চিঠি- 20 (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১১ আগস্ট, ২০১৬, ০১:৫১:৪৩ দুপুর
দেখা দিল অভিশপ্ত ঘুম, মেয়েদের কাজের যেই সময় জহুর ও এশার সময় ঘুমাত। আগের বাসায়ও ঘুমাত তবে ডাক দিলে কোনরূপ উচ্চ বাচ্য না করে কাজে লেগে যেত, কান্না- কাটিও করত না, গালাগালিও করত না। কিন্তু এ বাসায় প্রমোশন হল। ডাক দিলে শুয়ে শুয়ে এক ঘণ্টা কাঁদবে আর মন্ত্র আওড়াবে- আমার বাপে আমারে কত আদর করত। তারপর স্বামীর কথা বলত- আমার সুখ দেখতে পারে না, খাটাতে চায়,কামলা রাখে না, কিপটে ছোদা ইত্যাদি বকবক করতেই থাকত।
একদিন এশার আজান দিয়েছে, হাসান মসজিদে যাবে, বাইরে বেরুনোর দরজা পাশের রুমে। সে বাইরে গেলে তাকে দরজা বন্ধ করতে হয় তাই স্ত্রীকে তোলার জন্য ডাকছে কিন্তু সে শুধু হু হা করছে, উঠছে না। ওদিকে নামাযের সময় হয়ে গেছে। হাসানের পড়ার টেবিল খাটের কাছাকাছি। সে চেয়ার থেকে হাত বাড়িয়ে তার হাটুতে ধরে নাড়া দিয়ে বলল- এই উঠ, দরজা বন্ধ করতে হবে। উঠল না, ক্ষনেক পর আরেকটা নাড়া দিয়ে বলল- এই উঠনা। আর অমনি সে চ্যাত করে ফণীনির মত বালিশ থেকে মাথা তুলে চোখ বিস্ফারিত করে, দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠল- সরেন, সরেন বলছি, লাত্থি মাইর্যা ফালাইয়া দিমু কইলাম, আমি এখন ঘুমামু- বলে আবার প্রশান্তির সাথে বালিশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরল। হাসানের মনে হল পৃথিবীটা যেন লাটিমের মত ঘুরছে। মাথা নিচু করে অতি কষ্টে একটা আগুনের ঢুক গিলল। কান গরম হয়ে গেছে, শোঁ শোঁ শব্দ করছে। কোন স্ত্রী স্বামীকে লাথি মেরে ফেলে দেয়ার কথা বলতে পারে- তাও আবার ধর্মীয় পরিবারের মেয়ে, এটা জীবনে সে প্রথম শুনল।
কিন্তু যে কোন অবস্থায় তার অনুভূতি ঠিক থাকে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। বুঝতে পারল ঘরে থাকলে যে কোন অঘটন ঘটতে পারে। বেরিয়ে যাওয়ার সময় ধৈর্যের চুড়ান্ত পরাকাষ্টা দেখিয়ে স্ত্রীকে ডেকে বলল- আমি মসজিদে গেলাম দরজা বন্ধ কর। বুকটা তার ফেটে যাচ্ছে, চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইছে। নামায পড়ে অব্যক্ত যন্ত্রনায় মসজিদে অনেকক্ষণ শুয়ে থাকল। দুঃখ আর হতাশায় তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে- এটা কী করে সম্ভব, স্ত্রী কিভাবে স্বামীকে লাথি মারার কথা বলতে পারে। সংসার তো মাত্র শুরু, বাকী জীবনের এই বিশাল বেলাভুমি সে এমন বউ নিয়ে কেমনে পারি দিবে। বিয়ের পর থেকেই সে হাসানের সাথে ঝগড়া করত, নিজেকে স্বামীর চেয়ে বড় মনে করত। এ ধারণা সম্ভবত সে পেয়েছে তার বোন ও দুলাভাইদের কাছে থেকে। কারণ তার দুলাভাইরা সব সময় স্ত্রীর সামনে ক্রীতদাসের ন্যায় মস্তক অবনত রাখত। এ ছাড়াও সে যে কোন বিষয়ে বোকার মত তর্ক করত, তখন হাসান তার ভুলগুলি ধরিয়ে দিত, বুঝাত। তখন সে মাঝে মধ্যে বলত আমি কি আর আপনের মত শিক্ষিত, আমি কি সব বুঝি, আমাকে বুঝিয়ে দেবেন। এ জন্য তাকে হাসান সব সময় বুঝাত, ভুল শুধরে দেয়ার চেষ্টা করত। কিন্তু বাসায় উঠার পর সে তার কোন বুঝ মানত না, হাসান যা বলত তার বিপরীত করত। সে মনে করত হাসানের কথামত চললে সে স্বামীর সামনে ছোট হয়ে যাবে। বিভিন্ন কথায় ও কাজে স্বামীকে অত্যাচার নির্যাতন করত, তখন হাসান তাকে অবোধ শিশুর ন্যায় মনে করে কোন কিছু গায়ে মাখত না বরং হাসি মশকরা করত।
কিন্তু আজ যে অঘটন ঘটল এটা তো মেনে নেয়া যায় না। তাহলে সে প্রতিদিনই এমন ব্যবহার করতে থাকবে। না এর একটা প্রতিকার হওয়া দরকার। নিজের জন্য বউকে সে কোনদিন মারেনি কিন্তু আজ ওকে পিটিয়ে হাত পা ভেঙ্গে ফেলবে- এমন চিন্তা নিয়ে সে বাসার দিকে রওয়ানা হল। কিন্তু যেতে যেতে মনকে বুঝাল, আসলে সে ঘুমের ঘোরে কথাটা বলেছে, স্বজ্ঞানে বলেনি। গিয়ে দেখে এ দীর্ঘ সময় পর্যন্ত দরজা খোলা পরে আছে। দৌড়ে ঘরে ঢুকল, চোর বেচারা অরক্ষিত মালের মত সবকিছু নিয়ে গেল কিনা, ত্বরিতে দৃষ্টি বিলাল, না সব ঠিকই আছে। টের পায় নি, আর টের পেলে তো তার যে হুঁশিয়ার বউ- তাকে শুদ্ধ তুলে নিয়ে যেতে পারত। স্ত্রী তখনো ঘুমুচ্ছে দেখে রাগে-তার হাতে ধরে এক টানে তুলে ফেলল- এই উঠ, রাধতে যা, ঘুমের আর কোন সময় গময় নাই। সে এক পলক হাসানের দিকে তাকিয়েই কান্না জুড়ে দিল- আমার বাপে আমারে কত আদর করত। কথাটা শুনেই তার মাথায় রক্ত উঠে গেল, নিজের অজান্তেই বলে উঠল- এই মাগি, আমি কি তোর বাপ লাগি। এই লাগি পর্যন্ত গিয়েই নিজের হাতে নিজের মুখ চেপে ধরল, আস্তাগফিরুল্লাহ বলতে বলতে পাশের রুমে দৌড়ে গিয়ে কেঁদে ফেলল। এক অন্তহীন যন্ত্রনায় বিছানায় গিয়ে উপুড় হয়ে পরে গেল, দুঃখে কষ্টে তার বুকটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে- হায় আল্লাহ্ কি চেয়েছিলাম আর কি পেলাম। জীবনে শ্বশুর বাড়ি বা ধন সম্পদ কিছুই তো চাইনি। শুধু একটা ভাল বউ চেয়েছিলাম, ভালো জীবন সঙ্গিনী- যাকে নিয়ে বাকী জীবনটা শান্তিতে কাটানোর আশা করেছিলাম। কিন্তু কি পেলাম, না শ্বশুর বাড়ি, না ধন, না স্ত্রী। এমন একটা বিচ্ছু নিয়ে জীবন কেমনে কাটাব। এতো কোন বুঝ মানে না, উপদেশ মানে না, স্বামী মানে না। যে বাবা ও স্বামীর পার্থক্য বোঝে না, স্বামীর কাছে বাবার অবদান কামনা করে- এমন বোকা নিয়ে সংসার করা কিভাবে সম্ভব।
এই প্রথম মাথায় তালাকের চিন্তা ঢুকল। কিন্তু এটাই বা কি করে সম্ভব, তার বাচ্চা? নিজে ইয়াতিম হওয়ার যন্ত্রণা সামলাতে গিয়ে রক্তাশ্রু ঝরিয়েছে। এখন সে জীবিত থাকতে তার সন্তান মা হারা হবে, এটা তো কল্পনাতিত। আল্লাহ্ নিয়ে গেলে ভিন্ন কথা কিন্তু যা তার আয়ত্তের মধ্যে- নিজের সুখের জন্য তাতে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে সন্তানের কষ্ট ডেকে আনা ছিল তার কাছে মৃত্যুর শামিল। হঠাৎ তার একটি ঘটনা মনে পরল, কিছুদিন আগে পত্রিকায় পড়েছিল- একটি অনার্স পড়ুয়া মেয়ে আত্নহত্যা করেছে, মেয়েটি ছিল যথেষ্ট সুন্দরি। কারণ হিসাবে বলা হয়েছে- মেয়েটির একের পর এক বিয়ের আলাপ হত আর ভেঙ্গে যেত, কারণ তার পিতা- মাতার মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটেছিল- যা প্রভাব ফেলেছিল মেয়ের বিয়ের উপর। হাসানের আত্নাটা চ্যাত করে উঠে, সে ভিত- সন্ত্রস্তের ন্যায় মৃদু আর্তনাদ করে উঠে- না না, না না, এমনটা হতে পারে না। আমার মেয়ের জন্য আমি নিজেকে কোরবান করলাম, স্ত্রীর হাতে আমি কোরবানি হব- তবুও আমার মেয়ের অনু-বিন্দু ক্ষতি হতে দেব না।
এছাড়া স্ত্রীর প্রতি ছিল তার নিখাত ভালবাসা, তার অত্যাচারে মনটা বিষিয়ে থাকলেও যখন স্ত্রীকে ছাড়া জীবন কল্পনা করল, তখন পৃথিবীটা তার কাছে ফাকা মনে হল, জীবনটা অর্থহীন ঠেকল। কাজেই তালাকের চিন্তা বাদ। তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে, পিটিয়ে, শিকল দিয়ে বেধে রেখে হলেও ওকে নিয়েই জীবন কাটাবে- এটাই তার শেষ কথা। এসব চিন্তা করতে করতে রাত বারটা পার হয়ে গেল। তারপর এ পাশের রুমে ঢুকে দেখে সে দুই হাতে হাটু জড়িয়ে তার উপর মাথা রেখে কেঁদেই চলেছে। হাসান বলল, এই তুই আমারে কি কইছস তোর হুস আছে? সে চোখ পাকিয়ে বলল, কইছি ভালা করছি, আরো একশ বার কমু। তুই আমারে তালাক দে, আমি তোর ঘর করমু না, তোর ভাত খামু না, এক্ষন তালাক দে ......। তারপর চলল শ্রাব্য অশ্রাব্য গালাগালি। হাসান বুঝল- সে কথাটা স্বজ্ঞানেই বলেছে, ঘুমের ঘোরে বলেনি। কিন্তু সে লাচার, কারণ এমনিতেই তালাক চাচ্ছে, তার উপর মারলে বা কিছু বললে সোজা ঘর থেকে বেরিয়ে চলে যাবে। তারপর বোনদের কাছে গিয়ে উল্টা-পাল্টা বলবে- তখন মহাবিপত্তি দেখা দিবে।
ছাত্র কাল থেকে তার অভ্যাস ছিল বিপদাপদ বা বেকার সময়ে তাসবীহ জপত। অগত্যা তসবীহটা নিয়ে সে খাটের একপাশে গিয়ে শুয়ে পরল আর দোয়া ইউনুস পড়তে লাগল। স্বামীকে খাটে উঠতে দেখে সে নেমে গেল, তারপর শিশুরা যেমন কোন কিছু বায়না ধরে হাত পা ছুড়তে থাকে, নাচতে থাকে, আর কাঁদতে থাকে, সেও তেমনি নাচানাচি শুরু করল। আর এক কথা বারবার জপ করছে- আমারে তালাক দে, আমি থাকব না। অনেকক্ষণ এভাবে নাচানাচি করল, তারপর মাটিতে বসে শিশুরা যেভাবে পা আচড়ায়- কতক্ষণ পা আচড়াল। তারপর উঠে এসে বিছানার পাশে বসে হাসানকে ধাক্কা দেয় আর বলে- এই আমারে তালাক দে, আমি তোর ঘর করমু না, তোর ভাত খামু না, আমি চলে যাব। এভাবে বলতে থাকে আর হাসানকে ধাক্কা মারতে থাকে। হাসান পাথরের মত বিছানায় পড়ে থেকে মনে মনে নিজের ভাগ্যকে অভিসম্পাত করে, ভবিষ্যৎ চিন্তা করে আর তাসবীহ টিপে।
সে কিছুক্ষণ এরূপ করে উঠে গেল, এবার খাতা কলম নিয়ে এসে হাসানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, নে তালাক লেখ, আমি চলে যাব, এভাবে বার বার বলতে থাকে। তারপর কিছুক্ষণ হাত পা ছুড়ে নাচতে থাকে আবার খাতা কলম নিয়ে বলতে থাকে। তারপর হয়ত মাটিতে বসে পা আছড়ায়, আবার বলে তালাক দে, আবার খাতা কলম নিয়ে আসে। এভাবেই এক নিরীহ স্বামীর উপর চলতে থাকে দাজ্জাল স্ত্রীর নারকীয় পীড়ন। অবশেষে হাসান নিরস ও শান্ত কণ্ঠে বলল, তালাক দেয়ার জন্য আমি বিয়ে করিনি। এ কথা শুনে ফেরদৌসী খুশি গেল। সে তার বউকে চিনে। তার ভেতরের খুশিটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও চেহারায় প্রকট হয়ে উঠল, তার মুখমন্ডলে খুশির উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু সেই খুশিটা অবশ্যি স্বামী থেকে লুকানোর চেষ্টা করছে। তারপর কিছুক্ষণ নীরব হয়ে চেয়ারে বসে রইল। কিন্তু এ মেয়েটা ছিল আসলেই পাগল এবং বোকা।
হাসান বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর সে চেয়ার ছেড়ে এসে সোজা স্বামীর উপর শুয়ে পড়ল। কি অবাক কান্ড, কোন প্রসঙ্গ নাই, আনুষঙ্গিকতা নাই, আহ্বান নাই, আবেগ নাই, জাগরন নাই, প্রয়োজন নাই- জীবনে এ একটিবার মাত্র একান্ত বেখাপ্পা ভাবে সেই নিজেই শুরু করল, সেই হল কর্তা আর হাসান কর্ম হয়ে নির্বাক অন্য দিকে ফিরে রইল, স্ত্রীর কাণ্ড দেখে তার হাঁসি পাচ্ছে । কিছুক্ষণ এভাবেই চলল, তারপর সে নিজেই মাঝপথে স্বামীকে ছেড়ে গিয়ে আবার চেয়ারে বসল। খানিক পর আবার শুরু করল- তালাক দে, আমি থাকমু না।
আসল ঘটনা হল, সে স্বামীকে যে কথাটা বলেছে তজ্জন্য তার মধ্যে কিছুটা অপরাধ বোধ কাজ করছিল। কিন্তু তাই বলে সে তো এমন মেয়ে নয় যে স্বামীর কাছে ক্ষমা চাইবে বরং সে চাচ্ছিল হাসানই তার কাছে ক্ষমা চাউক বা এ জাতীয় একটা কিছু করুক। আবার হাসানও তাকে “তোর বাপ লাগি” এমন একটা জঘন্য কথা বলেছে। তজ্জন্য তার মধ্যে জেদ প্রবল হয়ে উঠেছে অন্যান্য দিনের মত সে হাসানকে মাফ চাওয়াবে, এজন্যই সে অত্যাচার শুরু করেছে। আসলেই সে চলে যাবে এটা তার উদ্দেশ্য নয়, কারণ এমন উদ্দেশ্য হলে তো তালাকের প্রয়োজন পরে না, এমনিতে বেরিয়ে গেলেই পারত। কিন্তু হাসান যখন তাকে বলল, তালাক দেয়ার জন্য বিয়ে করিনি- তখন সে সত্যি সত্যিই খুশি হয়ে গেছে। কাজেই সে হাসানের মাফ চাওয়ার বিষয়টা বাদ দিয়ে চাইছিল তাকে জড়িয়ে ধরে একটু আদর করুক বা শান্তনা দিক। এ জন্যই সে চেয়ারে কিছুক্ষণ নীরব বসে থাকল। যখন হাসান এল না তখন সেই উঠে গিয়ে তার উপর শুয়ে পড়ল। তাও যখন জড়িয়ে ধরল না তখন সে নিজেই শুরু করল, যেন তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে। কিন্তু তাও যখন ধরল না, তখন তার তো আর কাজ উদ্দেশ্য নয় উদ্দেশ্য হল আদর- তা না পেয়ে মাঝ পথেই নেমে এল এবং সত্যি সত্যিই ক্ষেপে গেল। আর চূড়ান্ত অভিপ্সায় নামল, যতক্ষণ হাসান মাফ না চাইবে ততক্ষণ নির্মম অত্যাচার চালিয়ে যাবে। কখনোই তার চলে যাওয়া উদ্দেশ্য নয়, এটা উদ্দেশ্য হলে তো চলে গেলেই পারত, কিন্তু তা না করে ষ্টীম রুলার চালাল। পক্ষান্তরে হাসানের সিদ্ধান্ত হল, আজ আর কখনোই মাফ চাওয়া যাবে না। তাহলে সে প্রতিদিনই এর চেয়েও জঘন্য আচরণ করতে থাকবে। তখন আর তাকে নিয়ে ঘর করা সম্ভব হবে না। সে চোখ কান বন্ধ করে কাঠের টুকরার মত শুয়ে রইল।
রাতের তৃতীয় প্রহর অতীত, শুরু হয় তান্ডব। বাজারি নয় একটা সংসারি নারী, উগ্র আধুনিক নয় ধর্মীয় পরিবারের মেয়ে, মুক্তমনা নয় একজন মুহাদ্দিসের স্ত্রী কতটা জঘন্য হতে পারে- রাতের অন্ধকার নীরব চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে তাই দেখছিল। একটা অপরিনামদর্শি জাহান্নামী আওরত স্বামীর উপর কতটা পাশবিক নির্যাতন করতে পারে- শুরু হয় তার কুৎসিত অভিনয়। সে কখনো মাটিতে থাকে, কখনো খাটের পাশে এসে বসে। মাটিতে কখনো হাত পা ছুড়ে নাচানাচি করে, কখনো মাটিতে বসে পা আছড়ায়, কখনো শুয়ে থাকে। গালাগালি করে আর মন্ত্র জপ করে- তালাক দে, আমি তোর ঘরে থাকব না। আবার খাতা কলম নিয়ে খাটের কিনারে এসে বসে এগিয়ে দিয়ে বলে- নে তালাক লেখ। কিন্তু হাসান নড়াচড়া করে না। তখন সে স্বামীর পা ধরে টান মারে, টান দিয়ে লুঙ্গি খোলে ফেলে, চিমটি কাটে, কানে ধরে টান মারে, চুলে ধরে টান মারে। এভাবেই চলতে থাকে হাসানের ধৈর্যের পরীক্ষা। কখনো তার মনটা রোষে উঠে, মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠে, মন চায় মাগীটার গলা চেপে ধরতে। কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তার অর্জিত হয়েছিল। কারণ বাবার সংসার চালাতে গিয়ে তাকে ধৈর্যের চূড়ান্ত পরীক্ষা দিয়ে আসতে হয়েছিল। হাসান তার বিপরীত দিকে মুখ ফিরিয়ে পদদলিত প্রাণীর মত মৃতবৎ পড়ে আছে। তখন তার মেয়েটি ঘুমিয়ে আছে। কখনো মেয়েটির দিকে তাকায়- আমার মত কি আমার মেয়েটাও ইয়াতিম হবে? চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। না হবে না, সে হতে দেবে না, হ্যাঁ এটাই তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।
তার তান্ডব চলছেই, কখনো মাটিতে কখনো খাটের পাশে, তাকে গুতাগুতি করছেই। আকেরবার জোরে কান ধরে টান মারতেই ব্যথা পেয়ে হঠাৎ তার রক্ত মাথায় উঠে যায়, মন চায় হাতটা গলায় বসিয়ে দিতে, সকল যন্ত্রনার অবসান হয়ে যাক, তারপর কপালে যা আছে তাই হবে। কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বলে উঠে- এই মাগি, এত তালাক তালাক করছিস, তালাক দিলে তো ভিক্ষে অথবা বেশ্যালয় ছাড়া কপালে কিছুই জুটবে না। কি আছে তোর বাপের, কী বাল চামড়াটা আছে যে বসে বসে খাবি? একটা ভাই তাও তো মুরগী বেঁচে খায়। আর রুপের যে বাহার, কোন নাগর তোর জন্য হা করে বসে আছে নেয়ার জন্য, কিসের বলে এত নাচানাচি? ব্যস, আহত বাঘিনীর পাচায় আঙ্গুল দিয়ে দিল। সে খাতাটা হাসানের মুখের উপর ছোড়ে মারল। চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে। আবার খাতাটা নিয়ে তার মুখের উপর ধরে চেহারায় ও কণ্ঠে সীমাহীন কাঠিন্য ফুটিয়ে তুলে, মাথা নেড়ে, চোখ পাকিয়ে, দাঁত খিঁচিয়ে বলতে লাগল, এক্ষন তালাক লেখ, এক্ষন লেখ, আল্লাহ্র কসম আমি তোর ঘর করমু না। তুই এক্ষনি তালাক দিয়ে আমারে বিদায় কর। আমি বেশ্যালয়েই যামু, তবু তোর ঘর করমু না। ততক্ষনে সে রুদ্র মুর্তি ধারন করেছে, রাগে তার শরীর কাঁপছে।
রাগের সময় হাসান হাসতে পারে। মুচকি হেসে বলল, আমাকে তালাক দিতে হবে কেন, যার চায় মন সে তালাক দিয়ে চলে যাক। ততক্ষনাৎ সে খাট থেকে লাফিয়ে পরে- ঠিক আছে আমিই লিখব- বলে খাতার উপরে এক টানে লিখে ফেলল “ আমি তালাক দিয়ে গেলাম”। আর তা লিখেছে এজন্য যে, তার জানা ছিল স্ত্রী হাজার বার তালাক লিখলেও কিছুই হবে না। কারণ স্বামী সম্মতি না দিলে তালাক পতিত হবে না। আর ইতিমধ্যেই তার বিশ্বাস হয়ে গিয়ে ছিল হাসান সম্মতি দিবে না। এর পরেও তিন দিন সে হাসানকে তালাক লিখেছে। তবে এ দিনের কাগজটি ছিঁড়ে সে সংরক্ষণ করেছিল তার অভিভাবকদের দেখানোর জন্য। কিন্তু সে সুযোগ হয়নি বিধায় তা সংরক্ষণ করেছিল তার মেয়েকে দেখানোর জন্য।
এতক্ষণ সে তাকে মাফ চাওয়ার জন্য চূড়ান্ত প্রচেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে, এবার শুরু করল নতুন কৌশল। সে তালাক লিখেছে এবার চলে গেলেই পারে, ভয়ের তো কিছুই নেই, ভোর হয়ে গেছে। গাড়ি ও রিকশার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। যারা ভোরের ট্রেন ধরবে তাদের দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়েছে। কিন্তু না, সে যাবে না, হাসানকে বলে- উঠ আমারে বড়াপার বাসায় দিয়ে আয়। উদ্দেশ্য হল, এখনো মাফ চাইলে সে শান্ত হয়ে যাবে। হাসান বলল, আমাকে যেতে হবে কেন, রিকশা নিয়ে চলে যা। সে বলে- না তুই আয়, তুই গিয়ে দিয়ে আয়। আবার শুরু হল তাকে গুতানো। টান দিয়ে লুঙ্গি খোলে ফেলা, পায়ে টান মারা, কান, চুল ধরে টানাটানি শুরু হল। স্বামীকে মাফ চাওয়ানোর জন্য ওর একের পর এক অভিনয় এবং এত কিছুর পরও না যাওয়ার অভিনয় দেখে তার হাসি পাচ্ছিল। কিন্তু সে এ অভিনয়ের শেষ দেখতে চায়, তাই উঠে বলল, চল দিয়ে আসি। বাসা থেকে বেরিয়ে পঞ্চাশ ফুট দক্ষিনে গলি, গলি দিয়ে একশ ফুট পশ্চিমে মসজিদ, মসজিদের সামনে যেতেই মুয়াজ্জিন আযান শুরু করল। তখন হাসান বলল, ঐ যে সামনে রিকশা দেখা যায়, একটা রিকশা নিয়ে চলে যা- বলে সে বাসায় ফিরে গেল। সাথে সাথে স্ত্রীও বাসায় ঢুকল। সে জিজ্ঞেস করল, কি হল গেলে না কেন? স্ত্রী কোন কথা বলল না, এখন সে শান্ত। হাসানের একটু হাসি পেল, কারণ এতদিন সে বউকে নাপাক করত কিন্তু আজ বউ তাকে নাপাক করে দিল। গোসল করে মসজিদ থেকে নামায পড়ে এসে শুয়ে পড়ল। সারা রাত রান্না খাওয়া ও ঘুম ছাড়াই কাটল।
ঘুম থেকে উঠে দেখে তার বধুরত্ন শান্ত সুবোধ গিন্নির মত বাচ্চাকে কোলে নিয়ে রান্না করছে। অথচ বাচ্চাকে কোলে নিয়ে কাজ করার মত নারী সে নয়। তার এ প্রশান্তির কারণ হল, গত রাতে স্বামীকে মাফ না চাওয়াতে পারলেও সারা রাত তাকে কৈ-ভাজা ভাজতে সক্ষম হয়েছে, এটাই তার আত্মতৃপ্তির মূল কারণ। কিন্তু ইতিমধ্যে সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেল, এই প্রথম স্ত্রীর প্রতি তার মনে ঘৃণার উদ্রেক হল। তিক্ততায় তার মন বিষাক্ত হয়ে উঠল- যে নারী ইচ্ছা পুর্বক স্বামীকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায় তার ধার্মিকতা তো সুদূর পরাহত, সে কারো স্ত্রী হওয়ারই যোগ্য নয়। এরপর থেকে স্ত্রীর প্রতি হাসানের যে নিখাত ভালবাসা ছিল তার উপর একটা একটা ঘৃণার আবরন পরতে লাগল। তারপর এক সময় সেই ভালবাসা ঘৃণার সৈকতে হারিয়ে গেল, সমুদ্রে তলিয়ে গেল।
স্ত্রীর দুলা ভাইদের মধ্যে এডির (সহঃ পরিচালক, ইসঃ ফাউন্ডেশন) সাথে তার গভীর সম্পর্ক ছিল। হাসানের বাবার ছাত্র হওয়ার কারণে সে তার প্রতি ছিল প্লীজড। ভাবল এভাবে তো আর সংসার চলে না, তাকে একটু জানাই, সে দুয়েকটা ধমক দিয়ে গেলে হয়ত কাজ হতে পারে। পূর্বেও দুয়েক বার জানিয়েছে কিন্তু সে গায়েও মাখেনি, আসেওনি। বিকালে অফিস থেকে ফিরার পথে হাঁটতে হাঁটতে তার সাথে আলাপ করল। হাসান ভেবেছিল, এত বড় ঘটনা শুনার পর সে চমকে উঠবে, কিন্তু তার মধ্যে কোন ভাবান্তর লক্ষ করা গেল না। মনে হল যেন বিচার দেওয়াতে বিরক্ত হয়েছে। তার কথা বার্তার ইঙ্গিত হল এমন যে, এ পরিবারের মেয়েদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা যায় না, এখানে এটাই নিয়ম, এটা ফকির বংশের বৈশিষ্ট।
অবশ্য ইতিমধ্যে তারও যথেষ্ট অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছিল। এদের বোনেরা এমনিতে দ্বীন-দুনীয়া কিছু বুঝুক আর না বুঝুক কিন্তু এরা ছিল বাজপাখির মত দক্ষ স্বামী শিকারি। স্বামীকে পদানত রাখার কৌশল যেন এরা মায়ের পেট থেকেই প্রশিক্ষণ দিয়ে আসে। হাসান নিজেই দেখেছে এরা কিভাবে স্বামীকে ধ্মক মেরে এবং চোখা চোখা কথা বলে নির্বাক করে দেয়, তখন বেচারারা ক্রিতদাসের মত দাঁত বের করে হাসে। তার সন্দেহ হল, তাহলে কি এডিও এমন হিংস্রতার শিকার। তার স্ত্রী যদিও এমনিতে ভাল মানুষ কিন্তু বলা তো যায় না, হয়ত সেও বউয়ের হাতে দুয়েকটা লাথি গুতা খেয়েছে অথবা চেলা কাঠের দু’চারটা বাড়ি টারি খেয়েছে। নচেৎ এমন একটা জঘন্য ঘটনা শুনে সে নীরব থাকতে পারত না। তাছাড়া এডি একটা চির-রোগা মানুষ, তার বউ তাকে পাত্তাই দেয় না, সম্ভবত সব দিক দিয়েই দুর্বল। এডি- আচ্ছা আসব বলে বিদায় হয়ে গেল কিন্তু পরে আর আসেনি।
বিষয়: সাহিত্য
১৯০৩ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
পরেরটা দিয়ে দিন....
কোন মন্তব্য করব না..
মন্তব্য করতে লগইন করুন