চিঠি- ১৮ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ০৮ আগস্ট, ২০১৬, ০১:৫৫:৩৯ দুপুর
২য় বাসাঃ
ফেরদৌসী ফ্ল্যাট- বাসায় উঠতে চাইল, স্বামীকে নিয়ে খোজা খুজি করল কিন্তু পেল না। তবে ফ্ল্যাটের জন্য গু ধরে নি। আবার পর্দাসহ ভাল মানের বাসা পাওয়া কঠিন, অধিকাংশই যৌথ বাসা। অবশেষে অনেক খোজাখুজির পর আগের বাসা থেকে কিছুটা উত্তরে চলনসই একটা বাসা পাওয়া গেল। উত্তর দক্ষিনা ঘরে বড় বড় দুটি রুম। দক্ষিনের রুমটিতে তারা বেড রুম বানাল। এ রুম সংলঘ্ন বড়সড় রান্না ঘর। দরজা মাঝখানে থাকায় খাটে বসে রান্না ঘরের ভেতর দেখা যায়। সামনে ছোট একটু উঠান। উত্তর পাশে রুম সংলগ্ন গোসল খানা, তারপর টিউবওয়েল, তারপর টয়লেট- যা থাকার ঘর থেকে পনের বিশ ফুট দূরে।
দ্বিতীয় বাসায় উঠে আরো নতুন নতুন উপসর্গ দেখা দিতে লাগল। এখানে এসে সে হয়ে গেল একদম খুকী। কোন খুকীর যেমন রান্না- বান্না ঘর কন্যা বা সংসারের কোন দায়িত্ববোধ থাকে না, খেলার পর তার খেলনাটি কোথায় পরে থাকল সে সম্পর্কে তার কোন চেতনাবোধ থাকে না, ফেরদৌসীর অবস্থায়ও ছিল তদ্রুপ। স্বামী সন্তান সংসার সম্পর্কে তার কোন দায় দায়িত্ব, চেতনা ও অনুভূতি ছিল না। আসলে সে ছিল অনুভূতিহীন প্রাণীর মত। তার একটাই চেতনা ছিল অহংকার দাম্ভিকতা আর ঝগড়া। সর্বদাই ঘর থাকত অগোছালো। তাদের ও বাচ্চার কাপড়-চোপড় বিছানার উপর, মাটিতে ও এখানে সেখানে পরে থাকত, কখনো সামলিয়ে রাখত না। বিছানার চাদর উল্টে জড় হয়ে থাকত, বাসন কোসন ইতস্তত বিক্ষিপ্ত পরে থাকত। ভাত তরকারীর পাতিল উদোম থাকত। এ সম্পর্কে তার কোন চেতনা বা অনুভূতি থাকত না। স্বামী কিছু বললেই ঝগড়া বেধে যেত। বাচ্চা বিছানায় পেশাব পায়খানা করে সমস্ত শরীর, মুখে মাথায় লাগাত, বিছানায় ছড়িয়ে দিত কিন্তু তার হুস থাকত না।
একদিন রাতে হাসান বলল, অন্যরা বাচ্চাদের পটে পেশাব পায়খানা করায় তুমি পার না? - না আমি পারি না।- কেন পার না?- আমার এত যোগ্যতা নাই।- আরে বাচ্চাদের পেশাব পায়খানা করাতে যোগ্যতা লাগে না। আগে না শুনেছিলাম এত যোগ্যতা, এখন সেই যোগ্যতা গেল কোথায়? স্বামী বেচারা যোগ্যতার প্রশ্ন তুলেছে, আর যায় কোথায় বাবা। মেয়েটাকে থ্যাকনা মেরে খাটের উপর রেখে- সে সময় চোখ পুটকিতে (পাছায়) ছিল, যোগ্য দেখে করতে পারল না। আমি এত যোগ্য না, যারা যোগ্য তাদেরকে নিয়ে আসুক গিয়ে - বলতে বলতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। হাসান মেয়ের কান্না থামাতে ব্যস্ত। কিছুক্ষণ পর খোঁজা খোঁজি শুরু করল, পাশের রুমে নাই, সামনে একটু উঠোন ছিল সেখানেও নাই, বাথরুমেও নাই। সে পেরেশান হয়ে গেল- চলে গেল নাতো আবার? অবশেষে গেল রান্না ঘরে, লাইট জ্বালানোই ছিল। দেখে তো হাসিতে বেচারার পেট ফেটে যাওয়ার উপক্রম, অনেক কষ্টে হাসি আটকে রাখল। কারণ হাসলে কপালে দুঃখ আছে। রান্না ঘরের কোণায় খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছে, এটুকুতেই তার মাথায় এমনই রাগ চড়ে গেছে যে, গায়ের জামা খুলে মেঝেতে ছুড়ে ফেলেছে।
হাসান জামাটা হাতে নিয়ে- এই এই শুনছ- বলে তার বাহু ধরে নাড়াতে লাগল। হঠাৎ চমকে উঠে দুই কাঁধে আড়াআড়ি ভাবে হাতের তালু রেখে মেয়েরা যেভাবে বুক ঢাকে- সেভাবে ঢেকে বলল, আমার জামা কোথায়? স্বামী হাত উঠিয়ে দেখাল, তার হাতে। সে চোখ গরম করে বলল, খোলছেন কেন? হাসান বলল, আমি নয় তুমিই খোলেছ। জামা পরার পর সে হাত ধরে টানে কিন্তু বউ ভূতের মত ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল, আসবে না। তখন হঠাৎ তার মনে পড়ল, তার তৃতীয় দুলাভাই বজলু একদিন ফেরদৌসী সম্পর্কে বলেছিল, সাংঘাতিক রাগী। রাগ করে গিয়ে কোথাও দাঁড়িয়ে থাকবে, তখন কোলে করে ঘরে আনতে হবে। হাসান তাই করল, পাজা কোলে করে এনে খাটের উপর বসিয়ে দিল।
একদিন হাসান মসজিদ থেকে জহুরের নামায পড়ে এসে দেখে দু’দিন আগে কিনে আনা ফুল ঝাড়ুটা খোলে আওলা ঝাউলা হয়ে পড়ে আছে। স্ত্রী শুয়ে আছে, জিজ্ঞেস করল, এটা খুলল কেমনে? ফেরদৌসী বলল, ঝাড়ু দিতে গিয়ে। হাসান বসে সেগুলি ভাজ করতে করতে বলল - তখন বাধতে পারলে না?
- না আমার এত ক্ষেম (ক্ষমতা) নাই।
- আরে বাবা, একটা ঝাড়ু বাধতে ক্ষেমের দরকার হয় না। তুমি একটা ঝাড়ু বাঁধতে পার না, সংসার চালাবে কেমনে? – আমি কারো সংসার চালাতে আসিনি। - তাহলে কি করতে এসেছ? –জানস না কি করতে আইছি। - কি করতে আইছ? – তোর শখ মিটাতে আইছি। - বউয়েরা শখও মিটায় কাজও করে। - করে না, কাজের মেয়েরা কাজ করে। - বউ থাকলে কাজের মেয়ের দরকার হয় না। - তাহলে কাজের মেয়ে থাকলে বউয়ের দরকার হয় কেন? এই কিপটে ছোদা কামলা রাখতে পারস না। ব্যস শুরু হয়ে গেল ভীষণ ঝগড়া। কিছুক্ষণ ইছা (চিংড়ি) মাছের মত নাচল। তারপর বোরকা পরে বলল, আমি থাকব না। যাদের ক্ষেম আছে তাদেরকে নিয়ে ঘর কর, আমি গেলাম গা। সে আগেও বহুবার থাকবে না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে চেয়েছে। তাই স্ত্রীকে ভয় দেখানোর জন্য হাসানও চিন্তা- ভাবনা ব্যতীত রাগের মাথায় বলে ফেলল- এই এই ঘর থেকে বের হবি না। ঘর থেকে বের হলেই তুই তালাক হয়ে যাবি। ব্যস, সর্বনাশ করল, পাগলের হাতে খুন্তি তুলে দিল। এখন তার জিদ হল সে ঘর থেকে বের হবেই।
এর অর্থ আসলে চলে যাওয়া নয়, বরং স্বামীকে শাস্তি দেয়া, ঘায়েল করা। কিন্তু স্বামী বেচারা মরিয়া, তাকে বের হতে দেবে না, তাহলে তো তালাক হয়ে যাবে। শুরু হয় টানা হেঁচড়া, সে কখনো মেয়েকে নিয়ে, কখনো মেয়েকে রেখে বের হওয়ার চেষ্টা করছে আর হাসান জাবরে ধরে রাখছে। দীর্ঘ সময় এভাবে টানা হেঁচড়া চলতে থাকে। অনেকক্ষণ হুরা হুরি ও ঝাকুনি দিয়েও যখন স্বামীর বাহু বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারল না, তখন মৃদু হাসি দিয়ে বলল, ছেড়ে দেন যাব না। হাসান ছেড়ে দিল আর এ সুযোগে চোখের পলকে সে খোলা দরজা দিয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। সে বিজয়ি, হাসি মুখে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হাসান স্তম্ভিত, জূলার মত ঘরের মেঝেতে দাঁড়িয়ে আছে। সে দরজার সামনে থেকে আরেকটু অগ্রসর হল কিন্তু কেউ দেখে ফেললে পর্দা নষ্ট হবে, গুনাহ হবে বিধায় আবার তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকল। কিন্তু এমন একটা জঘন্য কর্ম করল এবং বিনা অন্যায়ে স্বামীকে এতটা কষ্ট দিল- তজ্জন্য ভয় পেল না- এই হল এদের ধার্মিকতা। হাসান হতাশায় বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। ব্যস তার শাস্তি হয়ে গেছে।
কী হল এ বিষয়ে তার মাথা ব্যাথা নাই, স্বামীকে শাস্তি দিতে পেরেছে এটাই তার বড় প্রাপ্তি। যে ঝাড়ু নিয়ে এতকিছু হল- তা বাধল এবং মনোযোগ সহকারে অন্যান্য কাজ শুরু করে দিল। যা ঘটল তাতে হাসান ভিত, কারণ তালাক তো হয়ে গেছে, তবে সে জানে যে রুজু করলে সংশোধন হয়ে যাবে। সে নিজেকে মনে করত ধৈর্য্যশীল, তারপরেও এমন বোকামি শর্ত কেন করল। আসলে সে বুঝতে পারেনি এমন শর্তের উপর স্ত্রী জেদ ধরবে। এমন লজ্বাজনক ঘটনায় নিজের প্রতি ধিক্কার আসছিল।
তখন জ্যৈষ্ঠ প্রায় শেষ, আম কাঁঠালের সিজন উপলক্ষে মা বারবার বাড়িতে যাওয়ার কথা বলছে। তাই সতর্কতার খাতিরে স্ত্রীর সাথে দুরত্ব বজায় রাখল এবং বিয়ে পড়ানোর জন্য পরদিনই বাড়িতে চলে গেল। সেখানে আসল কথা না বলে ঘুরিয়ে বলল যে, মানুষ এমন কত কথা বলে বা কাজ করে ফেলে যে, তাতে বিয়ে ভেঙ্গে যায়। তাই প্রত্যেকের উচিত কিছু দিন পর পর বিয়ে নবায়ন করে নেয়া। তারপর মাকে সামনে রেখে, দুই ভাইকে আড়ালে রেখে স্ত্রীকে বলল, আমি প্রস্তাব করব, তুমি শুধু রাজি বা কবুল বলবে। ব্যস বিয়ে নবায়ন হল।
এটা ছিল ধান কাটার সিজন। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে ঘরে বাইরে উঠোনে খাটের তলায়, টেবিলের তলায় মাচার উপড়ে নীচে সর্বত্র ধান আর ধান, পা ফেলার জায়গা নেই। ওদিকে ঘটল আরেক বিপত্তি। হাসানের ছোট ভাইয়ের বউ বাড়িতে বেড়াতে গেছে। সঙ্গত কারণেই রান্নার দায়িত্ব বর্তেছে ফেরদৌসীর উপর। যে বেচারি বাসায় টুকটাক কাজের জন্য স্বামীর সাথে অনুক্ষন ঝগড়া করে তার মাথায় যেন কুড়ালের কূপ। কথায় কথায় রাগ করে আর স্বামী ও শাশুড়িকে বলে আপনাদের সামর্থ নাই, কাজের মেয়ে রাখতে পারেন না? কিন্তু বাস্তবতা হল শহরে কাজের মেয়ে পাওয়া গেলেও গ্রামে তা পাওয়া কতটা দুস্কর তা এক মাত্র ভুক্তভোগিরাই জানে। কারণ কাজের লোকেরা এখন সবাই শহর মুখী, তাছাড়া কাজের মেয়ে দিয়ে কেউ রান্নাবান্না করায় না। হাসান ছোট ভাই বউ সম্পর্কে তাকে বুঝিয়ে বলল যে, মেয়েটা সব সময় কাজ করে এখন তুমি এসেছ, এ ক’টা দিন একটু কষ্ট কর। না হলে যে ভীষণ বদনাম হয়ে যাবে। এই সামান্য রান্না বাড়াই তো, বড় কোন কাজ তো আর না ইত্যাদি বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে রেখে কয়েকদিন পর হাসান চলে এল।
সে আসার পরদিন রাত্রে ইঞ্জিনিয়ারের এক ছেলে এসে জানাল, ফেরদৌসীর মা, বড় বোন, ছোট ভাই ও বাচ্চা-কাচ্চাসহ সাত আটজন লোক তাদের বাড়িতে গেছে। শুনে সে থ মেরে গেল। কারণ প্রথমত তারা কাউকে না জানিয়ে হঠাৎ চলে গেছে, দ্বিতীয়তঃ এটা বেড়ানোর সিজন নয়, গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে ধানের স্তূপ। তাদের জমিও বেশি ধানও বেশি। আবার গরম সিজন, তার উপর ধানের গরম, তখনো বিদ্যুৎ যায় নি, ফ্যান নেই, আবার এতগুলি মানুষের থাকার সমস্যা- তাদের তো খুব কষ্ট হবে। সে বাড়িতে নেই, এতগুলি মানুষের থাকা- খাওয়া আদর আপ্যায়নের ব্যাপার আছে, কী হয় না হয়। সে রাত্রেই রওয়ানা করতে চাইল কিন্তু লাভ নেই। কারণ এত রাত্রে গাড়ি পাওয়া যাবে না, আবার পরদিন নাকি তারা এসে যাবে। হাসান চিন্তায় পড়ে গেল। সেই সাথে ফের একবার বুঝতে পারল, এদের বোধ- বুদ্ধি, বিচার- বিবেচনা ও হুস- জ্ঞান বলতে কিছু নেই। এ ধানের সিজনে না বলে এতগুলি মানুষ কী করে গেল।
পরের দিন বিকালে ঈশ্বরের দরবারে তার ডাক পড়ল, এখানে ইশ্বর বলতে বুঝতে হবে ওদের বড় বোন মাজেদা। তিনি তার বাবার পরিবার ও স্বামীর পরিবারের কর্ত্রী ছিলেন না, ছিলেন ইশ্বর। হাসান গেল এবং ঈশ্বরের পয়গাম পেল। তিনি বার্তা পাঠালেন, এক্ষুনি এ মুহুর্তে গিয়ে তার বোনকে নিয়ে আসতে হবে, তার বোনের সেখানে কষ্ট হচ্ছে। বউকে বোনের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময়ও সে একই পয়গাম পেয়েছিল।
এখন হাসানের মাথায় শাখের করাত, কারণ তার বউকে নিয়ে আসলে তার মায়ের কষ্ট হবে। এ ক্ষেত্রে আল্লাহ্র বিধান হচ্ছে মাকে কখনোই কষ্ট দেয়া যাবে না। কিন্তু স্ত্রীর পারিবারিক বিধান হচ্ছে স্ত্রীকে কষ্ট দেয়া যাবে না, মা গোল্লায় যাক। আর তখন হাসান স্ত্রীর পরিবারিক বিধান মানতেই বাধ্য হয়েছিল। কারণ তার স্ত্রী সর্বদা ঝগড়া করত তার দুলা ভাইরা ভাল সে খারাপ। এর মূল কারণ, এদের পারিবারিক বৈশিষ্ট হল, এ পরিবারের মেয়েরা কখনো স্বামীর বাড়িতে বা স্বামীর পরিবারে থাকে না। আলাদা বাসা নিয়ে থাকে সেখানে স্বামী বা তার পরিবারের কোন কর্তৃত্ব থাকে না। বস্তুত এদের মেয়েরা হয় স্বামী আর স্বামীরা হয় স্ত্রী বা কৃতদাস। তখন তারা তাবলীগের উপর ভিত্তি করে তাদের বাপের পরিবার ও বোনদের নিয়ে একটা সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। সেখানে স্বামীর কোন কর্তৃত্ব থাকে না, তাকে পদানত করে রাখা হয় ও তার পরিবারের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়। আর এই কৃতদাসদের প্রথম ও প্রধান হচ্ছে তাদের বড় ভগ্নিপতি ইঞ্জিনিয়ার আব্দুর রউফ। ফেরদৌসীও চাইত তার স্বামী এমন হউক, বাড়ির সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করুক। কিন্তু হাসানের বিষয়টা ছিল কিছুটা ব্যতিক্রম। কারণ তখনো সে তার পরিবারের কর্তা, তজ্জন্য তাকে ঘন ঘন বাড়িতে যাওয়া আশা করতে হত। আর এটা তার স্ত্রী পসন্দ করত না, ঝগড়ার সূত্রপাত হত। সঙ্গত কারণেই সেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল অন্যান্য দুলা ভাইদের মত স্ত্রীর অনুগত হতে।
কাজেই তাদের পারিবারিক ইশ্বর যখন তার বোনকে নিয়ে আসার হুকুম জারি করল- তখন হাসান প্রমাণ করার সুযোগ পেল যে, সে স্ত্রী ও তাদের পরিবারের কৃতদাস হয়ে গেছে। সুতরাং বিনা বাক্য ব্যয়ে অবনত মস্তকে সে তৎক্ষণাৎ হুকুম তামিল করতে ছুটল। এবার সে প্রমাণ করার সুযোগ পেল যে, সে এ পরিবারের যোগ্য জামাই, দাসত্বে অন্য জামাইদের চেয়ে পিছিয়ে নেই। অথচ বউকে নিয়ে এলে তার মায়ের কতটা কষ্ট হবে তা সে জানত। আগে ধান বানা ও ধান সামলানোর কাজ কাজের মহিলারা করত বটে কিন্তু সংসারের যাবতীয় কাজ তিনি একাই সামাল দিতেন। তিনি ছিলেন শক্তিশালী এবং কর্মঠ । রান্নায়ও ছিলেন পাকা, আশপাশের বাড়িগুলিতে বিয়ের রান্না বান্না পর্দার আড়ালে বসে তাকেই করতে হত। কিন্তু হাসানের বাবার ইন্তেকালের পর তিনি অনেকটা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। কোন কিছু ঠিকমত বুঝতেন না, কাজ কর্ম করতে পারতেন না, রান্না তো একদম পারতেন না। কারণ আগুনের কাছে গেলে মাথা ঘামত ও প্রচন্ড ব্যথা হত। সমস্যা হত না, কারণ তার বোনেরা ছিল, কাজের মহিলা তো ছিলই। কিন্তু এখন তো কেউ নেই, তার বউকে নিয়ে আসলে মায়ের বিপদটা তার অজানা ছিল না। কিন্তু বাসন্তির স্বামী যেমন মায়ের জন্য বউকে বিসর্জন দিয়েছিল, তেমনি সে বউয়ের জন্য মাকে বিসর্জন দিল। বাড়িতে পৌঁছে মাকে বলল, তার মা ও বোন নিয়ে যেতে বলেছে, হয়ত কোন দরকার আছে। শুনেই মায়ের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল, তার বুঝতে বাকী রইল না। কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে- নিয়ে যা, বউয়ের এখানে কষ্ট হচ্ছে, শহরে থেকে অভ্যাস, এখানে পাখা নাই, গরম- বলতে বলতে চলে গেলেন। তিনি স্বাবাভিকভাবে কথাগুলি বললেও বুঝা যাচ্ছিল, সেখানে হাজারটা মিনতি ও অসহায়ত্ব ঝড়ে পরছিল।
হাসান জানে, কয়েক দিনের মধ্যে তার ছোট ভাই- বউ এসে যাবে, কিন্তু স্ত্রীর পরিবারের প্রতি আনুগত্য দেখাতে গিয়ে এ কয়টা দিনও সুযোগ দিতে পারল না। পরদিন সকালে সে ছোট ভাইয়ের বউকে নিয়ে আসার উপদেশ বাতলিয়ে নিজের বউকে নিয়ে রওয়ানা হল। এবারও শাশুড়ির আদর যত্ন ও কান্নাকাটি দেখে ফেরদৌসী বলল, আম্মা মেয়ে বিদায় করে। এভাবেই হাসান মায়ের উপর স্ত্রীকে প্রাধান্য দিল, আল্লাহ্র হুকুমের উপরে ওদের পারিবারিক ইশ্বরকে প্রাধান্য দিল। অথচ তার বাবা মারা যাওয়ার পর সে সারাটা জীবন সাধনা করেছে মায়ের মুখে একটু হাসি ফোটানোর জন্য। এ একটি কাজ ব্যতিত মায়ের কষ্ট হতে পারে এমন কোন কাজ সে জীবনে কোন দিন করেনি।
এ ঘটনায় সম্ভবত আল্লাহ্ তা’লা তার উপর এতটাই অসন্তুষ্ট হয়ে ছিলেন যে, কিছু দিন পরই তিনি তাকে শাস্তি দিলেন, নির্মম শাস্তি। এ জন্যই মাতৃ- জঠরে জন্ম নিয়েছে, মায়ের দুধ পান করেছে এমন প্রত্যেক সন্তানের জন্য এখানে, ঠিক এইখানে উপদেশ রয়েছে।
বিষয়: সাহিত্য
১৩৭৭ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন