চিঠি- ২৪ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১৭ আগস্ট, ২০১৬, ১০:৫৬:১৬ সকাল

২৪

হাসান বাড়িতে পা দিয়েই বুঝতে পারল কিছুদিন ধরে এখানে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। তাকে দেখেই মা বললেন, বউ কই, বউকে নিয়ে এলে না কেন? সিদ্ধান্তের সুরে বললেন, এখন থেকে বউ বাড়িতে থাকবে। তার দ্বিতীয় ভাইটা ছিল উগ্র প্রকৃতির- সে বলল, এই রুপবানুর আর টাউনে থাকতে হবে না, বাড়িতে থেকে কিছু দিন ধান বনের (খড়) কাজ করলেই তেজ কমে যাবে। নিভৃতে মা জিজ্ঞেস করলেন বউ কি করে রে, মোবারক যেভাবে বলল আমি তো খুব চিন্তায় আছি। হাসান জিজ্ঞেস করল, কি বলল? মা বললেন, কইল চব্বিশ ঘন্টা তোর সাথে ঝগড়া করে, মানে না, কথায় কথায় ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। বউকে তাড়াতাড়ি বাড়িতে নিয়ে আসতে, নইলে নাকি তোকে মেরে ফেলবে। আর বলার সময় ছেলেটাকে খুব ভিতগ্রস্থ দেখা গেছে, মনে হয়েছে ভয়ে তার গলা মুখ শুকিয়ে গেছে। তখন থেকেই আমি চিন্তা করছি। হাসান বলল, না চিন্তার কিছু নেই। সে থাকার সময় বেশি ঝগড়া করেছে, অন্য সময় এমন করে না। আমাকে মানেও, ভয়ও পায় ইত্যাদি উল্টা পাল্টা বুঝিয়ে মাকে শান্ত করল। কিন্তু মনে মনে বলল, আমার ভাঙ্গা কপাল আপনি জোড়া লাগাবেন কেমনে।

হাসান মোবারককে ডেকে এনে মায়ের সামনে জিজ্ঞেস করল- আচ্ছা তুই অন্য কোন কথা না বলে ধুম করে বিয়ের কথা বললি কেন? সে বলল, এ ধরনের মেয়েদের এভাবেই শায়েস্তা করতে হয়। হাসান বলল- আরে বোকা, একটার জ্বালা থেকে বাঁচার জন্য আরেক বিয়ে করা মানে কড়াই থেকে চুলায় লাফিয়ে পরা। দুই বিয়া যারা করে এদের পরিনতি জানিস না? সে বলল- জানি ত, কিন্তু তুমি তো কোনটাই পার না। আমার পাল্লায় পরলে দেখতা গরুর মত পিটাইয়া কবেই সাইজ কইর‍্যা ফালাইতাম। মা বললেন, মেয়েদের বাকা স্বভাব কোনদিন ঠিক করা যায় না, ধৈর্য ধরতে হয়। সাবধান, কোনদিন বিয়ের চিন্তা করবি না, জীবনটা শেষ হয়ে যাবে।

কয়েকদিন থাকার পর হাসান বাসায় এসে বউকে কল করল- টাকা তো তোমার কাছে আছেই, আম্মাকে নিয়ে এসে পর। কিন্তু না, সে আসবে না, তাকে গিয়ে আনতে হবে। আবার সেই পশ্চিম মুল্লুকে হাজারিপাড়া গিয়ে তাকে নিয়ে আসল। এ তারিখে বাসায় এসে তার পাগলামি ও অকর্মন্যতা ক্রমে ক্রমে আরো বারতে লাগল। প্রতিদিন, প্রায় প্রতি বেলায় রান্নার সময় ভাত তরকারী পোড়ে ফেলত। রান্না বসিয়ে হয়ত সে অন্য কোন কাজ করছে বা শুয়ে আছে বা বসে আছে বা মেয়েকে নিয়ে খেলছে ওদিকে রান্নার কথা তার কোন হুস থাকত না। প্রায় সব সময় হাসান তারা দিয়ে বলত এতক্ষণ হল গিয়ে দেখ, পোড়ে যাবে তো। কিন্তু সে পড়া-লেখায় বা অন্য কিছুতে মনোযোগি থাকলে বা খেয়াল না থাকলে পোড়া গন্ধ পেয়ে সে নিজেই দৌড়ে যেত। তবে অনেক সময় বাতাস প্রতিকুলে থাকালে গন্ধও পাওয়া যেত না। তখন বাসার মালিক সংলগ্ন বাসা থেকে দৌড়ে এসে ডেকে বলত ভাত বা তরকারি পুড়া গন্ধ আসছে। এভাবে এমন কোন দিন বাদ যেত না যে দুয়েক বার করে ভাত বা তরকারি পোড়ত না।

ঘুম আগের মতই চলল, দুপুরে ও সন্ধার পর নাক ডাকিয়ে ঘুমাত। ডেকে তুললে এক ঘণ্টা পর্যন্ত কাঁদত আর বলত- আমার বাপে আমারে কত আদর করত। এর দ্বারা সে বুঝাতে চাইত একজন বাবা যেভাবে মেয়েকে দিয়ে কাজ করায় না, শুধু আদর-যত্ন করে আর প্রতি পালন করে, তদ্রুপ স্বামীও তাকে দিয়ে কোন কাজ করাবে না, শুধু আদর করবে আর তোয়াজ নোয়াজ করবে। কিন্তু এটা যে বাবা নয় স্বামী, এখানে উভয়েরই আলাদা আলাদা দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে, উভয়েরই যৌথ প্রচেষ্টায় একটা সংসার গড়ে উঠে- এ বিষয়টা সে বুঝত না এবং বুঝতে চাইত না। আর হাসানও অনেকটা সে রকমই করত, পারত পক্ষে তাকে দিয়ে কোন কাজ করাত না। রান্না ও মেয়ের খাওয়া পড়া এ দুটি কাজ সে পারত না বিধায় তাকে করতে হত। আর বাদ বাকী কাজ হাসানই করত।

কিন্তু এশার সময় তাকে ডেকে তুলতে বাধ্য হত স্ত্রীর নিজের জন্য, হাসানের জন্য নয়। কতবার চিন্তা করেছে -এই ডেকে তুলে কান্না কাটি ও অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করার চেয়ে নিজেই চারটে ভাত ফুটিয়ে বা দু চারটা বিস্কুট খেয়ে ঘুমিয়ে থাকবে। কিন্তু তার কি হবে সেতো ছিল স্বাস্থ্যহীন, দুর্বল- তাল পাতার সেপাই। রাতে না খেয়ে থাকলে তো স্বাস্থ্য আরো ভেঙ্গে পড়বে। অথচ হাসানের সর্বাত্নক প্রচেষ্টা ও আন্তরিক আকাংখা ছিল স্ত্রীর স্বাস্থ্যটা ঠিক করে তোলা। কারণ এমনিতে সে যথেষ্ট সুন্দরি ছিল, কিন্তু তার স্বাস্থ্যটা হাসানকে বিকর্ষণ করত। তার গায়ে হাত দিলে মেশিনের ভিতরকার কিছু লোহা-লক্বর হাতে বাজত। এ জন্যই সে চেষ্টা করত আর কল্পনা করত, তার বউ তো শুধু আদর চায়, স্বাস্থ্যটা হলে দেখিয়ে দিবে- সে কত মন কত টন আদর নিতে পারে। কারণ আদর হল রাসায়নিক পদার্থ। এটা নরম ও তুলতুলে জায়গা কামনা করে, হাড়- হাড্ডি ও লোহা- লক্বরে কেউ কোন দিন আদর করে না। এ জন্যই মানুষ সাধারণত নরম ও তুলতুলে জায়গায় চুমু দেয়, আদর করে। কিন্তু তার স্ত্রী সংসার সম্পর্কে যেমন ছিল উদাসিন তেমনি নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে ছিল আরো উদাসিন। তার জন্য বান্ধিক করা দুধ- ডিম নিয়মিত খেত না। এসব স্বামীকেই খেয়াল করে তাকাদা দিয়ে খাওয়াতে হত। আর একই কারণে তাকে ঘুম থেকেও ডেকে তুলতে হত।

অনন্তর সে গায়ে গতরে কখনো হাসানের মনোরঞ্জন করত না, সে শত বললেও কোন দিন সাজ গোজ করত না বরং আরো বিশ্রি হয়ে থাকত। কিন্তু ঈদ বা অন্য কোন উৎসব অনুষ্ঠানে যদি বা সাজল তাহলে এর মুল্যটা কড়ায় গন্ডায় আদায় করে নিত। তখন হাসানকে বাইরে যেতে দিত না, তার সামনে বসে থাকতে হবে। অন্য দিকে দৃষ্টি ফেরান যাবে না, তাকিয়ে তাকিয়ে শুধু তাকেই দেখতে হবে। ২০০৪ সালে বকরা ঈদে স্ত্রী ভাল সাজ-গোজ করল আর স্বামীকে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত সামনে বসিয়ে রাখল, উঠতে দিল না।

আর তার মেয়ের অবস্থা হল সে নিজে নিজে প্রতিপালিত হচ্ছিল, মা তাকে প্রতিপালন করছিল না বা করতে সক্ষম ছিল না। যেমন ধরা যাক মেয়ে হেটে বা হামাগুড়ি দিয়ে যাচ্ছে, তার সামনে জগ, গ্লাস বা তরকারির বাটি, গরম ভাত, দা ইত্যাদি কোন কিছু পড়ল, তার ইচ্ছা হল না- ধরল না, ভাঙ্গল না। কিন্তু ইচ্ছা হল তো সেটা ধরবে, ফেলবে, ভাঙ্গবে, হাত পোড়বে, মা তাকে ফিরাতে সক্ষম হয় না। অথবা বিছানায় খেলছে, খেলতে খেলতে খাটের কিনারায় এসে গেল তো পরে গেল, আসল না তো পড়ল না। অর্থাৎ যা ঘটত তা মেয়ের ইচ্ছা ও প্রাকৃতিক নিয়মে ঘটে যেত। কিন্তু মা মেয়েকে বা নিজিস পত্তর বাঁচাবে- এমন কোন হুস চেতনা ও অনুভূতি ছিল না, অনেকটা যেন বলদের মত অনুভূতিহীন প্রাণী। আবার মেয়েকে খাওয়ানো পড়ানো এসবের কোন হুস তার থাকত না, হাসানকেই দেখে শুনে করতে বা করাতে হত। এভাবে মেয়েকে দেখা শুনার দায়িত্ব ধীরে ধীরে নিজেই গ্রহণ করে। কিন্তু মেয়ের কষ্ট ও সংসারের এসব ক্ষতি সে সহ্য করতে পারত না, তখন কোন কিছু বললেই সে সিংহীর মত তার উপর হামলে পড়ত।

তখন মাঘ মাসের কনকনে শীত। শীতের তীব্রতায় ফেরদৌসীর পা ফুলে গেছে। হাসান সকালে ঘুমিয়ে ছিল। হঠাৎ চেয়ে দেখে সে রান্না বসিয়েছে এবং গ্যাসের চুলায় উপোড় হয়ে নিজের শরীর গরম রাখছে। অথচ মেয়েটাকে তখন খালি গায়ে ঘরের মেঝেতে ছেড়ে দিয়েছে। সে দেখে অবাক হয়ে গেল। আর তার মেয়ে এই প্রথম নতুন খেলা শিখেছে। সে দুইটা হামাগুড়ি দেয় তারপর মাথাটা দুপাশে ঘুরায় আর হাসে। আবার দুই হামাগুড়ি আবার মাথা ঘুরানো ও হাসি। যে কোন বাবার চোখে এ এক মনোহর দৃশ্য। কষ্টে তার মনটা বিষিয়ে উঠল। এ কেমন মা, নিজে আগুন তাপাচ্ছে অথচ বাচ্চাটাকে এ কনকনে শীতে খালি গায়ে ফ্লোরের ঠাণ্ডায় ছেড়ে রেখেছে। হাসান বলল, মেয়েকে কাপড় পড়িয়ে চুলার কাছে নাও, কয়েক বার বলল কিন্তু সে ফিরেও তাকাল না। কারণ সে মনে করে স্বামীর কথায় কাজ করলে তার সামনে ছোট হয়ে যাবে। ঘৃণায় মনটা তেতো হয়ে উঠল। মন চাচ্ছিল মুখের উপর গিয়ে দুইটা থাপ্পড় মারে। নিজের সন্তানের উপর যার দরদ নাই সে কিসের মা। অগত্যা সে নিজেই উঠল, কাপড় পড়িয়ে লেপের নীচে নিয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু সে থাকবে না, খেলবে। অগত্যা কোলে নিয়ে আগুনের ধারে গিয়ে বসল।

এর মাত্র দুই দিন পর রাত্রে ফেরদৌসী মেয়েকে নিয়ে গ্যাসের চুলায় আগুন তাপাচ্ছে। চুলার উপর যে লোহাটায় পাতিল বসানো হয় মেয়ের পা গিয়ে সেটায় লাগল। বিকট এক চিৎকার। হাসান দৌড়ে গেল, লোহার চ্যাকায় পা পুড়ে গেছে। মেয়ের পায়ে চিরস্থায়ী দাগ পরে গেল। সে ছিল এমনই বেহুশ বান্দা যে, মেয়েকে ছেড়ে দিয়ে আর খেয়াল রাখত না। মাটিতে কতগুলি কাচের গ্লাস ছিল। মেয়ে দুই দিনে ছয়টি গ্লাস ভাঙ্গল, হাত কাটল অথচ সে না মেয়েকে হেফাজত করতে পারল আর না গ্লাস।

সময়ের প্রয়োজনে ইসলাম রক্ষার স্বার্থে বিভিন্ন ইসলামী দল ও শাখা গড়ে উঠে। যেমন দেওবন্দ, জামাতে ইসলাম, তাবলীগ ইত্যাদি। পরবর্তিতে নিজ নিজ রুচি- পসন্দ ও পরিবেশ অনুযায়ী বিভিন্ন লোক এসব দলে ঢুকে। তারা নিজ দলকেই একমাত্র সঠিক ইসলাম ও অন্যান্যদের ভ্রান্ত গণ্য করতে থাকে। নিজ দলের উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য এরা নিজেদের কর্মকান্ডে বিভিন্ন গোপনীয়তা অবলম্বন করে অথচ ইসলামে গোপনীয়তা কিছুই নেই। এভাবে তারা ইসলামের মধ্যে বিকৃতি সাধন করে একে অন্যকে ভ্রান্ত আখ্যা দিয়ে ফিরকায় পরিনত হয়ে যায়। ফেরদৌসিদের পরিবারটাও ছিল এরকম। তার বাবা ছিলেন অধ্যাপক গোলাম আযমের ছাত্র, তার হাত ধরেই তিনি তাবলীগে ঢুকেন। তার আটটি মেয়ে, তাদেরকে তিনি তাবলিগি জামাই দেখে বিয়ে দেন। তার মৃত্যুর পর কর্তৃত্ব চলে আসে বড় জামাই ইঞ্জিনিয়ার আব্দুর রওফের হাতে। সেছিল কট্টর তাবলিগী, এটাকেই একমাত্র ইসলাম মনে করত। তাবলিগী উসুলের বাইরে পিতা মাতার খেদমত, ইসলাম প্রতিষ্ঠা, মানব সেবা ইত্যাদিকে সে ইসলাম মনে করত না।

যেহেতু সে আলেম ছিল না বিধায় ইসলাম বুঝত না। তার এই বিকৃত ইসলাম আলেমদের সাথে ও অন্যদের সাথে বনী- বনা হত না। তখন সে শ্যালিকা ও শ্যালিকা জামাইদের নিয়ে একটা তাবলীগ ভিত্তিক পারিবারিক বলয় গড়ে তোলে। যা হয়ে উঠে একটা নারী তান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থা। কারণ, প্রথমতঃ এ পরিবারের মেয়েরা স্বামীর পরিবারে থাকে না, সম্পর্কও রাখে না। এদের সম্পর্ক থাকে নিজের পরিবারের সাথে, বোনদের সাথে। স্বামীকে নিয়ে এরা শহরে থাকে, চাকরি না থাকলেও একটা কিছু করে ধরে চলে। দ্বিতীয়তঃ স্বামী স্ত্রী উভয়েই কট্টর তাবলীগী হওয়ার কারণে এরা স্ত্রী নির্ভর হয়ে উঠে, স্ত্রীর উপরে সব কিছু ছেড়ে দেয়। এ পরিবারের কর্তা ইঞ্জিনিয়ার এবং এডির সংসার চালায় তাদের স্ত্রীরা। স্ত্রী লাভ কি ক্ষতি করল, ভাল কি মন্দ করল- স্বামী ফিরেও তাকায় না, কিছু বলেও না। বললেও লাভ নেই স্ত্রী ধ্মক মেরে মুখ বন্ধ করে দেয়। সঙ্গত কারনেই কুয়োর ব্যাঙ ফেরদৌসি তাদের নারী তান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থাটাকেই প্রকৃত সমাজ ব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থা মনে করত। তখন স্বামী কিছু বললে মনে করত নিয়ম ভঙ্গ করছে, অনধিকার চর্চা করছে।

পক্ষান্তরে হাসান ছিল পরীক্ষিত সংসারি, বাবার বিশাল সংসার চালিয়ে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল। কাজেই সংসারের ক্ষতি বা স্ত্রীর ভুল শোধরানোর জন্য সে কিছু বললেই স্ত্রী তার উপর হামলে পরত, ঝগড়া করত, কাঁদত আর কথায় কথায় বলত ময়মনসিংহের মানুষ ভাল না, ফুলপুরের মানুষ ভাল না। তাদের বরিশালী জামাই পটেটোর ভাইয়ের জন্য তার বিয়ের আলাপ হয়েছিল, ফেরদৌসি তাদের বাড়িতেও গিয়েছে। প্রায়শই ঝগড়ার সময় কাঁদত আর বলত- সেই ছেলের সাথে বিয়ে হলেই তার ভাল হত, তখন হাসান বিমর্ষ হয়ে যেত। সে ছিল ছিঁচকাঁদুনে- কথায় কথায় কাঁদত আর বলত- আমি ফুফুর মত পাগল হয়ে দেশে দেশে ঘুরব।

এভাবে ঝগড়া সব সময় লেগেই থাকত, তার সংসারটা হয়ে উঠল কুরুক্ষেত্র। আর এসব ঝগড়া এত তুচ্ছাতিচুচ্ছ বিষয় নিয়ে শুরু হত যে, পরবর্তিতে কি নিয়ে ঝগড়া হল তা মনে থাকত না। হাসান অনেকবার চিন্তা করেছে এসব ঝগড়ার বিষয় গুলি লিখে রাখবে তারপর ইঞ্জিনিয়ারের হাতে দিয়ে বলবে, আমার সংসার আর চলছে না, কি ব্যবস্থা করবেন করেন। কিন্তু একে তো নিজের স্ত্রীর বিষয় লিখে অন্যের হাতে দেয়াটা তার কাছে কাপুরুষতা ও জঘন্য বলে মনে হল। আবার সেখানেও কর্তা হচ্ছে তার বড় বোন ওরফে বড়াপা। আর এ মহিলার সেচ্ছাচারিতা সম্পর্কে ইতিমধ্যেই তার যা উপলব্ধি হয়েছে তাতে বুঝতে পারছিল বিচার দিলেও কোন ফায়দা হবে না। কাজেই এডি লোকটা সহজ সরল ছিল, হাসানের সাথে ভাল সম্পর্ক ছিল বিধায় যা ঘটত তাকে জানাত- যদিও কোন বিচার পেত না।

একদিন সন্ধ্যার পর তুচ্ছ কোন বিষয় নিয়ে ঝগড়া শুরু হল। হাসান তার নাচানাচি ও কলজে ভেদি কথা থেকে বাঁচার জন্য পড়তে বসল। তখন সে একটা পাঠ্য বইয়ের ব্যাখ্যা গ্রন্থ লিখছে। সে যখন দেখল তার দিকে হাসানের মনোযোগ নাই, তার কথার ঝাঁঝ গ্রহণ করছে না, মাফ চাওয়ার সম্ভবনাও কম, তখন তার কাছে এসে দেয়াল ঘেঁসে দাঁড়াল। তার চেয়ার ছিল দেয়াল থেকে দুই ফুট ব্যবধানে। স্ত্রী বকবকানি শুরু করল আর স্বামী গভীরভাবে পড়ায় মন দিল। হঠাৎ মনে হল চেয়ারটা নড়ে উঠেছে। তাকিয়ে দেখে চেয়ারের ডান হাতলের উপর তার পা- যা হাতলে রাখা হাসানের হাত ছুয়ে আছে। আগুনের একটা উদগার তার নাক মুখ কান দিয়ে বেরিয়ে গেল। তার মনে হল- সে দিন রাতের কথাটা আজ সে বাস্তবায়ন করেছে। সিটিয়ে চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে গেল। হাসানের অবস্থা দেখেই সে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল, সোজা রান্না ঘরে চলে গেল, সেখান থেকে উঠোনে, মুখে একটাও রা নেই। সে সিদ্ধান্ত নিল আজ ওর ঠ্যাং ভেঙ্গে ফেলবে। সে গর্জে উঠল- এই হারামি, এটা তুই কি করলি? ফেরদৌসী ভয় পেয়ে গিয়েছিল- আমি কিছু করিনি, শুধু হাতলে পা রাখছি। হাসান ভাবল- আসলে সে কি লাথি মেরেছে নাকি পা রেখেছে। লাথি মারলে তো তার শরীর সহ চেয়ারটা নড়ে উঠত। কিন্তু শুধু চেয়ারটা নড়েছে? বুঝতে পারল আসলে পা রেখেছে।

কিন্তু হাতলে তার হাতের উপর পা রাখবে কেন। রাগে কয়েকটা অশ্রাব্য গালি দিল। কিন্তু মারার সাহস পেল না। কারণ এ মেয়েটার এতই জেদ যে, মারলে নিশ্চিত চলে যাবে এবং তার বোন- দুলা ভাইদের বলবে। আর ওদের সম্পর্কে ইতিমধ্যে তার যে ধারনা হয়েছে- তারা হয় আটকা দিবে এমনকি বিয়েও ভেঙ্গে দিতে পারে। তারপর সে ভিক্ষে করবে না বেশ্যাবৃত্তি করে খাবে- এমন চিন্তা না আছে তার নিজের আর না আছে তার বোনদের। তদুপরি হাসানের গলার ফাস তো একটাই তার মেয়ে, মরলেও মেয়েকে মা হারা হতে দেবে না। কাজেই মারার সাহস পেল না, আবার মেনেও নিতে পারল না। এডির সাথে তার ভাল সম্পর্ক ছিল, জানে তাকে জানিয়ে লাভ নেই, তবুও কিছুটা প্রতিকারের আশায় পর দিন বিকেলে গিয়ে তাকে বলল। কিন্তু সে হা- না এমন একটা ভাব দেখাল যে, হাসানের মনে প্রবল ধারনা হল সেও মাঝে মধ্যে বউয়ের হাতে কিছু না কিছু মাইর- টাইর খায়।

এরপর যা ঘটত সবই তাকে জানাত কিন্তু সে কোন দিন এসে তার বউকে কিছু বলেনি। বরং কোন দিন তাকেই ধমকে উঠত- এই তুমি খালি বউয়ের সাথে ঝগড়া কর ক্যা। কোন দিন বুঝাত- আরে শুন মেয়েদের এসব সহ্য করতে হয়। আবার কোন দিন ভাবে সাবে বুঝাত- তার চেয়ে বরং সেই ভাল আছে। তখন আর বিচার কি চাবে বরং এডির জন্যই মায়া হত। তারপর বাসায় গিয়ে বউকে বলত- হাসান কি জহিরের মত বউকে অত্যাচার করে নাকি? তখন তার বউ বলত- না, এমন করলে ফেরদৌসী থাকত না, কবেই এসে পরত। তারা ধারনা করত ময়মনসিংহের আরেক জামাই জহির তার বউকে অত্যাচার করে।

একদিন ফেরদৌসী কোন কাজে এডির বাসা থেকে ফিরে এসেই তার উপর সিডর সাইক্লোন বইয়ে দিল। আত্মরক্ষার্থে হাসান বলল- আরে দুঃ, তুমি কি যে বল না, আমি এসব বলতে যাব কোন দুঃখে, মোবারকই এসব বলে গেছে। তখন সে মাথা ঝাকিয়ে চোখ পাকিয়ে, দাঁত খিঁচিয়ে বলল, কানা মোবারক্যা কইয়া গেছে, না? আমি সেজদা করার সময়, চেয়ারের হাতলে ঠ্যাং রাখার সময় মোবারক্যা এহানে আছিল, না? বেশরম, বেহায়া, নির্লজ্ব কোথাকার। নিজের বউয়ের বদনাম মাইনসেরে কইতে খুব মজা লাগে, আবার দাঁত বাইর কইর‍্যা হাসে। মানে মোবারকের উপর দোষ চাপানোর সময় সে মোসাহেবি করে একটু হাসছিল, তখন সম্ভবত মিলিমিটার পরিমাণ দাঁত বেরিয়ে ছিল। এজন্যই বলল, সে দাঁত বের করে হাসে।

এরপর যা বলল তার সারাংশ হচ্ছে, যারা নিজের বউয়ের বদনাম বাইরে বলে বেড়ায় তারা পুরুষ না, এই মাইগ্যা টাইগ্যা জাতীয় একটা কিছু। আসলে তার মনোভাব হল স্বামীর চামড়া ছিলবে, তারপর মরিচের আস্তর বিছাবে, তারপর চিপে চিপে লেবুর রস দিবে, লবণ দিবে। এরপর নিয়ে শুকনা কড়াইয়ে কিছুক্ষণ ভাজবে, তারপর ডুবা তেলে ভাজবে, আবার মাঝে মাঝে চেকে দেখবে, লবণ মরিচ ঠিকমত হয়েছে কি না। এসবের মধ্যে যে ওঁ ওঁয়া করবে না সেই হল প্রকৃত স্বামী। কিন্তু এসবের কারণে স্বামী যদি মারে তাহলে সে অসভ্য জানোয়ার। আর যদি অভিভাবকদের কাছে নালিশ করে তাহলে সে মাইগ্যা বা ক্লীব জাতীয় প্রাণী বিশেষ। এরই মধ্যে বাসার টিউবওয়েল নষ্ট হয়ে গেছে। মালিক বলল, এখন আর কিছুই ঠিক করবে না, বাসা ভাঙ্গার সময় একবারে সব নতুন করে করবে। খাবার পানির জন্য সমস্যা, দূর থেকে টেনে আনতে হত। এ আবার ঝগড়ার নতুন ইস্যু হল। কাজেই নতুন বাসার সন্ধান শুরু করল।

বিষয়: সাহিত্য

১৪৭৪ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

376401
১৭ আগস্ট ২০১৬ দুপুর ১২:৪২
কুয়েত থেকে লিখেছেন : ভালো লাগলো চালিয়ে যান প্রত্যেকে তারা নিজ দলকেই একমাত্র সঠিক ইসলাম ও অন্যান্যদের ভ্রান্ত গণ্য করতে থাকে। অনেক ধন্যবাদ
376410
১৭ আগস্ট ২০১৬ দুপুর ০৩:১৩
আবু নাইম লিখেছেন : কি বলব বলার ভাষা পাই না।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File