ জন্যই ফেরদৌসি যখন শাশুড়িকে চুলের মুঠি ধরার কথা বলল তখন এটা তারা আমলে নেয়নি। কারণ তাদের কাছে এটাই স্বাভাবিক, এটাই নিয়ম।
ইঞ্জিনিয়ার যে পরোক্ষ জারজ এর প্রমাণ হচ্ছে, তার ও তার পরিবারের কারো মুখে কোন দিন মা বাবার নাম শুনা যায়নি। তার ছেলে মেয়েরা ঘুনাক্ষরেও কখনো দাদা দাদুর নাম মুখে নেয় না। ওরা নানা নানু ও খালা খালুর নাম নিয়ে ব্যস্ত থাকে। একদিন তার এক ছেলে নানার স্তুতি সম্বলিত একটা কবিতা লিখে আমাকে পাঠ করে শুনাচ্ছে। মুরুব্বীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা খুশির বিষয়, কিন্তু আমার মন বিষিয়ে উঠেছিল কারণ, এরা শুধু নানা নানীরই প্রশংসা করে দাদা দাদীর নামটা পর্যন্ত মুখে উচ্চারণ করে না। দাদা দাদী দরিদ্র, মূর্খ, তুচ্ছাতিতুচ্ছ হলেও রক্ত- সম্পর্কের একটা ব্যাপার আছে। এরা তো কোনদিন দাদা দাদীর জন্য হাত তুলে দোয়া করবে না, একটি পয়সাও দান করবে না, একটা মিসকিন খাওয়াবে না, সুরা ফাতেহা পড়ে তাদের জন্য মাগফেরাত কামনা করবে না। ইঞ্জিনিয়ার তো গোলাম হয়ে গেছে, কুলাঙ্গার হয়ে গেছে। কিন্তু আমার সন্তানরা? বাবা মা আমার গর্বের ধন, আমার সন্তানরাও কি তাহলে আমার মা বাবার নাম মুখে উচ্চারণ করবে না, তাদের জন্য দোয়া করবে না, তাদের রেখে যাওয়া সম্পদ ভোগ করবে অথচ পৃথিবীতে তাদের প্রতিনিধিত্ব করবে না? হায়, এটা আমি কি করে মেনে নিব। (পুনরুক্ত)
আর পটেটো? এ ব্যক্তি বলে কিনা আমার চেয়ে তার ভাইয়ের সাথে বিয়ে হলেই ভাল হত। কারণ মা নাই খেদমত করতে হত না। অর্থাৎ তার ভাইয়ের কোন যোগ্যতা না থাকলেও একটা যোগ্যতা আছে সেটা হল মা না থাকা। বউয়ের আরাম আয়েশের জন্য কোন মা থাকতে পারবে না। এরা মাকে এতটাই সমস্যা মনে করে, আর বউকে পূজা করে। এদের বিধান অনুযায়ী সন্তান বড় হলে, বিয়ে করলে তারপরও যদি মা বেঁচে থাকে তাহলে বলতে হবে মা এখন আর তোমার দরকার নাই, আমি বড় হয়ে গেছি। তুমি থাকলে আমার বউয়ের সমস্যা হবে, কাজেই তুমি কি নিজে নিজে মরবে নাকি আমাকে মারতে হবে? তারপর মাকে মেরে গলায় কলার পাতরা পেছিয়ে মরা কুত্তার মত টেনে নিয়ে নদীতে ফেলে দিতে হবে, নাউযুবিল্লাহ। হায় আল্লাহ্! যে মা সন্তানকে পৃথিবীর ঝঞ্জা থেকে বাঁচাতে দশ মাস দশদিন জঠরে পোরে রাখে, তারপর আজরাইলের সাথে পাঞ্জা নড়ে পৃথিবীতে আনে, তারপর নিজের কলজেটা একটু একটু করে চুষিয়ে চুষিয়ে খাইয়ে সন্তানকে পৃথিবীর পথে হাটতে শিখায়, বউয়ের জন্য সেই মাকে বিসর্জন দিতে হবে? হাসানের শরীরটা কেঁপে উঠল, সে নিঃশব্দ রাতে মৃদু চিৎকার দিয়ে উঠল, ঐ কুত্তির বাচ্চা, সমগ্র মাতৃজাতির শত্রু, মানবতার দুষমন, ইসলাম বিকৃতকারি, তোকে আমি খুন করব, তোর বিরুদ্ধে মামলা ঠোকে তোকে ফাসি কাষ্ঠে ঝুলাব। নিজের চিৎকারে নিজেই লজ্বা পেয়ে উঠে দাঁড়াল তারপর চেয়ারে গিয়ে বসল। কিন্তু তার শরীর রাগে স্ফীত হয়ে আছে। তার স্থির বিশ্বাস হয়ে গেল নিশ্চয় পটেটো কোন নটি- বেশ্যার সন্তান, নইলে মা সম্পর্কে এমন কুৎসিত মনোভাব পোষণ করতে পারত না। ওকে হত্যা করা একান্ত প্রয়োজন, নইলে তাদের মতাদর্শ সমাজে প্রশমিত হলে সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে। আর মেয়েরা কেন বুঝবে না, আজকের বউ আগামি কাল মা পরশু শ্বাশুড়ি। নিজের আসন প্রতিষ্ঠার জন্যই তাকে স্বাশুড়ির দেখাশুনা করা কর্তব্য।
তাছাড়া এই পটেটো ও ইঞ্জিনিয়ারের পরিবার যদি আমাদের এলাকায় থাকত তাহলে নিশ্চয়ই এদের বাপ মা আমাদের বাড়িতে কাজ করত, আমার মা ফেনসহ ভাত ওদের ছেলে মেয়েদের খেতে দিত। আমার আব্বা তাদেরকে দান দক্ষিণা করত। কারণ আমাদের এলাকায় এমন কোন দরিদ্র পরিবার নাই যারা আমাদের বাড়িতে কাজ কর্ম করেনি এবং আমার মা বাবার সাহায্য সহযোগিতা নেয়নি। আর এরাও যেহেতু দরিদ্র, কাজেই আমাদের এলাকায় থাকলে নিশ্চয়ই আমাদের পরিবারের ফেন অন্ন খেয়ে ধন্য হত।
কিন্তু এখন? যারা জারজ, যাদের জন্মের কোন ঠিক ঠিকানা নেই। যারা আমাদের পরিবারের কামলা বা সদকা ফেতরা খাওয়ার উপযোগি তারাই আমার উপর কর্তৃত্ব করছে, আমার ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, আমার সন্তানকে কেড়ে নিয়েছে, আমার বউকে নিজেদের বউয়ের মত ব্যবহার করছে। হায় আমার অদৃষ্ট, বলতে বলতে সে অসহ্য যন্ত্রনায় নিজের কপালে হাত মারতে লাগল আর ফ্লোরে বসে কপালে মাটি ঘষতে লাগল। স্ত্রীর প্রতি সে আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। জামালপুর থেকে ঢাকাগামি ট্রেনগুলি শেষ রাত্রে যায়। সে প্রথম রাত্রে সিদ্ধান্ত করেছিল, স্ত্রীকে এক নজর দেখার জন্য শেষ রাত্রে ষ্টেশনে যাবে। কিন্তু এখন আর সেই গরজ অনুভব করল না, বাসাতেই শুয়ে থাকল। কারণ স্ত্রী তার কথা রাখল না, তাকে আর স্বামী মনে করে না। স্বামী মনে করে তার দুলা ভাইদের, তাদের কথায় তাকে ফেলে সেই সুদূরে চলে যাচ্ছে।
পরদিন মাদরাসা থেকে এসে বিধ্বস্ত মন নিয়ে বিছানায় পড়ে থাকে। আবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠে সেই করুণ দৃশ্য, স্ত্রীর অপলক চাহনি। সে আবেগ তাড়িত হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। বিকালে তাদের কয়েক বন্ধু মিলে একটা আড্ডা হয়, কফি হাউজের আড্ডা, সেখানে জাতি ধর্ম সমাজ রাস্ট্র ইত্যাদি নিয়ে কথা হয় জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হয়। হাসান সেখানে গিয়ে উপস্থিত হল। এক বন্ধু তাকে দেখেই এক পার্শ্বে ডেকে নিয়ে বলল আপনার বউ আমার কাছে কল করেছিল। নিমজ্জিত ব্যক্তি খড়কুটো পাওয়ার মত হাসান অধির আগ্রহে প্রশ্ন করল কী বলেছে? বন্ধুটি বলল না তেমন কিছু বলেনি। শুধু বলল আপনি তাকে জীবনেও কোন দিন ভালবাসেননি, পসন্দ করেননি। এখন আপনি বছর চিল্লায় না গেলে সে আর আসবে না। এ কথাটা আপনাকে জানিয়ে দিতে বলল, এটুকুই।
হাসান বিমর্ষ হয়ে গেল, লজ্বা ও অপমানে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল। এ বন্ধুটি তার স্ত্রীর জঘন্য বিষয়গুলি না জানলেও এতটুকু জানে যে, মহিলাটি ঝগড়াটে, বদমেজাজি। সে কয়েকবার ঝগড়া শুনেছেও, হাসানের বিষাক্ত দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে তার অবগতি ছিল। এ জন্য সে সমব্যথি হয়ে তিক্ত ভাষায় বলল, আচ্ছা আমি তো আপনার ভাই বা মামা চাচা কোনটাই নই, জাস্ট পরিচিত এবং বন্ধু মানুষ, কিন্তু আপন জন নয়। কাজেই যে মহিলা একজন পরপুরুষের সাথে কল করে স্বামীর বদনাম বলতে পারে, স্বামী ভালবাসে না, পসন্দ করে না। আর যাই হউক আমার ক্ষেত্রে এমন হলে এ বউ নিয়ে ঘর করা আমার পক্ষে সম্ভব হত না। কাজেই আমি আপনাকে পরামর্শ দিচ্ছি না, চিন্তার জন্য বলছি, আমি যতটুকু জানি এমন একটা বদচরিত্র মহিলা নিয়ে জীবনেও সুখি হতে পারবেন না। জীবন দশটা নয় একটাই। কোন খারাপ মেয়ে ছেলের জন্য সারাটা জীবন নিজেকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দেয়ার কোন মানে হয় না। এ জন্যই শরীয়ত তালাক জায়েয রাখছে। আর আপনার মত লোকের বিয়ের খুব একটা অভাব পরবে না। এখন দেখুন আপনার পরিবার, আপনাকেই চিন্তা ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। হাসানের মনটা ধ্বসে গেল। সে বিরস বদনে বন্ধুদের সাথে কিছু সময় কাটিয়ে বাসায় চলে গেল।
এ কেমন কথা। আমার স্ত্রী অন্যের সাথে স্বামীর বদনাম করে বেড়ায়। নিশ্চয়ই তার বোন ও ভগ্নিপতিদের সাথেও বলেছে আমি তাকে ভালবাসি না, পসন্দ করিনা। আর কি করলে ভালবাসা হবে তার মন উঠবে। দিনের পর দিন ওর অমানুষিক অত্যাচারে জীবনটা আমার তিক্ত বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। আমাকে লাথি মারবে, আমার মাকে চুলে ধরবে, এতসব জঘন্য অপরাধের জন্যও তাকে আমি কোন দিন গালিও দেইনি, মারিওনি, তালাকের কথাও বলিনি। এসব আমি কেন করলাম, কার জন্য করলাম, কেন ধৈর্য্য ধরলাম, একমাত্র তার জন্যই তো। এতকিছু করেও যদি ভালবাসা না হয় তাহলে আর কি করলে ভালবাসা হবে। হ্যাঁ প্রথম তো পসন্দ হ্য়ইনি, ভালওবাসিনি। কিন্তু তারপর তো ওকে ভালবাসার জন্য আমাকে অনেক তপস্যা করতে হয়েছে, অনেক কান্নাকাটি করতে হয়েছে। এরপর ওকে ভালবাসতে পেরেছি, ভালবাসতে শিখেছি, অনেক ভালবেসেছি, অনেক।
এরপরেও যদি ভালবাসা না হয়, তাহলে সে আর কি চায়? তাহলে কি সে আমার চৌদ্দ গোস্টি উদ্দার করবে, আমাকে লাথাবে, আমার মাকে চুলে ধরবে, আর তখন আমি হাত তালি দিব আর বগল বাজাব, জী মালিকান! সব ঠিকই আছে, চালিয়ে যান। এই বুঝি ভালবাসা। হাসান বিছানায় শুয়ে শুয়ে অবাক হয়ে ভাবে, এ মেয়েটি এমন করছে কেন, আসলে কি সে আমাকে ভালবাসে না, আমার দিকে মনের টান নাই। থাকলে তো এমন করার কথা নয়। বিদায় বেলায় আমার দিকে সে যে আগ্রহ দেখিয়েছে, করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছে- এ সবই কি তার অভিনয়? হাসান অন্তহীন নৈরাশ্য আর বিষণ্ণ মনে স্বরণ করতে থাকে- আমার বউ আমার সামনে বসে বসে পটেটোর ভাইয়ের জন্য কাঁদত আর বলত, আপনার সাথে বিয়ে না হয়ে সোলেমানের সাথে বিয়ে হলেই আমার ভাল হত। আবার পটেটোও বলেছে- আমার সাথে বিয়ে না হয়ে ওর ভাইয়ের সাথে বিয়ে হলেই কত ভাল হত, মা নাই খেদমত করতে হত না।
আবার ঐ বেচারা এমনই যোগ্য আর এমনই পরিবারের সন্তান যে এত দিনেও নিজের দেশে একটা বিয়ে জোটাতে পারছে না। অথচ বরিশালের মেয়েরা ঢাকা চট্টগ্রামে বিভিন্ন পেশা করছে আর বিভিন্ন এলাকার ছেলেদের বিয়ে করছে। কিন্তু এই নাগর এমনই যোগ্য আর এমনি খান্দানি পরিবারের পোলা যে, স্বদেশে একটি মেয়ে পাচ্ছেনা, কেউ তার কাছে বিয়ে দিচ্ছেনা। এখন নাকি তার ভাবীকে বারবার কল করে আর বলে ভাবী ঘুম আসে না, চুল পেকে যাচ্ছে, একটা কিছু ব্যবস্থা করেন, অর্থাৎ ফেরদৌসীকে পেতে চায়। আর আমার বউও এই লোকটার জন্য কাঁদে। হাসানের মাথার চুল খাঁড়া হয়ে উঠে- উঃ, হারামজাদি খাংকি মাগি, যা তোর নাগর পথ চেয়ে আছে, যা তার সাথে শুয়ে থাক গিয়ে। আমার ভালবাসায় তোর মন ভরেনি, ঐ লোকের ভালবাসায় মন ভরবে। বার নাঙ্গের পানি না পেলে বেশ্যাদের মন তৃপ্তি হয় না। আমি এখন সেকেন্ড হ্যান্ড, তার উপর বাচ্চা আছে। এরপরেও এখনো আমি বিয়ে করলে তোর চেয়ে হাজার গুনে ভাল বিয়ে করতে পারব। তোকে আর আমার দরকার নাই। স্ত্রীর প্রতি মনে কুইনাইনের তিক্ততা নিয়ে বিছানায় পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন আবার চিন্তা শুরু হল। এক মুহুর্তের জন্যও সে স্ত্রী সন্তানকে ভুলতে পারে না। তারা অদৃশ্যে থেকে তার মনটাকে নিয়ে খেলায়, দোলা দেয়, নাড়াচাড়া করে। সে শুয়ে শুয়ে স্ত্রীর সাথে তার সুখ দুঃখের স্মৃতিগুলি রোমন্থন করে। কিন্তু স্ত্রীর অপকর্মগুলি স্বরণ হতেই তার মনটা বিগড়ে যায়। পরক্ষনেই সে চমকে উঠে, এটা কি করে সম্ভব, বেঁচে থাকতে মরে যাব। আমার বাচ্চা হবে মা হারা, আমি আরেকটা বিয়ে করব। সেও আরেকজনকে বিয়ে করে হবে অন্যের শয্যাসঙ্গিনী। হাসান শিউরে উঠে, এটা সম্ভব নয়, ওকে ছাড়া যে শুধু আমার সংসারই চলবে না তা নয়, ওকে ছাড়া আমার জীবন অর্থহীন। এর চেয়ে মরে যাওয়া ভাল। ওকে আনতেই হবে, আর আনলে সাল লাগাতে হবে। ওরা যে ভয়ঙ্কর চীজ, সাল না লাগালে দিবে না। কাজেই সে সাল লাগানোর মোটামোটি সিদ্ধান্ত করে ফেলে। এরপরেও চিন্তা করে একটা বছর স্ত্রী সন্তান সংসার চাকরি সব কিছু ফেলে বিদেশ বিভূঁইয়ে কিভাবে এ দীর্ঘ সময় কাটাবে। সাহস পায় না, হীনবল হয়ে পড়ে। পরামর্শ ও প্রস্তুতির জন্য কয়েকদিন পর সে বাড়িতে চলে যায়।
বিষয়: সাহিত্য
১৪৯২ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন