আগ্নেয়গিরির উদগিরণ- ১০

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২৭ জুন, ২০১৬, ০২:০১:২২ রাত

সোনার প্রতিমা মোর লুটায়ে সিন্ধু পাড়ে –

২০১৫ সালের ঘটনা। আয়লান, আয়লান কুর্দি, তিন বছরের শিশু। মানব সভ্যতার কপোলে এক প্রচণ্ড চপেটাঘাত, মুসলিম উম্মাহর এক অশনি সংকেত। পশ্চিমারা মধ্য প্রাচ্যে যে আগুন জ্বালিয়েছে-সেই অগ্নিগর্ভ থেকে বাচতে ইউরোপের দিকে লক্ষ লক্ষ শরনার্থীর ঢল নামে। সিরীয়ার আব্দুল্লাহ কুর্দি স্ত্রী রেহানা ও দুই সন্তান- তিন বছরের আয়লান ও পাঁচ বছরের গালিবকে নিয়ে ইউরোপের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। ২০১৫ এর পহেলা সেপ্টেম্বর তুরস্ক থেকে গ্রিস যাওয়ার লক্ষে তারা ভুমধ্য সাগরে ছোট্ট একটি ডিঙ্গি নৌকায় চেপে বসে। কিন্তু নৌকা ডুবিতে অন্যান্যদের সাথে আব্দুল্লাহ ব্যতিত তাঁর পরিবারের সবাই মারা যায়। কিন্তু আল্লাহ তা’লা মুসলিম জাতীর আত্নসংশোধনের নিদর্শন হিসাবে ভুমধ্য সাগরের প্রমত্ত ঢেউয়ের ডগায় তোলে আয়লানকে তুর্কি সৈকতে নিক্ষেপ করেন। লাল জামা, নিল হাফপ্যান্ট ও জুতা পরিহিত সোনার প্রতিমা আয়লানের দেহ বালুতে মুখ গোজে পড়ে থাকে। না, না এটা আয়লানের দেহ নয়, এটা মুসলিম উম্মাহর শবদেহ, এটা এক অভিশপ্ত জাতীর ক্ষয়িষ্ণু অবয়বের ধ্বংসাবশেষ।

তাঁরপর নিলুফার ডেমির নামক এক তুর্কি মহিলা ফটো সাংবাদিক সৈকতে মুখ থুবরে পরে থাকা আয়লানের দেহটি ক্যমেরা বন্দি করেন। দুনিয়ার ইলেকট্রিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে সেই ট্রেজিক দৃশ্য । পৃথিবীতে শোকের ঝঞ্ঝা বয়ে যায়। মানবতা ডুকরে কেঁদে উঠে। কাঁদে ইউরোপ, কাঁদে দূর প্রাচ্য, কাঁদে পৃথিবী। শুধু কাঁদেনা মধ্যপ্রাচ্য, কাঁদেনা উম্মাহর নেতৃবৃন্দ, কাঁদে না ইসলাম ও মুসলিমের রক্ষক আলেমে দ্বীন। তারা স্ত্রী সন্তান নিয়ে মৌজ করে, ফুর্তি করে। অথচ খৃষ্টীয় ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিসের হৃদয় হাহাকার করে উঠল, তিনি গর্জে উঠলেন। ইউরোপের প্রত্যেক দেশে শরনার্থিদের আশ্রয় দেয়ার নির্দেশ প্রদান করলেন।

খৃষ্টীয় ধর্মগুরুদের উদ্দেশ্যে তিনি ঘোষণা দিলেন “হে ইউরোপের ক্যাথলিক যাজক পল্লী, তোমরা তোমাদের প্রতিটি পল্লীতে একটি করে মোহাজের পরিবারকে গ্রহণ কর। আমি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি, প্রত্যেক যাজক পল্লী, প্রতিটি ধর্মীয় সম্প্রদায়, প্রতিটি আশ্রম, প্রতিটি মঠ, প্রতিটি গীর্জা এবং প্রতিটি ধর্মালয়ে তোমরা সিরীয় শরনার্থীদের আশ্রয় দাও। আজ সিরিয়রা পরিত্যাক্ত, তাদের তোমরা প্রতিবেশী করো এবং তাদের মনে আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে দাও। ইউরোপের সমস্ত বিশপের প্রতি আমার আহ্বান, আমার আহবানে সাড়া দিন।” ফলে হাঙ্গেরি ব্যতিত সমগ্র ইউরোপ শরনার্থীদের আশ্রয় দিতে সম্মত হল। সর্বাগ্রে জার্মানি এগিয়ে এল, তারা আট লক্ষ রিপিউজি আশ্রয় দানের ঘোষণা দিল এবং সাথে সাথে তাদের জন্য তিনশো কোটি ইউরো (২৬ হাজার কোটি টাকা) বরাদ্দ দিল।

খৃষ্টান ধর্মগুরু হয়েও বিপর্যস্ত মুসলমানদের প্রতি পোপ ফ্রান্সিসের এই মমত্ববোধ, মানবতাবোধ সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় তুলল। কেউ শিরোনাম করল সৌদি বাদশার চেয়ে ফ্রান্সিস বড় মুসলমান, কেউবা মক্বা মদিনার ঈমামের চেয়ে পোপ বড় ইমানদার ইত্যাদি বিভিন্ন শিরোনামে পোপের শরনার্থি আশ্রয় দানের সংবাদটি প্রকাশ করল। মধ্য প্রাচ্যের পেট্রো ডলার সমৃদ্ধ সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, উমান, আরব আমিরাত ইত্যাদি ধনাঢ্য দেশগুলির বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠল, পৃথিবীবাসি এদের উপর অভিসম্পাত বর্শন করে। কারন ইউরোপ যেখানে লক্ষ লক্ষ শরনার্থিকে গ্রহণ করছে, সেখানে এসব দেশ নীরব, উদ্বাস্তুদের কোন ফয়সালা করছে না, যুদ্ধ বন্ধের কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না, শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করছে না। এজন্যই এরা আল্লাহ্‌ ও সমগ্র মানব জাতির ঘৃনার পাত্রে পরিণত হয়েছে। আর কোন জাতি যখন এমন আত্নবিধ্বংসী স্থরে উপনিত হয় তখন আল্লাহ্‌ তা’লা তাদেরকে ধ্বংস করে দেন। যেমন সম্রাট নেবুচাদ নেজার কর্তৃক জেরুসালেম ও যিহুদার ধ্বংস সাধন এবং হালাকু খান কর্তৃক বাগদাদ ধ্বংস সাধন- যা পুর্বে আলোচিত হয়েছে।

মধ্য প্রাচ্যের বর্তমান অবস্থা এশিয়া ও মুসলিম জাতির জন্য এক সতর্ক বার্তা। যতদুর মনে হচ্ছে শরনার্থিদের সাথে সাথে ইসলাম চলে যাচ্ছে ইউরোপে। তারপর হ্য়ত একদিন দেখা যাবে মধ্যপ্রাচ্য প্রাচিন জেরুজালেম ও যিহুদার ভাগ্যবরন করেছে, ইতিহাসের চেড়া পাতায় আশ্রয় নিয়েছে, সেখানে ইহুদীদের কথিত প্রমিজল্যান্ড বৃহত্তর ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। আর ইউরোপ হয়ে গেছে মুসলিম জনপদ। এর প্রমান হচ্ছে এমনিতেই ইউরোপ ব্যাপকভাবে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে তার উপর লক্ষ লক্ষ মুসলিম শরনার্থির মিশ্রন ও সংশ্রব-এটাই প্রমান করে ইউরোপ ইসলামের হতে যাচ্ছে। আর ইসলামের জন্মভুমি ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আর এভাবেই আল্লাহ্‌ তা’লা দুষ্কৃতিকারীদের ব্যাপারে তার ওয়াদা পূর্ণ করেন -- وَإِن تَتَوَلَّوْا يَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ ثُمَّ لَا يَكُونُوا أَمْثَالَكُم -- যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তিনি তোমাদের পরিবর্তে অন্য জাতিকে প্রতিষ্ঠিত করবেন, এরপর তারা তোমাদের মত হবে না। (৪৭: ৩৮)

এখন প্রশ্ন হল খৃষ্টান পোপ যদি মুসলমানদের আশ্রয় দানের নির্দেষ দিতে পারেন, খৃষ্টীয় ইউরোপ যদি আশ্রয়দানে আগ্রহ প্রকাশ করতে পারে-সেক্ষেত্রে ইসলামের আলেমগন, মক্বা মদিনা, আল-আযহারের ইমামগন ও মুসলিম নেতৃবৃন্দরা কী দায়িত্ব পালন করলেন, তাদের ভূমিকা কি ? এখানে, ঠিক এখানেই কথাটা। কারন আলেমদের উপর বিশেষতঃ উম্মাহর ধর্মগুরু হিসাবে মক্বা মদিনার ইমামগনের উপর ফরয ছিল, শরনার্থী সমস্যার সমাধান করা, মুসলিম দেশগুলিকে আশ্রয়দানে বাধ্য করা, মুসলিম নেতৃবৃন্দকে বাধ্য করা, মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা সমাধান করা, ঐক্যের ডাক দেয়া, আলেমদের ঐক্যবদ্ধ করা। আলেমদের ঐক্যের মাধ্যমে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা। তারপর সমস্যা সমাধানে মুসলিম নেতৃবৃন্দকে বাধ্য করা, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেনের মিমাংসা করা, আসাদ ও আইসিসের ফয়সালা করা। নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে সমাধান না হলে পৃথিবীর আলেম সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে খিলাফত/ মুসলিম জাতী সংঘ/ আফ্রেশিয় ইউনিয়ন বা অন্য কোন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে মধ্যপ্রাচ্যসহ উম্মাহর সকল সমাস্যার সমাধান করা।

কিন্তু না, তারা কিছু তো করলেনই না এমনকি একটি বক্তব্য বিবৃতি পর্যন্ত দিলেন না, শোক প্রকাশ করলেন না। আয়লানের জন্য সারা দুনীয়া কাঁদল, বক্তব্য-বিবৃতি দিল, দুঃখ প্রকাশ করল। কিন্তু মক্বা মদিনা আল-আযহারের ইমামগন, তেহরান দেওবন্দসহ বিশ্বের আলেমগন, বাইতুল মুকাররমের ইমামগন ইসলামকে পুঁজি করে সর্বোচ্চ সুবিধা ও সম্মান ভোগ করতেছেন-অথচ আয়লানের জন্য তারা একটি কথাও বললেন না, দুঃখ প্রকাশ করলেন না, তাদের চোখ কাঁদল না, হৃদয় বিগলিত হল না, অথচ কাফেররা কাঁদল। এরা আলেম নয়, উম্মাহর অভিশাপ। এদের সম্পর্কেই আল্লাহ্‌ বলেন-- وَلَقَدْ ذَرَأْنَا لِجَهَنَّمَ كَثِيرًا مِّنَ الْجِنِّ وَالْإِنسِ لَهُمْ قُلُوبٌ لَّا يَفْقَهُونَ بِهَا وَلَهُمْ أَعْيُنٌ لَّا يُبْصِرُونَ بِهَا وَلَهُمْ آذَانٌ لَّا يَسْمَعُونَ بِهَا أُولَٰئِكَ كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ أُولَٰئِكَ هُمُ الْغَافِلُونَ = আর আমরা জাহান্নামের জন্য নিশ্চয়ই সৃষ্টি করেছি জিন ও মানুষের মধ্যের অনেককে, তাদের হৃদয় আছে তা দিয়ে তারা বুঝে না, আর তাদের চোখ আছে তা দিয়ে তারা দেখে না, আর তাদের কান আছে তা দিয়ে তারা শোনে না। তারা গবাদি-পশুর ন্যায়, বরং তারা আরো পথভ্রষ্ট। তারা নিজেরাই হচ্ছে উদাসীন। (৭: ১৭৯)

সুতরাং উম্মাহর কাছে আমাদের প্রশ্ন, এখন তোমরা কী করবে ? তোমাদের আলেম সমাজ আশাররুল উলামা হয়ে গেছে। রাসুল (সাঃ) যাদেরকে ইসলাম ও উম্মাহ রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে গেছেন তারা এখন ইসলাম নিয়ে সিন্দবাদের মত বানিজ্যিতে ব্যস্ত। উম্মাহর উত্থান পতন ও ধ্বংস নিয়ে তারা মাথা ঘামায় না, প্রয়োজনও বোধ করে না। এই ধর্ম ব্যবসায়ী আশাররুল উলামাদের ধ্বংস না করলে তোমাদের মুক্তি নেই। কাজেই হয় ওদের গরু ছাগলের মত হাকিয়ে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ কর না হয় ধ্বংস কর। অন্যথায় তোমাদেরও এমন দিন আসছে, যখন আয়লানের বাবা আব্দুল্লাহর মত ভিসুভিয়াসের যন্ত্রনা বুকে ধারন করে আজরাইলের সাক্ষাৎ প্রতিক্ষায় তার পথ পানে তাকিয়ে প্রহর গুনা ব্যতিত কোন গত্যন্তর থাকবে না। আল্লাহ্‌ সবাইকে সঠিক সমঝ দান করুন।







বিষয়: বিবিধ

১২৪৪ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

373247
২৭ জুন ২০১৬ রাত ০৪:০৫
কুয়েত থেকে লিখেছেন : রাসুল (সাঃ) যাদেরকে ইসলাম ও উম্মাহ রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে গেছেন তারা এখন ইসলাম নিয়ে সিন্দবাদের মত বানিজ্যিতে ব্যস্ত। ভালো লাগলো ধন্যবাদ جزاك الله خيرا وشكرا لك يا أخي الكريم

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File