চিঠি- ১৯ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১০ আগস্ট, ২০১৬, ০১:৫৭:৫৫ দুপুর
রমজান মাস, হাসান চেয়ার টেবিলে বসে কোরান শরিফ পড়ছে, আর ফেরদৌসী অবসন্ন দেহে শুয়ে আছে। ইফতারির খুব বেশি দেরি নেই। ডাল, ছোলা বোট ভিজিয়ে রেখেছে কিন্তু ইফতার তৈরির তার কোন হুস জ্ঞান নেই। রোজা রেখে বিকাল বেলায় সবারই মেজাজ একটু গরম থাকে। হাসান ঘড়ি দেখে বলল, এখনো ইফতার বানাও না তো এশার পরে বানাবে। এই এশার পর কথাটা তার শ্লাঘায় বাজল। সে বলল, আমাকে খাটাতে এত মন চায় কেন, নিজে করেন গিয়ে। - আমি পারলে তো আর তোমাকে বলতাম না। - কামলা রাখা যায় না? - কামলা কেমন পাওয়া যায় জান না? - পাওয়া যায় না নিজে করেন। হাসান ভাবল, যাঃ টুকটাক কাজ নিয়ে প্রতিদিন এত কথা আর ভাল্লাগেনা, নিজেই করব, তেল মরিচ দিয়ে কোন রকম ভাজলেই তো হল। ছোলার বাটিটা হাতে নিল কিন্তু ফেরদৌসী উঠে- এখন আর নিতে দিবে না- বলে টানাটানি শুরু করল, ছোলা পড়ে গেল। হাসান বলল, এখন নিতে দাও না কেন, তোমার মূরোদ তো দেখতেই আছি।
ব্যস মুরোদের কথা বলল, এবার শুরু হল নাচানাচি। সে চোখ পাকিয়ে মাথা ঝাকিয়ে- কি দেখছেন, কি দেখছেন মুরোদের, আমারে কয়ডা কাম কইর্যা দেন, সব কাম তো আমারেই করতে অয়।– এই চোলামুখি (মুখরা) রান্না আর মেয়ের হাগা-মুতা ছাড়া তুই আর কোন কাজটা করস, বাকী কাম তো আমিই করি। সত্য বলায় ফেরদৌসী কথার মোড় ঘুরিয়ে বলল- এত মুরোদের বেটা একটা কাজের মেয়ে রাখার তো মুরোদ পায় না, আবার আমার মুরোদের গপ্প মাড়ায়। রোযার তেজ ঝগড়ায় ঝাঁঝ পায়, শুরু হয় ফাটাফাটি ঝগড়া।
কওমী মাদরাসায় যারা পরে সম্ভবত পান-জর্দা খাওয়া তাদের জন্য সুন্নত, মানে দেওবন্দী সুন্নত। সেই সুবাদে মাদরাসায় পড়াবস্থায়ই হাসান পান জর্দা খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলেছিল। বাসায় পান জর্দা থাকত। ফেরদৌসী ঝগড়া করতে করতে হঠাৎ পান-জর্দার কাছে গিয়ে বসে পরল, তারপর অপ্রাসঙ্গিক ভাবে ভরা জর্দার কৌটা খুলে মুখে ঢেলে দিল। হাসান সিটিয়ে উঠে গিয়ে মুখে ধরল, দুই চোয়ালে চাপ দিল কিন্তু মুখ খুলে না। বেশি জুড়ে দিলে আবার ব্যথা পাবে। এমনিতেই সে দুর্বল, তার উপর সারাদিন রোযা রেখে খালি পেটে জর্দা গেলে তো মরে যাবে। সে রীতিমত আর্তনাদ করে বলতে লাগল, আপা না, আপা না, বইন না আমার, বইন না, তুমি এমন করলে তো আমি মরেই যাব। তোমার মেয়েটার কি হবে। মুখে চাপ দিতে লাগল কিন্তু মুখ খোলে না। অসহায় হয়ে এবার মাফ চাওয়া শুরু করল, আচ্ছা আমার ভুল হয়ে গেছে, এই যে তোমার হাতে ধরলাম মাফ করে দাও। না তবুও হল না। কি আর করা হাঁটুতে ধরে বলল, এই যে তোমার পায়ে ধরি মাফ করে দাও। এবার সে স্বামীর দিকে তাকাল এবং মুখের ঝামটি ছাড়ল। তারপর হাসান দৌড়ে গিয়ে পানি এনে স্ত্রীকে বাইরে নিয়ে কুল্লি করাল। এসব সে করে স্বামীকে শাস্তি দেয়ার জন্য। এটা হল শুকনা গো চিবিয়ে অন্যের মুখে থু থু দেয়ার নামান্তর, এটা ওদের পারিবারিক স্বভাব, তার বোনদের মধ্যেও এ চরিত্র দেখা যায়। তবে এ দিন থেকে স্বামী বেচারার প্রমোশন হল। আগে ঝগড়ার সময় মৌখিক মাফ চাইলেই হত, তারপর হাতে ধরতে হত আর এ দিন থেকে পায়ে ধরা ছাড়া গত্যান্তর থাকল না।
একদিন সকালে মাদরাসায় যাওয়ার আগে হাসান বলল, বিকালে এক অনুষ্ঠানে যেতে হবে, কাপড়গুলি ধুয়ে তৈরি করে রেখ। বিকালে এসে দেখে কিছুই করেনি। খাওয়া দাওয়া করে বের হওয়ার সময় বলল, দুনিয়ার বউয়েরা স্বামীর খাওয়া পরার দিকে খেয়াল রাখে আর আমি কি খেলাম, কি পরলাম তুমি জীবনে কোন দিন তাকিয়েও দেখ না, বেশি গুণধর বউ চাইছিলাম, এজন্যই আল্লায় কপালে জোটাইছে এক অলুম্ভুত। এ জাতীয় দু’চার কথার পর বলল, কপালে দুঃখ আছে। কথাটা অনেকে অর্থহীন ভাবে এমনিতেই বলে, সেও তেমনি বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। দরজার বাইরে গিয়ে বুঝল ঘরে কিছু শব্দ হচ্ছে। দাঁড়িয়ে কান পাতল, শব্দটা ঘরের দেয়ালে হচ্ছে। ভড়কে গিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে দেখে, সে শুয়ে সর্বহারার মত ফুলে ফুলে কাঁদছে আর দেয়ালে পা মারছে। স্বামীকে দেখেই বলল, দেখেন আমার আম্মুডারে কত সুন্দর দেখা যায়, আম্মুডারে কত সুন্দর দেখা যায়। আমার আম্মুডার কি হবে? মুনীরা তখন ঘুমিয়ে ছিল।
হাসান বুঝতে পারল, তার কথায় তার বউ ধরে নিয়েছে তাকে দিয়ে দিবে। আর তখন মেয়েটা মা অথবা বাবা হারা হবে। লক্ষ কোটি বিচ্ছু যেন তার কলজেটা কামড়ে ধরল। অসহ্য যন্ত্রণায় স্ত্রীর উপর ঝাঁপিয়ে পরল। একটানে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরে স্ত্রীর মুখে মুখ লাগিয়ে কেঁদে ফেলল- তুমি কেন এমন কথা বললে, কেন বললে? সারাটা জীবন ইয়াতিম হওয়ার মাসুল দিয়ে এসেছি, এখন আমার জীবন থাকতে আমার সন্তান ইয়াতিম হবে- কেন তুমি এমন চিন্তা করলে। বউকে পাগলের মত আদর করতে লাগল। সেও বসে নেই, হাত উঠিয়ে স্বামীর পিঠে কাঁধে মাথায় মমতার পরশ বুলাতে লাগল। এ এক স্বর্গীয় অনুভূতি। কিচ্ছুক্ষণ আদর করে ওকে বিছানায় রেখে হাসান গিয়ে দুধ গরমে দিল। এমনিতে যে বেচারি কাজ করে দেয়ার জন্য সারাক্ষণ ঝগড়া করে সে যেন লজ্বা পেয়ে বলল, আপনাকে করতে হবে না, আমি গরম করে খাবনে। হাসান বলল, না তুমি শুয়ে থাক আমি আনছি। তারপর গ্লাসে দুধ ঢেলে এনে ওকে তুলে বুকের সাথে লাগিয়ে নিজ হাতে দুধ খাইয়ে দিল। স্ত্রী খুশি, তারপর সে বাইরে চলে গেল।
মুনিরা তখন হামাগুরি দিতে শিখেছে, অনেক সময় খাট থেকে পরে যায়, মা কাছে থেকেও ধরতে পারে না। কাজেই ফেরদৌসী মেয়েকে রাখার জন্য মেকাপ বক্স নিয়ে খাটে বসল। খাটের পূর্ব পাশে দেয়াল পশ্চিম পাশে মেঝে। মেয়েকে পূর্ব পাশে রেখে হাসান বারবার বলল, খেয়াল রেখ আবার যেন পরে না যায়। কিন্তু এরপরেও তার আস্থা হচ্ছিল না, তাই পিঠে ধাক্কা দিয়ে বলল, কী বলছি শুনেছ? বউ রেগে বলল, আরে শুনলাম তো আর কত। এবার সে গোসলে গেল। কিন্তু দুই তিন মিনিট পর শুনে ধপাস, সেই সাথে বিকট কান্না। বাথরুম ছিল অনেকটা দুরে। হাসান ভিজা কাপড়েই লাফ দিয়ে বের হয়ে ধীরে ধীরে আসল এই ভেবে যে, আমি যেতে যেত তো তার মা-ই তোলে নিবে। কিন্তু দরজায় গিয়ে দেখে বাচ্চা এখনো নিচেই চিত হয়ে পড়ে আছে আর মহারাণী এতক্ষণে পূর্ব মুখী থেকে পশ্চিম মুখী ফিরতে সক্ষম হয়েছে মাত্র। হাসান ত্বরিতে ভিজা শরীরেই মেয়েকে টান দিয়ে কোলে নিয়ে চোখের পলকে বাইরে চলে গেল, ঘোরাফিরা করে ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে কান্না থামাল।
তারপর ঘরে ঢোকে দেখে সে এখনো মেঝেতে দাঁড়িয়েই আছে। বলল, এত করে বলে গেলাম তবুও কাছ থেকে মেয়ে পড়ে যায় কেমনে? সে ঘাড় বাকিয়ে চোখ বড় করে হুবহু এ কথাটা বলল, তুই ধরলি না কেন? তার মাথাটা চক্বর দিয়ে উঠল- হারামজাদি কয় কি, একটা চড় মারল। এই যে সর্বনাশ করল, মৌচাকে ঢিল পড়ল। স্বামীর উপর অগ্নি দৃষ্টি হেনে মাটিতে শুয়ে পরল। তারপর কাঁদতে কাঁদতে- অসভ্য জানোয়ার, বউয়ের গায়ে হাত তুলে, ছোট লোক রিকশাওয়ালা, ইত্যাদি মুখে যা আসল গালাগালি করতে লাগল। সে বাচ্চাকে মায়ের পাশে বসিয়ে রেখে গোসলে চলে গেল। হাসান আড়াই বছরের দাম্পত্য জীবনে স্ত্রীকে তিন দিন মেরে ছিল। প্রথম বাসায় আট দিনের মেয়েকে মারার জন্য, এদিন এবং তাদের বাড়িতে একবার পা দিয়ে দুটা গুতা মেরেছিল। গোসল থেকে এসে দেখে ঐ অবস্থায়ই পরে পরে কাঁদছে। সে জানে মাফ না চাইলে উঠবে না, আর যদি বিয়ে বাড়িতে না যেতে পারে তাহলে তো আর রক্ষে নেই, তার মাথায় ডিম ভেজে খাবে। কী আর করা, মাফ চাইল কিন্তু হাতে পায়ে ধরল না। আর এ জন্য যদিও বিয়ে বাড়ির তাড়নায় সে উঠল কিন্তু মন ভাল হল না। গুমরাহ মুখেই গেল বিয়ে বাড়ি।
বিয়েতে ফেরদৌসীর চেংড়া দুটি মামাত বোন এসেছিল যারা তার চেয়ে সুন্দরি ছিল না, এরা তিনটাই ছিল লম্বায় পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চির উপড়ে, তবে নাকের গাঠনিক সঙ্কেতে পার্থক্য ছিল। হাসানের সাথে নতুন সাক্ষাত হিসাবে পরিচয় ও কোশল বিনিময় হল। অপরিচিত মেয়েদের সাথে সে কথা বলে না, বলতে পারে না। হয়ত সে যোগ্যতা নেই, সাহসও নেই। কারণ প্রথমত সে ছিল মাদরাসা পড়ুয়া, দ্বিতীয়ত পাঁচটি ভাইয়ের অভিবাবক, তারা যদি বুঝতে পারে যে, ভাই মেয়ে নিয়ে টাংকি মারে- তাহলে প্রতিযোগিতায় নামবে। সঙ্গত কারনেই তাকে সতর্ক হয়ে চলতে হত। বিশ্ববিদ্যালয়েও সে মেয়েদের থেকে দুরত্ব বজায় রেখে চলত।
এর মধ্যে সে স্বামীর চোখের দিকে তাকিয়ে আন্দাজ করতে চাইল কোথায় তাকিয়ে আছে। কারণ তার নিয়ম হল, যখন সে স্বামীর সাথে বাইরে বের হয় আর সামনে কোন সুন্দরি মেয়ে দেখা যায়- তখন সে স্বামীর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকবে। যদি দেখে হাসান সেই পাশে তাকিয়েছে, চাই মেয়েটির দিকেই হউক বা অন্য কোন কিছুর দিকে ব্যাস তাহলেই হল? দুনিয়ার যত বাঁশ আছে আইখ্যা ওয়ালা আর বেআইখ্যা ওয়ালা সব তাকে দিবে, কোন কসুর করবে না। এটি ছিল তার ভাল দিক। হাসান ভাবত, এমনিভাবে সংসারের সব কিছুই যদি সে বুদ্ধিমত্তার সাথে নিয়ন্ত্রন করতে পারত- যা ছিল আমার আজন্মের কাম্য- তাহলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করতাম।
কিন্তু সে যখন দেখল হাসান তার মামাত বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে দুয়েকটা কথা বলছে তখন সে ক্ষেপে না গিয়ে তার গুমরাহ মুখটা আরো কালি হয়ে গেল। আর এ বিষয়টা হাসান বুঝতে পারল। কারণ এতদিনে স্ত্রীর মনের প্রতিটা বিন্দু বিসর্গ পাঠ করার যোগ্যতা তার হয়ে গেছে, সে নিজের বউকে চেনে। বোকাটা ভাবছে, স্বামী তাকে পসন্দ করে না, তার দুই মামাত বোনকে পসন্দ করে, ভালবাসে। তাকে ভালবাসে না বলেই চড় মেরেছে। আর যদি ভালবাসত তাহলে মেয়েকে ফেলে দেয়া কেন একদম মেরে ফেললেও বড় জোর এতটুকু বলত- মেয়েটাকে মেরে ফেললে? আচ্ছা তুমি যখন মেরেছ তাহলে ঠিকই আছে, সমস্যা নেই। এ জন্যই তার মুখ কালি হয়ে গেছে। হাসানের মনটা বিষিয়ে উঠে- হায় আল্লাহ, এমনি এক আজীব চিড়িয়া আমার কপালে বরাদ্দ দিলে।
আগের বাসায় প্রথম মাস ফেরদৌসীর কাজ-কর্ম সবই ঠিক ছিল, কিন্তু দ্বিতীয় মাসে গিয়ে দেখা দিল বিশৃঙ্খলা ও অসময়ে ঘুম। কিন্তু এ বাসায় আসার পর তার নিয়ম শৃঙ্খলা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গেল। অসময়ে ঘুমিয়ে থাকত, ডাক দিলে এক ঘণ্টা পর্যন্ত কাঁদত, স্বামীকে গালাগালি করত আর বলত- আমার বাপে আমারে কত আদর করত। এ কথা দ্বারা সে স্বামীর কাছে বাপের আদর কামনা করত।
বিষয়: সাহিত্য
১২৭৩ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সম্ভবত জুলাই বা আগস্টের ঘটনা। লন্ডন প্রবাসি ফেরদৌসীর এক খালাতো ভাইয়ের বিয়ে। সেখানে যেতে হবে। হাসান তাকে বলল, তুমি আগে গিয়ে গোসল করে আস, আমি মেয়েকে নিয়ে বসলাম। সে গোসল করে এসে ব্রিফকেস খুলে শাড়ি পরল, গয়না পরল, তারপর মেকাপ বক্স নিয়ে বসল। হাসান নয়ন ভরে দেখে, তারা সবাই কট্টর তাবলীগি- আমীর সাব হুযুর। কখনো শাড়ি পরে না, চকচকে কাপড় পরে না, কম দামের রংচটা থ্রি পিস পরে, দেখতে কাজের মেয়ের মত লাগে। হাসান কত বলেছে কিন্তু কোন দিন সাজেনি। অথচ সাজলে তার চেহারাই পাল্টে যায়, কত মজা লাগে। কিন্তু তার হাসি পেল এজন্য যে- বেচারি আমার জন্য কোনদিন সাজেনি আজ বিয়ে বাড়ির জন্য সাজছে। অথচ কেউ তাকে দেখতে পাবে না, কালো কাপড়ে মোড়কজাত হয়ে যাবে- তেমনি আসবে। তাহলে এ সাজার লাভটা কি হল। কিন্তু আমি যদি সাজতে বলি তাহলে আরো নোংরা হয়ে থাকবে, আমার কথার বিপরীত করাই তার ধর্ম।
মন্তব্য করতে লগইন করুন