চিঠি- ১১ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২৬ জুলাই, ২০১৬, ১২:৫৬:৩৯ দুপুর
অবশেষে আলতো করে স্ত্রীর পেটে হাত রেখে হাসে আর মনে মনে বলে, বাড়িতে কেউ আছেন? হ্যাঁ আছে, তবে কথা বলতে পারে না, খুব দুর্বল, ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, কীট, অনুকীট, শুক্রানু। কার আমার? হ্যাঁ আমার, আমার শুক্রানু। হাসানের দেহমন বাস্পায়িত হয়ে উঠে। আনন্দাতিশয্যে তার মন নক্ষত্র লোকে উড়ে বেড়ায়। আমার সন্তান, আমার থেকে, প্রাণ থেকে প্রাণের অস্তিত্ব, জীব থেকে জীবনের উৎপত্তি। আমার থেকে আমার সন্তান, আমার দুনিয়া, আমার ইহকাল-পরকাল, আমার জগত, আমার চোখের জ্যোতি। আসছে, আসছে পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি। আমি যেদিন থাকব না সেই দিন সে শত কণ্ঠে পৃথিবীকে আমার অস্তিত্বের জানান দিবে।
হাসান উপুর হয়ে অন্তহীন মমতায় স্ত্রীর পেটে হাত ঘুরায়- এই অজ্ঞাত বাসে আছে আমার সন্তান। একটা শুক্রানু, এই বাড়িতে থেকে ক্রমে ক্রমে আকৃতি ধারণ করবে, বড় হবে, হাত- পা, চোখ- মুখ, নাক- কান, মাথা সবকিছু এ অন্ধকার ঘরে গঠিত হতে থাকবে। এক সময় পূর্ণ মানবাকৃতি ধারণ করবে। তারপর সময় হলে পিচ্ছিল পথ বেয়ে নেমে আসবে হিংস্র শ্বাপদের অভয়াশ্রম এই কন্টকময় পৃথিবীতে। এসেই খর্বদেহ নিঃসহায়, ক্ষীণ দুর্বল দুটি হাত প্রচন্ড আক্রোশে উত্তোলিত করে ঠা ঠা চিৎকারে আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করবে- তাকে এই ঝঞ্জা বিক্ষুব্ধ পঙ্কিল পৃথিবীতে আনয়নের জন্য। তখন আমি দৌড়ে গিয়ে বলব- আরে রাখ রাখ, আগেই এত চেচামেচি করবি না কিন্তু বলে দিলাম। তোর সাথে আমার একটা অঙ্গিকার আছে, নে তোর অঙ্গিকার।
হাসান হাসে, স্ত্রীর পেটে চুমু খেয়ে আবার হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে, কে গো তুমি, তুমি কি আমার মা, নাকি আমার বাপ? তুমি যেই হও আমার অঙ্গিকার গ্রহণ কর-
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান।
জীর্ন পৃথিবীতে ব্যর্থ- মৃত আর ধ্বংস স্তূপ পিঠে,
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ,
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গিকার।
অবশেষে সব কাজ সেরে,
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আশির্বাদ,
তারপর হব ইতিহাস। (ছাড়পত্র, সুকান্ত)
হ্যাঁ, তাকে দেয়া আমার অঙ্গিকার পূরণ করতে হবে। শুরু হবে অনন্ত যুদ্ধ। প্রতিদিন আমার সন্তানকে নিরাপদ আশ্রমে রেখে বেরিয়ে পড়ব আমি স্বার্থবাদী হিংস্র হায়েনার অভয়ারণ্য এই পৃথিবীর সমরক্ষেত্রে। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি যুদ্ধ হবে, আমার সন্তানের চলার পথ কণ্ঠকমুক্ত করার জন্য, কুসুমাস্তির্ন করার জন্য, তার পৃথিবীর ব্যাপ্তি সুবিস্তৃত করার জন্য। সন্ধ্যায় ঘর্মাক্ত, ক্লান্ত, শ্রান্ত মলিন মুখে যখন ঘরে ফিরব তখন আমার সন্তান আব্বু ডেকে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়বে, তখন সকল দুঃখ কষ্ট ভুলে যাব। নিশীথে স্ত্রী আমার বুকে মাথা রেখে সমস্ত শরীরে ভালবাসার পরশ বুলিয়ে দেবে। আমি ভুলে যাব সকল দুঃখ যন্ত্রণা। পরদিন দ্বিগুন শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ব পৃথিবীর রনাঙ্গনে। আবার ঘরে ফিরব। আবার যাব রনাঙ্গনে। এ যুদ্ধ চলতে থাকবে অনন্ত কাল ব্যাপি, মৃত্যু পর্যন্ত। এভাবে গড়ে তুলব আমি এক স্বর্গীয় উদ্যান- সেখানে আমার সন্তানের হাসি ফুলের হাসিতে একাকার হয়ে যাবে। আমার সন্তান থাকবে দুধে-ভাতে। এভাবে আমার অঙ্গিকার বাস্তবায়ন করব।
তারপর আমার সন্তান যখন একটু বড় হবে তখন আমি বাইরে যেতে চাইলে সে দৌড়ে পিছু ছুটবে। তখন আমি তাকে কোলে নিয়ে এসে বউকে বলব, বাচ্চাটাকে পর্যন্ত সামলাতে পার না? সে রাগে ঝংকার দিয়ে বলে উঠবে, ওকি আপনাকে ছাড়া থাকে নাকি, আপনার বাচ্চা আপনি রাখেন গিয়ে আমি পারব না- বলে সে মুখ ঘুরিয়ে চলে যাবে। তখন তাকে কোলে নিয়ে দোকানে গিয়ে এটা ওটা কিনে দিয়ে, শান্ত করে খেলনায় বসিয়ে রেখে বাইরে যাব। প্রতিদিন বাহির থেকে আসার সময় চোখে পড়বে দুটি মুখ, চারটি চোখ জানালার ধারে বা দরজার আড়ালে আমার পথ পানে তাকিয়ে আছে। তারাদের মত মিটিমিটি হাসছে, যে হাসিতে মুক্তা ঝড়ে।
কোনদিন আমি হয়ত এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে কোন কাজে বাড়িতে বা বাইরে যাব। তখন স্ত্রী বলবে তাড়াতাড়ি আসে যেন, আমি এতদিন একা থাকতে পারব না। তখন আমি তাড়াহুড়া করে সপ্তাহের কাজ দু’দিনে গুছিয়ে হঠাৎ এসে উপস্থিত হব। সেই দূর থেকে চোখে ভেসে উঠবে জানালার ধারে আমার স্ত্রী-সন্তান, আমারই পথপানে তাকিয়ে প্রতিক্ষায় আছে। আমাকে দেখে খুশিতে ওদের মুখ চাঁদের মত ঝলমল করে উঠবে। তাদের সীমাহীন উচ্ছাসে, হাসির কলরবে বাসাটা মুখর হয়ে উঠবে। ঘরে ঢুকতেই আমার সন্তান কোলে ঝাঁপিয়ে পরবে- আব্বু আমার জন্য কি এনেছ? স্ত্রী বলবে সেই কবে থেকে পথের পানে তাকিয়ে আছি, এত দেরি হল কেন, বাইরে গেলে বুঝি বউ-বাচ্চার কথা মনে থাকে না? তখন বলব, গেলাম মাত্র দুই দিন হল, আর তুমি সেই কবে থেকে তাকিয়ে আছ, না ? তখন সে হেসে উঠে বলবে তাই নাকি, কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে যেন এক মাস হয়ে গেল।
হ্যাঁ, এই তো জীবন, এই তো জীবনের প্রত্যাশা, এই তো মানব জীবনের আশা আকাংখা, এই তো প্রাপ্তি, এটাই তো জীবনের লক্ষ উদ্দেশ্য। তারপর এক সময় আমরা বুড়া বুড়ি হয়ে যাব, দাঁত পড়ে যাবে। সে গরুর হাড় বা শক্ত কোন কিছু খেতে চাইবে, পারবে না। তখন আমি চিবিয়ে নরম করে ওকে খেতে দিব। না না, সে তো আমার ছোট, আগে আমার দাঁত পড়বে, তখন সেই চিবিয়ে আমাকে খেতে দিবে। এইভাবে একদিন বুড়া বুড়ি জড়া জড়ি করে নাতি নাতনি নিয়ে খেলা ধূলা করে বাকী জীবনটা কাটিয়ে দিব। এক সময় পৃথিবী আমাদেরকে অচল মুদ্রা বলে ঘোষণা দিবে, আর তার বুকে ঠাই দিবে না, পেটের ভিতর নিয়ে নিবে। তখন আমাদের সন্তান আমাদের কথা স্বরণ করে অন্তহীন কষ্ট নিয়ে দুটি হাত তুলে ধরবে উর্ধ্বে, চোখে ঝর্নার ধারা বইবে। আতর্নাদ করে উঠবে- রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বায়ানি সগীরা- প্রভু আমার মা- বাবা যেমন স্নেহ মমতায় আমাদেরকে লালন পালন করেছেন সেইরুপ মমতায় তুমিও তাদেরকে বেহেশতে লালন পালন কর, তুমি দয়া করে তাদেরকে বেহেশত নসীব কর। সেই দিন প্রমাণিত হবে এ মর্তলোকে আমাদের জন্ম সার্থক ছিল, সেই দিন সন্তান প্রতিপালনের বিনিময় আমরা পাব। সেই দিন পৃথিবী গেয়ে উঠবে জয় জয় মানবতার জয়, জয় জয় ইনসানিয়্যাতের জয়, ধন্য ধন্য খোদার সৃষ্টি ধন্য। বন্ধু যেদিন তুমি থাকবে না, সেদিন যদি পৃথিবীর কোন চোখ তোমার স্বরণে কাঁদে, জানবে- ইহলোকে তোমার জন্ম স্বার্থক ছিল। হাসান এভাবে স্বপ্ন দেখতে দেখতে শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন সকালে বাসাটা মুখর হয় উঠল। কোন শিশু তার সবচেয়ে প্রিয় খেলনাটা হারিয়ে পুনরায় ফিরে পেলে যেমন আনন্দে আত্মহারা হয়ে নাচানাচি হৈচৈ শুরু করে দেয় ফেরদৌসীর অবস্থাও ছিল তাই। সে আত্মহারা হয়ে গেল, কি করবে কী না করবে ভেবে পাচ্ছে না। কখনো স্বামীর খাওয়ার জন্য এটা ওটা আনছে। কখনো অমুক তমুকের গল্প ফেদে বসছে। কখনো এতদিন না যাওয়ার জন্য স্বামীকে শাসাচ্ছে, শিশুদের মত দৌড়াদৌড়ি করছে আর অবিরাম উচ্চস্বরে হাসছে। তার অবস্থা দেখে ওপাশের কামড়া থেকে ভাবী ঠাট্টা করছে, এতদিন দেখলাম নাকের পানি চোখের পানি এক হয়ে গেছে আর এখন তো বত্রিশ দাঁত বের করে হাসির জ্বালায় বাসায় টিকা দায়। সেও উত্তর দিল কেন, নিজের আন্দাজে বুঝ না? দাদু দু’দিনের জন্য বাড়িতে গেলে তোমার কেমন লাগে। আসলে হাসানের আসতে দেরি দেখে বোকাটা ভাবতে শুরু করেছিল, স্বামী তাকে ফেলে বাড়িতে চলে গেছে। আর তখনি কান্নাকাটি শুরু করল, অবশেষে স্থির হল পরদিন মানে হাসান যাওয়ার পরদিন তার ভাই হাসানদের বাড়িতে যাওয়ার কথা।
দশটায় হাসান বাংলা বাজার যাওয়ার জন্য বের হল তার একটি লেখা প্রকাশের তদবীরের জন্য। কী অবাক কান্ড এতক্ষন স্ত্রীর কাছে ছিল ভাল ছিল, বুঝতে পারেনি। কিন্তু বের হওয়ার পর বুঝতে পারল দুঃখে কষ্টে তার ভিতরটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। তার স্ত্রী তারই জন্য তার সামনে কাঁদল, এতটা দিন কাঁদল কষ্ট করল, এটা হয়ে উঠল তার সহ্যের অতীত। ভিতর থেকে কান্নার ঢেউ গলায় আচরে পরছে, গলা ব্যাথা করছে। অতি কষ্টে কান্না নিয়ন্ত্রন করছে। স্ত্রীর ব্যাথায় তার সমস্ত দেহ-মন বিষণ্ণ ও বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। মণ চাইছে চিৎকার করে কাঁদে, ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে তাহলে হয়ত মনের ব্যাথাটা লাঘব হবে। কিসের বাংলা বাজার, বেচারা বাসে বসে বসে রুমালে চোখ মুছে আর ভাবে, কেন সে কাঁদল, কেন আমি আমার নববধূকে এতটা কষ্ট দিলাম। যাওয়া আসার পথটুকু এক মোহাবিষ্ট শোকের ঘেরাটোপে বন্ধি হয়ে কিছুক্ষণ পর পর শুধু রুমালে চোখ মুছল। এ এক বিরল দৃষ্টান্ত, কোন পুরুষ স্ত্রীর এতটুকু কান্নায় এমন কষ্ট পায় না, এভাবে কাঁদে না। তবে হাসান কেঁদে ছিল এটাই সত্য, এটাই বাস্তব। কিন্তু তার দাম্ভিক স্ত্রী কোন দিন জানল না, তার আত্মীয়রা বুঝল না, জগত শুনল না, এক স্ত্রী অন্তপ্রাণ স্বামী স্ত্রীর জন্য কতটুকু কেঁদেছিল আর কিভাবে কেঁদেছিল।
দুইদিন পর হাসান বউ নিয়ে জামালপুরের উদ্দেশ্যে ট্রেনে চড়ে বসল। ট্রেন ময়মনসিংহ এসে থামল, ক্রসিংয়ের জন্য অনেক দেরি হচ্ছিল। প্রচন্ড গরম, ঠাণ্ডা হওয়ার জন্য ট্রেন থেকে নেমে ঘোরাফিরা করতে লাগল। এখান থেকে সোজা উত্তর দিকে তাদের বাড়ি। একটু পর সে তাকিয়ে দেখে তার ময়ূরপঙ্খিটা জানালা দিয়ে গলা বের করে দৃষ্টি কটুভাবে ঘাড় উল্টিয়ে অপলক নেত্রে স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে, হাসানের মনটা হাহাকার করে উঠল। সে বুঝতে পারল এই বোকাটা এখনো ভাবছে তাকে এখানে ফেলে সে সোজা বাড়িতে চলে যাবে। এজন্যই এভাবে তাকিয়ে আছে। যদি দেখে তার স্বামী ওদিকে যাচ্ছে তাহলেই চিৎকার করে নেমে এসে তার পিছু নেবে। স্ত্রীর জন্য তার খুবই মায়া হল, ওর জন্য তাড়াতাড়ি কিছু ঝালমুড়ি ও চানাচুর কিনে নিয়ে এসে ওর সাথে বসে পড়ল।
বিষয়: সাহিত্য
১২২৭ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন