চিঠি- ৭ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২৭ মে, ২০১৬, ১১:২৭:০০ সকাল

এবার তাদের বাড়িতে বেড়ানোর পালা। এখনো আমার শ্বশুর বাড়ি দেখা হয়নি। বিয়ের আগে খোঁজ-খবর নেইনি এই যুক্তিতে যে, আমার আগে এখানে সাতজন মানুষ বিয়ে করেছে, খোঁজ-খবর তো তারাই নিয়ে আমার কাজ এগিয়ে রেখেছে। এছাড়া শুনেছি দরিদ্র বিধায় দেখার আর কিছু ছিল না। তদুপরি আমার শর্তই ছিল প্রতিভাবান সুন্দরি স্ত্রী, শ্বশুর বাড়ি লক্ষ ছিল না।

যাবার দিন যহুরের পর থেকে সাজ গোজ শুরু করল। আসরের ওয়াক্ত হয়ে গেছে তবুও সাজ শেষ হয় না। তার বোন তাড়া দিচ্ছে তোদের তো পৌছতে রাত হয়ে যাবে। আসলে সে কোন সাজের কন্যা ছিল না। বিয়ের পূর্বাপর কখনোই তেমন সাজেনি। তখন তার উদ্দেশ্য ছিল তাদের বাড়ির মহিলাদেরকে দেখানো। যখন পৌঁছলাম তখন রাত আটটা। আমার শ্বাশুরি ঘরে নেই। তাকে ডাকাডাকি করে আনল। আমাদেরকে দেখে তিনি উচ্ছসিত আনন্দে শিশুর মত এমন সশব্দে হেসে উঠলেন যা আমি আর কোন দিন তার মুখে দেখিনি। বউয়ের অবস্থা হল, রাত হয়ে গেছে বিধায় তার সাঁজ গুজ কাউকে দেখাতে পারল না বলে বিরক্ত, কিন্তু আমি খুশি। কারণ সে আমার জন্য সাজে না।

ফকির বাড়ি। সম্ভবত এলাকায় খান্দানি বংশ হিসাবে পরিচিত। পুর্ব পশ্চিমে রাস্তা বয়ে গেছে, রাস্তার উত্তর পাশে দক্ষিন মুখি বিশাল লম্বা বাড়ি, তবে স্থান সংকুলানের অভাবে সম্ভবত কেউ কেউ রাস্তার দক্ষিন পাশে সরে গেছে। আমার শ্বশুরের উত্তর দক্ষিনে লম্বালম্বি একটা টিনের ঘর, দাড় পাকা ভিটে পাকা নয়। মাঝখানে বেড়া দিয়ে চার পাঁচটা রুম করা হয়েছে, সম্ভবত অনেকগুলি জামাই বিধায় এ ব্যবস্থা করা হয়েছে। একটা রান্না ঘর, একটা টিউবওয়েল, একটা টয়লেট ও এক দেড় একরের মত জমি- এই হল শ্বশুর বাড়ির ফিরিস্তি।

আমার স্বাশুরির বাবা নাকি জমিদার বা এ জাতীয় একটা কিছু ছিলেন। তারা তিন বোন, বড় বোনের স্বামী ও বড় ছেলে ডাক্তার, দুই মেয়ের জামাই সচিব। আমার শ্বাশুরিকে সম্ভবত স্কুল শিক্ষক খান্দানি বংশের ছেলে দেখে দরিদ্র পরিবারে বিয়ে দেয়া হয়েছিল। ছোট বোনের বিয়ে হয়েছে লন্ডন প্রবাসির কাছে, তারা সেখানেই থাকে।

বাড়িতে কেউ থাকে না, বড় ছেলে ঢাকায় ছোট খাট ব্যবসা করে, কনিস্টটা লেখা পড়া করে। আমার শ্বাশুরি ঘর তালা মেরে মেয়েদের ও আত্নীয় স্বজনের বাসায় বাসায় সময় কাটান। তাকে তার দুই বোন বিশেষত লন্ডনি বোন সাহায্য সহযোগিতা করে। আমার শ্বাশুরি একদম সহজ সরল সাদা মনের মানুষ। কিন্তু তার মেয়ে গুলি চূড়ান্ত পর্যায়ের দাম্ভিক, অহংকারী ও মুখরা। এ স্বভাব তারা পিতা মাতা থেকে পায়নি, কারণ আমার শ্বশুরও ছিলেন সাদা মনের, ভাল মানুষ। এসবের শিক্ষক ছিল তাদের বড় বোন ওরফে বড়াপা। দরিদ্র পরিবারের মেয়ে হয়েও এ অহংকারের সম্ভবত চারটি কারণ ছিল। ১। তারা খান্দানি বংশ তথা ফকির বংশের মেয়ে। অনেকেই বলে ফকির বংশের মেয়েরা নাকি দাম্ভিক স্বৈরাচারি হয়, ২। তাদের আত্নীয়-স্বজন বিশেষত খালারা বড়লোক, ৩। তারা ছিল জামালপুর তাবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা-নেতৃ। এজন্য তাবলীগী ছেলেদের বাজারে তাদের মেয়েদের উচ্চ মুল্য ছিল, ৪। তাদের প্রায় সব গুলি জামাই মধ্যম মানের শিক্ষিত ও চাকুরে। বড়াপা তার বোনদের অহংকার শিক্ষা দিত এভাবে- এই শুন, আমরা অহংকার করব নাতো কে করবে, আমাদের একটা জামাইও গরুচোর না, সবগুলি শিক্ষিত চাকরিজীবী। তবে সকল বোনের দাম্ভিকতা, স্বৈরাচারিতা ও মুখরাপনার সন্নিবেশ ঘটেছিল সর্ব কনিস্ট আমার স্ত্রীর মধ্যে। পৃথিবীর কারো প্রতি তার শ্রদ্ধা বোধ ছিল না। সে নিজেকে সকলের উর্ধ্বে মনে করত। এমনকি স্বামী, শ্বশুর-শ্বাশুরির চেয়েও নিজেকে বড় মনে করত। এ জন্যই এ মেয়েটির মধ্যে স্বামী সংসার করার মত কোন যোগ্যতা ছিল না।

পরদিন ফযরের পর সে বাইরে বেরুবে, আমাকে তাড়া দিচ্ছে। কিন্তু আমার কিছু বদ অভ্যাসের মধ্যে একটি হচ্ছে, ফযরের পর হাটাহাটি না করে ঘুমানো। সে আমাকে বিছানা থেকে টেনে তুলে নিয়ে বের হতে চাইছে। কিন্তু আমি উঠি না। সে বলল, উঠেন আব্বার কবর যিয়ারত করতে হবে। অমনি তাড়াতাড়ি উঠলাম। বাড়ির পশ্চিম প্রান্তে একটা পতিত ভিটায় কবর। বাঁশঝাড় বাড়তে বাড়তে কবরের উপর এসে পরেছে, কেউ দেখবাল করে না, অসংরক্ষিত অবস্থায় পরে আছে। দ্বিতীয় বাপের জন্য দোয়া করলাম, প্রত্যেক বিবাহিত নর-নারীর দুটি করে মা-বাপ থাকে। যিয়ারতের পর সে আমাকে বাড়িতে আসতে দেয় না, টেনে নিয়ে চলল পশ্চিম দিকে। বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে পশ্চিম দিকে প্রায় এক কিলোমিটার হেটে গেলাম। আমি ফিরে আসতে চাই সে দেয় না। সেখানে একটি প্রাইমারি স্কুলের কাছাকাছি গিয়ে সে থামল সম্ভবত এ পর্যন্তই তার চেনা। সামনেই কৃষ্ণচুরা ফুটে আছে। একটি ছেলেকে বলে ফুলের একটি ডাল ভাঙ্গিয়ে এনে তা নিয়ে বাড়ির দিকে ফেরা শুরু করল। বাড়ির কাছাকাছি এসে দেখি সে আমার হাত ধরে হাটার চেষ্টা করছে। তার মতলবটা বুঝলাম এবং মনে মনে হাসলাম। আসলে যে মেয়ে ঘর থেকে বারান্দায় পর্যন্ত বেরোয় না সে কিনা ঘুরতে যাবে, আবার যে জীবনে ফুল ছোয়েও দেখেনি সে ফুলের ডাল ভেঙ্গে আনে। এসবের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদের বিশাল বড় বাড়ির লোকদেরকে জানান দেয়া যে, সে এখন আর মূল্যহীন কোন বালিকা নয়, তার বিয়ে হয়ে গেছে, স্বামী নামের নারী জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার সে পেয়ে গেছে। এই যে, যে লোকটির হাত ধরে সে হাটছে এটিই তার সাধনার ধন, গলার মালা, তার স্বামী। আর ফুল নিয়ে এসে তার জীবনে বসন্তের জানান দিচ্ছে। এবার ঘরে এসে ব্রিপকেস খুলে কয়েকটা শাড়ি রৌদ্রে দিল। সেগুলি রোদে দেয়ার কোন প্রয়োজন ছিল না। উদ্দেশ্য হল আমাকে নিয়ে বাইরে ঘুরে পুরুষদের জানিয়েছে তার বিয়ে হয়ে গেছে। এখন মহিলাদের জানানো যে, এ বাড়ির ছোট মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে।

শ্বশুর বাড়ি আগমনের রিহার্সেল হিসাবে এডি আমাকে বলে দিয়েছিল, বাইরে যাওয়া, অন্যের ঘরে যাওয়া অন্যদের সাথে মিশা তারা পসন্দ করে না, সাবধান থেকো। সম্ভবত এ কারনেই সে আমাকে বাইরে বেরোতে দিত না। আটার মত লেগে থাকত। গোসলের সময় টিয়বওয়েল চেপে বাথরুমে বালতি ভরে পানি দিয়ে রাখত, গোসল শেষে নিজে লুঙ্গি ধুয়ে আনত। টয়লেটে গেলে বদনা ভরে আগেই পানি দিয়ে আসত।

বাঘা সম্ভবত তাদের গোষ্ঠীর একটু নেতা গোচের মানুষ। সম্পর্কে দাদা। সে ছিল চির কুমার। গোষ্ঠীর এক মেয়ের সাথে প্রেম ছিল কিন্তু বিয়ে দেয়নি। ফলে বাঘা থাকল চির কুমার আর ঐ ফুফু শ্বাশুরিটা পাগলা হয়ে গেল। একদিন দুইজন বসে আছি, সে দরজায় এসে এক বিকট ধ্মক দিয়ে আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে কটমট করতে লাগল। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। মনে হচ্ছিল তার ভাতিজীকে নিয়ে ফষ্টি-নষ্টি করার জন্য সত্যি সত্যি আমাকে মারবে। সে উঠে- ফুফু যাওগা যাওগা, ঐ যে তোমারে ডাকতাছে- বলে কয়ে বিদায় করল। সে বিশাল বাড়িশুদ্ধু দৌড়াদৌড়ি করত, হাততালি দিত আর গান গাইত- প্যারাতন দুলে, প্যারাতন দুলে--- । এ বংশের অনেকেই কেন জানি পাগল হয়ে যায়। বাঘা সম্ভবত আমার শ্বাশুরির সংসার কিছুটা দেখা শুনা করত। নতুন জামাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ের জন্য তিনি বাঘাকে দাওয়াত করলেন। এক সাথে বসে খাওয়া দাওয়া ও আলাপ হল, বেশ একজন ভাল লোক। শ্বশুর বাড়িতে জীবনের প্রথম কয়েকটা দিন ভালই কাটল। সে থাকল আমি চলে আসলাম।

আবার সপ্তাহ শেষে তর সইছিল না। বৃহস্পতিবারে একটা কাপড় কিনে নিয়ে দুপুরেই গিয়ে হাজির হলাম। তার এক ভাবী যিনি ঢাকায় গার্মেন্টেসের মালিক সে গিয়ে বলল, তোর জামাই এসেছে। সে এসে দরজা খুলে আমাকে দেখেই আনন্দে আত্মহারা। ভাবী বলল, তোর জামাই এসেছে আমি ভাবলাম আমার জামাই এখনি আসবে, আমার জামাই এত ভাল হয়ে গেছে, আমার জামাইয়ের তো রাত ছাড়া সময় হয় না............। এভাবে সে বারবার উচ্চস্বরে আমার জামাই আমার জামাই করছিল যে, আমি লজ্বা পেয়ে গেলাম। তাকিয়ে দেখি বিয়ের পানির প্রভাব দেখা যাচ্ছে, শরীরটা অনেক সতেজ ও হৃষ্টপুষ্ট দেখা যাচ্ছে, মুখটা আনন্দে ঝলমল করছে। মন চাইল গভিরভাবে একটু আলিঙ্গন করি, সেও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আমার লজ্বা, দ্বিধা সংকোচ অন্তরায় হল, তার দিকে না গিয়ে সোজা খাটে গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ পর সে কয়েকটা পিঠা নিয়ে এল। আমি বললাম এখন না, পরে খাব। একে তো পিঠার প্রতি আমার জীবনেও তেমন আকর্শন ছিল না, আবার স্বভাবগত নিয়ম ছিল কেউ কিছু দিলে আমি উপস্থিত খাই না, পরে খাই। একটু পরে বললাম আন পিঠা। তখন সে আমাকে বাঁশ দিল, আইখ্যা ওয়ালা বাঁশ। অপরাধ, যখন সেধেছে তখন খাইনি, এখন চাই কেন, আসলে সে খেয়ে ফেলেছে। আমি শুধু হাসলাম।

সন্ধ্যার পর পিঠা বানাবে, আমাকে রান্না ঘরে নিয়ে যেতে এসেছে, আমি কাছে না থাকলে তার ভাল লাগে না। গিয়ে একটা পিড়িতে বসলাম। এর মধ্যে তার ছোট ভাইটা এসে জুটেছে। সে এসেই হারুন কিসিঞ্জার ও হানিফ সংকেতের কৌতুক বলা শুরু করল। শুরু হল হাসি। কেন জানি না, সেদিন অসম্ভব হাসি পেয়েছিল, কোন ভাবেই চাপিয়ে রাখতে পারছিলাম না, যা আমার কখনো হয়নি। তিন জনেরই সমান অবস্থা, হাসিতে যেন পেট ফেটে যাচ্ছে। হাসাহাসি শুনে চাচি শ্বাশুরি দেখতে এলেন, তাকে দেখে মাথা নিচু করে এই যে হাসি থামানোর চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না। সে নিজে মুখে কাপড় গুজে হাসছে আবার আমাকে বলছে এত হাসছেন কেন। এ অবস্থা দেখে চাচি নিজেও একটু হেসে বললেন, হাস হাস এটা তো তোমাদের হাসির সময়। পরে আর সময় পাবে না। আসলে হাসি হল একটা ছোঁয়াচে রোগ। দূরে কয়েকজন লোক হাসছে, দেখবেন, কারণ না জেনেই আপনিও হাসি শুরু করে দিয়েছেন। চাচীর মত বুড়ি মানুষও হাসতে হাসতে চলে গেল।

আমার সমসাময়িক কালে তাদের পাশের ঘরের এক চাচাত বোনের বিয়ে হয়েছিল, জামাই স্কুল শিক্ষক নাম আলাল। আমার স্ত্রীর প্রতিযোগিতার মানসিকতা এতই প্রবল ছিল যে, সে ঐ লোকটাকে হেয় জ্ঞান করত। কারণ সে শিক্ষা দীক্ষা ও অন্যান্য দিক থেকে আমার চেয়ে কম ছিল। এমনকি তার নামটাকেও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করত। কারণ আলাল নামটা নাকি পুরাতন সেকেলে, আর আমার নামটা আধুনিক শ্রুতিমধুর। বুঝা গেল, তার বোনটার সাথেও তার আড়ি, মেয়েলী একটা রোগের কথা বলল, আর সমালোচনা করল। চাচা শ্বশুর দাওয়াত দিলেন, তার জামাইয়ের সাথে ডাল ভাত খেতে। আলাল আর আমি এক সাথে বসে খেলাম, আলাপ করলাম, খুব ভাল একজন সরল প্রান মানুষ। খাওয়া দাওয়ার পর এসে তাকে ঘরময় খুজি কিন্তু সে লাপাত্তা। একি কাণ্ড, জলজ্যান্ত বউটা রেখে গেলাম আর এখন নাই, কেউ আবার নিয়া গেল নাতো।

বৃষ্টি পরছে, কিছুক্ষণ পর দেখি বৃষ্টির মধ্যেই দৌড়ে আসছে। ঘরে ঢুকতেই- ওয়াও কী মজা বলে জড়িয়ে ধরলাম, আহ কত মধুর, একেবারে ঠিক সেই বিয়ের রাত্রের নববধূ। স্বর্নালঙ্কার পরেছে, বিয়ের শাড়ি পরেছে, আলকাতরা মানে লালস্টিক মেরেছে, আরো ঐ যে কি জানি বলে মেকাপ না চেকাপ-সব মেরেছে। অপরূপ লাগছে, পাগলামি করতে মন চাইছে। সে কখনো আমার জন্য এভাবে সাজে না, আজ অন্যদের দেখানোর জন্য সেজেছে। আমার বাহু বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আনন্দ উচ্ছ্বাসে তার চেহারা চকচক করছে, মনটা ভরে উঠল।

সে মনমাতানো হাসি দিয়ে বলল, আমি মনে করেছি আপনি ওখানেই, এজন্য আমার আসতে দেরি হল, যখন শুনলাম আপনি এসে গেছেন অমনি দৌড় মারলাম।

বললাম, তোমারও যে দাওয়াত এটা তো আমি জানতাম না।

সে বলল, আপনের দাওয়াত বাইরে আমার দাওয়াত ভিতরে। এখন ছাড়ুন, এগুলি খুলি।

আমি বললাম, হা হা হা, ছাড়ার জন্য ধরেছি নাকি, আমি বললেও কোন দিন সাঁজ না, আজ কায়দামত পেয়েছি সারা দিন কোলে নিয়ে বসে থাকব।

সে বলল, এত শখ লাগব না, এগুলি এখনো পরে বসে থাকব নাকি। তারপর জোরজার করে গিয়ে খুলেই ফেলল। মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে চোরের মত আমার আড়ালে সেজে গুজে গিয়েছে ঐ নব বিবাহিত মেয়েটা ও অন্যান্য মহিলাদেরকে তার শাড়ি অলঙ্কার দেখানোর জন্য, আর এসেই খুলে ফেলল। আমার মনের দিকে তাকাল না, আমার জন্য কোন দিন সাজেও না।

শনিবার সকালে জামালপুর আসার সময় জুতা পায়ে দিতে গিয়ে দেখি জুতার উপর ধুলির আস্তর পরে আছে। তাকে একটা ন্যাকড়া আনতে বললাম। আমি খাটের পাশে বসা। ন্যাকড়া নিয়ে এলে হাত বাড়ালাম, কিন্তু দিল না, নিজেই পায়ের কাছে বসে পড়ল। পা সরিয়ে নিলাম, সে টেনে নিয়ে জোর করে ধরে জুতা মুছা শুরু করল। বললাম আরে আমার কাছে দেও, কিন্তু দিল না। সংকোচগ্রস্থ হয়ে বসে থাকলাম, কারণ স্ত্রীকে দিয়ে জুতা মোছানো বা এ জাতীয় নিচু কাজ করানো আমার কাছে হীনতা মনে হয়। আমি বসে আছি সে আমার পায়ে পরা জুতা মোচ্ছে, ইতস্তত করছি কেউ দেখে ফেলে কিনা। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত পোহায়। হঠাৎ কোন দরকারে শ্বাশুরি এসে উপস্থিত, লজ্জ্বায় লাল হয়ে গেলাম, পা টেনে আনতে চাইলাম দিল না, এক হাতে চেপে ধরে আরেক হাতে মোছতেছে। শ্বাশুরি প্রয়োজনীয় কথা বলে চলে গেলেন। তার ভাব দেখে মনে হল তিনি বরং খুশিই হয়েছেন, স্ত্রী স্বামির জুতা মোছে দিবে এটাই তো নিয়ম। তাকে বললাম, তুমি তো আমাকে অপমান করলা, সে শুধু হাসল। চলে এলাম।

বৃহস্পতিবারে আরেকটা কাপড় কিনে নিয়ে গিয়ে হাজির হলাম। কারণ লম্বা মানুষ, কাপড় পরলে ভাল মানায়, থ্রী পিস পরলে ঘাড়চিলা বকের মত লাগে। সে কাপড় নিয়ে ওকে দেখায়, তাকে দেখায়, পাশের ঘরের তার সমবয়সী একটা চাচাত ভাগ্নিকে দেখিয়ে বলে, দেখ দেখ, কেমন পাগল, যতবার আসে একটা করে কাপড় নিয়ে আসে। তাকে বলে কয়ে কাপড় পরাই। শ্বাশুরি অনেক সময় রান্না ঘরে বা বাইরে থাকে। সে ঘরময় ঘোরাফিরা করে, আমিও সাথে সাথে হাটি, ভাল লাগে। আর শুয়ে বসে থাকলে সেও এসে আটার মত লেগে থাকে।

আমি গিয়ে থাকতাম সর্ব দক্ষিনের রুমটিতে, এখানে বাতাস পাওয়া যেত, তাদের বাড়িতে কারেন্ট ছিল না। পরদিন দুপুর বেলা আমি সেই রুমটিতে শুয়ে আছি, সে হাতের একটা আঙ্গুল ধরে উহু হু, উহু হু- করতে করতে আমার কাছে আসছে। আমি উঠে বসে জিজ্ঞেস করলাম- কী হইছে ? সে বলল, আমারে সাপে কামড়েছে। লাফ দিয়ে গিয়ে আঙ্গুল ধরে মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলাম- বলছ কী ? সে আমার বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে দুষ্টের মত হেসে বলল, বল্লা কামড় দিয়েছে। উহঃ বাচাইলা, বুকে হাত দিয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে- যাও চাচীর ঘর থেকে একটু চুন নিয়ে আস। মেয়েরা এ অভিনয়টা করে যখন তারা স্বামির আদর সোহাগ পেতে চায়। তবে আমার আবার কি হল? যে বউকে পসন্দ হয়নি, তাকে ভালবাসার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম। কিন্তু এ অবস্থায় তো বুঝা যাচ্ছিল তার আগে আমিই মরে যেতাম। বুঝলাম, এতদিনে স্ত্রীর প্রতি মনের মধ্যে কুচ কুচ হুতা রাহা হ্যায়। নিজের হাতে আঙ্গুলে চুন লাগিয়ে দিয়ে বললাম, বল্লার বাসাটা কোথায় ? দেখাল, পাশের রুমের দরজার ঠিক মাঝামাঝি মানে কাঁধ বরাবর, কেউ দরজা দিয়ে ঢুকলে কামড়াবে বা হাত দিলে গিয়ে পরবে বাসার উপর। বললাম, পাঠকাঠি দিয়ে আগুন নিয়ে আস। সে বলল, আগুন দিয়ে পুড়ানো তো নিষেধ। বললাম, নিয়ে আসই না, তারপর দেখ। আগুনটা বাসার নিচে ধরে কাঠি দিয়ে নাড়া দিলাম, বল্লা গুলি বের হল আর পাখা পুড়ে মাটিতে পরে কিলবিল করতে থাকল। - এবার বুঝলে তো, এখন এগুলি পায়ে পিষে পিষে মার।

বড়াপার বাসায় একবার এমন অভিনয় করেছিল। বড়াপা কোথাও বেড়াতে যাবে, তার বাসায় থাকার কথা বলল। আমি বউকে বললাম নিজের বাসা খালি রেখে কেমনে থাকবে। এটুকু শুনে ঐ মহিলা এমন সব কথা বলল যে, আমি শুনে অবাক হয়ে গেলাম। জানতাম, এই মহিলা অন্তহীন স্বেচ্ছাচারী আর ভয়ঙ্কর স্বৈরাচারী। ছোট বেলা নাকি এই মহিলা জেদ ধরেছিল, শাড়ি না কিনে দিলে চাচাত বোনের বিয়েতে যাবে না, তারপর যায়ইনি। সেই থেকে নাকি আমার শ্বশুর তাকে ভয় পেত। আর এখন স্বামী সহ সবাই ভয় পায়। অগত্যা বললাম চল থাকি গিয়ে। রাত দশটার দিকে সে রান্না ঘরে রুটি বানাতে গেছে, হঠাৎ- ওরে বাপরে বলে দৌড়ে আসছে। আমি লাফ দিয়ে নামতেই এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। - কী হইছে, কী হইছে ? সে জড়িয়ে থেকেই কিছু না বলে হাসে। বেরিয়ে দেখি একটা কুকুর দাঁড়িয়ে আছে। বুঝলাম, দুষ্টুমি, আদরের জন্য। হাঁ, আমার কাছেও কমতি ছিল না, আদরের চূড়ান্তটাই দিয়েছিলাম।

এরই মধ্যে রমযান এসে গেল, আগে থেকেই চিল্লা ও সাল লাগানোর জন্য হাতুরি পিটিয়ে আসছে। এখন রমযানে লম্বা বন্ধ পাওয়া গেছে, চিল্লায় যাওয়ার জন্য বাঁশ দেয়া শুরু করল। আমি চিল্লায় যাব সে তাদের বাড়িতে থাকবে।

বিষয়: সাহিত্য

৩২৩৬ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

370283
২৮ মে ২০১৬ সকাল ১১:১৮
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : সুন্দর বর্ণনা ভঙ্গি, খুবই উপভোগ করলাম। ধন্যবাদ।
370293
২৮ মে ২০১৬ দুপুর ০১:২১
মাহবুবা সুলতানা লায়লা লিখেছেন : আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু! বউয়ের বদনামে তো ইতিহাস লিখে ফেললেন.......।
370655
০১ জুন ২০১৬ সন্ধ্যা ০৬:১১
গাজী সালাউদ্দিন লিখেছেন : মন্তব্যটি পোস্ট রিলেটেড নয়।
রমজান নিয়ে ব্লগীয় আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। অংশ নিতে পারেন আপনিও। বিস্তারিত জানতে-
Click this link

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File