চিঠি- ৪০ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ০৯:২৩:৫৮ সকাল
হাসানের দুই ভাই ও ভগ্নিপতি জুমার নামাযের অনেক আগেই বাসায় এসে পৌঁছেছে। নামায পড়ে খাওয়া দাওয়া করল। তারপর তারা রেডি হয়ে বসে রইল ইঞ্জিনিয়ারের বাসায় তাদেরকে ডাকবে, সেখানে গিয়ে হাসান তার জবানবন্দী দিবে। সুখ দুঃখের কথা বলবে। এখন তার সাহস অর্জিত হয়েছে, ওরা গণ্ডগোল করতে চাইলেও পারবে না, কারণ এখন তারা চারজন, যাকে বলে ভাই বল বড় বল যদি থাকে সাথে। তারা অপেক্ষায় বসে আছে কিন্তু কেউ ডাকতে আসে না। অবশেষে প্রায় বিকালে দরজায় টোকা পরল। হাসান দরজা খোলে সালাম দিল, মোসাফাহা করল কোশল বিনিময় করল কিন্তু তাদের মুখ ছিল গম্ভীর আচরণ ছিল রুক্ষ। পটেটো বলল আপনার সাথে কথা আছে। হাসান বিনয়ের সাথে বলল, আসুন ঘরে আসুন। বুঝা গেল ঘরে ঢোকে হাসানের ভাই ও ভগ্নিপতিকে দেখে তারা চমকে উঠেছে। কারণ ফেরদৌসিদের পারিবারিক নিয়ম হল, এরা বিয়ের সময় পিতা-মাতা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন ইত্যাদি খোজে না, শুধু ছেলেটা দেখে বিয়ে দেয়, তারপর জামাইকে ক্রীতদাস বানায়, তার পরিবারের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়। কাজেই এখানে হাসানের ভাই ভগ্নিপতিকে দেখে তারা নিজেদের পারিবারিক বিষয়ে অন্য মানুষের অনাহুত উপদ্রব ভেবে বিরক্ত হল, কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে থাকল, কথা বলল না। হাসান তাদেরকে মানে এবং শ্রদ্ধা করে, তাদেরকে হালকা কিছু খাওয়ানোর জন্য সে ব্যস্ত হল।
তখন পটেটো বলল, আপনি ব্যস্ত হবেন না আপনার সাথে কথা আছে, বসেন। হাসান বসল আর পটেটো শুরু করল- আমরা সবাই বসে ছিলাম, সকলের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হল আপনি এক সাল লাগিয়ে আসবেন। সাল না লাগালে আমাদের মেয়ে দিব না, নিয়ে নিব। শেষ কথাটায় তার সকল অনুভূতি আটকে গেল, আর কোন কথা তার কানে ঢুকল না। একটা ভয় ও আতঙ্ক তার শিরদাড়া বেয়ে উপড়ে উঠছে, আশাংকার একটা ঝড় তার ভেতরটা তোলপাড় করে গলায় এসে আটকে রইল, দেহটা কাপছে। ওদিকে তার ভগ্নিপতি বলল- কেন, চিল্লায় যেতে হবে কেন, বউয়ের সাথে চিল্লার কি সম্পর্ক? পটেটো বলল, যেতে হবে, এটা আমাদের শর্ত, নচেৎ মেয়ে দিব না। - আপনাদের মেয়ে আপনারা দিবেন না দিবেন সেটা আপনাদের ব্যাপার কিন্তু চিল্লার শর্ত লাগাবেন কেন? ছেলে অন্যায় করলে তার বিচার করবেন, মেয়ে অন্যায় করলে তার বিচার করবেন। কোরানে স্পষ্ট বলা আছে- স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গণ্ডগোল হলে উভয় পক্ষের শালিস বসে মীমাংসা করবে। তা না করে আপনারা চিল্লার শর্ত দেন কেন, এটা কোথায় পেলেন?
পটেটো চেঁচিয়ে উঠল- আমরা এত কোরআন- টোরআন বুঝি না (নাউযুবিল্লাহ), বউ আনতে হলে আমাদের শর্ত মানতেই হবে, বছর চিল্লা লাগাতে হবে। উভয়ের কণ্ঠ চরমে উঠে গেল, জোশের বসে তারা হাতের আস্তিন গোটানো শুরু করল, হাতাহাতির উপক্রম হল। হঠাৎ হাসান চিৎকার দিয়ে উঠল- আপনারা থামেন, কী শুরু করছেন, আমি রাজি, যাব, বছর চিল্লা লাগাব। হাসানের ভগ্নিপতি ধমকে উঠল, কেন তুমি বছর চিল্লা লাগাবে? ইসলামের বিধান অনুসারে কাজ করতে হবে। ছেলে মেয়ে উভয় পক্ষের লোক বসে কার ন্যায় কার অন্যায় শুনে বুঝে ফয়সালা করতে হবে। এভাবে সাল লাগানো জায়েয হবে না। হাসান পাল্টা ধমক দেয়- চিল্লায় যাব আমি, আপনি কথা বলেন কেন? আমি এক বছর না দশ বছর লাগাই তাতে আপনার কি? আপনি চুপ থাকেন। বেচারা লজ্বা পেয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে চুপ মেরে বসে রইল। হাসান পটেটোর দিকে ফিরে বলল, আপনারা যান, আমি শীঘ্রই তৈরি হয়ে চিল্লায় চলে যাব। তারা সন্তুষ্ট হয়ে বলল- দেরি করা যাবেনা, এ মাসের মধ্যেই আপনাকে বের হতে হবে- বলে তারা উঠে চলে যেতে লাগল। হাসান কিছু খাওয়াতে চাইল কিন্তু তারা খাবে না।
সৌজন্যের খাতিরে তাদেরকে এগিয়ে দেয়ার জন্য সেও তাদের সাথে সাথে বাইরে গেল। তখন পটেটো বলল- কি আর করা যাবে, সবই আল্লাহ্র ইচ্ছা। আপনার সাথে বিয়ে না হয়ে আমার ভাইয়ের সাথে বিয়ে হলে কত ভাল হত, মা ছিল না কারো খেদমত করতে হত না। ঘৃণা ও ক্রোধে হাসানের মুখটা বিকৃত হয়ে গেল কিন্তু কিছু বলার সুযোগ তার ছিল না। কারণ তখন সে পতিত, আর তার গর্দানে পা রেখে তারা তখন যা ইচ্ছা তাই বলতে পারে, যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। এলাকার মানুষ হিসাবে সম্ভবত জহিরের একটু মায়া হল। সে হাসানকে একটু তফাতে নিয়ে গিয়ে বলল- আজ রাতে আপনার বউকে খুলনায় পাঠিয়ে দেয়া হবে, সাক্ষাৎ করতে চাইলে সন্ধ্যায় গিয়ে দেখা করে আসুন।
তাদেরকে বিদায় দিয়ে ঘরে ঢুকতেই ভগ্নিপতি ও ভাইয়েরা তার উপর হামলে পরল। ভগ্নিপতি বলল, তুমি এমন মাইগ্যা কেন? বউয়ের জন্য নিজের মান সম্মান সব বিসর্জন দিয়ে দিলে, আহঃ বউয়ের জন্য নির্বাসনে চলে যেতে হবে, এমন বউ আর মানুষের নাই। আরে স্বামী স্ত্রী গন্ডগোল হলে কোরআনের স্পষ্ট ঘোষণা হচ্ছে ছেলে পক্ষ ও মেয়ে পক্ষ বসে ফয়সালা করবে। এরা কিসের তাবলীগি, কোরআন মানেনা, হাদীস মানেনা, ইসলাম মানে না, তাদের মনগড়া একটা শর্ত দিল, আর তুমি গোলামের মত তাই মেনে নিলে। ছিঃ, এখন বউয়ের জন্য এক বছরের নির্বাসনে গিয়ে বসে থাক। আরে চিল্লায় যাওয়ার কথা তো আমরাও বলি, এক বছর কেন দশ বছর লাগাও, এটা ভাল, কিন্তু বউয়ের জন্য শর্ত দিয়ে সাল লাগানো জায়েয হবেনা, এটা হারাম। উল্লেখ্য যে, সে একটি মাদরাসার শায়খুল হাদীস। হাসান অনুযোগের সুরে বলল, আসলে তাদের শর্ত টর্ত কিছু না। আমারই আমলের ঘাটতি আছে, বহুদিন ধরে চিল্লায় যাব যাব ভাবছি, এই সুযোগে সময়টা লাগিয়ে আসি, আমার জন্যই ভাল হবে।
বাড়ির সবাই ফেরদৌসি সম্পর্কে মোবারকের কাছে জানতে পেরেছিল। তখন থেকেই তাকে কেউ দেখতে পারত না। তদুপরি হাসানের দ্বিতীয় ভাইটা ছিল উগ্র বদমেজাজি। সে কর্কশ ভাষায় বলল, চিল্লা টিল্লা বুঝিনা, এই বউ রাখা যাবেনা। না আছে রূপ, না আছে গুন, না আছে ধন, অন্যের সদকা ফেতরা আর উচ্ছিষ্ট খেয়ে জীবন চালায়, আবার অহংকারে বাঁচে না। এমন খবিস বউ নিয়ে মানুষ ঘর করে নাকি। ওকে ছেড়ে দিতে হবে। এটাকে বাদ দিলে আমার চ্যালেঞ্জ, এক সপ্তাহের মধ্যে এর চেয়ে সুন্দরী, মেধাবী, শিক্ষিত ও ধনী দেখে বিয়ে করাব। ভগ্নিপতি ধমক দিয়ে বলল, ছেড়ে দেয়ার কথা বল কেন, মেয়ে আছে তালাক দেয়া যাবে না, তবে শর্তের উপর চিল্লাও দেয়া যাবে না। তার ভাই বলল, আরে ছাড়ার কথা বলি কি আর সাধে। এর ব্যবহার সম্পর্কে জানলে তো আপনি এখনি বমি করে ঘর ভাসিয়ে দেবেন। এর মত দুশ্চরিত্রা কোন মেয়ে মানুষ হয় না। এভাবে তর্ক বিতর্ক চলতে লাগল। তারপর সন্ধ্যায় হাসানকে তিরস্কার করতে করতে তারা বেরিয়ে গেল। তাদেরকে বিদায় দিয়েই হাসান উর্ধ্বশ্বাসে ছুটল স্ত্রী সন্তানের সাক্ষাতে। বাচ্চার জন্য মিষ্টি নেয়ার উদ্দেশ্যে সে বিভিন্ন দোকান ঘুরল কিন্তু কোথাও মিষ্টি পেলনা। ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর, তখন জোরেশোরে ভেজাল বিরোধি অভিযান চলছে, কেউ মিষ্টি বানায় না। অগত্যা কিছু কেক ও বিস্কুট নিয়ে রওয়ানা হল। তার ইচ্ছা, গিয়ে অনুনয় করে স্ত্রীকে নিয়ে আসবে এবং চিল্লায় যাওয়া পর্যন্ত বাসায় থাকবে।
বড় মামার কৌশলে ভগ্নিপতিদের ধকলটা কেটে গেছে, ফেরদৌসির সংসারটা টিকে গেছে। সে আশ্বস্ত হয়ে বসে রইল কিন্তু প্রতিনিধি দল যখন তার স্বামীর বাসায় গেল তখন সে চরম উৎকণ্ঠা ও হতাশায় অস্থির হয়ে উঠল। স্বামীর সাথে সে যে অপকর্ম করেছে এখন কি হবে? সে জানে, তার স্বামী সাধারণত রাগ করেনা, ধৈর্য্যশীল মানুষ। কিন্তু তার জেদ বড় ভয়ঙ্কর। অতীত জীবনে তার এমন কিছু রেকর্ড আছে সেখানে দেখা যায় সে ভয়ানক জেদি, পশুর মত হিংস্র, প্রতিপক্ষকে ধুলিস্যাত করে দিতে চায়। এখনো যদি সে জেদ ধরে চিল্লায় যেতে না চায়, তাহলে কি তার ভাগ্যে তালাক। আর সে চিন্তা করতে পারেনা, তার শিরদাড়াটা যেন মোমের মত গলে যাচ্ছে। বিছানায় শরীরটা ছেড়ে দেয়, গুটিশুটি মেরে মাংসের দলার মত পরে থাকে। হাত পা নড়া চড়ার মত শক্তিটুকুও তার নিঃশেষ হয়ে গেছে। কিন্তু প্রতিনিধি দল যখন এসে জানাল যে হাসান রাজি হয়েছে, সে বছর চিল্লায় যাবে। তখন তার দেহটা যেন শুন্যে ভেসে উঠল, মনে হল যেন এক অনন্ত আনন্দ সরোবরে সে সন্তরণ করছে, পাখা ঝাপটে অবগাহন করে বেড়াচ্ছে। তার মেঘাচ্ছন্ন মুখটা সহসা চাঁদের মত দীপ্তিমান হয়ে উঠল।
আল হামদুলিল্লাহ- বলে খাট থেকে লাফিয়ে নেমে মেঝে থেকে মেয়েকে টান দিয়ে বুকে চেপে ধরে সশব্দে কেঁদে উঠল। তারপর আনন্দাতিশয্যে কান্না লোকানোর জন্য সে বারান্দার এক পাশে চলে গেল। সে কাঁদছে, অধির হয়ে কাঁদছে, নিজেকে উজার করে কাঁদছে। এ কান্না হারানোর নয়, আনন্দের কান্না, সর্ব প্রশান্তির কান্না। এ কান্নায় মনের কালিমা সব গলে গলে ঝড়ে যাচ্ছে। সে আম্মু আম্মু বলে পাগলের মত মেয়েকে চুমুতে লাগল, সে আত্মহারা, কারণ তার সংসার তরিটি যে ডুবতে ডুবতে বেঁচে গেল। সে নিজেকে তিরস্কার করল এ জন্য যে, সে ভাবত স্বামী তাকে পসন্দ করে না, ভালবাসে না। অথচ স্বামী তাকে কত গভীরভাবে ভালবাসে, পোড়ামুখী এতদিন কেন বুঝতে পারলি না। যে বেচারা কোন সময় তিনদিন, সাতদিন বা এক চিল্লার জন্যও যেতে চায়না, সেই কিনা এক বছরের জন্য নির্বাসনে চলে যাবে, আর যাবে একমাত্র তারই জন্য, শুধুই তাকে পাওয়ার জন্য। স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা ভালবাসায় তার মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠে। তার কান্নার বেগ আরো বেড়ে যায়। তার শরীর কাঁপছে, দেয়ালে হেলান দিয়ে কাঁদতে লাগল। নিজেকে ধন্য মনে হয়, মনে হয় সেই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি নারী, সে পৃথিবীর সম্রাজ্ঞী। কারণ তার স্বামী তাকে ভালবাসে, তার জন্য সব কষ্ট মেনে নিতে পারে। কিছুক্ষণ পর চোখ মুখ মুছে স্বাভাবিক হয়ে ঘরে ঢুকল।
কিন্তু এখন তার চিন্তা হল, আজ তো সে চলে যাবে সেই সুদূর খুলনায়, তার স্বামীও চলে যাবে এক বছরের জন্য। দীর্ঘদিন পর্যন্ত আর দেখা সাক্ষাৎ হবেনা। এখন বিদায় বেলায় কি সে স্বামীকে একটু দেখতে পারবেনা। তার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল আর আকাংখা করতে লাগল স্বামী যদি একবার আসত। জেদি মানুষ যারা এরা নিজের জেদ ঠিক রেখে বাকী সব কিছু ঠিকঠাক পেতে চায়। এ মূর্খ ও নির্বোধ মেয়েটা একটি বার ভাবল না তার জেদের কারণেই আজ এ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। সে অন্যায় করল আর স্বামী এসে এর প্রতিকার চাইল। কিন্তু স্বামী তার দোষ বলল কেন এই জেদ ও প্রতিহিংসায় সে স্বামীর বিরুদ্ধে সত্য মিথ্যা অনেক কিছু বলল। যার ফলে তার ও তার সংসারের উপর এই বিপদ নেমে এল। কিন্তু এখন তো তার উচিত ছিল বোনদেরকে বুঝিয়ে বলা যে, সে যেহেতু রাজি হয়েছে আপাতত আমি বাসায় যাই, তাকে রেডি করে চিল্লায় পাঠিয়ে তারপর আমি চলে আসব। ন্যুনতম তার কোন ভাগ্নেকে পাঠিয়ে বা মোবাইলে স্বামীকে জানানো তার কর্তব্য ছিল যে, আমরা দুরে চলে যাচ্ছি, দেখতে চাইলে আসুন। কিন্তু এ সবের কোনটাই সে প্রয়োজনবোধ করলনা। শুধু মনে মনে প্রতিক্ষা করতে লাগল।
মাগরিবের পর হাসান যখন বাসায় পৌছাল তার আহট পেয়ে ফেরদৌসি যেন পোষা পাখির মত উড়ে গিয়ে স্বামীর উপর পড়ল। আনন্দাতিশয্যে সে এমন অঙ্গভঙ্গি করতে লাগল যে, হাসানের আশংখা হল এই পাগলিটা কি তাকে জড়িয়ে ধরে চুমাতে শুরু করবে, নাকি কোলে নিয়ে নাচন শুরু করে দেবে। সে স্ত্রীর হাত ধরে টান মেরে পাশের রুমে ঢুকে গেল। ইঞ্জিনিয়ারের পশ্চিমমুখি বাসায় পশ্চিম দিকে বারান্দা, সামনে অল্প ফাঁকা জায়গা, তাতে দুটি নতুন রুম করা হয়েছে। গেইটের পাশের প্রথম রুমটিতে ঢুকেই সে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল, চল বাসায় চল, আমি তোমাকে কোথাও যেতে দিব না। আমাকে ফেলে তুমি কোথাও যেতে পারবে না, আমি চিল্লায় গেলে তোমার যেখানে খুশি যেয়ো। ফেরদৌসি শান্তনা ও অনুনয়ের সুরে বলল- যান, এ কয়টা দিনই তো, দেখতে দেখতে এক বছর কেটে যাবে। হাসান বলল, তোমার কি এখন না গেলে চলে না? – না, দুলাভাইরা মানবে না।
হাসান মেয়েকে কোলে নিল, কেক বিস্কুট খাওয়াতে লাগল। কিন্তু মেয়ে তখন খেলায় মত্ত, সে বিস্কুট খাবে না, কোলে থাকবে না। কোল থেকে নেমে বারান্দায় তার সমবয়সি ইঞ্জিনিয়ারের বাচ্চার সাথে দৌড়াদৌড়ি শুরু করল। তখন হাসান খাটের পাশে গিয়ে বসল, এই প্রথম স্ত্রী তার কোলে বসে অন্তহীন মমতায় দু’হাতে স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খেল। তারপর স্বামীর ডান কাঁধে মাথা রেখে আজকের ঘটনার বিবৃতি দিতে লাগল- বড় দুলাভাই বারবার বলছে ওর সাহস কত বড় আমার বাসায় থেকে ফজরের নামায পড়েনি। বড় মামা না থাকলে যে আজ ভাগ্যে কী ঘটত আল্লাহই জানে ইত্যাদি ফিরিস্তি চলতে থাকল। তারপর বলল- যাইতাম না কিন্তু মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রাজি হলাম। হাসান অবাক হয়ে গেল- মাগি কয় কি, অন্যায় করল সে অথচ এখন এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন আমি একটা নিকৃষ্ট লোক, আমার সাথে তার ঘর করা চলে না, শুধু মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ঘর করতে রাজি হয়েছে। কিন্তু ভালবাসার এ আবেগঘন মহুর্তে সে কিছু না বলে নীরব থাকল। তারপর সে চোখে কিছুটা অবজ্ঞা ফুটিয়ে তুলে আবার জিজ্ঞেস করল- আপনের ভাই আর দুলা ভাই কেন এসেছিল? হাসান বুঝল- এ মেয়েটা মরে গেলেও কোন দিন অহংকার, জেদ আর গোয়ার্তুমি ছাড়বে না, এর কোন চক্ষু লজ্বাও নাই। সে তাদের পারিবারিক নারী তান্ত্রিকতার বিধান বলছে। অর্থাৎ সে স্বামীকে মারবে কাটবে চিলবে লবণ- মরিচ লাগাবে, রোদে শুকাবে, কড়াইয়ে ভাজবে আবার তার বোন ও ভগ্নীপতিরা তাকে ফুটবল খেলবে, যা ইচ্ছা তাই করবে। কিন্তু তাই বলে স্বামীর ভাই, ভগ্নীপতি বা অন্যান্য আত্নীয়রা তার খোঁজ নিতে আসবে কেন, সে তো স্ত্রী ও শ্বশুর পরিবারের গোলাম, তার উপর অন্য কারো অধিকার নাই। হাসান মনে মনে বিরক্ত হল, কিন্তু বিদায় বেলায় স্ত্রীকে রুষ্ট না করে বলল- গণ্ডগোল শুনেছে তো জানতে এসেছিল। কিন্তু স্ত্রী এই উত্তরে সন্তুষ্ট নয়, তার অবজ্ঞাপুর্ন দৃষ্টি কৈফিয়ত চাইছে। তবুও বিদায় বেলায় সেও স্বামীকে আর কিছু বলল না।
ধর্ম লেবাসে নয়, অন্তরে, মানুষের মধ্যে, মানবতার মধ্যে। বরিশালি পটেটো তাবলীগ করে, দাড়ি, টুপি, গোল্লাবের পাঞ্জাবি, দেখতে দরবেশের মত। কিন্তু এ লোকটার চরিত্র কুকুরের চেয়েও অধ্ম, মনটা সাপের মত। তার ভাইয়ের সাথে ফেরদৌসির বিয়ে না হওয়ার কারণ হিসাবে সে হাসানকে দেখতে পারত না, অর্থাৎ কোন প্রেমিকার পিছনে যেমন দুই প্রেমিকের দ্বন্ধ থাকে। সে যখন টের পেল ফেরদৌসির স্বামী এসেছে, তখনই তার পিত্তিটা জ্বলে গেল। তার উপর দরজা বন্ধ করে স্বামী স্ত্রীর মিলনটা সে সহ্য করতে পারল না, বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাসানকে ডাকতে লাগল। হাসান বেরিয়ে দেখে রুমের দরজার সামনে দু’টি বস্তা রাখা, দুই বস্তায় দুই জন বসে তার খবরদারি করছে। পটেটো একা আসেনি, সপ্তম জামাইটাকে সঙ্গে নিয়ে বসেছে। তবে সহজ সরল সে বেচারা কথা বলছে না, মুখ বন্ধ করে বসে আছে। ঘৃণায় হাসানের শরীরটা কাটা দিয়ে উঠল- বিদায় লগ্নে একজন স্বামী তার স্ত্রীর সাথে কথা বলবে আর এরা তা হতে দিবে না, দরজায় পাহারা বসিয়েছে। ছিঃ এরা কি মানুষ নাকি জীব জন্তু, এরা কেমন ধার্মিক। পটেটো খেক খেক করে উঠল- যান যান, তাড়াতাড়ি কেটে পড়েন, আমাদের অনেক আজ আছে, অনেক দূর যেতে হবে, প্রস্তুতি নিতে হবে।
হাসান অনুনয়ের সাথে বলল এই তো যাচ্ছি- বলে রুমে ঢুকে আবার দরজা বন্ধ করল। স্ত্রীকে এতটা প্রফুল্ল আর খুশি জীবনে সে আর কখনো দেখেনি, আত্মতৃপ্তিতে আর মুখটা চাঁদের মত চকচক করছে, একটা বছর আর দেখা হবে না। সে গভীরভাবে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরল, চুমিয়ে চুমিয়ে আদরে সোহাগে তাকে উত্তেজিত করতে চাইল, স্ত্রীও স্বামীর কোলে নিজের দেহটাকে এভাবে সমর্পন করল যা সে পূর্বে কখনো করেনি। বুকে বুক চেপে স্ত্রীর ঠোঁটে ও গালে ওষ্ঠাধরের উষ্ণ পরশ বুলিয়ে যেতে লাগল। স্ত্রীও সীমাহীন মমতায় স্বামীর পিঠে দু’হাত রেখে চেপে ধরল, স্বামীকে চুমিয়ে চুমিয়ে পিঠে মাথায় সমস্ত শরীরে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে তার ভালবাসার জানান দিল। তারপর। কিন্তু একি, হাসানের শরীরটা শিউরে উঠল, প্রফুল্ল মুখ দেখে স্ত্রীর শরীর সম্পর্কে তার আন্দাজ ছিল না। এখন মনে হল যেন চামড়ায় ঢাকা একটা কঙ্কালের উপর শুয়ে আছে। সাথে সাথে তার চেতনা ও উত্তেজনা কর্পুরের মত উবে গেল, নেমে আসল। তার কান্না পেল, হায় এরা মানুষ নাকি অনুভূতিহীন পশু। বউটাকে আদর দেখিয়ে আমার বাসা থেকে ডেকে আনল অথচ এই মেয়েটা এতটা দিন ধরে না খেয়ে দুশ্চিন্তায় শরীরটা নিঃশেষ করে দিয়েছে। অথচ নিজের বোনের প্রতি এরা এতটুকুও খেয়াল রাখেনি।
ওদিকে হাসান দ্বিতীয়বার ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই পটেটো কুকুরের মত খেক খেক শুরু করে দিল। কিন্তু দেরি দেখে বুঝতে পারল তারা কোন অবস্থায় আছে। আর তখনই সে পাগলা কুকুর হয়ে যায়। চিৎকার, চেচামেচি ও গালাগালি শুরু করে দিয়েছে। হাসান ঘৃণায় লজ্বায় তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বলল, এই তো চলে যাচ্ছি। সে বাসার ভিতর থেকে মেয়েকে ডেকে এনে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল, পাগলের মত চুমুতে লাগল। তখন সপ্তম জামাইটা প্রথম মুখ খোলে পরামর্শ দিল- প্রিন্সিপ্যাল আপনাকে এক বছরের ছুটি দিতে পারবে না, ডি সি স্যারের কাছে দরখাস্ত করতে হবে। ডি সি কমিটি ডেকে অনুমোদন দিলে তারপর আপনি চিল্লায় যেতে পারবেন। সময়ের ব্যাপার, আপনি কাল থেকেই কাজে লেগে পরেন। হাসান ঠিক আছে বলে মেয়েকে নিয়ে আবার ঘরে ঢুকল। তা দেখে পটেটো কুকুরের মত ঘেউ ঘেউ করে উঠল- আপনি আবার ঘরে ঢুকলেন কেন, তাড়াতাড়ি বেরুন, বেরুন বলছি, আমাদের কাজ আছে। হায়, হতভাগ্য বেচারা শান্তিতে স্ত্রী সন্তানের সাথে একটু সাক্ষাতের সুযোগও পেল না। হাসান বাচ্চাকে তাড়াতাড়ি স্ত্রীর কোলে দিয়ে উভয়কে জড়িয়ে ধরল, চুম্বন করল, তারপর কেঁদে ফেলল, তারপর মাথা নত করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
কিন্তু গেইটের কাছে গিয়ে সে থমকে দাঁড়াল। গেইট থেকে পাঁচ ফুট ব্যবধানে এ রুমের জানালা। হাসান স্ত্রী সন্তানকে এক নজর দেখার জন্য সেদিকে তাকাল। এক জোড়া মুখ, দুই জোড়া চোখ তার দিকে নির্নিমেশ তাকিয়ে আছে। তার স্ত্রী মেয়েকে কোলে নিয়ে গালেগাল মিশিয়ে তার দিকে বড় করুণভাবে তাকিয়ে আছে। এই দৃষ্টি বড়ই হৃদয় বিদারক, মর্মভেদি, জ্বালাময়ী, সেখানে প্রকট হয়ে উঠেছে রাজ্যের নৈরাশ্য আর হতাশা। মুখে ভাষা নেই কিন্তু ছলছল চারটি চোখ যেন বলছে- এটাই কি আমাদের শেষ দেখা, এখানেই কি চোকে যাবে আমাদের সম্পর্ক, ইহলোকে কি আর আমাদের মিলন হবেনা, আমরা কি একই বন্ধন থেকে হারিয়ে যাচ্ছি চিরদিনের তরে? অন্তহীন বেদনায় হাসানের ভিতরটা দুমড়ে- মুচড়ে হাহাকার করে উঠল। তার চোখ ঝাপসা হয়ে এল, মাথা ঘোরাচ্ছে, পেট গুলিয়ে বমি আসতে চাইছে, বুকটা ভেঙ্গে নিক্ষিপ্ত কাঁচ খণ্ডের ন্যায় চুর্ন বিচুর্ন হয়ে যাচ্ছে। সে চিৎকার করতে চাইল- না না, এ হয় না, এটা অসম্ভব, এটা অন্যায়, এটা জুলুম, এটা অপরাধ, এটা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। বিনা দোষে তোমরা এভাবে আমার স্ত্রী সন্তানকে আমার বুক থেকে কেড়ে নিতে পার না। আমি ওদেরকে কোথাও নিয়ে যেতে দেব না। কিন্তু সে যে অসহায়। তার ডুকরে কেঁদে উঠার উপক্রম হল। কান্না লোকানোর জন্য সে মাথা নিচু করে হন হন করে দ্রুত পায়ে হাটা শুরু করল।
বাসায় পৌঁছে তার অবসন্ন দেহটা বিছানায় ছেড়ে দিল। স্ত্রীর সেই তীক্ষ্ণ চাহনির তীব্র দহন যন্ত্রনায় তার বুকটা জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিল। বেচারা জবাই করা মুরগীর মত তরফাতে থাকে, বিছানায় গড়াগড়ি দিতে থাকে ছটফট করতে থাকে। কত করুণ চাহনি, সেই কাতর দৃষ্টি যেন নিরন্তর তার কলিজায় সুই বিদ্ধ করে চলেছে। এই দৃষ্টি ভুলার নয়, জীবনেও সে ভুলতে পারবে না, কোন মানুষ ভুলতে পারে না। অনুক্ষণ যেন সেই দৃষ্টি থেকে মিনতি ঝড়ে পরছে- বন্ধু আমার, স্বামী আমার, একমাত্র তুমিই আমার জীবন, আমার জীবনের সম্বল, কোন দিন আমায় ভুলো না। একটা বছর আমি ধৈর্য্যধারণ করব, এক বছর পর আবার তোমার বুকে মাথা রাখব। তুমি শুধুই আমার, একমাত্র আমার। হাসান কাত হয়ে বুকে একটা বালিশ জড়িয়ে অধির হয়ে কেঁদে উঠে- না না, আমি তোমায় ভুলব না, ভুলতে পারি না। তোমার কি মনে নেই সেই প্রথম রাত্রে তুমি কেঁদে ফেলেছিলে। তারপর বলেছিলে তোমার যা কিছু সব আমার। হ্যাঁ, তোমার কিছু সব আমার আর আমার যা কিছু সব তোমার, তুমি আমার আমি তোমার। তুমি আমার অর্ধেক দেহ, আমার জীবন সাথী। পৃথিবীর কোন আটলান্টিক অথবা হিমালয় আমাদের মাঝে অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারবে না। আজ তার উপর দিয়ে অনেক ধকল বইয়ে গেছে। এক সময় তার ক্লান্ত অবসন্ন দু’টি চোখে ঘুম নেমে আসে, যেমনটা তার হয় চরম দুঃখ- কষ্টের সময়।
বিষয়: সাহিত্য
১৩৬০ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আসলে এমন লোকদের জন্যই সমস্যা.....
মন্তব্য করতে লগইন করুন