আগ্নেয়গিরির উদগিরণ-১১
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২৮ জুন, ২০১৬, ০১:৪৩:২৯ রাত
বাংলাদেশ প্রসঙ্গঃ
সম্ভবত বাংলাদেশে যে পরিমাণ চেতনার বানিজ্য হয় পৃথিবীর অন্য কোন দেশে চেতনা নিয়ে এতটা বানিজ্য হয় না। এ চেতনা বানিজ্যের মুল উৎস হলো ইংরেজ শাসন। কারণ ইংরেজরা তোলাদন্ড হাতে নিয়ে এসে যখন দেখল, এদেশে হিন্দু মুসলিম দ্বন্দ তো আছেই সেই সাথে মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যেও কোন ঐক্য নেই। একে অন্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে, রাজ্য আক্রমণ করে, তারা নিজ নিজ স্বার্থে পরস্পর হানাহানি করে বহুধা বিভক্ত হয়ে আছে। ইংরেজ তুলাদন্ড ফেলে রাজদন্ড হাতে নেয়ার প্রয়াসি হয়ে উঠল। আর এ ক্ষেত্রে তারা divide and rule নীতি প্রয়োগ করল। অর্থাৎ তাদের মূলনীতি ছিল ভাই ভাই সে লড়াও, ঘর ঘর সে, পরুসি পরুসি সে, গাঁও গাঁও সে, মহল্লা মহল্লা সে, রাজা রাজা সে, অওর হিন্দু মুসলমান সে লড়াও। আর এভাবে বিভক্ত করে, দুর্বল করে ভারত শাসন কর। অন্যথায় গুটি কয়েক ইংরেজ ভারত বর্ষ জয় করে শাসন করা সম্ভব ছিল না।
তারপর ইংরেজরা চলে যাবার পর উত্তরাধিকার হিসাবে আমরা ইংরেজের এ নীতিটি গ্রহণ করি। আমরা খন্ড খন্ড হয়ে একেক দল একেকটা চেতনার বানিজ্য শুরু করে দিয়েছি। যেমন এক দল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফেরি করছে। কথা সত্য মতলব খারাপ। সত্য এজন্য যে, কেউ পরাধিনতা বা অন্যের গোলামি মেনে নেয় না বিধায় নিজেদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে প্রাকৃতিকভাবেই মানুষ সচেতন থাকে এবং থাকতে হয়। এটা দেশ প্রেম এবং মহৎ মানবীয় গুন। আবার মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানের লোটতরাজ, শাসন শোষণ থেকে মুক্ত করে অর্থনৈতিক সাম্য ও ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে এদেশে শোষণ বঞ্চনাহীন একটি আদর্শ সমাজ গড়ার লক্ষে। অথচ স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দি অতীত হয়ে গেলেও সে লক্ষ্য তো অর্জিত হয়ই নি বরং ঐসব চেতনার বেনিয়ারা দেশের সম্পদ লোটপাট করে বিদেশে পাচার করছে, সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে, খুন খারাবিতে দেশকে শ্মশানে পরিণত করছে। দেশ বারংবার দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান হচ্ছে। অথচ সাধারন মানুষ প্রান্তিকে চলে যাচ্ছে। কাজেই বুঝা যাচ্ছে এই চেতনার পেছনে আসল চেতনা হচ্ছে অন্তহীন লোটপাট আর লালসার অনন্ত সরোবরে লকলকিয়ে উঠা বাসুকির অযুত কোটি রসনার রসদের যোগান মূল উদ্দেশ্য। আর এটাই চেতনাবাজদের মতলব।
আরেক দল জাতীয়তাবাদী চেতনার ফেরি করছে। এখানেও কথা সত্য মতলব খারাপ। আর তা দু’টি কারণে, প্রথমতঃ ইসলাম সাধারণতঃ রাষ্ট্র, ভাষা, আঞ্চলিকতা ও গোত্রভিত্তিক জাতীয়তাবাদের স্বীকৃতি দেয় না। ইসলাম ঘোষণা দিয়েছে . مِّلَّةَ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ هُوَ سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمِينَ - তোমরা তোমাদের পিতা ইব্রাহীমের ধর্মে কায়েম থাক। তিনিই তোমাদের নাম মুসলমান রেখেছেন)। অর্থাৎ ইসলামই মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তি। কাজেই সকল মুসলমান ভাই ভাই, এক জাতি, এক গোত্র, সকল মুসলিম দেশ এক দেশ। ইসলামী জাতীয়তাবাদের সুবিধা এই যে, ধনি দেশ গুলির সম্পদে দরিদ্র দেশগুলির অধিকার স্বীকৃত, দরিদ্র জন গোস্টি যে কোন দেশে ভিসা ও বর্ডারবিহীন ভাবে সে দেশের বিধিমালা অনুযায়ী চাকরি-নকরি, ব্যবসা-বানিজ্যি ইত্যাদি সুবিধা প্রাপ্ত হবে, যে কোন দেশে বসবাস করতে পারবে। কাজেই ধনী দরিদ্র বৈষম্যে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিম জাতিয়তাবাদের কোন বিকল্প নেই।
সুতরাং প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যদি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের জন্ম না দিয়ে মুসলিম জাতীয়তাবাদের জন্ম দিতেন এবং সার্কের ন্যায় মুসলিম জাতিসংঘ বা আফ্রেশিয় ইউনিয়ন বা কেন্দ্রীয় খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতেন বা চেষ্টা করতেন তাহলে তিনি শুধু বাঙালি জাতিই নয় বরং সমগ্র মুসলিম জাতির ত্রানকর্তার বরমাল্যটি অর্জন করতে পারতেন। কারণ মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে কোন কেন্দ্রীয় সংস্থা থাকলে আজ মধ্যপ্রাচ্যসহ ফিলিস্তিন, আরাকান, কাশ্মির, জিংজিয়াং ইত্যাদি স্থানে মুসলমানদের মানব বিপর্যয়ের সম্মুখিন হতে হত না এবং মুসলিম দেশগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যও থাকতো না।
পক্ষান্তরে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কুফল এই হলো যে, আজ মধ্যপ্রাচ্যের স্বজাতি মুসলিম ভাইয়েরা আমাদেরকে মিসকিন বাঙালি বলে ডাকে, আমরা তাদের ফুটপরমাশ খাটি। অথচ তাদের প্রত্যেকটা পেট্টো ডলারে তাদের নিজেদের যতটুকু অধিকার রয়েছে ইসলাম আমাদের জন্যও ঠিক ততটুকু অধিকারই সাব্যস্ত করেছে। আবার মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশগুলি আমাদেরকে শ্রমিক জাতি, দাস জাতি হিসাবে গন্য করে। আর এসবই মুসলিম জাতীয়তাবাদের খেলাপ।
দ্বিতীয়তঃ বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ যদি আমাদেরকে ধনে-জনে, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, যশ-খ্যাতি, ক্ষমতা ও নেতৃত্বে বিশ্ব সভার আসরে পৌঁছে দিতে পারত, যেমন হিটলারের জাতীয়তাবাদী চেতনা জার্মানদের বিশ্ব জয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছিল, কামাল আতাতুর্কের জাতীয়তাবাদ তুর্কিদের জন্য অন্তত কিছুটা হলেও সুফল বয়ে এনেছিল-তাহলেই আমরা এ জাতীয়তাবাদকে আশির্বাদ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারতাম। কিন্তু এ জাতীয়তাবাদীরা দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে জাতির ললাটে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দুর্নীতি গ্রস্থের কলঙ্ক তিলক এঁটে দিল। মিসকিন জাতি, শ্রমিক জাতি, দাস জাতি ইত্যাদি কলঙ্কময় অবিধাগুলি জাতির ভাগ্যলিপিতে পরিণত হল। কাজেই প্রমাণিত হল এসব জাতীয়তাবাদ কায়েমী স্বার্থবাদীদের বেলুনিয় স্লোগান মাত্র, জাতীর কল্যাণ সেখানে কিছুই নাই। বস্তুত মুসলিম জাতীয়তাবাদের শ্লোগান ব্যতীত এ জাতির মুক্তির দ্বিতীয় কোন সুরঙ্গ নেই।
বিষয়: বিবিধ
১১৫৯ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন