চিঠি- ৩৬ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ০৯:৪৪:৪৩ সকাল
বাবার সংসার চালাতে গিয়ে হাসানের অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। যে সব বিষয় স্পষ্টত কল্যাণকর সেগুলোতে সিদ্ধান্ত নিতে সে গড়িমসিও করত না ছাড়ও দিত না। যেমন লেখা পড়া করতে হবে, এখানে সিদ্ধান্তের কিছু নাই, নিজের ও ভাইদের লেখাপড়ায় কোন ছাড় দিত না। উন্নতি করতে হবে, আর কৃষি নির্ভর পরিবারে উন্নতির উপায় হল, তেল লবণ কাপড়-চোপড় ছাড়া কোন কিছু না কিনা, নিজে উৎপাদন করা, কাজেই সে সব কিছুই আবাদ করত। কিন্তু কিছু বিষয় এমন আছে যেগুলোর ভাল মন্দ আগেই বুঝা যায় না, এসব বিষয়ে সে আবেগের বশে হুট করে সিদ্ধান্ত নিত না, লেংথির উপর ফেলে রাখত। সময় গড়াতে থাকত আর স্পষ্ট হতে থাকত কোন দিকটা ভাল আর কোনটা মন্দ, সেই মোতাবেক সিদ্ধান্ত নিত। স্ত্রীর ব্যাপারেও সে একই পন্থা অবলম্বন করল, চিন্তা করল এখানে তিনটি জীবন জড়িত, কাজেই আবেগে কোন কিছু না করে হিসেব কিতেব করে কাজ করতে হবে।
প্রথমে হিসাব করল স্ত্রী বাদ দিলে তার লাভ কি হচ্ছে আর ক্ষতি কি হচ্ছে। লাভ তার একটাই- ঝগড়ার এ ক্লেদাক্ত নরককুন্ড থেকে মুক্তি পাবে, ভয়ঙ্কর এক বিষাক্ত ফণিনীর কবল থেকে রক্ষা পাবে। এখনো সে বিয়ে করলে তার আগের আশা পূরণ করতে পারবে, একটা সুন্দরী, মেধাবী, প্রতিভাবান মেয়ে বিয়ে করতে পারবে। কিন্তু তার ক্ষতি কি হচ্ছে? ক্ষতি তো অনেক। তার সন্তান মা হারা হচ্ছে, সেও ইয়াতিম হয়েছিল তার বাচ্চাও ইয়াতিম হবে। এছাড়া তার বউয়ের পৈত্রিক এমন কোন সম্পত্তি নাই যে, গিয়ে বসে বসে খাবে। অগত্যা তার বোনেরা তাকে বিয়ে দিতে চাইবে, আর তখন তার রুপের যে বাহার, যে পগার মার্কা নাক, স্বাস্থ্যের যে ছিরি তার উপর বাচ্চা হয়ে গেছে, সাধারণত কেউ তাকে বিয়ে করতে চাইবে না। বড় জোর বউ মারা গেছে কয়েক হালি বাচ্চা আছে এ জাতীয় কেউ বিয়ে করতে পারে। আর তখনই হবে খেলা। যে মেয়ে দু’জন মানুষের সংসার চালাতে পারে না, নিজের একমাত্র বাচ্চাকে রাখতে পারে না, মেরে বাপের কাছে পাঠিয়ে দেয় রাখার জন্য, কোন কাজ করতে পারে না, নিজের প্রথম বাসরের স্বামীকে লাথি মারতে বলে, অষ্ট প্রহর কড়াইয়ে ভাজাভাজি করে, মায়ের চেয়েও মমতাময়ি শাশুড়িকে এ ধরনের কথা বলে, এই মেয়ে যে অন্যের সংসারে গিয়ে অন্যের স্বামী সন্তানকে মেনে নিবে, খেদমত আঞ্জাম দিবে, জীবন কাটাবে, এটা সুদূর পরাহত।
তারপর হবে কি, ঐ যে সে চূড়ান্ত রাগের সময় বলত- তোর কান্নায় বৃক্ষ পত্র ঝরে পড়বে, তোর কান্নায় বৃক্ষ- লতা, পশু- পাখি, পাথর পর্যন্ত কাঁদবে। তুই রাস্তায় পরে ভিক্ষে করে খাবি। হায়, এই পরিণতি ব্যতীত আর কোন পথ আছে বলে তো মনে হয় না। ভাই বোনদের মধ্যে এমন তো কেউ নেই যে ওর বোঝা বহন করতে পারবে। হাসান বিমর্ষ হয়ে উঠে- হায়, যে মেয়েটি বাসর রাতে কেঁদে উঠে বলেছিল আমার যা কিছু সব আপনাকে দিলাম। আমি বেঁচে থাকতে তার এই পরিণতি কি করে মেনে নিব, এটা সম্ভব নয়। আবার তাকে ঘুম থেকে ডাকলে বলে আমার বাপে আমারে কত আদর করত, এর অর্থ কি? এর অর্থ হল, পিতা সন্তান যেমন ঐশী বন্ধনে আবদ্ধ, সেও তেমনি আমার সাথে আবদ্ধ। সন্তান হাজারটা অন্যায় করলেও কোন পিতা সন্তানকে ফেলে দেয় না, তারও বিশ্বাস সে শত অন্যায় করলেও আমি কখনো তাকে ফেলে দেব না, এ জন্যই সে এমন করে।
অবাক কান্ড, বিয়ে পরবর্তি স্ত্রীর সাথে মধুময় স্মৃতিগুলি একের পর এক তার মনের তলায় বুদবুদ হয়ে ভাসতে লাগল। এক পবিত্র ভালবাসার আবেশ ছড়িয়ে পরল তার দেহমনে। হাসান গভীরভাবে অনুভব করছিল আসলে স্ত্রীর প্রতি তার মনে যে ভালবাসা সৃষ্টি হয়েছিল, তা হারিয়ে যায়নি, মরেও যায়নি, বরং নির্যাতনের শৈল প্রবাহের নিচে চাপা পরে আছে, জীবনমৃত হয়ে এখনো বেঁচে আছে। সে মনকে শান্তনা দিল থাক না, কেন ওর জীবনটা নষ্ট করব। মানুষ তো দূরের কথা কোন প্রাণীর দুঃখ-কষ্ট আমি সহ্য করতে পারি না, তাহলে নিজের স্ত্রীর ক্ষতি কি করে মেনে নেব। তাছাড়া আমি তালাক দিলে এই বিশ বাইশ বছরের মেয়েকে তার দুলাভাইরা এমনি রাখবে না, আবার বিয়ে দিবে, এটা আমি কি করে মেনে নেব। আমি জীবিত অথচ আমার স্ত্রী অন্যের বিছানায় যাবে এটা আমার জন্য মৃত্যুর শামিল। কখনো যদি মনে হয় আমার স্ত্রীর অন্যত্র বিয়ে হলে অন্য পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হত বা তার আবার বিয়ে হবে, আরেক জনের বিছানায় যাবে, তখন এটা আমি সহ্য করতে পারি না, ওকে মেরে ফেলতে মন চায়। কি ভয়ঙ্কর অবস্থা, অন্য কোন বিষয়ে তো এমন হয় না। সে আমার, আমার জন্যই ওর জন্ম হয়েছে, আমার হয়েই থাকবে। সে নটি, বেশ্যা, চিনাল, খাংকি, বদমেজাজি, মুখরা যাই থাকুক তা আমারই, ভাল হলেও আমার পঁচা হলেও আমার। এটাকে নিয়েই জীবন কাটাব, এটাই আল্লাহ্র ফয়সালা।
আর এ জন্যই তিনি আমাকে সংসার ও পাঁচটি ভায়ের যাতনা সহ্য করিয়ে করিয়ে গড়ে তুলেছেন, তারপর এই অগ্নি স্ফুলিঙ্গটা উপহার দিয়েছেন। কাজেই এটা আমার ভাগ্যলিপি। আর আমি ছাড়া এর উত্তাপ সহ্য করার মত কোন পুরুষ নাই। কাজেই আমি আগুন তাপাব, এর বিনিময় আল্লাহ্র কাছে পাব, অবশ্যি উত্তম বিনিময় পাব। এক পীরকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল- আপনার বউ এত মুখরা, বদমেজাজি তবুও তালাক দিচ্ছেন না কেন? তখন নাকি তিনি উত্তর দিয়েছিলেন- আমি তালাক দিলে তো গিয়ে আরেক জনকে জ্বালাবে, তার চেয়ে আমিই সহ্য করি। আর ঐ লোকও যদি তাকে না রাখে তাহলে তো মহিলাটার জীবনটাই নষ্ট হল। আর কারো জীবন নষ্ট করার চেয়ে ধৈর্য্যধারণ করাই আমার জন্য সহজ। কাজেই আমিও ধৈর্যধারণ করব।
কিন্তু আম্মাকে যে এমন একটা জঘন্য কথা বলল। কি আশ্চর্য্য, কথাটা স্বরণ হতেই তার দেহ কাটা দিয়ে উঠল, ক্রোধ, ঘৃণা ও লজ্বায় তার শরীরটা মিইয়ে গেল। মায়ের খিদমত করা ফরয, কোন ধর্মীয় পরিবারের মেয়ে মাকে এ ধরনের কথা বলতে পারে না, এটা চাট্টিখানি বিষয় নয়। এতো পাহাড়ে সাগর আর সাগরে পাহাড় হয়ে যাওয়ার মত কথা, পৃথিবী উলট পালট হয়ে যাওয়ার মত কথা। সবে তো মাত্র সংসার শুরু হল, এখনি মা সম্পর্কে এমন কথা বললে ভবিষ্যতে তো ভয়ঙ্কর কিছু করবে। ওর জন্য আমার ইহকাল তো গেছেই, এখন তো পরকালও যেতে বসেছে। বউয়ের জন্য মায়ের বিরাগ ভাজন হয়ে আমাকে জাহান্নামে যেতে হবে। ওর মত রূপ গুণহীন একটা জাহান্নামের কুত্তির জন্য আমার ইহকাল পরকাল নষ্ট করব কেন? আমার স্ত্রী আমার খেয়ে পরে আমার মাকে এ ধরনের কথা বলবে, এটা কিভাবে মেনে নেয়া সম্ভব। ইসলামিক বিধান ও মানবিক বিধান অনুসারে ওকে তালাক দেয়া ওয়াজিব হয়ে গেছে।
সে আমার পরিবার ও ভাই বোনদের পর মনে করে, বিদ্বেষ পোষণ করে অথচ তার ভাই বোন ও দুলা ভাইদের আমি কত গভির ভাবে শ্রদ্ধা করি, মান্য করি। আমার মা তাকে কত আদর করেছেন, নিজে না খেয়ে খাইয়েছেন, নিজের পাত থেকে মাছ গোশত তার পাতে তুলে দিয়েছেন, নিজে ডিম দুধ গরম করে খাইয়েছেন অথচ এই কুত্তিটা আমার মাকে শ্রদ্ধা তো করেই না বরং বিদ্বেষ পোষণ করে। আর তার মা তো জীবনে আমার এক পয়সার উপকার করেনি তবুও তাকে দেখলেই পা ছুয়ে সেলাম করি, গভির ভাবে শ্রদ্ধা করি, রিকশা ভাড়াটা পর্যন্ত দিয়ে দেই। তার বাপকে আমি শ্বশুর মশাই ডাকি অথচ আমার বাবাকে সে আপনের বাপ বলে সম্ভোধন করে। কতবার বলেছি দেখ আমিও শ্বশুর পাইনি তুমিও পাওনি, কাজেই আব্বা বলার দরকার নেই। আমি যেভাবে শ্বশুর মশাই বলি তুমিও সেভাবেই বলো। কিন্তু এই দাম্ভিক মেয়ে কোন দিন শ্বশুর মশাই বলেনি। অর্থাৎ সে বউ হয়েও আমার পরিবারের প্রভু আর আমি জামাই হয়ে তার পরিবারের গোলাম।
কিন্তু এই গোলামিটা না করলে সমস্যাটা কোথায়? না, আর গোলামি করব না- উচ্চস্বরে হাক মেরে আবেগে দাঁড়িয়ে উঠল। তার ঠোঁটের কোনায় ক্রোড় হাঁসি ফুটে উঠল। মাগি, তালাক তালাক করস, এবার বুঝবে তালাক কাকে বলে। তিন কথা লিখে হাতে ধরিয়ে দিয়ে মেয়েটা রেখে লাথি মেরে বের করে দিব। তারপর ভিক্ষে করে না হয় বেশ্যাবৃত্তি করে খা গিয়ে। আসলে সে তো একটা বাজারি বেশ্যা বা বস্তির মেয়ে বরং এর চেয়েও জঘন্য। এর বোনগুলিও প্রায় একই রকম। এদের পরিবারটাই এমন, আর এমন পরিবারের সাথে আত্মীয় করা বা রাখা হারাম, বিলকুল হারাম। মেয়ের চিন্তা করে লাভ নেই, মা বাপের এত কেলেঙ্কারি দেখলে মেয়ে এমনিতেই নষ্ট হয়ে যাবে, এ ধরনের মা না থাকলে মেয়ে আরো উত্তমরুপে মানুষ হবে। তাছাড়া যেসব বাচ্চাদের মা মারা যায় ওরা কি মানুষ হয় না। আমার মা বোন ও ছোট ভাই বউ আছে ওরাই মেয়েকে পালতে পারবে।
ক্রোধোন্মত্ত অবস্থায় উঠে সে হন হন করে বাসার দিকে চলল, তখন রাত প্রায় আটটা বেজে গেছে। যেতে যেতে ভাবল এভাবে হঠাৎ তালাক দিয়ে দিলে তো বিপদে পরতে হবে, ওরা তো ছেড়ে দিবে না। উপায় চিন্তা করতে করতে বাসায় পৌঁছল। গিয়ে স্ত্রীর প্রতি দৃষ্টিটা পরতেই এই প্রথম মনে হল একটা পায়খানার কীট, গোবরে পোকা, যার ঠিকানা শুধুই জাহান্নাম, ঘৃণায় শরীরটা রি রি করে উঠল। স্বামীর মুখের অবস্থা দেখে সে টের পেল কিন্তু তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এটা বুঝতে পারেনি। ফেরদৌসীর অবস্থা হল, যা ঘটতে যাচ্ছে তার মধ্যে এর প্রভাব পড়ে গিয়েছিল। কেমন যেন উসকু খুসকু চুল, পাগলির মত বেশ, অস্থির ভাব, বিকার গ্রস্থ অবস্থা। হাসানের গাম্ভির্যতা দেখে সম্ভবত সে বুঝে গিয়েছিল, যে কোন সময় এক্সিডেন্ট ঘটে যেতে পারে। এজন্য এর পরে সে আর কোন কথা বলেনি, নীরব হয়ে যায়। এত কিছুর পরেও তার সেই কুৎসিত কথাটার জন্য তাকে অনুতপ্ত দেখা যায়নি।
রাতে শুয়ার সময় হাসান স্ত্রীকে ধরে থাকত। অনেক সময় সে ঝগড়া করত আর বলত- আমি তো আপনের ঘরে থাকব না, ছি ছি তাহলে আপনের সাথে শুয়ে আছি কেন? আপনি তো পরপুরুষ বলে সরে যেত। হাসানই টেনে কাছে আনত। কিন্তু আজ স্ত্রীর বিপরীতমুখী হয়ে তার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে শুইল। কিছুক্ষণ পর দেখে হাসানের গায়ের সাথে গা লাগানোর চেষ্টা করছে, মনে হল তার পেছনটা পোড়ে যাচ্ছে, সরে এল, সে এগিয়ে এল, আবার সরল, আবার এগিয়ে এল, তার সাথে মিশে শুইল। কিন্তু আর সরার জায়গা নাই। সহসা মনে হল একটা বিরাট বীছে পোকা তার পিছনে লেপটে আছে, পিছনটা বুঝি পঁচে গেল।
পরদিন হাসান কথাবার্তা না বলে গম্ভীর হয়ে থাকল। সেও বুঝতে পারল স্বামী রেগে আছে। আবার ফেরদৌসীকে দেখে বুঝা যায়- বিধ্বস্ত, মজলুম, বিষণ্ণ- যা ঘটতে যাচ্ছে এর প্রভাব পড়ে গেছে তার দেহমনে। কিন্তু এই দাম্ভিক আওরত তার সেই জঘন্য কথাটার জন্য লজ্বিত হওয়া তো দুরের কথা, মাফ চাওয়া তো দুরের কথা, স্বামীকে অন্তত এতটুকুও বলল না যে, কথাটা বলে ফেলেছি কিছু মনে করেন না যেন। কিছুই বলল না, ঝগড়াও করল না, গম্ভীর হয়ে থাকল। আসলে ফেরদৌসী এতটাই দাম্ভিক যে- সে যত বড় অন্যায়ই করুক কখনো ভুল স্বিকার করে না, অনুতপ্ত হয় না। এতে হাসানের মন আরো ক্ষেপে গেল, ভাবল ওকে বিদায়ের পদ্ধতিটা কি হতে পারে। অনেক চিন্তা করল কিন্তু কোন কুল কিনারা পেল না। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল- আগে গিয়ে বিচার দিবে, তারপর দেখবে কি হয় না হয়।
কিন্তু বিচার কার কাছে দেবে, এডির কাছে বিচার দিলে তো কাজ কিছু হবেই না, সে উল্টো গিয়ে তার বউকে বলবে- হাসান কি জহিরের মত বউকে অত্যাচার করে নাকি? তখন তার বউ বলবে- না, ফেরদৌসি ইসুবিসুর মত না। জহিরের মত করলে ফেরদৌসি এক ঘন্টাও থাকবে না, চলে আসবে। কাজেই এখানে গিয়ে লাভ নেই। আবার ইঞ্জিনিয়ার চলে গেছে চিল্লায়, এখন গেলে বজলুর কাছে। এ বেচারা দরিদ্র, তার হাতে কোন কর্তৃত্ব নাই, তবুও যাবে, জানাবে গিয়ে, তারপর দেখা যাক কি হয়।
মাগরিবের পর গেল তার কম্পিউটারের দোকানে। দোকানে ভিড় দেখে এশার পর গিয়ে আলাপ শুরু করল। প্রথমে বলল, তার মা বউকে কেমন আদর করতেন, দুধ ডিম গরম করে নিজের হাতে খাওয়াতেন, নিজের পাত থেকে মাছ গোশত তাকে তুলে দিতেন, হাসান গেলেই সে বলত আপনি না থাকলে আম্মা আমারে বেশি আদর করে। চলে আসার সময় শাশুড়ির কান্না দেখে বলত আম্মা মেয়ে বিদায় করে। একদিন মা তাকে আম কেটে দিতে বললেন, দু’ঘন্টা পর্যন্ত বলার পরও কাটল না, যহুরের আযান দিয়ে দিছে, তখন মা একটু রাগে বললেন, যাও গোসল করে নামায পর গিয়ে, তোমার আর আম কেটে দিতে হবে না, আমিই কেটে দিচ্ছি। এটুকু রাগ দেখালেন কেন। এজন্য সে পরশু দিন রাতে বলে- ঐ বাড়িটাতে যে আমার পায়ের ধূলা ফেলেছি এটাই বেশি। আবার আমাকে কাজের অর্ডার করে, তখন চুলের মুঠি ধরে কোমরে কয়েকটা লাগিয়ে দিলেই উচিত শিক্ষা হত।
হাসান মনে করেছিল মা সম্পর্কে এটুকু শুনার পর সে কেঁপে উঠবে, বিস্মিত হয়ে যাবে। কিন্তু তার মধ্যে কোন ভাবান্তর দেখা গেল না, কী বোর্ডে টিপাটিপি করছে। বুঝল এরা সবাই আসলে একই নৌকার যাত্রি, স্ত্রীর ক্রীতদাস, এদের কাছে বলে কোন লাভ হবে বলে মনে হয়না। তবুও বলতে থাকল- একদিন ঘুম থেকে ডাক দেয়ার কারণে আমাকে বলে লাথি মেরে চেয়ার থেকে ফেলে দিবে। আরেকদিন সে চেয়ারের হাতলে হয় লাথি মেরেছিল না হয় আমার হাতের উপর পা রেখেছিল, আরো কিছু অপকর্ম জানাল। তার ঝগড়া ঝাটি, কাজ না করা, মেয়েকে না রাখা, মারা, হাসানকে ও তার পরিবারকে গাল মন্দ করা ইত্যাদি সব কিছুই কম বেশি জানিয়ে যখন উঠল তখন রাত বারটা। অবশেষে সে যা বলল- ইঞ্জিনিয়ার তো নাই, সে আসুক, ফেরদৌসিকে ধমক দিব তখন সে কাঁদবে। ব্যস এটুকুই ছিল তার মূল কথা। বিচার যে কেমন হবে হাসান বুঝল।
বাসায় গিয়ে টোকা দেয়ার সাথে সাথে দরজা খুলল, দরজার কাছেই সে দাঁড়িয়ে ছিল অর্থাৎ হাসানকে খুজছে অপেক্ষা করেছে, বোরকা পরা। তাকে দেখেই ঐ রুমের বিছানায় গড়িয়ে পরল এবং কেঁদে উঠে বলল- এত রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলেন, আমি আপনার খোজে বড়াপার বাসায় যাইতে চাইছিলাম। অন্যদিন কাঁদলে সে স্ত্রীকে বুকে জড়িয়ে আদর করত কিন্তু আজ ওর কান্না দেখে একটা উৎকট ঘৃণায় মনটা আরো বিষিয়ে উঠল। এক পলক ঘৃণার দৃষ্টি ফেলে পাশের রুমে গিয়ে কাপড় চোপড় খুলে চেয়ারে বসল। স্ত্রীকে বিষণ্ণ ও বিধ্বস্ত দেখা যাচ্ছে, সে এসে হাসানের পায়ের কাছে ফ্লোরে বসল। তারপর পা দু’টি জড়িয়ে ধরে উরুর উপর মাথা রেখে কাঁদতে লাগল- আপনে আমারে ছাড়া কেমনে থাকবেন, কোন মেয়ের কাছে গেছিলেন ইত্যাদি বলতে বলতে অঝোরে কাঁদতে লাগল।
এই মেয়েটা ছিল এমনই বোকা যে, তার ধারনা হাসান কোন মেয়ের কাছে গেছে। তবে হাসান জানে না সে কোনটা ভেবেছে, অবৈধভাবে নাকি বিয়ে করতে। এর এটুকু চিন্তা শক্তিও নাই যে, একজন মুহাদ্দিস কোন মেয়ের কাছে যায় না, যেতে পারে না। আবার বিয়ে করলে তো মানুষের মধ্যে একটা আলামত থাকে, কন্যা খুজাখুজি করা, আলাপ সালাপ করা বা মানসিক ভাব লক্ষন, কোন কিছুই নেই তবুও তার সন্দেহ- হাসান কোন মেয়ের কাছে গেছে। সে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে, তার স্ত্রী উরুর উপর মাথা রেখে কাঁদছে, কাঁদছে, অঝোরে কাঁদছে, তার উরু ও লুঙ্গি ভিজিয়ে ফেলেছে। মনটা হাহাকার করে উঠল, যুগপৎ ঘৃণা ও ভালবাসার অদ্ভুত মিশ্রন। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল- তুমি কি মনে করছ আমি কোথায় গেছি? সে মাথা তুলল, চোখে পানি, বড় করুণ দৃষ্টিতে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে শিশুর মত অভিমানি কণ্ঠে বলল- কোন নটি বেশ্যার কাছে গেছিলেন? এ মুর্খ এখনো আন্দাজই করেনি যে স্বামী তাকে তালাকের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তার মায়া হল। স্ত্রীর মাথায় ও গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলল- আজে বাজে চিন্তা কর কেন? আমি বজলুর কাছে গিয়েছিলাম। - কেন? – এমনিতেই, দরকার ছিল। আসলে সে বুঝে ফেলেছে যে, তার বিচার দিতে গিয়েছিল। অন্য দিন হলে কুরুক্ষেত্র কান্ড ঘটে যেত, স্বামীকে পায়ে ধরিয়ে ছাড়ত কিন্তু আজ সে ভিত, সন্ত্রস্ত, একটি কথাও বলল না। রাতে হাসান ওর প্রতি তাকাল, ঘৃনাও লাগে মায়াও লাগে, এক অদ্ভুত মানসিক দ্বন্ধ। সাক্ষাৎ হল কিন্তু সে নির্জীব, না আছে দৈহিক চেতনা আর না আছে মানসিক চেতনা।
দুপুরে হাসান মাদরাসা থেকে বাসায় ফেরার পর স্ত্রী বলল- বড়াপা এসেছিল। - কেন- বলে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল আর সাথে সাথে তার মনটা কেঁদে উঠল। একি দেখছে সে, সম্পুর্ণ বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত, আধমরা একটা মুখ। অনেক মার খাওয়ার পর গৃহ পালিত কৃতজ্ঞ কুকুর যেমন কিছু পাওয়ার জন্য সজল নয়নে মুনিবের দিকে তাকিয়ে থাকে, তেমনি বড় করুণ চোখে সে স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে। আবেগে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে অনেক আদর করল, চুমু দিল। সে বলল- কেন আইছিল জানিনা, শুধু কাঁদল আর বলল- তোর জামাই আসলে বলবি বিকালে যেন তোকে আমার বাসায় দিয়ে আসে। আসলে ফেরদৌসীদের শক্তি নির্ভর করে তাদের বড় বোনের উপর। ব্ড়াপা যখন বাসায় এসে কাঁদল তখন সে বিধ্বস্ত হয়ে গেল। কিন্তু যদি তার বোন সাহস দিত তাহলে স্বামীর গর্দান মারতেও কুণ্ঠাবোধ করত না। কিন্তু হাসান মনে করল বিচার দেওয়ার প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। তবে অবাক হল এজন্য যে, এর মত স্বেচ্চাচারি আর স্বৈরাচারী মহিলা কাঁদল কেন, এ তো কাঁদার লোক নয়। যদ্দুর মনে হচ্ছিল তার বোন শাশুড়িকে সেই ভয়ঙ্কর কথাটা বলার জন্য অনুশোচনায় বা প্রতিক্রিয়ায় কেঁদে ফেলেছে। আর বাসায় যেহেতু দিয়ে আসতে বলেছে তাহলে নিশ্চয়ই এর কঠিন বিচার করবে।
হাসান মনে মনে খুশি হল। আসলে সে তখন চাচ্ছিল কেউ যদি ওর একটু বিচার করে সংশোধন করে দিত, মাকে বলা কথাটার জন্য মাফ চাইত, তাহলে তিনটি জীবন বেঁচে যেত। ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বাকী জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারত। স্ত্রীকে যে সে ভালবাসে, সেও তো তাকে ছেড়ে যেতে চায় না। মনে হল বড়াপা বিচার করবেন, হাসানের বাসা থেকে তার বাসা এক থেকে দেড় কিলো দূরে, অনেক আশা নিয়ে বিকালে তার বাসায় গিয়ে দিয়ে আসল। দিনটি ছিল ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০০৫ সাল। তাদের বিয়ে হয়েছিল ৪ঠা এপ্রিল, ২০০৩ সাল। তখন তাদের দাম্পত্য বয়স ছিল- ২ বছর ৫ মাস ১৫ দিন।
বিষয়: সাহিত্য
১২৬০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন