চিঠি- ২৮ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২৪ আগস্ট, ২০১৬, ১১:৪৩:৪৬ সকাল
ফেরদৌসির তৃতীয় দুলা ভাইয়ের নাম বজলু। ফর্সা, লম্বা, মিডিয়ম স্বাস্থ্য, চোখ কটার মত, রাগে তাকালে চিতার চোখের মত জ্বলে উঠে। সে ম্যাট্রিক ফেল মেরে কিছু দিন মাস্তানি ও বাউন্ডুলেপনা করে, তারপর তাবলীগে যোগ দেয়। ওদিকে ফেরদৌসির বাবা ছিলেন একজন দরিদ্র স্কুল মাস্টার। সম্পদ বলতে এক থেকে দেড় একর জমি, তার ছিল আটটি মেয়ে। আর এমন পরিবারে সাধারণত ধনী ও উচ্চ শিক্ষিত ছেলেরা আসে না। সঙ্গত কারণে ইঞ্জিনিয়ার তাবলিগি ছেলে দেখে তার তৃতীয় শ্যালিকার বিয়ে দেয়। বিয়ের কিছুদিন পর সে মধ্য প্রাচ্যের কোন দেশে চলে যায়। পর্যাপ্ত পরিমান টাকা রোজগার করে দেশে পাঠায়। স্ত্রী দু’হাতে টাকা ভাঙ্গে আর বোনদের পিছনে ব্যয় করে। প্রথম সন্তান হওয়ার পর দেশে আসল। কিন্তু ছেলে বাবা চিনে না, কোলে যায় না। তা দেখে বউ অনেক কান্নাকাটি করল, স্বামীকে আর বিদেশ যেতে দিল না, ব্যবসা করার পরামর্শ দিল। কিন্তু টাকা কোথায় পাবে, যা রোজগার করেছিল তা ধুম-ধাম করে শেষ। অবশেষে পৈত্রিক যৎকিঞ্চিত পেয়েছিল তা বেঁচে দুইটা কম্পিউটার কিনে টাইপের দোকান দিল। এটাই তার জীবিকার উৎস।
বস্তুত যে কোন ফকির মিসকিনেরও বাড়িতে অন্তত পা রাখার স্থানটুকু থাকে কিন্তু তাদের প্রথম ছয় জামাইয়ের বাড়িতে পা রাখার স্থানটুকুও ছিল না। কেউ কেউ পৈত্রিক যেটুকু পেয়েছে বেঁচে শেষ করে দিয়েছে, আবার ইঞ্জিনিয়ার ও এডি বাড়ি ঘর বিক্রি করে শহরে বাসা করেছে। মানুষের প্রাকৃতিক স্বভাব হল পৈত্রিক সম্পত্তি কেউ নষ্ট করতে চায় না। তাছাড়া শেষ বয়সের জন্য বা সন্তানের জন্য কিছু জমায়। কিন্তু এরা ছিল বাস্তবতার উল্টো। কারণ এদের সবগুলি বোন ছিল ভয়ানক ধরনের অপব্যয়ী ও বেহিসেবি। আর তারাই ছিল স্বামীর সংসারের কর্তা। ফলে এরা স্বামীর পৈত্রিক যেটুকু পেত তা বিক্রি করে স্বামীর পরিবারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে দিত। এ জন্যই এদের কারো কারো কিছুই ছিল না, আর কারো কারো শহরে একটি বাসাই ছিল সম্বল। কিন্তু হাসানের বাড়িতে জমি ছিল বলে স্ত্রী তাকে নাতু ধনী বলে তিরস্কার করত এবং জমি বিক্রি করার জন্য ঝগড়া করত।
ফেরদৌসী বজলু সম্পর্কে বলত, সে মেট্টিক ফেল, ছোট সময় খুব দুষ্ট ছিল, গাছ থেকে পরে ঘাড় ভেঙ্গে গিয়েছিল। তারপর সন্ত্রাসী ও মাস্তানি করত। সেই নাকি মাস্তানি করে লাঠি সোটা নিয়ে গিয়ে জামালপুরের কোন ডিজিকে তাড়িয়ে ছিল। এরপর বিয়ে করে বিদেশ চলে যায় কিন্তু বিদেশ থেকে এলে বাচ্চা বাপ চিনে না কোলে যায় না। তখন তার বউ খুব কান্না করে আর বিদেশ যেতে দেয় নি। তারপর একটা কম্পিউটারের দোকান দিয়ে টুকটাক কাজ করে কষ্টে জীবন কাটাচ্ছে। হাসান কৌতুক করে বলে এ লোকটার মধ্যে এমন এক বিরল প্রতিভা দেখেছি যা খুব কম মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। এ প্রতিভাটা কাজে লাগালেই সে হঠাৎ বড় লোক হয়ে যেতে পারে আর কষ্ট করতে হবে না। স্ত্রী উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাল। হাসান হাসি চেপে বলল, তুমি তার চোখ দেখেছ কেমন কটার মত। সে যদি রাগে চোখ বড় বড় করে কারো প্রতি তাকায় তাহলে তার চোখ চিতার চোখের মত জ্বলে উঠে। যে কেউ দেখে হাগু মুতো করে দেবে। কাজেই তুমি গিয়ে তাকে পরামর্শ দিয়ে আস- তার দোকানটাকে একটা চেম্বার বানিয়ে কিছু ছেলে ছোকরা রাখুক। তারপর বিত্তশালীদের কাছে চিঠি পাঠিয়ে ঘোষণা দেবে, বাবা বজল শাহের দরবারে সময় মত টাকাটা পৌঁছে দিয়েন। কেউ গড়িমসি করলে সে নিজে গিয়ে- কি মিয়াঁ টাকাটা তো পেলাম না- বলে কটা চক্ষে একটু তাকাবে। ব্যাস কোন বুলেট বোমার দরকার পরবে না, ফের ফের করে আলমারি খুলে টাকা দিয়ে দেবে। আর এভাবে সে কয়েকদিনেই বড় লোক হয়ে যেতে পারে।
সে অগ্নি দৃষ্টি হেনে বলল, গোন্ডা ছোদা, মাইনসেরে কইতে খুব মজা লাগে, না? আপনেরা না ছয় ভাই, ডাকাতি করলেই তো পারেন। হাসান বলল, না আমাদের তো আর খাওয়া পরার জন্য কষ্ট করতে হয় না। যারা কষ্টে আছে তাদের তো একটা কিছু করা দরকার। ব্যস হাসতে হাসতেই ঝগড়া বেধে যায়।
তার তৃতীয় বোন সম্পর্কে বলত- অপব্যয়ী, দু’জন মানুষের সংসারে মাসে দশ কেজি তেল লাগে। সব কিছু ডোবা তেলে ভাজে। বাচ্চা দুইটাকে কয়েক জায়গায় ভর্তি করেছে, কয়েকটা টিউশনি। এভাবে আজে বাজে পয়সা নষ্ট করে। দোকানে যা কামায় তাই উড়ায়। সে বলল, এভাবে টাকা নষ্ট করে কেন, তাদের তো অন্য কোন সম্পদ নাই যে, বিপদে আপদে টান দিতে পারবে। দুর্দিনের জন্য তো অন্তত কিছু টাকা জমানো দরকার। তুমি কিছু বল না? সে কৈফিয়ত তলবের দৃষ্টিতে বলে- কেন, আপনের এত মাথা ব্যাথা কেন? আপনে তাদেরকে কয়টা টাকা দেন, এত গপ্প মারেন বাড়িতে এই আছে, সেই আছে, তাহলে কোন দিন কোন জিনিসটা এনে দিছেন। হাসান বলল- তাদেরকে দিতে হবে এটা আমার জানাও নাই কর্তব্যও নয়। এবার সে মাথা ঝাকিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বলে- কর্তব্য নয়, তারা আত্মীয় নয়? আত্নীয়কে বিপদে- আপদে দেখতে হয় জানেন না? ব্যস কথার মার প্যাচে এ মুখরা মেয়ে এমন যুক্তি দেয়া শুরু করল যে, সে মিইয়্যে গেল। নিজেকে অপরাধী মনে হল, মনে হচ্ছিল তাদেরকে সাহায্য না করে সে হারাম কাজ করে চলেছে।
আবার বলত এ মহিলাকে নাকি ইঞ্জিনিয়ার বিয়ে দিয়েছিল। অশিক্ষিত দরিদ্রের কাছে বিয়ে দেয়ার কারণে সে ইঞ্জিনিয়ারকে বলত, আমি আপনের মাথায় বসে বসে খামু, আমাকে গরিবের কাছে বিয়ে দিলেন কেন? তারপর হাসান বলত- দেখছ, এ মহিলা অশিক্ষিত দরিদ্র জামাইকে ফেলে চলে যেতে কয় না, আর তুমি এত কিছু পেয়েও চলে যাওয়ার জন্য লেজ খাড়া করে রাখ। সে বলত- বজলু দুলা ভাই আপনের চেয়ে অনেক ভাল আছে। কিভাবে ভাল? ব্যস শুরু হত ঝগড়া।
বজলুর বাবা প্যারালাইজড হয়ে বহুদিন বিছানায় পরেছিল। তখন শ্বশুরের খেদমতের জন্য এই মহিলাকে নেয়া হল। সে দু’দিন থেকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল- শ্বশুর- শ্বাশুরির খেদমত করতে হবে এমন কথা হাদীস- কোরানে আছে নাকি- বলে বাপের বাড়িতে চলে গেল। এ ছিল এদের ধার্মিকতার নমুনা।
তাদের চতুর্থ দুলা ভাই ছিল মওদুদ ওরফে এডি অর্থাৎ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এসিস্টান্ড ডিরেক্টর। । লোকটা মধ্যাকৃতি ও ফর্সা। হাড় মোটার কারণে স্বাস্থ্যবান দেখায়, আসলে সে ছিল চির রোগা। কথা বলে মিনমিনিয়ে অস্পষ্ট, কথা বুঝতে কয়েক বার জিগাতে হয়। নিজেকে জ্বিনের রোগী মনে করে কিছু দিন পর পর বালিয়াপাড়ার পীর সাবের ওখানে গিয়ে কিছু বেতের বাড়ি খেয়ে আসত, কয়েকদিন ভাল চলত। লোকটা ছিল সহজ সরল সাদা মনের মানুষ। কোন অহংকার ছিল না, মানুষের উপকার করত। নিতান্ত দরিদ্রের সন্তান, কওমী মাদরাসায় কিছু লেখা পড়া করে আলিয়াতে চলে যায়। কামিল করে ডিগ্রি পরীক্ষা দিয়ে নিজের এলাকার কৃতি সন্তান ময়মনসিংহ, গফরগাঁও- এর মাওলানা মুহিউদ্দিন খানকে ধরে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে ঢুকে যায়। পদোন্নতি পেতে পেতে ডি ডি পর্যন্ত হয়ে যায়। হাসান ও এডি এ দুজনই ছিল মাদরাসা পড়ুয়া, আলেম। তারা ইসলাম বুঝত এবং সঠিক ইসলামের অনুসরণ করত। তারা দু’জন বসে বসে তাবলীগের ইসলাম বিকৃতি ও জিহাদের বিধানগুলি গাশতের কাজে লাগানোর সমালোচনা করত আর হাসত।। এজন্য উভয়েই বউয়ের বাঁশ খেত এবং অন্য বোনেরাও ধমক দিত। এ দু’জন আলেম ছিল বিধায় তারা ফাড়া পাঞ্জাবি পরত, পাঁচ কলি টুপি পরত না। এ জন্যও বউ ও শালী জ্যাঠাশদের বাঁশ খেতে হত। কারণ বাকী জামাইরা ছিল কট্বর তাবলীগী, গোল পাঞ্জাবি ও পাঁচ কলি পরত। এডি বলত- সে দরিদ্র পরিবারে বিয়ে করেছে একমাত্র সুন্দরী মেয়ে দেখে। আর তার নাম বেচেই পরবর্তি মেয়েদের ভাল বিয়ে হয়েছে।
তাদের জামাইদের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ার ও এডি- এ দুজনই বড় চাকরি করত এবং ফেরদৌসীদের পরিবার এ দুজনের পরিবার কেন্দ্রিক আবর্তিত হত। জামাইদের মধ্যে মানুষ হিসাবে সেই ছিল শ্রেষ্ঠ। সে ছিল আলেম, এজন্য সম্ভবত তার মধ্যে মানবতা বোধ ছিল। কিন্তু সমস্যা একটাই ছিল স্ত্রী ও শ্বশুর পরিবারের দাসত্ব। শ্বশুর পরিবার ইঞ্জিনিয়ারের চেয়ে এডি থেকে বেশি উপকৃত হত কিন্তু তাকে মানত না। কারণ ইঞ্জিনিয়ার ছিল দাম্ভিক, রুক্ষস্বভাব, কর্তৃত্ব পরায়ন, অন্যদের পদানত করে রাখত। আর তাদের বোনদের স্বভাবও এ জাতীয় ছিল বিধায় তাকে পসন্দ করত। কিন্তু এডি ছিল সহজ সরল, এ জন্য তারা তাকে মানুষ হিসাবেই গণ্য করত না। আর ফেরদৌসি তাকে পাতলা ভারসাম্যহীন বলে অবমূল্যায়ন করত। আর এ নিয়ে বউয়ের সাথে তার অনেক ঝগড়া হত। এডির বউও ছিল সহজ সরল একজন ভাল মানুষ।
তাদের পঞ্চম জামাইয়ের নাম জহির, বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলপুরে। বি এ পাশ, এডির অধিনে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে চাকরি করত। এডির কৌশলে বিয়ে হয়ে গেলেও দরিদ্র পরিবার বলে জহিরের পসন্দ ছিল না, স্বামী- স্ত্রীর বনি বনা কম ছিল। এ জন্য ফেরদৌসি কথায় কথায় বলত ময়মনসিংহের মানুষ ভালা না, ফুলপুরের মানুষ ভালা না, এটা ছিল তার কমন গালি। আবার তার বউও ছিল আবুল আবুল, অন্যান্য বোনের মত স্বামী শিকারি ছিল না। জহির ছিল এমনই সুন্দর যে, শালিরা তাকে লিপিস্টিক ডাকত। একবার ছোট চার বোন ছিল বাপের বাড়িতে। জহির তখন পাবনায় চাকরি করে। বউয়ের সাথে সাক্ষাতের জন্য আসলে বউ হালকা সাঁজ গুজ করল। তা দেখে ছোট বোনেরা ঠাট্টা শুরু করল। একজন বলল- দেখলে জামাই দেখেই কেমন পরী সেজে গেছে। আরেকজন বলল- কিন্তু লিপিস্টিক তো দেয়নি। অন্যজন বলল- সে লিপিস্টিক দিবে কেন, তার তো লিপিস্টিক আছেই। এর দ্বারা তারা জহিরের সৌন্দর্যকে বুঝিয়েছে অথবা অন্য কোন স্টিকের দিকে ইঙ্গিত করেছে।
তাদের ষষ্ঠ জামাইয়ের বাড়ি বরিশাল। দরিদ্র অশিক্ষিত পরিবারের সন্তান, সে আগে মাদরাসায় লেখা পড়া করে স্থানিয় কলেজে অনার্স করেই অর্থাভাবে একটি কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে জামালপুর আসে। লোকটা কালো, বেটে, অসম্ভব মোটা। মুখে নিষ্ঠুরতা ও কাঠিন্যের ছাপ, বুঝা যায় অতিরিক্ত কাঠিন্যতার কারণে দাড়ি গোফ গজাতে পারেনি, দু’চার গাছ দাড়ি ঝুলছে। তার কণ্ঠস্বর ছিল হিজড়াদের মত ফ্যাস- ফ্যাসে, অনেকটা যেন নাটক- সিনেমার ভৌতিক নারী কণ্ঠের ন্যায়। বুকের পাটা জাহাজের পাটাতনের মত চওড়া, কোন পশম নেই, এ জাতীয় মানুষকে গ্রামাঞ্চলে শিমার (হযরত হুসাইন হত্যাকারি) বলা হয়, এটা নাকি নিষ্ঠুরতার আলামত। দেখেই বুঝা যায়, এ লোকটা সন্ত্রাসী, মাস্তানি বা দুঃসাহসিক কাজে ভাল জস করতে পারত। সে নিজের নামের সাথে তালুকদার লিখে। এ জন্য তাবলিগিরা তাকে তালুকদার বলে ডাকত। কিন্তু অন্যরা পটেটো ডাকত, সম্ভবত লম্বায়- চৌড়ায় সমান হওয়ার কারণে এ উপাধি পেয়েছিল। সব মিলিয়ে লোকটার আকৃতি যেমন ছিল কুৎসিত তার চেয়েও ভয়ঙ্কর কুৎসিত ছিল তার স্বভাব প্রকৃতি। কিন্তু তার ভাগ্যের বৃহস্পতি ছিল তুঙ্গে। তার ভাগ্যে জুটেছিল এমন স্ত্রী- যে ছিল নারী সৌন্দর্যের মুর্ত প্রতিক, মর্তের মাটিতে বেহেশতের হুর। এ মেয়ের নাম নুরানি, বাস্তবেও ছিল নুরের মত উজ্বল। ফেরদৌসিদের পুরা খান্দানের মধ্যে দৈহিক সৌন্দর্য্য, কথা- বার্তা, আছার আচরন সর্বদিক দিয়ে সে ছিল অন্যন্য। একটি দেশ, একটি শতাব্দি এমন মেয়ে খুব কমই জন্মায়। আল্লাহ এ মেয়েটিকে মর্তের মাটিতে পাঠিয়েছেন পৃথিবীর মানুষ যেন বেহেশতি হুর সম্পর্কে আন্দাজ নিতে পারে। তার কণ্ঠে ছিল এমনই মাদকতা যে, কারো যদি তিন জগ পানির তেষ্টা লাগে এ মেয়ের মুখের তিনটা কথা শুনলেই চিরতরে তেষ্টা মিটে যাবে। এমন নারী পৃথিবীর যে কোন রাজা মহারাজার কাম্য।
সঙ্গত কারনেই তাদের আপন ইঞ্জিনিয়ার চাচাত ভাই এ মেয়ের পাণি প্রার্থি হ্য়, কিন্তু তাবলীগ না করার কারণে বড় দুলা ভাই বিয়ে দেয়নি। বেচারা অসহায় হয়ে এসে ধরল এডিকে। এডি খুব চেষ্টা করল, অবশেষে অপারগ হয়ে বরিশালি পটেটোকে বলল, মেয়ের তো চাচাত ভাইয়ের সাথে প্রেম, আপনি পিছিয়ে যান। কিন্তু পটেটো মেয়ের রূপ দেখে পাগল হয়ে গেল। সে বড় দুলা ভাই ইঞ্জিনিয়ারকে তেল মবিল মেরে বিয়ে করেই ছাড়ল। বিয়ের পর নুরানি বাড়িতে গেল। তাদের ও পাণি প্রার্থি চাচাত ভাইয়ের ঘর ছিল পাশা পাশি, একই উঠান। নব বধু আনা গুনা করছে, তার রুপের সুধা পান করার জন্য পাণি প্রার্থি চাচাত ভাই ঘরের দরজায় এসে বসল। দৃষ্টি বিনিময় হয়, চাওয়া চাওয়ি হয়, উর্বশি যৌবনা অপ্সরী। হঠাৎ একবার চার চোখের মিলন হতেই উভয়েই হেসে উঠল। আর তখন একজন ব্যর্থ প্রেমিকের কলিজায় যে কৃঞ্চ গহ্ববের সৃষ্টি হল তা সেই মেয়েটিও জানল না আর কোন নারী অনুভবও করল না যে, মৃত্যুর আগে সেই গহ্বর ভরাট হবার নয়। আর ফেরদৌসীদের পরিবার এমন কৃত্রিম ধার্মিক যে, যেখানে পর্দা করার প্রয়োজন সেখানে করে না, যেখানে প্রয়োজন নাই সেখানে করে।
আর পটেটো অভাবিত পুর্ব স্ত্রী পেয়ে আত্মহারা হয়ে গেল। কৃতজ্ঞতায় সে স্ত্রীর পরিবার ও ইঞ্জিনিয়ারের কৃতদাস হয়ে গেল। আবার মেধাগত দিক থেকেও পটেটোর চেয়ে তার স্ত্রী ছিল উর্ধ্বে। কারণ এ মেয়েকে লেখা পড়া করালে মেডিকেলে যেতে পারত। এ জন্যই পটেটো পরবর্তিতে মাস্টার্সটা করে নেয়। এই পটেটোর ভাইয়ের জন্য ফেরদৌসির বিয়ের আলাপ হয়েছিল। আর এখানেই সকল বিপত্তি নিহিত ছিল।
চাচাত ভাইয়ের বিয়ের ওকালতি করার জন্য ফেরদৌসী সর্বদা এডির বদনাম করত। সে প্রতিবাদ করলেই ঝগড়া বেধে যেত। তখন হয়ত হাসান ঠাট্টা করে বলত, এত ভাল মেয়েটাকে সেই সুদূর বরিশাল পাঠিয়ে দিয়েছে। তখন সে তিক্ষ্ম দৃষ্টিতে বলে, কেন তার দিকে আপনের লোভ আছে নাকি? - নাউযুবিল্লাহ, সে বলত- আরে কমিন- কমজাত যাকে নিজের বোন মনে করি তার সম্পর্কে এমন বাজে কথা বলতে তোর মুখে বাধে না। তখন ঝগড়া শুরু হয়ে যেত। ফেরদৌসী তার এ দুলা ভাইকে নিয়ে অনেক গর্ব করত আর বলত তারা তালুকদার, অবশ্য আসল তালুকদার নয়, তালুকদারের জমি কিনেছিল। এখন অবশ্য বাড়িটা ছাড়া আর কিছুই নাই। তারপর হাসানের দিকে তাকিয়ে, গর্বিত দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করত তারা তালুকদার কিনা। সে বলত আরে না, আমরা হলাম কৃষক শ্রমিক ও মুটে মজুর জাতীয় একটা কিছু। অবশ্য কাগুজে বাঘ নয় আসল বাঘ। - মানে। তারপর মানে নিয়েই শুরু হত ঝগড়া।
কখনো বা বলত তার এই দুলা ভাইয়ের এক ভাই অনেক বড় রাজনীতিবিদ। সর্বহারা করত, বহুবার জেলে গেছে, দুলা ভাইও কয়েকবার জেল খেটেছে। তারপর হাসানের দিকে তাকাত, ভঙ্গিমায় বুঝা যেত জেল খাটাটা গর্বের বিষয়। আসলে তাদের মন্দ বিষয়টাকেও উত্তম প্রতিপন্ন করে স্বামী ও তার পরিবারের উপর প্রয়োগ করত তাদেরকে হেয় ও পদানত করার জন্য। তখন সে বলত- আরে কি যে বল না, আমাদের এত যোগ্যতা কোথায় যে, কোন নিষিদ্ধ দল বা ইসলাম বিরোধি কর্ম কান্ডে যুক্ত হয়ে জেলে যাব। এসব সম্মান তোমাদেরকেই মানায়। - আমাদেরকে মানে? - মানে হল তোমার কথায় বুঝা যাচ্ছে, সর্বহারা করা, জেল খাটা খুব গর্বের। কাজেই তোমার বাপ ভাইও তো বোধহয় তাই করত। আর যায় কোথা বাবা। হাসানের উপর দিয়ে কাল বৈশাখীর তান্ডব বয়ে যেত।
তাদের সপ্তম জামাই ছিল, পৃথিবীর সেই সব মানুষদের একজন যারা সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মায়, এরা পৃথিবীকে কিছু দেয় না। দিতে পারে না। দেয়ার যোগ্যতাও নাই। কিন্তু পৃথিবী থেকে নিতে পারে। মুঠি মুঠি আজলা ভরে নেয়ার যোগ্যতা রাখে। এ ব্যক্তি কারো উপকারও করত না, অপকারও করত না, সোজা বাঙালির মত থাকত, সবাই তাকে আদর করত, সে মাঝে মধ্যে জামালপুর আসত, সবার থেকে একটু একটু করে আদর নিয়ে আবার চলে যেত। তার বউটাও সহজ সরল, মিয়াঁ বিবি মিলে দু’দিন পর পর চিল্লায় যেত।
ফেরদৌসী তার এই দুলা ভাইয়ের বাবা সম্পর্কে বলত, তিনি আগে গান বাজনা করতেন, নাটক ফাটক করতেন। তিনি কবরির সাথে অনেক নাটক করেছেন। তারপর বিজয়ির হাসি দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে গর্বসহকারে বলত, আপনার বাপ কি করত? হাসানের মনটা তখন বারুদের মুখে পেট্টোলের মত জ্বলে যেত। মন চাইত মুখের উপর লাথি মারতে। কিন্তু ধৈর্য্য ধরে শ্লেষের সুরে বলত, আরে দুঃ, কার সাথে কার তুলনা। আমার বাবা ছিলেন একজন বোকা মানুষ। কোথায় না তিনি আই এ, বি এ পাস করে শাবানা কবরির সাথে জুটি বাধবেন, সিনেমা করবেন। তখন আর আমার বাপের সামনে রাজ্জাকের পাত্তাই থাকত না। আব্বার চেহারা দেখেছ, ভিসায় ফটোতে দেখে নিও, খাড়া নাক, সুদর্শন ছিলেন। আবার তার সুর ছিল মোহন বাঁশি, আজো তার সুরের নাম আছে। তিনি গান করলেও তো আঃ আলিম, জব্বার এদের পাত্তা থাকত না। তিনি নায়ক বা শিল্পি হলে পুত্রবধু হিসাবে আজ তোমার জীবনটা ধন্য হত, তুমি গর্ব করতে পারতে।
কিন্তু তা না করে বোকার মত তিনি চলে গেলেন দেওবন্দ। সেখানে দাওরা (মাস্টার্স) করার পর ইফতা বা মুফতি (ইসলামী আইন শাস্ত্র) পরার জন্য ভর্তি হলেন। তখন সকল ছাত্রকে এ সুযোগ দেয়া হত না, এডমিশন টেস্টের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে তিন জন ছাত্র এ সুযোগ পেত। ইফতা শেষ করে বৃত্তি নিয়ে উম্মুল কুরা- মক্কা ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য যখন তিনি তৈরি হচ্ছিলেন, তখন বাড়ি থেকে পত্র গেল- তুমি যদি তোমার বড় ভাইকে দেখতে চাও তাহলে দেরি না করে শীঘ্র আস। তার অবস্থা আশংখা জনক। বড় ভাইকে দেখার জন্য তিনি চলে এলেন এ নিয়ত নিয়ে যে, এখান থেকে মক্কা চলে যাবেন। কিন্তু দেশে আসার পর আর সে সুযোগ হল না, তার উস্তাদরা নিয়ে তাদের মাদরাসায় রেখে দিলেন। কাজেই আমার বাবার মত বোকা মানুষের তুলনা খোজ কেন? আর এ মেয়েটা এমনই মুর্খ ছিল যে, সে মনে করত হাসান আসলেই তার বাবাকে তিরস্কার করছে। আর এজন্য সে খুশি হত।
কখনো সে গর্বসহকারে বলত, আগে তার বাবা কৃষিকাজ করাত, ধান পেত। একদিন তার সপ্তম বোন ধান সেদ্ধ করছে, তখন তার শাশুড়ি বলল, তোমরা তো কোন দিন ধান সেদ্ধ করনি, না? অর্থাৎ শাশুড়ি মনে করেছেন তারা এতই গরীব যে, ধান পায় না। তখন তার বোন বলল, না আমরা তো আগে ধান পেতাম, সিদ্ধও করতাম। তখন হাসান বলল, দেখ তোমার বোন ধান সিদ্ধ করে কিন্তু আমার মা তোমাকে ধান সিদ্ধের কথা বললে তুমি কি করতে? কেন, ধান সেদ্ধ করব কেন, আমি কাজের মেয়ে নাকি। ব্যস শুরু হত ঝগড়া।
এ পরিবারের অষ্টম রত্ন হল ফেরদৌসী মহারত্ন। বরিশালি পটেটোর ভাইয়ের জন্য এ রত্নটির বিয়ের আলাপ হয়েছিল। কিন্তু অর্ধ শিক্ষিত দরিদ্র পরিবার দেখে বিয়ে দেয়নি। এ অবস্থায় ফেরদৌসী তার বোনের সাথে কয়েকবার তাদের বাড়িতে বেড়াতে গেছে। আর সেখানেই ঐ ছেলের সাথে তার সম্পর্ক গড়ে উঠে, তবে ধর্মীয় পরিবার ও কঠোর পর্দার কারণে বিষয়টি প্রকাশ পায়নি। কিন্তু ইচ্ছা- অনিচ্ছায় হাসানের সাথে বিয়ের পর থেকে ধীরে ধীরে প্রতিক্রিয়া শুরু হতে থাকে। হাসান তাদের ধর্ম- কর্ম দেখে কোন দিন ভাবতেও পারেনি যে, সে শুধু স্ত্রীর দেহ নিয়েই বাস করছে আর তার মন পরে আছে সুদূর বরিশালের মাটিতে।
হাসান মনে করত- এ রত্নটি আল্লাহ্ তা’লা চুলার পোড়ামাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। তারপর তার বাবাকে উঠিয়ে নিয়ে পৃথিবীর তাপদাহে পুড়িয়ে পুড়িয়ে তাকে উত্তীর্ণ করে বলেন, এবার যাও, জামালপুরে যাও। সেখানে তোমার জন্য একটি অগ্নিগোলা তৈরি করে রেখেছি- যার দহন সহ্য করার ক্ষমতা অন্য কারো নাই। এর জন্যই আমি তোকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে উপযোগী করে গড়ে তুলেছি। এখন যাও, ওর দহন সহ্য কর, পরকালে তোকে এর বিমিময় দিব।
নিজের উপর স্ত্রীর অত্যাচার দেখে আর স্ত্রীর উপর নিজের ধৈর্য্য দেখে হাসান মাঝে মধ্যে আপন মনে ভাবত আর হাসত। কারণ বাস্তবে দেখা যায় এ জাতীয় মেয়েদের আল্লাহ্ শাস্তি দেন, দুয়েকটা বাচ্চা রেখে স্বামী মারা যায়। তখন এদের দুঃখ দুর্দশা ও ভোগান্তির চূড়ান্ত হয়। তারও এমনটাই মনে হত। কারণ যেহেতু সে তাকে তালাক দিবে না, কাজেই তার শাস্তির এ একটা পথই হতে পারে। মানুষ সাধারণত স্ত্রীর উপর নির্যাতন করে বাপের বাড়ি থেকে যৌতুক আন, এটা আন, সেটা আন অথবা সাংসারিক কাজ- কর্মের জন্য নির্যাতন করে, নেশা করে, মারে। অথচ বিপরীত ক্রমে শাশুড়ির যে কোন সহায়তার জন্য তার মানসিক প্রস্তুতি ছিল। আবার রান্না ছাড়া বাসার যাবতীয় কাজ ও মেয়েকে রাখার কাজ সে করত। এতদসত্ত্বেও তার স্ত্রী অষ্ট প্রহর শুধু ঝগড়াই করত।
তার মূলনীতি ছিল তার অধীনস্থদের ব্যাপারে সর্বাত্মক ধৈর্য্য ধারণ করা, সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা দেয়া, তাদের সুখ শান্তির জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করা। সে নিজে কষ্ট করে ভাইদের সকল প্রকার আরামের ব্যবস্থা করেছে। একই কারণে স্ত্রীকে সে সর্বোচ্চ সুখ শান্তিতে রাখতে চাইত। এজন্যই তাকে কোন দিন ধমক দিত না, যা বলার বুঝিয়ে বলত, নরম সুরে বলত। স্ত্রীর কোন কথা, কাজে বা তার স্বভাবগত ঝগড়া ঝাটির কারণে অধিকাংশ সময় অপারগ হয়ে শান্তির জন্য তার কাছে মাফ চাইত, মাঝে মধ্যে পায়েও ধরত। কখনো স্ত্রীর পা মেজ মেজ করত, তখন পা টিপে দিত। যদিও তার স্ত্রী ভয়ানক অন্যায়ের জন্যও কোন দিন তার কাছে মাফও চায়নি, পায়েও ধরেনি বা পা টিপেও দেয়নি। তার চিন্তা ছিল, আমার স্ত্রী তো আমারই, আমার দেহের অংশ। কাজেই পা টিপলে জাত যাবে কেন? শুধু মানুষে না শুনলেই হল।
বিষয়: সাহিত্য
১৮৫৪ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কি ভাই তাইতো বলি ..এত তারিখ কিন্তু ভাল না। নজর ঠিক ।/
মন্তব্য করতে লগইন করুন