চিঠি- ৬ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২৫ মে, ২০১৬, ১০:৫৩:২০ সকাল
কয়েক দিন পর আমি বাড়িতে গেলাম। বোর ধান কাটা চলছে। ধান গোলায় তোলা, বিক্রি করা, জমি কিনা হয়েছে তার মূল্য পরিশোধ করা ইত্যাদি ঝামেলায় আমার আসতে দেরি হচ্ছিল। আর তখনো মোবাইলের ব্যাপক প্রচলন হয়নি। পাঁচ ছয় দিনের মাথায় তার তৃতীয় বোন বজলুর স্ত্রী এসে তার সামনে বড় আপাকে বলল এত দূরে বিয়ে দিলে, এত দিন হয়ে গেল জামাইটা আসছে না, আর যদি না আসে তখন কী হবে? শুরু থেকেই এদের মুর্খতার পরিচয় পাচ্ছিলাম। এ মহিলাটা একটিবার ভাবল না তারই আদরের ছোট বোন এমন কথা শুনার পর মনে কতটা কষ্ট পেতে পারে, আড়ালে বললে কোন সমস্যা ছিল না। এই যে তার মনে এক ভয় ঢুকল, এ ভয় শেষ পর্যন্ত তাকে তাড়া করে ফিরছিল। আর শেষ পর্যন্ত বনের বাঘে নয় এই মনের বাঘই তাকে খেল।
এর পিছনেও অবশ্য একটা কারণ ছিল। তাকে পসন্দ হয়নি এমন কথা আমি কোন দিন তাকে বলিনি। কিন্তু আমার কোন আচরণ বা ইঙ্গিতে সে হয়ত ধরে নিয়েছিল তাকে আমার পসন্দ হয়নি। আসলে সে ছিল মোটামুটি সুন্দরী এবং লম্বায় আমার প্রায় সমান সমান। সমস্যা ছিল নাক বুচা ও অতিরিক্ত স্বাস্থ্যহীনতা। আর এ মেয়ের আত্মশ্লাঘা ও বদমেজাজ ছিল এত উচ্চাঙ্গের যে অন্যের জন্য যা সাধারণ কথা তার জন্য ছিল সহ্যাতিত। যেমন আমি হয়ত বলেছি নাকটা আরেকটু উচু হলে খুব সুন্দর লাগত বা গায়ে হাত দিলে শুধু হাড্ডি লাগে বেশি বশি খেয়ে মোটা হও। এটুকুতেই সে ধরে নিত আমি তাকে পসন্দ করি না। আর তখন সে আমার কাছ থেকে উঠে পাশের রুমে চলে যেত। আমি পড়ে জানতে পেরেছিলাম সেখানে গিয়ে সে কাঁদত। আগে জানতে পারলে আমি অবশ্যই সতর্ক হয়ে থাকতাম। এভাবেই তার মনে ভয়ের জন্ম নিল। সে মনে করত আমি তাকে ফেলে চলে যাব। আরো সন্দেহ করত যে, বাড়িতে আমার আরেকটা বউ আছে। এ মেয়েটা ছিল এমনই মুর্খ যে, বিয়ের সময়, অনুষ্ঠানের সময় বিশিষ্ট ব্যাক্তিরা উপস্থিত ছিল, আমাদের বাড়ি থেকে মানুষ এসেছিল, তাদের এখান থেকেও গেছে আমাদের বাড়িতে- এসব কিছু ডিঙ্গিয়ে, সবাইকে অবিশ্বাস করে সে ভাবত বাড়িতে আমার আরেক বউ আছে। এ ছাড়াও প্রথম রাতে তার সাথে আমার এমন বোকামি কাণ্ড হয়েছিল যে, সে কিছুটা বুদ্ধি ধারন করলেও বুঝতে পারত যে, লোকটার নারী দেহ সম্পর্কে কোন ধারনাই নাই।
তখনো আম পাকেনি সবে আটি হয়েছে। কিছু কাচা আম আর পুকুরের কিছু মাছ নিয়ে প্রায় দশদিন পর বাসায় পৌঁছলাম। আমার আহট পেয়ে সে ঝড়ের বেগে দরজা খুলে বাইরে এল কিন্তু কোন কথা না বলে অভিমান করে বাইরের রুমে গিয়ে বসে থাকল। আমি পিছু পিছু গেলাম। সে যুগপৎ কৃতজ্ঞতা ও অভিমানের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। গত কয়েক দিন ভয় ও উৎকণ্ঠায় থাকার পর প্রথম সাক্ষাতে তার দৃষ্টি আমার কাছে একটু আদর একটু সোহাগ কামনা করছিল কিন্তু আমি ছিলাম অসম্ভব নারীভিতু, তখনো আমার নতুনত্ব কাটেনি, শুধু ভ্যাবলার মত দাঁড়িয়ে থাকলাম। কথা বলতে বলতে ধীরে ধীরে কাছে ঘেঁষা ছাড়া আমি কোনদিনই সরাসরি জড়িয়ে ধরতে পারিনি।
তাকে আত্মীকরণের প্রয়াস ঠিকমতই চলতে লাগল, সারারাত জড়িয়ে ধরে কখনো গান শুনাই, কখনো স্মৃতি রোমান্থন করি, কখনো পান্ডিত্য ঝাড়ি। সেও আমার আড়ালে আবডালে কান্নার ধারাটা বজায় রাখল। তবে এখন নতুন নতুন জিনিস সংযোগ হতে লাগল। সে আমাকে চিমটাত, কথায় কথায় চিমটাত আর কাতুকুতু দিত। মাশাল্লাহ, কাতুকুতুতে আমি ছিলাম চ্যাম্পিয়ান, একেবারে দম আটকে যেত। একদিন কিঞ্চিৎ ত্বক ধরে দুই আঙ্গুলে এমন চিপি মারল যে আমার মুতে দেয়ার উপক্রম হল। সাথে সাথে এক থাপ্পর মারলাম। চামড়াটা পনের দিন পর্যন্ত ফুলে ছিল। এরপর থেকে আর চিমটি দেয়নি। আসলে আমার বউ নতুন অবস্থায় মারত হাতে পড়ে মারত মুখে।
আরেক বিষয় হল ঝগড়া। একটু একটু নতুনত্ব কাটছিল আর তার ঝাঁঝ প্রকাশ পাচ্ছিল। আমার অতিসাধারণ কোন কথা নিয়ে সে ঘন্টার পর ঘন্টা ঝগড়া করত। এ নতুন অবস্থায় ও তার বদমেজাজ আর মুখরাপনা দেখে আমি হতবাক হয়ে যেতাম।
এরা ছিল জামালপুর তাবলীগের কেন্দ্রীয় চরিত্র। শিঘ্রই বুঝতে পারলাম কক্ষচ্যুত হয়ে আমি ভিন গ্রহে ছিটকে পরেছি- যেখানে নারী কেন্দ্রিক পরিবার ব্যাবস্থা। পৃথিবীর সাধারণ পরিবার ব্যাবস্থা হচ্ছে স্বামী কেন্দ্রিক স্ত্রী সংসার আবর্তিত হয়। কিন্তু এখানে স্ত্রী কেন্দ্রিক স্বামী ও সংসার আবর্তিত হয়। এদের ছেলে মেয়েদের মুখে সব সময় শুনতাম নানা নানু খালা খালু, কিন্তু দাদা দাদি কাকা কাকি বা ফুফা ফুফু কোন দিন শুনিনি। আবার সাধারণ বাঙালি সমাজের নিয়ম হল, নতুন বউয়ের দোষ গুন খুটে খুটে বের করা হয় এবং অন্যের সাথে তুলনা করা হয়। কিন্তু এখানে দেখলাম স্বামীদের দোষ গুন খুটে খুটে বের করে অন্যদের সাথে তুলনা করা হয়। তবে স্ত্রীদের দোষ গুনের হিসেব করার শক্তি ও সামর্থ কারো নাই। কারণ এ পরিবারের মেয়েরা দুনিয়ার কিছু বুঝুক আর না বুঝুক কিন্তু ভয়ঙ্কর স্বামী শিকারি। বিয়ের পর এরা স্বামীকে কব্জা করে স্বামির পরিবার থেকে বিচ্চিন্ন করে নেয়।
প্রথম থেকেই লক্ষ করলাম আমার স্ত্রীর মত একটা মুর্খ অশিক্ষিত বোকা মেয়ে আমার চেয়ে নিজেকে বড় মনে করছে, আমাকে পদানত করার চেষ্টা করছে। আমি কিছু বললেই তর্ক করত, দোষটা ধরিয়ে দিলে প্রথম প্রথম যদিও বলত আমি কি সব বুঝি আমাকে বুঝিয়ে দিবেন। কিন্তু পরে কোন দিন নিজের ভুল বা দোষ শিকার করত না, ঝগড়া করত। আমাকে সে নিক্তি তুলা দিয়ে মেপে মেপে তার সাতটা দুলা ভাইয়ের সাথে তুলনা করত, কে কত ভাল, স্ত্রী ও শ্বশুর পরিবারের প্রতি কতটা অনুগত, এসব চ্যালেঞ্জ আমার সামনে তুলে ধরত। মানুষ হিসাবে ভাল হওয়ার, অন্যের কাছে ভাল ও প্রশংসিত থাকার প্রবণতা সবার মধ্যেই থাকে, আমার মধ্যেও ছিল। সঙ্গত কারনেই স্ত্রী ও শ্বশুর পরিবারের প্রতি আনুগত্যের ক্ষেত্রে তার সাত দুলা ভাইয়ের সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে হল। এভাবেই ক্রমে ক্রমে দাসত্ব নিগড়ে আবদ্ধ হতে থাকলাম, কিন্তু আমার স্ত্রী কখনও নিজের দোষ ত্রুটির দিকে ফিরেও তাকাত না। এটাই তাদের পরিবারের নিয়ম। আবার ধিরে ধিরে বুঝতে লাগলাম, তাদের ধর্মটা কৃত্তিম, মনগড়া, বানানো একটা বিকৃত ইসলাম।
বিষয়: সাহিত্য
১২৬৮ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন