চিঠি- ২৯ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২৬ আগস্ট, ২০১৬, ১০:৪২:৩৯ সকাল
শিক্ষা নিয়ে ঝগড়া হত। ফেরদৌসী তাদের পরিবার ও দুলা ভাইদের উচ্ছসিত প্রশংসা করত। তারা সবাই নাকি তুখোর মেধাবী। আসলে তুখোর মেধাবী তাদের মধ্যে কেউ ছিল না- যা ছিল কোন রকম চলনসই ধরণের মেধাবী। সে বলত বড়াপা ও তার দাদু মানে বড় ভাই একই ক্লাসে পড়ত, এক সাথে স্কুল থেকে আসত। বড়াপা বই- পত্র রেখে রান্না ঘরে গিয়ে ভাত বেড়ে খেতে বসত, তখন দাদু গিয়ে তার পাতে থু থু দিয়ে থাল নিয়ে আসত যাতে তাকে বেড়ে না খেতে হয়। তখন বড়াপা নতুন করে বেড়ে খেত। এভাবে প্রতিদিনই চলত। কিন্তু দাদু খুব একটা মেধাবী ছিল না, বড়াপা ছিল তুখোর মেধাবী, তার সাথে কারো তুলনা ছিল না। তাকে নিয়ে আব্বার অনেক আশা ভরসা ছিল, তাকে মেডিকেলে পড়ানোর ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বিয়ে হয়ে গেল আর ডাক্তারি পড়া হল না।
একদিন আলাপ চলছিল রাত্রে খাওয়ার সময়। হাসান বলল, মেট্রিকে তার রেজাল্ট কি ছিল? সেকেন্ড ক্লাস- মুখ ফসকে এতটুকু বলেই কণ্ঠ আটকে দিল এবং লজ্বা ও প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে এক দৃষ্টে হাসানের দিকে তাকিয়ে রইল। সম্ভবত সে স্টার- স্ট্যান্ড বা এ জাতীয় একটা কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু মুখ ফসকে সত্য কথাটা বেরিয়ে আসে। হাসান তখন মাত্র লোকমাটা মুখে দিয়েছে, কার রেজাল্ট কি তাতে তার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু তার দিকে স্ত্রীর অপলক চাহনি দেখে পেটের মধ্যে হাসি ঘোরপাক খেতে লাগল। এ অবস্থায় হাসলে কপালে দুঃখ আছে- বুঝে মাথাটা নিচু করে মুখ বন্ধ করে হাসিটা দমনের চেষ্টা করছে। কিন্তু বেয়ারা হাসিটা পেটের মধ্যে ঘুর্নি সৃষ্টি করে উপর দিকে খোলা পেয়ে গলা দিয়ে এসে ফুট্টুস করে মুখ থেকে বেরিয়ে গেল। সাথে সাথে মুখের ভাত স্ত্রীর নাকে মুখে ও পাতে গিয়ে পরল। পরবে তো পর একেবারে মালীর ঘাড়ে।
বেয়ারা হাসিটা তখন বাঁধ ভেঙ্গেছে, অপারগ হয়ে বেচারা মাথা নিচু করে হাসতে লাগল। কিন্তু ততক্ষণে বারুদের ঘরে আগুন ধরে গেছে। সে মনে করেছে রেজাল্ট শুনে হাসান বড়াপাকে উপহাস করছে। আর যাবে কোথায়? লাফিয়ে উঠল- আপনের মত অসভ্য মানুষ তো দেখিনি, আপনে আমাদের কাউরে মানেন না। শেষ পর্যন্ত বড়াপাকেও অপমান করলেন। হাসান নরম সুরে বার বার তাকে বুঝিয়ে বলে- দেখ আমি বড়াপার উদ্দেশ্যে হাসি নি। তোমার চাহনি দেখে আমার হাসি পেয়েছে। কিন্তু স্বামীকে ঘায়েল করার সুযোগ পেয়ে সে সদ্ব্যবহার শুরু করল- হে, কেমন মেধাবী জানা আছে না, গোস্টির মধ্যে ক্য়ডা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার আছে যতসব মূর্খ ছোদার দল। হাসানের চৌদ্দ গোস্টি সুদ্ধু তুলো ধুনা শুরু করল।
সে নিজেই স্বামীকে সর্বদা মেধাবী বলত, কিন্তু এবার তার মেধার নিকুচি শুরু করল- আহ, কী আমার মেধাবী জানা আছে না, ঢাকা ভার্সিটি তো সান্স পেলেন না, সেই চট্টগ্রামে যেতে হল। হাসান বলল- জান না সে সময় ঢাকা ভার্সিটিতে মাদরাসা ছাত্রদের শর্তারোপ করা হত, ভাল সাবজেক্ট দিত না। - হ, মুরোদ না থাকলেই টালবাহানার আলাপ। অবশেষে অধৈর্য্য হয়ে সে রাগের মাথায় বলে ফেলল- আহ- হারে, কত বড় মেধাবী আর কত বড় শিক্ষিত তাতো আমার জানাই আছে। একটাও তো আমার ছাত্র হওয়ার যোগ্য না, আমার ছাত্র হতে হলেও আরো পনের বছর পড়া লেখা করে আমার ছাত্র হতে হবে। যদিও কথাটা বাস্তব কিন্তু পরিণামের আশংখায় হাসান আর কথা না বলে চুপ মেরে গেল। স্ত্রী দৃষ্টির অগ্নি ঢেলে দাঁত খিঁচিয়ে মাথা ঝাকিয়ে বলল- তাই নাকি, বাঃ এত বড় শিক্ষিত। তাহলে তো আমাদের মত মেধাহীন, অশিক্ষিত মূর্খ আপনের মত শিক্ষিতের সাথে থাকা আপনের জন্য লজ্বাজনক। দেন দেন তালাক দেন, এখনি তালাক দেন। আমার মত মূর্খ চলে গেলে আপনে মেধাবী ও শিক্ষিত দেখে বিয়ে করে মান রক্ষা করতে পারবেন।
এবার শুরু হল তালাকের জন্য উৎপাত। হাসান গম্ভীর হয়ে চেয়ারে বসে আছে। কিন্তু এ বসে থাকাটা তার জন্য সহ্য হল না। আঙ্গুল দিয়ে তার মাথায় ধাক্কা মেরে বলল, বসে আছিস কেন, তালাক দে। হাসান হাত ছিটিয়ে তার হাতে মেরে বলল- যার মন চায় সে তালাক দিয়ে চলে গেলেই তো হয়। এবার সে সুযোগ পেয়ে গেল। ত্বরিতে টেবিলের কাছে গিয়ে ড্রয়ার টেনে কলম বের করে একটানে লিখে ফেলল- আমি তালাক দিয়ে চলে গেলাম। এটা তার দ্বিতীয়বার তালাক লেখা। হাসান বসে বসে ভাবছে আজ যে করেই হউক সে যেতে চাইবে। কারণ আজ তার হাতে দলীল আছে। বড়াপাকে উপহাস করেছে, তাদেরকে ছাত্রের অযোগ্য বলেছে- এসব গিয়ে বলবে, আরো কিছু বানিয়ে বলবে। আর তখন বউটাকে তো হারাতে হবেই সেই সাথে বোনাস হিসাবে রাম ধোলাইও কপালে জুটতে পারে। স্থির সিদ্ধান্ত নিল আজ কোন ভাবেই যেতে দেয়া যাবে না। সে বোরকা পড়ছে, হাসান গিয়ে হাত ধরে বলল- দেখ রাগের মাথায় কি না কি বলে ফেলেছি মাফ করে দাও। সে হাসানের থেকে ছিটিয়ে সরে গিয়ে বোরকা পড়ল। তারপর মেয়েকে কোলে নিয়ে রওয়ানা করল। হাসান এক হাতে তার হাত ধরে গম্ভির গলায় বলল- যাওয়া যাবে না। সে হাত ছাড়ানোর জন্য অনেক চেষ্টা করল, ঝাকুনি দিল, টানা হেঁচড়া করল কিন্তু পারল না।
অবশেষে অপারগ হয়ে বলল- ছাড় ছাড় কইলাম, নইলে মেয়েকে ফালাইয়্যা দিমু। হাসান খপ করে মেয়েকে ধরে তার হাত থেকে ছারিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিল। ইত্যবসরে সে বেরুনোর জন্য দৌড়ে পাশের রুমের দরজায় চলে গেল। হাসান দৌড়ে গিয়ে টেনে হেঁচড়ে বেড রুমে নিয়ে এল আর বারবার বলতে থাকল- আমি রাগের মাথায় কথাটা বলে ফেলেছি মাফ করে দাও, আমার কথা তোমার মেয়েটার কথা চিন্তা কর। কিন্তু তার ভাব দেখেই বুঝা যাচ্ছে আজ সে যাবেই। হাত ছাড়ানোর জন্য অনেক হুড়োহুড়ি করল, ঝাকুনি দিল, গায়ের শক্তি ঝারল কিন্তু পারল না। তারপর মাটিতে বসে পরল- ছাড়, আমি চলে যামু, আমি তোর ঘরে থাকমু না, আল্লাহ্র কসম আজ হউক কাল হউক আমি চলে যামুই। তোর ভাত আমি খামু না ইত্যাদি বলতে বলতে শিশুদের মত মাটিতে দুই পা আঁচড়াতে লাগল এবং এক হাত মারতে লাগল, আরেক হাত হাসান ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর দাঁড়াল, আবার শুরু করল টানা হেঁচড়া, হুড়োহুড়ি, কিছুক্ষণ পর ক্লান্ত হয়ে আবার মাটিতে বসে পরল। হাসান নিজের কথা, মেয়ের কথা ও সংসারের কথা বলে বুঝাতে লাগল কিন্তু তার মধ্যে কোন ভাবান্তর নেই।
হঠাৎ হাত ফসকে সে দৌড় মারতে চাইল। হাসান আবার ধরে ফেলল, এবার সে হুড়োহুড়ি আর কান্না একসাথে শুরু করল- আমারে যাইতে দে, আমি থাকমু না, চলে যামু। হাসান বলল ঠিক আছে, গেলে অন্যদিন যাবে আজ নয়। - না আমি এখন যামু, আমারে যাইতে দে – ভীষণ কান্না কাটি শুরু করল। হাসান বুঝতে পারল- আজ গেলে সে তাকে ভাল রুপে জব্দ করতে পারবে, এ জন্য তার জেদ চেপেছে আজ যাবেই, তাকে শায়েস্তা করবে। ক্ষোভ আর ঘৃণায় হাসানের মন চাইছে চিৎকার করে কাঁদে অথবা হারামজাদিকে গলায় টিপ মেরে ফেলে। ইতিমধ্যে এই টানা হেঁচড়া করে দেড় থেকে দুই ঘন্টা চলে গেছে। রাত প্রায় বারটা বাজে। প্রচন্ড রাগ উঠে গেল তার। ক্ষোভে দুঃখে বলে উঠল- তুই আমাকে যে কষ্ট দিলি একদিন তোর কান্নায় বৃক্ষপত্র ঝড়ে পড়বে। তারপর মৃদু গর্জন দিয়ে বলল- যাওয়া যাবে না বলছি শুনিস নাই, বিছানায় চল- বলে টেনে হেঁচড়ে বিছানায় নিয়ে ফেলল। তারপর বাম হাতে কোমর ও ডান হাতে হাটু চেপে ধরে ঠিক এ কথাগুলি বলল- তুমিই কাজী, তুমিই বিচারক আমার দোষ হলে তুমিই বিচার কর। পাশেই বসা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল- আমার মেয়েটাকে ইয়াতিম কইর্যো না- বলে এক অন্তহীন বেদনায় কেঁদে ফেলল।
সে হাসানের দিকে তাকাল, চোখে পানি ঝড়ছে, হাটুর দিকে তাকাল, তার পায়ে ধরে আছে। স্ত্রীর দৃষ্টিতে উৎকট ঘৃণা, প্রতিশোধ আর হিংস্র আনন্দ উপছে পড়ছে, সে শান্ত হয়ে গেছে। হাসান তাকে চিনে, এ দৃষ্টির অর্থ বুঝে, এ যাবত সে তাকে যত অত্যাচার করেছে, হাসান যতটা কষ্ট পেয়েছে, কোন দিন তার মন ভাঙ্গেনি। কিন্তু এই দিন স্ত্রীর সেই কুৎসিত দৃষ্টি দেখে তার মনটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল, কলজেটা জ্বলে গেল। পৃথিবীর কোন নারী স্বামী তো দুরের কথা অন্য কারো প্রতি এমন বিশ্রিভাবে তাকাতে পারে না। মন চাইছিল হয় নিজেই মরে যায় অথবা এই পাষণ্ডীকে মেরে ফেলে। নিজেকে নিয়ন্ত্রন করে পাশের রুমে চলে গেল। বুক ফেটে কান্না আসছিল, মন চাইছিল চিৎকার করে কাঁদে- আমি কি শুকর, কুকুর নাকি এর চেয়েও নিকৃষ্ট, হয় মাটির সাথে মিশে যাব অথবা নারী জাতির কলঙ্ক, স্ত্রী রুপি এই অভিশাপটা খতম করে দেব। কিন্তু শান্ত হওয়ার জন্য সে বাইরে বেরিয়ে গেল।
প্রথমে বউ পসন্দ হয়নি, তাকে ভালবাসতে হাসানকে অনেক খড় কুটো পোড়াতে হয়েছিল। অনেক দোয়া কান্নাকাটি ও চেষ্টা তদবিরের পর তাকে ভালবাসতে পেরেছিল। কিন্তু এই দিন তার প্রতি ভালবাসার সমাধি রচিত হল আর মনে জন্ম নিল তীব্র ঘৃণা। এরপর থেকে স্ত্রী তাকে কষ্ট দিয়ে যেমন আনন্দ পেত তদ্রুপ স্বামীও তার কষ্ট দেখলে বা কষ্ট দিয়ে আনন্দ পেত। তাকে কাঁদতে দেখলে আগে বুকে জড়িয়ে শান্তনা দিত আদর করত কিন্তু তখন থেকে মনে এক হিংস্র আনন্দের ঢেউ অনুভব করত।
এই শিক্ষা ও মেধা নিয়ে প্রায় প্রায়ই ঝগড়া হত। একবার এডির বাসায় ঝগড়া হল। হাসানের সর্ব কনিষ্ঠ ভাইটা আনন্দ মোহন কলেজে পড়ে, ভাল একটা ছেলে, তাবলীগ করে, মানে তাবলীগের আমীর, দাড়ি কাটে না। কিন্তু ছোট বেলায় সে ছিল শয়তানের হাড্ডি। তার হাই স্কুলের সময়টা কেটেছে বেপরোয়াভাবে। এ সময় সাধারণত সে বাড়িতে থাকত না, সারাদিন বাইরে বাইরে থাকত, খেলাধুলা, টিভি- সিনেমা দেখা, খেলায় রেফারি গিরি করা এসব ছিল তার কাজ। স্কুলে মাঝে মধ্যে নাটক হত, আর নাটকের পাগলাটে বা আগ্নিগর্ভ জাতীয় চরিত্র তাকে দেয়া হত, এসব পাঠ নাকি সে ভাল ফুটিয়ে তুলতে পারত। এসব নাটক পরিচালনা করত মিরাজ মাস্টার। তখন হাসান তাকে বলে কয়ে- একজন আলেমের সন্তান, এসব নাটক ফাটক করা সমিচীন নয় ইত্যাদি বলে বাদ দেওয়ার ব্যবস্থা করত। হাসান মেজো ভাইটাকে লাগিয়ে রাখত- ওকে যেখানে পাবি ধরে আনবি। খোজা খুঁজি করে কিছু দিন পর পর সে ধরে বেধে নিয়ে আসত। বেধে রাখত, শাসন করত কিন্তু মায়ের জন্য মারতে পারত না।
ঘটনাটা ঘটেছিল একদিন রাত্রে এডির বাসায়। সে হাসানের এই ভাইটাকে নিয়ে সর্বদা খোটা দিত- আপনাদের কে এত ভাল ছাত্র, এসব লেখাপড়া আমার জানা আছে। ছোটটাতো আপনের বাপের মুখে চুনকালি দিতাছে, এইটা জীবনেও ম্যাট্রিক পাশ করতে পারবে না ইত্যাদি বিষোদগার করতে করতে হাসানকে অতিষ্ঠ করে তুলত। একদিন হাসান বলল- নিজের চিন্তা কর। সে কৌতুহলি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল- মানে? - মানেটা তো তুমি নিজেই জান। এবার সত্যিই তার মনে সন্দেহ দেখা দিল যে, তার বিষয়টা হাসান জেনে ফেলেছে কি না। এবার সে শক্ত হয়ে বসে জিজ্ঞেস করল- কি আমি জানি, কইন। বারবার তাকীদ করতে লাগল। হাসান তার থেকে বিপরীত মুখী হয়ে শুয়ে থাকল। তখন রাত দশটা বাজে। সে হাসানকে গুতা মারে, কাতুকুতু দেয়, কখনো কানে ধরে কখনো চুলে ধরে টান মারে। একেবারে অস্থির করে তুলল।
অবশেষে রাগে বলল- তুমি জান না? – আমি কি জানব আপনে কইন। - আমি বললে তো তোমার ভাল লাগবে না। - ভালা লাগুক না লাগুক আপনে কইন। - বেশ তো ম্যাট্রিক কয়বারে পাশ করেছ? কথাটা শুনে সে ভুত দেখার মত চমকে উঠল, হঠাৎ মুখটা কালো হয়ে গেল। - কইন আপনে কয়বারে পাশ করছি। - একবার পরীক্ষা দেওনি, একবার দিয়ে ফেল করেছ, তৃতীয় বারে পাশ করছ, এবার খুশি তো? - সে ফ্যাকাসে মুখে, বিস্ফোরিত চোখে, রুদ্ধশ্বাসে অন্তত পাঁচ মিনিট হাসানের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকল। অবশেষে ধরা গলায় প্রশ্ন করল- আপনে কই শুনছেন? – যার বাসায় আছ সেই বলেছে মানে এডি। - কবে? – এই তো কিছু দিন আগে তার অফিসে বসে আলাপ করেছে। সে বসে বসে এডিকে কিচ্ছুক্ষণ গালাগাল করল।
এই রুমের পূর্বপাশে একটি খাট যাতে হাসান শুয়ে আছে আর পশ্চিম পাশে একটি চৌকি পরে আছে। সে হঠাৎ খাট থেকে একটা বালিশ নিয়ে চৌকিতে চলে গেল- আজ থেকে আমি আর আপনের সাথে থাকব না, যে দিন ম্যাট্রিক পাশ করতে পারব সেদিন থেকে থাকব।
হাসান বলল- আগে পড়ানোর জন্য এত চেষ্টা করলাম ভর্তি করলাম কিন্তু পড়লে না, এখন তোমাকে পড়াবে কে? – আপনি পড়াবেন, প্রতিদিন এসে পড়িয়ে পড়িয়ে চলে যাবেন। - যখন পড়াতে চেয়েছি তখন পড়নি, এখন পড়ে ফেলবে, এসব গাজাখুরি গপ্প রেখে শুতে আস, রাত অনেক হয়েছে। - না, ম্যাট্রিক পাস না করে আমি আপনের সাথে থাকব না। বলেন, প্রতিদিন আমাকে পড়াতে আসবেন কিনা। সে স্বামী থেকে ওয়াদা নিতে চায়, তার ঘ্যানর ঘ্যানর চলতেই থাকে। হাসান বলে- আচ্ছা পড়ামু নে, এখন আস শুয়ে পর রাত বারটা বাজে। - না আপনের সাথে শুব না, যেদিন দেখাতে পারব সেদিন শুব।
আসলে যে মেয়ে শির উদ্ধত রাখতে আর স্বামীকে পদানত রাখতে অষ্ট প্রহর যুদ্ধ-জেহাদ চালিয়ে যাচ্ছে- ম্যাট্রিক পাস ফেলের বিষয়টা যেন সহসা তার উদ্ধত শিরে খড়গের আঘাত হেনেছে। সে হাসানের সামনে দৈবক্রমে ছোট হয়ে গেছে। যে সর্বদা স্বামীর পরিবারকে নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, এখন সেই কিনা তাচ্ছিল্যের পাত্র হয়ে গেছে। আর এ বিষয়টা সে কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না। এ জন্যই সে কি করবে না করবে দিশা পাচ্ছে না। অবশেষে তাকে ধরে এনে শুয়ানোর জন্য যেই মাত্র হাসান উঠল অমনি সে গলার উড়নাটা হাতে নিয়ে- সাবধান কাছে আসবি না আমি আত্মহত্যা করব, আমি মরব- বলে উড়না নিয়ে দৌড়ে পাশের রুমে চলে গেল। সে রুমে ছিল এডির বাবা, অতিশয় বৃদ্ধ মানুষ কিছুই টের পান না। আর এ রুম সংলঘ্ন বাথরুম। তার ইচ্ছা বাথরুমে ফাস টানাবে। হাসান দৌড়ে গিয়ে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে এল, চেপে ধরে বিছানায় শুয়াল কিন্তু উঠে পড়ল।
এরপর থেকে শুরু হল সেই নারকিয় অভিনয়, সে স্বামীকে শাস্তি দিবে, তার লজ্বার প্রতিশোধ নিবে। হাসান এক অব্যক্ত যন্ত্রনায় অধির হয়ে বিষের ঢোক গিলে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে কিন্তু সে আরো বেশি উথলে উঠছে। উড়না হাতে ঘরের মেঝেতে দাঁড়িয়ে থাকে। স্বামী কিছুক্ষণ বুঝায়, হঠাৎ ধরতে যায় অমনি সে দৌড়ে পাশের রুমে চলে যায়। ওপাশের চিটকিনি লাগাতে চেষ্টা করে, দরজা ঐ মুখি, হাসান হাতে ব্যাথা পেয়ে হলেও দরজা টেনে ধরে খুলে, টেনে হেঁচড়ে নিয়ে আসে, আবার চলে যায়। যদিও হাসান জানে সে হয়ত ফাঁস নিবে না, শুধু তাকে শাস্তি দিয়ে অপমানের শোধ নিতে চাচ্ছে। তবুও যদি জেদের বসে ফাঁস নিয়েই ফেলে, তখন? হাসানের হাত পা অবশ হয়ে আসে, মন চায় এডি ও তার বউকে ডাক দিতে কিন্তু সাহস পায় না। স্ত্রী ফাঁস নিতে চায়- একথা তাদেরকে কিভাবে বলবে।
এদিকে সেই কুৎসিত অভিনয় চলতেই থাকে চলতেই থাকে। সে ওপাশে চলে যায় দরজা লাগাতে চায়, প্রচন্ড শব্দ হয়, টেনে ধরে খুলে নিয়ে আসে। আবার চলে যায়, দরজায় শব্দ হয়, ভয় হয় ওরা উঠে আবার গালাগালি শুরু করে কিনা। সম্ভবত সেই রাত্রে দরজার শব্দ আজো তাদের মনে থাকার কথা। রাত আড়াইটা বাজে, অবশেষে সেও ক্লান্ত হয়ে এসেছে। হঠাৎ স্ত্রীকে জাবরে ধরে শুন্যে তুলে বিছানায় ফেলে চেপে ধরল। এবার আদর আর শান্তনা একসাথে চলল। বলল- দেখ, ফেল করা দোষের কিছু নয় বরং ক্ষেত্র বিশেষে এটা গর্বের বিষয়, সবাই ফেল করতে পারে না। এটা ভাগ্যের ব্যাপার, ভাগ্যবানরাই ফেল করতে জানে। তুমি কি জান না যে, নজরুল, রবীন্দ্র, টলস্টয়, গোর্কি এরা সব ফেল মারা ছাত্র ছিলেন। আর নিউটন ও আইনস্টাইন তো ছাত্রের জাতই ছিল না। বড় কথা হল রাসূল (সাঃ) তো এক্কেবারে নিরক্ষর ছিলেন, পড়তেও জানতেন না, লিখতেও জানতেন না। তাহলে একটু আধটু ফেলের জন্য তুমি এমন হার্মাদ করছ কেন। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল।
বিষয়: সাহিত্য
১৩১৬ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমিও ভাবি এটা কিভাবে সম্বব নাকি অন্য কিছু..লিখছেন সত্য ঘটনা . তা হলে অন্য চিন্তাকরি কি করে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন