আগ্নেয়গিরির উদগিরণ- ১২
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ০১ জুলাই, ২০১৬, ০২:২৪:৫৯ রাত
আলেম সমাজের দায়িত্ব ও কর্তব্য-
এতো গেল চেতনার বেসাতী সংক্রান্ত আলোচনা। এক্ষণে আমরা আলোচনা করব আলেম সমাজের দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে। আলেম সমাজের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে-ইসলাম বা খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা। আর খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য যে চিরন্তন সংগ্রাম তাকেই জিহাদ বলে। উল্লেখ্য যে, কারো গর্দান মেরে কালেমা পড়ানোর নাম জিহাদ নয় বরং জিহাদের মূল বার্তা হচ্ছে, সমাজের শোষণ বঞ্চনা উৎখাত করে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করা এবং অন্যায়-অবিচার-যুলুম-নির্যাতন নির্মূল করে ইনসাফ ও ন্যায় ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। এজন্যই আল্লাহ তা’লা বলেন,
وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ﴾
আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী যারা ফায়সালা করে না তারাই কাফের৷
وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ﴾
৭৫ আর যারা আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী ফায়সালা করে না তারাই জালেম৷
وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ﴾
আর যারা আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী ফায়সালা করে না তারাই ফাসেক ৷
এটাকে আমরে বিল মারুফ ও নেহি আনিল মুনকারও বলা হ্য়। যেমন রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন - «من رأى منكم منكرا فليغره بيده فإن لم يستطع فبلسانه فإن لم يستطع فبقلبه وذلك أضعف الإيمان» وَفِي رِوَايَةٍ: "وَلَيْسَ وَرَاءَ ذَلِكَ مِنَ الإيمَانِ حَبَّةُ خَرْدَلٍ" ‘‘তোমাদের মধ্যে যে কেউ কোন অসৎকাজ (হতে) দেখবে, সে যেন তাকে তার হাত দ্বারা প্রতিহত করে। তবে যদি সে ঐরূপ করতে অক্ষম হয়, তাহলে কথা দ্বারা যেন তাকে প্রতিহত করে, যদি এরপরও করতে অক্ষম হয়, তাহলে যেন অন্তর দিয়ে তাকে ঘৃণা করে। আর সেটা হবে সবচাইতে দুর্বল ঈমান। অন্য বর্ণনায় এসেছে, এর বাইরে বিন্দুমাত্র ঈমান নাই)।
এখন পর্যালোচনার বিষয় হলো আলেমগণ এ দায়িত্ব কতটুকু পালন করছেন। আমরা জানি এ দায়িত্ব পালনের লক্ষে রায় বেরেলির সিংহ সৈয়দ আহমদ বেরেলভি আন্দোলন শুরু করেছিলেন। কিন্তু কিছু পাঠান গাদ্দারের কারণে বালা কোটের ময়দানে সে আন্দোলনের সমাধি রচিত হয়। তারপর ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিপ্লবের ব্যর্থতার পর মুসলমানদের উপর অত্যাচারের খড়গ নেমে আসে। তখন আলেম সমাজ ইংরেজের সাথে সন্মুখ সমরের আর কোন সম্ভাবনা না দেখে রাষ্ট্র, রাজনীতি, সমাজ সবকিছু ছেড়ে ছোড়ে মসজিদ মাদরাসা ও খানকায় ঢুকে পড়লেন। সেই যে তারা ঢুকলেন অদ্যাবধি আর কখনো বের হলেন না।
পক্ষান্তরে ব্যর্থ সিপাহি বিপ্লবের পর মুসলমানদের একটা অংশ জাতীয় অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে, হিন্দুদের সাথে প্রতিযোগিতার লক্ষে, রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তির আসায় ইংরেজ বৈরিনীতি পরিহার করে হিন্দুদের ন্যায় তোষণ ও সহযোগিতার নীতি অবলম্বন করল। তারা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করল, ইংরেজের মন জয় করল, চাকরিপ-নকরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করল। অবশেষে ১৯৪৭ সালে ইংরেজ চলে যাবার পর সঙ্গত কারণেই এ আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণীর হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা চলে আসে। কারণ তারা আধুনিক শিক্ষায় রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে বিজ্ঞ ছিল।
পক্ষান্তরে আলেম সমাজ তখন দেওবন্দ ভিত্তিক ধর্মীয় শিক্ষা ও অন্যান্য খিদমত নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন এবং মসজিদ মাদরাসা ও খানকার চার দেয়ালের মধ্যে নিজেদের বন্দী করে ফেলেছিলেন। ফলে যা হবার তাই হলো। খৃষ্টীয় পোরুহিতদের কুকর্ম আর ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে সমগ্র ইউরোপ যেমন বস্তুবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ গ্রহণ করেছিল, একইভাবে আলেমদের পশ্চাতমুখিতা এবং নিস্পৃহতার কারণে পাকিস্তানের রাষ্ট্রনীতি হয়ে উঠেছিল বস্তুবাদ, ধর্মনিরপেক্ষ নাস্তিক্যতাবাদ এবং সর্বগ্রাসি পুঁজিবাদ। বিষয়টি পর্যালোচনার দাবী রাখে।
মুসলিম নেতৃবৃন্দ কংগ্রেস বা হিন্দুদের থেকে যখন ঐক্য সমতা ও ইনসাফের কোন সম্ভাবনাই দেখলেন না তখন শেরে বাংলার লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের দাবী জোরালো হল। তখন মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ আলেম সমাজকে বুঝালেন, পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হলে তা হবে ইসলামের ল্যাবরেটরি-গবেষণাগার। এ প্রতিশ্রুতি পেয়ে আলেম সমাজ সাধারণ জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ফলে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্ম হয়। এখন প্রশ্ন হল নবসৃষ্ট পাকিস্তানের নেতৃত্বে কে থাকবে এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রনীতি বা সংবিধান কি হবে ?
এখানে, ঠিক এখানেই কথাটা। কারণ তখন পাকিস্তানের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য আলেম সমাজ তাদের মসজিদ-মাদরাসা-খানকা ছেড়ে এগিয়ে আসেন নি। ফলে ইসলামের সূচনা কাল থেকে যে সাধারণ রেওয়াজ চলে আসছিল, মুসলিম রাষ্ট্রগুলি আলেমদের নেতৃত্বে কর্তৃত্বে পরিচালিত হওয়া-তার ছন্দ পতন ঘটল। ইংরেজ আমলের ন্যায় আলেমগণ রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন রয়ে গেলেন। আর নেতৃত্বের আসন কখনো ফাঁকা থাকে না। সেখানে মানুষ না বসলে শয়তান আসন গ্রহণ করে। সুতরাং আবিশ্যম্ভাবি পরিণতি হলো পাশ্চাত্য ধারার বস্তুবাদি সেক্যুলারিস্টদের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা চলে গেল। আর তারা তো ইসলাম বুঝেই না-প্রতিষ্ঠা তো সুদূর পরাহত। কাজেই জিন্নাহ ও মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দকে গালাগালি করা- যে তারা ইসলাম প্রতিষ্ঠা না করে মুসলিম জাতির সাথে গাদ্দারি করেছে এটা ঠিক নয়। এর জন্য দায়ী আলেম সমাজ, তারা এর দায় কোন ভাবেই এড়াতে পারবেন না।
আবার ইসলামের যে চির সুন্দর অর্থব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থা (বিস্তারিত খিলাফত ইশতেহার) আলেমগণ তা জনগণের সামনে তোলে ধরতে পারেন নি এবং সেগুলো প্রয়োগের কোনরূপ চেষ্টা তদবীরও করেন নি। ফলে পাকিস্তান একটি ধর্মহীন পুঁজিবাদী শোষণের রাষ্ট্রে পরিণত হল। এ সুযোগে পশ্চিম পাকিস্তান পুর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করল। ফলে পাক বাংলা ভারতের প্রায় অর্ধ কোটি মানুষের রক্তপাত ঘটিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হল। কাজেই আলেম সমাজ এ পাপের দায় এড়াতে পারবেন না। কারণ শরীয়া আইন চালু থাকলে শোষণ যুলুম নির্যাতন চলতে পারত না। আবার উভয় পাকিস্তানের আলেমগণ পাকিস্তানী শাসকদের শোষণ যুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে, জিহাদের হুমকি দিলে তার অবসান হত, পাকিস্তান ভাঙ্গত না, লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনপাত ঘটত না। কাজেই এর দায় আলেমদের।
পাকিস্থান জন্মের পর ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য আলেমগণ সম্মিলিতভাবে এগিয়ে তো আসেনইনি, তদুপরি মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন ফিরকা বিভক্তি সৃষ্টি করে ভারতবর্ষে ইসলাম প্রতিষ্ঠার পথ চিরতরে রুদ্ধ করে দিয়েছেন। বিষয়টা ব্যাখ্যা প্রয়োজন। ইংরেজ আমলের আগে উপমহাদেশে কোন ফিরকা ছিল না, সকলের একটাই পরিচয় ছিল সুন্নী হানাফি মুসলমান। কিন্তু বৃটিশ রাজত্বে বিভিন্ন প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে দেওবন্দী, তাবলীগী, জামাতে ইসলামী, বেরেলভী ইত্যাদি দলের সৃষ্টি হল। যেমন, দেওবন্দীরা ইসলামী শিক্ষার খেদমত আঞ্জাম দিচ্ছে, তাবলিগীরা অশিক্ষিত ও আধুনিক শিক্ষিত জনগোষ্টির দোরগোড়ায় ইসলামের দাওয়াত ও শিক্ষা পৌঁছে দিচ্ছে, জামাতে ইসলামী রাষ্ট্রীয় ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে যাচ্ছে, বেরেলভীরাও মাযার ভিত্তিক কিছুটা হলেও ইসলামের খেদমত করে যাচ্ছে। এ প্রত্যেকটা দলই ইসলামের একেকটা অংশে মহৎ খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু সমস্যা হল তারা একে অন্যের খিদমতের স্বীকৃতি তো দিচ্ছেই না বরং পরস্পরের প্রতি এতটাই বিষ উদগিরণ করছে, এতটাই শত্রুতা পোষণ করছে যতটা কাফের মুশরিকদের সাথেও করে না। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য তারা বিধর্মীদের সাহায্য গ্রহণ করে। ফলে পাক-বাংলায় বাহ্যত মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ মনে হলেও আসলে তারা সংখ্যা লঘিষ্ঠ। ফলে তারা নিজেরা নিজেরা কামড়া কামড়ি করে যেমন মরছে, তদ্রুপ বিধর্মীদের হাতেও বন্য প্রাণীর মত মারা পড়ছে। হায়, এই দুঃখ রাখার স্থান কোথায়? অথচ তাদের বুঝা উচিত ছিল, বিভিন্ন শাখায় খিদমতদাতা এসব দল এক্ত্র হলেই পূর্নাংগ ইসলাম প্রতিষ্ঠা হয়ে যেত।
কাজেই এই ফিরকাগুলি ঐক্যবদ্ধ হওয়া ব্যতীত ইসলাম প্রতিষ্ঠা, খিলাফত প্রতিষ্ঠা ও মুসলিম জাতির উত্থানের আশা করা মরীচিকায় পানি প্রাপ্তির আশার নামান্তর। আর এ বিষয়টি যুব সমাজ, ছাত্র সমাজ, ছাত্র সংগঠন- ছাত্র শিবির, ছাত্র সেনা, ছাত্র আন্দোলন ইত্যাদিরা যত তাড়াতাড়ি বুঝবে তত তাড়াতাড়ি তাদের নিজেদের, ইসলামের ও উম্মাহর জন্য মঙ্গল বয়ে আসবে। আল্লাহ সবাইকে সঠিক সমঝ দান করুন।
বিষয়: বিবিধ
১০৮২ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন