চিঠি- ১৫ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ০২ আগস্ট, ২০১৬, ০১:৫৬:০৫ দুপুর
১ম বাসা।
বিচিত্র পৃথিবী, আরো বিচিত্র মানবাকৃতি-অবয়ব, তার চেয়েও বিচিত্র মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি। হিংসা, অহংকার, আত্মশ্লাঘা, বদমেজাজ, নিষ্ঠুরতা এগুলি পুরুষ চরিত্রে প্রকাশ ঘটলে দোষনীয়তার সাথে কোন রকম খেটে যায়। পক্ষান্তরে নারী চরিত্রে বিকাশ ঘটলে সেখানে বিপত্তি অনিবার্য। আর এ বিপত্তির ঘনঘটাই ছেয়ে ফেলেছিল হাসান ফেরদৌসি দম্পত্তির ভাগ্যাকাশ। কারণ স্বভাব প্রকৃতির দিক থেকে এরা দু’জন ছিল দুই মেরুর। হাসান ছিল কোমল হৃদয়, ধৈর্যশীল, নিরহংকারী, চিন্তাশীল। অতীত জীবনে সে এর প্রমাণ রেখে এসেছে। যেখানে কোন বাবার পক্ষে পাঁচটি ছেলেকে আয়ত্ব রাখতে নাভিশ্বাস উঠে, সেখানে হাসান ধৈর্যশীল ছিল বলেই ভাই হয়েও উগ্র প্রকৃতির পাঁচটি ভাইকে সুপথে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। সে চিন্তাশীল ছিল বলেই শিক্ষা ও সম্পদে বাবার সংসারে অবদান রাখতে পেরেছিল। সে বহুমুখি ও উচ্চ শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও তার মধ্যে কোন অহংকার ছিল না।
পক্ষান্তরে তার স্ত্রী ছিল অন্তহীন বোকা, ভয়ঙ্কর বদমেজাজি, চূড়ান্ত পর্যায়ের মুখরা আর ছিল মাত্রারিতিক্ত আত্মশ্লাঘা। সে ছোট বেলা থেকে তার বোনদের নারীতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থা দেখেছে, দুলাভাইদের দাসত্ব দেখেছে, তাদের দরিদ্র পরিবারে আত্মীয়- স্বজনদের সাহায্য সহযোগিতা দেখেছে তখন সে মনে করেছে এটাই সমাজ, এটাই নিয়ম। আর সবগুলি বোনের আধা শিক্ষিত ও কোন রকম একেকটা চাকরিজীবির কাছে বিয়ে হওয়ার সুবাদে ফেরদৌসীর দেমাগ উচ্চমার্গে বিরাজ করত। সে নিজেকে ভাবত রাজকুমারী আর কোন রাজকুমারকেই সে একমাত্র নিজের যোগ্য মনে করত। বিয়ের পর তার কিছুটা ঝাঝ প্রকাশ পেলেও আসল রূপ প্রকাশ পায়নি। কারণ নতুন বউ, স্বামীর সাথে লাঠালাঠি তো আর করা যায় না। আবার আগে তার ভয় ছিল স্বামী তাকে পসন্দ করে না, ফেলে চলে যাবে। কিন্তু বাসা নেয়ার পর, সন্তান জন্মের পর আর সে ভয় থাকে না। আবার বিয়ের পর তার উপর সংসারী কোন দায়িত্বও ছিল না। তখন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়িয়ে, হানিমুন করে আনন্দ করে সময় কেটে গেছে। সন্তান পালন, সংসারী কাজকর্ম, স্বামীর দেখাশুনা এসব দায়িত্ব তখন ছিল না। কিন্তু বাসা নেয়ার পর এ দায়িত্বগুলি যখনি তার কাধে চাপল তখনই সে ধীরে ধীরে স্বরূপে আত্মপ্রকাশ শুরু করল। আড়াই বছরে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছল। তারপরই নেমে আসে খোদার গজব।
পর্দা রক্ষা করে চলা যায়- তারা এমন বাসা খুঁজছে। হাসান বউকে সাথে নিয়ে অনেক বাসা দেখাল কিন্তু তার কোন বাসাই পসন্দ হয় না। কোনটা যৌথ- পর্দা রক্ষা করা মুশকিল, কোনটা এক্সট্রা কিন্তু বাসা পসন্দ নয়। ফেরদৌসীর বিলাসী রুচিসম্মত বাসা খুজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ল। অবশেষে রেলগেট বড় মসজিদের দক্ষিণ পাশে একটি বাসা দেখাতে নিয়ে গেল, দেখেই সে খুশিতে আত্মহারা, তার ষষ্ঠ বোন নুরানী আপাও নাকি প্রথম এ বাসায় উঠেছিল। কাজেই সে এখানেই উঠবে অন্য কোথাও নয়। অথচ এ বাসাটি হাসানের পসন্দ নয়, কারণ পুর্ব-পশ্চিমা ঘরটিতে ছোট ছোট দুটি রুম, পুর্ব পাশের বারান্দায় উত্তর পাশে বাথরুম, দক্ষিণ পাশে কিচেন। ফলে পুবালি হাওয়ায় তরকারি রান্নার ঝাঁঝ সবটুকুই ঘরে ঢুকে। আর তখন হাচি দিতে দিতে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠত, তার বাচ্চার অবস্থাও নাযুক হয়ে উঠত, ফলে বাসাটি ছাড়তে হয়েছিল। কিন্তু ফেরদৌসীর পসন্দ হল শুধু এ কারণে যে, তার বোন থেকেছিল অথচ পরে কত সুন্দর সুন্দর বাসা দেখত কিন্তু তার পসন্দ হত না।
হাসান নতুন বাসায় উঠল, শাশুড়িও সাথে এলেন তার বয়স তখন ষাটোর্ধ্ব বা আরো বেশি। বহুদিন যাবত তিনি একটা মেয়েলি রোগে ভোগছিলেন, অপারেশন করলেই ভালো হয়ে যেতেন কিন্তু কোন ছেলে মেয়ের এ দিকে কোন খেয়ালই ছিল না। মায়ের দুঃখ কষ্ট তাদের গায়েই লাগত না। আসলে এরা ছিল বিবেচনাহীন, অনুভূতিহীন অনেকটা যেন ইতর প্রাণীর মত। তিনি কোন মেয়ের বাসায় গিয়েই কাজে লেগে পড়তেন। আর তার মেয়েরা বসে বসে ঠ্যাং নাচাত আর দাঁত বের করে হাসত। সে তাদের বড়াপার বাসায় বহুবার দেখেছে বেচারি ককিয়ে ককিয়ে হাপাতে হাপাতে কাজ করছেন, রান্না করছেন আর তার মেয়েরা খুশ গল্পে মজে আছে, হাসছে, ঘুরছে, আনন্দ করছে। হাসান স্ত্রীকে বহুবার বলেছে মাকে দিয়ে কাজ না করাতে। কিন্তু তারা বিষয়টা গায়েই মাখত না।
কী আশ্চর্য্য, হাসানের বাসায় এসেও তিনি কাজের মেয়ের মত কাজে লেগে গেলেন, আর তার বউ তার সাথে বসে খোশ গল্প জুড়ে দিয়েছে। তখন তার মন চাচ্ছিল ঢাস ঢাস করে স্ত্রীর নাকে মুখে কয়েকটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। কিন্তু ইতিমধ্যেই তার এ অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছিল, ধমক দিলে বা কিছু বললে কাজ তো করবেই না বরং উল্টো তার মাথাটা চিবিয়ে খাবে। হাসান বুঝিয়ে বলল, দেখ মা বাপের খিদমত করা ফরয। অথচ এমন একজন অসুস্থ মানুষ ককিয়ে ককিয়ে কষ্ট করে কাজ করতেছেন আর তুমি জোয়ান মেয়ে বসে বসে তামাশা দেখছ। এটা কিন্তু হারাম, তোমার অন্য বোনেরা যাই করুক আমার এখানে কিন্তু এসব চলবে না বাপু বলে দিলাম। যাও উঠ, উনাকে বিশ্রাম দাও। আমার বাসায় উনাকে যেন কোন দিন কাজ করতে না দেখি। কিন্তু এরা এতই অনুভূতিহীন এবং বেপরোয়া যে তাও উঠে না। হাসান স্ত্রীকে ধাক্কিয়ে, টেনে তুলে পাঠাল। কিন্তু সে রান্না ঘরে গেল, একটু দেখল, দাঁড়িয়ে থাকল তারপর এসে পড়ল। আবার পাঠাল আবার দেখে এসে পড়ল। হাসান রাগ দেখায় আবার পাঠায় আবার আসে, ধ্মক দেয় কিন্তু শুধু যাওয়া আসাই সার হল কোন কাজ করল না। মা থাকলে বাচুক মরুক তাকেই করতে হবে।
তত দিনে হাসান- ফেরদৌসী দম্পতির একমাত্র সন্তান মুনিরা পৃথিবীতে এসে গেছে। ঘর তার চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত। হাসান বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসে বসে ভাবে- কী আর্শ্চয্য, আমার থেকে আরেকটা মানুষ হয়ে গেল? এই হাত-পা, চোখ-মুখ, নাক-কান, সবই আমার? অন্তহীন মমতায় কচি মুখটিতে আলতো করে চুমু খায় আর শুধায়, আব্বু তুমি কার মত হবে, আমার মত না তোমার মায়ের মত? সে হাসে, ক’দিন পর তার বাচ্চা আব্বু আব্বু ডেকে পিছু ছুটবে। একদিন বিকাল তিনটার দিকে ফেরদৌসি শুয়ে বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছে, হাসান খাটের একপাশে বসে আছে। তখন মুনীরার বয়স সাত আট দিন। হাসান অতি সাধারণ একটা কথা বলায় সে ক্ষেপে গেল। আর স্বামীর প্রতি রাগে বাচ্চাটার পিঠে গায়ের জোড়ে ধপাস ধপাস করে পরপর তিনটা থাপ্পড় মেরে লাফ দিয়ে এসে মেঝেতে দাঁড়িয়ে পড়ল। হাসান অনুভব করল যেন তার কলজেটা ছিঁড়ে গেছে। তার আট দিনের মেয়েটা বিকট এক চিৎকার দিয়ে দম বন্ধ হয়ে গেল। চোখের পলকে সে মেয়েকে টান দিয়ে কোলে নিয়ে দৌড়ে পাশের রুমের জানালার ধারে গিয়ে দাড়াল। চরম অসহায়ত্ব নিয়ে বাচ্চাকে বুকের সাথে লাগিয়ে ঝাকুনি দিতে লাগল আর হাউমাউ করে কেঁদে উঠে আব্বু আব্বু বলে পাগলের মত ডাকতে লাগল। কিন্তু মেয়ে তো এই যে বিকট হা করেছে, তার হাও বন্ধ হয় না, দমও ফেলে না। সুন্দর মুখটা কালো হয়ে গেছে, ছোট্ট শরীরটা কাঁপছে। হাসানের মনে হচ্ছিল কে মারা যাচ্ছে, সে নাকি তার মেয়ে। দেড় থেকে দুই মিনিট পর হেঁচকির মত একটা শব্দ হল। তারপর দম ফেলে শুরু হল তীব্র কান্না। সে কখনো বুকের সাথে লাগিয়ে ঝাকুনি দেয় কখনো দু’হাতে দুলিয়ে অনেক চেষ্টা করে প্রায় আধা ঘণ্টায় বাচ্চার কান্না থামাল। কিন্তু বাচ্চার মা একটি বারের জন্যও এসে দেখল না বা বলল না যে, দেন আমার কাছে দুধ খাইয়ে কান্না থামাই। তারপর বাচ্চাকে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল।
রাক্ষসীটা তখনো ব্যাঙের মত ফুলে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল, স্বামীকে দেখে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে। দেখেই তার পিত্তিটা যেন জ্বলে গেল, চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল, তুই মা না ডাইনী- বলেই একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল। কিন্তু এটা ছিল হাসানের জন্য ভয়ঙ্কর অপরাধ। স্বামীর দিকে অগ্নি দৃষ্টি হেনে রাগে গড়গড় করতে করতে মাটিতে শুয়ে পড়ল- অসভ্য জানোয়ার, বউয়ের গায়ে হাত তুলে। তার মাথায় যেন আগুন ধরে যায়- এত বড় অপরাধ করার পর উল্টো আমাকে রাগ দেখাস- স্ত্রীর পিঠে কয়েকটা কিল দিল, রুমের ভিতরে ব্যবহারের জুতা হাতের কাছে পেয়ে- তা নিয়ে কয়েকটা বারি দিয়ে পাচায় দু’তিনটা লাথি মেরে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
আসরের পর একটি খোলা জায়গায় গিয়ে একটি পুকুর ধারে বসল। তার মেয়ের হা করা মুখটা কোনভাবেই সে ভুলতে পারছে না। অসংখ্য বিচ্ছু যেন তার কলজেটা কুটকুট করে কামড়াচ্ছে। অন্তহীন বেদনায় তার বুকটা ভেঙ্গে চোরমার হয়ে যাচ্ছে। হাঁটুতে মাথা গুজে সে উচ্চস্বরে কেঁদে উঠে- আমার আট দিনের বাচ্চার এত বড় কষ্ট আমি কি করে সহ্য করব, বেচারা অনেকক্ষণ বসে বসে কাঁদল। বারবার মনে হতে লাগল এত বদমেজাজি বউ নিয়ে আমি সংসার করব কেমনে। আবার বউকে মারার সময় ওর কান্নাটা তার মনে পড়ে খুব কষ্ট লাগছিল। আপসোস হচ্ছিল, সে মেরেছে মেরেছেই, আমি আবার মারতে গেলাম কেন? তাতে তো আর আমার মেয়ের কষ্ট লাঘব হয়ে যায়নি। আসলে স্ত্রীর কান্না তার সহ্য হত না। জীবনে সে স্ত্রীকে এ একবারই মেরেছিল। এর আগে পড়ে হয়ত দুয়েকটা চড় দিলেও প্রকৃত মাইর বলতে যা বুঝায় তা এ একবারই ছিল।
মাগরিবের পর বাসায় আসল। স্ত্রী তার দিকে অসহায়ের মত তাকিয়ে আছে। হাসানের মনটা হাহাকার করে উঠে- আমি মারলাম, আবার আমার দিকেই এভাবে তাকিয়ে আছে। আসলে ফেরদৌসী মেয়ের জন্য ছিল দুঃখিত, শত হলেও তো মা। সে মেয়েকে কোলে নিয়ে খাটের পাশে বসে আছে। শান্তনা দেয়ার জন্য হাসান গিয়ে তার ডান পাশে বসে বাম হাতটা স্ত্রীর বাম কাঁধে রেখে একটা চুমু দিল, তারপর জড়িয়ে ধরে বলল- তুমি কি মাকড়সা দেখেছ? মাকড়সার বাচ্চা থাকে তার মুখের ভিতর। এ বাচ্চাগুলি একটু একটু করে মাকে খেতে থাকে আর বড় হতে থাকে। মায়ের দেহটা সম্পূর্ণ খাওয়ার পর যখন তারা বেরিয়ে আসে তখন তাদের মায়ের বিচ্ছিন্ন হাত পা গুলি বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। এটাই মায়ের ধর্ম। একটি শিশু যদি মায়ের হাতে এভাবে মার খায় তাহলে পৃথিবীতে এ অসহায় শিশুদের আর নিরাপদ আশ্রয় কোথায়, বল।
বিষয়: বিবিধ
১২০৬ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন