চিঠি- ১২ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২৮ জুলাই, ২০১৬, ১২:০৫:২০ দুপুর
ভাইয়ের বাসা থেকে বেড়িয়ে রিকসায় উঠেই ফেরদৌসি ক্ষ্যাপা কণ্ঠে ঝাঝ শুরু করল, হেঃ মাইনষেরে দিতে পারে আমারে দিতে পারে না। আমি যেমুন তার কেউ না, বউয়ের কথায় চলে। বড়াপারে গিয়া কমু তখন বউ পাছা দিয়া দিব। হাসান ভাবল আবার তাকে কিছু বলছে কিনা, ভড়কে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী বাজে বকছ ? ফেরদৌসি কর্কশ কণ্ঠেই জবাব দিল, বাজে বকছি না, দাদু তার জ্যাঠাসের মেয়ের বিয়েতে সেই কবে ২০০২ সালে বিশ হাজার টাকা দামের শাড়ি দিল। আর আমাকে একটা সুতার নালও দিল না, আপনাকেও তো কিছু দিল না। জানে না নতুন বউ, নতুন জামাই আসলে একটা কিছু দিতে হয়। আমাকে একটা উড়না আপনাকে একটা লুঙ্গি পর্যন্তও দিতে পারল না। আমার কি বাপ আছে না আরো দশটা ভাই আছে, সেই তো আমাদের অভিভাবক।
আসলে বড়াপা না থাকলে সে একটা একটা করে রিকশা ওয়ালার হাতে দিয়ে আমাদেরকে বিদায় করত। আর জীবনে ফিরেও তাকাত না। এই সব বউয়ের কথায় করে। এ তারীখে যাই বড়াপাকে দিয়ে ওদেরকে সাইজ করব। কিন্তু এ জন্য হাসানের কোন ক্ষোভ ছিল না, সে বরং বউকে বুঝাল, দেখ দরীদ্র বেচারা ছোটখাট ব্যবসা করে কোন রকম সংসার চালায়, তার হাতে টাকা থাকলে তো তোমাকে কোন কিছু দিত। আর তার জ্যাঠাইসের মেয়েকে দিয়েছে তখন হয়ত তার হাতে টাকা ছিল। এজন্য তোমার রাগ করা ঠিক হবে না। সে বলল, শুধু ঐটাকে কেন ওর জ্যাঠাইসের আরো যে মেয়ে আছে ওদেরকেও দেয়। আর আমাকে দেয়ার সময় টাকা থাকে না। আচ্ছা আমি না হয় বোন আমাকে নাই দিল কিন্তু আপনি তো নতুন জামাই আপনাকে দিল না কেন? কোন ভাই খালি হাতে এভাবে নতুন জামাইকে বিদায় করে নাকি? আসলে স্বামীকে কোন কিছু না দেয়ার জন্য তার কোন ক্ষোভ ছিল না, কিন্তু নিজে না পাওয়ার দুঃখে সে স্বামীকে ক্ষেপাতে লাগল। এভাবে ট্রেনে বসে বসে পুরাটা রাস্তা সে ভাইয়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঝাড়ল।
বস্তুত ফেরদৌসির বাবা মারা যাওয়ার পর তারা আত্মীয়- স্বজনের মুখাপেক্ষি হয়ে পরে। কারণ ব্যয় সংকুলান করার মত তাদের আর্থিক সঙ্গতি ছিল না। তখন খালারা মামারা দুলা ভাইরা তাদের সাহায্য করত। ফেরদৌসি থাকত বোনের বাসায়, তখন বোনেরা তাকে কাপড় চোপড় ও অন্যান্য উপহার দিত। এভাবেই সে হয়ে উঠে লোভাতুর, পরমুখাপেক্ষি। এ জন্যই যদিও উপহার দেয়া ভাল কিন্তু এমন ভাবে দিতে নেই- যাতে কেউ লোভি পরমুখাপেক্ষি হয়ে উঠে। জামালপুর এসে সে তার বোনদের সাথে আলাপ করল,পরিবারের মান রক্ষার্থে বোনেরা তাকে পরামর্শ দিল। দু দিন পর সে স্বামীকে বলল, আসলে দাদু তার জ্যাঠাইসের মেয়েকে কিছুই দেয় নাই আমি ভুল বলে ছিলাম- তার কণ্ঠে আড়ষ্টতা। হাসান হাসল- এই বোকা মেয়েটা কি আমাকে এতই বোকা মনে করে যে, আমি কিছুই বুঝি না। মুখে বলল- আমাকে প্রবোধ দেয়ার দরকার নাই, তোমার দুঃখ না থাকলেই হল।
হাসান তখনো বাসা নেয়নি, গিয়ে উঠল এডির বাসায়। জামালপুরে ফেরদৌসীর তিন ভগ্নিপতি থাকত, ইঞ্জিনিয়ার এডি ও বজলু, বাকীরা বিভিন্ন জায়গায় থাকত। বজলু দরিদ্র ছিল বিধায় তাদের বোনেরা বাকি দুইজনের বাসায় আনাগুনা করত। পরদিন হাসান টেস্টটিউব কিনে এনে দিল। পরীক্ষার পর ফেরদৌসী এসে উচ্ছসিত আনন্দে বলতে লাগল, কি আশ্চর্য্য, দেয়ার সাথে সাথে দুটি লাল দাগ উঠে গেল। সে হাসছে, আনন্দে তার চেহারা চমকাচ্ছে। খুব কম মেয়েই আনন্দের সময় এভাবে উচ্ছাস প্রকাশ করতে পারে। হাসান স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, ওর হাসিটা তার কত যে ভাল লাগে, যেন তুষার শুভ্র দন্ত থেকে মুক্তা ঝড়ে পড়ছে। হাসান অবাক হয়, বিয়ের পর এ একই হাসি তাকে না আকর্ষণ করত আর না বিকর্ষণ।
রাতে এক কান্ড ঘটল। রাতের দ্বিতীয় প্রহরে ফেরদৌসী গোসল করে ফেলবে। সকালে টিউবওয়েল চাপাচাপি করা, একে তো পানি বের হয় না, আবার লজ্বা শরমের ব্যাপার। বাসা সংলগ্ন একটা জলাশয় আছে যার পানিটা স্বচ্ছ এবং ব্যবহারোপযোগি। সেখানে গোসল করার জন্য জেদ ধরল। হাসান অগত্যা বউকে নিয়ে গেল। কিন্তু কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার। বাসায় আসার সাথে সাথে স্ত্রীর বুকের বাম পাশটা প্রচন্ড ব্যাথা ও ফুলে যেতে লাগল, ডান পাশ ঠিক আছে। হাসান ভড়কে গেল, বুঝতে পারল, রাতের বেলা নতুন বউ বাইরে উন্মুক্ত স্থানে গোসল করা মারাত্মক ভুল হয়েছে। এটাকে তারা বলে বাতাস লাগা। কি আর করা, হাসান তিন কুল ও অন্যান্য সুরা দিয়ে ঝাড় ফুক শুরু করল, পানি পড়ে খাওয়াল, ধুয়ে দিল। বাঃ চমৎকার, মুহুর্তেই বিমার মুহুর্তেই ভাল হয়ে গেল।
এরপর থেকে এমন হল যে, হাসান বউকে না দেখে থাকতে পারত না। যতক্ষন বাইরে থাকত মনে হত যেন স্ত্রীর জন্য তার মনটা পুড়ে যাচ্ছে। চৌম্বকীয় আকর্ষনে বউয়ের কাছে ছুটে যেত। সে স্বামীকে দেখেই একটা হাসি দিত, স্বামীর কাছে যার মূল্য ছিল অমুল্য। বিয়ের সময় হাসান তাকে পসন্দ করেনি, মন তাকে মেনে নেয়নি। এ জন্য সে দুঃখিত হয়ে নিরন্তর আল্লাহ্র কাছে কান্নাকাটি করত যেন স্ত্রীর প্রতি তার মনে মহব্বত পয়দা করে দেন। এ দোয়া যে এভাবে কবুল হয়ে গেছে ভাবতেও পারেনি। সে ভাবে, ডারউইনবাদের বিবর্তন তো ঘটেছিল লক্ষ লক্ষ বছরে, কিন্তু আমার বিবর্তন ঘটল তিন মাসে।
সে অবাক হয় কখন সঙ্গোপনে চুরের মত স্ত্রী শুধু তার মনের সিংহাসনই দখল করেনি বরং তার অস্তিত্বটাই যেন স্ত্রীর হয়ে গেছে। অষ্ট প্রহর স্ত্রীর মুখখানা তার চোখের সামনে ভেসে থাকে, তার মন মগজ চিন্তা চেতনা আচ্ছন্ন করে রাখে। এ এক মোহাবিষ্ট অবস্থা। বাবা ছাড়া জগতে তার সবাই আছে, মা- যাকে অবলম্বন করে শৈশব থেকে এ ভবদরিয়া পাড়ি দিয়েছে, ভাই বোন আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব সবাই আছে। আছে এই পৃথিবী আর পৃথিবীর কত মোহনিয় বস্তু। কিন্তু একমাত্র মায়ের পর স্ত্রী ছাড়া তার মনের উপর অন্য কারো এবং কোন কিছুর ছায়া পড়ে না। তার মন মগজে কারো অস্তিত্ব অনুভব করে না। এসব কিছু যেন ঝেটিয়ে বিদায় করে সেখানে একজন আসন গ্রহণ করেছে, সে হল তার স্ত্রী। হাসান অবাক হয়ে লক্ষ করল, কোন কাজেই সে একাগ্রতা আনতে পারে না, স্ত্রীর চেহারা তার মনে ভেসে থাকে। কারো সাথে আলাপ করছে বা কোন কাজ করছে তো মনোযোগ নেই। বউ তার মনটাকে উলট পালট করছে। স্ত্রীর ভালবাসা তার মনের গহীন থেকে গহীন অরণ্যে পৌঁছে গেছে, তার দেহ মনে বিক্রিয়া হয়ে গেছে।
কিন্তু সেই সাথে যেন একটা সুক্ষ্ম ব্যাথা অনুভব করে। হয়ত কেউ বলবে আগে বউ পসন্দ হয়নি বিধায় এখন ভালবাসার সাথে সেই ব্যথা সহাবস্থান নিয়েছে। আসলে তা নয়, কারণ তার অপসন্দের বিষয় স্ত্রীর নাক ও স্বাস্থ্যহীনতা। কিন্তু এখন এসব তার কাছে স্বাভাবিক। সে কাল না ধলা তাও মুখ্য বিষয় নয়। স্ত্রীর অস্তীত্বটাই মুখ্য যা তার দেহমন আচ্ছন্ন করে আছে। তবে এর দুটি ব্যাখ্যা হতে পারে, হয়ত নিখাত পবিত্র- প্রেম এমনই হয়। নর নারীর প্রেম যখন গভীর হয়, সকল পর্যায় অতিক্রম করে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায় তখন তার মধ্যে তিক্ষ্ম বেদনা অনুভূত হয়। হয়ত এটাই প্রেমের প্রকৃতি ও স্বরুপ।
অথবা তার স্ত্রী যে ভয় পায় সে তাকে ফেলে চলে যাবে, আর এ জন্য কাঁদে এ ব্যাথাটাই হয়ত তার ভালবাসার সাথে সহাবস্থান নিয়েছে। বস্তুত তখন সে আর তার নিজের মধ্যে ছিল না স্ত্রীর মধ্যে বিলিন হয়ে গিয়েছিল। মনোবিজ্ঞান এর কী ব্যাখ্যা দেয় জানা নেই, তবে সুফী শাস্ত্রে এ অবস্থাটাকে বলে ফানা ফিল্লাহ। সুফীরা নিজেদেরকে আল্লাহ্র অস্তিত্বের মধ্যে ফানা করে দেয়। ফলে তাদের দেহটাই নাকি আল্লাহ্র অস্তিত্ব হয়ে যায়। যেমন মনসুর হেল্লাজের মুখ থেকে আনাল হক আনাল হক বের হল, তাকে টুকরা টুকরা করার পর মাংশ থেকে, জ্বালিয়ে দেয়ার পর কয়লা থেকে আনাল হক- আমি খোদা, আমি খোদা রব উঠল। তদ্রুপ হাসানও অনুভব করতে থাকে, সে আর তার মধ্যে নেই, তার অস্তিত্বটাই স্ত্রীর হয়ে গেছে। এ জন্যই পারস্যের উমর খৈয়্যাম, ফরিদ আত্তার হাফিজ ও জালালুদ্দিন রুমির মত মরমি কবিরা নরনারীর প্রেমের মধ্যে গাঢ়তা সঞ্জার করে চালিয়ে দিয়েছেন আলাহর দিকে। রচিত হয়েছে লাইলি মজনুর মত মহাকাব্য অমর প্রেমকাব্য।
আর তখন হাসান নিজেকে মনে করত পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি ও সার্থক পুরুষ। সে অতীত দুঃখ দুর্দশা ও বর্তমান ভবিষ্যৎ ভুলে স্ত্রী ও তার মনমাতানো হাসির মধ্যে আত্মহারা হয়ে থাকল। এভাবেই চলতে লাগল। তবে সেই সাথে আরেকটি মহড়া চলল। দিনের বেলা সে কয়েকবার স্ত্রীর কাছে ছোটে আসত। এসে খাটের পার্শ্বে দুজন পাশাপাশি বসে কথাবার্তা বলত। অধিকাংশ সময় দুজনের মধ্যে তর্ক বেজে যেত। ফেরদৌসী স্বামীর কোন কথা মেনে নিত না। চলে যাওয়ার সময় হলে সে বলত উঠি বা যাই। আর এ মেয়েটা ছিল এমনই বোকা, সে মনে করত স্বামী বুঝি তাকে ফেলে চলে যাচ্ছে। আর এমনি সে তাকে ঝাপটে ধরত। ফেরদৌসী থাকত খাটের পার্শ্বে বসা হাসান দাঁড়ানো, সে সর্বহারার মত স্বামীকে এমন ভাবে চেপে ধরত যে, তার হাতের বালার কাটা-খাজ স্বামীর পিঠে বিধে যেত, প্রচন্ড ব্যাথা পেত। সে স্বামীর বুকে মাথা রেখে কাঁদতে থাকত। তখন হাসান একটু আদর সোহাগ করে দিলেই আবার শান্ত হয়ে যেত। হাসান কতবার তাকে বুঝিয়েছে, এতে যে তুমি নিজেই কষ্ট পাচ্ছ তাতো নয় আমাকেও তো অপমান করছ। স্ত্রী সন্তান ফেলে চলে যায় কারা- যারা রিকশা ওয়ালা, ছিন্নমূল, ঠিকানাবিহীন পথের মানুষ। এখন তুমি কি আমাকেও তাই মনে কর নাকি? কিন্তু বোকা মানুষরা নিজের মনে যা উদয় হয় তাই বিশ্বাস করে। ফেরদৌসীও স্বামীকে বিশ্বাস করতে পারে না।
দ্রষ্টব্যঃ মনসুর হেল্লাজের মিথটা সম্ভবত আব্দুল্লাহ ইবনে সাবার মত কোন ধুরন্দর ইহুদি মুসলিম মিল্লাতের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে উম্মাহকে জিহাদ বিমুখ নির্বীর্য করার জন্য। বিবেকের সিদ্ধান্ত হল, পৃথিবীতে অসংখ্য নবী রাসুল ও তাদের আসহাব অতীত হয়ে গেছেন, কিন্তু কেউ কোন দিন আনাল হক, আনাল হক জিগির তুলেন নি। তাহলে কি মনসুর হেল্লাজ তাদের চেয়েও বড় আল্লাহ প্রেমিক ছিল? বস্তুত এ কিচ্ছা যারা বলে বেড়ায়- এরা নিছক ধর্ম ব্যবসায়ী।
বিষয়: সাহিত্য
১৩৯৭ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
নিচে মনসুর হেল্লাজের মিথ্যাটা উল্লেখ করে ভাল করেছেন।
জাযাকাল্লাহ খায়ের।
মন্তব্য করতে লগইন করুন