চিঠি- ৩৯ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ০৯:১০:৩৪ সকাল
ইঞ্জিনিয়ার আব্দুর রউফ। কালো, শুকনা, খিট খিটে লম্বা বয়সে প্রৌঢ় একজন মানুষ। লম্বাটে মুখাকৃতিতে ক্ষুদ্র গুতগুতে দুটি চোখ শৃগালের চোখের মত ধুর্ত, চিতার চোখের মত হিংস্র। মুখে কাঠিন্যের ছাপ, গণ্ডারের চামড়ার মত খসখসে পোরু চামড়াস্তর ভেদ করে দাড়ি গজাতে পারেনি, দু’তিন গাছি সাদা দাড়ি ঝুলছে। মুখের বলি রেখার ভাজে ভাজে নিষ্ঠুরতা ও হিংস্রতা ফুটে উঠেছে। মাথার পিছনে দুই কানের সরল রেখার নিচে কোন চুল নাই, অর্ধেক মাথা পর্যন্ত সবটাই ঘাড় মনে হয়, ফলে ঘাড়চিলা মোরগের মত দেখা যায়। সে এমনই তাল পাতার সেপাই যে, কালো চামড়ায় মোড়ানো তার কঙ্কালসার দেহটা একটা ভৌতিক দেহ বলেই মনে হয়। অন্ধকার রাতে খালি গায়ে সে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলে পৃথিবীর যত বড় আলেকজান্ডার, নেপোলিয়ন আর হিটলারই হউক না কেন, তাকে দেখলে ভুত ভুত বলে পরি-মরি দৌড় লাগাবে।
তার স্ত্রী মাজেদা খাতুন, খাট, মাত্রাতিরিক্ত মোটা, এস এস সি পাশ একজন মহিলা। ফেরদৌসি তার সম্পর্কে গর্ব করে বলত- বড়াপার এতগুলি বাচ্চা হয়েছে অথচ এখনো তাকে অবিবাহিত মেয়ের মত দেখা যায়। এখনো তাকে কুমারী বলে বিয়ে দেয়া যাবে। একবার নাকি কয়েকজন মহিলা কোন দরকারে ইঞ্জিনিয়ারের কাছে এল। তারা বউকে দেখিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল- এটা কে, আপনার মেয়ে? ইঞ্জিনিয়ার থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি বলল, না আমার নাতনি। মহিলারা তাই বিশ্বাস করল। ফেরদৌসির বিয়ের দিন নাকি তার দ্বিতীয় বোন বড় বোনকে বলল, তোমার গাল এখনো যে ঠসঠসে, তুমি মেয়ে বিয়ে দিবে কেমনে? সে হেসে বলল- আমি জামাইয়ের সামনে যাব না। কিছুদিন পর মেয়ের বিয়ে দিল, কিন্তু বেচারি পরল ফ্যাসাদে, জামাইয়ের সামনে যেতে লজ্বা পায়। জামাই বাবাজি সারাদিন অপেক্ষা করল, সারা রাত অপেক্ষা করল শাশুড়ির পদধূলি মাথায় নিয়ে নিজেকে ধন্য করতে, কিন্তু শাশুড়ির তো দেখা নাই। পরদিন বেচারি ভাল করে ঘোমটা- ঘামটি দিয়ে এডির বউ হাফুরিকে সাথে নিয়ে গেল পাশের রুমে জামাইকে পদধুলি দিতে। কিন্তু হতভাগা জামাই বেচারার শাশুড়ির মুখ দর্শন হল না, শুধু পা দর্শন হল।
এ মহিলার বুক থেকে পেট পর্যন্ত সবটাই কলিজা, দুরন্ত সাহসি, অসম্ভব কর্তৃত্ব পরায়ণ, মাত্রারিতিক্ত অহংকারী, স্বেচ্ছাচারী ও স্বৈরাচারি। অন্যদের পদানত করে রাখা তার নেশা। সে হল তার বাবা ও স্বামীর পরিবারের অঘোষিত ঈশ্বর, স্বামী হল তার পদানত কৃতদাস। এই মহিলা রাজনীতি করলে খ্যাতি অর্জন করতে পারত। তার বিরোধি কোন দল বা দেশ সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে পোড়িয়ে ধ্বংস করে দিলেও তার কপালে কোন ভাজ পরত না। সে হতে পারত এক আদর্শ লেডি হিটলার। এই মহিলা স্বামীকে তার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজের পরিবারের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে।
ফেরদৌসীরা ইঞ্জিনিয়ারের সর্বদা উচ্ছসিত প্রশংসা করত, যতটা অন্য কারো করত না। এর কারণ এ ইঞ্জিনিয়ার ছিল তাদের পারিবারিক ক্রীতদাস, বলা যায় একেবারে সাফ কাওলার গোলাম। তার কাজ ছিল চাকরি করা, তাবলীগ করা আর স্ত্রীর অভিপ্রায়গুলি বাস্তবায়ন করা। তার সকল শ্যালিকাকে বিয়ে দেয়া, নিজের বাসায় রেখে বিয়ে দেয়া, এখানেই বাসর শয্যা, নায়র, আনাগোনা, দেখা সাক্ষাত সব কিছুই বাবার বাসার মত এখানেই হয়। আত্মীয় স্বজনদের আনা গোনা ও তাদের সকল দায়িত্ব পালন করা ইত্যাদি ছিল তার কর্তব্য কাজ অর্থাৎ তার বাসাটি যেন শ্বশুরের বাসা, এখানে সকল মেয়ে ও মেয়ের জামাইরা আসত বেড়াত, আনা গোনা করত।
পক্ষান্তরে ইঞ্জিনিয়ারের নিজের পরিবারের সাথে তার কোন সম্পর্ক ছিল না। নিজের ভাতিজা ভাগিনাদের লেখাপড়া বা ভাতিজী ভাগিনিদের বিয়ে শাদি ইত্যাদি ব্যাপারে সে ফিরেও তাকাত না, এমনকি কোন যোগাযোগ ও সম্পর্ক রাখত না। তাদের কেউ উপযাচক হয়ে বাসায় বেড়াতে এলেও ছেলে মেয়েদের কেউ কথা বলত না, হয়ত তার শ্যালিকা বা শ্বশুর বাড়ির কেউ কেউ থাকত কিন্তু কথা বলত না, ফলে বেচারারা লজ্বিত অপমানিত হয়ে বিদায় নিত। এভাবে দু’চার বার অপমানিত হওয়ার পর সঙ্গত কারণেই তারা সরে পড়ত, সম্পর্কচ্ছেদ হয়ে যেত। এসব কারণে ইঞ্জিনিয়ারের পরিবারটা সম্পূর্ণ মাতৃ তান্ত্রিক পরিবার রুপে গড়ে উঠেছে। তার ছেলে মেয়েদের মুখে নানা নানু খালা খালুদের আলাপ আলোচনা ও প্রশংসা শুনা যেত, দাদা-দাদী, কাকা-কাকি, ফুফা-ফুফু এদের কারো নাম ভুলক্রমেও উচ্চারিত হত না।
একদিন তার এক ছেলে নানার স্তুতি সম্বলিত একটা কবিতা লিখে হাসানকে পাঠ করে শুনাচ্ছে। মুরুব্বীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা খুশির বিষয়, কিন্তু তার মন বিষিয়ে উঠেছিল কারণ, এরা শুধু নানা নানীরই প্রশংসা করে দাদা দাদীর নামটা পর্যন্ত মুখে উচ্চারণ করে না। দাদা দাদী দরিদ্র, মূর্খ, তুচ্ছাতিতুচ্ছ হলেও রক্ত- সম্পর্কের একটা ব্যাপার আছে। এরা তো কোনদিন দাদা দাদীর জন্য হাত তুলে দোয়া করবে না, একটি পয়সাও দান করবে না, একটা মিসকিন খাওয়াবে না, সুরা ফাতেহা পড়ে তাদের জন্য মাগফেরাত কামনা করবে না। ইঞ্জিনিয়ার তো গোলাম হয়ে গেছে, কুলাঙ্গার হয়ে গেছে। কিন্তু তার সন্তানরা? বাবা মা হাসানের গর্বের ধন, তার সন্তানরাও কি তাহলে তার মা বাবার নাম মুখে উচ্চারণ করবে না, তাদের জন্য দোয়া করবে না, তাদের রেখে যাওয়া সম্পদ ভোগ করবে অথচ পৃথিবীতে তাদের প্রতিনিধিত্ব করবে না? হায়, এক অব্যক্ত বেদনা ও হতাশায় সেদিন হাসান যেন মাটিতে মিশে গিয়েছিল।
ইঞ্জিনিয়ারের পরিবারের কেউ সাধারণত তার বাসায় আসত না। একটা ভাগ্নে জোর করে থাকত। এ ছেলেটাকে দিয়ে হাট বাজারসহ বাসার যাবতীয় কাজ কর্ম করানো হত, ছেলেটার মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখা-পড়া ছিল। আশায় ছিল তার মামা একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিবে। সে যতদুর জানে, তার অধীনে একটি খালি পদ ছিল কিন্তু স্ত্রীর প্রভাবে সে পদটিতে নিয়োগ বন্ধ করে রাখে- যাতে তার ভাগ্নে ছোট এ পদটিতেও ঢুকতে না পার। অবশেষে ছেলেটি মামা যেন টের না পায় অতি গোপনে বাইরের লোক দিয়ে তদবির করে, টাকা পয়সা খরচ করে চাকরিটা নিশ্চিত করে, তারপর ঘটনা প্রকাশ পায়। তার স্ত্রী জেনে কৈফিয়ত তলব করে- অমুকের নাকি চাকরি হয়ে গেছে? ইঞ্জিনিয়ার মোসাহেবি হাসি দিয়ে বলে, আরে না, চাকরি এত সহজ নাকি। এভাবে সে ইসলামের কঠোর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে স্ত্রীর দাসত্ব নিগড়ে আবদ্ধ হয়ে যায়।
সে ছিল ম্যাট্রিক ও ডিপ্লোমা করা একজন ইঞ্জিনিয়ার। আশির দশকের গোড়ার দিকে একটা চাকরি পেয়েছে এবং অভিজ্ঞতায় ধীরে ধীরে পদোন্নতি পেয়ে অগ্রসর হয়েছে। উচ্চশিক্ষিত, বড় আলেম বা তাবলীগের বড় বড় মুরুব্বীদের সাথে মিশত না, কারণ তাদের সাথে কথা বলার মত শিক্ষাগত ও ব্যবহারগত কোন যোগ্যতাই তার ছিল না। তার মধ্যে যা ছিল শুধু অহংকার। তার নির্ধারিত কর্মসুচি ছিল অফিস, তাবলীগ ও বাকী সময় বাসায় বসে থাকা। কিন্তু লোকটা ছিল শৃগালের চেয়েও ধুর্ত ও বন্য কুকুরের চেয়েও হিংস্র। সে তুলনামূলক তার অধিনস্থ লোকদের সাথে মিশত এবং তাদের সাথে এমন কর্কশ ভাষায় কথা বলত আর রুঢ় আচরণ করত যে, তারা তার অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য সর্বদা তটস্ত থাকত । কিন্তু তার ছিল কর্তৃত্বের প্রতিভা, কাজেই সাধারণত কেউ প্রতিবাদ করত না বা করার সাহস পেত না। সে এতটাই অহংকারী ছিল যে, তার বলয়ের সবাইকে পদানত করে রাখতে চাইত। এমনকি তার মামা শ্বশুর বা এ জাতীয় কোন মুরুব্বী এলেও তাদের সাথে গেয়ো গোয়ারের মত রুক্ষ ব্যবহার করত। আর তখন আরেক ধুর্ত শৃগাল তার বউ এসে সেই মুরুব্বীর পা ছোয়ে সেলাম করত আর বুঝাত যে, সৌজন্যের জন্য করেছে কিন্তু আসল উদ্দেশ্য তার স্বামীর ব্যবহারে যেন তিনি রাগ না করেন। তার বউ মাঝে মধ্যে কৌতুক করে বলত- তার স্বামী যেমন চরের মানুষ, ব্যবহারটাও ঠিক চরুয়াদের মতই।
পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে যারা অহংকারকে একমাত্র জীবন চলার পাথেয় হিসাবে গ্রহণ করে। মানুষকে পদানত করে রাখতে চায়, ইঞ্জিনিয়ার দম্পতি ছিল এই শ্রেণীভুক্ত। যদিও শিক্ষা সম্পদ বা পদাধিকারের দিক থেকে মানুষকে পদানত রাখার সামর্থ তাদের ছিল না। ইঞ্জিনিয়ার তার ছোট শ্যালিকাদের তাবলীগি দেখে দেখে বিয়ে দিত আর ওদের উপর কতৃর্ত্ব খাটাত। আর এসব জামাইরা যেমন ছিল স্ত্রৈণ তেমনি তাবলীগের মুরুব্বী হিসেবে ইঞ্জিনিয়ারকে দেবতা জ্ঞান করত এবং ইঞ্জিনিয়ার দম্পতিকে ঈশ্বরের মত মেনে চলত। এরা তাবলীগকেই একমাত্র ইসলাম মনে করত। এভাবে এরা আট বোন মিলে একটা নারী তান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলে যা বাহ্যিক ইসলামী পরিবেশ মনে হলেও বাস্তবে এদের কর্মকান্ড ছিল ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত। অর্ধশিক্ষিত এ মানুষগুলির মধ্যে কেউ আলেম ছিল না বিধায় ইসলাম বুঝত না। তাই এরা নিজেদের খেয়াল খুশিকেই ইসলাম মনে করত।
ইঞ্জিনিয়ার ও তার স্ত্রী ভাল করেই জানে ফেরদৌসি ভয়ানক অন্যায় করেছে, তার স্বামীর কোন দোষ নেই। কিন্তু এরা ছিল এতটাই অহংকারী আর স্বেচ্ছাচারী যে, শত অন্যায় করলেও তারা তাদের মেয়ের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ শুনতে রাজি নয়। হাসান অভিযোগ করল কেন এটা তার অন্যায় হয়েছে। এ জন্য ইঞ্জিনিয়ার প্রথমে কিছু হুমকি ধমকি দিল, ফেরদৌসিকে দিবে না, বাসা করে দিবে, চলার ব্যবস্থা করে দিবে ইত্যাদি। এতে সে আশা করে ছিল হাসান যাবে এবং তারা স্বামী-স্ত্রীর হাতে পায়ে ধরে মাফ চাইবে, তখন দুয়েকটা ধমক দিয়ে স্ত্রীকে দিয়ে দিবে। কিন্তু হাসান বেচারা বুঝলই না, অপরাধ করল স্ত্রী, এখন উল্টো তাকে মাফ চাইতে হবে, হাতে পায়ে ধরতে হবে। কাজেই সে যায়নি। আর তখন ইঞ্জিনিয়ার ও তার স্ত্রী সত্যি সত্যি ক্ষেপে গেল। তারা হাসানকে শায়েস্তা করার সিদ্ধান্ত নিল, তারা পরামর্শ করল হাসানের ঘাড় ধরে তালাক নিয়ে নিবে, তারপর ফেরদৌসিকে তাবলীগি দেখে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দিবে।
জাহান্নামের এই কুকুর কুকুরি একটিবার ভাবল না, স্বামীর কি হবে, স্ত্রীর কি হবে, বিশেষত একটা বাচ্চা আছে, বাচ্চাটার কি হবে? হ্যাঁ, চিন্তা করত যদি ফেরদৌসি তাদের নিজের মেয়ে হত। তখন অবশ্যি জামাইকে ডেকে এনে উভয়ের বক্তব্য শুনে মীমাংসা করত। কিন্তু অন্যের মেয়ের প্রতি তাদের সেই দরদ ছিলনা। তদুপরি এরা ছিল এমন নিচু প্রকৃতির মানুষ যে, শুকনা গু চিবিয়ে অন্যের মুখে থুথু দিয়ে অন্যকে নাপাক করার আনন্দে হাত তালি দেয়।
শুক্রবার রাতে ইঞ্জিনিয়ার ও তার স্ত্রী মিলে শলা পরামর্শ করল, পরদিন হাসানকে ঘাড় ধরে এনে তালাক নিবে। এতে যদি ফেরদৌসী বা অন্যান্য ভগ্নিপতিরা রাজি না হয়, তাহলে হাসানকে এক সাল চিল্লা লাগানোর শর্ত দেয়া হবে। যদি রাজি হয় তো ভাল। অন্যান্য জামাইদের মত স্ত্রীর অনুগত হয়ে যাবে, আর কোন গণ্ডগোল হবে না। আর যদি রাজি না হয় তাহলে ওকে ধরে এনে মেরে কুটে তালাক নেয়া হবে। তবে শর্ত থাকল, হাসানকে কখনোই তাদের বাসায় ডাকা হবে না। কারণ বাসায় ডাকলে সে ফেরদৌসির অপকর্মগুলির কথা বলবে এবং তারা বিচার না করে যেসব ষড়যন্ত্র করেছে সকলের সামনে সেগুলি বলে দিবে। কাজেই তাকে জবান বন্দির কোন সুযোগ দেয়া হবে না। সকলের সম্মতিতে তালাকের সিদ্ধান্ত হলে বাসা থেকে ধরে এনে তালাক নিবে। আর চিল্লার সিদ্ধান্ত হলে বাসায় প্রস্তাব দিয়ে পাঠানো হবে। যদি রাজি হয় তো ভাল, নইলে ধরে এনে তালাক নিয়ে নিবে। কারণ ইসলামী বিধান মতে স্বামী কর্তৃক তালাক দিতে হয়, স্ত্রীর তালাক দিলে শুদ্ধ হয়না।
ইঞ্জিনিয়ার শুক্রবারে বসার জন্য তাদেরকেই ডাকল যারা তার বশংবদ, তাকে ধর্মাবতার মনে করে। সে কোন কথা বললে প্রতিবাদ না করে অবনত মস্তকে মেনে নিবে। এ জন্যই সে ফেরদৌসির বড় ভাইকে ডাকেনি। কারণ এ লোকটা তাদের মত অহংকারী নয়, সহজ সরল। তাছাড়া সে সকলের বড়, ইঞ্জিনিয়ারকে মানে না। সে আসলে মিয়াঁ বিবি দুজনকে একত্র করে উভয়ের কথা শুনবে, তখন বোনের অন্যায় দেখলে তাকে থাপড়িয়ে স্বামীর হাতে তুলে দিয়ে বলবে, নিয়ে যাও, ও অন্যায় করলে মেরে হাত পা ভেঙ্গে দিও। এ জন্য তাকে ডাকা হয়নি। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার একটা ভুল করল ফেরদৌসির বড় মামাকে ডেকে এনে, এই ব্যক্তির জন্য সে দিন তার মনোবাঞ্জা পূর্ণ হয়নি।
শুক্রবার। জুমার নামাযের পর সবাই বসল। ইঞ্জিনিয়ার একটা চেয়ারে বসা, বাকীরা কেউ খাটে কেউ মাটিতে কেউ চেয়ারে বসল। সে চোখ ঘুরিয়ে একবার সকলের দিকে তাকাল, গর্বে সে ব্যাঙের মত ফুলে উঠল। কারণ এরা সবাই তার উম্মত, তার দাস, সে এদের প্রভু। তার কথাকে এরা ইশ্বর বাক্যের ন্যায় অভ্রান্ত অলঙ্ঘনীয় হিসাবে মেনে নেয়। সে কথা বলবে, কিন্তু ভাবছে কি বলবে। অনেক স্বামীরা নেশা করে, যৌতুক চায়, স্ত্রীকে মার ধোর করে, গালাগালি করে কিন্তু হাসানের এসব অন্যায় তো নেইয়ই বরং সে স্ত্রীর হাতে নির্যাতিত। কাজেই জামাই পেঁয়াজ খাওয়ার মত খুত ধরে সে বলা শুরু করল, ওর মত বদ চরিত্র মানুষের কাছে মেয়ে দেয়া আমি ঠিক মনে করিনা। ও তো মানুষ নয় একটা পশু, বউয়ের সাথে উল্টা পাল্টা ভাবে থাকে। সে এত অহংকারী যে আমাদেরকে মানুষ মনে করে না, ভাবে সে একাই শিক্ষিত একাই ধনী, আমরা তার সামনে কিছুই না। ওর সাহস কত বড় আমার বাসায় থেকে ফজরের নামায পড়েনি। আর কোন ইস্যু না পেয়ে সে এ কথাটাই বার বার আবৃত্তি করতে লাগল। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল নিজের ব্যক্তিত্বের জানান দেয়া যে, সে চাট্টিখানি ব্যক্তি নয় যে তার বাসায় কেউ উল্টা পাল্টা করবে। তদুপরি পৃথিবীতে সেই যে একমাত্র বাসার মালিক, এমন বাসা যে দুনিয়ায় আর কারো নেই এ কথার জানান দেয়া। ফজর নামাযের সূত্রটা হল, বাসর রাতে স্ত্রীর অসুস্থাবস্থায় তার একটু সমস্যা হয়েছিল। তখন সে ফজরের নামায পড়তে পারেনি। এটাই এখন তার বিরুদ্ধে দলীল।
এডি দেখল তার প্রভু আর কিছু বলতে পারছে না, তখন সে মোসাহেবির প্রয়োজন বোধ করল- হুজুরকে দেখে ওর কাছে বিয়ে দিয়েছিলাম, মানে হাসানের বাবাকে বুঝাল, কিন্তু সে তো হুজুরের পায়ের সমানও হয়নি। ওর কাছে বিয়ে দিয়ে ভুল করেছিলাম। সে বউয়ের উপর অত্যাচার করত আর আমার কাছে গিয়ে উল্টা বিচার দিত। ওর মত একটা খারাপ ছেলে হয় নাকি। আমি বলি মেয়েকে আর দেয়ার দরকার নাই, সে সারা জীবন এমনই করবে। এভাবে তারা হাসানের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট কোন অভিযোগ পেশ করতে না পেরে শুধু দোষারোপ করে চলল। ফেরদৌসির বড় মামা একজন আধুনিক শিক্ষিত, উদারমনা মানুষ। সাধারণ ধর্ম কর্ম করে, তাদের মত তাবলীগও করে না গোড়া ধার্মিকও না। তিনি অবাক হয়ে গেলেন, তারা বলছে মেয়ে দিবে না অথচ বিয়ে ভাঙ্গার মত কোন কারণ তিনি দেখতে পেলেন না। মাঝে মধ্যে ফজরের নামায না পড়লে যদি বিয়ে ভেঙ্গে দিতে হয় তাহলে তো দুনিয়ার কারো বিয়ে তো টিকবেই না এমনকি যত আলেম উলামা আল্লামা আছে কারো বিয়ে টিকে থাকার কথা নয়। ওদের অহংকারটা তিনি বুঝতে পারলেন, তার মনে ঘৃণা ধরে গেল। কিন্তু কিছু বলার সাহস পেলেন না, কারণ ইঞ্জিনিয়ার বয়সে তার বড়, মামা শ্বশুর হিসাবে মানে না, কিছু বললে অপমান করবে।
কিন্তু তিনি অস্বস্তি বোধ করছেন। এরা কোন ধরণের ধার্মিক, খেয়াল খুশির বসে কোন কারণ ছাড়াই একটা সংসার ভেঙ্গে দিতে চায়, যেখানে তিনটি জীবন জড়িত। তার মন কাঁদছে কেন বিয়েটা ভেঙ্গে যাবে, তিনটা জীবনের কী পরিণতি হবে। অবশেষে তিনি উঠে পাশের রুমে গেলেন। ফেরদৌসি তখন শুয়ে শুয়ে কাঁদছে। তিনি ভাগ্নিকে বললেন, কিরে বিয়ের দুই বছরের মধ্যেই তোদের এই অবস্থা বাকী জীবন কেমনে চলবে, এখন কী করবি? ফেরদৌসি উঠে বসে অন্তহীন আশা ও ভরসা নিয়ে মামাকে বলল, আরেকবার যাই, দেখি কী হয়। কিন্তু ঐ অভিশপ্ত নারী আসল কথাটা বলল না যে, দোষ থাকলে আমার আছে, আমার স্বামীর কোন দোষ নাই, থাকলেও এমন কোন দোষ নাই যে তার সাথে ঘর করা যাবে না। এই আমি চললাম তার কাছে। তাহলেই সকল ল্যাঠা চুকে যেত। মামা আশান্বিত হলেন, উৎফুল্ল হলেন। তিনি দরবার কক্ষে গিয়ে বললেন, মেয়ে তো যাবে তাকে বাধা দেয়া ঠিক হবে না।
ইঞ্জিনিয়ার দম্পতি ছাড়া কেউ চাচ্ছিল না যে বিয়েটা ভেঙ্গে যাক। কারণ এমনিতে ভাল মেয়েদেরই সহজে বিয়ে হয় না। এ ক্ষেত্রে ফেরদৌসির বিয়ে হয়েছে, বাচ্চা আছে, এমন মেয়েকে বিয়ে দেয়া কঠিন হবে। বিয়ে হলেও ভাল জামাই পাওয়া যাবে না। কাজেই মামার প্রস্তাব শুনে তারা সবাই খুশি হয়ে গেল, আশ্বস্ত হল। ইঞ্জিনিয়ার হল শৃগালের মত ধুর্ত। সে জানে, এখন যদি সে না দেয়ার কথা বলে তাহলে কেউ মানবেনা, উল্টো তাকে দোষারোপ করবে। এজন্য সে নীরব থাকল। কিন্তু তার বউয়ের কানে পোকা ঢুকল, সে অস্থির হয়ে উঠল। পাশের রুম থেকে চেচিয়ে বলল, না এত সহজে দেয়া যাবেনা, তাহলে দু’দিন পরপর গণ্ডগোল করবে, আগে এক সাল (বছর চিল্লা) লাগিয়ে আসুক তারপর চিন্তা ভাবনা। যেহেতু তারা তাবলীগি, এ প্রস্তাব সবাই সমর্থন করল। বলাবলি করল, এটা উত্তম প্রস্তাব, বছর চিল্লা দিলে আর কোন সমস্যা থাকবে না, সব ঠিক হয়ে যাবে। ইঞ্জিনিয়ার বলল, ওর স্বভাব ভালো না, বউয়ের সাথে কেমনে থাকতে হয় জানে না। আগে সাল লাগিয়ে স্বভাব- চরিত্র ঠিক করুক তারপর চিন্তা ভাবনা করা যাবে। সভায় সাল চিল্লার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হল।
ফেরদৌসিদের সকল ভগ্নিপতি স্ত্রৈণ ও স্ত্রীর ক্রীতদাস হলেও ওদের পারিবারিক ক্রীতদাস দুজন, ইঞ্জিনিয়ার ও বরিশালি পটেটো। নূরানিকে পটেটোর কাছে বিয়ে দেয়ার সুবাদে সে ছিল ইঞ্জিনিয়ারের প্রতি কৃতজ্ঞ, বলা যায় ক্রীতদাস। এমন ক্রীতদাস যে, ইঞ্জিনিয়ার যদি তাকে বলে- অমুক জায়গা থেকে দশটা লাশ ফেলে আস, তাহলে সে মুখে তোলা লোকমা ফেলে দিয়ে আগে কাজটা সমাধা করবে। কাজেই হাসানের কাছে প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার জন্য তৃতীয় জামাই বজলু, পঞ্চম জামাই ফুলপুরের জহির ও ষষ্ট জামাই অর্থাৎ নূরানির জামাই পটেটোকে নির্বাচন করা হল। তারপর পটেটোকে দলনেতা করে ইঞ্জিনিয়ার ঘোষণা দিল- আপনারা গিয়েই তাকে সাল চিল্লার প্রস্তাব দিবেন। যদি রাজি হয় তাহলে বলবেন এ মাসেই চলে যেতে হবে। আর যদি রাজি না হয় তাহলে সাথে সাথে ধরে বেঁধে বাসায় নিয়ে আসবেন, তারপর তালাক নিব। মামা চমকে উঠে বললেন- যদি তালাক না দেয়? ইঞ্জিনিয়ারের ঠোঁটের কোনায় হিংস্র হাঁসি ফুটে উঠল- ওর হাড়-মাংস আলাদা করে ফেলব না। মামার ভিতরটা কেঁপে উঠল, তার মনে হল শীঘ্রই এখানে খোদার গযব নাযিল হবে। তার কথা ইঞ্জিনিয়ার মানবে না বিধায় এখানে থাকা তিনি সমীচীন বোধ করলেন না। আমার একটু জরুরি কাজ আছে- বলে তিনি হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন। ওদিকে প্রতিনিধি দল হাসানের বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করল।
বিষয়: সাহিত্য
১৪৩৬ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন