চিঠি- ৮ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২২ জুলাই, ২০১৬, ১২:২৩:২৬ দুপুর
জ্ঞাতব্য
১। রমজান উপলক্ষে সিরিজটি বন্ধ ছিল, আল্লাহর নামে আবার শুরু করিলাম।
২। সঙ্গত কারণে এখন থেকে ধারাভাষ্যটি নাম পুরুষের বাচনিকে বর্ণিত হবে। কারণ এমন অনেক বিষয় আছে যা লজ্বা দ্বিধা সংকোচের কারণে উত্তম পুরুষে বর্ণনা করা যায় না, নাম পুরুষে সহজ হয়।
৩। এ সিরিজের মূল চরিত্র হাসান, ফেরদৌসি ও মুনিরা। সব ঠিকই আছে কিন্তু হাসানকে দেখানো হয়েছে একজন কলেজ শিক্ষক, আসলে সে একজন আলিয়া মাদ্রাসার মুহাদ্দিস। কলেজ শিক্ষক দেখানোর কারণ হল, আলেম শ্রেণির ব্যক্তি জীবন, দাম্পত্য জীবন বা মেয়েলি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে সম্ভবত আজো কোন আত্মজীবনী বা শিল্প সাহিত্য রচিত হয়নি, সমাজ তা গ্রহণ করে না, দোষনীয় মনে করে। কিন্তু হুবহু বাস্তবতা তুলে ধরতে, আলেম শ্রেণীর যাপিত জীবন দর্পনের সামনে আনতে তাকে মুহাদ্দেস হিসাবেই দেখানো হবে।
৪। ৬ মার্চের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে সিরিজটি অগোচালোভাবে লিখা শুরু করেছিলাম। কিন্তু এখন গুচিয়ে নিয়েছি। কাজেই প্রথম পর্বটি বাদ দিয়ে চলতি পর্বটিকেই প্রথম পর্ব বলে গন্য করতে হবে। নচেৎ পাঠকরা শেষ পর্বে গিয়ে পলটি খাবেন। মোট তিনটি পর্ব থাকবে। মুল ট্রাজেডি শেষ পর্বে।
৫। আমার মুল আশা আকাঙ্ক্ষা মুসলিম জাতীয় ঐক্য ও স্বার্থ। কাজেই এ সিরিজটির সাথে ঐক্য সংক্রান্ত লিখাগুলিও চলতে থাকবে। আল্লাহ, রাসূল (সাঃ) এর নির্দেশের বিপরীতে আমরা বিভক্ত হয়েছি এখন আমাদেরকেই ঐক্য হতে হবে। যুব সমাজের মাঝে চেতনা সৃষ্টি করুন, ইংশাআল্লাহ একদিন মুক্তি জুটবেই।
৬। আগে সাত কিস্তি গিয়েছিল, এখন অষ্টম কিস্তি থেকে শুরু হল। এবার চলুন---
৮
যে যে জগতে থাকে সে সে জগতের নেতৃত্ব কামনা করে। হাসানের বিয়ের পিছনে ইঞ্জিনিয়ারের লক্ষ ছিল তাকে জামালপুর তাবলীগের কুতুব বানানো, যার সুফল ও যশ খ্যাতির তারাও অংশীদার হবে। কারণ সে ছিল ধর্মীয় ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মোটামোটি পরিচিত ও পরিচিত ব্যক্তির ছেলে। কিন্তু তারা ছিল শুধু আধুনিক শিক্ষিত তাও আবার অর্ধ শিক্ষিত। কাজেই তারা চাচ্ছিল, সে সালটা লাগিয়ে এলেই তাবলীগের হুমরা চুমরা একটা কিছু হয়ে যেতে পারবে।
কিন্তু হাসান ভাল করেই জানে যে, রাসূল (সাঃ) দাওয়াতের কাজ করেছেন যা তাবলীগ আঞ্জাম দিচ্ছে। রাসূল তা’লীমের কাজ করেছেন সে দায়িত্ব এখন মাদরাসাগুলি পালন করছে। রাসূল (সাঃ) রাষ্ট্র, রাজনীতি ও যুদ্ধ করেছেন যা জামাত, ব্রাদারহুড ও অন্যরা আঞ্জাম দিচ্ছে। রাসূল (সাঃ) আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধির কাজ করেছেন যা পীর মাশায়েখরা করছেন। এই প্রত্যেকটা দল ইসলামের একেকটা অংশের উপর খিদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে, পূর্নাঙ্গ ইসলামের নয়। তবে তাদের প্রত্যেকের কিছু না কিছু ভুল আছে। আর এসব ভুলের কারণে তারা একেকটা ফেরকায় পরিনত হয়ে গেছে, একে অপরকে স্বীকৃত দিচ্ছে না। অথচ তারা ঐক্য হয়ে গেলে ইসলামের খিদমতও পূর্নাঙ্গ হয়ে যায় আর ইসলামও প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়। কিন্তু তারা ঐক্য হচ্ছে না বিধায় ইসলাম ও উম্মাহ ধ্বংস হচ্ছে। কাজেই তার একান্ত আশা আকাংখা হল এই পরস্পর বিদ্বেষী ফিরকাগুলিকে শুধু ঐক্যবদ্ধ করা। আর এটুকু কাজ করতে পারলে পৃথিবী থেকে দাজ্জালও বিদায় নিবে, ইসলামও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে, পৃথিবীতে শান্তিও নেমে আসবে।
আর এটা সর্বজন বিদিত এরূপ চিন্তা ধারার লোক তাবলীগ বা অন্য যে কোন ফিরকায় এককভাবে জড়িত হতে পারে না। সঙ্গত কারণেই সেও আংশিক তাবলিগী ছিল, তিন দিন সাত দিনের জন্য যেত। গ্রামের দুষ্ট পোলা শেখের পোলা সবগুলিকে সেই দাওয়াত দিয়ে দিয়ে তাবলীগে পাঠাত। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার ও তার বউ ফেরদৌসির উপর চাপ সৃষ্টি করল যে, তোর জামাইকে বল এক সাল লাগিয়ে আসতে। আর তার বউ এসে কানের গোড়ায় মশার মত ভন ভন করত। তখন সে মুখে বলত আচ্ছা সময় হোক দেখা যাবে। কিন্তু মনে মনে বলত, কয় কি হাদারামের দল, নতুন বউ ফেলে বছর চিল্লায় গিয়ে না খেয়ে মরব নাকি, এটা তো অসম্ভব। আবার ইসলামের অন্যান্য বিষয় যথা ইসলামী অর্থব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থা তথা খিলাফতের চিন্তা বাদ দিয়ে শুধু একক তাবলীগ করা তো জায়েজ নেই। আর এটাকেই একমাত্র দ্বীনের কাজ মনে করলে তো ঈমানই থাকবে না।
আগে থেকেই কথা বার্তা রমজানে চিল্লায় যেতে হবে। রমযান তো এসে গেল, এবার সে বউয়ের মুখের দিকে পিটপিটিয়ে তাকায়, দেখে সে কি কয় ? এই গরমের মৌসুম, তাও আবার রোযা রেখে চিল্লা ফাল্লা তার ভাল লাগে না। ওমা, বউ তো চোখ রাঙ্গায় আর ধমকায় যান তাড়াতাড়ি ভাগেন। কী আর করা, রাজার হুকুম অমান্য করা যায় কিন্তু বউয়ের হুকুম অমান্য করে সাদ্ধি কার। আঞ্চলিক মারকাজ থেকে তিন দিন সাত দিনের জন্য যাওয়া যায়, কিন্তু চিল্লার জন্য কাকরাইল যেতে হয়। সাথী খুজল পেল না। অবশেষে রোযা মুখে নিয়ে একাই রওয়ানা হল।
ঢাকায় পৌঁছে জামে আটকে বাসে বসে বসে ঘামছে আর চারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে, ইট বালি, সুরকির নগর, কংক্রিটের জনপদ। আচ্ছা এই ইট পাথরের ভুবনে মানুষ থাকে কেমনে। শুনেছি এরা এখানে বিষাক্ত আর সিষাক্ত বাতাস খায়, পানি কিনে খায়, গরম পানি খায়। পানির সাথে নাকি মাঝে মাঝে জোকও খেয়ে ফেলে। আর খাদ্য বলতে গাঁও গেরাম থেকে যা আসে সেই বাসী জিনিস খেয়েই কোন রকম বেঁচে থাকে। মাঝে মধ্যে মরা মুরগী, মরা গরু ছাগলের গোশতও গোগ্রাসে খায়। আবার খাসির মাংস মনে করে শিয়ালের মাংস তো প্রায়ই খায়। আহ হা রে, এরা কত গরিব, আল্লাহর দান বাতাস ও পানিটাও ঠিক মত পায় না।
শুনেছি এখানকার আকাশ ছোয়া হর্ম প্রাসাদের বাসিন্দারা নাকি টাকা দিয়ে তোষক বানায়, গদি বানায়। অথচ এরা কত গরিব, একটু বাতাস পায় না, পানি পায় না, টাটকা একটু খাবার পায় না। আজ যদি গাও গেরামের কৃষকরা ডাক মারে, ঢাকাইয়্যারা খুব বাড় বেড়ে গেছে, কেউ একমুঠ ধান বেচতে পারবে না, পিশারির একটাও মাছ বেচবে না, একটা কচু একটা লতাও বেচবে না, দেখি ওরা খায়টা কী। ওদেরকে বললাম আচ্ছা তোমাদের যেহেতু বুদ্ধি-শুদ্ধি আছে, তোমরা ঢাকায় গিয়ে দেশটা চালাও আমরা খেটে খুটে তোমাদের দানা পানির ব্যবস্থা করি। ওমা, ওরা রাজধানীতে গিয়ে জোক হয়ে গেছে। আমাদের সব রক্ত চোষে নিয়ে বিদেশ পাচার করছে, রংমহল তৈরি করছে। রাখ এবার এ গাদ্দারদের সাইজ করব। তখন বেচারাদের মাথায় হাত দিয়ে চেটে চোটে ইট পাথর খাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। আচ্ছা এই আহম্মকরা গাঁও গেরামে গিয়ে প্রকৃতির সন্তান প্রকৃতি থেকে জীবন রস সংগ্রহ করতে পারে না। এখানকার ভারি শিল্প প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি দেশময় ছড়িয়ে দিলেই তো এই মহানগরীটি রক্ষা পায় এবং বাসযোগ্য হয়ে উঠে।
না, এরা এখানে থেকে থেকে হয়ে উঠেছে ফার্মের মুরগী। এরা বাচ্চা দেয়, এ বাচ্চাগুলি কংক্রিটের প্রাচীরে ধাক্কা খেতে খেতে কংক্রিটের মানব-দানব হিসাবে বেড়ে উঠে। এরা কোন দিন এই মা মাটি ও মানুষের মমতা অনুভব করবে না। আর এদেরই বাচ্চারা একদিন প্রশ্ন করবে, আচ্ছা বাবা লাঙ্গল জিনিসটা কি, এটা কি খায় নাকি মাথায় দেয়। আচ্ছা মা কওছাইন দেহি, ঢেঁকি কি শুধু স্বর্গেই ধান বানেন, উনি কি মাঝে মধ্যে পৃথিবীতে ধান বানতে আসেন না। আসলে আমাকে বলো, আমি উনাকে একটু দেখতে যাব।
এভাবে রাজধানীর মুরুব্বিয়ানা চিন্তা করতে করতে যখন সে কাকরাইল পৌঁছল তখন ইফতারির সময় হয়ে গেছে। কিছুই জানা-শুনা নেই। আগে কিশোর বয়সে মাত্র একবার এসেছিল, তখন দুটি জিনিস নিয়ে এসেছিল, জুতা ও চাদর। দুটিই রমনা পার্কে চোর মশাইয়ের কাজে লেগে ছিল। অর্থাৎ চিল্লা থেকে আসা মামাকে আনতে গিয়ে ফজরের পর পার্কে গিয়ে ঘুমিয়ে ছিল, তখন চোর বেচারা জুতা ও চাদর দুটাই নিয়ে যায়। রাজধানিতে এ জাতীয় খেদমত হয় এটা আগে তার জানা ছিল না। আর এ তারিখেও জুতা ও ব্যাগ- দুটি জিনিস নিয়ে গিয়েছিল, তবে একটি লাভের মধ্যে ছিল। অর্থাৎ জুতা জোড়া নিয়ে গিয়েছিল আর ব্যাগটা টিকে গিয়েছিল। হোটেল মোটেল কোথায় তার জানা নেই। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেক ইত্যাদি দিয়ে ইফতার করল। গরমের এত লম্বা দিনে রোযা রেখে এটা একটা ইফতার হল। সে তো ঠিকই খাটের উপর বসে বসে ঠ্যাং নাচিয়ে নাচিয়ে মজা করে খাচ্ছে, আর আমাকে পাঠিয়ে দিল বনবাসে না হলেও কঙ্কর বাসে। আসলে যত কষ্ট ছেলেদের, মেয়েরা বসে বসে খায় আর স্বামীর ঘাড়ে চড়ে ঠ্যাং নাচায়। পানি খেতে হল কিনে। তারপর নামায পড়তে গেল।
ইফতারির পর তার শরীর জাহাজের মত ভারি হয়ে যায়। ব্যাগটা শিয়রে দিয়ে বিশ্রাম করতে লাগল। শরীরটা চাঙ্গা হলে একজনকে জিজ্ঞেস করল, ভাই এখানে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে নাকি হোটেলে ? সে বলল, যান যান খাওয়া শুরু হয়ে গেছে। ক্ষিধেয় পেট ছো ছো করছে। উঠে পড়ল কিন্তু একি, নতুন কিনা বাটা জুতা, মসজিদের ভেতর থেকে উধাও। বাহ আল্লাহ্র বান্দা আর শয়তানের বান্দাদের চমৎকার মিলন মেলা। খালি পায়েই গিয়ে দেখে বড় বড় প্লেটে দু’ তিন জন, চার পাঁচ জন, কোনটাতে সাত আট জন পর্যন্ত বসে বসে খাচ্ছ, এ যৌথ খাওয়াটা কোন দিনই তার পসন্দ নয়। এক পাশে দেখা গেল একজন, সেখানে গিয়ে বসে পড়ল। লোকটা তাকে দেখে খুশি হল বলে মনে হল না। তবে লোকটা সম্ভবত এখানকার খাদেম। সে শুকনা একটা তরকারী দিয়ে খাচ্ছিল প্রায় শেষ, হাসান দুই তিন লোকমা খেল। লোকটা একজনকে ডেকে বলল আর অমনি পাত ভর্তি ডাল দিয়ে গেল। ডালের মধ্যে ভাত গুলি সাতার কাটছে। লোকটাকে বেশ খাদক মনে হল, গোগ্রাসে খাচ্ছে আর হাত মুখ থেকে পাতে পড়ছে। তা দেখে হাসান যা খেয়েছিল তা বেরিয়ে আসার উপক্রম হল। লোকটা বলল, বসে আছেন কেন, খান খান। আমার হয়ে গেছে- বলে হাসান উঠে হাত ধুয়ে পানি খেয়ে চলে গেল। পেটে ক্ষুধা নিয়েই থাকল।
সেহেরীর সময়ও ঠিক একই অবস্থা হল। তবে এতে তার সুবিধা হল, পরের দিনটা ভাল কাটল। পেট ভর্তি সেহেরি খেলে বুক জ্বালা পোড়া করে। ফজরের পর জামাত বদ্ধ করা হল। বিভিন্ন জেলার লোক মিলিয়ে বিশজনের এক জামাত। আমীর স্কুল শিক্ষক , থাকে কুমিল্লা, বাড়ি সিরাজগঞ্জ। কয়েকটা তরুণ আছে, আমীর সাব তাদের পরিচয় নিচ্ছে আর বলছে ময়মনসিংহের কেউ নাই তো? ময়মনসিংহের পোলাপান খুব খারাপ। একবার আমার সাথে চার পাঁচটা ছেলে পরেছিল, ওরা আমাকে জ্বালিয়ে খাইছে ইত্যাদি ইত্যাদি। হাসান ছিল একটু দুরে, মনে মনে ভাবল, এবার গিয়ে পরিচয়টা দেই। বাড়ি ময়মনসিংহ শুনে বেচারা অর্ধেকটা মিলিয়ে গেল। মুহাদ্দিস পরিচয় পেয়ে যেন বাকী অর্ধেকটাও মিলিয়ে গেল। তখন সেই হয়ে উঠল অঘোষিত আমীর, সবাই সম্মান করত।
বিষয়: বিবিধ
১২৮২ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন