আগ্নেয়গিরির উদগিরণ-৭

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২২ জুন, ২০১৬, ০২:১৮:০৯ রাত

ইতিহাসের শিক্ষা/ পুনরাবৃত্তি- ১

ইতিহাসের বড় শিক্ষা হল ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না। যদি করত, তাহলে পৃথিবীতে প্রথম খুনের পর দ্বিতীয় খুন হত না, প্রথম যুদ্ধের পর দ্বিতীয় যুদ্ধ হত না। তদ্রুপ আলেমদের ফিরকাবাজি ও এখতেলাফের কারণে অতীতে মুসলিম জাতির যে সর্বনাশ হয়েছে- তা থেকে শিক্ষা নিলে মুসলমানদের পরবর্তী বিপর্যয় হত না, বর্তমানে এ ধ্বংস গহ্বরে পতিত হতে হত না। এখানে আমরা বাগদাদের উদাহারণ টেনে আনছি। কারণ ফিরকাবাজির কারণে বাগদাদে আটবার দাঙ্গা হয়েছিল, তবে অষ্টমবারের পর আর কোন দাঙ্গা হয়নি। কারণ তখন আর দাঙ্গা করার মত সেখানে কেউ জীবিত ছিল না। যেমন-

প্রথম ঘটনাঃ প্রথম ঘটনা ঘটে হিজরী ৩১৭ সালে। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত, মাকামে মাহমুদ শব্দের অর্থ নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে ঝগড়ার সূত্রপাত হয়। শেষ পর্যন্ত এই ঝগড়া ব্যাপক আকার ধারণ করে। কাটাকাটি ও মারামারি করার ফলে হাজার হাজার লোক মারা যায়। ঐতিহাসিক আবুল ফিদা লিখেছেন, এই সংঘর্ষে কয়েক হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছিল, তাদের মধ্যে আলিম ও বিদ্বান লোকের সংখ্যা অনেক ছিল।

দ্বিতীয় ঘটনাঃ-হিজরি ৩২৩ সাল, তখন খলীফা ছিলেন রাজী বিল্লাল। বাগদাদের বড় মসজিদে বিসমিল্লাহ পড়া নিয়ে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়। একদল ঘোষণা দিল যারা নামাজে উচ্চস্বরে বিসমিল্লাহ পড়বেনা, তাদের কেউ ইমাম হতে পারবে না। অন্য দল ঘোষণা দিল যারা বিসমিল্লাহ নিম্নস্বরে পড়বে না তারাও ইমামতি করতে পারবে না। আলেমরাও স্ব স্ব ফতোয়ার উপর অটল থাকল। ফলে ভয়ানক দাঙ্গার সৃষ্টি হল, মসজিদ রক্তাক্ত হয়ে গেল। খলীফা ছিলেন শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী। দাঙ্গার সংবাদ শুনে তিনি ফরমান জারি করলেন, নামাজে সবাইকে উচ্চস্বরে বিসমিল্লাহ পাঠ করতে হবে, যারা আদেশ অমান্য করবে তাদেরকে কঠোর শাস্তি দেয়া হবে এবং তাদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু নিম্নস্বর ওয়ালারা খলীফার আদেশ মেনে নিতে পারল না। বিবাদ অব্যাহত থাকল। ঐতিহাসিক আবুল ফিদা বলেন, দীর্ঘ সাত বছর পর্যন্ত এ ঝগড়া স্থায়ী হয়। অবশেষে খলীফা রাগান্বিত হয়ে তাদেরকে ধ্বংস করার নির্দেশ দেন। ফলে তাদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হল এবং অসংখ্য মুসলমানকে হত্যা করা হল।

তৃতীয় ঘটনাঃ বাগদাদের তৃতীয় ঘটনা ঘটে ৩৯৮ হিজরীতে। শিয়া ও সুন্নীদের মধ্যে শরীয়তের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতভেদ হতে থাকে। শেষে শিয়ারা সুন্নীদেরকে আর সুন্নীরা শিয়াদেরকে কাফির বলে ফতোয়া জারি করতে লাগলো। অবশেষে শিয়া ও সুন্নীদের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে গেলো। ঐতিহাসিক যুহরী বলেন, এই সংঘর্ষে বিপুল সংখ্যক মুসলমান প্রাণ হারিয়েছিল।

চতুর্থ ঘটনাঃ বাগদাদের চতুর্থ ঘটনা ঘটে ৪৪৮ হিজরীতে। এই ঘটনার জন্য সুবিখ্যাত আলিম ইমাম কুশায়রীকে দায়ী করা চলে। তিনি একজন আশায়েরা মতবাদের লোক ছিলেন। ঐতিহাসিক ইবনু খাল্লিকান বলেছেন, ইমাম কুশায়রী বাগদাদে এসে আকিদা সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে হাম্বলী মাযহাবের লোকদের সাথে ঝগড়া-বিবাদ শুরু করে দিলেন। পরে এই ঝগড়া দাঙ্গায় রূপ নিলো। এই দাঙ্গায় কয়েক হাজার মুসলমান প্রাণ হারিয়েছিল।

পঞ্চম ঘটনাঃ বাগদাদের পঞ্চম ঘটনা ঘটে ৪৮৩ হিজরীতে। এ ঝগড়া বাধে শিয়া আর সুন্নী মুসলমানদের মধ্যে। শিয়ারা সুন্নীদেরকে আর সুন্নীরা শিয়াদেরকে কাফির, ফাসিক, মুনাফিক ও বিভ্রান্ত বলে গালিগালাজ করতে থাকে। এর ফলে উভয় পক্ষে তুমুল লড়াই বেধে যায়। হয় মরবো- না হয় মারবো, এই পণ করে দু’দলই সমর ক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঐতিহাসিক যুহরী বলেছেন, এই যুদ্ধে উভয় পক্ষে বহু সংখ্যক মুসলমান মারা পড়ে। শাসন কর্তৃপক্ষ বহু চেষ্টা করেও অবস্থা আয়ত্বে আনতে পারেননি।

ষষ্ঠ ঘটনাঃ বাগদাদের ষষ্ঠ ঘটনা ঘটে ৫৮২ হিজরীতে। মহররমের সময় তাজিয়া নিয়ে মাতম করতে করতে শিয়ারা জোরে জোরে হজরত আবু বকর, হজরত উমর ও হজরত উসমানের মত জবরদস্ত সাহাবায়ে কেরামকে গালাগালি দিতে থাকে। সুন্নী মুসলমানরা এই বেয়াদবি সহ্য করতে না পেরে শিয়াদের উপর আক্রমণ চালায়। ফলে শিয়া ও সুন্নীদের মধ্যে এক ভয়াবহ যুদ্ধ বেধে যায়। ঐতিহাসিক ইয়াফেযী বলেছেন, এই ভয়াবহ যুদ্ধে বিপুল সংখ্যক মুসলমানের প্রাণহানি ঘটে।

সপ্তম ঘটনাঃ বাগদাদের সপ্তম ঘটনা ঘটে ৫৮৭ হিজরীতে। আকিদা সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে দু’মাযহাবের মুসলমানদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হতে থাকে। পরে ইহা দাঙ্গায় রূপ নেয়। ঐতিহাসিক ইয়াফেযী বলেন, এ যুদ্ধে মুসলমানদের জান-মালের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল।

অষ্টম ঘটনাঃ বর্তমান উজবেকিস্তানের শাসক খাওয়ারেজম শাহ ছিলেন আলাভী সমর্থক। তিনি বাগদাদের খলীফার নামে খুৎবা দিতেন না। এমনকি বাগদাদ আক্রমণ করে খলীফাকে উৎখাত করার সংকল্প করে ছিলেন। ফলে খলীফা এক লোকের মাথা মুন্ডিয়ে তৎকালীন লিপি শিল্প অনুযায়ী তার মাথায় সুচ দিয়ে লিখলেন-“আপনি খাওয়ারেজম আক্রমণ করুন, আমাদের সমর্থন ও নেক দোয়া আপনার সাথে থাকবে”। তারপর লোকটিকে তাতারি সম্রাট চেঙ্গিস খানের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হল। চেঙ্গিস খান তার মাথা মুন্ডিয়ে বার্তাটি পাঠ করে মুসলিম বিশ্ব আক্রমণের সাহস অর্জন করল। কারণ সে বহু দিন ধরে মুসলিম বিশ্বে তার সাম্রাজ্য বিস্তার করতে লালায়িত ছিল। কিন্তু বাগদাদের খেলাফতকে যমদূতের মত ভয় করত। সে জানত কোন মুসলিম দেশে হাত দিলে খলীফা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে। আর তখন পৃথিবী থেকে চেঙ্গিস খান ও মঙ্গোলিয়ার অস্তিত্ব মুছে যাবে। কাজেই খলীফার বার্তা পেয়ে সে এটাকে সূর্য দেবতার আশির্বাদ হিসাবে গ্রহণ করল। পক্ষান্তরে খাওয়ারেজম শাহ্‌র হটকারিতা, নির্বুদ্ধিতা আর কাপুরুষতার কারণে যুদ্ধ বেধে গেল। মুসলিম বিশ্বের উপর নেমে এল রোজ কিয়ামতের বিভীষিকা। চেঙ্গিস খান মধ্য এশিয়াকে শ্বশানে পরিণত করল। তারা যুদ্ধের চিরাচরিত কোন নিয়ম মেনে চলত না। প্রত্যেক যুদ্ধ জয়ের পর তাতারিরা নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ সকল নাগরিকের মুন্ডু কেটে এনে মিনার নির্মাণ করত। সবচেয়ে বড় মিনারের জন্য চেঙ্গিস খান সবচেয়ে বড় পুরুস্কার বরাদ্দ দিত। গর্ভবতী নারীদের পেট ফেড়ে শিশু বের করে হত্যা করা হত। সাধারণ মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মারত। গোবির এ নর পিশাচের ধ্বংসলীলা এতটাই বীভৎস ছিল যে, ব্যাবিলন, নিনোয়া, পম্পিয়ায় প্রকৃতির ধ্বংসলীলাও এর সামনে ম্লান হয়ে যায়। মুসলিম বিশ্ব যখন হিংস্র হায়েনাদের শিকারে পরিণত হয়েছে- তখন বাগদাদের খলীফা মসনদে বসে গোঁফের নীচে মিটিমিটি হাসে এবং মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ্‌ পাঠ করে। তারপর মদ আর নর্তকির আসর গরম করে তুলে। আর উলামায়ে দ্বীন-যাদের উপর রাসূল (সাঃ) ইসলাম ও উম্মাহ রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে গেছেন তারা বাগদাদের মোড়ে মোড়ে বিতর্কানুষ্ঠান করত। শরয়ী মাসলা-মাসায়েল নিয়ে বিতর্কের ঝড় তুলত। পক্ষ-বিপক্ষ সৃষ্টি করে দাঙ্গা বাধিয়ে রাখত। এমনকি মহিলার দুধ বাজারে বিক্রি করা, স্ত্রীর দুধ খেয়ে ফেলা ইত্যাদি তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ের বিতর্ক সৃষ্টি করে দাঙ্গা, হাঙ্গামা, ফ্যাসাদ বাধিয়ে রাখত। কিন্তু চেঙ্গিস খান মুসলিম বিশ্বের উপর যে প্রলয় ঘটাচ্ছে সেদিকে তারা ফিরেও তাকাত না। তখন আলেমরা যদি খলীফাকে বাধ্য করত তাতারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করার জন্য তাহলে পৃথিবীর কোন সিংহের গুহা অথবা মুশিকের গর্ত গুটি কতেক নর পিশাচের গর্দান রক্ষা করতে পারত না। অথবা আলেমরা নিজেরাই জিহাদ ঘোষণা করলে, আর সম্মিলিত মুসলিম শক্তি মঙ্গোলিয়ার দিকে ধাওয়া করলে পৃথিবীতে তাতারী নামের কোন প্রাণীর অস্তিত্ব থাকত না। কিন্তু বাগদাদের আলেমরা কর্তব্য কাজ না করে নিজেদের মধ্যে ফিরকাবাজি ও দলাদলি সৃষ্টি করে জাতি ধ্বংসের ফাঁদ তৈরিতে মশগুল থাকল। (অসমাপ্ত)

বিষয়: রাজনীতি

১৪৭৬ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

372810
২২ জুন ২০১৬ সকাল ০৫:২৩
কুয়েত থেকে লিখেছেন : তখন আলেমরা যদি খলীফাকে বাধ্য করত তাতারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করার জন্য তাহলে পৃথিবীর কোন সিংহের গুহা অথবা মুশিকের গর্ত গুটি কতেক নর পিশাচের গর্দান রক্ষা করতে পারত না ভালো লাগলো অনেক অনেক ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File