চিঠি- ২ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে এক অনন্য ট্রাজেডি)

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১৯ মে, ২০১৬, ১০:৫৮:২২ সকাল

কারণ গ্রামীন পরিবেশ, সাধারণত অশিক্ষিত দরিদ্র জনগোস্টির বাস। আর গ্রামীন সমাজ যে কত কুৎসিত হতে পারে তা ভোক্ত ভোগিরা হারে হারে টের পায়। তাছাড়াও সেখানে ছিল আত্মীয় নামের কিছু বিচ্ছু। তাদের লক্ষ ছিল আমাদের অভিভাবকহীন সচ্ছল পরিবারটিকে লোটে পোটে চেটে চোটে খাওয়া। আমি অর্ধেক জমি নিজের চাষে রাখতাম আর বাকী অর্ধেক বর্গা চাষে দিয়ে দিতাম। কিন্তু বর্গা চাষীরা খুব ভোরে গরুকে আল- এর ঘাস খাওয়ানোর নামে ধান খাওয়াত। আর দিনের বেলা অর্ধেক খাওয়া ধান গোড়া থেকে কেটে এনে গো-খাদ্যের চাহিদা মিটাত। এভাবে প্রত্যেক ক্ষেতের চতুর্প্বাশে অর্ধেক ধান কেটে নিয়ে যেত। আবার ফসল কাটার সময় ধানের আটি চুরি করে নিয়ে যেত। অবশিষ্ট ধান মাড়াই করে বন্টনের সময়ও চুরি করত। আমি কাছে না থাকলে তারা চুরির উৎসব ফেলে দিত।

আবার বিলে মান্দার ছিল। সেই মান্দার রক্ষনা বেক্ষন ও সেচ দিয়ে মাছ ধরার জন্য বর্গা বা অর্ধেক ভাগে দিতে হত। সে সব মান্দারে প্রচুর মাছ থাকত। এমনকি কোন কোন মান্দারে রকমারি জাতের ৫০ খাচা পর্যন্ত মাছ পাওয়া যেত। এসব মান্দারের জন্য প্রচুর গাছের ডাল দিতে হত। কিন্তু বর্গাদার রাতের বেলা মান্দারের মুখ আটকিয়ে ডাল তুলে জাল দিয়ে চেকে সব মাছ তুলে নিয়ে বিক্রি করত। তাতে প্রচুর টাকা পেত। অথচ আমি টেরও পেতাম না।

দুয়েকজন বছুরে কামলা সব সময় থাকত। এগুলি ছিল বজ্জাতের হাড্ডি। এরা গরুগুলিকে পর্যন্ত ঠিক মত খাবার দিত না। ছোট কোন কাজে সারাদিন কাটিয়ে দিত, দিন নেই রাত নেই সুযোগ পেলেই তাসের আড্ডায় বসে থাকত। এরা সংসারের সব কিছু দেখে শুনে সংরক্ষণ করা তো দুরের কথা সুযোগ পেলেই চুরি করত। বিশেষতঃ ধান কাটার মৌসুমে তাদের চুরির উৎসব পরে যেত। তাছাড়া আম, কাঁঠাল, সুপারি ইত্যাদি মৌসুমি ফল ফসল সর্বদাই চুরি করে বেচত। যেহেতু পরিবারে বড় কোন কর্তা ছিল না তাই কামলারাই নিজেদেরকে কর্তা মনে করত আর যাচ্ছে তাই করত।

আব্বার ইন্তেকালের সময় আমার বয়স ১৫ বছর আর বাকী ভায়েরা সবাই ছোট। আমরা সবাই লেখা পড়ায় ব্যস্ত থাকতাম। ক্ষেত খামার ফল ফসল সব সময় দেখ বাল করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এজন্য আমাদের সংসারটাকে মগের মুল্লুক মনে করা হত এবং সেখানে চুরি করা, লোট-পাট করা নিজেদের অধিকারের শামিল মনে করত। অত্যাচার নির্যাতনের সীমা এতদুর পর্যন্ত গড়িয়ে ছিল যে, কোন শত্রুও সাধারণত গাছ নষ্ট করে না। কিন্তু আমার এখনো মনে আছে, বাড়ির পিছনে রাস্তার ধারে যে দুইটা আম গাছ দেখা যায়, সেখানে আমি ত্রিশটা গাছ লাগিয়েছিলাম। কিন্তু আত্মীয়দের মধ্যে এমন শত্রুও ছিল যারা আমাদের পরিবারের কোন ভাল সহ্য করত না। এরা ছোট ছোট গাছগুলির কাণ্ড ভেঙ্গে দিত। আবার শাখা গজাত, আবার ভাঙ্গত। এভাবে অবশেষে দশটি গাছ টিকে গিয়েছিল। কিন্তু একদিন দুপুর বেলা দেখলাম, গাছগুলি খাড়াই আছে কিন্তু পাতা নেতিয়ে পড়েছে, সোটা (শুকিয়ে যাওয়া) হয়ে যাচ্ছে। অবাক হয়ে একটা গাছ ধরে টান দিলাম আর সাথে সাথে গাছটি এক ইঞ্চি মাটির নিচ থেকে উঠে এল। দুঃখে কলজেটা ফেটে গেল, কাঁদতে কাঁদতে লক্ষ করলাম কোদাল বা খুন্তি দিয়ে ইঞ্চি খানিক মাটির নীচে আটটি চারা গাছের মূল কেটে দিয়েছে-যাতে সহজে বুঝা না যায়। মানুষের অত্যাচারে সেদিন অনেক কেঁদেছিলাম।

একইভাবে বাড়ির সামনে চল্লিশটি কাঁঠাল গাছ লাগিয়েছিলাম। কিন্তু সেগুলি ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে অবশেষে চারটি গাছ টিকেছিল, এখন সেগুলোতে কাঁঠাল ধরে। আমাদের বাড়িটা পাঁচ একর জমির ঠিক মাঝখানে অবস্থিত। আমি চেয়েছিলাম এর চতুর্দিকে এবং প্রত্যেক আলে বিভিন্ন ফল ফলাদির গাছ লাগিয়ে একটা বাগান বাড়িতে পরিনত করব। সে হিসাবে দু’হাত অন্তর অন্তর সুপারি এবং অন্যান্য প্রচুর ফলের গাছ লাগিয়েছিলাম কিন্তু শত্রুরা তা হতে দেয়নি। সুপারির চারাগুলি উপড়ে ফেলে দিত অথবা নিয়ে যেত আর ফলের চারাগুলি মাঝখানে বা গোড়ায় ভেঙ্গে ফেলে দিত। মানুষের অত্যাচারে মনটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যেত, কেঁদে কেঁদে আল্লাহ্‌র দরবারে ফরিয়াদ জানাতাম।

প্রবাদ আছে কিছু আত্মীয় হয় বিচ্ছুর মত। গোস্টির কিছু লোক ছিল এই শ্রেণীর যারা আমাদের পরিবারের ধ্বংস কামনা করত এবং লোট পাট করে খাওয়ার ধান্ধায় থাকত। গ্রামাঞ্চলে অনেক ক্ষেত্রেই এমনটা দেখা যায়। তাছাড়া গ্রামটি ছিল অশিক্ষিত আর অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র। এজন্যই এরা ছিল অকাট মূর্খ। একটা ইয়াতিম পরিবারের সাথে কেমন আচরণ করতে হবে সে জ্ঞান তাদের ছিল না। এদের প্রকৃতি ছিল শক্তের ভক্ত নরমের যম। তাদের অধিকাংশ অবশ্য বলে কয়েই আমাদের পরিবার থেকে নিজেদের চাহিদা পূরণ করত, কিন্তু কিছু লোক এমন ছিল যে, কয়টা আম, কয়টা কাঁঠাল, কয়টা সুপারি বা অন্য কোন জিনিস যেগুলি তারা চাইলেই পেতে পারত কিন্তু তারা চাইত না, চুরি করে নিয়ে যেত। চুরির মালে তারা আনন্দ পেত বেশি। এভাবে আপন জন ও প্রতিবেশীদের অত্যাচারে অত্যাচারে জীবনটা বিষিয়ে উঠল।

কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দিলাম। ক্রমে ক্রমে আমার এ বিশ্বাস জন্মিল এই মুর্খ জালিম জনপদে আমার বসবাস চলবে না। তাই শত প্রতিকূলতার মাঝেও নিজের লেখা পড়া চালিয়ে গেলাম।

বিখ্যাত আলেমের সন্তান হিসাবে মাদরাসা থেকে লেখা পড়া শুরু হলেও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সুযোগ হাত ছাড়া করলাম না। ছাত্র হিসাবে মন্দ ছিলাম না। এজন্য সংসার সিন্দুতে নিমজ্বিত থেকেও লেখা পড়া চালিয়ে যেতে কোন সমস্যা হয় নি। বাবা না থাকার কারণে ছোট ভাই বোনদের ব্যাপারে ছিলাম সর্বোচ্চ সচেতন। তাদের কোন আশা আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ রাখিনি। আপত্য স্নেহে তাদের লালন পালন করেছি। বাবার অনুপস্থিতি তারা যেন কোন ভাবেই টের না পায় সে জন্য সর্বদাই প্রানান্তকর চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাদের লেখা পড়ার বিষয়ে ছিলাম অতিশয় কঠোর, কোন ছাড় দিতাম না। আমি নিজেই তাদেরকে সকালে ও রাত্রে পড়াতাম, কোন প্রাইভেট টিউশনির দরকার পরত না। এইভাবে পতনন্মোখ একটি পরিবারকে সম্মনজনক অবস্থানে পৌছাতে সক্ষম হয়ছিলাম এটাই আমার গর্ব, এতেই আত্মতৃপ্তি।

লোকজনের অত্যাচারে নিজের গ্রামের প্রতি বিতৃঞ্চা ধরে গিয়েছিল। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, দেশের কোথাও না কোথাও একটা চাকরি বাকরি জুটিয়ে সেখানেই স্থায়ী বসত গড়ে তুলব, এ জালিম জনপদে আর কোনদিন আসব না। এভাবে কল্পনায় এক স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলেছিলাম, স্বপ্নে সেখানে নির্মাণ করেছিলাম এক শীষমহল। যে শীষমহলে আছে এক রাজকুমারী। সংসার যাতনায় ক্লিষ্ট এক যুবক স্বপ্ন দেখে তার স্ত্রী হবে রাজকুমারীর মত নিখুত সুন্দরী, যার কোলে মাথা রেখে তার অতীত জীবনের সকল যন্ত্রনা ভুলে যাবে। সে তার বুকে মাথা রেখে বলবে জীবন আমার, আমার আজন্ম সাধনার ধন, এই পাথরের পৃথিবীতে আঘাতে আঘাতে আমি জর্জরিত, পৃথিবীর কন্টকাকীর্ণ পথে চলতে চলতে আমি রক্তাক্ত, পৃথিবী পথের কাটা ঝোপ ঝাড়ে আমার দেহ ক্ষত বিক্ষত। পরমাত্মা আমার, একটু শান্তির আশায়, একটু আশ্রয়ের আশায় হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথে পথে আমি তোমায় খুঁজে মরছি। তোমার খোঁজে- হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে, সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে, অনেক খুঁজেছি আমি, বিম্বিসার অশোকের ধুসর জগতে (বনলতা সেন)। অবশেষে কত উষর মরু পেরিয়ে, কত মরু বিয়াবন ছাড়িয়ে, কত বন জঙ্গল মাঠ ঘাট মাড়িয়ে, সাত সমুদ্দুর তের নদী পেরিয়ে তোমাকে পেলাম। চিরসাথী আমার, আমায় ধর, তোমার নরম বক্ষে আমার মাথাটা চেপে ধর, এ পোড়া কপালটায় হাত বুলিয়ে দাও। জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া এ বুকটায় তোমার মাথা রাখ। আমায় একটু আদর কর, অনেক আদর, অনেক। আদরে আদরে আমায় সেনান করিয়ে দাও, আমার আজন্মের দুঃখ, বেদনা, ব্যথা, যন্ত্রণা তোমার ভালবাসার তরলে ধুইয়ে মুছে সাফেদ করে দাও। তোমার বুকের মধ্যে আমাকে লুকিয়ে রাখ, পৃথিবী যেন আমাকে খুঁজে না পায়। কারণ আমি পৃথিবী আর পৃথিবীর মানুষকে ভয় পাই।

এই ভাবে যে বালক তিল তিল করে মানুষের যাতনা আর সংসারের যন্ত্রনা সইতে সইতে যৌবনে পদার্পন করেছে, উগ্র, ডানপিটে ও অবাধ্য প্রকৃতির পাঁচটি ভাইকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হাফিয়ে উঠেছে- সে কল্পনায় তার স্বপ্নের বাসর রচনা করে। যেখানে স্ত্রী তার জীবনের সকল যন্ত্রনা ভুলিয়ে দিবে, সে হবে একান্তই তার, আর সেও হবে একান্তই স্ত্রীর। দুজন শুধুই দুজনার, অন্য কেউ নেই। সুন্দর ছিমছাম গোছানো একটি সংসার, সন্তান, এই হবে তার সুখের ঠিকানা। সে বাহিরে থাকবে, স্ত্রী তার পথের পানে তাকিয়ে থাকবে, সেও প্রতিক্ষার প্রহর গুনবে, তারপর অধির হয়ে ঘরে ছোটে আসবে, স্ত্রী তাকে আদরে আদরে ভালবাসায় জীবন কানায় কানায় ভরিয়ে দেবে। এভাবে তার অতীত জীবনের সকল দুঃখ কষ্ট গ্লানি স্ত্রী থেকে পুষিয়ে নেবে। এখন এটাই তার একমাত্র স্বপ্ন এবং লক্ষ।

এক সময় লেখা পড়া শেষ করে জামালপুরে একটা কলেজে ঢুকলাম, বিয়ে করলাম। আর তারপরই শুরু হল আমার জীবনের নতুন অধ্যায়, অভিশপ্ত অধ্যায়। হায়, কোথায় স্বপ্ন আর কোথায় বাস্তবতা, সুদূর পরাহত।

বিষয়: সাহিত্য

১২৫৩ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

369583
১৯ মে ২০১৬ দুপুর ০৩:২২
দুষ্টু পোলা লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ পিলাচ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File