চিঠি- ৩৮ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:২৫:৫৯ দুপুর
পৃথিবীতে যত অনর্থ ঘটেছে এবং ঘটবে এ সবের মূলে রয়েছে অহংকার, দাম্ভিকতা। এ অহংকারের কারণে কত যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে, কত দেশ জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে, কত সংসার ভেঙ্গে গেছে, কত জীবন ক্ষয়ে ক্ষয়ে মৃত্তিকা বাসর রচনা করেছে। এ জন্যই হাদীসে কুদসিতে আল্লাহ্ বলেছেন “আল- কিবরিয়াউ রেদায়ি, লা তানাযায়ু বিরেদায়ী- অহংকার আমার চাদর তা নিয়ে টানাটানি করো না”। অথচ এ অহংকারই আজ তিনটি জীবন ক্রমে ক্রমে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে। ইঞ্জিনিয়ার ও তার স্ত্রী দুজনই স্বত্ত্বাগতভাবেই ছিল অহংকারী, স্বেচ্ছাচারী। আল্লাহ্ তা’লা দু’জন মূর্খ অহংকারীকে একত্র করে দিয়ে ছিলেন। এদের সম্পদ বলতে ছিল- শহরে তিন শতাংশ জমির উপর তিন রুমের একটা বাসা। অথচ এ ব্যক্তিই কিনা আমার স্ত্রীকে বলে বাসা করে দিবে, সারা জীবন চলার ব্যবস্থা করে দিবে। অথচ তার কয়েক হালি সন্তান, এদের মাথা গোজার ও জীবন চলার ব্যবস্থা করে দেয়া তো দুরের কথা, ভবিষ্যতে ওদের তিন বেলা দু’মুঠো ভাতের সংস্থানও করে যেতে পারবে না। সে ব্যক্তি কিনা আমার স্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে আমার সংসার ভাঙ্গতে চায়। মানুষ এতটা স্বৈরাচারী কী করে হতে পারে। একবার আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করল না কী হয়েছে। চিল্লা থেকে আসল, বউ সারা রাত কান মন্ত্রনা দিল আর অমনি সে কোন কিছু না শুনে, না বুঝেই আমার সংসার ভাঙ্গার কাজে উঠে পরে লাগল। এ জন্যই গ্রাম্য প্রবাদে বলে- কি করিবে সুজন পুতে কান মন্ত্রনা দাতা যদি সঙ্গে হুতে ( শয়ন করে)। অর্থাৎ পুত্র সুজন হলে কি হবে স্ত্রী যদি শুয়ে শুয়ে কান মন্ত্রনা দেয়। তার বউ সারা রাত যা বুঝিয়েছে তাই শুনে সে এখন আমার শত্রু হয়ে গেল। হাসান বিছানায় পড়ে এসব চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল।
একাকি বাসায় ভাল লাগে না, অস্থিরতা লাগে। রান্না খাওয়ার নাই কোন ঠিক ঠিকানা। পরদিন বিকালে আবার স্ত্রীর কাছে ছুটে গেল। অন্যদিন সে বাসায় যাওয়া মাত্রই স্ত্রী যেখানেই থাকুক ছুটে আসত। কিন্তু আজ সে অনেক্ষণ বসে থাকল, আসল না। সে গেস্ট রুম অর্থাৎ ঈশান কোণের রুমটিতে বসে বসে গলা খাকারি দিল, মেয়েকে মুনিরা মুনিরা ডেকে নিজের আগমনের জানান দিল। অবশেষে স্ত্রীর মন্থর দেহটা এসে হাযির হল। দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে অনিচ্ছায় এসেছে, মুখটা বিষ হয়ে আছে। হাসানের মনে আশংকা দেখা দিল, সে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বলল- চল যাই গা। - এখন যামু কেমনে, দুলা ভাই খুব ক্ষেপে আছে। ফেরদৌসী খাটের কোনায় বসল আর হাসান মেয়েকে কোলে নিয়ে চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করল - কেন? – আপনে অহংকার করেন, আমাদের কাউকে মানেন না, নিজেকে খুব শিক্ষিত আর খুব ধনী ভাবেন, সকলের চেয়ে নিজেকে বড় মনে করেন। - তুমি এসব বলেছ নাকি? – বলবই তো। – তাহলে আমিও বলবই তো, শিক্ষা ও সম্পদে আমি তাদের চেয়ে তো বেশিই। - ঠিক আছে, আপনের শিক্ষাও বেশি সম্পদও বেশি, তাই বলে আপনি অহংকার করবেন নাকি। - অহংকার তো আমি করিনি, তুমিই অহংকারের দাপটে আমাকে তাদের সামনে ইঁদুর বিড়াল বানিয়ে রাখ, তখন আমি হয়ত রাগে সত্য কথাটা বলেছি মাত্র। সে চোখ গরম করে- রাগে যেমন বলেছেন না এখন ঠেলাটা টের পাবেন। কে বড় কে ছোট এখন বুঝতে পারবেন- বলে স্বামীর দিকে অগ্নি দৃষ্টি হেনে হন হন করে পাশের রুমে চলে গেল। হাসান নিরাশ হয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে বাসায় চলে গেল। সারা রাত ঘুম হলনা, অভ্যাস অনুযায়ী রাত বারটার পর তাহাজ্জুদ ও তাসবীহ পড়া শুরু করল।
মনটা ভেঙ্গে গেছে, কিছুই ভাল লাগে না, পরদিন বিকালে আবার গিয়ে হাজির হল। অনেকক্ষণ বসে থাকল, গলা খাকারি দিল, স্ত্রীকে ডাকল, ইঞ্জিনিয়ারের ছেলেকে এবং ওকে তাকে ডাকল, অবশেষে মুনিরা মুনিরা বলে অনেক্ষণ ডাকাডাকি করল তবুও স্ত্রী এল না। পাশের রুমে মুনিরার কান্না শুনা যাচ্ছে, বুঝা যাচ্ছে বাবার আওয়াজ পেয়ে বাচ্চাটা আসতে চাচ্ছে কিন্তু তাকে আসতে দিচ্ছে না। তারপর সে দরজায় করাঘাত করতে লাগল, তখন ইঞ্জিনিয়ারের মেজো মেয়েটা এসে ধমকের সুরে বলল- আপনি এত ডাকাডাকি করতেছেন কেন, খালামনি আপনার সামনে আসবে না, আব্বা বলেছে আপনার ঘরেও আর দিবে না, আপনি চলে যান। একটা লোহার গরম শলাকা যেন তার কলজেটা এপোর ওপোর করে দিল। হুলকুম পর্যন্ত ফেনায়িত হয়ে উঠল কান্না। সে অসহায়ের মত কিছুক্ষণ বসে থাকল। আবু দারদা এসে তার গায়ে ঢলাঢলি করছে, কিছু একটা বলতে চাচ্ছে কিন্তু সে পাত্তা না দিয়ে আস্তে আস্তে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।
নাওয়া নাই খাওয়া নাই। বেচারা সারা রাত ধরে কখনো নামায পড়ে, কখনো বিছানায় গরাগরি করে রাত কাঁটাল, এক ফোটা ঘুম হল না। তাহলে কি ইঞ্জিনিয়ার আমাদের তিনটি জীবন নষ্ট করে দিবে, তার নিজের মেয়ে হলে কি সে এমন করতে পারত। অবশ্যই তখন জামাইকে ডেকে এনে বিচার- ফয়সালার ব্যবস্থা করত। আমার বউ তো আর তার মেয়ে না, আমিও তার কিছু না। কাজেই আমাদের জীবন নষ্ট হলে তার কি। এসব চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। পরদিন বিকালে আবার বাসায় গিয়ে উপস্থিত হল। অনেকক্ষণ বসে থাকল ডাকাডাকি করল কিন্তু কেউ এল না। বুঝা যাচ্ছে মুনিরা আসার জন্য কাঁদছে। আবার সেই মেয়েটা বলল- আপনি প্রতিদিন এসে ডাকাডাকি করেন কেন, আপনার কি লাজ লজ্বা নাই। বলছি না খালামনি আপনার সামনে আসবে না। হাসান অসহায়ের মত কিংকর্তব্য বিমুর হয়ে বসে থাকল।
গোটা শ্বশুর বলয়ের মধ্যে হাসানের একটা গমখার খাটি বন্ধু ছিল, ছোট্ট বন্ধু, অসম বয়সের বন্ধু। ইঞ্জিনিয়ারের সাত আট বছরের ছেলে আবু দারদা। বিয়ের আড়াই বছরের মধ্যে এই শিশুটি ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে তার আন্তরিকতা বা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেনি, এমনকি স্ত্রীর সাথেও না। সে গেলেই আবু দারদা এসে পোষা বিড়ালের মত তার গায়ের সাথে গা ঘেঁষে ঢেস দিয়ে বসে, কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকে। তারপর বলে খালু টাকা দেন পান এনে দেই। সব সময় সে খালুকে দোকান থেকে খিলি পান এনে দেয়। এভাবেই সে খালুর সাথে ঘনিষ্ট হয়ে উঠে। সেদিন ছেলেটি এসে হাসানের সাথে বসল। খালুর মুখের দিকে তাকিয়ে দুঃখিত হল। তারপর কেউ দেখে ফেলে কিনা ভীতগ্রস্থ দু’টি চোখে এদিক সেদিক তাকিয়ে খালুর হাত ধরে টানতে টানতে ফিসফিসিয়ে বলল, খালু আসেন, আপনার সাথে কথা আছে। সে শিশুটির কাঁধে হাত রেখে ধীরে ধীরে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।
বাসার বাইরে গিয়ে ছেলেটি আবার এদিক সেদিক তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল- খালু জানেন, খালামনি না আপনার অনেক বদনাম কইছে। আপনি নাকি তাকে কয়েক দিন মারছেন, আপনি অহংকার করেন, আপনি নাকি বাকী খালুদের চেয়ে বেশি ধনী, বেশি শিক্ষিত, অন্য খালুরা আপনের সামনে কিছুই না। আপনি খালি বড়লোকি আলাপ করেন। আপনি বই লিখবেন, প্রকাশ করবেন, অনেক বড়লোক হবেন। আপনি নাকি খালামনির সাথে উল্টা পাল্টা থাকেন। আচ্ছা খালু উল্টা থাকা মানে কি, খালামনির পায়ের দিকে আপনি মাথা দিয়ে শুয়ে থাকেন নাকি? হাসান হাসল- হা, তোমার খালামনি তো আমার মুনিব, আমি তার গোলাম। তার সাথে শুইলে তো আমার বেয়াদবি হবে। এজন্য তার পায়ের কাছে মাথা রেখে শুই।
আচ্ছা আর কি কি বলেছে? আরো অনেক কথা, আমি সব কথা শুনিনি, অনেক কথা বুঝিওনি। আপনি নাকি খালুদেরকে গরীব ছোট লোক বলেন, নিজেকে সকলের চেয়ে বড় মনে করেন, অহংকার করেন। এই সব কথা আম্মু- আব্বু মোবাইল করে বড় মামাকে ও খালুদেরকে জানাইছে। তারা সবাই রাগে ফায়ার, তারা আপনার বিচার করবে। কয়দিন পরে তারা সবাই আমাদের বাসায় বসবে। আচ্ছা খালু, তারা কি আপনাকে মারবে? শিশুটি করুণ দৃষ্টিতে খালুর মুখের দিকে তাকায়। হাসান ছল ছল চোখের জল লোকানোর জন্য মুখ ঘুরিয়ে সেই দূর দিগন্তে তাকিয়ে থাকে, যেখানে পৃথিবীর সবুজ আকাশের নিলিমায় একাকার হয়ে গেছে। ধরা কণ্ঠে বলে- না দারদা, তুমি দেখো তারা আমাকে কিছুই বলবে না। তারপর দোকানে গিয়ে ছেলেটিকে কয়েকটা লজেন্স কিনে দিয়ে- দারদা তুমি বাসায় যাও আমি চলে যাচ্ছি- বলে হাসান উদ্ভ্রান্তের মত হাটতে লাগল।
হায় আমার কপাল, পৃথিবীর নিকৃষ্টতম কমবখতের ভাগ্যেও যেন এমন বউ না জোটে। বউয়ের সাথে তো মানুষ কত আলাপই করে। আলাপে আলাপে আমি বলেছি আমার লেখা বই আমি নিজেই প্রকাশ করব, এভাবে ধীরে ধীরে একটা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলব। এটা আমার অন্যায় হয়ে গেছে। আবার সে আমাকে তার পরিবার ও দুলা ভাইদের পদানত করে রাখতে চায়, আর তজ্জন্য অষ্ট প্রহর ঝগড়া করে। তখন আমি রাগে দুয়েক বার যা সত্য যা বাস্তব তাই বলেছি। এসব কথা আমার অন্যায় হয়ে গেল অথচ সে যে সব গুরতর অন্যায় করেছে সে গুলির নাম নেই, সেগুলি অন্যায় নয়। হায় আল্লাহ্, এ তুমি আমাকে কোথায় এনে ফেলেছ। এরা কোন ধর্মের অনুসারী, এরা কেমন ধার্মিক, কিসের ধার্মিক- হাসান এসব ভাবতে ভাবতে দিশেহারা হয়ে ঘুরতে থাকে আর ভাবে, কারো কাছে যাওয়া দরকার, একটা আশ্রয় দরকার যে তাকে সাহায্য করতে পারে।
কিন্তু কার কাছে যাবে। বজলুর কাছে গিয়েই তো এই সর্বনাশ হল। এখন কোথায় যাওয়া যায়। মাগরিবের পর সে উদভ্রান্তের মত হাটতে হাটতে এডির বাসায় চলে গেল। এডিকে দেখে সালাম দিয়ে বলল, আমার বিষয়টা তো ধীরে ধীরে জটিল হয়ে উঠছে, আপনারা একটা ফয়সালা করে দিলেন না। এডি কর্কশ গলায় চেচিয়ে উঠল- তুমি বিগড়াইবা, বউয়ের উপরে অত্যাচার করবা আর আমরা তো পানিতে পরছি দুই দিন পর পর তোমাদের দরবার করে দিব। হাসান উৎকট ঘৃণায় তার প্রতি তাকায়, হায় মানুষ এত নিচ এত ঘৃণিত এতটা ক্রীতদাস কি করে হতে পারে। এই লোক শিক্ষিত, একটা চাকরিও করে, তার উপর আলেমও অথচ সে জানে না স্ত্রীর অধিকার কি আর স্বামীর অধিকার কি। সব কিছু জেনেও সে আমাকেই দোষারোপ করছে। নিজে যেমন স্ত্রীর ক্রীতদাস হয়ে বসে আছে দুনিয়ার সবাইকে তাই মনে করে।
ফেরদৌসীদের পারিবারিক ধর্মের নিয়ম ছিল, তারা সকল বোন বড় ভগ্নিপতিদের সামনে যেত কিন্তু ছোটদের সামনে আসত না। অথচ সমবয়সী হওয়ার কারণে বড় জামাইদের সাথে বড় বোনদের বিয়ের সাম্ভাব্যতা সত্বেও তারা পরস্পরের সামনে যেত। কিন্তু ছেলের বয়সী ছোট জামাইদের সামনে আসত না। হাসান এডির দিক থেকে নিরাশ হয়ে একটা চেয়ার টেনে পাশের রুমের দরজার কাছে গিয়ে বসে ডেকে বলল, আপা আপা একটু এদিকে মনোযোগ দেন, আমি আপনার সাথে কথা বলব। ওপাশ থেকে আওয়াজ এল, বল আমি শুনছি। হাসান বলতে শুরু করল, আপনারা হয়ত জানেন ও বুঝেন আমি আপনাদেরকে বড় বোন মানি, বড় বোনের মত শ্রদ্ধা করি। আর আমিও জানি আপনারা আমাকে ছোট ভাই মনে করেন, ভালবাসেন। ফেরদৌসি যেমন আপনাদের বোন তেমনি আমিও আপনাদের ভাই। কাজেই আপনাদের থেকে আমি বড় বোনের ইনসাফ আশা করি। তারপর সে বজলুর সাথে যে কথাগুলি বলেছিল সে কথাগুলিই বলল। কিন্তু তাকে লাথি মারার কথা ও মায়ের চুলের মুঠি ধরার কথা বলতে গিয়ে সে কেঁদে ফেলল। দুঃখ ব্যথা যন্ত্রনা ও লজ্বায় ঘৃণায় সে শিশুর মত ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল।
সম্ভবত মহিলাটির দয়া হল। সে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যাও আমি কালই বড়াপার বাসায় যাব, চিন্তা করো না। দেখি আমি আলাপ করে একটা ব্যবস্থা করব। - হা আপনি কালই যান। - ঠিক আছে যাব, তুমি কি খাওয়া দাওয়া ঠিক মত করছ, রান্না বান্না কে করে? – সে মিথ্যে বলল, খাওয়া দাওয়া ঠিক আছে, রান্না আমিই করি। - এখন খেয়ে যাও। - না, আমার কাজ আছে বলে উঠে পরল। তারপর এডিকে সালাম দিয়ে বেরিয়ে গেল। কিন্তু এডি সেদিকে ফিরেও তাকাল না, সালামের উত্তরও দিল না। হাসান এই আশায় থাকল নিশ্চয়ই হাফুরি আপা মানে এডির বউ বড়াপার বাসায় যাবে আর তাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে একটা কিছু ব্যবস্থা করবে। পরদিন সে অধির আগ্রহ নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারের বাসায় গিয়ে পৌঁছল। মুনিরা মুনিরা বলে কয়েকটা ডাক দিতেই দারদা এসে উপস্থিত হল।
দারদাকে নিয়ে সে গেস্ট রুমে বসে কানে কানে জিজ্ঞেস করল- দারদা তোমার হাফু খালামনি আইছিল? – হ আইছিল। - এসে কি করল? – এসে ছোট খালামনিকে বলল, তুই নাকি তোর জামাইকে বলেছিস চেয়ার থেকে লাথি মেরে ফেলে দিবি? ছোট খালামনি বলেছে- হ, কইছিই তো। - কেন কইলি? – কইছি বেশ করেছি, আমাকে ঘুমুতে দেয় না। তখন আরো অন্য খালামনিরা ছিল, তারা কইল ঠিকই করছে, ভালা করছে, জামাইদের এত লেম দিতে নাই। তখন হাফু খালামনি কইল- তুই নাকি তোর শাশুড়িকে চুলে ধরার কথা বলেছিস। ছোট খালামনি কইল- হ, কইছি, বেটির সাহস কত, আমারে খালি কাজের অর্ডার দেয়। তখন সব খালামনিরা বলল ঠিকই আছে, তুই উচিত কাম করছস, শাশুড়িরা বউকে দাসী বাদী মনে করে, এদেরকে এভাবেই শিক্ষা দিতে হয়। উচিত শিক্ষা- বলে তারা সবাই খুব হাসাহাসি করল, আম্মুও হাসল। হাফু খালামনি বলল, তুমিও হাসতাছ, জামাইয়ের তো দোষ নাই, দোষ আমাদের বোনের, কাজেই সে বেচারাকে আর শাস্তি না দিয়ে ওকে দিয়ে দাও।
তখন আম্মু রাগে হাফু খালামনিকে বলল তুই যা, তোকে মাতব্বরি করতে হবে না, যা করার আমিই তো করছি। দু’দিন পর পর গন্ডগোল করে, এ তারিখে ওকে শায়েস্তা করে ছাড়ব, ওর ঘরে আর দিব না। তারপর হাফু খালামনি চলে গেল। হাসান জিজ্ঞেস করল, তোমার খালামনিরা কি সবাই এখানে? দারদা বলল- হ, ছোট খালামনির গন্ডগোল শুনে খুলনার খালা ছাড়া সবাই এসেছে। হাসান বলল- ঠিক আছে, তুমি গিয়ে মুনিরাকে নিয়ে আস। দারদা পাশের রুমে গিয়ে কিছুক্ষণ চিল্লা ফাল্লা করে এসে বলল, দেয় না। হাসান ভড়কে গিয়ে ভাবল- সব চাবি কাঠি বড়াপার কাছে, তার সাথে আলাপ করে দেখি বরফ গলে কিনা। সে দারদাকে বলল- তোমার আম্মুকে গিয়ে বল খালু আপনার সাথে আলাপ করবে, এই দরজার কাছে নিয়ে আস গিয়ে। সে গিয়ে চিল্লা ফাল্লা শুরু করল। বুঝা যাচ্ছে তার মাকে টেনে দরজার কাছে নিয়ে আসছে।
হাসান সালাম দিয়ে বলল, বড়পা আপনিই তো বলেছিলেন আমি আপনাদের ছোট ভাই, ছোট ভাইয়ের মত থাকার কথা বলেছিলেন। আমিও জানি, আমি আপনাদের ছোট ভাই, আপনাদের সন্তানদেরকে নিজের ভাগ্নে ভাগ্নির মত, সন্তানের মত দেখি। আমার এমন কোন কথা বা কাজ দেখাতে পারবেন না যাতে প্রমাণ হয় যে, আমি আপনাদেরকে বড় বোন মানি না বা আপনাদের সন্তাদেরকে ভাগ্নে ভাগ্নির মত দেখি না। আপনি যদি সত্যিই আমাকে ছোট ভাই জানেন তাহলে ভাই বোনে ঝগড়া লাগলে যেভাবে মীমাংসা করা হয় আমার ও আপনার বোনের মধ্যেও সেভাবে ফয়সালা করে দেন। এটুকু বলতেই দারদার চেচামেচি শুনা গেল, আরে খাঁড়াও খাঁড়াও, খালুর কথা শেষ অইছে না, আরো কথা কইব। এর মধ্যে ঢাস করে একটা চড়ের শব্দ শুনা গেল। পরক্ষণে ছেলেটি কাঁদতে কাঁদতে তার কাছে এল।
সে ছেলেটিকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে তারপর বলল, চল দারদা বাইরে যাই। ছেলেটি তার হাতের আঙ্গুল ধরে হাঁটতে লাগল। বাসার বাইরে গিয়ে একটা বিস্কুটের প্যাকেট কিনে দিল। ছেলেটি বলল, খালু আরেকটা খবর আছে। - কি বল। - কালকে না নাজমা খালা মনি (বজলুর বউ) এসে আব্বাকে খুব প্যাদানি দিল আর বলল, জামাইয়ের ঘর থেকে এনে মনে করছেন আপনের বাসায় রেখে কাজের মেয়ে বানাবেন, তা চলবে না, আবার বিয়ে দিতে হবে। এই জামাইয়ের চেয়ে আরো ভাল, আরো উন্নত বিয়ে দিতে হবে, আপনার বাসায় রেখে কাজের মেয়ে বানাতে পারবেন না। তখন আব্বু হাসতে হাসতে বলল, সেই চিন্তা আমার, এ নিয়ে চিন্তা করে কারো মাথার চুল পাকাতে হবে না। তখন খালামনি ঠিক আছে- বলে হাসতে হাসতে চলে গেল।
আচ্ছা খালু, আব্বু আম্মু যদি খালামনিকে আরেক জনের সাথে বিয়ে দেয় তখন আপনি কি করবেন - বলে ছেলেটি কৌতূহলের দৃষ্টিতে খালুর মুখের দিকে তাকায়। হাসানের পাণ্ডুর মুখখানা অপলক নেত্রে দিক চক্রবালে তাকিয়ে থাকে, তারপর বলে- দারদা দেখছ ঐ যে দিগন্তে কয়েকটা পাখি উড়ছে, আমি ওদের মত উড়ব, ঝড়ের পাখির মত ঠিকানাহীন অনন্ত আকাশ উড়ে বেড়াব। - আপনি আকাশে উড়ে বেড়াবেন- বলে শিশুটি নাচতে লাগল, খালু আকাশে উড়বে তার খুব আনন্দ লাগছে। হাসান বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল- দারদা তুমি বাসায় যাও আমি চলে যাচ্ছি। তার দেহটা নেশাগ্রস্থের ন্যায় টলছে। কোন রকমে বাসায় গিয়ে বিছানায় শরীরটা ছেড়ে দিল। হায়, এরা তো দেখছি নটি বেশ্যার চেয়েও অধম। কোন কারণ ছাড়াই স্বামীর ঘর থেকে এনে অন্যত্র বিয়ে দেয়া বাজারি মেয়ে লোক ছাড়া কোন ভদ্র ঘরের মেয়েরা কল্পনাও করতে পারেনা, যেখানে তিনটি জীবনের ভবিষ্যৎ জড়িয়ে আছে। এরা তাদের বোনকে নিয়ে ব্যবসায় নেমেছে, আমার চেয়ে ভাল জামাই পেলে বিয়ে দেবে। এদের কাছে স্বামীকে লাথি মারা শাশুড়ির চুলে ধরা কোন অন্যায় নয়। এরা নিজেদের স্বামীদের ক্রীতদাস বানিয়ে তাদের সাথে একই আচরণ করে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, আট বোন মিলে নারী তান্ত্রিক একটা সমাজ গঠন করেছে- যেখানে স্বামীরা ক্রীতদাস।
হাসান ভাবে এখন তাহলে কি করা যায়। এমনও তো হতে পারে বড়াপা ইঞ্জিনিয়ারকে আসল ঘটনা না বলে উল্টা পাল্টা বুঝিয়েছে, তার বোনকে তুলসী পাতা প্রমাণ করে আমাকে বানিয়েছে কচু পাতা। ইঞ্জিনিয়ারের কাছে মূল সংবাদটা পৌঁছানো দরকার। পরদিন সে অনেক তথ্য তালাশি করে ইঞ্জিনিয়ায়রের এক আদিম ঘনিষ্ট বন্ধুর সন্ধান পেল- যে বিসিকে থাকে। বস্তুত এ লোকটাও ইঞ্জিনিয়ারের মত প্রায় মূর্খ, নিরক্ষর এবং উগ্র প্রকৃতির। উভয়ের একই স্বভাবের কারণে সম্ভবত দু’জনের মধ্যে এই বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। হাসান বিসিকে গিয়ে অনেক খোজাখোজি করে তাকে বের করল। তারপর স্ত্রীর সাথে তার যা কিছু ঘটেছে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করে তাকে অনুরোধ করল, আপনি ইঞ্জিনিয়ারকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলুন। তাকে বলুন আমাকে আর আমার বউকে সামনা সামনি বসিয়ে উভয়ের কথা শুনুক। আমার অন্যায় থাকলে যে কোন বিচার আমি মাথা পেতে নিব, আর আমার স্ত্রীর অন্যায় থাকলে আমি আর বিচার চাই না বউটা ফেরত পেতে চাই। দেখুন এখানে স্বামী স্ত্রী ও সন্তান- এ তিনটি জীবনের প্রশ্ন জড়িত। আল্লাহ্র ওয়াস্তে বিষয়টা সুরাহার ব্যবস্থা করে দেন। লোকটা চেষ্টা করবে বলে কথা দিল।
পরদিন ঐ লোকের আশায় হাসান আর কোথাও গেল না, বাসাতেই থাকল। যহুরের পর ইঞ্জিনিয়ারের এক ছেলে এসে বলল, খালু আগামি শুক্রবার মামারা খালুরা সবাই আসবে, আপনি বাসায় থাকেন যেন। হাসান অনুভব করতে লাগল একটা প্রবল ঘুর্নিবাত্যা তার সামনে পিছনে ডানে বামে উর্ধ্বে ঘুরছে। সহসা তাকে গ্রাস করে কোন সুদূরে নিরুদ্দেশের দেশে নিয়ে যাবে। সে ভয় ও হতাশায় মুষড়ে গিয়ে নিথর হয়ে বিছানায় পড়ে থাকে। রাত্রে ভাত নিয়ে বসল, প্রথম লোকমাটা গলা দিয়ে নামল কিন্তু দ্বিতীয় লোকমা দেয়ার সাথে সাথে বমি এসে গেল। দুশ্চিন্তা ও দুঃখের সময় তার এমনটা হয়। তারপর প্রত্যেক লোকমা মুখে দিয়ে এক ঢোক করে পানি নিয়ে কষ্টে শিষ্টে গিলে গিলে কয়েক লোকমা খেল। সারা দিনে এ একবার তার খাওয়া হল।
পরদিন আশা ও দ্বিধা নিয়ে আবার ইঞ্জিনিয়ারের বাসায় গেল। মুনিরা মুনিরা বলে কিছুক্ষণ ডাকল, তার আশা তার বউ আসবে অথবা মুনিরাকে আসতে দিবে কিন্তু কেউ এল না। দারদা বেরিয়ে এল। বাসার বাইরে গিয়ে সে বলল, খালু জানেন, খালুরা মামারা সবাই শুক্রবারে আসবে। তারা আপনার বিচার করবে, আপনাকে মারবে। কষ্টে হাসানের অন্তরটা ফেটে যায়। এ কেমন জুলুম, অন্যায় করল আমার স্ত্রী, সংশোধনের জন্য তাদের জানালাম। এখন সংশোধন তো দুরের কথা উল্টো আমার গর্দানের উপর খড়গ ঝুলিয়ে দিয়েছে। স্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে দিচ্ছে না, এমনকি নিজের সন্তানকে পর্যন্ত দেখতে দিচ্ছে না। এদের চেয়ে বড় যালিম আর কে হতে পারে। একটা ভয় ও আশংখা তাকে অস্থির করে তুলে। সে ছেলেটাকে বিদায় করে বাসায় চলে এল।
সে অনুভব করতে থাকে একটা ভয়ঙ্কর বিপদ তার দিকে ধেয়ে আসছে। শুয়ে শুয়ে চিন্তা করে, আচ্ছা ওরা কি আসলেই আমাকে মারবে। মেরে হাত পা ভেঙ্গে দিবে, নাকি জোর পূর্বক তালাক নিয়ে নিবে, নাকি জামালপুর থেকে তাড়িয়ে দিবে। সে উত্তেজনায় বিছানা থেকে নেমে পায়চারি করতে থাকে। তার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে, বুকের পাটা স্ফিত হয়ে উঠে। তারপর নিজের বাহু টিপতে টিপতে সহসা হেসে উঠল- এত দিন ওরা শৃগাল দেখেছে কিন্তু সিংহের গর্জন শুনেনি, এবার শুনবে। আমাকে টর্চার করলে ওদেরকে ঝাড়ে বংশে নিপাত করে দিব। আমার অতীত সাক্ষ্য দেয়, কেউ আমার উপর যুলুম করে বাঁচতে পারে না। আসলে ওরা আমাকে চিনে না, কিন্তু আমার স্ত্রী তো কিছুটা হলেও আমার সেই ভয়ঙ্কর রূপটা সম্পর্কে জানে, সে তো তাদেরকে অন্তত এটুকু জানানোর কথা যে লোকটা ভিতু কাপুরুষ নয়।
যেহেতু বিপদ তার সামনে এসে গেছে তাই তার পক্ষের কিছু লোক শুক্রবারে উপস্থিত থাকা সে প্রয়োজন বোধ করল। উত্তর ময়মনসিংহে শক্তিমত্তা ও প্রতিপত্তির দিক থেকে একসময় তার মাতুল পরিবার বিখ্যাত ছিল, আর এখনো তা নিঃশেষ হয়ে যায়নি। কিন্তু নিজের পারিবারিক ঘটনা সে মামাদের বা অন্যদের জানানো সমীচীন বোধ করল না। তাই বাড়িতে কল করে বলল, তার ছোট দুই ভাই এবং বড় ভগ্নিপতি শুক্রবার সকাল সকাল যেন তার বাসায় উপস্থিত থাকে। পরের দুই দিন সে আর ইঞ্জিনিয়ারের বাসায় গেল না বরং ইঞ্জিনিয়ারের ঘনিষ্ট কয়েক জনের সাথে সাক্ষাৎ করে ঘটনা জানিয়ে অনুরোধ করল তারা যেন ইঞ্জিনিয়ারের সাথে আলাপ করে বিষয়টা ফয়সালার চেষ্টা করে।
বিষয়: সাহিত্য
১১৪২ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন