চিঠি- ১৪ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ৩১ জুলাই, ২০১৬, ০১:৪৭:৩০ দুপুর

বিভিন্ন জায়গায় বেড়ানো হল, নতুনত্ব কেটে গেছে। এখন বাসায় উঠবে, খুজা খুঁজি শুরু হল। হাসান ছোট বেলা থেকেই ছিল জ্ঞান পিপাসু, শিক্ষানুরাগি। তা না হলে তো আর বাবার বিশাল সংসার চালিয়ে নিজের লেখা- পড়াও হত না আর ভাইদেরও শিক্ষিত করতে পারত না। তার শিক্ষানুরাগের নমুনা হচ্ছে, তার বোনের বাড়ি ছিল মুক্তাগাছা, উত্তর থেকে ময়মনসিংহ পেরিয়ে দক্ষিনে যেতে হত। যাওয়ার সময় গাঙ্গিনাপার রোডে অবস্থিত কবির লাইব্রেরী, পারুল লাইব্রেরী, শাহজাহান লাইব্রেরী ইত্যাদি লাইব্রেরীর সামনে গিয়ে সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকত। কত বই, স্তূপে স্তূপে কাড়িকাড়ি বই অথচ সে চাহিদানুযায়ি বাংলা বই পায় না পড়তে। কারণ তার বাবা ছিলেন দেওবন্দি আলেম, তাদের বাড়িতে আরবি ফারসি উর্দু বিভিন্ন কিতাবাদির স্তূপ ছিল কিন্তু বাংলা বই ছিল না বললেই চলে। সে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ধার করে বা দুয়েকটা কিনে এনে পড়ত। তাই সে কৈশোরে লাইব্রেরীর সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটি ঘটনা স্বরণ করত।

আশি ও নব্বইয়ের দশকে উত্তর ময়মনসিংহের প্রত্যন্ত পাড়া গায়ে মোটর গাড়ির প্রায় দেখা মিলত না। হঠাৎ মাঝে মধ্যে বিয়ে বা মাল টানার জন্য দুয়েকটা বাস ট্রাক যেত। কোন ট্রাক গেলেই পাড়ার দুষ্ট ছেলেরা পিছু নিত ট্রাকে উঠার জন্য। তখন অ্যাক্সিডেন্টের আশংখায় হেলপার একটা কঞ্চি নিয়ে ট্রাকের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকত। কোন ছেলে কাছে যেতে চাইলে ধ্মক দিত, আরো কাছে গেলে দিত কঞ্চি দিয়ে বারি। তখন হাসানের এক চাচাত ভাই বলত, আমাকে যদি কেউ ট্রাকে চাকরি দিত তাহলে মাগনা চাকরি করতাম, ট্রাকে চড়ে চড়ে সারা দেশ ঘুরতাম। হাসানও লাইব্রেরীর সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবে, আমাকে যদি কেউ লাইব্রেরীতে চাকরি দিত তাহলে মাগনা (অবৈতনিক) চাকরি করতাম আর দিন রাত বসে বসে বই পড়তাম।

আল্লাহ হয়ত ইয়াতিম বালকের মনোবাঞ্জা পূর্ণ করেছিলেন। তিনি তাকে কওমী, আলিয়া ও বিশ্ববিদ্যালয়- দেশের প্রচলিত এ তিনটি ধারায় লেখা- পড়া করার তাওফীক দিয়েছিলেন। সঙ্গত কারণেই আরবী, ফারসি, উর্দু, ইংরেজি ও বাংলা- পৃথিবীর প্রধান এ ভাষাগুলি ছিল তার করায়ত্ব। তাছাড়া বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হিসাবে বাংলা ভাষা ও বিশ্ব সাহিত্যে তার ভাল একটা দখল ছিল। তদুপরি বাংলা শব্দ ভান্ডারে ব্যবহৃত বিদেশি শব্দগুলির উৎপত্তি, বিশ্লেষণ, আভিধানিক অর্থ, প্রায়োগিক অর্থ ইত্যাদি বিষয়ে অন্যান্য শিক্ষিত লোকেদের তুলনায় তার মধ্যে গড়ে উঠেছিল এক ব্যতিক্রমি পান্ডিত্য। কিন্তু ভাগ্য দোষেই হউক আর গুনেই হউক এমন পন্ডিতের ভাগ্যে জুটেছিল ফেরদৌসীর মত তিন বারে এস, এস, সি করা একটা অর্বাচিন বোকা স্ত্রী। হাসান দেখল তার বউ যেমন অজ্ঞ, তেমনি মূর্খ, তেমনি বোকা। এর সাথে সংসার পাতা মানে হাতি ও বিড়াল দিয়ে হাল জোড়া। তাই সে বউকে নিজের উপযোগী, পৃথিবীর উপযোগী এবং ব্যবহার উপযোগী করার জন্য মৌখিক শিক্ষাদানের চেষ্টা শুরু করল। বিশেষত সে ধর্মীয় পরিবারের মেয়ে ও বউ হয়ে অর্থ বুঝে কোরআন পড়তে পারবে না- এটা কী করে হয়। তাই সে স্ত্রীকে আরবী শিখানোর উদ্যোগ নিল, কিন্তু বধুরত্ন শিখার চেয়ে ঝগড়াই বেশি করত।

পৃথিবীর ভাষা সমূহের মধ্যে একমাত্র আরবী ভাষা- যা গ্রামার ছাড়া একটি শব্দও উচ্চারণ করা যায় না। কারণ হরকতের ভুল হলে অর্থ বিকৃতি ঘটে যায়। কিন্তু ইংরেজি ভাষায় ব্যাপক ভোকাবুলারি জানলে গ্রামারে দুর্বল থাকলেও সমস্যা হয় না। পক্ষান্তরে আরবী ভাষায় ভোকাবুলারি কম। কোরানে মৌলিক শব্দ মাত্র আঠার শত। কেউ গ্রামার শিখে চার পাঁচ শত শব্দ মুখস্ত করলেই সে অর্থ বুঝে কোরআন হাদিস পড়তে পারবে। আর গ্রামার বলতে ছোট্ট দুটি চটি কিতাব- মিযান (শব্দ গঠন প্রণালি) ও নাহবেমির (বাক্য গঠন প্রণালি) পড়লেই যথেষ্ট, আর শব্দার্থ বা সাহিত্যের জন্য রওজাতুল আদব। যে কেউ এই ছোট্ট তিনটি চটি কিতাব পড়বে- সেই অনায়াসে অর্থ বোঝে কোরান হাদিস পড়তে পারবে।

হাসান উক্ত তিনটি কিতাব কিনে নিয়ে ফেরদৌসিকে বলল, এগুলি ধীরে ধীরে পড় তাহলে অর্থ বোঝে কোরান পড়তে পারবে। কিন্তু সে পড়ে না, হাসান পড়া দিয়ে আদায় করতে চায় তবুও পড়ে না। অবশেষে সে ভাবল- রাখ শালি, তোকে গ্যারাকলে না ফেললে তুই পড়বি না। তখন নিজের মাদসারায় দাখিলে ভর্তি করে দিয়ে এসে বলল- সোনার চান পিতলা ঘুঘু, এবার যাবে কোথায় ? পরীক্ষা দিতে হবে, ভাল করে পড়। সম্ভবত পৃথিবীতে এর চেয়ে অযোগ্য নারী দ্বিতীয়টা ছিল না। এত চেষ্টা সত্ত্বেও সে পড়ে না, হাসান পড়া দিয়ে আদায় করতে চায় তবুও পড়ে না। অবশেষে একদিন অল্প পড়া দিয়ে বলল, এটা কালকে দিতেই হবে। এ পড়াটুকু আধা ঘন্টা পড়লেই যথেষ্ট। পরদিন জিজ্ঞেস করল, না পড়া শেখে নি।

তারপরদিন চেপে ধরল। কারণ তার জানা ছিল, ওকে এটে না ধরলে সে কিছুই করবে না। কিন্তু যখনই চাপ দিল অমনি খাটের উপর শুয়ে পরল এবং একেবারে অসহায়ের মত মুখটা হা করে- আল্লাহ্‌ আমাকে এত অসহায় কেন বানাল- বলতে বলতে কাঁদতে লাগল। হাসানের বুঝতে বাকী রইল না, এ অসহায়ত্বের কান্না পড়া না শিখার জন্য নয়, তার ধারণা স্বামী তাকে পসন্দ করে না, তাকে ফেলে চলে যাবে, সে জোর করে স্বামীর ঘর করতেছে। এখন সে না পড়লে নিশ্চিত স্বামী তাকে ফেলে চলে যাবে, এই হল তার অসহায়ত্ব। হাসানের ক্ষোভ জন্মায়, একে তো পড়া শিখল না আবার তাদের বাড়ি থেকে সব দেখে-শুনে, বুঝে-শুনে এল, তাদের পরিবার, তার মা, সে নিজে বউয়ের জন্য এতকিছু করার পরও যদি এমন ধারণা করে তাহলে এমন একটা বোকা নিয়ে এ জীবন সংসার কেমনে পাড়ি দিবে। কিন্তু স্ত্রীর কান্না সে সহ্য করতে পারে না। খাটে উঠে তার মাথাটা বুকে নিয়ে অনেক আদর করল, চুমিয়ে চুমিয়ে গাল দু’টা লাল করে তুলল। এ দিনের আদরটা সম্ভবত তার জিবে ভাল রুচেছিল। এজন্যই পরবর্তিতে অন্যদের সাথে আলাপ করত, আমি রাগ করলে বা কাঁদলে সে আমাকে শান্তনা দেয়। সম্ভবত তার এ একদিনের কথাই স্বরণ ছিল। কিন্তু বাস্তবে এমন কখনো হয়নি যে, বউ রাগ করেছে বা কেঁদেছে আর হাসান তাকে শান্তনা দেয় নি, আদর সোহাগ করেনি। অগত্যা স্ত্রীর পড়ার চিন্তা সে বাদ দিল।

তার ব্যবসা আগের মতই চলছে, বউকে না দেখে থাকতে পারত না, দিনে কয়েক বার করে আসত। আসলে স্ত্রীর ভালবাসা ও মুহব্বত তার দেহ-মনে বিক্রিয়া হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ঝগড়াও হত, আবার চলে যাবার সময় সে ভাবত স্বামী তাকে ফেলে চলে যাচ্ছে। তখন তাকে দু’হাতে চেপে ধরত, হাতের বালার খাজ পিঠে সেথে যেত, বেচারা ব্যাথা পেত। সে স্বামীর বুকে মাথা রেখে কাঁদত। এ অবস্থা প্রায় প্রতিদিনই ঘটত এবং একাধিক বার। আর প্রতিবারই তাকে আদর সোহাগ দিয়ে শান্ত করতে হত।

হাসানের একমাত্র বড় বোন তাদের বাড়িতেই বলে এসেছিল নতুন বউকে নিয়ে তাদের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসতে। এখন আবার বারবার তাকাদা দিচ্ছে । সে ভাবল পরে বাচ্চা কাচ্চা হয়ে যাবে, হয়ত আর বেড়ানোর সুযোগ হবে না, বেড়ানোর কাজ একবারেই শেষ হয়ে যাক। স্ত্রীকে নিয়ে গেল, ইচ্ছা যে দুয়েক দিন থেকে সাথে নিয়ে আসবে। কিন্তু তার বোন নাছোড় বান্দা- জীবনে আর আসা হয় কি না হয়, বউটা কয়েকদিন থাকুক, তুই সপ্তাহ শেষে এসে নিয়ে যাবি। হাসান দেখল, বউ তার ভাগ্নিদের সাথে মিশে গেছে, হাসি খুশি ভাব। তার অনন্য বৈশিষ্ট সেই উচ্ছসিত আনন্দ আভা তার চেহারায় ছড়িয়ে আছে এবং তারও থাকার ইচ্ছা। কাজেই তাকে রেখে চলে এল।

পরদিন তাদের বড়াপার এক ছেলে এসে বলল, নানু বলেছে আপনি এক্ষুনি তার সাথে সাক্ষাত করতে। সংবাদটিতে কেমন যেন একটু বিপদ সংকেত ছিল। বিয়ের পর এ কয়েক মাসে শাশুড়ি বুঝতে পেরেছিলেন, তার এ মেয়ের জামাইটা ভাল না খারাপ। তিনি তার প্রতি ছিলেন আন্তরিক। যাওয়ার সাথে সাথে তিনি তার পাশে বসে সমব্যাথি হয়ে বললেন, ওকে রেখে আসছ, মাজেদা খুব রাগ করছে। তুমি তার অনুমতি নিয়েছিলা, তার অনুমতি ছাড়া রেখে আসলা কেমনে। সে ভীষণ রাগ হয়েছে। এখন যাও তাড়াতাড়ি গিয়ে নিয়ে আস। হাজির বান্দা গুনাহ মাফ। নিয়ে আসলেই ওর রাগ কমে যাবে। তারপর তিনি একটা করে কথা বলতে লাগলেন আর কোরাস হিসাবে- হাজির বান্দা গুনাহ মাফ, বলতে লাগলেন।

আসলে তার শাশুড়ি এখানে আসার পর ওদের বড় বোন ওরফে বড়াপা হাসানের বিরুদ্ধে ঈশ্বরের হুকুম জানিয়ে দিল। তাতে শাশুড়ি ভয় পেয়ে তাকে ডেকে আনলেন। বিচিত্র পৃথিবীতে বিচিত্র মানুষ। আরো বিচিত্র মানুষের চরিত্র। আর এখানে হাসানের জন্য অপেক্ষা করছিল বিচিত্র অভিজ্ঞতার তথ্য ভাণ্ডার। এই প্রথমবার সে অনুভব করল এই মহিলাটা আসলে হিটলার, লেডি হিটলার এবং স্বৈরাচারী। যাবার সময় সে হাসানকে কিছুই বলেনি, যদি তার বোনকে সাথে নিয়ে আসার হুকুম দিত তাহলে সে অবশ্যি তাই করত। কিন্তু তিনি ঈশ্বরের মত হাসানের উপর বার্তা চাপিয়ে দিলেন। তার সাথে হাসানের সম্পর্ক ভাল ছিল, তাকে বড় বোন মানত। কিন্তু ভালর মধ্যে বিনা অন্যায়ে কেউ এভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে পারে এই প্রথম সে দেখল। হাসান ক্রমে ক্রমে বুঝতে পারছিল এরা কোন সমাজ করে না, কারো সাথে সামাজিক যোগাযোগও রক্ষা করে না, তাদের বোনেরা মিলে ছিল তাদের সমাজ- নারী তান্ত্রিক সমাজ। এখানে পুরুষরা সবাই ক্রিতদাস। একটা বিষয় সে অবাক হয়ে লক্ষ্য করত, এদের ছেলে মেয়েদের মুখে সব সময় শুধু নানা-নানু ও খালা-খালু অর্থাৎ মাতৃতান্ত্রিক বুলি উচ্চারিত হত। কিন্তু কারো মুখে কোনদিন দাদা-দাদু, কাকা-কাকী, ফুফা-ফুফি ইত্যাদি নাম একটিবারও উচ্চারিত হতে শুনেনি। বিষয়টা সে খুব ভাবত- তাহলে কি আমার সন্তানরাও আমার বাপ- মা ও ভাই-বোনদের ভুলে যাবে। এ কোন নারী তান্ত্রিক গ্রহে ছিটকে পড়লাম।

সে গিয়ে দেখে তার বউ বেশ হাসি খুশি প্রানোচ্ছল। কিন্তু ঘটনা শুনে ফেরদৌসী দুঃখিত হল, মনক্ষুন্ন হল। স্বামীর অপমানে স্ত্রী দুঃখিত হবে এটাই নিয়ম। কিন্তু হাসানের অপমানে তার স্ত্রী দুঃখিত হল, এতে তার মনটা ভরে গেল, এ যেন তার অমূল্য প্রাপ্তি। কারণ সে বোনের চেয়ে স্বামীকে প্রাধান্য দিয়েছে। দেরি না করে তারা শীঘ্রই রওয়ানা করল। বাসায় পৌঁছে ফেরদৌসী সোজা চলে গেল তার বোনের কামরায়, ফিরে এসে চেহারায় সেই উচ্ছল হাসি ফুটিয়ে বলল- হাজির বান্দা গুনাহ মাফ, বড়াপা খুশি হয়ে গেছে। হাসান অবাক হয়, এরা সবাই একই কথা বলে কেন। সারা জীবন সে শুনে এসেছে- হাজির বান্দা গুনাহ মাফ কথাটা মানুষ আল্লাহ্‌র ক্ষেত্রে বলে থাকে কিন্তু বড়াপার ক্ষেত্রে গুনাহ মাফের কথা বলে কেন? না কথাটা রুপক ছিল না, ধীরে ধীরে তার ভুল ভাঙ্গল। সে মনে করত এ মহিলা তার বাবার ও স্বামীর পরিবারের কর্ত্রী। আসলে তিনি কর্ত্রী ছিলেন না, ছিলেন ইশ্বর। তার ইচ্ছায় কারো ভাগ্য রবি উদিত হত, আর কারো ভাগ্য শশি অস্তাচলে চলে যেত। কয়েকদিন পর সে বাসা নিয়ে চলে গেল।

বিষয়: সাহিত্য

১৫১৮ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

375655
৩১ জুলাই ২০১৬ বিকাল ০৪:৫৯
কুয়েত থেকে লিখেছেন : অনেক ভালো লাগলো পড়া দিয়ে আদায় করতে চায় তবুও পড়ে না। অবশেষে সে ভাবল অনেক অনেক ধন্যবাদ
375658
৩১ জুলাই ২০১৬ সন্ধ্যা ০৬:৩০
আবু নাইম লিখেছেন : হাজির বান্দা গুনাহ মাফ। নুতন শুনলাম.। ভালো লাগলো ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File