চিঠি-৪ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে এক অনন্য ট্রাজেডি
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ২১ মে, ২০১৬, ১১:০৬:৩১ সকাল
বিয়ে হয়ে গেল আর আমাদেরকে বিদায় করে দেয়া হল। নিজের স্ত্রীকে একনজর দেখতেও দেয়া হল না। এটা ছিল তাদের প্রথম স্বৈরাচারিতা। বিয়ের পর একজন যুবক স্ত্রীকে কাছে না পাওয়া কতটা কষ্টকর, এটা তারা বুঝার প্রয়োজন বোধ করেনি। আমি কলেজ হোস্টেলে গিয়ে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম। সব শেষ, সব শেষ হয়ে গেল। সারা জীবন মনের মন্দিরে ময়ূর সিংহাসনে যার জন্য আসন পেতে রেখেছিলাম আজ তার ফয়সালা হয়ে গেল। এ দীর্ঘ সময় যে কান্না দমিয়ে রেখেছিলাম এবার তা বাঁধ ভাঙ্গল, বুকটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছিল। আমার রুমটি ছিল দোতলায় নিরিবিলি স্থানে, আশ পাশে কেউ থাকত না। মনে আছে দু’ঘন্টা পর্যন্ত পাগলের মত বিছানায় গড়াগড়ি দিচ্ছিলাম। আর অনুচ্চ কণ্ঠে আর্তনাদ করছিলাম আব্বা, আব্বা গো আপনি কোথায়, আমার কি হবে আব্বা, এই মেয়েকে নিয়ে আমি জীবনেও সুখি হতে পারব না। সারা জীবন কষ্টের এই বুঝি প্রতিদান পেলাম, কী হবে আমার ? মন চাইছিল আম্মাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদি। দুঃখের সময় মা-বাবার কথাই মনে হয়।
সারা রাত ঘুম হল না। সকালে একটু ঘুমালাম। শুধু আব্বার কথা মনে পড়ত আর কাঁদতাম। নিশ্চয় বাবা থাকলে এ অবস্থা হত না। না খেয়ে বিকাল পর্যন্ত এভাবেই বিছানায় পরে থাকলাম। গভীর ভাবে কেউ দেখলে বলত দু’বছর ধরে বিছানায় পড়ে থাকা আমাশয়ের রোগী। বিকাল বেলা তার পঞ্চম দুলা ভাই জহির এসে বিছানা থেকে তুলল, অনেক হাসি ঠাট্টার আলাপ করল। সে বলল, এভাবে নতুন বউ ফেলে রাখলে চলবে, যান কথা টথা বলে আসেন। তাকে দেখে আমার দুঃখ অনেকটা হালকা হয়ে এল। দাড়ি, টুপি, পাঞ্জাবী, পাগড়ী, ঠিক যেন ফেরেশতা, আমি এদের আত্মীয় হয়েছি এটাই আমার গর্ব, আনন্দে আমার বুকটা ভরে উঠে। মনকে শান্তনা দিতে লাগলাম, বউ যেমনই পেলাম, আত্মীয় তো পেলাম। স্ত্রী সম্পর্কে এই সিদ্ধান্তে পৌছলাম, সে যেমনই হউক আমার স্ত্রী, তাকে আপন করে নেয়াই আমার কর্তব্য ।
আসরের পর বিয়ে অনুষ্ঠানের ঘরটিতে গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ পর খাটের অপর প্রান্তে আরেক জন এসে বসল। আজীবন মেয়েদের সম্পর্কে ছিলাম ভয়ঙ্কর লাজুক। কোন দিন প্রয়োজন ছাড়া কোন মেয়ের সাথে কথা বলিনি। কিন্তু আজ ওটা কে, বসে আছে আমার সামনে। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা, এক পবিত্র অনুভূতি। আমার হৃদয় বীণার সবগুলি তার বেজে উঠল, বুকটা দুক পুক করছে। আমার জীবনসাথী, দেহের অংশ, ইহকাল পরকালের একমাত্র সহযাত্রি। দুজন খাটের দুপাশে বসা, কাছে ঘেঁষে বসা বা গায়ে হাত দেয়ার মত সাহস পেলাম না। নির্বাক বসে থাকা পীড়াদায়ক বিধায় বকবক শুরু করলাম। ছোট বেলা থেকে বাপ নাই, অনেক কষ্ট করেছি। তোমার কাছে একটু শান্তির আশ্রয় চাই। সজ্ঞানে কোনদিন তোমাকে কষ্ট দিব না। ইত্যাদি সারা জীবন কপচানো কমন কথা গুলোই মুখ থেকে বেরুল। কথা বলছিলাম আর ভাল করে দেখছিলাম। গতরাতের ভ্রম অনেকটা কেটে গেল, ফর্সা লম্বা, নাকের গঠন ও শুকনা এ দুটি ছাড়া সব ঠিকই আছে। কিছুক্ষণ কথা বলে চলে গেলাম।
তাদের বোনদের সিদ্ধান্ত হল, সর্ব কনিস্ট বোন, অনুষ্ঠান ব্যতীত ঘরে দিবে না। পরের সপ্তাহের সোমবার অনুষ্ঠানের তারিখ ধার্য্য হল। তাদের কর্তা হল বড় বোন যাকে আমরা সবাই বড়াপা বলে ডাকতাম। তিনি বলে পাঠালেন বাড়িতে গিয়ে কিছু টাকা নিয়ে আসতে আর আত্মীয়দের অনুষ্ঠানের দাওয়াত দিয়ে আসতে। সাদা মাটা সহজ সরল পরিবার। অলংকার কে কী দিবে আলাপের প্রয়োজন হয়নি। তারা গলা কান দিয়েছিল আমাকে হাতের বালাটা বানাতে বলেছিল। যহির বলল, আগামি কাল দুপুরে আসেন এক সাথেই চলে যাব।
পরদিন দুপুরে গেলাম, সে বলল, যান বউয়ের সাথে দেখা করে বিদায় নিয়ে আসেন। গিয়ে বসলাম আগের রুমটিতে। এবার নিজেকে মৃদু তিরস্কার করলাম, ধুত্তুরি ছাই, আমি কি ছাগল না পাগল নাকি কাপুরুষ। মানুষ রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে মেয়েদেরকে কত কিছু করে ফেলে আর আমি এখনো নিজের বউকে একটু আদরও করতে পারলাম না, আচ্ছা এবার হবে খেলা। এটুকুর জন্য আমাকে বসে বসে হিমালয় জয়ের সাহস অর্জন করতে হল। সে এসে খাটের এক প্রান্তে বসল আমি অপর প্রান্তে বসা। কোন কথা না বলে ধীরে ধীরে কাছে ঘেঁষতে লাগলাম, সেও সরতে সরতে খাটের প্রান্তে গিয়ে ঠেকল। আত্না ধুক-পুক করছে বটে কিন্তু ধরে ফেললাম। সাথে সাথে সে অসহায় হয়ে মৃদু আর্তনাদ করে বিছানায় গা ছেড়ে দিল। টেনে তুলে আবার ধরলাম, এবার আমার কাঁধে ঘাড় ছেড়ে দিল, জামায় লিপিস্টিকের দাগ লেগে গেল। এই প্রথম স্ত্রীর প্রতি কিছুটা মনের টান ও ভালবাসা অনুভব করছিলাম। বিয়ের পর সাধারণত মেয়েদের যা হয়, না খেয়ে আধ মরা হয়ে থাকা। মুখটা মলিন দেখাচ্ছে, মায়া হল, বললাম, কিছু খাওনি মুখটা শুকিয়ে গেছে, আমি খাইয়ে দেই ? বলল, না। কথাটা সম্ভবত নরম স্বরেই বলতে চেয়েছিল কিন্তু অপ্রতিভ হওয়ার কারণে কর্কশ স্বরে বেরিয়ে গেছে। মনে হল সে যেন আমাকে গালি দিল, নিশ্চয় এ মেয়ের অন্যত্র সম্পর্ক আছে। ওদিকে তার অবস্থা হল ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। ছেড়ে দিলাম, অমনি ভিতা হরিনির মত দৌড়ে পাশের রুমে পালাল। কিন্তু আমার নীতি হল, নিজে কষ্ট পাই অন্যকে কষ্ট দেই না। এ মেয়ে যদি নটি-বেশ্যাও হয় তবুও সে আমার স্ত্রী, আমি স্বেচ্ছায় কখনো কষ্ট দিব না।
জহিরের সাথে বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। কারণ তাদের বাড়ি আমাদের বাড়ির কাছাকাছি ছিল। খেয়া ঘাটের কাছে গিয়ে আলাপে আলাপে তাকে বললাম আপনার শ্যালিকাকে কতটুকু সুখি করতে পারব জানি না, তবে ভালবাসায় মমতায় তার জীবনটা ভরে দিতে পারব। সে বলল, খুলনার দুলা ভাইয়ের সাথে পারবেন না। আপা অসুস্থ হলে সে রেধে খাওয়ায়। আমি মুখে কিছু না বলে মনে মনে বললাম অসুস্থ বউকে রেধে খাওয়ানো এটা বড় কী হল। বাড়িতে চলে গেলাম।
নিজের ভবিষ্যৎ চিন্তায় একটা সপ্তাহ জীবন মৃত অবস্থায় পড়ে থাকলাম। একে তো বউ পসন্দ হয়নি, তার উপর মনে হচ্ছে মেয়েটির অন্যত্র সম্পর্ক আছে। এমন বউ দিয়ে আমি কী করব, ওকে নিয়ে কিভাবে জীবন কাটাব। নিজেকে অভিশপ্ত ঢেকে, জীবন মৃত্যুর পাল্লা সমান সমান মনে হয়। জামালপুরের দিকে পা অগ্রসর হয় না, বিবেক দেহটাকে ঠেলে ঠেলে অগ্রসর করে। বিয়ে তো হয়ে গেছে, অন্তত আমার পক্ষে মেয়েটির তো ক্ষতি করা সম্ভব নয়। মরিয়া হয়ে আল্লাহ্র কাছে দোয়া করি, স্ত্রীর প্রতি আমার মনে ভালবাসা পয়দা করে দাও, ওর জন্য আমাকে মজনু বানিয়ে দাও। সার্বক্ষনিক চলতে ফিরতে উঠতে বসতে শুইতে পাগলের ন্যায় তাসবীহ জপার মত এভাবে দোয়া করতে থাকি। আসলে বিয়ের রাতেই বউকে আমার হাতে দিয়ে দিলে এতসব বৃথা যন্ত্রনা ভোগ করতে হত না।
সোমবার যথারীতি অনুষ্ঠানের পর ঘরে গেলাম। নানি শাশুড়ি নব বধুকে নিয়ে আসল। দেখে আমার মনটা ভরে উঠল। বিয়ের শাড়ি পরনে, তার এক লন্ডনি খালা তখন দেশে ছিলেন, তিনি ফুল চন্দন দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছেন, নব বধুকে অপরুপ দেখা যাচ্ছে। শাড়িটা পাল্টানোর কথা বলে এস্তেঞ্জা সারতে বাইরে গেলাম। বাইরে যহির বলল, রেড সিগন্যাল, সাবধান, আমি বুঝলাম না। কনিস্ট দুলাভাই বুঝিয়ে বলল। জানতে ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে গেলাম, ফুল চন্দন ধোয়ে শাড়ি খুলে সাধারণ পোশাক পড়ে বসে আছে। আর এরা অতি ধার্মিক হওয়ার কারণে চকচকে কাপড় পড়ত না, কম মূল্যের গজ কাপড়ে বানানো সাধারণ পোশাক পড়ত। মনে হল একটা কাজের মেয়ে বসে আছে। আবার তাকে সন্দেহ হল, কারণ বিয়েতে রাজি থাকলে সে এভাবে নব বধুর চিহ্ন মুছে ফেলল কেন। অসুখের কথা বলল হ্যাঁ। মনটা ভেঙ্গে গেল। থাকলে সমস্যা হতে পারে ভেবে তাকে বললাম তাহলে আমি হোস্টেলে চলে যাই। সে কেঁদে উঠে আমার হাত ধরে ফেলল এবং বলল, আপনি বলেছেন আমাকে কোন দিন কষ্ট দিবেন না। আহ এটুকু কথায় আমার মনটা পানি হয়ে গেল, স্ত্রীর প্রতি মমতায় হৃদয়টা কানায় কানায় ভরে উঠল। থাকলাম। তবে একটু সমস্যা হয়েছিল, যার দরুন ফজরের নামায পড়তে পারিনি। আর এটাই পরবর্তিতে মহীরুহ রূপ ধারণ করে মহাবিপত্তির কারণ হয়েছিল।
এদের পরিবারস্ত লোকেরা যে কতটা আহাম্মক আর অপরিনামদর্শি সেদিন প্রথম বুঝেছিলাম। বিয়ে হয়ে গেল অথচ সাতদিন পর অনুষ্ঠান। আর মেয়ের অসুখ কবে তা না জেনেই তারা অনুষ্ঠানের তারীখ দিল। ফলে আমাকে পনের দিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এভাবেই পনের বছর বয়সে যে ভিসুভিয়াসের যন্ত্রনা নিয়ে পৃথিবীর পথে হাঁটতে শুরু করে ছিলাম এখানে পৌঁছে তখন নতুন কষ্টের অভিষেক হল মাত্র।
বিষয়: সাহিত্য
১৬৫৭ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন