আগ্নেয়গিরির উদগিরণ-১৩
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ০২ জুলাই, ২০১৬, ০৩:৩১:৫৩ রাত
প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ-
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফের একবার ইসলাম প্রতিষ্ঠার সুযোগ এল। কারণ তখন কমিউনিষ্টরা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য রক্তারক্তি শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু আলেম সমাজের বিরুদ্ধাচরণের কারণে তারা ব্যর্থ হয়েছে এবং বর্তমানে নাসিয়াম-মানসিয়্যার অবস্থায় পৌঁছে গেছে। অথচ সমাজতন্ত্রের জন্ম ইসলাম থেকে। ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার একটা অংশ সমাজতন্ত্র যা লেলিনের স্বিকৃতি এবং ইসলাম গ্রহণের প্রস্তাব থেকেই বুঝা যায়।( খেলাফত ইশতিহারে বিস্তারিত আসছে) কাজেই তখন কমিউনিষ্টদের সাথে মিলে তাদেরকে ইসলামাইজেশন করে খুব সহজেই ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। কিন্তু আলেম সমাজ তা করেন নি।
আবার বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির দুটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও সমাজতন্ত্র। এ দু’টি মূলনীতির কারণে আলেম সমাজ বঙ্গবন্ধুকে গালাগালি করে, রাগ করে অভিমান করে একেবারে মসজিদের মেহরাবে ঢুকে লম্বা ঘুম দিলেন। তা না করে তারা যদি বিষয়টা ইসলামের সাথে বাজিয়ে দেখতেন তাহলে বুঝতে পারতেন এগুলি ইসলামেরই মূলবার্তা। বিষয়টা ব্যাখ্যা প্রয়োজন। কোন কোন বিষয় পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি গোস্টির কাছে একই অর্থ বোঝায় না বরং বিভিন্ন ব্যাখ্যার দাবী রাখে। যেমন ধর্ম বললে একজন মুসলিম বুঝে ইসলাম ধর্ম, হিন্দু বুঝে হিন্দু ধর্ম, খৃষ্টান বুঝে খৃষ্ট ধর্ম। অনুরূপ ভাবে সেক্যুলারিজম বলতে খৃষ্টানরা বুঝে ধর্মহীনতা। কারণ পুর্বে বলা হয়েছে যে, বাইবেলের চব্বিশ হাজার সংস্করণ পাওয়া যায়-যার একটার সাথে অন্যটার কোন মিল নেই। কাজেই ইউরোপ জানে তাদের ধর্মের কোন ভিত্তি নেই। খৃষ্টধর্ম বলতে বুঝায় সেন্ট পৌলের ধর্ম আর পোরুহিতদের ইচ্ছা অনিচ্ছা ও খেয়াল খুশির কিছু আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। কাজেই যেহেতু তাদের ধর্মের ভিত্তি নাই বিধায় তারা সেক্যুলারিজমকে ধর্মহীনতার ব্যাখ্যা দিয়ে উহাই নিজেদের ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করেছে। পক্ষান্তরে এ পৃথিবী চন্দ্র সুর্য্য যেমন চাক্ষুস সত্য ইসলামও তদ্রুপ চাক্ষুস সত্য, কোরআন অবিকৃত। কাজেই ইসলামের দৃষ্টিতে স্যাকুলারিজমের ব্যাখ্যা হচ্ছে একক ধর্ম, পৃথিবীতে একটাই ধর্ম, তা হচ্ছে ইসলাম। যেমন . إِنَّ الدِّينَ عِندَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ. নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য দ্বীন একমাত্র ইসলাম।)
এখন প্রশ্ন হল তাহলে কি হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদী খৃষ্টান ইত্যাদি ধর্মকে আমাদের স্বীকৃতি দিতে হবে ? অবশ্যই স্বীকৃতি দিতে হবে রাসূলের আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত। আর তা কোরানের নির্দেশ যেমন .. شَرَعَ لَكُم مِّنَ الدِّينِ مَا وَصَّىٰ بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَىٰ وَعِيسَىٰ أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ كَبُرَ عَلَى الْمُشْرِكِينَ مَا تَدْعُوهُمْ إِلَيْهِ اللَّهُ يَجْتَبِي إِلَيْهِ مَن يَشَاءُ وَيَهْدِي إِلَيْهِ مَن يُنِيبُ -- তিনি তোমাদের জন্যে দ্বীনের ক্ষেত্রে সে পথই নির্ধারিত করেছেন, যার আদেশ দিয়েছিলেন নূহকে, যা আমি প্রত্যাদেশ করেছি আপনার প্রতি এবং যার আদেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই মর্মে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং তাতে অনৈক্য সৃষ্টি করো না। আপনি মূশরেকদেরকে যে বিষয়ের প্রতি আমন্ত্রণ জানান, তা তাদের কাছে দুঃসাধ্য বলে মনে হয়। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন এবং যে তাঁর অভিমুখী হয়, তাকে পথ প্রদর্শন করেন। (৪২: ১৩)
অর্থাৎ সকল ধর্মের মূল এক। সবগুলি ধর্মই ইসলামের বিভিন্ন ধাপ যা হযরত নূহ (আঃ) এর মাধ্যমে শুরু হয়ে ক্রমবর্ধনের মাধ্যমে মুহাম্মদ (সাঃ) এর উপর পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয় এবং সমাপ্ত হয়। কাজেই পূর্ববর্তী ধর্মগুলিকে স্বীকৃতি দিতে হবে, কোনরূপ পার্থক্য করা যাবে না।
যেমন .. كُلٌّ آمَنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِّن رُّسُلِهِ -- সবাই বিশ্বাস রাখে আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, তাঁর গ্রন্থসমুহের প্রতি এবং তাঁর পয়গম্বরগণের প্রতি। তারা বলে আমরা তাঁর পয়গম্বরদের মধ্যে কোন তারতম্য করিনা।(২: ২৮৫)
আর প্রত্যেক নবী রাসূল স্ব স্ব উম্মতকে সর্বশেষ নবী সম্পর্কে ভবিষ্যতবাণী করে গেছেন, তার নিদর্শন বলে গেছেন, তাকে অনুসরণের অসিয়্যত করে গেছেন। সেগুলি প্রত্যেক জাতির স্ব স্ব ধর্ম গ্রন্থে এখনো উল্লেখ আছে। এ সম্পর্কে আমি অন্য গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছি তবে এখানে দুয়েকটি উদাহারণ উল্লেখ করছি।
গৌতম বৌদ্ধ মৃত্যুর সময় তার ভাই এবং প্রধান শিষ্য নন্দাকে বলে গেছেন, নন্দা এই পৃথিবীতে আমি প্রথম এবং অন্তিম (সর্বশেষ) বুদ্ধ নই। এই পৃথিবীতে সত্য এবং পরোপকার শিক্ষাদান করার জন্য সময়মত এক বুদ্ধ আবির্ভূত হবেন। তিনি পুতঃ-পবিত্র অন্তঃকরনের অধিকারী হবেন। তাঁর হৃদয় পরিশুদ্ধ হবে, তিনি জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান হবেন। তিনি সকল লোকের নায়ক ও পথ প্রদর্শক হবেন। যদ্রুপ আমি পৃথিবীতে সত্যের শিক্ষা দিয়েছি তিনিও তদ্রুপ সত্যের শিক্ষা দিবেন। তিনি পৃথিবীতে এমন জীবন দর্শন প্রচার করবেন যা একাধারে পবিত্র এবং পূর্নাঙ্গ। নন্দা তার নাম হবে মৈত্রেয়। (gospel of Buddha by carus). বুঝতে কোন অসুবিধা নাই এখানে মুহাম্মদ (সঃ) কে বুঝানো হয়েছে।
বেদ পোরানের কল্কি নরাশংস দ্বারা মুহাম্মদ (সাঃ) কে বুঝানো হয়েছে এ কথা হিন্দু পন্ডিতগণই গ্রন্থ লিখে প্রচার করে গেছেন এবং করছেন। বাইবেলের প্যারাক্লিট, কমপোর্টার, উস্ট্রারোহি, ফারানের ভাববাদি ইত্যাদি দ্বারা মুহাম্মদ (সাঃ) কে বুঝানো হয়েছে-খৃষ্টান পাদ্রিরাই এর স্বীকৃতি দিয়েছেন। কিন্তু হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদী, খৃষ্টান কেহই স্ব স্ব ধর্ম গ্রন্থ মানে না এবং অনুসরণ করে না। যদি করত তাহলে সবাই মুহাম্মদ (সাঃ) কে রাসূল হিসাবে স্বীকৃতি দিত এবং অনুসরণ করত। সুতরাং প্রমাণিত হল যে, পৃথিবীর সকল ধর্মই ইসলাম অর্থাৎ ইসলামের বিভিন্ন ধাপ। কাজেই একক ধর্ম প্রমাণিত হল। অতএব সেক্যুলারিজম বলতে এই একক ধর্ম ইসলামের স্বীকৃতি বোঝায়, এর বাইরে আর কোন ধর্ম নাই। এটাই হল সেক্যুলারিজম বা ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদের ব্যাখ্যা। যে এটা বিশ্বাস করবে না সে কিভাবে মুসলিম হিসাবে গন্য হবে ?
তারপর হলো সমাজতন্ত্র। এ সম্পর্কে খিলাফত ইশতিহারে বিস্তারিত আসছে, তবে এখানে সংক্ষিপ্ত উদহারণ পেশ করছি। দরিদ্র জনগোষ্ঠির অবস্থা ও প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে ইসলাম ক্রমান্বয়ে তিনটি অর্থ ব্যবস্থা দিয়েছে। যাকাত। কোরানে সালাতের কথা এসেছে ৮২ বার, আর যাকাতের কথা এসেছে ৯২ বার। সালাত আদায়ের জন্য মহল্লায় মহল্লায় পর্যাপ্ত মসজিদ গড়ে উঠেছে। ইমাম মুয়াজ্জিন তথা আলেমরা নামাজ আদায়ের তাকিদসহ পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ও প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রশ্ন হল, নামাজের চেয়েও অধিক যাকাতের ব্যাপারে তারা কি প্রচেষ্টা নিচ্ছেন। নামাজ হক্বুল্লাহ- যা ক্ষমার যোগ্য। কিন্তু ক্ষমার অযোগ্য হক্বুল ইবাদ তথা নিরন্ন বিবস্ত্র মানব সমাজ সম্পর্কে তারা কি জবাব দিবেন। ঠিকমত যাকাত উসুল হলে নিঃস্ব সর্বহারার অস্বিত্ব থাকত না। অথচ আলেম সমাজের উচিত ছিল, মসজিদ ভিত্তিক বাড়ি বাড়ি গিয়ে যাকাতের হিসাব করে উসুল করে দরিদ্র জন গোষ্ঠীর মাঝে বিলি বণ্টনের ব্যবস্থা করা। কিন্তু এ দায়িত্ব তারা পালন করছে না বিধায় নিরন্ন বিবস্ত্র মানব সমাজের হাহাকারের দায় তারা এড়াতে পারবেন না।
যাকাতে দরিদ্রের অভাব না মিটলে ইনফাক তথা আরো অতিরিক্ত ব্যয়ের বিধান রয়েছে। ইনফাক সম্পর্কে ১০০ এরও বেশি আয়াত রয়েছে। তাতেও অভাব না মিটলে ইসলাম সমাজতন্ত্রের বিধান দিয়েছে। যেমন,
وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٍ ﴿التوبة: ٣٤﴾
আর যারা স্বর্ণ ও রূপা জমা করে রাখে এবং তা ব্যয় করে না আল্লাহর পথে, তাদের কঠোর আযাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন। (৯: ৩৪)
وَيَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنفِقُونَ قُلِ الْعَفْوَ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمُ الْآيَاتِ لَعَلَّكُمْ تَتَفَكَّرُونَ ﴿البقرة: ٢١٩﴾
আর তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে, কি তারা ব্যয় করবে? বলে দাও, নিজেদের প্রয়োজনীয় ব্যয়ের পর যা বাঁচে তাই খরচ করবে। এভাবেই আল্লাহ তোমাদের জন্যে নির্দেশ সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা চিন্তা করতে পার। (২: ২১৯)
ব্যাখ্যাঃ অর্থাৎ সম্পদ কেউ জমা করতে পারবে না, প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ দান করে দিতে হবে। কেউ কেউ বলেন, সমাজে প্রয়োজন থাকলে অর্থাৎ অভাব থাকলে এ বিধান প্রযোজ্য হবে। হযরত আলী (রা) বলেন, যে কোন অবস্থায় কেউ চার হাজার দিরহামের বেশি সম্পদ জমা করতে পারবে না। যাই হউক, খিলাফত ইশতিহারে বিস্তারিত আলোচনা আসছে।
এখন প্রশ্ন হল, আলেমরা কি যাকাত ব্যতীত ইনফাক ও সমাজতন্ত্রের আয়াতগুলি বাদ দিয়ে দিয়েছেন ? তারা তো এগুলি সম্পর্কে কিছুই বলেন না। সুতরাং বুঝা গেল আলেমগণ ইসলাম, সমাজ, রাষ্ট্র ও মানবতার দায়িত্ব পালন করেন না। তারা শুধু ফিরকাবাজি ও ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে ভিক্ষাবৃত্তির দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। আর এ বিষয়টা যুব সমাজ, ছাত্র সমাজ, ছাত্র সংগঠন গুলি যত তাড়াতাড়ি বুঝবে- দাজ্জালের কবল থেকে তত তাড়াতাড়ি ইসলাম ও উম্মাহর মুক্তি জুটবে।
কাজেই বলছি, স্বাধীনতা উত্তর আলেম সমাজ বঙ্গবন্ধুর সাথে বিরোধিতা না করে তার সাথে আপসের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। কিন্তু তারা সে চেষ্টা করলেন না।
বিষয়: বিবিধ
১১৯৮ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন