চিঠি-৫ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২২ মে, ২০১৬, ০৯:১৬:৪৭ সকাল
অসুস্থাবস্থায় মাঝে মধ্যে যেতাম। নববধুর সাথে দু চারটা আলাপ করে এসে পরতাম। সাত দিন পর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। যার জন্য প্রত্যেক যুবক যুবতী আজন্ম নিজেদের তৈরি করে, যার জন্য বিপরীত লিঙ্গের সৃষ্টি, যার জন্য স্বামী স্ত্রী পড়ন্ত যৌবনে প্রৌঢ়ত্বে বার্ধক্যে একে অন্যের সাথে প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে পারে, যার জন্য এ পৃথিবী এ মহাবিশ্বের এত আয়োজন, যার জন্য এ সৃষ্টি ধারা এবং এর নেজাম অক্ষুন্ন আছে এবং থাকবে। আর এরই মধ্যে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণ নিহিত।
স্ত্রীর গায়ে প্রথম যখন হাত দিলাম, সে কেঁদে ফেলল, তারপর বলল, আমার যা কিছু সব আপনাকে দিলাম। মেয়েটি এমন কেন বলল, বিয়ের ইসলামী সংজ্ঞাই হচ্ছে- স্বামী মহরের বিনিময়ে স্ত্রীর গুপ্তাঙ্গের মালিক হয়ে যায়। নতুনত্বের জড়তা থাকলেও প্রত্যেক নব বধু তার সম্পদ স্বামীকে দেয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে। গায়ে হাত দিলে অন্তত কেঁদে ফেলে না, তার সম্পদ স্বামীকে নতুন করে দানের প্রস্তাব দেয় না। তাহলে এ মেয়েটি কেন এমন বলল। সে কি তার সম্পদ অন্য কারো জন্য সংরক্ষন করে ছিল। টাইটানিকের বৃদ্ধা নায়িকার উক্তি- প্রত্যেক নারীর হৃদয়তল এ আটলান্টিকের অতলান্তের ন্যায় অজানা, রহস্যাবৃত অন্ধকারাচ্ছন্ন। আমার স্ত্রীর হৃদয়ও আমার আন-ডিসকভার। কাজেই এর উত্তর আমার জানা নেই অথবা জানা আছে। আমি যা জানি আমার স্ত্রীর দেহ-মন পবিত্র। দেহের পবিত্রতা তো প্রশ্নাতীত। মনের দিক থেকেও পবিত্র। কারণ প্রচলিত অর্থে যাকে প্রেম বলে- চিঠি চালাচালি করা, কথাবার্তা বলা তা সে কোন দিনই করেনি। তবে তার কোন আত্নীয়ের সাথে তার বিয়ের আলাপ হয়ে ছিল, সেই ছেলেটির জন্য সে আমার ঘরে আমার সামনে বসে বসে কাঁদত। হয়ত এটা ছিল তার মনের টান, এটুকু আমি কোনদিন দোষনীয়ও মনে করিনি আর ধর্তব্যের আওতায়ও আনিনি।
অথবা উত্তর এটাও হতে পারে যে, মেয়েটি ছিল অসম্ভব বোকা, ভয়ঙ্কর বদমেজাজি ও জেদি। এর দৈহিক চেতনা ছিল না বললেই চলে। ফলে সে সম্ভবত বিয়ে বা পুরুষ সান্নিধ্য কামনা করত না। তাই বিষয়টা এমন যে, যার বিয়ে তার খবর নাই পাড়া পরশির ঘুম নাই। আমি যখন তাকে দেখতে আসি তখন নাকি সে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিল। ঘুম থেকে তুলে আনার কারণে তার ঝাঁঝটুকু দেখিয়েছিল। বিয়ের পনের দিন পর শুভ সাক্ষাত হল। সে আমাকে আপনি ডাকত, যেহেতু তাকে আমার পছন্দ ছিল না, কাজেই আপনি ডাকল না তুমি ডাকল নাকি তুই ডাকল তাতে আমার কোন ভ্রুক্ষেপ ছিল না।
পরদিন দুপুরে এসে দেখি আমার বধুরত্ন যুগান্তর পত্রিকা হাতে নিয়ে বসে আছে। সে আমাকে দেখে রাগে চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা পুরুষরা এত খারাপ কেন? আমি বললাম, কেন, কি হয়েছে? সে পত্রিকাটা এগিয়ে দিয়ে বলল, এটা পড়েন। পড়ার দরকার নাই, বল কি হয়েছে। সে বলল, এক দরিদ্র পরিবারের বউ ভাত বেশি খেত, এজন্য স্বামী মারত। আরেকদিন স্বামী শ্বশুর মিলে মারতে মারতে মেরেই ফেলেছে। তারপর সে রুক্ষ ভাষায় আমাকে এমনভাবে জেরা শুরু করল যেন হত্যাটা আমিই করেছি। মনটা তেতো হয়ে গেল। আসলাম একটু আলিংগনের জন্য। অথচ সে একটা অনাহুত বিষয়ের জন্য যেন আমাকেই দায়ী করল। ভাবগতিকে মনে হচ্ছে মেয়েটা পুরুষ বিদ্বেষী, একি আরেক তাসলিমা নাসরিন নাকি?
একদিন বললাম তোমাদের মানুষ গুলি বোকা। বিয়ে হয়ে গেল, অথচ তারা তোমার সাথে আমার সাক্ষাতের সুযোগটাও দেয়নি। আবার তোমার অসুখের কথা না জেনেই তারীখ দিল আর আমাকে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হল, তাহলে তারীখটা এক সপ্তাহ পড়ে দিলেই হত। নতুন বউ চোখ পাকিয়ে আমাকে বলে বেয়াদব। নতুন জামাই হয়ে বড় জ্যাটাস ও দুলা ভাইদের বোকা বলি কেমনে, আমি লেখা-পড়া শিখেছি কিন্তু আদব কায়দা শিখিনি। আদব শিখে বড়দের সম্পর্কে কথা বলার উপদেশ দিল। এরপর মুখে খই ফুটতে লাগল। নতুন বউয়ের নতুন প্যাদানি খেয়ে ভালই জব্দ হলাম, মনে হল আমি একটা উকিল বিয়ে করেছি।
মানুষের সচেতন ও অবচেতন মন অনেক সময় সাংঘর্ষিক অবস্থানে চলে যায় যা তখন আমার উপর প্রতিফলিত হচ্ছিল। আজীবন আমার রুচি ছিল উন্নত। যৌবনের সূচনা থেকেই কল্পনা ছিল আমার স্ত্রী হবে অতুলনীয় সুন্দরী ও মেধাবী। আর তজ্জন্য ধনী দরিদ্র আশরাফ আতরাফ কোন শর্ত ছিল না। কিন্তু বাস্তবে আমার স্ত্রী কিছুটা সুন্দরী হলেও প্রকৃত সুন্দরি ছিল না। সারা জীবন আমার মনের মন্দিরে জীবন সঙ্গীর জন্য যে সিংহাসন গড়ে তুলেছিলাম অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, সেখানে এমনকি এর ধারে কাছেও আমার স্ত্রীর কোন অস্তিত্ব নেই। আমার অবচেতন মন তাকে কোন ভাবেই গ্রহণ করছে না। আমি ভয় পেলাম এবং দুঃখিত হলাম। ভয় পেলাম এ জন্য যে, মন দিয়ে যাকে ভালবাসতে পারব না তাকে নিয়ে জীবন কাটাব কেমনে। আর দুঃখিত হলাম এ জন্য যে, এ মেয়েটি তো কোন অন্যায় করে নি, তাহলে কেন সে স্বামীর ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হবে। আর আমিই বা ভালবাসাহীন মরুময় এক রুক্ষ জীবন কেমনে কাটাব। বিয়ে তো হয়ে গেছে। এখন স্ত্রী বাদ দেয়া বা অন্যত্র বিয়ে করার চেয়ে বরং আমার আদর্শ ও পরিশুদ্ধ বিবেক মৃত্যুকেই সহজে আলিঙ্গন করবে।
মনটা আমার ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে। শুরু হয় সচেতন ও অবচেতন মনের সংঘাত। শুরু করি তাকে আপন করে নেয়ার কৃত্রিম প্রয়াস। কৃত্রিমই বলা যায় কারণ তার প্রতি আমার দেহের কিছুটা আকর্ষন থাকলেও মনের কোন আকর্ষণ ছিল না। এবার মন থেকে গ্রহণ করার প্রচেষ্টা শুরু করি। সর্বত্র তার উচ্চসিত প্রশংসা করতাম। কখনো তাকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে যাতে অন্যেরা না শুনতে পায় নিম্ন স্বরে গান গাইতাম- কে তুমি এলে গো আমার এই জীবনে, নতুন মানে ডাকব তোমায়, আমি যে শুধু এই জানি। যদি বউ সাঁজ গো, আরো সুন্দর লাগবে গো। এ জাতীয় প্রীতি ভালবাসা সম্পর্কিত গানের দু চার কলি করে গাইতাম, কারণ কোন গানই আমার সবটুকু জানা ছিল না।
কখনো বা তাকে শুনাতাম আমার ইয়াতিম জীবনের দুঃখ কষ্টের ইতিহাস। সে সব ঘটনা বলতে গিয়ে, মানুষের যুলুমের ফিরিস্তি তুলে ধরে কষ্টের আতিশয্যে কখনো ককিয়ে উঠতাম। তখন সে আমার দিকে বিষণ্ণ হয়ে তাকিয়ে থাকত। আমি মনে করতাম আমার ব্যথায় সে ব্যথিত। আর তখন গাইতাম- আমি তো আমার গল্প বলেছি, তুমি কেন কাঁদলে, এখনো অনেক রাত রয়েছে বাকী। এসব এ জন্যই বলতাম সে যেন আমার ব্যথায় ব্যথিত হয়ে যথার্থ জীবন সাথীরুপে গড়ে উঠে। আসলে আমি চাইছিলাম মনের মত করে তাকে গড়ে তুলতে। কিন্তু পরে বুঝেছিলাম এসব শুনে সে সহমর্মি হওয়া তো দুরের কথা বরং অবজ্ঞা করত। কারণ সে চাইত তার স্বামী হবে ফুল কুমার, চিনির পুতুল, কাঠালের কোষের মত নরম, দুধে আলতায় মিশানো গায়ের রং। এমন একজন হতভাগা তার স্বামী হবে কেন? ঠিক আরেকটা তসলিমা।
আবার কখনো তার উপর আমার পান্ডিত্য ঝাড়তাম। ছোট বেলা থেকেই জ্ঞান চর্চা করতাম। কোথাও কোন বই পেলেই গোগ্রাসে পড়া শুরু করতাম। এ জন্যই আমার মধ্যে একটা ব্যতিক্রমি অভিজ্ঞতা তৈরি হয়ে ছিল। এ বিষয়টা আমার স্ত্রীর উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল। কারণ সে শিক্ষিত পরিমণ্ডলের মেয়ে হলেও সে আমার নিকট যা পেত অন্য কোথাও জীবনে তা পায়নি। সঙ্গত কারণেই সে আমাকে পন্ডিত মনে করত। এ তিন প্রকার কর্ম কৌশলে তাকে নিজের মধ্যে ঢুকানোর নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম এবং তাকেও প্রভাবিত করার চেষ্টা করছিলাম। অধিকাংশ সময় সারা রাত গল্প গুজবে কেটে যেত।
প্রথমাবস্থায় সাজ গোজ করত না, সাদা মাটা পোশাকে কাজের মেয়ে সেজে থাকত, হয়ত ঢাকার কাজের মেয়েদের পোশাক এর চেয়েও ভাল, আমি বললেও সাজত না। একদিন এশার পর দরজা খুলতেই দেখি এক রাজকুমারী শাড়ি পড়ে সেজে গুজে বসে আছে। আসলে সে ছিল সেসব মেয়েদের অন্তর্ভুক্ত যারা না সাজলে পচা আর সাজলে ফুল কুমারীর মত দেখায়। আমার মনটা ভরে গেল, ঠিক বিয়ের রাত্রির বধুর মত দেখাচ্ছে। আমি বললাম বাসর রাতে নববধু স্বামীকে সেলাম করে কিন্তু তুমি তো কর নাই এখন কর, সে তা করল। তারপর থেকে প্রতি রাতেই নতুন বাসরের অভিনয় চলতে থাকল।
বিষয়: সাহিত্য
১৫৬৪ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
Click this link
মন্তব্য করতে লগইন করুন