চিঠি- ৩৭ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:৪১:০৯ দুপুর
হাসান ভাত রাধতে পারে, কিন্তু তরকারি রাধতে পারে না। তাই ফেরদৌসি যাবার সময় কয়েকবার খাবার উপযোগী কিছু তরকারি রান্না করে রেখে গিয়েছিল আর বলেছিল পরদিন কিছু গোশত কিনে বড়াপার বাসায় নিয়ে যেতে, সে রান্না করে দিবে। তাতে আরো কয়েক বার চলে যাবে। বউ ছাড়া একাকি বাসায় ভাল লাগে না। হাসান মাদরাসা থেকে এসে চারটে খেয়ে বড়াপার বাসায় গিয়ে হাজির হল। ফেরদৌসি তাদের বাসর শয্যার রুমটিতে অর্থাৎ ঈশান কোনের রুমে খাটের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে, মুনিরা খাটের উপর খেলা করছে। স্বামীকে দেখেই যেন তার চোখ থেকে অবজ্ঞা ঘৃণা আর প্রতিশোধের আগুন ঠিকরে পরছে। মাথা ঝাকিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বলল- যে সবটাই চায় সে সবটাই হারায়, আপনিও যেমন কইছেন আমিও কইছি। স্ত্রীর ভাব দেখে তার কলজেটা যেন পোড়ে গেল। সে বুঝল তার কথাটাই বউ তাকে ফিরিয়ে দিল। স্ত্রীর অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে সে মাঝে মধ্যে একটা আরবি প্রবাদ বলত- মান তামায়া কুল্লাহু ফাতা কুল্লাহু- যে সবটাই চায় সে সবটাই হারায়।
আরে মূর্খ তুই তো তোদের তুলনায় একটা শিক্ষিত ধনী জামাই পেলি কিন্তু আমি তো পেলাম একটা দরিদ্র, অশিক্ষিত মূর্খ, বদমেজাজি, বাঘিনী স্ত্রী। সবটা তো পেলে তুই আমি তো কিছুই পেলাম না। আরে খান্নাস, অন্যায় করলি তুই আর এখন উল্টো তেজ দেখাস আমার উপর। কিন্তু মুখে কিছু না বলে ক্রোধ হজম করে খাটের পাশে রাখা একটা চেয়ারে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল- কি কইছ? ফেরদৌসি স্বামীর প্রতি একটা অপাংক্তেয় দৃষ্টি বুলিয়ে বলল- বড়াপা বজলু দুলা ভাইয়ের বাসায় পাঠাইছিল, সেখানে আপনে যা কইছেন সব শুনছি। তারপর আমিও যা মন চাইছে সব কইছি। - কি কইলা একটু কও শুনি। - আপনে আমার সাথে কি করেন জানেন না, সব কইছি।
হাসান ভাবে- আমি আবার তার সাথে কি করলাম, দোষনীয় হতে পারে এমন কোন কথা বা কাজ তো আমি করিনি- মাগি তোর খুব বাড় বেড়ে গেছে। তোর তেজ ভাঙ্গার ঔষধ আমার জানা আছে। সে সিদ্ধান্ত নিল কয়েকদিন স্ত্রীর সাথে দেখা করবে না। তাহলে সে ভাববে স্বামী বুঝি তাকে ফেলে চলে গেছে। আর তখন বাওয়ানো ছাগির মত ভ্যা ভ্যা করে বাসায় গিয়ে উপস্থিত হবে। সে আর কিছু না বলে- ঠিক আছে আমি এখন যাই। ক্রোধে ফুলে থাকা স্ত্রী তার দিকে ফিরেও তাকাল না। কিন্তু ঘর থেকে বেরোনোর সময় উঠে এসে বলল- কই গোশত তো আনলেন না, বাসায় গিয়ে খাবেন কি? কিন্তু হাসান কোন কথা না বলে চলে গেল।
পরদিন কিছু গোশত কিনে একটা ছাত্র ডেকে রান্না করাল। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে মঙ্গল বুধ বৃহস্পতি এ তিন দিন যাবে না, শুক্রবারে যাবে, এ কয় দিনে নিশ্চয়ই সাইজ হয়ে যাবে। এমনকি বাসায়ও চলে আসতে পারে। সে শাশুড়িকে এমন একটা ভয়ঙ্কর কথা বলার পরও তার মধ্যে কোন অনুশোচনা নেই। আমি তাদেরকে জানাইছি বলে আমার অন্যায় হয়ে গেছে। এ তারিখে যদি ওর বিচার না হয়, সে যদি আম্মাকে ঐ কথাটা বলার জন্য মাফ না চায় তাহলে ওকে আনব না। পরে থাকুক অন্যের বাসায় তখনই মজাটা বুঝবে। আর বিচার ছাড়া এভাবে আসলে তো ওর মত রাক্ষুসীকে নিয়ে ঘর করা অসম্ভব হয়ে পরবে।
একাকি বাসায় ভাল লাগে না। পরদিন ঘুরতে ঘুরতে বকুলপুর মসজিদে গিয়ে মাগরিব পড়ল। এ মসজিদটি বজলুর দোকানের কাছাকাছি। আবার মসজিদের ইমাম সাবের বাড়ি ফুলপুর, হাসানদের এলাকার মানুষ, তার ঘনিষ্ঠ লোক। ইমাম সাব তাকে দেখে নামাযের পর তার হুজরায় ডেকে নিয়ে গিয়ে গেল। তারপর বলল- আপনি একজন মুহাদ্দিস মানুষ হয়ে জানেন না বউয়ের সাথে কিভাবে থাকতে হয়? হাসানের মুখ থেকে যেন কেউ চোষ কাগজে সবটুকু রক্ত চোষে নিয়ে এক পোঁচ কালি মেখে দিল। সে বিধ্বস্ত কণ্ঠে বলল- আমি আমার বউয়ের সাথে কিভাবে থাকি না থাকি সেটা আপনি জানলেন কি করে। ইমাম সাব বলল- আমি কেন, জামালপুরের সবাই জানে। -কেমনে? - আপনার ভায়রা বজলুই বলে বেড়াচ্ছে।
অপমান লজ্বা ও ঘৃণায় হাসান কিছুক্ষণ বিমর্ষ হয়ে বসে থাকল। তারপর বলল- আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব জবাব দিবেন। আচ্ছা কোন যুবক যদি চূড়ান্তভাবে উত্তেজিত হয়ে যায় তখন কি করবে, স্ত্রীর কাছে যাবে নাকি কোন গণিকার কাছে যাবে? ইমাম সাব হাসল- কঠিন প্রশ্ন, এর উত্তর দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
সে বলল- আচ্ছা ঠিক আছে, এ অবস্থায় যদি সে নিয়ন্ত্রনহারা হয়ে আবেগের বশে স্ত্রীর সাথে মিলিত হয়ে যায়, আর তা স্ত্রীর সম্মতিক্রমেই- তাহলে এর বিচার কি, মানে মানুষের আদালতে ও আল্লাহর আদালতে? তিনি বললেন- মানুষের আদালতে সম্ভবত এর কোন বিচার নাই। আর আল্লাহ তো এ বিষয়ে সীমারেখা নির্ধারণ করেই দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেন নিসায়ুকুম হারছুল্লাকুম.........। অর্থাৎ তোমাদের স্ত্রীরা হল তোমাদের শস্যক্ষেত্র, যাও শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে। এর অর্থ নিষিদ্ধ সময় ও ভিন্ন পথে নয়। এখন কেউ যদি সেই সীমারেখা লঙ্ঘন করে তাহলে তাকে তওবা করতে হবে। ইসলামী বিধান মতে তার জন্য জেল জরিমানা বেত্রাঘাত বা এ জাতীয় কোন শাস্তি নেই।
হাসান বলল- অর্থাৎ মানুষের মধ্যে জৈবিক চাহিদাটা হল একটা আগুন, এ আগুনে যে কেউ হাত পোড়াতে পারে। এ জন্যই আল্লাহ ও রাসূল (সাঃ) এ ব্যাপারে তওবার বিধান দিয়েছেন। কিন্তু শারীরিক ও আর্থিক শাস্তির বিধান দেননি, এ ক্ষেত্রে ছাড় দিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হল, যে নিজেদের গোপন বিষয় অন্যদের সাথে বলে বেড়ায় এদের বিধান কি? তিনি বললেন- এরা তো যিনাকার। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যে নিজেদের গোপন বিষয় অন্যদের কাছে বলে সে জিনাকার। কারণ আপনি বললে অন্যরা আপনার স্ত্রীর প্রতি আকৃষ্ট হবে। আপনার স্ত্রী বললেও তার প্রতি আকৃষ্ট হবে। এটা যিনার সমতুল্য অপরাধ। আচ্ছা আপনার স্ত্রী পাগল নাকি, এসব জঘন্য কথা বলল কেন? – এটা আমার ভাগ্য, এমনি এক স্ত্রীর মালিক আমি। সে কিছু ভয়ঙ্কর অন্যায় করেছিল তজ্জন্য আমি মারিও নাই শাস্তিও দেইনি, শুধু বজলুর কাছে বিচার দিয়ে গিয়েছিলাম। বিচার দিলাম কেন এই জিদে সে এসব বলছে।
ইমাম সাব হাসল- জিদে অন্য কিছু বলবে, এমন গোপন কথা বলল কেন? – আর কি বলবে? মানুষ তো মদ গাজা খায়, বউকে মাইর পিট করে, যৌতুক চায়, আমি তো কোনটাই করিনা, কোন দোষ না পেয়ে এ গুলিই বলল, চিন্তা করেন কত হিংস্র স্ত্রী। পরশু সে আমাকে বলল, আপনে যেমন কইছেন আমিও কইছি, সব কইছি। তখন আমি বুঝতে পারিনি কি বলেছে, এখন বুঝলাম। উহঃ, এদের বোনগুলি আর এদের পরিবারটা কত জঘন্য। ছোট বোন স্বামীর সাথে কিভাবে থাকে, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সে সব কথা বের করে স্বামীদের সাথে আলাপ করেছে, আর স্বামীরা এগুলি শহরময় রাষ্ট্র করে দিয়েছে। হ্যাঁ আল্লাহ্র দরবারে আমি অপরাধ করেছি, আর এ অপরাধ আমার একার নয় আমার স্ত্রীও সমান অংশীদার। আমার অপরাধের জন্য আমি তওবা করেছি আরো করবো। কিন্তু কথাটা হল, তার বোন ও ভগ্নিপতিরা যখন জানল তখন তারা তো আমাকে ডেকে নিয়ে শাসাতে পারত, বিচার করতে পারত, তা না করে শহরময় প্রচার করে বেড়াল, এটা কি মনুষ্যত্বের কাজ হল? ছিঃ এরা মানুষ নাকি পশু। মানুষ এতটা বেহায়া কিভাবে হয়। আমাকে লাঞ্চিত করার জন্য এদের বিচার আমি আল্লাহ্র দরবারে ন্যস্ত করলাম।
- এখন ছিঃ ছিঃ করেন কেন? বিয়ের আগেই তো বুঝা উচিত ছিল। কেউ এদেরকে মানুষ হিসাবে গণ্য করে না। এরা কোন সমাজ করে না, কারো সাথে মিশে না, কারো সাথে আন্তরিকতা নাই। তারা নিজেরাই আলাদা একটা সমাজ গঠন করে নিয়েছে। এরা তো ইসলাম মানে না, কট্টর তাবলীগী সেজে ইসলামটাকে বিকৃত করে ফেলেছে।
হাসান হাসল- আমার বউ তার বাপের বাড়ি ছিল। একদিন একটা যুবতি মেয়ে দেখিয়ে বলল ঐ মেয়েটাকে স্বামীর ঘর থেকে নিয়ে এসেছে। জিজ্ঞেস করলাম কেন? সে বলল- মেয়েটা তার দাদীর সাথে বলেছিল জামাই তার দুধ খায়। কথাটা জানাজানি হয়ে গেলে মেয়ের বাপ স্বামীর ঘর থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। তারপর সে মেয়েটির খুব গালমন্দ করল স্বামীর গোপন কথা বলার জন্য। এখন প্রশ্ন হল, সে যে ঐ মেয়েটির চেয়েও জঘন্য অন্যায় করল এর বিচার কি হবে আর কে করবে?
ইমাম সাব বললেন- বিচার আবার কি, আপনি বউ বাদ দিয়ে দেন। এমন জঘন্য বউ নিয়ে সংসার চলে না। দুনিয়া শুদ্ধু স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কত ঝগড়া ঝাটি হয়, মারামারি, ছাড়াছাড়ি কত কিছু হয় কিন্তু এমন তো কোথাও শুনিনি যে, স্বামী কিভাবে থাকল স্ত্রী তা অন্যের কাছে বলে বেড়িয়েছে, এটা তো পতিতাদের স্বভাব। এ বউ নিয়ে চলতে পারবেন না, বাদ দেন গিয়ে। তারপর হাসান স্ত্রীর প্রতি একরাশ ঘৃণা নিয়ে ক্ষোভে দুঃখে বাসায় ফিরল। হায়, এই মেয়েটির ভাগ্যে না জানি কত শাস্তি অপেক্ষা করছে। হায় আমার অভিশপ্ত স্ত্রী, তোর এত অন্যায়ের পরেও তোকে কোন দিন মারলাম না, গালি দিলাম না, কষ্ট দিলাম না, আর তুই আমাকে এতটা অপমান করলি। সম্ভবত আল্লাহ তোর কপালে শাস্তি লিপিবদ্ধ করে ফেলেছেন। হাসান বিছানায় শুয়ে এসব চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল।
সে জেদ ধরেছে স্ত্রীকে শাস্তি দেবে, তার সাথে দেখা করবে না। ধৈর্য্য ধরে তিন দিন থাকল, শুক্রুবারেও দেখা করতে গেল না। কিন্তু একাকি বাসায় স্ত্রী সন্তান ছাড়া ভাল লাগে না। আওয়ারার মত এদিক সেদিক ঘুরা ফিরা করে সময় কাটায়। অবশেষে আর থাকতে না পেরে শনিবারে বিকালে গিয়ে হাজির হল। স্বামীকে দেখেই ফেরদৌসি ছুটে এল। দরজার মুখে থাকতেই সে দুই হাতে স্বামীর ডান হাত জড়িয়ে ধরে কান্না জড়িত কণ্ঠে- আমি আজ আপনার সাথে চলে যাব- বলে অন্তহীন নৈরাশ্যপূর্ণ দু’টি চোখ মেলে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বাঃ চমৎকার, আমার ঔষধ তো দারুন কাজে দিয়েছে, স্ত্রীর তেজ পানি হয়ে গেছে- ভেবে হাসানের মনটা আনন্দে নেচে উঠল। কিন্তু সাথে সাথে হৃদয় ব্যথা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। এ চার দিনে স্ত্রীর গাল দুটি বসে গেছে, চোখ কোঠরাগত, চোখের নীচে কালচে দাগ পড়ে গেছে। সে বুঝতে পারল এ কয় দিন বেচারি নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে শুধু চিন্তাই করেছে।
হাসান মেয়েকে কোলে নিয়ে খাটের পাশে গিয়ে বসল। ফেরদৌসি স্বামীর পাশে বসে তার কাঁধে মাথা রেখে উরুর উপর হাত রেখে কান্না জুড়ে দিল- এ ক্য়দিন কোথায় ছিলেন, কোন নটি বেশ্যার কাছে ছিলেন। আসলেন না কেন, আমাকে ছাড়া কিভাবে থাকলেন, সামনে না থাকলে বুঝি বউ বাচ্চার কথা মনে থাকে না, কি খাইছেন, এ কয় দিন কে রান্না করে দিল? সে একাকি কেঁদে কেঁদে এসব বলতে লাগল। হাসান মাঝে মধ্যে আবেগাপ্লুত হয়ে উঠছে, তার মন চাইছে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে আদর করে, চুমিয়ে চুমিয়ে ফর্সা গাল দুটি লাল করে দেয়- আরে মূর্খ বুঝ নাই, এ কয়দিন তোমাকে শাস্তি দিলাম। কিন্তু কিছু না বলে সে পাকা অভিনেতার মত অভিনয় চালিয়ে গেল। স্ত্রীর দিকে ফিরেও তাকায় না, কথাও বলে না, মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর করছে, খেলছে, স্ত্রীর প্রতি অবহেলা দেখাচ্ছে, বুঝাচ্ছে যেন তোমাকে আমার দরকার নাই।
মাগরিবের আযান হচ্ছে, এ পর্যন্ত সে স্ত্রীর প্রতি এক বারও তাকায়নি। মেয়েকে বিছানায় রেখে দাঁড়িয়ে স্ত্রীর প্রতি না তাকিয়েই বলল- মসজিদে গেলাম। ফেরদৌসি চট করে উঠে স্বামীর হাত ধরে করুণ কণ্ঠে বলে উঠল- না, আমি আজকে চলে যাব। আগে বলেন, নামায পড়ে এসে আমাকে নিয়ে যাবেন- সজল চোখে, করুণ দৃষ্টিতে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। হাসান আবেগাপ্লুত হয় কিন্তু স্ত্রীকে আরও সাইজ করার জন্য বলে কেন, বড়াপা আনছে থাক কিছুদিন, দেখ কেন আনল। সে স্বামীর প্রতি ভরসা পায় না, হঠাৎ পকেটে হাত ঢুকিয়ে বাসার চাবি হাতে নিয়ে বিজয়ির হাসি দিয়ে বলল- আপনে নামায পড়ে আসেন, আমি রেডি হয়ে থাকব, আজ আমি একা হলেও চলে যাব।
বাসা থেকে বেরিয়ে হাসানের মনটা বড়াপার প্রতি ক্ষুভে বিষায়িত হয়ে উঠল। তার ছোট বোন, সে আদর মাড়িয়ে আনল অথচ এ ক্য়দিনে বেচারি সম্ভবত না খেয়ে দুশ্চিন্তায় বিছানায় পড়ে থেকে আধমরা হয়ে গেছে। নিজের বোনের প্রতি একটুও লক্ষ রাখেনি, নইলে এমন করুণ অবস্থা হত না। তার কি, বউটাতো আমার, স্ত্রীর স্বাস্থ্যের জন্য কত চেষ্টা করছি, কত কিছু খাওয়াচ্ছি। নিজে না খেয়ে সামর্থ অনুযায়ী ভাল মন্দ খাওয়াচ্ছি একটু স্বাস্থ্যের জন্য। আর এ বেকুব মহিলাটা আমার বউটাকে এনে কয়েক দিনেই একেবারে হারগিলে বানিয়ে দিল। আসলে এরা সবাই এক রকম, কোন অনুভূতি নেই, গরু ছাগলের মত বেহুশ।
হাসান নামায পড়ে বাসায় এলে ফেরদৌসি বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল- বড়াপাকে কইলাম আমি চলে যাচ্ছি। সে কইল- না, তুই যেতে পারবি না, আমি তোকে আনছি। তোর দুলা ভাই আজকে আসার কথা, সে আসুক তারপর যাবি। অহন দুলা ভাই না আসলে তো যাওয়া যাবে না, আপনে যান গা আমি পরে যাই। আর বাসায় খাইতাছেন কি, রান্না করে দেয় কে? মাছ গোশত একটা কিছু নিয়ে আসেন আমি রান্না করে দেই। হাসান বলল- না তরকারি আছে, ছাত্র দিয়ে রান্না করাই। ফেরদৌসি আবার দু’হাতে স্বামীর ডান হাত চেপে ধরে মুখের দিকে তাকিয়ে বড় করুণ স্বরে জিজ্ঞেস করল- বাড়িতে গেছিলেন? হাসান বলল- না। - তাহলে এ কয়দিন আসেননি কেন, আমার দিকে রাগ করছেন? হাসান মুচকি হেসে অন্য দিকে তাকিয়ে বলল- না, লেখালেখিতে ব্যস্ত ছিলাম। আচ্ছা বড়াপা তোমাকে আনল, এ পর্যন্ত কিছু কয় নাই কেন আনল? ফেরদৌসি বিরস কণ্ঠে বলল- না, কিছু কয় নাই। হাসান ভাবল, সম্ভবত ইঞ্জিনিয়ারের জন্য অপেক্ষা করছে। সে আসলে সব কিছু শুনে তারপর বিচারে বসবে। সে মনে মনে খুশি হয়। তারপর মেয়েকে একটু আদর করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।
হাসান বাসায় বসে বসে চিন্তা করে আর হাসে- দাজ্জাল বউ আমার এ তারিখে শায়েস্তা হবে। নিশ্চয়ই ইঞ্জিনিয়ার এসে আমাকে ডাকবে, আমার বক্তব্য শুনতে চাইবে। তখন এ যাবৎ সে যা যা করেছে সব বলব, একটাও বাদ দিব না। সে হাসতে থাকে, কারণ কল্পনায় দেখে ফেরদৌসীকে তার বোনেরা চুলের মুঠি ধরে- হারামজাদি, আমরা জামাইয়ের ঘর করে খাচ্ছি না, কয়দিন জামাইকে লাথি মারার কথা বলেছি, শাশুড়িকে চুলের মুঠি ধরার কথা বলেছি, স্বামীকে দিয়ে বাসার কাজ করিয়েছি, ঝগড়া করেছি, তুই এত লায়েক হয়ে গেছিস কি করে- বলতে বলতে কেউ ঘুষি মেরে বউয়ের বোচা নাকটা আরো থ্যাবড়া করে দিচ্ছে, কেউ পাছায় লাথি মারছে, কেউ ঝাড়ু দিয়ে বেদম পেটাচ্ছে। তারপর বলছে- যাঃ, তোর জামাইয়ের অন্যায় করেছিস, লাথি মারার কথা বলেছিস, এখন গিয়ে পায়ে ধরে মাফ চা। হাসান আপন মনে হাসতে থাকে। তখন সে টেনে তুলে ধরে বলবে- না না, মাফ চাইতে হবে না, শুধু আমার কয়েকটা শর্ত আছে, এই শর্ত মাফিক চললেই হবে।
তারপর সে শুয়ে শুয়ে আঙ্গুলে গুনে গুনে শর্তগুলি স্থির করতে থাকে। এক নম্বর শর্ত, আম্মাকে ঐ বিশ্রি কথাটা বলার জন্য মাফ চাইতে হবে, আম্মা সম্পর্কে কোন দিন বেয়াদবি মূলক কথা বলা যাবে না। দুই নম্বর শর্ত, তার কাজ শুধু মেয়েকে খাওয়ানো আর রান্না করা। বাকী কাজ আমি নিজে পারি বা কাজের মেয়ে রেখে করাই সে দায়িত্ব আমার। কিন্তু কাজের জন্য ঝগড়া করা যাবে না। তিন নম্বর, মেয়েকে মারা যাবে না, মেয়ে আমিই রাখব। চার নম্বর, কথায় কথায় আমাকে তালাক দে, তালাক দে, আমি চলে যাব ইত্যাদি বলা যাবে না। এভাবে সে গুনে গুনে বারটি শর্ত নির্ধারণ করল। এখন সে খুশিতে আত্মহারা এই ভেবে যে, এসব শর্তগুলি মানিয়ে আনলে বউ আর তার সাথে ঝগড়া করবে না, মাথা নিচু করে চলবে। কোন সময় ঝগড়া করলে আবার তার বোনদের দিয়ে কয়েক ঘা লাগিয়ে দিয়ে আনলে স্থায়ী ভাবে সাইজ হয়ে যাবে। বেচারা কল্পনায় আত্মতৃপ্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
হাসান এই আশায় রাত ও দিনটি কাটাল যে, ইঞ্জিনিয়ার এসে তাকে ডাকবে, তার কথা শুনবে এবং স্ত্রীর ভাল মন্দ একটা কিছু বিচার করবে, সে সারা দিন অপেক্ষা করল কিন্তু কেউ তাকে ডাকল না। অগত্যা বিকালে সে নিজেই গিয়ে হাজির হল। তার স্ত্রী এক পা খাটে তোলে আরেক পা নামিয়ে আত্ম প্রশান্তিতে পা নাচাচ্ছে আর তাকে দেখে মিটি মিটি হাসছে। হাসান কিছুটা আশাভঙ্গ হল। কারণ সে আশা করেছিল সে যেতেই স্ত্রী এসে গুমরাহ মুখে কাঁদো কাঁদো স্বরে হাত ধরে বলবে- এখানে আমি আর থাকব না, আমাকে নিয়ে চলেন, বড় দুলা ভাই আমাকে বকেছে। আশানুরুপ না দেখে সে উল্টোটা দেখছে।
সে এগিয়ে গিয়ে খাটের পাশে রাখা চেয়ারে বসল- বড় দুলা ভাই আসছে? ফেরদৌসি তাচ্ছিল্যভরে জবাব দিল- হু। - কিছু কইলো? - বড়াপা রাত্রে দুলা ভাইয়ের সাথে আলাপ করছে, ফজরে মসজিদে যাওয়ার সময় দুলা ভাই আমাকে ডেকে বলল- জামাইয়ের ঘরে তোকে আর যেতে হবে না, এখানেই থাকবি, আমি তোকে আলাদা বাসা করে দিব, সারা জীবন চলার ব্যবস্থা করে দিব, চিন্তা করিস না। এবার হাসান স্ত্রীর উৎফুল্লের কারণটা বুঝতে পারল। সে ভাবল- যার কোন দৈহিক চেতনা নেই, দৈহিক খোরাকের দরকার নাই, শুধু পেটের খোরাকের জন্য সে স্বামীর ঘর করে। এখন যদি অন্যত্র খোরাকের ব্যবস্থা হয়ে যায় তাহলে কাজ- কর্ম, স্বামী সন্তান এতসব ঝক্কি ঝামেলা কেন পোহাবে। আর এ জন্যই সে ইঞ্জিনিয়ারের কথায় আত্মতৃপ্ত হয়ে বসে আছে।
আর এই বেটা ইঞ্জিনিয়ার। তারা তো চিল্লাকে হজ্ব মনে করে, এখন সে হজ্ব থেকে এসে এমন এক কাজ করল যা তাকে জাহান্নামের ঘাট উৎরে দেবে। এ মেয়েটি তো এমনিতেই ঘর করবে না, সংসার করবে না, তালাক চায়, মাঝে মধ্যে নিজেও তালাক লিখে। এমনিতেই নাচনে বুড়ি তার উপর ঢোলের বারি। তার কথায় যদি সত্যি সত্যিই আমার ঘর-সংসারটা ভেঙ্গে যায়, তাহলে সত্যি সত্যিই ইঞ্জিনিয়ারকে জাহান্নামে ঢুকতে হবে। কারণ এখানে তিনটি জীবনের ভবিষ্যৎ জড়িয়ে আছে। হাসান জিজ্ঞেস করল- কেন সে এমন কথা বলল? ফেরদৌসি ঠোঁট উল্টিয়ে জবাব দিল- কি জানি বড়াপা কি কি জানি কইছে। হাসান স্ত্রীর হাত ধরে বলল- চল যাই গা। ফেরদৌসি কিছুটা অবজ্ঞাভরে হাত টেনে নিয়ে চড়া কণ্ঠে বলল- এখন যাব কেমনে, দুলা ভাই আসছে দেখি কি করে। পেজগিটা তো আপনিই বাজাইছেন, আপনেই তো আমার নামে বিচার দিছেন, সব কথা কইছেন, আমি তো আর কই নাই। যেমন বিচার দিছেন এখন মজাটা বুঝবেন- বলে স্বামীর দিকে সেই উৎকট ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। যেন তার দৃষ্টির আগুনে স্বামীকে পোড়িয়ে মারতে চায়।
হাসান স্ত্রীর চোখের দিকে তাকায়, তার পরিচিত এই দৃষ্টির অর্থ সে বুঝে। তার পিত্তিটা যেন জ্বলে উঠল- হারাম জাদী মাগি, যতদুর মনে হচ্ছে আল্লাহ্ তোর কপালে শাস্তি নির্ধারন করে ফেলেছেন, তুই অভিশপ্ত। অন্যায় করলি তুই, তোর সংশোধনের জন্য আমি জানিয়েছি বলে আমার দোষ হয়ে গেল। আমাকে অবজ্ঞা করার ফল তুই পাবি। হাসান ক্রোধ লজ্বা ও ঘৃণায় আর বসে থাকতে পারল না, ঠিক আছে আসি- বলে উঠে চলে গেল। ফেরদৌসি স্বামীকে কিছু বললও না, সেদিকে ফিরেও তাকাল না।
বিষয়: সাহিত্য
১৫১২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন