চিঠি- ১৩ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২৯ জুলাই, ২০১৬, ১০:৪৯:২০ সকাল
হাসানের বিয়ের প্রায় চার মাস হতে চলল, ভাইদের সাথে কোন বিষয়ে রাগ করে এতদিন সে বউকে বাড়িতে নেয়নি। তার মা তখনো বউ দেখেননি। বড় ছেলের বউ, তার কত আশা, কত স্বপ্ন। তিনি বউ দেখার জন্য পাগল হয়ে উঠেছেন, ছেলেদের সাথে রাগারাগি শুরু করে দিয়েছেন। বউ বাড়িতে নেয়ার জন্য হাসানকে এক সপ্তাহের আল্টিমেটাম দিয়েছেন। আবার তার বড় বোনও বউ দেখার জন্য বাড়িতে গিয়ে বসে আছে। কাজেই এবার এল তাদের বাড়িতে বেড়ানোর পালা। যাওয়া উপলক্ষে ফেরদৌসীর বড় বোন ওরফে বড়াপার বাসায় পিঠা বানানোর ধুম পড়ে গেল। হাসান তখন ভীষণ অস্বস্তি বোধ করতে লাগল, কারণ সে কখনো চায়নি শ্বশুর পক্ষ থেকে তার বা তার পরিবারের জন্য একটি সুই সুতা খরচ করুক। কিন্তু এটা ছিল অপারগ অবস্থা। কারণ গ্রামিন ঐতিহ্য কারো অজানা নয়। নতুন বউ গেল আর পিঠা চিঁড়া নিয়ে গেল না তো রক্ষে নেই। বদনামের অন্ত থাকবেনা, সেই সাথে গ্রামের মহিলারা কথায় কথায় নতুন বউকে জর্জরিত করবে। শ্বশুর ফ্যামিলি ও তার নিজের মুখ রক্ষার জন্যই সে মানা করল না। প্রচুর পিঠা বানানো হল।
পরদিন হাসান বউকে নিয়ে বাড়িতে পৌঁছল । তার মা বোন বউ পসন্দ করল, বিশেষত বউয়ের পর্দা ও ধার্মিকতা দেখে তার মা খুব খুশি। যদিও তখনো তাদের বাড়িতে পাকা ঘর উঠেনি যা ছিল সবই টিন কিন্তু ফেরদৌসীদের বাড়ির তুলনায় ছিল অনেক বড়, বড় কৃষক পরিবার হিসাবে ভিতরবাটি ও বহির্বাটির উঠান ছিল অনেক বড়। তাই সম্ভবত বউয়ের বাড়ি পসন্দ হয়েছিল, তাকে বেশ হাসি খুশি ও আনন্দিত দেখাচ্ছিল। পরদিন সকালে হাসানের বড় বোন তাকে ডেকে নিয়ে কিছু চাউল দিয়ে বলল এগুলি ঝেড়ে পরিস্কার করে রান্না বসাও, দেখি কেমন কাজ শিখেছ। হাসান তখন তার রুমে শুয়ে ছিল, সে কয়েক ঝাড়া দিয়ে যখন দেখল হাসানের বোন সরে গেছে তখন সাথে সাথে চলে গেল এবং স্বামীর বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলতে লাগল-আমি আপনার সাথে চলে যাব, আপনি চলে গেলে এরা আমার উপর অত্যাচার করবে। হাসান তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলল, আরে শুন, এখনো গ্রামের নিয়ম জানো না ? নতুন বউ এলে তাকে কোন একটা কাজ করতে দেয়া হয়, তাতে তারা আনন্দ করে আর দেখে বউ কাজ পারে কিনা। না পারলেও কেউ কিছু বলে না। কারণ সবাই জানে ঘর কন্যার কাজ সবাইকে করতে হবে, না পারলেও আস্তে আস্তে শিখে নেবে। স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে আদর দিয়ে বলল, যাও রান্নাটা বসাও গিয়ে, নইলে তোমার প্রতি মনক্ষুন্ন হবে, তোমার বদনাম হবে। তারপর দেখবে আমার বোনই রান্না করবে, তোমাকে দিয়ে করাবে না। আমার মা ও বোনকে আমি চিনি, তারা নিজেরা কষ্ট পায় কিন্তু কাউকে কষ্ট দেয় না। সে চলে গেল এবং কিছুক্ষণ পর এসে হাত উঠিয়ে তুড়ি দেয়ার মত করে হাসল, যে অবস্থাটা মানুষ কোন বিজয়ের সংবাদ দেয়ার সময় করে। তারপর বলল, আপা বলেছে তুমি সুন্দর কাজ করতে পার, নতুন বউ বেশি কাজ করতে নেই, এখন যাও আমি রাধি। আসলে সে ছিল কামচোরা, কোন কাজ করতে চাইত না। আর একাজ নিয়েই শেষ পর্যন্ত দেখা দিয়েছিল যত বিপত্তি ।
হাসানের মা বউকে অনেক আদর করতেন। সব সময় কাছে কাছে রাখতেন, সাথে বসে খাওয়াতেন। তিনি বললেন, বউতো এখন পুরাতন হয়ে গেছে, কিছু দিন থাকুক। শ্বাশুড়ির আদর পেয়ে ফেরদৌসীও থাকতে চাইল। হাসান চলে আসার সময় সে স্বামীর কাধের কাছে এসে শিশুর মত ফুফিয়ে কাঁদতে লাগল। হাসান যন্ত্রনায় পরল কারণ এখন তাকে জড়িয়ে ধরে আদর দেয়া দরকার অথচ এটা সম্ভব ছিলনা, মা পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। কিছু ভেবে না পেয়ে বলল, আম্মা দেখেন দেখেন কীভাবে বাচ্চা পোলাপানের মত কাঁদে। মা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে ওর গায়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলতে লাগলেন, আরে বেক্কল বেটি কাঁদ কেন, আমি তোমার মা না ? তোমার মায়ের কাছে থাক না ইত্যাদি ইত্যাদি।
আসার পর যন্ত্রনা শুরু হল। কারণ তখন তার এমন সময় কাল যাচ্ছিল যে, স্ত্রীকে না দেখে থাকতে পারত না, কষ্ট হত। পাঁচদিন পর লেজ খাড়া করে দৌড় লাগাল। হাসান পৌছতেই সে এল, চেহারায় সেই উজ্বল্য, উচ্ছ্বাস যেন চকমক করছে, হাসানের মনে হয় তার স্ত্রীর দন্ত ও হাসিতে যেন মুক্তা ঝড়ে পরছে, আনন্দের সময় তার চেহারায় যে উচ্ছ্বাস ফুটে উঠত এমনটা সে অন্য কোন নারীকে দেখেনি। কত যে তার ভাল লাগে এর পরিমাপ তার জানা নেই। ফেরদৌসী প্রথম শুরু করল, আপনি চলে যাবার পর আম্মা আমারে আরো বেশি আদর করছে, দুধ গরম করে ডিম সিদ্ধ করে খাওয়াইছে। নিজের পাত থেকে মাছ গোশত আমার পাতে তুলে দিছে, আরো এটা ওটা খাওয়াইছে, খেতে না চাইলেও জোর করে খাওয়াইছে।
হাসান বাড়িতে কয়েক দিন থাকল। গ্রামের বাড়ি গোসল করতে হয় পুকুরে, মেয়েদের গোসলের সুবিধার্থে তার বাবা বাড়ির সামনে পুকুর না দিয়ে দিয়েছিলেন বাড়ির পিছনে, প্রায় রান্না ঘর সংলগ্ন। মেয়েদের গোসলের জন্য ঘাটে বেরা দেয়া আছে। ফেরদৌসীও পুকুরেই গোসল করত, তখন হাসান পাড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাহারা দিত। যদিও বাহির থেকে দেখা যায়না, কিন্তু তার ভাইয়েরা বা কোন মহিলা আসে কিনা লক্ষ রাখতে হত। কারণ নতুন বউ কোন মহিলার সামনেও গোসল করা ঠিক না। বউ ঘাটে বসে দীর্ঘক্ষণ সাবান লাগাত, শরীর মাজত, আসলে সে ইচ্ছে করেই দীর্ঘায়িত করত। কখনো স্ত্রী ইঙ্গিত করত, কখনো সে নিজেই যেত, ওর পাশে বসে থাকত, পিঠ মেজে দিত, গায়ে হাত বুলাত। বউ তাড়া দিত সে আবার চলে যেত পাড়ে, কেউ আসে কিনা দেখতে। সে পানিতে নেমে যেত। মানুষ কানে আঙ্গুল দিয়ে ডুব দেয়, যাতে পানি না ঢুকে। কিন্তু বউকে নাকে ধরে ডুব দিতে দেখে সে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেত। তারপর হয়ত বউ ইঙ্গিতে জানতে চাইত, হাসান বলত, না কেউ নেই। তখন সে গায়ের কাপড় খোলে শরীর মাজত আর স্বামীর দিকে তাকিয়ে দুষ্টের হাসি হাসত। উজ্জ্বল চেহারা, স্নানের পর হয়ে উঠে স্বচ্ছ স্পটিক, তার উপর পরে অভ্রকিরণ, আর তা প্রতিফলিত হয় হৃদয় তলে, তখন হৃদয়-মন গেয়ে উঠে, সেকি তুমি নও, যার ছায়া পড়েছে, মনেরি আয়নাতে।
তারপর উঠে এসে ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকত, হাসি তার মুখে লেগেই থাকত। ঘাট থেকে একটু ব্যবধানে হয়ত তার কাপড় কিন্তু হাত বাড়িয়ে নিবে না, স্বামীর জন্য অপেক্ষা করত, হাসান গেল কাপড়ের ভাজ খোলে গায়ে জড়িয়ে দিল বা পরিয়ে দিল বা সহায়তা করল। হাঁ, পাগলামি বটে। আসলে এ সময়টা ও বয়সটাই পাগলামির। আর প্রত্যেক নর-নারীর মধ্যে আল্লাহ্ প্রদত্ত নিয়ামতের মধ্যে এ পাগলামিটাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠতম নিয়ামত। বার্ধ্যক্যে শিরার হিমবাহ, শুভ্রকেশ, কুঞ্চিত ত্বক ও দুলক দন্তরাজি যখন পরস্পরকে বিকর্ষণ করে তখন শুরু দাম্পত্যের এ পাগলামিটাই নর- নারীকে এক ঐশী ভালবাসার আবেশে আবদ্ধ রাখে। আসলে তখনকার সময় কালটাই ছিল হাসানের জীবনের স্বুবর্ণ সময়, শ্রেষ্ঠ সময়। যে স্মৃতি মানব হৃদয়কে আমৃত্যু দোলা দেয়, আলোড়িত করে।
এ সময় একটা ঘটনা ঘটল। হাসানের বাবার আমলের একটা সিন্দুক ছিল। পরে সে এটা ভেঙ্গে অন্য ফার্নিচারের কাজে লাগিয়েছিল। সে স্বপ্নে দেখল, তার স্ত্রীর একজন প্রৌঢ় লোকের সাথে বিয়ে হয়েছে, লোকটা ফর্সা, দীর্ঘদেহি ও শুভ্রকেশ। তাদের পুবের ঘরের যে জায়গাটায় সিন্দুকটা আগে ছিল সেখানেই আছে এবং লোকটা তার বউকে নিয়ে সিন্দুকটাতে শুয়ে আছে। তারপর কি যে আউড়া কাউড়া দেখল- স্বরণ রাখতে পারল না। আবছা মনে আছে, সম্ভবত মারামারি খুনাখুনির জন্য দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিয়েছিল। অল্পক্ষণ পরেই তীব্র যন্ত্রণায় ঘুম থেকে উঠে দেখে সে ঘামে নেয়ে গেছে। বুকটা ভীষণ ধরপর করছে, বিপর্যস্ত অবস্থা। তখনো তাদের গ্রামে বিদ্যুৎ আসেনি। বাইরে বাতাসে গিয়ে ভাবতে লাগল, আচ্ছা প্রেমিক প্রেমিকারা হত্যা বা আত্মহত্যা করে কেন। একটি ছেলে একটি মেয়েকে ভালবাসে কিন্তু মেয়েটি মারা গেল। আর প্রেমিকা মারা গেলে কোন প্রেমিক আত্মহত্যা করেছে বা পাগল হয়ে গেছে মহাকালের কোন ক্ষনে এমন কোথাও শুনা যায়নি। কিন্তু প্রেমিকা যদি জীবিত থাকে আর সে প্রেম প্রত্যাখ্যান করে এক্ষেত্রে প্রেমিক উগ্র চন্ডাল হলে মেয়েটিকে আঘাত করে, এসিড মারে বা ধর্ষণ করে বা মেরে ফেলে। আর অভিভাবক অন্তরায় হলে তাদের উপর অত্যাচার করে, হুমকি ধামকি দেয়।
আর ছেলেটি শান্ত সুবোধ হলে নেশা ধরে, নিজেকে আঘাত করে, তিলে তিলে পলে পলে নিঃশেষ হয়ে যায় বা আত্মহত্যা করে। একই প্রেম অথচ দুই অবস্থা হল কেন। এর কারণ, প্রেমিকা মারা গেলে সে অন্যের শয্যা সঙ্গীনি হচ্ছে না কিন্তু জীবিত থাকলে সে অন্যের শয্যা সঙ্গীনি হবে। আর এটা কোন পুরুষ সহ্য করতে পারে না। প্রেমিকা হউক স্ত্রী হউক অন্যের বাহুলগ্না কল্পনা করলে সে পাগল হয়ে যায়। একমাত্র নিজের সম্পত্তি গণ্য করে, অন্যকে সহ্য করতে পারে না। ফলে হয় অন্যের উপর আঘাত করে অথবা নিজের উপর। এজন্যই পুরুষরা সাধারণত ব্যভিচারিনি স্ত্রীকে বাঁচিয়ে রাখে না। এমন এক ঘটনার উপর ভিত্তি করেই রচিত হয়েছে পৃথিবীর অমর সাহিত্য আলিফ লায়লা, পুরুষের এ চরিত্র সৃষ্টিগত, স্রষ্টা প্রদত্ত। কাজেই হাসানের মনটাও স্ত্রীর প্রতি কেমন জানি বিষিয়ে উঠে। পরদিন সে বউকে স্বপ্নের কথা বলল কিন্তু সে যেন শুনলই না আর এমন উপেক্ষার ভাব দেখাল যেন বলতে চাচ্ছে, আমার স্বামী আছে, কদিন পর মা হব এমন বাজে স্বপ্নের কথা আমার শুনার দরকার কী? অদৃষ্টের কী নির্মম পরিহাস। যা অসম্ভব, অকল্পনীয় সময়ের ব্যবধানে তাই হয়ে উঠে আবিশ্যম্ভাবি এবং অনিবার্য।
কয়েক দিন পর বিদায় বেলায় হাসানের মা বউকে কী দিবেন, কী খাওয়াবেন ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন, উপদেশ দিলেন, কাঁদলেন। ফেরদৌসী বাড়ি থেকে বেরিয়েই বলল আম্মা মেয়ে বিদায় করছে, এরপর সে যতবার এসেছে ততবার শ্বাশুড়ির আদরে কখনো নিজে কেঁদেছে, কখনো কাঁদেনি, তবে একটি কথা বারবার বলেছে, আম্মা মেয়ে বিদায় করে।
বিষয়: বিবিধ
২১০২ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন